• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৫ | ডিসেম্বর ২০১৬ | গল্প
    Share
  • সখী, ভালোবাসা কারে কয়? : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    ত্যিকারের প্রেম বা ভালোবাসা আর ক্রাশ-এ (বাংলা প্রতিশব্দ কী? প্রেমভাব?) কী তফাৎ? এই নিয়ে তিন বন্ধুতে আলোচনা হচ্ছিল। এরকম ওদের প্রায়ই হয়। তিনজনই শিক্ষিতা স্বাবলম্বী ও অবিবাহিতা। ছোটবেলা থেকেই সখীত্ব। এখনও ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও মাসে অন্তত একবার ওরা একত্র হবেই। তারপরে খাবারদাবার ও পানীয় সহকারে গল্পগুজব চলে বেশিরভাগই হালকা বিষয় নিয়ে--অফিসের গুজব, সিনেমা, ছেলে বন্ধু ইত্যাদি। কখনো কখনো একটু গভীর বিষয়ও এসে যায়, যেমন প্রেম ভার্সাস ক্রাশ! কঠিন বিষয়!

    তিনজনেরই এ-বিষয়ে অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। তাই তর্ক চলে জোর গলায়। সোমার মতে ক্রাশ শুধুই শরীর সর্বস্ব। আর প্রেমে তার সঙ্গে যোগ হয় স্নেহ, শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ। সোমা একটু আদুরে প্রকৃতির। বয়সকাল থেকেই সে “ক্রাশে” পড়ে চলেছে সে ফিল্মস্টারই হোক্ বা টেনিস খেলোয়াড়। ওর ঘরের দেয়াল পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। ওর কাছে ক্রাশের বিশ্লেষণ একেবারেই সোজা।

    “কিন্তু অনেক প্রেমও তো শরীর দিয়েই শুরু হয়,” প্রীতি আপত্তি জানায়, “লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট” ব্যাপারটা তো শরীর ছাড়া কিছুই নয়, তাই না? তা বলে সেটাকে কি ক্রাশ বলবি?”

    “ঠিক আছে, তবে তুই-ই শোনা। তার ডেফিনিশনটা কী?” প্রীতি সময় নিল। বাঁ হাতে খোলা চুলের ডগা জড়াতে জড়াতে ওর মনটা চলে গেল কয়েক বছর আগে, সেন্ট লুইস কলেজে জুনিয়র তখন। ঝপ করে এক নতুন প্রফেসরের প্রেমে পড়ে গেল। একেবারে হাবুডুবু অবস্থা; ক্লাসে মন দিতে পারে না। হাঁ করে প্রফেসরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একদিন তো সোজা তার অফিসে গিয়ে মনের কথা বলে দিতে যায়। এই বন্ধুরাই ভাগ্যিস তাকে নিরস্ত করে। প্রফেসরটি মাঝবয়সী, বাড়িতে স্ত্রী ছেলেপুলে। শেষে প্রীতি কি ঘরভাঙানি ডাইনি হবে? এরকম অ্যাফেয়ারে তো কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধুই কেলেংকারি। এই বন্ধুরাই তখন ওকে উদ্ধার করে। ক্লাস বদলাতে সাহায্য করে। এখন সে-সব মনে পড়লে নিজের বোকামিতে নিজেরই হাসি পায়।

    “আমার মনে হয় ক্রাশ ব্যাপারটা একপেশে। সত্যিকারের ভালোবাসা দুপক্ষ থেকেই হয়।” প্রীতি জোর দিয়ে বলল।

    “জানি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছিস” সোমা হেসে টিপ্পনী কাটে।

    “কিন্তু সেটাও কি সত্যি? দান্তের ভালোবাসাও তো একপেশেই ছিল। বিয়াত্রিচ তো কিছুই বলেনি, তা হলে কি সেটা মিথ্যা?” তৃতীয় বান্ধবী বন্দনা মুখ খোলে।

    “আমি বলছি।” সোমা আবার চেষ্টা করে, “ক্রাশ হচ্ছে ছোটবেলার আকর্ষণ-‘পাপি লাভ যাকে বলে’--

    “লায়লা মজনুর গল্প ভুলে গেলি?” বন্দনা আবার বাধা দেয়।

    “ঠিক আছে, এক্সপার্ট, তুই-ই বল, তোর ব্যাখ্যাটা কি?” দুই বন্ধু দুদিক থেকে বন্দনাকে চেপে ধরে।

    ওদের মধ্যে বন্দনাই বয়সে বড় কিন্তু ভীষণ মুখচোরা রবং অন্তর্মুখী। তর্কাতর্কি ওর একদম আসে না। তবে যখন মুখ খোলে সে তার বক্তব্য বেশ ভেবেচিন্তেই বলে।

    “সময়।” বন্দনার ছোট্ট উত্তর।

    “মানে?” প্রীতি ভুরু কোঁচকায়, “একটু বুঝিয়ে বল্ না।” সোমা সবার গ্লাসে আরও মার্গারিটা ঢেলে দেয়। বুদ্ধির গোড়ায় একটি অ্যালকোহল ঢালা দরকার।

    “মানে ক্রাশ অল্পসময়ের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় আর সত্যিকারের প্রেম সারা জীবন জ্বালিয়ে মারে।” বন্দনা মুচকি হাসে।

    “অল্প সময় বলতে কী বোজাচ্ছিস? সপ্তাহ, মাস, বছর?”

    “এই ধর, এক বছর। যদি আবেগটা এক বছরেও না কাটে তবে সেটাকে সত্যি বলে ধরে নিতে পারা যায়। তবে ঐ সময়টায় কোনো পারস্পরিক যোগাযোগ--ডেটিং বা চিঠি চালাচালি চলবে না। এক বছর ম্যাক্স। যদি যোগাযোগ না থাকে তো বেশিরভাগ ক্রাশ মাসখানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এই আমার মতামত!” বন্দনা গেলাসে চুমুক দেয়। প্রীতি ও সোমা বিপক্ষ প্রমাণ ভাবার চেষ্টা করতে থাকে। বন্দনা আবার বলল, “এই দেখ্ না, প্রীতি, তোর অ্যাফেয়ারটা এক সেমেস্টারের মধ্যেই শেষ। আর তুই সোমা তো প্রত্যেক সপ্তাহে দেয়ালে পোস্টার বদলাস।”

    “তা, তুই এক বছর সময়টা কোথা থেকে বের করলি?”

    “ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা? কিরে? ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস নাকি!” বন্ধুরা বন্দনাকে চেপে ধরে।

    “কিছু একটা নিশ্চয়ই, হয়েছে। তুই লুকোচ্ছিস।”

    “বল্ না। এই বন্দনা--”

    বন্দনার মুখচোখ একটু লালিয়ে যায়।

    “তোদের তো মনে আছে নিশ্চয়ই যখন আমি অফিস ট্যুরে চীনে যাই। সেই এক্সপার্ট গাইডের কথা?”

    “সেই হ্যান্ডসাম ইটালীয়ন ছেলেটা না? কি যেন নাম?”

    “অ্যাটম। আমি বাংলা করে অণু বলে ডাকতাম।”

    “তার সঙ্গে?” দুই বন্ধু লাফিয়ে উঠল, “আর তুই এতদিন বলিসনি আমাদের?”

    “ক্রাশকে আর কে কবে গুরুত্ব দেয়।” বন্দনা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে।

    “বল এইবার, সব ডিটেল চাই,” সবাই গুছিয়ে বসে।

    “অ্যাটম খুবই চৌকস ছেলে। বয়সে আমাদেরই মতো। কিন্তু ওর মতো দায়িত্ববান গাইড আমি আগে কখনো দেখিনি। চীনা ভাষা, রাজনীতি, সাহিত্য, খাবার সবকিছুতেই ওর দখল সমান। বিদেশে বিভুঁইয়ে ঐ রকম গাইডরা মহিলা যাত্রীদের কাছে গল্পের নায়কের মতো সর্ববিপদহারী। এমত অবস্থায় গাইডের ওপর একটু ক্রাশ হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

    “আমারও তাই হয়েছিল। বেশি কিছু না। একটু আকর্ষণ। একটু আমার দিকেও নজর দিক। আমার সঙ্গে কথা বলুক। দলের মধ্য থেকে আমাকে একটু আলাদা করে চিনুক। ব্যস। ওরও বোধহয় একটু আকর্ষণ হয়েছিল কিংবা শুধুই কৌতূহল। একদিন আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গেল একটা বারে--শুধু একটা ড্রিংকস। কিন্তু আমার কি যে হল। কোনো কথাই সরল না মুখে। তোরা তো জানিস আমি এমনিতেই মুখ চোরা, সেদিন যেন আরও বেশি--”

    সোমা আস্তে ওর হাতে মৃদু চাপ দিল আশ্বাসের।

    “সেইদিন বিকেলে আমার একটা মাসাজ অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল; পুরনো অ্যাকুপ্রেশার পদ্ধতিতে মাসাজ। এক থুত্থুড়ে বুড়ো এক অক্ষরও ইংরিজি জানে না, সে আমার মুখে চোখে টিপেটিপে পিষছে আর আমার দুচোখ বেয়ে হু হু করে কান্না। বুড়ো কি বুঝল কে জানে কিন্তু গুনগুন করে সান্ত্বনার সুরে কিছু বলেছিল। তাইতেই আমি অনেকটা শান্ত হতে পেরেছিলাম।

    "তারপর আর ওর সঙ্গে কথা হয়নি। শুনেছিলাম শীগগিরিই আরেকটা ট্রিপে মঙ্গোলিয়া যাচ্ছে। ভীষণ ইচ্ছা হয়েছিল সব কিছু ছেড়ে মঙ্গোলিয়া চলে যাই। ফিরে এসে এয়ারপোর্টে ওর লালচুল সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডকে দেখে একটু ঈর্ষাও হয়েছিল।” বন্দনা থামল একটুক্ষণ।

    “কী বলবি এটাকে? ক্রাশ না লাভ?”

    “তারপর কী হল সেটা বল আগে।”

    “কী আবার। এক সপ্তাহ যেন একটা জ্বরের ঘোরে কাটালাম। সারাক্ষণ ওর মুখ মাথা থেকে সরাতেও পারছিলাম না। ও বলেছিল উলান বাটোর গিয়ে আমাকে একটা চিঠি দেবে। আমি তার আশায় সকাল দুপুর ঘরবার করছি। রাতে বালিশ ভিজিয়ে কেঁদেছি। তারপর এল সেই বহু আকাঙ্খিত চিঠি। একটা খোলা পোস্টকার্ড--দুলাইন লেখা— With Greetings from Mongolia.”

    সোমা ও প্রীতি দুদিক দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।

    “তারপর একটা অবাক ব্যাপার হল জানিস। হঠাৎ যেন ঘাম দিয়ে আমার জ্বরটা ছেড়ে গেল। ঐ কার্ডটা হঠাৎ আমার চোখের ধোঁয়াশা কাটিয়ে সব পরিষ্কার দেখিয়ে দিল। বুঝতে পারলাম কী বোকামি না করেছি। ভাগ্যিস আর কাউকে জানাইনি। নিজেরই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। দুদিনের মধ্যেই দেখলাম অণুর নাম নিতে বা ওর গল্প করতে আর চোখে জল আসে না। বুকে বাজে না। অন্য স্মৃতির মতোই সে-ও একসময় আবছা হয়ে গেল। তবে সম্প্রতি আরেকটা খবর পেলাম ওর।”

    “কী খবর? ভালো না খারাপ?”

    “বিয়ে করেছে বুঝি?”

    “না:।" বন্দনা নি:শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল।

    “ওর এক বন্ধু বোধহয় ওর কাগজপত্র থেকে আমার নাম পেয়ে একটা ই-মেল পাঠিয়েছিল যে দুদিন আগে অনু অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।

    হেরোয়িন ওভারডোজ।”

    “ওমা! সেকি?”

    “হ্যাঁ; জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম যে গত কয়েক বছর হল অন্য ওর চীনা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ড্রাগ নেশা শুরু করেছিল; কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছিল। কেউ খোঁজখবরও পেত না। দৈনিক ইনজেকশন নিতে গিয়ে অনেকটা বেশি নিয়ে ফেলেছিল। শুনেও কিন্তু আমার মনে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। শুধু একটা প্রাণবন্ত ছেলের মৃত্যুতে যতখানি দু:খ হয়।”

    “ইস কীরকম একটা অপচয়!”

    “হ্যাঁ। এত ট্যালেন্ট, এত জীবনশক্তি, তিরিশও পেরয়নি।”

    তিনবন্ধুই নি:শব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “বেচারা!”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments