কৈফিয়ৎ:
'তাবৎ চ শোভতে মূর্খ, যাবৎ কিঞ্চিৎ ন ভাষতে'--সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন বিষয়ে হাত দেওয়া প্রগল্ভতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সে জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে বেশ কিছু সামাজিক অসামঞ্জস্য আমাকে এমনভাবে আহত করেছিল যে তার প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী ছিল। হঠাৎ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের Can Subaltern Speak সম্পর্কে পড়ি। মনে প্রশ্নচিহ্নরা মিছিল জমায়। সঙ্গে এসে হাজির 'subaltern studies', 'deconstruction', 'knowledge politics' এর মতো শক্ত শক্ত সব পরিভাষা। যে বিষয়গুলো নিয়ে পণ্ডিতমহলেই সংশয়, আলোচনা, সমালোচনার ঝড় বইছে তাতে আমাদের আর কী কথা? সব কিছু বুঝেছি, এমন মিথ্যে দাবী করবো না। বোঝার ভান করছি মাত্র (তাও জটিল পরিভাষাগুলো টপকে)। 'Fools rush where angels fear to tread' আরেকবার প্রমাণ করলাম হয়তো। মার্জনা করবেন।
প্রবন্ধটা মূলত তিনটি বিষয়ের ঐকতান (নামকরণ দ্রষ্টব্য)। চিরাচরিত প্রথা অনুসারে, ময়ূরপুচ্ছধারী দাঁড়কাক শ্রেণীসমাজের প্রতিনিধিরা প্রথমে, তারপরে স্পিভাক ও অন্য কিছু চিন্তাবিদদের মননের সূত্র ধরে, সব শেষে আমার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা ও প্রশ্ন দিয়ে শেষ হয়েছে প্রবন্ধটি। অবহেলিত শ্রেণীসমাজের অস্তিত্বর যাপনবৃত্তান্ত হিসেবে লেখাটিকে উপস্থাপন করাই আমার প্রকৃত উদ্দ্যেশ্য।
"এইসব শুষ্ক, মূঢ়, ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা। "
--রবীন্দ্রনাথ
আমরা পরের মুখের ঝোল (নাকি ঝাল? যার যা ভালো লাগে খাবেন) খেতে ভালোবাসি। কথায় কথায় অপরের কথা আওড়াই (এই যেমন রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করেছি, পরে আরো আওড়াবো)। এই টোকাটুকি না করলে, জ্ঞানীর মর্যাদা থাকে না, শিক্ষিত সমাজ গ্রাহ্য করে না। ফলে স্বশিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত (অবশ্যই এখানে শিক্ষার মাপকাঠি, উচ্চবিত্ত সমাজ ও তাদের একুশে আইন) মানুষদের কথা কেউ কানে তোলে না। 'কান কাটাদের রাজ্যে/ ঠোঁটকাটারা যাই বলুক, আনে না কেউ গ্রাহ্যে'। Oscar Wilde কী আর এমনি এমনি বলেছেন, "Most people are other people"? কারণ আছে। তাঁর মতে, "Their thoughts are someone else's opinions, their lives a mimicry, their passions a quotation". এই নকলনবিশী শুরু হয় বর্ণপরিচয় থেকে।
বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কৃপায় গোপালকে ভালো ছেলে হিসেবে দেখতে শুরু করি। আর রাখালকে খারাপ। তারপর প্রাইমারীর গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে গিয়ে কেশব নাগের অঙ্ক করি। সেখানে চিরাচরিত চিরবিতর্কিত অসাধু দুধওয়ালা এসে মিশ্রণের অঙ্কের সাথে সাথে আমারদের মূল্যবোধেও জল ঢেলে দিয়ে চলে যায়। আর একটু বড় হতে মা বলে, "ও সিগারেট খায়, ও বাজে ছেলে, ওর সাথে মিশবে না।" আমরাও মিশি না। নিজের ভালত্বের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ওর ভালগুলো আলগোছে এড়িয়ে যাই। পাড়ার প্যান্ডেলে যখন আগুন লাগে তখন ও সবার আগে দৌড়োয় দমকলে, পাড়ায় মাঝরাতে দাহ করার লোকের অভাব পূরণ করে। আর আমি পটাপট ক্লাস টপকে, মেডেলে বাড়ি ভরিয়ে, ক্লাস এইটের পর আর ওর পড়া হয়নি শুনে, অবজ্ঞায় স্নান করিয়ে, হয়তো অনুকম্পার সুরে বলি, "আহা রে, খুব গরিব ছিল তো! তবে মাথা ভালো ছিল, পড়াশুনাটা করলে পারত।"
তারপর ধীরে ধীরে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করি। ততদিনে আমাদের নিজস্ব পৃথিবী তৈরি হয়েছে। ভিক্টোরিয়া আর গড়ের মাঠে অনেক প্রেম হয়েছে, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। মায়ের ভালো ছেলেটাও সিগারেটে অগুন্তিবার টান দিয়েছে। কিন্তু, মোজায় লেগে থাকা সহস্র চোরকাঁটার মতো আমাদের চরিত্রের অয়েলপেইন্টিং-এ ততদিনে লেগেছে চারপাশের মানুষগুলোর অজস্র তুলির পোঁচ। ফলে আমরাও আর পাঁচটা মধ্যবিত্তের মত, 'আরম্ভ করি শেষ করি না, আড়ম্বর করি কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না।'
স্কুল কলেজের পাঠ্য প্রান্তিক মানুষদের গল্প অনেকদিন আগেই বিস্মৃতির আলখাল্লা পরেছে। এখন এসি গাড়ির ভিতর দিয়ে দেখা বাইরের ভিখারী সমাজ কালো কাচের ওপারে, আর এপারে Times of India-য় মহাশ্বেতা দেবীর Obituary পড়ে চোখের জল মোছা আমরা।
এভাবেই সমাজ নামক যন্ত্রের মধ্যে মেকি হাসি, নকল ভাষা, কৃত্রিম আভিজাত্যে নিজেকে মেজে, বিবেক নামের অপ্রয়োজনীয় অংশটাকে ভেজে, ক্রমশ মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোর থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে থাকি আমরা। যত জ্ঞান (knowledge) লাভ করি, তত 'রচি নিতি ব্যবধান'। 1985 সালে প্রকাশিত হয় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বহুচর্চিত প্রবন্ধ 'Can Subaltern Speak'। তাতে এ বিষয়ে বিভিন্ন দিক দিয়ে আলোচনা করা আছে। আলো আঁধারিতে ঢাকা বিচিত্রবর্ণী এই 'Subaltern' শব্দটিরও বহুস্তরীয় অর্থ আছে। ক্ষমতায়নের স্তরে স্তরে Subalternity-র চরিত্র বদলে যায়। তবে আমরা সেসব সংজ্ঞাসন্দর্ভে না গিয়ে অবহেলিত শ্রেণী সমাজের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।
স্পিভাক সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন Subaltern cannot speak. তবে তারা কথা বলতে পারে না, এটাই তাদের নির্বাকত্বের একমাত্র কারণ নয়। এ বিষয়ে অমর্ত্য সেনের The Argumentative Indian গ্রন্থের একটা ঘটনার উল্লেখ বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি লিখছেন,
Just before the Indian general elections in the spring of 2004, when I visited a Bengali village not far from my own home, I was told by a villager, who was barely literate and certainly very poor: 'It is not very hard to silence us, but that is not because we cannot speak.' অর্থাৎ সমস্যা অন্যস্থানে।
অধিকাংশ স্থানে পার্থক্য অনুভবের। অভাব ভাবের আত্তীকরণে। তাই স্পিভাকের মতে, শোষক কখনো শোষিতের ইতিহাস লিখতে পারে না।' বিষের যাতনা 'বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?' ব্রিটিশদের ও বিদেশিদের লেখা যাবতীয় ঐতিহাসিক নথিকে তাই তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। কারণ, হয় বিকৃত ইতিহাস লেখা হয়েছে, নয় লেখা হয়েছে সহানুভূতির দোয়াতে কলম চুবিয়ে। বুদ্ধদেব বসু 'সংস্কৃত কবিতা ও মেঘদূত' প্রবন্ধে এ সম্পর্কে লিখেছেন,
"...সমগ্রভাবে একথাই সত্য যে সংস্কৃত ভাষার রচনাবলীর মধ্যে শ্বেতাঙ্গরা দেখেছেন--গ্রীক ও লাতিনের মতো কোনো সাহিত্য নয়, রসসৃষ্টি নয়, সৃষ্টিকর্ম নয়--দেখেছেন ইতিহাস ইত্যাদির উপাদান, আর ভারতীয় মনের পরিচয় পেয়ে ভারতবাসীকে বশীভূত রাখার ও খ্রিষ্টানিকৃত করার একটি সম্ভাব্য উপায়... স্বনামধন্য উইলসনকৃত 'মেঘদূত'-এর অনুবাদটি মূল রচনাকে লজ্জা দেয় এবং তাঁর টীকা পড়েও বোঝা যায়, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জলবায়ু, ভূগোল, পশুপক্ষী ও উদ্ভিদ বিষয়ে জ্ঞানদান, এবং এ বিষয়ে স্বদেশবাসীকে অবহিত করা যে ভারতীয় মানুষ বর্বর নয়, এমনকি কৃতজ্ঞতার অর্থ বোঝে ('ন ক্ষুদ্রোহপি প্রথমসুকৃতাপেক্ষয়া সংশ্রয়ায়। প্রাপ্তে মিত্রে ভবতি বিমুখ: কিং পুনর্যস্তথোচ্চৈঃ )..."
ভারতবাসী হিসেবে অপমানের মাত্রাটা অনুভব করতে অসুবিধা হয় না। Colonizer আর Colonialized এর ক্ষেত্র থেকে সরে এসে যদি আমাদের সমাজের দিকে তাকাই? আমরাও কী ওই 'অসম্মান শেল' ছুড়ে দিই না Subaltern-দের দিকে? মুখে প্রকাশ না করলেও (শিক্ষিত, অভিজাতের অভিনয় করতে গেলে এটা অত্যাবশ্যক শর্ত, যা ভাববে তা কদাচ প্রকাশ করবে না। ওটা courtesy, ওটা শালীনতা) আমরা কজন ভিক্ষা দেবার সময় মনে রাখি সেই উপনিষদীয় ভাবনা? 'শ্রিয়া দেয়ম্, হ্রিয়া দেয়ম্, শ্রদ্ধয়া দেয়ম্, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্?' আসলে আমাদের শহুরে শিক্ষিত বোধ, বুদ্ধির চৌকাঠে দ্বাররক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আর বাকিরা ভাষাহীন কণ্ঠস্বরে পর্যবসিত হয়। সহজ কথায় বললে, ব্যক্তিগত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মাধ্যমে আমরা যে ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণের 'আমি'-দের তৈরি করেছি সেগুলি ওদের সাথে নিজেদের মেলাতে পারে না।
কিন্তু ব্যতিক্রমও ঘটে, এবং তা নিয়ম মেনেই ঘটে। মহাশ্বেতা দেবীর 'হাজার চুরাশির মা' মনে করুন। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। জীবনানন্দের '১৯৪৬-৪৭' কবিতার মতো পরিস্থিতি তখন--
"ঘুমাতেছে।কাঁটাপুকুর মর্গে মৃতের তালিকায় একহাজার চুরাশিতম নাম ব্রতীর। ব্রতীন ব্যানার্জী। বড় বাড়ির ছেলে। সুন্দর সমাজ গড়বার আশায় প্রাণ হারিয়েছে আরো অনেক ছেলের সঙ্গে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিচুতলার। ব্রতীর মা, লরেটো থেকে পাশ করা, অভিজাত পরিবারের স্ত্রী সুজাতা যেতেন সমুর মার কাছে। সমু গরিব পরিবারের মেধাবী ছেলে। ব্রতীর বন্ধু। তার সাথেই মরেছে। মহাশ্বেতা দেবীর ভাষায়-
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর—’
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব;"
'সুজাতা বোঝেন, তাঁর লেখাপড়া, স্বচ্ছচিন্তা, চিন্তাকে বোধ্য বাণীতে প্রকাশ করার ক্ষমতা আছে বলে তিনি যে চিন্তা করেন, সমুর মার স্বল্প লেখাপড়া, সামান্য বিদ্যাবুদ্ধি, চিন্তাকে বোধ্যবাণীতে প্রকাশ ক্ষমতার একান্ত অভাব নিয়েই ঠিক এক কথাই চিন্তা করেন।
তাঁর মার মনে হয়, সমুর মা সেই কথা বলেই কেঁদে ওঠেন, মাইরা ক্যান ফ্যালাইন দিদি? তাগারো যদি এট্টা অঙ্গ খুতা কইরাও জিয়াইয়া থুইত, তবু তো জানতাম সমু আমার বাইচা আছে। আর না হয় নাই দ্যাখতাম চক্ষে। নয় জেলেই থুইত? তবু তো জানতাম ও আমার বাইচা আছে! ....... এখানেও যে দুঃখ হেই দুঃখ আছিল? সুজাতা সমুর মার প্রত্যেকটি কথা বুঝতে পারছিলেন।'
শেষ বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। সুজাতা বোঝেন। শ্রেণীপার্থক্য, ভাষাপার্থক্য ও অন্যান্য আরও অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পরস্পরের কথা বোঝেন। কী ভাবে? পুত্রের মৃত্যু যে তাদেরকে এক করে দিয়েছে। সামাজিক ভাবে না হলেও, মানসিকভাবে যে তাঁরা এক সাধারণভূমিতে দাঁড়িয়ে। 'আমরা' - 'ওরা'র এই বিভেদ মুছতে গেলে, মানসিক সাধারণীকরণ একান্ত কাম্য।
পুরুলিয়ায় থাকাকালীন এরকম কিছু ঘটনায় আমি বচন আর বাচিক তাৎপর্যের সম্পর্ক নির্ণয়ে নেমে কেঁচেগণ্ডুষ করেছি। মনে প্রশ্নচিহ্নরা কুচকাওয়াজ করেছে। উপসংহার টেনেছি 'ধুত্তোর' বলে।
দিগন্তবিস্তৃত শুকনো মাঠে আলপথ কাটাকুটি খেলছে, গ্রামের নাম বোঙাবাড়ী। এক বৃদ্ধা তেঁতুল কুড়োচ্ছিলেন। গাছ থেকে ঝরে পড়া, পাকা, থেঁতলে যাওয়া তেঁতুলের হাটে কত দাম কে জানে, কিন্তু তিনি কুড়োচ্ছিলেন। নববর্ষের দিন গ্রামে ঘুরতে আসা একদল ছেলে চারপাশে। ঝুড়িতে রাখা তেঁতুলে আবার এক ছাগল মাঝে মাঝে মুখ দিচ্ছে। বৃদ্ধার শতছিন্ন পাতলা শাড়িটা অনেক ফ্ল্যাটে ন্যাতা হিসেবেও গ্রাহ্য হবে না। এক ছেলের কি মনে হয়, বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তাঁকে ১০০ টাকা দেয়। ওটা ওনার একমাসের খরচ। বৃদ্ধা প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বলেন, 'বেঁচে থাক বাপ, অনেক বেটার বাপ হ। উকিল হ।'
এ কি আশীর্বাদ? এর কোনোটিই যে তার আকাঙ্ক্ষিত নয়! এত কিছু থাকতে শেষে উকিল? এটা নয় যে ওকালতি জীবিকা হিসেবে হীন কিছু, কিন্তু এক বিশেষ প্রতারক উকিলের কারণে, সবার উপরেই সে খাপ্পা। আর যাই হোক, উকিল হতে সে চায় না।
কিন্তু একটু ভাবলে বোঝা যায়, বৃদ্ধার বক্তব্যের উদ্দেশ্য সেটা ছিল না। তিনি তাঁর গ্রাম্য সংস্কার, সীমিত বিদ্যা-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত তাঁর জানা সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তুটিই প্রার্থনা করেছেন এই কিশোরটির জন্য। সেই প্রার্থনায় কোনো খাদ নেই। কৃতজ্ঞতার অশ্রুটি সিনেমার হিরোইনের গ্লিসারিনের কান্না নয়। তাঁর ভাষায় তিনি যাই বলুন না কেন, চোখের চিকচিকে জল বলছে, 'অনেক বড় হ বাবা, অনেক বড় হ।'
পুরুলিয়ার ভাষায় একটা কবিতা আছে, কোনো অজ্ঞাতনামা কবির লেখা--
'হ ভাল উই যে তিরঙা পৎপতাইছে
উ হামদের জাতীয় পতাকা বটে।
কত্ত বড়, কত্ত ভালো, ডাইস একখান কাপড়...
হামদের ছিলাটা ন্যাংটাপুঁটা
কাপড় জোটে নিকো মোটে।
সেদিন হা কইরা দাড়ায়ে উহারে ভালতাছিলি
উহারে দিবি বাবু?
কেটে পোশাক বনাইতাম।'
কোমরের নিচে জাতীয় পতাকা কেটে কাপড়? এ যে সংবিধানের চরম অবমাননা। রাষ্ট্রযন্ত্র একে কী শাস্তি দেবে? ক'জনকে শাস্তি দেবে? খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মানুষের প্রাথমিক চাহিদার যখন টান পড়ে, তখন যে হয় মনুষ্যত্বের অবমাননা। তার বেলা? যাদের পরনে কাপড় জোটানোর নূন্যতম দায়িত্বটুকু রাষ্ট্র নিতে পারেনি, তারা রাষ্ট্রীয় সম্মানজ্ঞাপনের দায়িত্ব বহন করবে কোন শর্তে? প্রশ্নগুলো বুদ্ধুদের মতো বারবার ভেসে ওঠে। উত্তর মেলে না।
গদাধর অভ্যুদয় প্রকল্পে, অবৈতনিক বিদ্যালয়ের কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসেছিল তাদের বার্ষিক ক্রীড়াপ্রতিযোগিতায়, একজন শিক্ষকের তত্বাবধানে গাওয়া হচ্ছিল 'জনগণমন'। কিন্তু আদুল গায়ে পুরুলিয়ার শীতের সকালে 'উহারা গাহিতেছিলি'--'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারতভাইগ্যবিধাতা.....'
অনেক পরিবারেরই এই প্রথম প্রজন্ম ইস্কুলে। জাতীয় সংগীতে যে উঠে দাঁড়াতে হয়, অভিভাবকদের প্রায় কেউই জানে না। শিক্ষকের তাড়া খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, এটা কী গাওয়া হচ্ছে, কেন উঠবে সে সব সম্পর্কে ধারণা খুব কমেরই আছে। একটা অন্ধ, বোবা, কালা লোকও এদের সাথে এসেছিল। সে কিছুই দেখেনি, কিছুই শোনেনি। উঠে দাঁড়ানো জনতার ভিড়ে সে কেবল একাই বসে রইলো। নিজের চারপাশের নিস্তব্ধ জমাট অন্ধকারের মাঝে।
ভাবছিলাম, ওই ব্যক্তির সাথে চারপাশের উঠে দাঁড়ানো লোকজনের পার্থক্য কী? ওদের উঠে দাঁড়িয়ে, আমাদের সভ্য(?) জগতের রীতি মেনে আমাদের নিয়মে চালিত হওয়ার মধ্যে অন্য কোনো গন্ধ নেই তো? ফ্রয়েডের Scapegoating তত্ত্ব বা 'Savior' তৈরি করার কোনো ইঙ্গিত নেই তো? নেই তো, এর উপর ভিত্তি করে সতীদাহ প্রথা সম্পর্কিত স্পিভাকের সেই বিতর্কিত 'White men are saving brown women from brown men' মন্তব্যের গোপন রূপায়ণ? শিক্ষা-অশিক্ষার সমীকরণের গভীরে গজিয়ে ওঠেনি তো কোনো প্রভুত্ববোধ? 'আমরা' শিক্ষা দেব, তবে 'ওরা' শিক্ষিত হবে, সভ্য হবে। সত্যি কি এতটাই 'আমাদের' উপর নির্ভরশীল 'ওরা'? অপরিণত মস্তিষ্কেও বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমাদের 'ভাগ্যবিধাতা' আর ওদের 'ভাইগ্যবিধাতা' একই লোক, তফাৎ শুধু গুরুত্বে। কারো কথা মন দিয়ে শোনেন, আর কারো কথা শুনেও না শোনার ভান করেন। প্রশ্ন করবেন না, 'কেন?' উত্তর নেই। ঈশ্বর নির্বাক। সমাজ নির্বাক। সভ্যতা নির্বাক।