‘মার্চ মাস কবে আসবে সুশান্ত? মার্চ মাস কবে আসবে?’—
বিকেলের বিবর্ণ আলোয় একটি একটি করে নির্জন পাতা নি:শব্দে খসে পড়ছিল বারান্দায়—বেতের চেয়ারে—যার থেকে একটা দু’টো উড়ে আসছিল ঘরের মধ্যেও—এসে পড়ছিল ফ্রেমে বাঁধানো চন্দনচর্চিত তেজেন্দ্রনারায়ণের মুখের উপর—গড়াতে গড়াতে—পড়তে পড়তে—সেগুলি যেন বলছিল সুশান্তকে—‘মার্চ মাস কবে আসবে সুশান্ত? মার্চ মাস কবে আসবে?’
তেজেন্দ্রনারায়ণ চলে গেলেন গত সপ্তাহে। আক্ষরিক অর্থেই দেহ রাখলেন তাঁর প্রিয় বেতের চেয়ারটির উপর। বারান্দায়। ফেব্রুয়ারির সকালে। সুশান্ত কেবল দেখতে পেয়েছিল ক্রমশ হেলে যাচ্ছে তেজেন্দ্রনারায়ণের শরীরটা। কাছে গিয়ে ছুঁয়েছিল তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ। পাশে টেবিলের উপর রাখা রেডিওতে তখনো বাজছে দেবব্রতর গলায়—‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার...'
‘মার্চ মাস কবে আসবে—মার্চ মাস কবে আসবে সুশান্ত?’—জীবনের শেষ কালটায় শিশুর মতো বার বার এই প্রশ্ন করে যেতেন তেজেন্দ্রনারায়ণ। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বিহ্বল উদ্বিগ্ন মুখে বসে। খানিকবাদেই সন্ধে হলে তাঁকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো ভিতরের ঘরে। বিছানায় শুইয়ে আস্তে করে চালিয়ে দেওয়া হতো রেডিও কিংবা টিভি। তেজেন্দ্রনারায়ণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন দেওয়ালের দিকে। খানিকবাদে তাঁকে খাইয়ে দেওয়া হতো এক কাপ স্যুপ। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে, বিছানায় ফের শুইয়ে দিয়ে ঘরের সবুজ নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। শোয়ার পরেই উদ্বিগ্ন মুখে ফের জিজ্ঞাসা করতেন—‘মার্চ মাস কবে আসবে বলো তো?’
এইভাবে তেজেন্দ্রনারায়ণ আরও কিছুকাল বেঁচে ছিলেন।
দিন শেষের পড়ন্ত আলোয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই সব কথা মনে পড়ছিলো সুশান্তর।
মনে পড়ছিলো সেই রাতের কথা—যখন সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন হয়ে গাইছিলেন তেজেন্দ্রনারায়ণ—
দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে এক গভীর গন্ধ হে,মার্চ মাসের প্রকাণ্ড নীল আকাশের গায়ে সত্যিই যতো তারা আছে সবাই যেন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল সেই গান। অন্তত সুশান্ত’র তাই মনে হচ্ছিল। কি অসাধারণ সুরের গভীরতা গলায়। গান শেষ হয়ে গেলেও সেই সুরের রেশ ভেসে বেড়াচ্ছিল আধো অন্ধকারে প্রায় নি:স্তব্ধ নির্জন সেই বারান্দায়।
আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।
সুশান্তর ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। তেজেন্দ্রনারায়ণ নিজেই উঠে পড়েছিলেন। সুশান্তকে দেখে অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বলেছিলেন—‘এবার শোয়া যাক। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। জানো তো?'
সুশান্তর মনে পড়ছিল পরদিন সকালে উঠেই স্নান করে ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে বাইরে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসেছিলেন তেজেন্দ্রনারায়ণ। সকালের নরম সাদা আলোয় যেন ঈশ্বরের মতো রূপবান মনে হচ্ছিল তাঁকে। পাশের টেবিলে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী মারফি রেডিওয়—‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আরো দাও প্রাণ’। সেই কথায় আর সুরে নিমগ্ন তেজেন্দ্রনারায়ণের তখনো জানা ছিল না যে এই গানের শেষাংশ যথার্থভাবে তাঁর জন্যই রচিত হয়েছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে তেজেন্দ্রনারায়ণের ড্রয়ার থেকে বার করা ডায়েরিগুলো বারান্দায় বসে নাড়াচাড়া করছিল সুশান্ত।
চাকরি জীবন শেষ করে ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলেন তেজেন্দ্রনারায়ণ। শুরু করেছিলেন একটা লাল ডায়েরিতে। সুশান্ত সেই অতিপরিচিত ডায়েরিটাকে হাতে তুলে নিয়ে তার হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো একটার পর উল্টোচ্ছিল আপনমনে।
৩রা মার্চ, ১৯৭২
আগামীকাল আমার দীর্ঘ বত্রিশ বছরের চাকরি জীবনের শেষ দিন। লালবাড়ির ওই চেয়ারটায় গিয়ে কোনদিনই আর বসবো না। Charles Lamb-এর Superannuated man-এর কথা মনে পড়ছে। কিন্তু ঐ ঘরটায়, ঐ চেয়ারটায় কাল থেকে যে বসবে সে আমার বিশেষ স্নেহভাজন।
৪ঠা মার্চ, ১৯৭২
চাকরিজীবন শেষ। “জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় মনে রেখো”—না। এমনি কথা আমি কাউকে বলতে যাইনি। বরং বলতে হলে Othello-থেকে বলা যেতে পারতো—“Farewell for I must leave you.” ঈশ্বরকে ধন্যবাদ অন্যান্য দিনের মতোই সব কাজ গুছিয়ে বুঝিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
১০ই মার্চ, ১৯৭২
কয়েক দিন কিছুই লেখা হয়নি। কারণ লেখার মতো মন ছিল না। সাদার্ন এ্যাভিনিউ-এর বাড়িটায় একাই চলে যাচ্ছি। অবশ্যই সুশান্তকে নিয়ে। ভেবেছিলাম রিটায়ার্ড লাইফে ঘোর সংসারী হবো। হলো না। যাক্গে, বইপত্র আর রেডিও তো রইলো সঙ্গী হয়ে। খবরের কাগজ আর ভালো লাগে না।
১২ই মার্চ, ১৯৭২
Congress landslide in six states—আজকের Statesman-এর প্রথম পাতার খবর। তারপর আরও আছে। নির্বাচনে ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেসের দিকে দিকে জয়পতাকা। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ভাল লাগে না। এই নিয়েই তো এতকাল কাটালাম। এবার চেয়েছিলাম পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনী নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে। হল না। তাই খবরের কাগজই পড়তে হচ্ছে। কিন্তু মনটাকে অন্য খাতে বইয়ে দিতে হবে। কাল থেকে আবার শুরু করবো। James Joyce-এর Ulysses দিয়ে।
১৩ই মার্চ, ১৯৭২
আজ ব্রতীরা চলে গেল। ওর কোম্পানীর দেওয়া ফ্ল্যাটে। আমিও আর এবাড়ির স্মৃতি বহন করতে চাই না। চার বছরের মাতৃহারা ব্রতীকে নিয়ে কাটালাম এখানে দু’দশকেরও বেশি সময়। শেষের দিনগুলো ছিল বড় ভয়ঙ্কর। ঘরে এবং বাইরে। ঘরে আমার সমস্ত ভ্যালুসগুলোকে সরিয়ে রেখে ব্রতী বিয়ে করে আনলো মধুরাকে। আর বাইরে তখন ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’। আমি কিন্তু ঘরে বাইরে দুটোতেই স্বধর্মেই ছিলাম। সেই জন্যই কি আজ আমার নিধনযজ্ঞ শুরু হচ্ছে?
১৭ই মার্চ, ১৯৭২
আজ সাদার্ন এ্যাভিনিউ-এর বাড়িতে চলে এলাম সুশান্তকে নিয়ে। পিতৃমাতৃহীন শিক্ষিত ভদ্র ছেলে। আর ভীষণ বিশ্বাসী। সেই চায়ের দোকানে আলাপ। অত্যন্ত জরুরি কিছু কাগজ ফেলে এসেছিলাম। ছেলেটা এসে ফেরত না দিলে সর্বনাশ হতো। এখন আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। আমার সঙ্গে থাকুক। ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার। কবিতা লেখার বাতিক আছে ওর। ওকে বলেছি রবীন্দ্রনাথ পড়ো। রবিঠাকুরকে পুজো না করে বাংলাভাষায় কোনো সাহিত্য হয় না। তাই আজ ওকে পড়তে দিলাম ‘নৈবেদ্য’।
বিনির জন্য মনটা খুব খারাপ লাগছে।
১৯ই মার্চ, ১৯৭২
আজ ব্রতীরা এসেছিল। ব্রতী, মধুরা আর বিনি। বিনিকে রেখে ওরা কোথায় যেন চলে গেল। তাই বিনি ঘন্টাখানেক ছিল আমার কাছে। মনের ভার অনেকটা হালকা হল। অনেকদিন বাদে আবার গানের খাতাটা নিয়ে বসেছিলাম। ‘বড়ো বেদনার মতো’ কতদিন বাদে গাইলাম।
২৭শে মার্চ, ১৯৭২
সাতদিন হয়ে গেল ওদের একটা খবর পর্যন্ত নেই। হয়তো এটাই স্বাভাবিক আজকের দিনে। আমি বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছি। এককালে বহু লোকের সঙ্গে, বহু বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছি। বুঝেছি মানুষ বড় বিষম বস্তু। এত সত্ত্বেও মনে করি মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। New Testament-এর কথা ‘We walk by faith, not by sight.’ তাই আমি বিশ্বাস করি ব্রতীরা ঠিক আসবে। একদিন না একদিন।
১লা এপ্রিল, ১৯৭২
সকালে হঠাৎ ফোন এল। বিনির গলা। বলল—‘আজ বিকেলে আসছি’। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—‘কখন?’ বিনি বলল—‘এপ্রিল ফুল! এপ্রিল ফুল!’ তারপরই ফোনটা রেখে দিল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সন্ধেবেলায় বেল বাজলো দরজা খুলে দিতেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিনি। বলল—এপ্রিল ফুল!
আজ সত্যিই এপ্রিল ফুল হয়ে গেলাম আমি।
এরপর অনেক খুঁজেও ১৯৭২ সালের একটা লেখাও বের করতে পারলো না সুশান্ত। তার কারণ অবশ্য সুশান্তর কিছুটা জানা ছিলো। একটা কারণ দুটো চোখেই পরপর অপারেশন হলো তেজেন্দ্রনারায়ণের। অপারেশনের পর চোখের দৃষ্টি আরও কম হয়ে গেল তাঁর। বিশেষত পড়াশুনো ও লেখালেখির ক্ষেত্রে। অপর কারণটি সুশান্ত ভালো ভাবেই জানে কিন্তু মনে রাখতে চায় না কখনো। যাই হোক সেই সময় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে গেল ঐ মারফি রেডিওটি।
সুশান্ত খানিকক্ষণ ডায়েরিগুলো ঘেঁটে বার করলো একটি খয়েরি রঙের ডায়েরি। তেজেন্দ্রনারায়ণের পরবর্তী লেখা ছিল এই ডায়েরিটিতেই।
২১শে মার্চ, ১৯৮২
Life is a sweet and joyful thing for one who has someone to love —Tolstoy.
অনেকদিন বাদে লিখছি। কারণ আজ লিখতেই হবে। আর এই ডায়েরিটাতেই লিখতে হবে। কারণ এটা বিনি দিয়েছে। আমার জন্মদিনে।
গতকাল আমার জন্মদিন ছিল। সত্তরে পা দিলাম। এই দিনটার অস্তিত্ব যেন নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম বহুকাল। মনে করালো বিনি। গত সপ্তাহে যখন এসেছিলো। বলেছিলাম—‘কে বলেছে? বাজে কথা’। ‘কিচ্ছু বাজে কথা নয়। আগামী ২০ তারিখে তুমি সেভেন্টিতে পড়বে। আমরা সেলিব্রেট করবো। তুমি আর আমি। ব্যস।' বুঝলাম ব্রতীর কাছেই শুনেছে তারিখটা। আরো বুঝলাম বিনিকে নিরস্ত করা আমার কম্মো নয়। তার বিরাট পরিকল্পনা। অনেক কষ্টে, অনেক কথায় সেগুলো কাটছাঁট করে ভদ্রস্থ একটা জায়গায় নিয়ে এলাম।
বহুকাল বাদে আবার রাস্তায় বেরোনো হলো। পার্ক স্ট্রিট কতো বদলে গেছে। নিউ মার্কেট তো চেনাই যায় না। নিউ মার্কেট থেকে ওর জন্য একটা শাড়ি কিনে দিলাম। শাড়ি পরার ওর ভীষণ শখ। কিন্তু কেউ কিনে দেয় না। সত্যি কত বড়ো হয়ে গেছে মেয়েটা। কেক আর আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে অবশ্য ক্লান্ত লাগছিলো। বারান্দায় চেয়ারে এসে বসলাম। বিনি বেতের মোড়াটা নিয়ে পাশে এসে বসলো। বললো—‘কিরকম হলো?’ বললাম—‘ভালোই’। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে বলে উঠলো—‘আসছে বছর আবার হবে’। সুশান্ত পাশে দাঁড়িয়ে হাসছিলো। হঠাৎ যেন বুঝতে পারলাম বেঁচে থাকার আনন্দ। বুঝলাম Tolstoy-এর কথাটা কি অসম্ভব দামি। তাই শুরুতেই লিখে ফেললাম সেটা।
এই লেখাগুলো সুশান্তর পড়তে গিয়ে চোখের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই ঘটনার পর থেকে প্রায় দশ বছর ধরে কিভাবে তার স্যার তেজেন্দ্রনারায়ণ নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করে রেখেছিলেন। কথাবার্তা বলতেন খুব কম। কদাচিৎ বাড়ির বাইরে যেতেন। ডায়েরি লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন পুরোপুরি। রেডিও নিয়েই পড়ে থাকতেন সারাক্ষণ।
আসলে হঠাৎ করে ছেলের সপরিবারে ভালো চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাওয়াটা তাঁর মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। তাছাড়া বিনির ব্যাপারটাও ছিল। শনিবার শনিবার আসতো দাদুর কাছে। সেটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। আসলে বিনির মধ্যে—তার চেহারা, হাঁটাচলা, কথাবার্তা—সবকিছুতেই তেজেন্দ্রনারায়ণ তাঁর অকালপ্রয়াতা স্ত্রী মনোরমার ছায়া দেখতে পেতেন। ফলে বিনির সঙ্গে এই ব্যবধান তাঁকে এতটা আঘাত দিয়েছিলো যে তিনি সম্পূর্ণ নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পারিপার্শ্বিক বিষয় থেকে।
তাই বছর দশেক বাদে যখন তাঁর ছেলে পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে এলো তেজেন্দ্রনারায়ণ সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন বিনিকে পেয়ে। সেই পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটা তখন পনেরো বছরের ছটফটে কিশোরী হয়ে গেছে। তাই তেজেন্দ্রনারায়ণ ডায়েরি খুলে লিখতে বসেছিলেন ঠিক দশবছর বাদে।
এই সমস্ত পুরনো কথাগুলো ছবির মতো পর পর মনে পড়ে যাচ্ছিল সুশান্তর। আর সেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খয়েরি ডায়েরিটার পাতাগুলো উল্টোচ্ছিল সুশান্ত। মনে হচ্ছিল একটানা এতটা লেখা আগে স্যার লিখতেন না। তবে সেগুলোর সংখ্যা খুব কম। তিন চারটি হবে। সেগুলো পর পর করে পড়তে লাগলো সুশান্ত।
২৭শে মার্চ, ১৯৮২
কাল একটু বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলাম। বাইরে মানে বেশি দূরে নয়। রাসবিহারী এভিনিউ-এর দিকটায়। ঠিক সাতদিন আগের কথা মনে পড়ছিলো। বিনির সঙ্গে বেরিয়েছিলাম।
কতকাল বাদে এদিকটায় এলাম। কত নতুন নতুন বড় বড় বাড়ি উঠে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে মহীদার বাড়ির দিকটায় চলে এসেছিলাম। কি মনে করে মহীদার বাড়ির দরজায় গিয়ে বেল বাজালাম। অনেক দিন যোগাযোগ নেই। মহীদার ভাইপো শ্যামল দরজা খুলে দিলো। বলল, ‘কাকার কি হয়েছে জানেন তো? সামনে কিছু বলবেন না যেন’। ঘরে ঢুকতেই মহীদা ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠলো, ‘আরে! তেজেন এসো এসো। কয়েকদিন ধরে তোমাদের কথাই ভাবছিলাম’। তারপর বললো, ‘আমি আর ক’দিন—পরের কেমোটা যদি নিতে পারি...’ কথাটা সম্পূর্ণ না করেই ঘোলাটে চোখে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো মহীদা। কথাবার্তায় বুঝলাম মহীদার থ্রোট ক্যানসার। অ্যাডভান্সড স্টেজ। মনে পড়লো এককালে দিনে তিন প্যাকেট কাঁচি সিগারেট চলতো মহীদার। বেশিক্ষণ বসতে পারছিলাম না ও-ঘরে। কেমন একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ। বেরিয়ে এসে যেন শ্বাস নিতে পারলাম।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল কি অসাধারণ গলা ছিল মহীদার। অসম্ভব ভালো মান্না দে’র গান গাইতেন—‘আমি যামিনী তুমি শশী হে...' এখনো যেন কানে লেগে আছে। ভাগ্যিস আমি জীবনে কোনদিন স্মোক করিনি।
শরীর ভালোই আছে। ফিরে বিনিকে ফোন করেছিলাম রাত্রে।
২২শে এপ্রিল, ১৯৮২
গত রোববারের কথাটা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছি না। খালি সুশীলদার মুখটা মনে আসছে। আর কথাগুলো কানে বাজছে—‘অমৃতি এনেছিস—মানুর দোকানের অমৃতি’।
সেই সুশীলদা। বুক চিতিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে হাঁটতো। ধব্ধবে ফরসা ছোটখাটো চেহারা। কি পারসোনালিটি। গুপ্তবাড়ির ছেলে। কিন্তু সর্বহারার জন্য পার্টি করে। সবাই বলতো, ‘লিট্ল রাশিয়ান’।
সেই লোকটার আজ কি অবস্থা। শরীরটা গুটিয়ে যেন দেড়হাত হয়ে গেছে। চোখে ভালো দেখতে পায় না। হাঁটতে পারে না। সেকালের উগ্র বিপ্লবী সুশীল গুপ্ত একটা জড়ভরতের মতো ইজিচেয়ারে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। মাথার পিছনে নোনা ধরা দেওয়ালে ধুলো পড়া বিশাল স্ট্যালিনের ছবি।
সুশীলদার ছেলে সুহাস বললো—‘দেখো কে এসেছে?’ এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরে বললাম—‘আমি তেজেন। চিনতে পারছেন?’ খপ করে হাতটা ধরে বললো—‘অমৃতি এনেছিস? মানুর দোকানের অমৃতি?’ জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। সাথে সাথে চিৎকার করে সুশীলদা বলে উঠলো—‘শালা! জানতুম আনবি না’। সুহাস তাড়াতাড়ি আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো। বললো—‘কিছু মনে করবেন না। সেই সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর থেকেই মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেছে।’
বাড়িতে ফিরে আসার সময় খালি মনে হচ্ছিলো কেন গেলাম। সুশীলদা অবশ্য বিস্তর অত্যাচার করেছে শরীরের ওপর। অত্যন্ত বোহেমিয়ান জীবনযাপন।
আমি কিন্তু চিরটাকাল ভীষণ ডিসিপ্লিনড্ ভাবেই কাটিয়েছি। তাই এখনো বয়সের কামড় ধরেনি।
আগামী শনিবার বিনি আসবে হয়তো।
৮ই অগাস্ট, ১৯৮২
আজকাল বাইরে বেরোতে কিরকম ভয় ভয় লাগে। আশেপাশে যা সব দেখছি। সেদিন প্রমথেশকে যা দেখলাম। আমি তো ভেবেছিলাম ডক্টর রায়ের কোনো কাজের লোক-টোক হবে। ডক্টর রায়ের গাড়ি থেকে ফুলগাছ নামাচ্ছিল।
আমিই এগিয়ে গিয়ে বললাম—‘কিরে চিনতে পারছিস?’ কেমন যেন এড়িয়ে গেল। খারাপ লাগলো। খুব খারাপ লাগলো।
গত কয়েকমাসে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কি দেখলাম? থ্রোট ক্যানসারে প্রায় বাকরুদ্ধ মহীদা—সেরিব্রাল অ্যাটাকে প্রায় পঙ্গু সুশীলদা—আর সহায়সম্বলহীন প্রমথেশ। তাই মনে হয় আর বেরবো না। আবার বাড়ির ভিতরে নিজেকে গুটিয়ে নেব। তারপর আবার মনে হয় তা কেন? আমি তো ওদের মতো নই। কিংবা ওদের মতো ছিলাম না। প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট ওড়াইনি। বিপ্লবের নামে চরম উশৃঙ্খল জীবন যাপন করিনি। সংসারে কারও দায়িত্ব না নিয়ে হিরো হয়ে ঘুরে বেড়াইনি।
তাই আমি ভালো আছি। কারণ আমি ভালো থাকতে জানি।
২০শে মার্চ ১৯৮৩
আজ আমার জন্মদিন। গতবছরের এই সময়টার কথা খুব মনে পড়ছে। একটা বছর যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল। ভাবতে অবাক লাগে।
বিনির জন্য একটা মুক্তোর দুল কিনেছি। মুক্তো ওর খুব পছন্দের। সবশেষে দেখিয়ে অবাক করে দেবো।
কাল অনেক রাত অবধি বারান্দায় একা বসেছিলাম। বাইরের আকাশটা তারায় ভরে গিয়েছিল। বিনির মুখটা বারবার মনে পড়ছিলো—‘আসছে বছর আবার হবে’। অন্তর থেকে রবিঠাকুর বেরিয়ে এলেন। বহুদিন পরে গলা ছেড়ে গাইলাম।
‘নিখিল নি:শ্বাস আজি এ বক্ষে বাঁশরির সুরে বিলাসে...'। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিভাবে বোঝাবো আমার মনের ভাব?
তাই সাতসকালেই লিখে ফেললাম কত কথা। রাতে আবার লিখবো। আজ একটা ব্যতিক্রমী দিন।
সাড়ে সাতটা বাজছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার বেরোতে হবে।
এরপর আর পড়া সম্ভব হলো না সুশান্তর। চোখ ফেটে যেন গলানো আগুন ঝরে পড়ছিলো ওর নিজের অজান্তেই। সুশান্ত চোখ বন্ধ করলো।
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই একরাশ গাঢ় নীল অন্ধকার। যার ভিতর দিয়ে ভেসে আসছে পরপর কিছু ছবি—তার নিজের জীবনের ধূসর সম্পদ—নিজের মুখের কিছু কথা—
... ‘এই ব্যাগটা আপনার স্যার। দোকানে ফেলে গিয়েছিলেন, কাল সকালে...'
... ‘না না এই চায়ের দোকানটা আমার বন্ধুর মামার, আমি শুধু সকালে বসি, আর বেলায় ...’
... ‘বড়বাজারের একটা গদীতে খাতা লেখার কাজ করেছিলাম কিছুদিন, তারপর ওরা...’
... ‘বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ঢুকেছিলাম। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের পরে...’
... ‘বাড়িতে কেবল মা আর দাদা, দাদা লেদ মেশিনের কাজ করতে গিয়ে ...’
... ‘দেখুন না স্যার পারি কিনা, কেবল একটা মাস নাহয়...’
... ‘রান্নাবান্না সব আমিই করে দিতে পারবো স্যার, শুধু দুপুরে যদি...’
... ‘এত বই আপনার বাড়িতে, যদি সঞ্চয়িতাটা একবার...’
... ‘নাতনী আপনার কাছে আসবেই, তবে ওনারা...’
... ‘এতদিন বাদে দেখলেন, আমার কথাটা ফলে গেল কিন্তু...’
... ‘জন্মদিনে প্যান্টশার্ট পরিয়ে নাতনী আপনার বয়েস তো কমিয়ে দিয়েছে, তাহলে কি আসছে বছরও...’
... ‘দারুণ হয়েছে দুল দু’টো, তবে আপনাকে একা ছাড়বো না, আমিও আপনার সঙ্গে ...’
... ডেথ ডিউ টু সাডেন অ্যাসফিক্সিয়া বাই ইমপ্যাকশন অফ ...
সুশান্ত চোখ খুললো। কারণ চোখ বন্ধ করলেই শেষে যে ছবিটা ভেসে আসছে বার বার তা দেখা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
চোখ মেলে তাকাতেই সবুজ ছোট ডায়েরিটার দিকে কিছুটা অজান্তেই সুশান্তর হাত চলে গেল। ক্লান্ত হাতে ডায়েরিটা খুললো সুশান্ত। ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—Truth is the funniest joke in the World—GBS।
সুশান্তর ভয় হলো পরের লাইনগুলো পড়তে। যে তেজেন্দ্রনারায়ণের হাতের লেখা মুক্তোর মতো পরিষ্কার—কোথাও কোনো কাটাকুটি থাকতো না—সেখানে অজস্র কাটাকুটিতে ভরা কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় কি এগুলো? তারিখগুলো এলোমেলো—লেখাগুলো অসংলগ্ন ও অসম্পূর্ণ—যতটুকু তার ভিতর থেকে উদ্ধার করা যায়—
২২শে ফেব্রুয়ারি
আমি বেঁচে থাকতে চাই। আর ক’টা মাস। অন্তত মার্চ মাস অবধি।
২৭শে ফেব্রুয়ারি
একটা মুক্তোর দুল কিনতে হবে
২৩শে ফেব্রুয়ারি
তবে তাই হোক। আমার কথাও রইলো। তোমার কথাও
২১শে ফেব্রুয়ারি
মার্চ মাস কবে আসবে? আর ক’দিন বাকি? আমি অপেক্ষা করে আছি কত দিন।
এটি সম্ভবত তেজেন্দ্রনারায়ণের শেষ লেখা। এরপর থেকে আর কোথাও কিছু লেখা নেই। ডায়েরিটা বন্ধ রাখতে যাবে, তখন হঠাৎ করে একটা ছোট ছবি বেরিয়ে এলো ডায়েরির পাতাগুলোর মধ্যে থেকে—মাথায় কোঁকড়া চুল আর বিরাট বড়ো বড়ো চোখে দুর্গাঠাকুরের মতো তাকিয়ে রয়েছে এক কিশোরী—সুশান্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সেই দুর্গার মুখের দিকে—আর সাথে সাথেই ঝাপসা হতে থাকলো সুশান্তর দৃষ্টি।
সেই ঘোলাটে আবছা দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সুশান্ত দেখতে পেলো—তেজেন্দ্রনারায়ণ চলেছেন সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে—সাতসকালে—হাতে একটা ছোট্ট জুয়েলারি বাক্স—‘কি সুশান্ত পছন্দ হবে তো?’—‘সে তো হবেই। কিন্তু আপনাকে তো একা যেতে দেবো না’। —ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী আর ততটাই ঝলমলে সকালের আলোয় তেজেন্দ্রনারায়ণকে কি অপূর্ব লাগছিল—কিন্তু কি ভয়ঙ্কর ঐ সাদা রঙটা—যখন দেখা গেল বিনির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা সাদা অ্যাম্বুলেন্স—তার থেকে বেরিয়ে আসছে সাদা পোষাক পরা একটি নার্স—আর সেই অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে শোয়ানো ধবধবে সাদা কাপড়ে ঢাকা সেই দুর্গাঠাকুরের মুখ—কেবল চোখটা বোজানো ডেথ ডিউ টু সাডেন অ্যাসফিক্সিয়া বাই ইমপ্যাকশন অফ মিট বোন লিডিং টু... —কথাটার মানে ভালো করে বুঝতে পারেনি সুশান্ত—স্তম্ভিত হয়েছিলো ঈশ্বরের এই আশ্চর্য বিধান দেখে—যে লোকটি এত ভালো মানুষ তাঁর সাধের জন্মদিন চিহ্নিত হয়ে রইলো তাঁরই চোখের মণি নাতনীর অপঘাতে মৃত্যুর সঙ্গে—এবং সে মৃত্যু নিছক খেতে গিয়ে গলায় মাংসের হাড় আটকে মৃত্যু! সুশান্তর মনে পড়ছিল ডেথ ডিউ টু সাডেন অ্যাসফিক্সিয়া বাই ইমপ্যাকশন... —এ কথাটা বিড়বিড় করে অসংখ্যবার বলেছিলেন তেজেন্দ্রনারায়ণ।
এরপর প্রায় তিনদিন পাথরের মতো স্থির হয়ে বসেছিলেন তেজেন্দ্রনারায়ণ— বারান্দায়—ঐ বেতের চেয়ারে—কোনো রেডিও নয়— টিভি নয়—নিউজপেপার নয়—কেমন যেন জড়ভরতের মতো বসেছিলেন বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে। এইভাবে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। হঠাৎ একদিন কি মনে করে এই ছোট্ট সবুজ ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলেন তিনি। মাঝে মাঝে সেটা খুলে কিসব আঁকিজুঁকি কাটতেন কিংবা লিখতেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই ডায়েরিটা তিনি আঁকড়ে থাকতেন সর্বক্ষণ।
সুশান্ত আবার সেই ডায়েরির প্রথম পাতাটায় ফিরে এলো—Truth is the funniest joke...
বিকেলের হলুদ আলো দ্রুত আঁধার হয়ে আসছে ডায়েরির অক্ষরগুলির ওপর— দিনের সমস্ত প্রখরতা হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে এক শীতল আবছায়ায় ঢেকে দিচ্ছে চারদিক—সুশান্ত বাইরের দিকে চাইলো—তখনো একটা দু’টো করে পাতা ঝরে যাচ্ছে নি:শব্দে—সেই সময়েই—ঠিক সেই সময়েই সুশান্তর মনে হলো এই ঝরাপাতাগুলো তার বহুকালের পরিচিত—তার সঙ্গে বহুযুগের সম্পর্ক চুকিয়ে তারা এক এক করে বিদায় নিচ্ছে।
সুশান্তর হঠাৎ কেন যেন মনে পড়ে গেল তার মায়ের মুখটা—যিনি ইহকাল ছেড়ে গেছেন বহুদিন আগে—সুশান্ত আসতে পারেনি মৃত্যুশয্যায় মা’কে দেখতে—মনে পড়লো দাদার অ্যাকসিডেন্টের কথা—দাদা শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল সুশান্তর জন্য—কিন্তু কলকাতায় আসার পথেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এইসব ভাবতে ভাবতে সুশান্তর মনে হলো সে অতি দ্রুত একা ও বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে—কতদিন ধরে সে ঘরছাড়া—আত্মীয়স্বজন বর্জিত কিন্তু সব অভাব ঢেকে রেখেছিলেন যিনি—তিনি একটু দূরেই স্থির হয়ে আছেন চন্দনচর্চিত কাচের ফ্রেমে।
অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র কয়েকদিন আগেও—একটি মাত্র আশায়—মার্চ মাস কবে আসবে।
সুশান্তর মনে হলো প্রত্যেকটি বিবর্ণ পাতা সদ্যসন্ধ্যার আধো অন্ধকারে একে একে ডুবে যেতে যেতে তাকে বলে যাচ্ছে—মার্চ মাস কবে আসবে সুশান্ত... মার্চ মাস কবে আসবে... তুমি তা টেরই পাবে না... বুঝতেই পারবে না... তোমার মার্চ মাস যবে আসবে...