নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর এবং বাদকুল্লার মাঝে একটি গ্রাম জালালখালি। অঞ্জনানদীর তীরে গড়ে ওঠা এই গ্রামেই বাস করেন বাউল কবি রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই খুব গরীব। জীবনধারণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হলেও এঁরা মন থেকে হারিয়ে যেতে দেন নি লোকসংস্কৃতির শেকড়। রমেন বাউল এমনই এক মানুষ যিনি পেশায় দরিদ্র কৃষিজীবী হয়েও স্বভাবে কবি। সংসারী হয়েও মনে-প্রাণে বাউল-সাধন পথের পথিক। বয়স ৬৮-র কাছাকাছি।
(১)ওরে আত্মতত্ত্ব পরম তথ্য,
বোদ (বোধ) হল না হবার কালে।
ও তোর দিনে দিনে দিন ফুরালো,
দিন ফুরালো কালের টানে।ঐ..............................
আসিয়া এই ভবের হাটে,
দিন কাটে তোর কামের ঘাটে।
পিতৃধন তোর গেল লাটে,
রং মেখে তুই সং সাজিলি।ঐ..............................
শৈশব গেল যৌবন গেল,
পঢ়ূহকাল সামনে এল।
ও তোর কাল শমনে ঘিরে নিলো,
কোনদিন দেবে গোরে ফেলে।ঐ..............................
ও চৈতন্য গুরুর নিয়ে জ্ঞান,
কামের ঘাটে দিয়ে বান্ধ,
রমেন তোমার হল না জ্ঞান।
জাহ্নবী কয় পাগলা ছেলে।ঐ..............................
ভাব সম্পুটঃ
কবি আত্মতত্ত্বের গানে পরম তথ্যকে খুঁজতে চেয়েছেন। বাউল বা বাউল জাতীয় সাধকদের এই সাধন প্রণালী সাধারণ মানুষ গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করতে না পারলেও নান্দনিক বোধের জায়গাটুকু ধরার চেষ্টা করতেই পারে। সত্যি তো মানুষের জীবন দিনে দিনে ফুরিয়েই যায়, কিন্তু আসল বোধ অধরাই থেকে যায়। যখন বোধ হবার ছিল তখন মানুষ ভুলে ছিল কালের টানে। শৈশব, যৌবন পেরিয়ে আসে প্রৌঢ় কাল। অতি সাধারণ, প্রথাগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই কবি জীবনের আসল কথাটা বলে দিয়েছেন -- "রং মেখে তুই সং সাজিলি''। গানের মাঝে এক জায়গায় তিনি 'কাল শমনের' অনুষঙ্গে মৃতদেহকে 'গোরে' ফেলার কথা বলেছেন। আজও যেখানে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা নিয়ে মাঝে মাঝেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, বাউল সাধকদের এই উদারতাবোধ মনের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। গানের শেষ স্তবকটিতে তিনি চৈতন্যকে গুরুরূপে দেখেছেন। মানুষের চাওয়ার কোনো শেষ নেই, তাই তিনি কামের ঘাটে বাঁধ দিতে বলেছেন।
টীকাঃ
ক) ভবের হাটে - এই পৃথিবীর জীবনকে হাটের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বাউল, বৈষ্ণব, সাহেবধনী--এসব সম্প্রদায়ের সাধকরা এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনকে হাট, বাজার, সম্পত্তি এইসব অর্থনৈতিক রূপকের মাধ্যমে ব্যবহার করেন।
খ) কামের ঘাট - কাম অর্থাৎ বাসনারূপ নদীতে বাঁধ দেওয়ার প্রসঙ্গে ঘাটের চিত্রকল্প এসেছে।
গ) পিতৃধন - ঈশ্বরকে পিতা মনে করে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সরাসরি সংযোগের বিষয়টিকে পিতৃধন বলা হয়েছে, যা মানুষ পার্থিব সম্পদের মোহে পড়ে হারিয়ে ফেলে।
ঘ) পঢ়ূহকাল - প্রৌঢ় কাল। 'প্রৌঢ়' শব্দটির 'র-কার' লোপ আর 'ঔ'-কার দু'ভাগ হয়ে পূর্বাংশ 'প'-এর সাথে 'অ'-কার হিসাবে যুক্ত হচ্ছে। উত্তরাংশ 'ঊ'-কার হয়ে 'ঢ়'-এ 'অ'-এর স্থানে বসেছে। 'ঢ়'-এর মহাপ্রাণতার প্রভাবে পৃ্থকভাবে 'হ'-কার 'আগম'রূপে যুক্ত হয়েছে।
ঙ) জাহ্নবী - গঙ্গার এক নাম জাহ্নবী। আবার বৈষ্ণব বাউলদের কাছে মাতৃরূপা জাহ্নবীদেবী (নিত্যানন্দের পত্নী)। এখানে সম্ভবত তাঁর কথাই বলা হয়েছে।
(২)সস্তা প্রেমের রাস্তা ও তুই খুঁজিস অনুক্ষণ।
ও তোর তিলে তিলে লাগল ভাঙ্গন কুল ভাঙ্গা তুফানে তোর।।ঐ..............................
গেলি না তুই সোনার দোকানে।
বহুরূপী কাঁচের ঝলক মন নিল কিনে।।
ও তুই সদায় (সদাই) ভ্রান্ত মন অশান্ত।
শ্রীগুরু চিনলিনা মন।।ঐ..............................
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য - এই ছয়,
তার ভিতরে কাম প্রধান সর্ব শাস্ত্রে কয়।
নিয়ে অটল মন্ত্র খাটায়ে তন্ত্র,
তীরের পরে বসগে মন।ঐ..............................
একুশ হাজার ছয়শত বার,
চলছে মানুষ নিরন্তর।
তার ভিতরে প্রাণ অপ্রাণ,
যোগ বুঝে তুই সাধন কর।
জাহ্নবী কয় কর্মকানা।
রমেন তুই ধরলি সং (সঙ্গ)।।ঐ..............................
ভাব সম্পুটঃ
এই গানটিতে কবি বাইরের চটক দেখে মোহিত হওয়ার থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন। মানুষ সোনার দোকানের অর্থাৎ আসল জিনিসের খোঁজ না করে সস্তার কাচের জিনিসের ঝলকেই মুগ্ধ হয়। এই ভ্রান্তির সঙ্গে এসে যোগ দেয় ষড়্-রিপু। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যেই রয়েছে প্রাণ-অপ্রাণের খেলা-- আর স্বরূপ বুঝে তবেই সাধন করা উচিত। তা না হলে 'কর্মকানা' হয়ে থাকতে হয়।
টীকাঃ
ক) তীরের পরে বস গে মন - বাউল-সাধনার দেহতত্ত্বে শরীরের তরল পদার্থের সংবহনকে নদীর সাথে তুলনা করা হয়। তীরে ওঠা বা সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছানো বলতে এই দেহজ সংবহনের জৈবিকতাকে অতিক্রম করার কথা বলা হচ্ছে।
খ) একুশ হাজার ছয় শতবার - সাধারণভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দিনে মোটামুটিভাবে একুশ হাজার প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস নেন এবং ত্যাগ করেন বলে মনে করা হয় (বিজ্ঞানের হিসেবে সংখ্যাটি কিছু বেশি হতে পারে)। এখানে এই নিরন্তর শ্বাস-প্রশ্বাসের কথাই বলা হয়েছে।
গ) প্রাণ-অপ্রাণ - প্রাণ বলতে জীবের প্রাণশক্তিকে বাউল, যোগী বা অন্যান্য সাধকরা যথার্থ চেতনা লাভের সহায়ক বলে মনে করেন। এই চেতনাযুক্ত অবস্থাকেই তাঁরা প্রাণ বলেন। এই চেতনার অভাবে মানুষ সাধারণভাবে বেঁচে থাকলেও সেইরকম বাঁচাকে তাঁরা অপ্রাণ বলে মনে করেন।
(৩)শান্তিপুর শ্রীঅদ্ব্যয়িৎ (অদ্বৈত) ধামে,
সুরধ্বনি নদী নামে,
ও তার ধারে ধারে আছে তমাল বাবলারই বন।
সেথায় হরি হরি বলে নাচে তিনজন।ঐ..............................
শান্তিপুরের অদ্ব্যয়িত (অদ্বৈত) গোসাঁই,
জীবের দশা মলিন দেখে,
আনিলেন গৌর আর নিতাই।
আসিলেন হরি ব্রজধাম ছাড়ি।।
করিয়ে বর্ণচুরি আসিলেন গৌর হরি।
পতিত তরাতে হরি নামে দিলেন মন।।ঐ..............................
বুড়ো গোঁসাই প্রথম দিলেন নাম,
সাতবার নাবি একবার খাবি,
জীব দিল না তাতে কান।
ও জীব মোহিত কামেতে মজে না নামেতে,
হয়ে আত্মহারা কামেতে পাগল তারা,
পেয়েছে পুত্র, কন্যা, আত্মীয় পরিজন।ঐ..............................
নিল না জীব আচার্যদেবের আচার্য এই নাম,
কামেতে সদায় (সদাই) মত্ত, কীসে আর পরিত্রাণ।
ও জীব পেয়ে কামিনীর কোল, তাজা মাছের ঝোল,
চলে লীলা চলে মুখে হরি বলে,
রমেন বলে লীলা চলে মজে নাকো মন।ঐ..............................
ভাব সম্পুটঃ
এই গানটিতে সাধারণ বৈষ্ণব ঐতিহ্যের কথাই বলা হয়েছে। বৃন্দাবনের তমাল, বাবলার বন, হরিধ্বনির সঙ্গে নৃ্ত্য, গৌর-নিতাই-এর কথা এসব নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু কয়েকটি অনুষঙ্গে সাধারণ অর্থের নীচে গভীরভাবের অর্থও খেলা করছে। যেমন-- 'শান্তিপুর শ্রীঅদ্বৈত ধাম' কথাটির মধ্যে দু'রকমের অর্থ পাওয়া যায়। বৈষ্ণবগুরু শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের আবাস ছিল শান্তিপুরে, আবার অ-দ্বৈত অর্থাৎ যেখানে কোন দ্বৈতভাব নেই; যে এক, পরম সত্যের ধাম সেই হল শান্তিপুর, যেখানে সবসময় শান্তি বিরাজ করে। শেষ স্তবকে 'কামিনীর কোল' আর 'তাজা মাছের ঝোল'-- এই চিত্রকল্প দু'টিও বেশ মজার। সাধারণভাবে কামিনীর কোল বলতে নারীসঙ্গের সুখ আর মাছের ঝোল বলতে ভালো মন্দ খেয়ে ভোগী জীবন কাটানোর কথা বলছে বলে মনে হয়। কিন্তু এর পিছনে একটি প্রচলিত গল্প আছে। এমনিতে সংসারী জীব হরিনাম নেবে না। তাই গৌর-নিতাই নাকি বুদ্ধি করেছিলেন, হরিবোলের সঙ্গে এইরকমের আখর দিতে হবে-- "মাগুর মাছের ঝোল, ঘোর যুবতীর কোল, বল হরিবোল"। প্রথমদু'টির লোভে যাঁরা হরিনাম নিতেন, আস্তে আস্তে তাঁরা বুঝতে পারতেন যে কামিনীর কোল মানে হচ্ছে ভাবের ঘোরে পৃথিবীর কোলে গড়াগড়ি দেওয়া। আর মাছের ঝোল হচ্ছে প্রেমের অশ্রু। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে এই লোককথাটির এরকম ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।
টীকাঃ
বর্ণচুরি - শ্রীকৃষ্ণের রং ছিল কালো। গৌরাঙ্গ অবতারে তিনি নিজের আসল বর্ণ লুকিয়ে বা চুরি করে এসেছেন বলে বৈষ্ণবদের বিশ্বাস।
লীলা চলে - এই পদবন্ধটিও দুটি অর্থ বহন করে। সাধারণ জীবের কামলীলা ছেড়ে হরিলীলায় মন বসে না। 'লীলাচলে' ('নীলাচলে') যেতেও ইচ্ছে হয় না।
(৪)বাউলমেলার লাগল ঠেলা জালালখালিতে।
রং আবীরের রঙের ছটায় আনন্দে মন মেতেছে।ঐ..............................
অঞ্জনার ওই নদীতটে গোপালপুজোর খালার মাঠে,
জালালখালি হাটের কাছে ঐ ধ্বনি শোনা যায়।
বাউলের ঐ মধুর সুরই (সুরে) রাখালে বাজায় বাঁশরী,
শুনে গান নরনারী আনন্দেতে রয় মেতে।ঐ..............................
হেমায়েতপুর জালালখালি আবাল বৃদ্ধ সবাই মিলি,
এনেছে তারা গানের ডালি শুনে শান্তি (শান্ত) শ্রোতাগণ।
দেশ বিদেশের নানা বাউল গান গেয়ে যায় হয়ে মজগুল (মশগুল),
গানেতে জ্ঞান নাই তাতে ভুল বেদ বিধি বিচার মতে।ঐ..............................
গ্রামগঞ্জের সবাই আসি পাড়া পড়শি মাসি পিসি,
ভাই বোনেরা সবাই আসি আনন্দেতে শোনে গান।
ভবা পাগলা, লালনগীতি, হাউরে, শরৎ লোকসংগীতি,
শুনে গান মাতামাতি ভাবের ঘরে ডুবেছে।ঐ..............................
রমেন পাগল আনমনা ভাবের ঘরে সে ডোবে না,
ভাবের অভাব আছে জানা তাইতে জনম হয় মাটি।
জাহ্নবী তাই কয় ভেবে মানুষ আর তুই হবি কবে,
শমন ডঙ্কা বাজবে পার পাবিনে কোন মতে।ঐ..............................
ভাব সম্পুটঃ
চতুর্থ গানটিতে কবি তাঁর গ্রাম, পরিচিত মানুষজন, সমধর্মী বাউলদের মেলা-- এইসব মিলে জাতধর্ম শ্রেণীবিভাগ ভুলে যে অনাবিল আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সেই কথাই বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বাউলধর্মী বিভিন্ন ঘরানার লোকসংগীতের প্রসঙ্গও এনেছেন। কবির মতে, এই আনন্দের স্বাদ না পেলে জীবনে ভাবের অভাব ঘটলে মানবজীবন ব্যর্থ হয়ে যায়।
টীকাঃ
হেমায়েতপুর - এটি জালালখালির নিকটবর্তী একটি গ্রাম। অঞ্জনানদীর যে-পাড়ে জালালখালি অবস্থিত তার বিপরীত পাড়ে এই গ্রামটি অবস্থিত, নদীয়া জেলার অন্তর্গত।
আজ যখন দলিত কবি-সাহিত্যিক বা প্রান্তবাসী মানুষদের সংস্কৃতি নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে, রমেন বাউলের মতো দরিদ্র লোকশিল্পীরা কি একটু বেশি সমাদরের আশা করতে পারেন না? বব ডিলানের নোবেল পুরস্কার লাভ দীর্ঘদিনের একটা প্রশ্নে নতুন করে উত্তেজনার রসদ জুগিয়েছে। প্রশ্নটা হল পারফর্মিং আর্ট বা করণ শিল্প যার মধ্যে নাচ, গান, অভিনয় সব কিছুই পড়ে তার সহায়ক লেখাকে সাহিত্যের পর্যায়ে গণ্য করা যায় কিনা। গান যদি কণ্ঠশিল্পীকে মর্যাদা দিতে পারে তাহলে গানের কথা বা লিরিক-এর জন্য একজন গীতিকবি সাহিত্যিকের মর্যাদা পাবেন না কেন? আমাদের দেশে সাহিত্যে একমাত্র নোবেল পুরস্কার কিন্তু একজন গীতিকবিই পেয়েছেন। মানসিকতার দিক দিয়ে যাঁকে রবি বাউল বললেও ভুল হয় না। রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের মতো প্রান্তিক লোককবিরা আরও বেশি করে প্রকাশনা এবং প্রচারের আলোয় যাতে আসতে পারেন তার জন্য সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে আমরা দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না।
বিঃ দ্রঃ -- প্রতি গানে 'ঐ...' পদটি গানের ধুয়া (ধ্রুবপদ) বোঝায়। গানের লিপিকর প্রমাদগুলির যথাসম্ভব সংশোধিতরূপ গানের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট শব্দের পাশে বন্ধনীতে দেওয়া হল।
(তথ্য ও গান সংগ্রহ - সুস্মিতা হালদার। টীকা তৈরিতে ডঃ বিশ্বেশ্বর কুণ্ডু সাহায্য করেছেন।)