প্রমোদবাবু জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। বাইরে গাছের পাতাগুলো আস্তে আস্তে ঝরছে হাল্কা হাওয়ায়। কড়া রোদ, তাই কেউ বড়ো একটা নেই রাস্তায়। নিঃসঙ্গ রাস্তা।
“কি, মুখার্জি সাহেব, আসবো?” অরিন্দমবাবুর বাজখাঁই গলা ভেসে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন প্রমোদবাবু। মুখে আর চোখের কোলে একটা হাসি খেলে গেলো ওনার। চওড়া একটা হাসি মুখে মেখে নিয়ে সাড়া দিলেন একটু জোরেই—
“আসুন, আসুন অরিন্দমবাবু। আপনার কথাই ভাবছিলাম।"
“তাই?” পাশের ইজি চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বললেন অরিন্দমবাবু।
“তা কাল কিরকম হারলো আপনার ইস্টবেঙ্গল?” বললেন প্রমোদবাবু, স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হাসি দিয়ে।
“গত দশটা ম্যাচে হেরে একটা কেঁদে ককিয়ে জিতেছেন। তাই নিয়ে এতো?”
দুলে দুলে হাসলেন প্রমোদবাবু। অরিন্দমবাবুর ইস্টবেঙ্গলকে কিছু বলা যাবে না। একটু গুছিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন প্রমোদবাবু—
“আসলে এদ্দিন মোহনবাগান ঠিক রিদমটা পাচ্ছিলো না, এবার পেয়ে গেছে। এবার দেখবেন, শৈল্পিক ফুটবল কাকে বলে। আপনাদের ইস্টবেঙ্গলের ড্যাশ আর শোলডার-চার্জ করা খেলা নয়, ফুটওয়ার্ক আর ড্রিবলিং-এর শিল্পকলা। সুরজিৎ সেনগুপ্ত, কৃশানু দে, সত্যজিৎ চক্রবর্তী, প্রসুন ব্যানার্জি — এই ঘরানার খেলা। বুঝলেন?”
হাঁ হাঁ করে উঠলেন অরিন্দমবাবু — “সুরজিৎ-কৃশানুর রমরমা কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেই। ওদের কোন হিসেবে মোহনবাগানের খেলোয়ার ধরছেন আপনি?”
“খেলা শিখেছে মোহনবাগানে থেকে। সেইটাই আসল কথা — বুঝলেন?”
সাড়া শব্দ নেই ওদিক থেকে আর। মনে মনে আবার হাসলেন প্রমোদবাবু। অরিন্দমবাবুকে চুপ করিয়ে দিতে পেরে বেশ ফুর্তি হলো প্রাণে। অরিন্দমবাবুর পরের কথাটাতেও এলো সন্ধির ভঙ্গি “একটা গান শোনাই আপনাকে”।
প্রমোদবাবু একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন “আপনার ওই “বাংলা ব্যান্ড” তো? ও আমার পোষায় না মশাই। কেমন যেন বিলিতি সুর মনে হয়।"
“আরে না, না। এ হচ্ছে আপনার পছন্দের জিনিস। ঋতু গুহ। চালাই?”
“ও হো — তাহলে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু ওটা আবার কি?”
অরিন্দমবাবু নিজের ফোনটা টেবিলে রেখে একটা চৌকো বাক্স তার পাশে রেখে কি সব যেন টেপাটেপি করছিলেন। মুখ না ফিরিয়েই বললেন—
“একে বলে ব্লু-টুথ স্পিকার। ফোনের সঙ্গে পেয়ার্ড হয়ে যাবে। তার লাগবে না। ফোনের থেকেই গান চলবে।"
“ফোনের থেকে গান চলবে? ফোনের মধ্যে গানটা রাখা থাকবে? রাখা যায় বুঝি?”
“যায়।" বললেন অরিন্দমবাবু। “তাছাড়া ইউ-টিউব থেকেও সরাসরি চালানো যায়।"
“ইউ-টিউব মানে?”
“আরে মশাই — ইন্টারনেট। ইন্টারনেট-এ একটা জায়গায় অনেক গান, সিনেমা রাখা থাকে। যে কেউ ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে গান শুনতে পারে। আপনি ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে গিয়ে সেখান থেকে ইউ-টিউব-এ গিয়ে গান শুনতে পারবেন। আরে সে গানও এই স্পীকারে বাজবে।"
প্রমোদবাবু একটু অবাকই হলেন। তারপর বললেন “আপনি বেশ টেক-স্যাভি হয়ে উঠেছেন তো!”
“যুগের হাওয়া”, বললেন অরিন্দমবাবু। তারপর বললেন “মুখার্জি সাহেব, এই স্পিকারটা কিন্তু আপনার জন্যেই এনেছি। উপহার। আপনার ফোনের সঙ্গে লাগিয়ে দেবো। নিজে নিজে গান শুনবেন।"
মাথা নাড়লেন প্রমোদবাবু, “না মশাই, ওসব পোষাবে না। আপনি যখন আসবেন, একসঙ্গে শুনবো না হয়।"
“সে দেখা যাবে। আগে এই গানটা শুনুন। “মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে?”
প্রমোদবাবু চোখ বুজে গান শুনতে লাগলেন। একসময় বলে উঠলেন “আহা। কি গলা ঋতু গুহর। আর মনে হয় প্রতিটি শব্দ একেবারে হৃদয় দিয়ে উচ্চারণ করছেন।"
“যা বলেছেন।"
“শুনুন অরিন্দমবাবু, মন দিয়ে শুনুন। এই যে গাইলো ‘তারে বলে আসি তোমার বাঁশি, আমার প্রাণে বেজেছে’ — আহা — বড্ড ভালো গেয়েছে গো।"
“মুখার্জি সাহেব — এবার শুনুন “মম দুঃখের সাধন, যবে করিনু নিবেদন...”
এবার চোখ খুললেন প্রমোদবাবু। ভুরু কুঁচকে শুনতে থাকলেন গানটা। কিন্তু শেষ হবার আগেই বলে উঠলেন—
“ভালো, কিন্তু এটাতে জর্জ বিশ্বাস কাউকে দাঁড়াতে দেয়নি মশাই।”
“সে কি মশাই,” বললেন অরিন্দমবাবু, “আপনি তো জর্জ বিশ্বাসের তেমন ভক্ত নন বলেই জানতুম।"
প্রমোদবাবু একটু বিরক্ত হলেন। সুইপিং স্টেটমেন্ট জিনিসটা ওর ধাতে নেই। গলা খাকরানি দিয়ে বলতে থাকলেন, “তা নয়। উনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা করেছেন। আমি তো একেবারে শান্তিনিকেতনী আর দক্ষিণী ঘরানার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বড়ো হয়েছি, তাই একটু কানে লাগে। কিন্তু কিছু কিছু গান জর্জ বিশ্বাসের গলায় ছাড়া ভাবা যায় না।"
“যেমন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’?”
“হ্যাঁ, ওটা ভালো, কিন্তু আমাকে যদি জিগ্যেস করেন, ‘আমার জ্বলে নি আলো অন্ধকারে’-টা একেবারে বুকে মোচড় দিয়ে যায়। আর ‘আমি চঞ্চল হে’-টাও বড়ো ভালো গেয়েছেন। কিংবা ‘কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন’।"
“একেবারে ঠিক বললেন এটা।"
গান শেষ হয়ে এসেছিলো। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমোদবাবু বললেন “দেবব্রত থাকলে চালান না দুএকটা?”
“পরের দিন নিয়ে আসবো। আপনার জন্যে বর্তমান কাগজের শব্দ-জব্দ গুলো নিয়ে এসেছি। আপনার তো এখানে আনন্দবাজার।"
খুশি হয়ে উঠলেন প্রমোদবাবু। “ওঃ, বাঁচালেন। আনন্দবাজারেরটা এতো সোজা যে দশ মিনিটে হয়ে যায়।"
“তাই তো নিয়ে আসা। এবার উঠি। আপনার তো খাবার সময় হলো? খেয়ে নিন এবার।" বলে উঠে পড়লেন অরিন্দমবাবু।
“আপনিও খেয়ে যান না! আজ মৃণাল পটলের দোলমা বানিয়েছে। চিংড়ি মাছের পুর দিয়ে — আপনাদের ওই কিমা-টিমা দিয়ে করা জাল জিনিস নয়। তার সঙ্গে সোনামুগ ডাল, কুমড়োর বেসন ভাজা, ঝিরি ঝিরি আলু ভাজা, দই মাছ, ছানার ডানলা।"
“আপনাদের বাড়ির শুক্তোও খেতে আমার খুব ভালো লাগে।" বললেন অরিন্দমবাবু।
“সেও আছে বোধহয়। ওর আসল জিনিস হলো ডাঁটা। ওইটিতেই ম্যাজিক।"
“শেষ পাতে চাটনি?”
“আলবাত!! টমেটোর চাটনি। তারপর যাদব দাশের সাদা দই।"
“গাঙ্গুরাম নয়?”
এবার গরম হয়ে উঠলেন প্রমোদবাবু। খেতে আর খাওয়াতে উনি বরাবরই ভালো বাসেন। খাদ্য রসিক বলা যায় ওনাকে।
“অর্বাচীনের মতো কথা বলবেন না তো! গাঙ্গুরাম! ও তো একটা কমার্শিয়াল দোকান। ভালো মিষ্টি হলো একটা শিল্প।"
অরিন্দমবাবু হাসি চেপে প্রশ্ন করলেন “তা আজকের মিষ্টিটা কার?”
“এটা নতুন দোকান — সুরেশ। কিন্তু দুর্দান্ত। মাখনের মতন মোলায়েম কাঁচাগোল্লা। মধুর।"
“তাহলে বসে যাওয়া যাক।" বললেন অরিন্দমবাবু।
“চলুন, চলুন।"
“গীতা,” হাঁক পাড়লেন অরিন্দমবাবু। “এখানে খাবারটা দিয়ে যাও না।”
“বাবা– ও বাবা।"
“অ্যাঁ!” ধড়মড় করে উঠলেন প্রমোদবাবু। ইজিচেয়ারে বসে খেতে খেতে তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো। হাতের খাবারের বাটিটা আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলো।
“ঘুমিয়ে পড়লে নাকি খেতে খেতে?” জিজ্ঞেস করলো অনীশ।
“উমম — আর খেতে পারছি না রে।"
“ওই এক চামচ খিচুড়ি খেয়ে নাও বাবা। ফেলো না।"
“ভালো লাগে না রে বাবু। একদম টেস্ট নেই রে এতে। এ কি খাবার?” প্রমোদবাবু মুখ কুঁচকে বললেন।
“কি করবে বাবা। তোমার শরীর এখন তো রিচ খাবার নিতে পারবে না।"
প্রমোদবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে তাকালেন। বাইরে এখনো হাওয়া দিচ্ছে না। পাতাগুলো স্থির হয়ে আছে।
“জানি রে বাবু। কিমো যে কি জিনিস, তা আমার থেকে ভালো কে জানে বল!” প্রমোদবাবু বললেন।
“একটু কাস্টার্ড খাবে? রিনা পাঠিয়েছে তোমার জন্যে।" তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলো অনীশ।
প্রমোদবাবু কাষ্ঠ হেসে বললেন “বউমার ওই কম্প্ল্যান মেশানো কাস্টার্র? মাপ কর বাবু। তোর মনে আছে, তোর মা কিরকম ক্যারামেল কাস্টার্ড বানাতো?”
“মনে থাকবে না?”
“তোর সব জন্মদিনে বানাতো। কেক মাঝে মাঝে বানাতো, মাঝে মাঝে নিয়ে আসতো ফ্লুরিজ্-এর থেকে। মনে আছে?”
“হ্যাঁ বাবা। আর রোস্ট চিকেন বানাতো মা।"
প্রমোদবাবু আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “সে সব খাবার আজো মুখে লেগে আছে রে। মৃণাল — মানে তোর মা তো আমাকে ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়লো। বড়ো কষ্ট পেয়ে গেলো রে।"
“বাবা, এ তো জীবনের নিয়ম। সবাই কি চিরকাল থাকে?”
মাথা নাড়লেন প্রমোদবাবু, “থাকে না। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো তো থেকে যায়। মৃণাল নেই, বন্ধুরা সব চলে গেলো একে একে, শেষে চলে গেলেন অরিন্দমবাবু — আমার শেষ বয়েসের বন্ধু। এই ক্যান্সারেই, এই কিমো সহ্য করেই।"
“বড় ভালো লোক ছিলেন উনি," বললো অনীশ।
“যে বয়েসে আর নতুন করে বন্ধু হয় না, সেই বয়েসে আমরা বন্ধু হয়েছিলাম রে। মৃণাল চলে যাবার পর অরিন্দমবাবু তো রোজ আসতেন আমাকে সঙ্গ দিতে। একসঙ্গে বই পড়তাম, তর্ক করতাম, গান শোনা হোতো..."
“কেন, আজও তো শুনলে। ওনার সঙ্গেই তো শুনলে। তাই না?”
হাসলেন প্রমোদবাবু। এক চিলতে হালকা হাসি। একটু যেন করুণ।
“ঠিকই বলেছিস অবশ্য।"
অনীশ ঘড়ি দেখল। “আজ উঠি বাবা। তোমার ফোনে অনেকগুলো গান তুলে দিলাম। শুনো। এই নতুন স্পিকারটা দিয়ে শুনো। ভালো লাগবে।"
মাথা নাড়লেন প্রমোদবাবু, “না না, অরিন্দমবাবুকে বললুম না, এক সঙ্গে শুনবো। আজ তুই আয়, দেরি হয়ে যাবে। অনেক বেলা হলো।"
অনীশ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গলার কাছে একটা অদ্ভুত ব্যথা, ঢোক গিলতে লাগছে।
গীতা দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিলো। প্রথম থেকেই দেখাশোনা করে, এখন পরিবারের একজন হয়ে গেছে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো একবার, তারপর ধরা গলায় বললো—
“শিগগিরি আসবেন আবার। আপনি এলে তবু একটু খান, দুটো কথা বলেন। নইলে তো কিচ্ছু খান না। কথাও বলেন না। শুধু স্থির দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। নাহয় অরিন্দমবাবু হয়েই আসবেন। যে কটা দিন আছেন...খুব বেশি দিনও বোধহয় নয়।"