গিয়েছিলাম ‘কুমার্’স-এ কিছু রং কিনতে। দেখে এলাম জীবনের ক্যানভাসে আঁকা প্রাণোচ্ছল এক বিক্রয় কেন্দ্র। বলছি শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের কথা।
‘ওলা’ ক্যাবে ওঠার আগেই শর্ত হয়ে গিয়েছিল নামব, রং কিনব আবার সেই ওলাতেই সল্ট লেক ঢুকে পড়ে তবে স্বস্তি। কিন্তু বাঁধা গরু ছাড়া পেলে এত সহজে কি আবার খুঁটিতে বাঁধা পড়ে? তার পালানোর ব্যবস্থা হয়েই যায়। ওলা মালিক অনুরোধ করলেন তাঁকে ছেড়ে দিতে যাতে আর এক যাত্রী পেয়ে যান। আমার হ’ল পোয়া বারো। যার রং চাই সে তো রং কিনতে ব্যস্ত, এই তালে আমার রথ দর্শন হয়ে গেল।
দেখলাম বিক্রেতা প্যাচপ্যাচে গরমে বরফ ঢাকা পাহাড়ের ছবি দেওয়া ভ্রমণ পত্রিকার ঠান্ডা আমেজে ডুবে আছেন। দোকান ছেড়ে হয়তো যাওয়া যাবে না কিন্তু মনে মনে কোথাও বেরিয়ে পড়তে বাধা কই! তাই বোধহয় এই পত্রিকার উজান বেয়ে ক্ষণিকের হারিয়ে যাওয়া। একাগ্রতা দেখে মনে পড়ে গেল অতি পরিচিত একজনের কথা যে ছেদ পড়ার ভয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে হ্যারি পটার পড়ত।
দৃষ্টি সরাতে চোখে পড়ল ছোট ছোট অসংখ্য ড্রয়ার দেওয়া দোকানের মাথা অব্দি ছুঁয়ে যাওয়া আলমারি, — রঙ তুলি ব্রাশে ভরা। আর প্রতি সেকেন্ডে নানান চাহিদা নিয়ে ক্রেতার আগমন যা সিদ্ধ হস্তে সামলাচ্ছেন বয়স্ক কর্মচারী।
রঙ তুলির দোকান ঘেঁষে অতি সরু একফালি মিষ্টির দোকান — সাইনবোর্ডের দাবি মালিকরাই প্রথম নলেন গুড়ে ভাসা রসগোল্লার প্রবর্তক। রসিয়ে, চেখে, খুঁটিয়ে দেখার আগেই কানে এল ‘মিষ্টি খাবে? না? তাহলে আর দাঁড়ানোর কি আছে? চলো চলো, অফিস ফেরতা ভিড় শুরু হলে বলে।’ খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা। তার ওপর কিছুদিন সল্ট লেকে থেকে ভিড়কে আরও ভয় করতে শিখে গেছি। আর বুদ্ধি তো বলেই ভিড়কে ভয় করাই উচিত যদি না পিষে মরতে চাও। কিন্তু হাঁ করে দেখার কিছু থাকলে যুক্তির সাথে প্রায়শই আমার আড়ি হয়ে যায়। তাছাড়া যে ভিড় চলমান তার রূপ যে অপরূপ তা মানতেই হয়।— অতএব--চলো ভিড়ে ভেসে যাই।
রাস্তার ওপারে, ‘কুমারস’-এর ঠিক কোনাকুনি হবেও বা, সেই রেস্তোঁরা, — জিভে জল এনে দেওয়া, কষামাংস-খ্যাত গোলবাড়ি। অরুচি মুখের টেস্টবাডদের চাঙ্গা করতে যার নাম এনজাইমের মত কাজ করে। খাবার টেবিলে হামলে পড়া খাদ্যরসিকদেরও দেখা গেল। কিন্ত আমার নেহাতই বাঙালি, ট্যালট্যালে মাছের ঝোল খাওয়া পেটে সইবে কি কালচে লাল কষা মাংস? তাই প্রস্থান না করা ছাড়া গতি নেই। তবে শ্যামবাজার থেকে শুধু মুখে প্রস্থান, —তাও কি হয়?
গোলবাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক কিশোর (বোধহয় ওখানকারই হোটেল বয়), আকাশপানে তাকিয়ে আছে, যেন ভিড়ের ও কেউ নয়ই। ওর ভাবে এক অদ্ভুত নির্বাণ—সারাদিনের ক্লান্তিই হয়তো। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘কাছাকাছি সিঙ্গাড়া কচুরির দোকান আছে?’ উত্তর পেলাম, ‘কেন ও ফুটেই তো আছে।’
রাস্তা পেরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজে এক অতি পুরনো ঘুপচি দোকানে ঢুকলাম লোভে লোভে। ভেসে গেল স্যানিটাইজার হাতে ঘষার চিন্তা। বসে পড়লাম ভূমিকম্পে চিড় ধরার মত ফাটা পাথরের টেবিলের পাশে লাগানো কালো হয়ে যাওয়া কাঠের বেঞ্চিতে। এল কলাপাতা — কি দিয়ে মোছা হল দেখিনি, ইচ্ছে করেই অন্যদিকে তাকিয়েছিলাম বোধহয়। এক প্রায় অন্ধকার খুপরিতে ভাজা হচ্ছে লুচি — পাঁচ টাকা পিস, সাথে খোসা শুদ্ধ আলুর লাল রঙের ঝোলঝোলে রসা। দেখেই মনে হল আহা বাড়ির ঝোল এমন হয় না তো! ভাবলাম দুটো খাই, খেলাম তিনটে করে, অনেক মনের জোরে লোভকে শাসন করে।
চারপাশে তাকিয়ে দেখি কমপক্ষে আটটা দশটা করে লুচি পড়ছে সব পাতে। খাদ্যরসিকদের মুখের দিকে চোখ পড়তে মনে হল যেন এক একটি পিকাসোর ব্লু পেন্টিং-এর যন্ত্রণাময় দোমড়ানো মোচড়ানো অভিব্যক্তি। কিন্তু লুচি আলুর রসায় আসক্তি?— মেলাই কেমন করে? এ যেন অদ্ভুত এক হাসিকান্নার মুখোমুখি বসে থাকা। জীবনের মারকে কলা দেখানোর এক জমাটি উপায়। খাওয়া সেরে পরে জেনেছিলাম দোকানটি অতি সাবেক হরিদাস মোদকের দোকান।
আনন্দ যদি কিনতে পাওয়া যেত তাহলে বলি মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকায় খরিদ করা এক অনাবিল সুখের সাথে যোগ করলাম গাড়ি বাসের ধুলোমাখা মাটির কোপটিতে চা।
রসনাতৃপ্তি বড় তৃপ্তি, মনটা ঠান্ডা হয়ে যায়, তাই বোধহয় ভাবলাম রাস্তা পেরিয়ে কালী দর্শন করে নিই। মন্দিরের পাশেই কবেকার কাঁসা পিতলের দোকান, — কাছেই ফুটপাথে বসে আছে চাবিওয়ালা। যেন বসে আছে তো আছেই (ওর কাছেই বোধহয় বছর দশেক আগে একবার চাবি বানাতে এসেছিলাম)। পাশ দিয়ে অবিশ্রান্ত মানুষের হেঁটে যাওয়া, কেনাকাটার মাঝে ও অবিচল।
সস্তার ছাতা, বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর, লাইটার, মোবাইল কেস, ঠাকুরের মালা, কুচো ফুল — সবই বিকোচ্ছে।
‘সস্তা’ শব্দটা পাল্টেই দিই, ওটা ব্যবহার করলে বোধহয় গণদেবতাকে ছোট করাই হবে — বরং বলি নিজের সাধ্যের মধ্যে কেনাকাটা করার এক সুন্দর বিপণি। মলে ঘুরে তো আমার বার বারই মনে হয়েছে আট হাজার টাকার ড্রেস কিনে দোব কন্যাকে তাহলে খাবটা কি? অবশ্য এটা আমার একান্তই নিজের ধারণা।
সেদিন আমার নিজের কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না, তাই যেন সব কিছু এত উজল হয়ে ধরা দিয়েছিল; কমলা লেবুর কমলা, মাটির ভাঁড়ের খয়েরি আরো ঘন গাঢ়, লুচি অনেক খাস্তা, চা আরো আরো জম্পেশ লেগেছিল।
অল্প সময়ের জন্য হলেও চারপশের অবিশ্রান্ত ব্যস্ত মানুষের ঢেউ যেন আমাকে ঘিরে নিল। মনে হল কই নড়ছে না তো! একেবারে যেন স্থির অবিচল। লাট্টু যেমন খুব জোরে ঘুরলে তার ঘোরা বোঝা যায় না অনেকটা তেমনই হবে। থেমে থাকা আর বয়ে যাওয়া ভিড়ের এই ভিতরের গানকে কুর্নিশ করে তৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরলাম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
অনন্যা দত্তের ছবির শীর্ষ ‘ভিড়ের গান’ ব্যবহারের জন্য।