• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৬ | মার্চ ২০১৭ | কবিতা
    Share
  • গুচ্ছকবিতা : সুমিত নাগ


    হলোকাস্ট

    রৌদ্র ছেড়ে যায় দগ্ধ দিন
    বিবর্ণ শ্যাওলা ভাসে
    মায়াপুকুরে। নির্জন, নির্জীব, অবসন্ন দখিন
    হাওয়া আচমকা এলোমেলো, খেলা করে ছেঁড়া প্লাস্টিক উড়িয়ে
    অদৃশ্য কান্নার শব্দ লেগে থাকে ঘাসে
    শিহরিত করে যায় বিষণ্ণ হৃদয় আরো
    গোধূলির আকাশের ভস্মীভূত কুড়িয়ে কুড়িয়ে
    সন্ধ্যা নামে, পরিযায়ী পাখিরা প্রত্যক্ষ করে এ-প্রহর,
    পালাতে পালাতে তারা দেখে, গলিতে-ঘুঁজিতে হলোকাস্ট আবারও;
    পুকুরের জলে ভেসে ওঠে ব্যাঙ--স্ফীতোদর, উল্টানো, নিথর।


    কুয়াশা

    কুয়াশায় ঝরে পড়ে হলুদ পাতারা
    মৃদু মৃদু কাঁপে রোঁয়া থরথর
    রোদে ডুবে ভিজে গেছে মলিন ছাতা-রা
    ছাতার নিচেতে শীত দুর্মর।

    ক্রিস্টমাস। মেঘহীন আকাশেতে পাখিরা
    খেলা করে গোধূলিতে একা, নিঃসঙ্গ
    মূর্ছনা এ-সুরের, কেঁদে মরে, বাকিরা
    খসে পড়ে ভূমিতেই, ভ্রষ্ট সারঙ্গ

    তারা স্বর্গোদ্যানহীন, মানুষের অন্তরে
    ঘুরেফিরে ঘাস খায়, গান গায়, ব্যর্থ
    পাখা মেলে ওড়ে জনহীন, কুয়াশার প্রান্তরে
    ঝ’রে যায়; সেইসব পাতারা সবার তো

    খেয়াল রাখেনি কোনোদিন, তারা ব্যস্ত
    নিজেদের ঝ’রে পড়া নিয়ে চিরকাল--
    ঝরেছে তো ঝরেছেই এভাবে সমস্ত
    রাত্রি নিশীথ, ভেজা-কুয়াশা সকাল।

    এবং ছাতা-রা সেই, যারা মুখ নিচু ক’রে
    বসে আছে বুকে ঢেকে অনন্ত শীত
    তারা কাঁপে থরথর, পাতা ঝরে, পড়ে ঝ’রে
    তাদের-ও গান আজ সাধনা-অতীত।


    তন্ময়তা

    কাকচক্ষু জল থেমে আছে মেঠোপাড়ের আঁচলে
    জলজ শ্যাওলা থেমে আছে হলুদ মাছের ঠোঁটে
    হলুদ মাছ বুদবুদ ছাড়তে ছাড়তে থেমে আছে পাঁকের আলিঙ্গনে
    পাঁকের আলিঙ্গনে থেমে আছে জলের ঘূর্ণন
    জলের ঘূর্ণন থেমে আছে মাটির গভীরে

    আমি সমস্ত থেমে যাওয়া দেখি
    স্পন্দনহীন সমস্ত আকাশ, ফুটে আছে চিত্রিত মেঘ, আলো, সুর--
    তারপরই, ভুল করে, ছোট্ট একটা ঢিল
    অজান্তে ছুঁড়ে ফেলি
    দীঘির কাকচক্ষু দর্পণে।

    হলুদ মাছ সোনালি কাক হয়ে
    ‘কা কা কা’ ডাকে উড়ে গেল
    বৃন্তচ্যুত শুকনো পাতা খসে পড়ল
    হাওয়ায়
    ভাসতে ভাসতে
    ধীরে ধীরে

    আচমকা শুরু হল পৃথিবীর ঘূর্ণন

    আর কোনখানে, গোপনে-অজান্তে, একটি গোলাপ কুঁড়ি ধীরে ধীরে ফুটে ফুটে উঠছে...


    সামান্য, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ

    ছায়ায় আশ্রয় দাও--বড় বেশি দৃশ্যমান
    হয়েছি হঠাৎ আজ; লুকোনো সমস্ত গান
    মুঠো খুলে, দেহ ভেঙে আপনি হারিয়ে
    যায়--এই নারিকেল-সারি, শাখাগুচ্ছ জীর্ণ বটের নাড়িয়ে
    বেলুনের মতন আকাশে--
    হাজার হাজার রোদ ফুটে থাকে ঘাসে
    হাজার হাজার রং ছায়াপথে ধীরে ধীরে ফোটে
    হাজার হাজার কলতান পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে
    পড়েছে ছড়িয়ে--আমাকে ক্রমশ নিঃস্ব, নিঃস্ব ক’রে
    বেদনায় ও উৎসবে নিমগ্ন নীরব এই-শীতল প্রহরে
    তারা ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র হয়ে মিশে থাকে, সহজে মিলিয়ে যায়
    মহাশূন্যে; নিষ্ঠুর, উদার, মুক্ত ঐ খাঁচায়।

    আমি শুধু তাদের নিয়ত চলে যাওয়া দেখি--
    ভারশূন্য শরীরে হব না প্রবেশ্য আমিও কি
    এভাবেই কোনোদিন, আলোক-মালার সে-শহরে?
    ক্রমশ সামান্য হয়ে, ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে, ক্রমে তুচ্ছ, ক্ষুদ্র হয়ে, অশেষ বিবরে?


    তোমার হলুদ রঙের জামাটা, কলারটা নেভি ব্লু

    ‘তিরিশটা রুপোর মুদ্রা তোমার জন্য রেখে গেলাম--’

    সময় নষ্ট করার সন্ধে এলো আবার
    সমুদ্র, পাতা ভিজিয়ে যায়, নোনা হাওয়া--
    সেই যে সে ফিরে এলো অন্য কেউ হয়ে,
    তাতে আমি তোমাকে দোষ দিই না!

    জলের ধারে তোমার সেই বাড়িটা
    এখনও আছে? সেখানে সে কি যায়?
    সেখান থেকেই ফিরে এলো অন্য কেউ হয়ে
    তাতে আমি তোমাকে দোষ দিই না!

    তোমার হলুদ রঙের জামাটা, কলারটা নেভি ব্লু
    বেশ লাগত তোমায়, গালে দাড়ি, অবিন্যস্ত চুলে--
    তোমার কবিতাগুলো তোমার মতই প্রেমিক
    তোমার গলার স্বরেও ইতস্তত লাজুক ভঙ্গিমা
    কার না ভাল লাগে, লাগবে না কেন তার?
    তাই বুঝি সে, সেই যে চলে গেল
    আর তো কই, আর তো ফিরে এলো না,
    হয়ত এলো, অন্য কেউ, অন্য কেউ হয়ে
    আর তো কই আমার সে তো হল না!

    এখনও আমি তোমার কবিতা পড়ি
    আরও বেশি পড়তে ইচ্ছে করে
    সে হয়ত তোমার কথাই ভাবে বা ভাবে না
    তুমি হয়ত তারই কথা ভাবো বা ভাবো না
    তোমার জলের ধারের বাড়িটা, আমি আবার তাকে
    সেখানে নিয়ে
    যাব কিনা যাব না--স্থির করতে পারিনি!
    আর তোমার হলুদ রঙের জামাটা, কলারটা নেভি ব্লু
    হয়ত এখন রঙটা কিছু ফিকে হয়েই গেছে,
    তবুও সেটা পতপত করে ওড়ে
    আমার ও তার
    সীমানার
    কাঁটাতারের মাঝে

    সময় নষ্ট করার সন্ধে এলো আবার
    নোনাজল পাতা ভিজিয়ে দেয়, ছেঁড়া হাওয়া--

    নেমে যাব
    যাবার আগে
    ‘তিরিশটা রুপোর মুদ্রা আমি তোমার জন্য রেখে গেলাম।’


    জানোয়ার

    তার ভিতরে একটি হরিণ আছে
    সে রোজ গিয়েছে ঝরনা-জলের কাছে
    অরণ্যে তার লুকিয়ে ঢেকে মুখ
    ঠোঁটে ধরে নরম ঘাসের বুক।

    তার ভিতরে একটি সারস আছে
    পুকুর জলে পা ডুবিয়ে নাচে
    কীসের ডাকে কীসের কী বিশ্বাসে
    হারিয়ে গেছে মগ্ন মেঘের পাশে।

    তার ভিতরে একটি আছে বাঘও
    ঝাপটে মারে হিংস্র সংরাগও
    আর কী আছে জন্তু যে কে জানে
    এমন তাকে হিঁচড়ে টেনে আনে।

    কেউই তবু পোষ মানেনি তার--
    হরিণ, সারস, মত্ত জানোয়ার
    কখনও বাঘ দাপায় শরীর জুড়ে
    হরিণ চরে বা সারস যায় উড়ে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ পৃথা কুণ্ডু
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments