• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৫ | ডিসেম্বর ২০১৬ | গল্প
    Share
  • কল-কল্লোল : অনুষ্টুপ শেঠ



    কাল থেকে কলতলায় বসে আছি।

    না মশাই, শরীর এক্কেরে ঠিক হ্যাজ। আর এ আপনার শাওয়ার দিয়ে ঝরোঝরো বারিধারা কি তিন ফুট উচ্চতায় প্যাঁচআলগা কল দিয়ে জল পড়া কলতলা নয় মোটেও। এ অন্যকল, যার কব্জায় পড়ে আমার কান মাথা পিঠ বিকল হবার জোগাড় হয়েছে।

    ( কল দিয়ে জল পড়া বলতে, একটা খাসা গল্প মনে পড়ল। মনে করিয়ে দেবেন তো, বলব পরে।)

    মানে সিম্পুল, সকাল থেকে একটা কনফারেন্স কলে বসে আছি। প্রায় ঘন্টাখানেক নাগাড়ে চলছে। মাঝে অবশ্য ফোন মিউট করে রেখে পাঁইপাঁই করে একবার ওয়াশরুম ঘুরে এসেছি, কিন্তু কফিটা খাওয়া হয়নি আর। ফলে মাথা ভার, একটানা বসে থেকে থেকে পিঠ টনটন।

    আর কান নিয়ে কিছু না বলাই ভাল, এমনিতেও আমার ঐ অঙ্গটি নিয়ে বাজারে একটু সুনাম আছে। হেডফোন পরে থেকে থেকে সেটি আপাতত ভোঁভোঁ করছে। তারপর বিশ্বমৈত্রী সম্মেলনের মত গুচ্ছ ভিন্ন ভিন্ন দেশের লোক জুটেছে এই কলে — এই কোনো রাশিয়ানের গাঁক গাঁক গলায় বোমা ফাটছে, তো তার পর কোনো জাপানী ললনা অসম্ভব মিষ্টি করে তিনটে লাইন বলতে তিন মিনিট নিচ্ছেন; খাস ব্রিট অ্যক্সেন্টে কেউ দুর্বোধ্য মতামত দিয়ে গেলেন তো পরক্ষণেই সানুনাসিক ফরাসী বড়কর্তা তাকে নস্যাৎ করে দিলেন, তাতে আবার দুই মহিলা, কে জানে কোথাকার, হে হে করে এমন দীর্ঘায়িত হাসি জুড়লেন যে শেষে সবাইকে কি একটা করতে হবে বললেন শুনতেই পেলুম না!

    কি জানি কি ইম্পর্ট্যান্ট মেসেজ মিস করলুম, সেই চিন্তায় পাশের জনের দিকে সপ্রশ্ন চোখ তুলে দেখি সে ঢুলুঢুলু চোখে ভারি চিন্তামগ্ন। দুবারের পর তিনবার ডাকাতেও যখন সে চিন্তার সূত্র ছিন্ন করতে পারলুম না, তখন তার সেই পারমার্থিক চিন্তায় ব্যাঘাত না করে অন্যদিকে মনোনিবেশ করলুম।

    চোখের সামনেই বস বসে। আয়েস করে চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে কল অ্যাটেন্ড করছে। যদিও শুনতে শুনতে হাতের আঙুলে তাল দেওয়াটা বেশ একটু সন্দেহজনক, কলই তো, কলেরগান তো নয় রে বাপু! তবু, কিছু শুনতে মিস করেছি এটা বসকে বলতে যাব এত তালকানা আমি নই। কাজেই তাকে বাতিল করে অন্যদিকে তাকাই।

    এ পাশের মেয়েটি এখনো ধ্যানমগ্ন। ওপাশের ছোকরা হেডফোন খুলে রেখেছে — অ্যাই কিরে? ম্যান্ডেটরি কল না? তোর তো হেবি আস্পর্ধা!

    কাতর মুখে সে জানাল প্রোডাকশন ইস্যু এসেছে তার অ্যাপ্লিকেশনে, আমি যেন পরে তাকে কলের আপডেট দিয়ে দিই।

    তথাস্তু, যা যা সামলা।

    তার পাশের গুরুভার হরিশ দাদা প্রবল খচমচ করে ড্রয়ার হাঁটকাচ্ছে। চোখাচুখি হতেই আকুতি, তিনি ক্ষুধার্ত, সকালে অফিস এসে ব্রেকফাস্ট করেন, আজ কলের চক্করে হয়নি, আমার কাছে কোনপ্রকার খাদ্যবস্তু থাকলে যেন এক্ষুণি দিই। বুঝে নিই এনাকে জিগিয়ে লাভ নেই, এনার এখন পৃথিবী গদ্যময়, কলকাকলি এনার মরমে পশিছে না। বিস্কুটের প্যাকেট ছিল বটে একটা, হস্তান্তরিত করি।

    এহেন সময় গুরুগুরু রবে মেঘ ডেকে উঠল নাকি? না। উচ্ছ্বসিত হাসি চাপতে চাপতে পিছনের দুই ললনা জানালেন যে কোনের সীটের সিনিয়র নীলেশবাবু নাক ডাকাচ্ছেন। কাগজ পাকিয়ে, সরু রোল করে, তার ডগাটা ঝিরিঝিরি করে ছিঁড়ে, কানে সুড়সুড়ি দেবার মহাস্ত্র প্রয়োগের ডেমোটা দেবার লোভ বহুকষ্টে সংবরণ করে ফেললুম, শেষে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের দায়ে পড়ে যাই আর কি! হরিশ দাদার পিছনের গুঁফো ভদ্রলোক অবশ্য এসবের ধার ধারেন না, দিব্যি কাঁধে টোকা মেরে অমন পুরুষ্টু ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়ে এলেন।

    বসের হাতে তাল দেওয়া থেমে গেছে। ইকি, আমার দিকে এমন হাসিহাসি মুখে তাকায় কেন? আবার মাথাও নাড়ে দেখি, খাইসে, এদিক ওদিক দেখতে গিয়ে আবার কি শোনা মিস করে গেলুম? আরে হেসেই যাচ্ছে, কি জ্বালা, ফিরতি হাসি হেসে গাল ব্যথা হয়ে গেল যে! কলে তো ষোল না সতেরো নম্বর পাতার গ্রাফ নিয়ে আলোচনা চলছে, যার সাথে আমার অ্যাপ্লিকেশনের দূরদূর তক কোন সম্বন্ধ নেই। এত প্রেম তো ভাল নয় রে বাবা!

    ওঃ, তাই বল। তেনার বস আমার পিছন বাগে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর পানে চেয়ে-চেয়েই এনার আঁখি না ফিরে! হাঁফ ছেড়ে আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দিই। তদারকি সেরে, বসের বস সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে গেছেন টের পাই যখন দেখি বস আবার আঙুলে তাল দিতে শুরু করেছে।

    এরপর আরো তিন পাতা এরকম বহুমাত্রিক উচ্চারণে পার হয়ে যায়। আমি শুনতে শুনতে রাফ কাগজে একটার পর একটা কাটামুণ্ডু আঁকি, গোটা তিরিশ বাজে মেইল ডিলিট করি, এমনকি রোববার পিজ্জা খাওয়া উচিত কিনা তার লাভ-ক্ষতির ব্যালান্স শীট অবধি মনে মনে বানিয়ে ফেলি। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর দশ মিনিট, ভেবে বেশ লাড্ডুপানা আহ্লাদ হচ্ছে মনে, হঠাৎ হেডফোনের মধ্যে 'টিং গিটিং গিটিং গিটিং গিটিং টিং টিং'।

    সবাই আঁতকে উঠে যার যার মোবাইল হাতড়াতে লাগল।

    কলের বক্তা থেমে গেছেন, সেই দুই মহিলা আবার সেই ভয়ানক লুটোপুটি হাসি জুড়েছেন, তার সাথে একাধিক পরুষ পুরুষ কণ্ঠ যোগ দিয়েছে। আর আমাদের সবার কানে সুধারস ঢেলে হেডফোনে বেজেই চলেছে 'টিং গিটিং গিটিং গিটিং গিটিং টিং টি...'

    ওরে যেই হ', মোবাইল ফোনটা ধর, আর এদিকে মিউট কর!

    'টিং গিটিং গিটিং গখ চমচক্যাঁক ধাম!'

    একটা লজ্জিত স্খলিত জড়িত এবং অতি পরিচিত কণ্ঠে 'ভেরি সরি, ভেরি সরি'।

    দূর কর্নার সীট থেকে মিতভাষী শেয়ারমার্ক-বিলাসী মোহনভাই টমেটোর মত লাল মুখে ফোন কানে প্রায় ছুটে পালিয়ে যায়। নির্ঘাৎ বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে ইন্ডেক্সের ওঠাপড়া দেখছিল!

    তারপর স্তব্ধতা কাটিয়ে ফরাসী বড়কত্তার মিঠে মন্তব্য 'দ্যট ওয়াজ সাম রিং-টোন!'

    আবার হি হি হে হে পেরিয়ে কলতান প্রবহমান। আমি এই ফাঁকে আপনাদের সেই মনে পড়ে যাওয়া মজার গল্পটা বলে নিই, কেমন?

    এটা সত্যিঘটনা কিন্তু আমি মোটেও আপনাদের স্থানকালপাত্র কিছু বলব না। অনেকদিন আগের কথা, তখন মোবাইল ফোন কেন ল্যান্ডলাইনে কলার আইডি অবধি ছিল না। কলকাতার উত্তরে কোন এক ইন্সটিটিউটের ছেলেদের হোস্টেলে, কোন এক অতি বুদ্ধিমান ও ততোধিক বিচ্ছু ছাত্র র‍্যান্ডম নাম্বারে সন্ধ্যা রাতে ফোন করে ভারি গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করত, 'কলকাতা কর্পোরেশন থেকে বলছি, একটু চেক করে এসে বলবেন আপনাদের বাড়ির কল থেকে জল পড়ছে কিনা?'

    নিঃসন্দেহ গৃহস্থ যখন এসে জানাত যে হ্যাঁ, কল দিয়ে জল পড়ছে, তখন এই মিচকে বালক গম্ভীর ও ভর্ৎসনাপূর্ণ গলায় 'কল দিয়ে জল পড়বে না তো কি কোকাকোলা পড়বে?' বলে ফোন কেটে দিত।

    না মশাই, সেই বালক, সেই গৃহস্থ, সেই ইন্সটিটিউট বাসেই হোস্টেল নিয়ে আমি এখন আর কিচ্ছু বলব না। ব্যাক টু কল।

    কল এখন শেষ প্রায়। শেষ হবার আগে বড়কত্তা আবার বললেন 'রিমেমবার হোয়াট আই সেইড আর্লিয়ার, এভরি ওয়ন হ্যাজ টু ডু দ্যট।'

    ডু হোয়াট, ডার্লিং?

    চারপাশে সবাই ভ্যাবলকান্তি মুখ করে বসে। অচিরাৎ বোঝা গেল, পাতা পাতা মাথা ঝিমঝিম করা গ্রাফ আর টেবিল মন দিয়ে অনুধাবন ও অনুশ্রবণ করলেও, কেউই ওই বিশেষ কথাটা খেয়াল করে শোনেনি। কাজেই কেউ জানে না কি সে বিশেষ কাজ যা সব্বাইকে করতে হবে।

    অগতির গতি বস। কিন্তু তাকে বশ করবে কে?

    এসব শহীদ হবার কাজ এমনিতে মোহনভাই-ই করে থাকে। কিন্তু আজ তো সে সেই যে সীট ছেড়ে উধাও হয়েছে, চট করে আর এদিক পানে আসবে বলে মনে হয় না! অগত্যার গোঁত্তা খেয়ে আমিই গুটিগুটি পায়ে এগোই।

    বস! বলছি কি...

    সমপরিমাণ সমীহ আর আহ্লাদ মিশিয়ে বক্তব্য পেশ করি। সব্বাই কি করে জানি ঐ জরুরী কথাটাই মিস করে গেছি। প্রমাণস্বরূপ চাদ্দিকে সবাই যে চাতকচক্ষে এদিকে চেয়ে আছে তাও দেখিয়ে দিই।

    তা, ইয়ে, কি করতে হবে বস?

    ধুত্তোর, আবার হাসে! এ লোকটা হেসে হেসে আর আমায় জবাবী হাসিমুখ করিয়ে করিয়ে গালে বাত ধরিয়ে দেবে দেখছি!

    কি?

    ক্কি? ঠিক শুনছি? মানে... বড়কত্তা এটাই বলেছেন? 'য়্যু হ্যাভ টু ফলো কম্পানি পলিসি'? অ্যাঁ! এটা আবার এত ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার কি আছে?!

    বস আমার বিহ্বল বদন দেখে আরো আমোদিত হন।

    'হোয়াট এলস ডিড ইউ এক্সপেক্ট ইন আ কম্পলায়েন্স কল?'

    তাও তো বটে! কল থেকে জল পড়বে না তো কি কোকাকোলা পড়বে!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments