গল্পশিকারী সময়ের অবয়ব থেকে ছিঁড়ে আনে ঘটনার তন্তু। কিন্তু কখনো কখনো হাতে একাধিক সুতোর টানা উঠে আসে যার একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি ঘটে উঠতো না। পরমাণু ভাঙতে গেলে যেমন ছিটকে আসে আজবকণারা, কখনো সখনো। তখন আর কাঁটা না বেছে, যেমন আছে সাজিয়ে দেওয়াই সঙ্গত।
১-গ্রীন রুম
—লক্ষ্য করেছিস? অতনু আজ তোকে দেখে, ঘাবড়ে-টাবড়ে গিয়ে তার ছিঁড়ে ফেলল।
—শ্ শ্ শ্। বাজে বকিস না। ও একটা আকাট। দেখছিস না, পাল্টাতে গিয়ে ভুল করে জুড়ির তারের যেটা ছেঁড়েনি সেটারই কান খুলে ফেলেছে!
—ওহে রাইকিশোরী, জুড়ির তার, একটির বিহনে অন্যটি কি বাঁচে?
—ওহে কুটিলা, তারেদের ব্যাপারে আর কি জান, কহ!
—জানি, জানি। তারে কিঙ্ক এসে গেলে, সে তার চড়ালেই ছেঁড়ে। যেমন তোদের...
কথা শেষ হবার আগেই তাঁতের নতুন শাড়ির খসখস। অতনু ওদের দিকে পিছন ফিরে তানপুরায় তার চড়ালে কি হবে, একমাথা সিঁদুর পরা শিঞ্জিনীর বেরিয়ে যাওয়াটি দেখল ঠিক, মনে মনে।
২-অডিটোরিয়াম
কিরবাণীতে আলাপ-জোড় শেষ করে বিলম্বিত গৎ ধরতে না ধরতেই নায়কী তার ছিঁড়লো। উস্তাদ রাস্তা বদল করলেন। সোজা গোরখকল্যাণের রজাখানি গৎ। ডা ডির ডা রা। ম রে নি রে সা। বেশিদূর গেল না, আবার। ভারতবিখ্যাত উস্তাদের ভ্রু কুঞ্চিত। আবার চাল পাল্টে দরবারি।
অডিটোরিয়ামে একদম সামনের সারিতে একটি শ্যামলী করপল্লবে একটি কমলহীরে অস্থির ভাবে নড়ে উঠছিল বার বার। আর কেন, আর কত ইমপ্রেস করা বাকি? এবার একটু থিতু হও।
ডায়াস থেকে উস্তাদও দেখছিলেন বিক্ষুব্ধ হীরের ঝলক-নৃত্য। বারো বছরে বাবার সাথে আসরে বাজিয়ে শুরু, আর কাকে ইমপ্রেস করবো। গান বাজনা শিল্পকলা এ সবের মূলে যে ওই একটি কথা, যেটা বলতে চাই, বারবার নানাভাবে, অথচ মুখে বলে উঠতে পারলাম না কোনদিন । সামনে এলেই কথা হারিয়ে যায় ...অস্থির হাতে তার ছিঁড়ে যায় ...আর বলাই হল না।
তুমিও তো সেই বালিকা বয়স থেকে এই সার্কিটেই। আজ কলকাতা ক, কাল ক্যালিফোর্নিয়া। কথাটা কি বোঝো না? বোঝো নি এখনও?
৩-ফয়ার
অডিটোরিয়ামের, গ্রীনরুমের কৃত্রিম শীততাপনিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের রুক্ষ নিষ্ঠুর ডিসেম্বরের শুষ্কতা বরং ভাল লাগছিল শিঞ্জিনীর। কিন্ত ভেতরে যেতে হবে, এখন যতই হাতের কমলহীরেটি ঝলকান, ওস্তাদজির বাজনা শেষ হলেই বেগম সাহেবা গ্রীনরুমে ফিরে গলা গরম করতে বসবেন, তাকেও থাকতে হবে সাথে। গুরুর সঙ্গে আজ তারই বসবার কথা।
চটপট মোবাইলে নাম্বার ডায়াল করে সে।
—তুমি কখন আসবে?
—সে কি!
—আচ্ছা।
সুজিত এক বিমান সংস্থায় কাজ করে। আজ অপ্রত্যাশিত কারণে দেরি হবে তার। তাদের একটি উড়োজাহাজ বিগড়েছে, না মেরামত হলে উড়ান বাতিল হবে, তারপর লোকসান, মিডিয়ার কোলাহল। সুজিত বলল আজকাল আধুনিক প্রযুক্তির সব উড়োজাহাজ নাকি তার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোথাও ছিঁড়ে গিয়ে থাকবে।
ফোন রাখতে রাখতে অজানা এক শীতে কেঁপে ওঠে সে।
—আচ্ছা, আপনারা পজেশন কবে দেবেন?
—ম্যাম, উইদিন এইটিন মানথস। জাস্ট হ্যাভ আ লুক অ্যাট দি প্রজেক্ট। সেলফ কনটেইনড। ২৪ আওয়ার্স জেনারেটর ব্যাক আপ, মডার্ন ক্লাবহাউস, রিভার প্রমেনেড।
সীমা পুরোটা না বুঝলেও, এক একটা শব্দ তার মনে স্বপ্ন রচনা করে। দীপক মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল। ছেলেটা আবার টাই পরে ইংরাজি মারাচ্ছে!
টাই-পরা স্বপন-ফেরিওয়ালা কিন্তু ধরে ফেলেছে কিসসু হবে না। ওরা উঠলে সে এক ফাঁকে সেই ঠাকুরনগর থেকে সাথে নিয়ে আসা দুটো রুটি আর ঢেঁড়সভাজা খেয়ে নিত এতক্ষণে। কিন্তু সেই রুটি-ঢেঁড়সের নিরন্তর স্রোতের স্বপ্নেই তো বসে থাকা, প্রাণপণে ভুল উচ্চারণে ইমপ্রেস করা। আরেকটা স্বপ্ন তো তার পার্সের ফ্ল্যাপে কাগজের ভাঁজে ভাঁজেই ক্রমবিলীয়মান। তাকে আলটিমেটামই বলো আর টিকিং টাইমবম্ব —একই ব্যাপার। তুমি তো সেই যাবেই চলে।
স্বপনসন্ধান-২
প্রজেক্ট অফিস থেকে বেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছিল দীপক। সীমা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তাল রাখতে পারছিল না। বুঝেছে —দীপক রেগে আছে। কিন্তু কেন? তারা তো এভাবেই প্রতি রবিবারে বেরিয়ে পড়ে, কখনো বাসে, কখনো শেয়ারের অটোতে গোপালপুর, কালিকাপুর আবার ওদিকে মহেশতলা, জোকা ছাড়িয়ে চলে যায়, এভাবেই তন্ন তন্ন করে এক টুকরো নিজস্ব ছাদ খুঁজে যায়, সে তবে কিসের জন্য?
—শুনছো? একটু আস্তে পা ফেল না!
দীপক তার চোখের দিকে তাকায় না, বলে — দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সীমা অবাক হয়ে ভাবে রবিবারেও কিসের দেরি, সবে তো দুটো। বাড়িতে থাকলে তো এতক্ষণে পাড়ার রোয়াক থেকে ...। কাছাকাছি আসতে দীপক প্রায় হিসহিস করে বলে ওঠে--একটু কম কিছুতে, সস্তা কিছুতে সুখী হবার চেষ্টা করো। আমাকে খোলা হাটে বেচলেও যা ফ্ল্যাটের দাম...
সীমা চোখ বন্ধ করে। আমাকে একটু সূর্যালোক দাও, তোমাদের ছিদাম মুদী লেনের খুপরি ভাড়াবাড়ির যৌথ সংসারে আমি আর পেরে উঠছি না। মুখে বললো, চলো না একটিবার ওই গ্রেট বাজারটায় ঢুকি।
স্বপনসন্ধান-৩
গ্রেট বাজার দোকানটার সামনে হকার, চা ওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালা এসব পাঁচপেঁচি লোকের ভিড়। তারমধ্যেই বাচ্চাটা দেখে ফেলেছে। বেলুন। গ্যাস বেলুন, কোনোটা মুরগী তো কোনোটা মাছ, বাঘ, আরো কত কি, বর্ণাঢ্য।
দীপক দাম জিজ্ঞেস করে। কিন্ত এগুলো বেশ দামী, যেমন তেমন নয়, বুঝে পিছিয়ে এলো। বাচ্চা তারস্বরে কাঁদে। তখনই সীমা দেখে বেলুনওয়ালার হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে আরেকটা বাচ্চা। নাকে সিকনি, হাতে একটা গ্লাস।
সীমা দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজের পার্স থেকে পয়সা বের করে একটা বড়সড় উজ্জ্বল কমলা রঙের মুরগী নেয়। মুহূর্তের মধ্যে বেলুনওয়ালার বৌ এসে হাজির হয়, স্বামীর থেকে পয়সা নিয়ে, ছেলেটাকে কাঁকালে নিয়ে দৌড় দেয়। ছেলেটার মুখের হাসিটা প্রায় অপার্থিব লাগে সীমার।