আমাদের সকলেরই জীবনে অনেক তিক্তমধুর অভিজ্ঞতা জমা আছে। তার সঙ্গে নিশ্চয়ই আছে এমন দু-একটি ঘটনা যা মনে পড়লে এখনো আফসোসে হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে। কিছু হয়তো করার ছিল যা করা হয়নি, কিছু বলার ছিল যা বলা যায়নি সময়মতো। কারুর কপালে সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ, জীবনের ধারা বদলে দেওয়ার মতো। অন্যদের পক্ষে সেগুলি অপেক্ষাকৃত ছোটো তবুও মনে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। এটা সেই রকমেরই একটি স্মৃতিকাহিনী।
অ-নেক বছর আগেকার কথা। আমি তখন ষোলোয় পা দিয়েছি। সদ্য স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। পুরোপুরি মেয়েদের স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মিশ্র ছেলে ও মেয়েদের কো-এড কলেজে ঢুকে নিজেকে খুব প্রাপ্তবয়স্ক মনে করছি। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। বাড়িতে রক্ষণশীল পরিবারের কড়া শাসন। তার ওপর কোনো ভাই বা ভাইয়ের বন্ধু না থাকায় আমার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মেশার সুযোগই হয়নি কখনো। তাই পুরুষ সহপাঠীদের মেশার জন্য একদমই তৈরি ছিলাম না।
সত্যি কথা বলতে কি সে সময় শহুরে মেয়েরাও এসব বিষয়ে খুব অপরিণত ছিল। কলেজে আমাদের ক্লাসে দশ বারো জন মাত্র মেয়ে। আমরা সবাই একত্র বসবাস, দল বেঁধে চলা ফেরা করতাম। আড্ডা দেওয়া, ছেলেদের দেখে গুজগাজ মন্তব্য, হাসি ইত্যাদি সবই দলবেঁধে করা হতো। দলছুট হয়ে কিছু করার মতো বুকের পাটা আমাদের ছিল না। কোনো ছেলের সঙ্গে দেখা বা কথাবার্তা হলে অন্যান্যরা এ ওর গায়ে ঢলে হাসাহাসি করত। এখনকার যুগের মেয়েদের তুলনায় আমরা ভীষণ কাঁচা ও ন্যাকা ছিলাম।
দুটি মেয়ে দলছাড়া ছিল। ওদের ভাব ছিল ক্লাসে দুটি ছেলের সঙ্গে। ওরা চারজন, একত্র থাকত। আমাদের দলের সঙ্গে খুব একটা ভাব ছিল না। ওদের নিয়ে আমরা খুব জল্পনা করতাম। ওদের ভাবতাম নির্লজ্জ, বেহায়া। মেয়েদুটোর কপালে যে অনেক দু:খ আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
আমাদের কলেজটা ছিল খুব পুরনো, ঐতিহাসিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন ক্যাম্পাসের বাইরে, পুরনো শহরের মধ্যে। কলেজটা বিগত শতাব্দীর বিদ্যাপীঠ ছিল। সেখানে তখন বিদ্যার্থী ছাত্রদের (ছাত্রী নয়) ভিড়ে গমগম করত। এখন জায়গাটা ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। কলেজের গেটের বাইরে মোটর মেকানিকের কারখানা, চোলাই মদের দোকান, মুচি, দর্জি সব গায়ে গায়ে। দিনের বেলা নিরাপদ কিন্তু রাত নামলেই জায়গাটা গুণ্ডা বদমাশদের আড্ডায় একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়।
কলেজটার অনেক ঐতিহাসিক সুনাম। শোনা যায় সম্রাট বাহাদুর শাহ্-এর সময়ে এখানে একটা নামী মুসলমান মাদ্রাসা ছিল। ধর্মশাস্ত্র ছাড়াও সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদিও পড়ানো হত। অধ্যাপকরা বড় বড় পণ্ডিত ছিলেন। বিখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিবও এখানে চাকরির দস্তখত দিয়েছিলেন। কিন্তু মঞ্জুর হয়নি। কলেজের অভ্যন্তরে একটি ছোট্ট সুন্দর মসজিদ। নিশ্চুপ, ঠান্ডা জায়গাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। অধ্যাপক ও বিদেশী ছাত্রদের থাকার জন্য একটি সংলগ্ন হোষ্টেলও ছিল। আমাদের প্রি-মেড ক্লাসে বেশ কিছু বিদেশী ছাত্র (ছাত্রী কখনই নয়!) ছিল। শ্রীলংকা, নেপাল, মালয়েশিয়া, কেনিয়া, মরিশাস ইত্যাদি জায়গা থেকে আগত। বয়সে আমাদের থেকে বড়, বেশি ধনী ও পাশ্চাত্য হাবভাব। আমাদের থেকে অনেক পাকা মনে হত তাদের।
ঐ বিদেশী ছেলেদের আমরা সযত্নে এড়িয়ে চলতাম। কেমন লোক বাবা, বিশ্বাস নেই। তবু তাদের নিয়েই আমাদের গুজবেরও অন্ত ছিল না। ওদের দলে একটি কেনিয়ার ছেলের সঙ্গে আমাদের দলছুট মেয়েটির ভাব ছিল। ঐ বিদেশী দলের নেতা ছিল মরিশাস থেকে আগত একটি ছেলে--অদ্ভুত নাম--রামলগন--হালকা গায়ের রং এবং উজ্জ্বল নীল চোখ। দেখেই বোঝা যায় দেশি মা ও সাহেবী বাবার সমন্বয়। গত শতাব্দীতে ভারতীয় শ্রমিকদের মরিশাসে রপ্তানি করার ফল। তাই রামলগন, রামশরণ ইত্যাদি নামগুলোর খুব চল সেখানে। রামলগনের অনেক মেয়ে বন্ধু বলে গুজব ছিল। মেয়েরা সবাই ওকে সাবধানে এড়িয়ে চলত। বেচারা ছেলেগুলো বিদেশ বিভুঁইয়ে একা থাকত। একটু বন্ধুত্বও কি আমরা দিতে পারতাম না? আমাদের ছেলেমানুষী দেখে ওরাও নিশ্চয়ই হাসাহাসি করত।
সে বছর আমায় ফটোগ্রাফির নেশায় ধরেছিল। আমার সম্বল ছিল একটা ছোট্ট কালো সাদা বাক্স ক্যামেরা। আর কলেজে ছিল ক্যামেরা ক্লাব ও একটি ডার্করুম। তাই নিয়েই আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতাম। ছুটির দিনগুলো আমি ডার্করুমে খিদে তেষ্টা ভুলে কাটিয়ে দিতাম। ডার্করুমে ঢুকলে কী ভাবে যে সময় কেটে যেত টেরই পেতাম না।
সেই রবিবারও আমি একা ডার্করুমে ফোটো ডেভেলপ করছিলাম। শীতের বেলা, চট করে অন্ধকার হয়ে যায়। আমিও যথারীতি নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজে বুঁদ। যখন ডার্করুম থেকে বেরুলাম, বাইরে ঘন অন্ধকার। বাড়ি ফেরার বাসস্টপটা কলেজের গেটের সামনেই, রাস্তার মোড়ের ওপারে। ১৩ নং বাস ধরলেই সোজা বাড়ির সামনে। তাই আমি খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না। তবে বাড়ি ফিরে দেরীর জন্য বকুনি খেতে হবে জানতাম। তবে ওসব তো জলভাত! আমি দ্রুত পায়ে গেটের দিকে এগোলাম।
লনটা পার হয়ে গেটে পৌঁছবার আগেই দেখি অন্য দিক থেকে রামলগনও গেটের দিকেই আসছে। রাতের বেলায় একা কলেজের কুখ্যাত কাসানোভার সঙ্গে দেখা করার একদম ইচ্ছা ছিল না। আমার বন্ধুদের সাবধানবাণী মনে পড়ে গেল। তাই তাড়াতাড়ি ওকে এড়িয়ে গেটের দিকে পা চালালাম। একবার বাইরে গেলেই ভীড়ের মধ্যে নিরাপত্তা।
কিন্তু আমার বরাত খারাপ। গেটের বাইরে পা দিয়েই বুঝলাম তপ্ত কড়াই থেকে সোজা আগুনে পড়েছি। একগাদা অচেনা লোক হল্লা করছে, শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে নাচ গান করছে। হাতে হাতে বোতলও চলছে। আশে পাশে তাকিয়ে একটি মহিলাও চোখে পড়ল না। কি বিপদ! আমি একমনে তের নম্বরের জন্য প্রার্থনা করতে লাগলাম। কিন্তু বাসের তো কোনো সময়ের ঠিক নেই। কখন আসবে ভগবান জানেন।
আমার কাছে স্কুটার বা ট্যাকসিরও পয়সা ছিল না। বাড়িতে ফোনও নেই যে একটা খবর দেব। কোনো চেনামুখও চোখে পড়ল না যে একটু সাহায্য চাইব। শুধু রামলগন ছাড়া। সে আমার পেছন পেছন গেট পেরিয়ে সোজা বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়েছে। থামে হেলান দিয়ে আরামসে সিগারেট খাচ্ছে, মুখে মিচকে হাসি--যেন আমার বিপত্তি দেখে বেশ মজাই পাচ্ছে মনে মনে। ওর কাছে সাহায্য চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওকে দেখেই আমার গা জ্বলে গেল। আমি ওর থেকে যতদূর পারা যায় দাঁড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম যাতে কোনোরকম চোখাচোখি না হয়। ও-ও আমার দিকে কোনোরকম আকার ইঙ্গিত করল না; শুধু মুখে সিগারেট আর একটু হাসি।
এদিকে মাতালের দল প্রশ্রয় পেয়ে আমাকে লক্ষ্য করে মন্তব্য ও গানের কলি ছুঁড়ছে। শিস দিচ্ছে, ডাকাডাকি শুরু করেছে। আমি শীতের দিনেও ঘামছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
অবশেষে বাসটা এল। আমার প্রার্থিত ১৩ নম্বরই। ভেতরে দু তিনজন মহিলা যাত্রী দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম। পাদানিতে পা রাখতেই মাথার আরেকটা চিন্তা খেলে গেল। রামলগনও যদি আমার বাসেই ওঠে? ওর হয়তো আমাকে ফলো করার ইচ্ছা--সোজা বাড়ি পর্যন্তও যেতে পারে। আমার অন্য কোথাও নামার উপায় নেই। একবার মনে হল ছেড়ে দিই এই বাসটা, কিন্তু তাহলে আরও ঘন্টাখানেক এখানে দাঁড়াতে হবে--সেটা মোটেই নিরাপদ নয়। আবার বাড়িতে উটকো ছেলে নিয়ে এলে আমাকেই ঠ্যাঙানি খেতে হবে। তা-ও জানা কথা।
এই সব ভাবতে ভাবতেই উঠে পড়লাম বাসে। পেছনে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম রামলগনও বাসে উঠল কিনা! আশ্চর্য। ও এখনও স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ওঠার কোনো চেষ্টা নেই। বাসটা ছাড়তে ছাড়তে দেখলাম এতক্ষণে ও সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সিগারেটটা জুতোর তলায় পিষে, নবাবী চালে কলেজের গেটের দিকে এগিয়ে গেল!
তক্ষুনি কেউ যেন মাথায় একটা বিরাশি সিক্কার চাঁটি মেরে আমায় জাগিয়ে দিল। মুহূর্তে আমি বুঝে ফেললাম ও কেন এতক্ষণ বাসস্টপে দাঁড়িয়েছিল। শুধু আমারই নিরাপত্তার জন্য। আমাকে দেরি করে একা কলেজ থেকে বেরুতে দেখে ও নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিল যে ঐ সময় বাসস্টপে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। আমি লজ্জায়, আফসোসে সরমে মরে গেলাম। ভাবলাম বাসটা থামিয়ে নেমে যাই কিন্তু সাহসে কুলোলো না। ইস্ কী ভাবল লোকটা। আমি অন্তত: একটু সৌজন্যের হাসি, একটু ‘থ্যাংক ইউ’ বলতে পারতাম। আমার বিবেক আমাকে অনবরত খোঁচাতে লাগল।
পরদিন বন্ধুদের লুকিয়ে রামলগনকে খুঁজলাম কলেজে। বন্ধুদের আমার বোকামির কথা বলতেও লজ্জা। জানতাম এই নিয়ে ওরা আমাকে প্রতিদিন খেপাবে। আমি মনে মনে একটা ভাষণ পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছিলাম, কিন্তু সারাদিন কোনো দেখা নেই রামলগনের। যত দেরী হচ্ছিল ততই আমার ক্ষমা চাওয়াটাও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে সেই কেনিয়ার ছেলেটিকে জিগ্যেস করলাম। রামলগনের সঙ্গে দেখা করতে চাই জেনে ও আশ্চর্যে দুই ভুরু কপালে তুলল। তারপর বলল যে বাড়ির কোনো খবর পেয়ে ও কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। কবে আসবে জানে না।
মাসখানেক পর আমি আবার ওকে কলেজে দেখেছিলাম। ততদিনে ঐ বাসের ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা চাইতে দ্বিধা হল। হয়তো আমার বোকামি দেখে আরও হাসবে। এই নিয়ে দোনামনা করতে করতে আরও কিছুদিন কেটে গেল। ক্ষমা আর চাওয়া হল না। ও-ও এগিয়ে এল না। আমিও কিছু বলতে পারলাম না।
দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল। ফাইনাল পরীক্ষার ব্যস্ততা ও তারপর সবাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লাম। কলেজে ফেরা বা রামলগনের সঙ্গে দেখা করা — কোনোটাই আর হল না। এতদিনে জানিও না ও কোথায় আছে বা কি করছে।
অনেক বছর পর কর্মসূত্রে আমি একবারে ম্যাডাগাস্কার দ্বীপে কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। ম্যাডাগাস্কার থেকে মরিশাস খুবই কাছে। হঠাৎ মনে হল চলে গেলেই হয়, রামলগনের সঙ্গে দেখা করা আসি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল আমি ওর পুরো নামটাই জানি না— কোনো নম্বর বা ঠিকানা তো দূরের কথা। হয়ত প্রতি শহরে ডজন খানেক রামলগন বাস করে। বৃথা চেষ্টা।
তবু মনের মধ্যে কোথাও একটা কিছু খোঁচায়। কী যেন বাকি রয়ে গেল। ওর পাওনাটা দেওয়া হল না। এই আফসোসটা চিরজীবন রয়ে যাবে।