• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৫ | ডিসেম্বর ২০১৬ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ছত্তিশগড়ে ছ-দিন : রাহুল মজুমদার


    অরকু


    চোদ্দোই অক্টোবর, দু হাজার পনেরো

    রাত আটটা তেত্রিশ

    কোরাপুট এক্সপ্রেস গড়ালো। দুজনে চলেছি ছত্তিশগড়ে।

    রাত দশটা এক

    গাড়ির দোলায় ঘুমের দেশে পাড়ি।

    পনেরোই অক্টোবর

    ভোর পাঁচটা সাতাশ

    রৌরকেল্লা ফতে করে গাড়ির অগ্রগতি।

    সকাল সাতটা দুই

    বামরা। যদিও কোনও লালঝাণ্ডা চোখে পড়ল না — ছোট্ট, মিষ্টি স্টেশন।

    সকাল সাতটা একুশ

    বাগডিহি। শুরু হয়েছে মালভূমি।

    সকাল সাতটা একচল্লিশ

    ঝাড়সুগুড়া। ঝাড়েবংশে অনেকে নেমে গেল।

    সকাল আটটা ষোলো

    এবার এক্কেবারে পথে বসালো! ঝাড়সুগুড়া রোড।

    সকাল আটটা আটত্রিশ

    লপঙ্গা। (নাকি লে পাঙ্গা!)

    সকাল আটটা একান্ন

    রেঙ্গালি (এ-কার বাদ গেলেই চলে যেত অসমে)।

    সকাল ন-টা

    বি-শা-ল এক লেক!

    সকাল ন-টা আঠারো

    লোটাকম্বল করে সম্বল — পুর রোড।

    সকাল ন-টা চব্বিশ

    সম্বলপুর জংশন।

    সকাল ন-টা সাতচল্লিশ

    এই সেই হীরাকুঁদ বাঁধ।

    সকাল ন-টা ঊনপঞ্চাশ

    বাঁধ পেরিয়েই ইস্টিশন — হীরাকুঁদ।

    সকাল দশটা দুই

    গোভাগা। টিরেন ভী ভাগা।

    সকাল দশটা চল্লিশ

    পথের যে নাই শেষ — এ যে রোডে রোডে রোডাক্কার! বরগড় রোড। বর গড় কিছুই অবশ্য চোখে পড়ল না।

    সকাল এগারোটা পাঁচ

    বরপালী। বর-পালনের দেশ নাকি?

    সকাল এগারোটা ছত্রিশ

    লৌহসিংহা। আবার সিঙ্গী টিঙ্গী কেন?

    দুপুর বারোটা বারো

    বলাঙ্গীর। বলাই বাহুল্য ছানাপোড়ার সোয়াদ মুখে লেগে রইল।

    দুপুর একটা তিন

    বড়মাল। ছোট মালগুলোর কী হবে!

    বেলা একটা তেইশ

    টিটিলাগড় জংশন। টিলা দেখলেও গড় চোখে পড়ল না।

    বেলা একটা সাতান্ন

    কেসিংগা। কে সিংগা?

    বেলা দু-টো বাইশ

    রুপরা রোড। আর অরূপরা?

    বেলা দু-টো বত্রিশ

    নারলা রোড। বলেছিলুম না, পথের যে নাই শেষ!

    বেলা তিনটে উনপঞ্চাশ

    থেরুবালি। বালি কোথা? সবুজভরা।

    বেলা চারটে দুই

    সিঙ্গাপুর রোড। সমুদ্দুর না পেরিয়েই! পাসপোর্ট ছাড়াই!!

    বেলা চারটে চোদ্দো

    রায়গড়া। কোন রায়ের গড়া? সুকুমার, না সত্যজিৎ?

    বেলা চারটে চল্লিশ

    গাড়ি যে উলটোবাগে ছুটছে!

    'সন্ধে' পাঁচটা উনিশ

    পাঁচটা থেকে এরই মধ্যে দশটা টানেল পেরোলুম।

    সন্ধে পাঁচটা সাতাশ

    ভালুমারকা। মার্কামারা ভালুকের জায়গা।

    সন্ধে পাঁচটা তেতাল্লিশ

    আরও লম্বা লম্বা তিনটে টানেল গুমগুমিয়ে পেরিয়ে লেল্লিগুম্মা।

    সন্ধে ছ-টা উনিশ

    আবার তিন টানেলের পারে - টিকরি।

    সন্ধে সাতটা দুই

    আবার পথে — লক্ষ্মীপুর রোড।

    শেষ সন্ধে সাতটা তেইশ

    কাকড়িগুমা। রীতিমতো কড়ি ফেলে পেটের আগুন নেভানো গেল।

    'রাত' সাতটা চল্লিশ

    অজানা অচেনা স্টেশনে গাড়ি বোধহয় অবস্থান ধর্মঘটে বসেছে, কিম্বা ঘুমিয়ে পড়েছে।

    রাত আটটা আঠারো

    গাড়ির ঘুম ভাঙল মনে হচ্ছে।

    রাত আটটা বত্রিশ

    দামনজোড়ি। আর কদ্দুর মা গো?

    রাত ন-টা দুই

    কোরাপুট। হুট করে ঢুকে পড়লাম ছত্তিশগড়ে।

    রাত ন-টা সাতাশ

    ই কী! আবার যে গাড়ি ব্যাকগিয়ারে!

    রাত দশটা পঁয়ত্রিশ

    জয়পুর। রাজস্থান! এত তাড়াতাড়ি!!

    রাত এগারোটা তেত্রিশ

    জগদলপুর। শরীরের বারোটা বাজতে বাজতে বেঁচে গেল।

    ষোলোই অকটোবর; রাত বারোটা বারো

    হোটেলের বিছানা এত আরামের হয়!

    সকাল সাতটা পাঁচ

    আমার ঘুম ভাঙলেও জগদলপুর এখনও ঘুমের দেশে।

    সকাল দশটা নয়

    চারচাকায় ভর করে চিত্রকোট অভিযান আরম্ভ।

    সকাল দশটা উনিশ

    দন্তেশরীর রথ পেরিয়ে মন্দির দর্শন। সতীর দাঁত দেখা না গেলেও মন্দির মন্দ নয়।

    সকাল দশটা একান্ন

    আদিবাসী সংগ্রহশালার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা! আমাদের দেশের কতটুকুই বা জানি।

    বেলা বারোটা বাজতে চার

    তিরথগড় প্রপাতের তীর্থে।

    বেলা একটা

    এতক্ষণ তিরথগড়ের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। ঝালরের পর্দার মতো নেমে এসেছে রূপবান প্রপাত। পাথুরে প্রেক্ষিতে তিরথগড় প্রপাতের উপস্থিতি — অনবদ্য। সুগ্রীবসেনার উপস্থিতি বাড়তি পাওনা।

    বেলা একটা তেত্রিশ

    একটা কেন্দুপাতা বোঝাই ট্রাক পেটে গ্যাস হওয়া হাতির মতো রেলগেট পেরোলো।

    বেলা দুটো চৌত্রিশ

    বস্তার-সুন্দরী অপরূপা চিত্রকোট প্রপাত! বর্ষায় নাকি সে নায়াগ্রার সাথে টক্কর নেয়। আরণ্যক পরিবেশে বিলাসবহুল ব্যবস্থাপনা।

    রাত আটটা

    দিনভর প্রপাতের এক রূপ — আর এই রাত্রে কৃত্রিম আলোয় তার রূপকথার রুপোলি রূপ।

    সতেরোই অক্টোবর, সকাল ছ-টা ছাপ্পান্ন


    চিত্রকোট প্রপাত
    ভোরের কুয়াশামাখা চিত্রকোটের চিত্র চিত্তমনোহারী।

    বেলা দেড়টা বেজে দুই

    আবার প্রপাতের আঙিনায়। ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রপাতে রামধনুর খেলা।

    বেলা একটা উনচল্লিশ

    আতা বিক্রেতা এক বৃদ্ধার সস্নেহ উপহার আতাগুলো স্নেহভরে দ্বিগুণ মিষ্টি লাগল।

    বেলা চারটে চব্বিশ

    প্রপাতের টানে আবার।

    আঠারোই অক্টোবর; সকাল ছ-টা ছেচল্লিশ


    চিত্রকোট
    আজ মহাপঞ্চমী। আজ চিত্রকোট ত্যাগ করে অরকু (আরাকু)-র ডাকে বেরিয়ে পড়া।

    সকাল ছ-টা ছাপ্পান্ন

    লোখন্ডিগুড়া। কুয়াশার আলপনা ধরে যাত্রা।

    সকাল সাতটা দুই

    বড়ঞ্জি। ছোট গঞ্জ।

    সকাল সাতটা পাঁচ

    টাকরাগুড়া। টাক গুঁড়িয়ে দেবে নাকি! অবশ্য গুঁড়োবার মতো লোকজন চোখে পড়ছে না।

    সকাল সাতটা সতেরো

    করঞ্জী।

    সকাল সাতটা বেয়াল্লিশ

    জগদলপুর স্টেশন। ফাঁকা স্টেশন। বেশ মনোরম। ট্রেন আসতে এখনও ঘন্টা তিনেক।

    সকাল এগারোটা একত্রিশ

    অত সুন্দর স্টেশনটাও জঘন্য লাগতে শুরু হয়েছে। সাড়ে দশটার ট্রেন এতক্ষণে আসার আশা দেখিয়েছে।

    সকাল এগারোটা একচল্লিশ

    অবশেষে কিরনভুল — বিশাখাপত্তনম প্যাসেঞ্জার প্যাসেজে পা রাখলেন। উঠে বসলাম। আদ্যন্ত লোকাল ট্রেন।

    দুপুর বারোটা বাজতে আট

    নক্‌টী সেমরা। এ কোন দেশী নাম রে বাবা! মানে কী?

    ঠিক দুপ্পুরবেলা হতে এক মিনিট

    আমাগুড়া। এরই মধ্যে বুঝে গেছি, এ ট্রেন হামাগুড়ি দিয়ে চলে।

    দুপুর বারোটা চল্লিশ

    বীরভূমি প্রকৃতির মাঝে চরামূলা কুসুমি। মুলোর ফুল চরাতে হবে?

    দুপুর বারোটা তিপ্পান্ন

    খড়পা।

    বেলা একটা এগারো

    ধনপুর। দেখে তো বেশ গরীব মনে হলো!

    বেলা একটা বাইশ

    জেপুর।

    বেলা একটা পঞ্চাশ

    ছাতরিপুট। ছাতার পুট!

    বেলা দুটো দুই

    মালিগুড়া। মালি কি এখানে গুড়ের ব্যবসা করে!

    বেলা দুটো সাতাশ

    পাঁচটা টানেল পার করে জরতি। এখানেও বিরতি!

    বেলা দুটো বেয়াল্লিশ

    মানাবার। উপায় নেই — পেটের জ্বালাকে পোষ মানাবার উপায় নেই। এ ট্রেনে কোনও হকার ওঠে না — কিনবে কে? যাত্রীরা এতই হতদরিদ্র যে, ট্যাঁকে একটা টাকাও আছে কিনা সন্দেহ। মুখে কিন্তু হাসিটি অমলিন। বাইরের প্রকৃতিও তেমন হাস্যমুখী।

    বেলা দুটো তিপ্পান্ন

    কোরাপুট।

    বেলা তিনটে তেরো

    পাক্কা কুড়ি মিনিট পর গাড়ি গতর নাড়াল।

    বেলা তিনটে উনচল্লিশ

    পালিবাড়ি। উঠেছে! হকার উঠেছে। আপেল আর পাঁউরুটি।

    বেলা তিনটে চুয়ান্ন

    মাছকুণ্ডু রোড। মাছ, কুণ্ড — কিস্‌সু নেই।

    বেলা চারটে দশ

    ভেজা। গলা ভেজাবার উপায় নেই।

    বেলা চারটে চব্বিশ

    পাড়ুয়া। বি-শা-ল জলাধারের পাড়ে সুন্দর পাড়া।

    বেলা চারটে সাঁইত্রিশ

    চারলিপুট। চ্যাপলিনের গেরাম নাকি!

    বেলা চারটে পঞ্চাশ

    একটা টানেল ফুঁড়ে গোরাপুর। গোরা কালা কাউকেই চোখে পড়ল না। ট্রেন এখন প্রায় ফাঁকা।

    বিকেল পাঁচটা ষোলো

    এলো অরকু।

    সন্ধ্যা পাঁচটা ঊনষাট

    ময়ূরীর কোলে আশ্রয়।

    রাত আটটা আট

    ভারি অদ্ভুত নিয়ম। খাওয়ার সাথে সাথেই দাম চোকাতে হবে!

    উনিশে অক্টোবর; সকাল সাতটা সাত

    আজ মহাষষ্ঠী। ঠাণ্ডাজড়ানো মোহময়ী সকাল।

    সকাল আটটা পঞ্চাশ

    সাইট সীয়িং-য়ে গোয়িং।

    সকাল দশটা তেইশ

    পদ্মপুরম পার্ক। নানান গাছগাছালি আর উইঢিপিতে সাজানো।

    সকাল এগারোটা তেরো

    কালীকুণ্ডা ফরেস্টের ভিউ পয়েন্ট। সবুজ পাহাড় গড়াতে গড়াতে নীলচে আভা মেখে দিগন্তে হেলান দিয়েছে। তারই মাঝে আঁকাবাঁকা রেললাইন ধরে সর্পিল ছন্দে চলেছে মালগাড়ি। কফি, ব্যাম্বু-চিকেনের স্টলে ভিড়।

    সকাল এগারোটা একুশ

    কফি-বনে বিহার। সঙ্গী গোলমরিচ। কফিগাছ বেয়ে গোলমরিচ লতার বেষ্টনী।

    সকাল এগারোটা একত্রিশ

    অনন্তগিরি। এখান থেকে বোরা গুহার পথ গিয়েছে বেঁকে।

    সকাল এগারোটা ঊনপঞ্চাশ

    বোরা গুহামুখ। প্রবেশপথ থেকে চলতে চলতে নামতে নামতে নিচে গোষ্ঠানী নদীর চলন দেখতে দেখতে, কিষ্কিন্ধ্যাবাসীদের দাঁত খিঁচুনি সইতে সইতে এসে পড়লাম অবাক রাজ্যের দোরগোড়ায়। ১৫ কোটি বছরের প্রাচীন এই গুহা স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাকমাইটের নানান ভাস্কর্যে শোভিত। সিঁড়ি লাগিয়ে, রঙীন আলো ফেলে তাদের রূপের আরও খোলতাই হয়েছে।

    বেলা দুটো দুই

    বিস্ময়ে বিভ্রান্ত! এ কোন রূপকথার সাতমহলা পুরীতে ঢুকে পড়েছি! কাকে ছেড়ে কাকে দেখি। দর্শকদের অনাবশ্যক চিৎকারে শান্ত গুহার নৈঃশব্দ খানখান হচ্ছে মুহূর্মুহূ। এই আশ্চর্য মুগ্ধতার মাঝে এসে নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে করে!

    বেলা দুটো বারো

    শ্রেষ্ঠতর অর্ধাঙ্গিনীর চোখেমুখের মুগ্ধতা।

    বেলা তিনটে আট

    বোরাগুহার অতিভোজনের পরে পেটের গুহায় ভোজনভরণ পর্ব।

    বেলা চারটে দশ

    আবার ময়ূরীর কোলে।

    বিশে অক্টোবর; সকাল ন-টা চল্লিশ


    অরকু ট্রাইবাল মিউজিয়াম
    ঘরের পাশেই আদিবাসী সংগ্রহালয় — অনেকখানি জায়গা জুড়ে।

    দুপুর বারোটা বত্রিশ

    ঘুরে ঘুরে আদিবাসী জীবনে আবার মুগ্ধতার ডুব।

    রাত আটটা এগারো

    নিচে আদিবাসী নৃত্য হচ্ছে — দুজনে ছ-চোখ ভরে তা-ই দেখছি।

    রাত ন-টা

    মহাসপ্তমীর নিঝুম রাতকে সাক্ষী রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি।

    একুশে অক্টোবর; সকাল ন-টা বারো

    মহাষ্টমী। আজ বিশাখাপত্তনমে নোঙর করার ইচ্ছে। স্মৃতির ঝুলি ভরে ছত্তিশগঢ়কে বিদায় জানালাম।



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments