• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৫ | ডিসেম্বর ২০১৬ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • তেনজিঙ আর এভারেস্ট : মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়


    বাইরের গ্রিলটা ধরে নাড়াচ্ছে নাকি কেউ?

    দরজাটা খোলা নাকি? কি জোরে আওয়াজ হচ্ছে। না, চেনা কেউ না, তাহলে এতো জোরে আওয়াজ করতো না, জানত আমি আছি বাড়িতে। যাই মাকে ডেকে তুলি, আমি না ওঠালে তো আজকাল ঘুম ভাঙে না। ওঃ সাহস তো মন্দ নয়, দরজাটা ভেঙে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে।

    মা...ও মা ওঠো, দ্যাখো কে এসেছে দরজায়। এরকম করে যদি ঘুমোও তাহলে অচেনা লোক ঢুকে পড়বে একদিন বাড়িতে। সোফার ওপর শুয়েই আজকাল ঘুমিয়ে পড়ে মা...উফ খুব সাহস তো এই লোকটার। জানে না আমি বাড়িতে আছি?

    তবে দিদি আমার সাহস নিয়ে খুব হাসাহাসি করতো। আমি কিন্তু সত্যিসত্যি খুব সাহসী, সবাই মনে হয় আমাকে বেশ ভয় করে চলে, কিন্তু শুধু পাজী দিদিটা আমার সাহস নিয়ে হেসে গড়াগড়ি যায়। আর যে আসে তাকেই এই গল্পটা শোনায়, তার ওপর আবার আমার নকলও করে দেখায়। আসলে হয়েছিল কি, পাশের বাড়ির পিন্টু এসেছিলো, ওর হাতে এইটুকু একটা বেড়ালছানা। আমি সত্যি কথা বলতে কি বেড়ালদের তেমন পছন্দ করি না তাই আমি ওর দিকে বিশেষ নজর করিনি, নিজের জায়গাতেই শুয়ে ছিলাম। একদম খেয়াল করিনি। ছানাটা চুপচাপ আমার খুব কাছে এসে খুব জোরে মিয়াও করে ডেকে ওঠে। ঐটুকু শরীর হলে কি হবে...খুব গলার জোর। ইশ। খুবই লজ্জার কথা, আমি দারুণ জোরে লাফ দিয়ে দিদির কোলে সোফায় উঠে পড়ি। প্রথমে দিদি একটু চমকে গেছিলো। তারপর সে কি হাসি। হাসি আর থামেই না কিছুতেই। আর কি? এরপর থেকে বাড়িতে যেই আসে তাকে দেখায় আমি কত জোরে লাফ দিয়ে দিদির কোলে উঠে পড়েছি। আমার এতো লজ্জা করে ... দিদিটা কিছু বোঝে না...

    তবে দিদি আমাকে খুব আদরও করে। খুব। রোজ সকালে আমরা মর্নিংওয়াক-এ যাই। সকালে না, অন্ধকার থাকতে থাকতে; আমি ঠিক শুনতে পাই... দিদি একবারই ডাকে। "Zing ...Zing, Ten-Zing ... আমি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি। আমাদের গলির একদম প্রথম বাড়িটার সামনেই আবর্জনার স্তূপ থাকে। দিদি ওখানটা নাকে চাপা দিয়ে চলে যায়... বাঁ দিকে ঘুরে বড়রাস্তা। একটা হাইড্র্যান্ট দিয়ে খুব জোরে জল বেরোয়, ওখানে একজন লোক রোজ শেষরাত্রে স্নান করে। সাবানের বুদ্বুদ আর জল ছড়িয়ে যায় পীচ রাস্তায়, চকচক করে কালো রাস্তা। শেষ রাতের একটা গন্ধ আছে। একটা ঝিমঝিমে গন্ধ... ঐ সাবান আর জল মেশানো গন্ধটা। ট্রামরাস্তা দিয়ে আর একটু এগিয়ে বাঁ দিক ঘুরেই নাকে আসে বিস্কুট আর ব্রেডের গন্ধ। ওখানে পৌঁছলে আমার মনে হয় সকাল হয়ে গেলো, ওটা আমার কাছে ভোরের গন্ধ।

    পার্কের গেট দিয়ে ঢুকে দিদি আর আমি শুরু করি দৌড়, আমরা দুজনেই খুব দৌড়োতে ভালোবাসি। দিদি ধীরে ধীরে স্পীড বাড়াতে শুরু করে... মাঝখানে পুকুরের পাশ দিয়ে এক রাউন্ড ... দুই রাউন্ড। দিদির ট্র্যাক-স্যুট থেকে আওয়াজ আসে "সুউউশ্‌ সুউশ্‌"। বাঁধা চুল, হাত, হাওয়া কেটে এগিয়ে চলে... থেমে যাওয়া হাওয়া থেকে আওয়াজ আসে "সুউউশ্‌ সুউশ্‌" ... দিদির জুতো কেমন মনে হয় মাটিতে আর পড়েই না, মাটির একটু ওপর দিয়ে উড়ে চলে। আমি হাঁপিয়ে যাই, পিছিয়ে পড়ি, ও আমাকে ধরে ফেলে, তারপর হাওয়া কেটে উড়ে যায়। তবে দিদির প্রচণ্ড আনন্দ হয় ঝমঝম করে বৃষ্টি হলে, তখন বৃষ্টি ভেদ করে ও দৌড়োয়। দিদির পা জমা জলে প্রচণ্ড শক্তিতে এসে পড়ে। জল এক প্রচণ্ড তীব্রতায় ছড়িয়ে পড়ে। ওপরে মেঘ গর্জন করে... দিদির বিনুনি সপাং সপাং শব্দে পিঠে এসে পড়ে বিদ্যুতের মতো। বৃষ্টি হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে। আমিও। ভেজা ঘাস, ভেজা মাটি থেকে এক তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ... আমার মনে হয় আমার দিদি পৃথিবীর সব চেয়ে শক্তিশালী মানুষ; বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে ছুটি আমরা। এক রাউন্ড ... দুই রাউন্ড ... তিন রাউন্ড--সব কিছু ঝাপসা হয়ে চারদিকে। বাকি পৃথিবীতে কোথাও কেউ নেই, শুধু আমি আর দিদি দৌড়োচ্ছি।

    তারপর কাদাজল মেখে বাড়ি ফিরে মার বকুনি খাওয়া এরপর দিদি আমাকে স্নান করিয়ে দেয় সাবান মাখিয়ে। দিদি ভাবে দিদির মতো আমিও বৃষ্টি ভালবাসি। আসলে আমি বৃষ্টিতে বাইরে যেতে একটুও ভালোবাসতাম না, কিন্তু যখন দেখতুম মেঘে কালো হয়ে আসতো আকাশ--চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতো, বৃষ্টি শুরু হত--দিদির মুখটা আনন্দে কেমন আলো আলো হয়ে যেত... দিদির ওই মুখটা দেখার জন্যই, দিদির ওই দৌড় দেখার জন্য আমিও বৃষ্টি ভালবাসতে শুরু করলাম।

    দিদির মুখটা ওই রকম আলো হয়ে উঠত যখন সুপ্রকাশ আসত, তখন ওর ছটফটানি বেড়ে যেত। দুজনে অনেক কাগজপত্র, বই নিয়ে বসত। পুরো ঘরের মাটিতে অনেক বড় কাগজে। কেমন সব ছবি... মন দিয়ে দেখত; কম্পিউটারের সামনেও বসে থাকত অনেক--অনেকক্ষণ; তারপর আরো আরো লোকজন আসতো। অনেক রাত্রি অব্দি কথা... তখন আমাদের দৌড় আরো বেড়ে যেতো... দিদি মাঠ থেকে ফিরে আসার সময় আমাকে অনেক কিছু বলত... আর ওর মুখটা জ্বলজ্বল করত।

    তারপর শুরু হত প্যাকিং। অনেক জামাকাপড়, জ্যাকেট নানা গগল্‌স, টুপি গ্লাভ্‌স... কত রকমের মেটালের জিনিস কত রকমের ছোট ছোট মেশিন, শক্ত নানান রঙের দড়ি, বড়ো বড়ো ব্যাকপ্যাকস। আমার মনে আছে দিদি আমাকে কম্পিউটারে দেখিয়েছিলো তার নিজের একটা ছবি। একটা মেটালের যন্ত্র, যেটা আমি দেখেছি দিদির ব্যাকপ্যাকে, সেটাকে একটা সাদা খাড়া--খুব খাড়া দেওয়ালে গেঁথে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে, দিদির কোমরে এই শক্ত দড়ি বাঁধা। দিদির আরো ওপরে আর একজন মানুষ, তার কোমরেও দিদির ঐ দড়ি তার আর এক প্রান্ত বাঁধা। আমার ছবিটা দেখে খুব ভয় লাগছিলো, তবে ওর মুখে কোনো ভয় ছিল না... চোখ শুধু ঐ খাড়া দেওয়ালটার মাথায়, যার ওপর শুধু আকাশ। দিদি আর ঐ খাড়া দেওয়াল ছাড়া আর পৃথিবীতে কিছু নেই... তবে প্যাকিং শুরু হতেই আমার মন খারাপ শুরু হয়। জানি অনেকদিনের জন্য চলে যাবে। সেই সময় মারও কিছু ভালো লাগে না। মা চুপচাপ হয়ে যায়। আমার মাথায় হাত বোলায়। যেটা খাওয়ালে দিদি রাগ করে সেগুলো ও আমাকে দিয়ে দেয়। ফোন বাজলেই মা কেমন চমকে ওঠে, কেউ বেল বাজালে চমকে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরে... দরজা খুলে দেয়।

    একদিন দিদি ফিরে আসে... কি হাসি তখন তার মুখে! বাড়িতে কি আনন্দ। মাও যেন সব ভুলে গিয়ে কত রান্না করত। সারাদিন গল্প আর কত লোক আসত। দিদি অনেক ছবি দেখাত কম্পিউটারে। অনেক ছবি... তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি দিদির ওই ঝকঝকে হাসিমুখ--টুপি গগল্‌স-এ দিদির মুখটা ঢাকা। পেছনে একটা বিশাল কুলপির খোলের এর মতো পাথর--সাদা ঝকঝক করছে। অনেক উঁচু। ওর হাসিটা ওই ঝকঝকে আলোর থেকেও বেশি। ওকে টিভিতেও একবার দেখেছিলাম--ওই ছবিটাই বারবার দেখাচ্ছিলো। সেদিন বাড়িতে কি আনন্দ। কত লোকজন ঢুকছে বেরোচ্ছে কোনো হিসেব নেই। রান্নাঘরে কত কিছু রান্না হচ্ছে। তবে ফিরে এসে দিদি কিছুদিন খুব ক্লান্ত থাকত। লোকজনের যাতায়াত কমে গেলে খুব ঘুমতো, সকালে উঠতে পারত না... যখন লোকজন চলে যেত, মা গরম জল করে দিত। তাতে হাত বা পা ডুবিয়ে বসে থাকতো। দেখতাম দিদির হাত, পা এর আঙুল কেমন নীল... কালো হয়ে গেছে। ঐ সময়ই ঘুমিয়ে পড়তো। সকালে উঠতে পারতো না। তারপর আস্তে আস্তে কিছুদিন বাদে আবার শুরু করতাম বেরোনো।

    দিদির ঘরে একটা মস্ত বড় ছবি আছে--দেয়ালজোড়া। একটা বিরাট বড় সাদা রুপোলি চকচকে বিরাট পাথর। আর নীল আকাশ। আর শুধু সাদা আর সাদা। একদিন দিদি আমাকে দেখিয়েছিল... ওই বিশাল সাদা জায়গায় পিঁপড়ের মত ছোটো ছোটো প্রাণীগুলো, আসলে মানুষ। তখন আমি বুঝলাম ওই পাথরটা আসলে কত উঁচু। ওই ছবিটা দেখলেই দিদির চোখ মুখ পাল্টে যেত ...তাকিয়ে থাকত ঐদিকে। মনে হত দিদি মনে মনে ওই মানুষগুলোর সাথে হাঁটছে। দিদি আর ওই ঘরের মধ্যে নেই ... ওখানে পৌঁছে গেছে। ঐ সাদা রুপোলি কোনাচে মস্ত উঁচু পাথর, যার সামনে মানুষদের পিঁপড়ের মতো লাগে, তার ওপরে উঠতে চায় দিদি, আকাশ ছুঁতে চায়।

    দিদি অনেক অনেক দিন বাড়ি আসেনি। একদিন সন্ধেবেলা টিভিতে দিদির ছবি দেখাচ্ছিল, মা খুব কাঁদছিল। বারবার ফোন করছিলো। তারপর সুপ্রকাশ এলো... মার সাথে কথা বলছিলো। মা বিছানায় শুয়ে পড়লো, ডক্টর কাকু এলো... মা বিছানা থেকে উঠতো না, শুধু অনেক লোক আসতো বড়ো বড়ো ক্যামেরা নিয়ে। কত লোক। ...

    মা এখনও সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে, প্রথমদিকে অনেক লোক আসতো, অনেক ফোন, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দিদির ঘরে ওই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে, হাত বোলায় ...আমারও তখন মনে হয়... দিদি ওখানেই আছে... হয়ত ওই ছবির ছোটো ছোটো পিঁপড়ের মত মানুষগুলোর সাথে হাঁটছে। ওখানেই আছে দিদি। ওই মানুষগুলোর সাথে। ...হেঁটে চলেছে। মা খায় না... আমাকে যা হয় দিয়ে দেয়। যদি মনে থাকে। আমার খিদে পায় না... কিছু ভালো লাগে না... সারা বাড়ি অগোছালো নোংরা... ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে আরো জিনিস প্রত্যেক দিন... বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় দিদির একটা দৌড়োনোর ট্র্যাকস্যুট ঝুলছে, মা ওটা ওখান থেকে তোলে না আর, ওটা বৃষ্টিতে ভেজে, রোদ্দুরে পোড়ে। ওটা দেখলে আমি মাঠে দৌড়োনো দিদিকে দেখতে পাই ...বারান্দার দিকের দুটো জানলার কাচ ভেঙে গেছে, ঝড় উঠলে ধুলো বালি সব ঢুকতে থাকে। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে যায়... আর যখন বৃষ্টি আসে... জল আসে ওই ভাঙা জানলা দিয়ে। আমার গা ভিজে যায়... মাটি ভিজে যায়... আমি নড়ি না। থাবার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে শুয়ে থাকি। আমি তেন-জিং অপেক্ষা করি আমার দিদি ফিরবে। ...মস্ত ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাসি মুখে। ওই দরজা দিয়ে। দিদি জানে আমি দিদির জন্য বসে আছি। থাকবো। আর কাল ভোর হবার আগে শুনতে পাবো "জিং...তেন-জিং...লেট'স গো"।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments