১
কান্ট্রিস্টাইলে ঢুকে দুই বন্ধুকেই বসে থাকতে দেখল ইমরুল। প্রদীপ ড্রাইভ করে আসে লরেন্স ইস্ট থেকে। আসার আগে ইমরুলকে ফোনে জানিয়েছিল রওনা দিয়েছে সে। ইমরুল তখন কান্ট্রিস্টাইলের উল্টোদিকের ড্রাগস্টোরে ব্লাড সুগার মাপার স্ট্রিপ কিনছিল। আর আগে থেকেই আশিক অপেক্ষা করছিল কান্ট্রিস্টাইলে।
জরুরি সভা বা মোলাকাতের বিষয় না। স্রেফ গল্পগুজবের ব্যাপার। বিরূপ আবহাওয়া ও জটিল জীবনব্যবস্থায় বন্ধুত্ব ও আলাপচারিতা মাইনাস শীতলতায় হিটিংয়ের মতোই জরুরি একটি বিষয়।
সুইটেনার মেশানো ব্ল্যাক কফি নিয়ে দুই বন্ধুর মুখোমুখি বসল ইমরুল। আশিকের ফোন বাজছিল। কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলে তারপর বলল, ‘আসতেছে।’
‘কে আসতেছে!’ ইমরুল জানতে চাইল। আর প্রদীপ প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল আশিকের দিকে।
‘ওই যে ভাবি, যাকে...। মানে বাতেন ভাই।’
‘ভাবি যাকে...কী?’ প্রদীপ বোকার মতো তাকাল।
‘উনার সাথে যোগাযোগ আছে নাকি আপনার?’ ইমরুল জিজ্ঞেস করল।
‘তেমন না। মাঝেমধ্যে ফোন দেয় তার অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে। লইয়ারের কাছে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম।’ আশিক জানাল। প্রদীপ হাওয়া বুঝতে চেষ্টা করছে। ওর চোখে প্রশ্নটা ঝুলে আছে দেখে আশিক চাপা গলায় বলল, ‘বাতেন ভাইয়ের দুর্দিন চলছে। ভাবি উনাকে ছেড়ে আরেকজনের সংসার করছে।’
‘হোলি শিট!’ প্রদীপ বলল।
‘তারপর ক্লাস কেমন চলছে?’ ইমরুলের প্রশ্নে প্রদীপ হতাশার সুরে বলল, ‘চালিয়ে নিতেছি। আপনি তো সামারের কোর্সটা আর করলেন না। করলে ভালো করতেন।’
‘ভালো করতাম। কিন্তু পড়শোনা আর ভালো লাগে না, অনেক ডিগ্রি তো নিলাম।’
‘তা ঠিক, আমারও ভালো লাগে না। তবে চলতে হবে, তাই লেখাপড়ায় নাম লিখিয়ে সরকারি লোন নিয়ে ঠেকা দিচ্ছি সংসারটাকে।’
অল্পক্ষণ পরই ভদ্রলোক ওদের সাথে যোগ দিলেন। ‘এ হচ্ছে ইমরুল ভাই,' আশিক পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আর প্রদীপ, আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু।’
পরিচয়-পর্ব ভদ্রলোকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হল, তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কালো জোব্বার পকেট থেকে একগাদা কাগজপত্র বের করলেন। জোব্বার ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য পকেট। একটা পকেট থেকে তিনি বের করলেন এলএসডি’র চালের বস্তার মতো দেখতে পার্স। ভেতরের আরেকটা পকেট থেকে বের করলেন পুরনো পাণ্ডুলিপির মতো থরে থরে সাজানো কাগজপত্র। তারপর তিনি তার ফোলা মুখমণ্ডলে বিরক্তির ছাপ ফেলে বললেন, ‘ক্ষতিপূরণ আদায়ে লইয়ার জোঁকের মতো লাইগা রইছে।’
‘গাড়ি ধাক্কা দিচ্ছিল আপনারে, না একটু হাওয়া লাগছিল?’ আশিক দাঁত বের করে হাসল।
‘আপনে হাসতেছেন। আরেকটু হইলে আমার জান যাইত। আর যা ভয় পাইছিলাম। তারপর তো আমার উকিলে কইল আপনে কইবেন, যে ভয় আমি জীবনে পাইছি তা মৃত্যুর চাইতেও খারাপ। দেখবেন সুড়সুড় কইরা পাঁচহাজার ডলার আপনের কাছে উইড়া আইব।’
বাতেন সাহেব সেলফোন নিয়ে নাড়াচাড়া কররে লাগলেন, একটা কাগজ বের করে আশিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন। ‘দেহেন তো অ্যামাউন্ট কত? চোখে কম দেখি। ক্রেডিট কার্ডের বিল, দিয়া দিই অনলাইনে।’
‘ষাট ডলার,' আশিক দেখে বলল।
‘আচ্ছা।’ বলে তিনি ফোন মুখের খুব কাছে নিয়ে বোতাম টেপায় মনোযোগী হলেন।
‘কেইসটা কী?’ প্রদীপ গলা বাড়িয়ে একবার আশিক, একবার ইমরুলের দিকে তাকাতে লাগল।
‘কেইস কিছুই না। উনারে পিছন থেকে এক সাদা খাটাস ধাক্কা মারছিল। আসলে ধাক্কা লাগে নাই, বাতাসটা লাগছিল আর ওই বাতাসে বাতেন ভাই হাঁইমাঁই কইরা উঠছিল। তারপর তো উনি উকিলের কাছে গেলেন। ওই যে দেখেন না এক বস্তা কাগজ। এইগুলা সেব কেইসের কাগজ, উনি খুব শিগগির পাঁচহাজার ডলার পাবেন।’ আশিক গড়গড় করে বলল।
‘ধাক্কাটা আপনে খাইলে বুঝতেন।’ বাতেন সাহেব কথাটা বলে ফের ক্রেডিট কার্ডের বিল দিতে ব্যস্ত হলেন। সেই ফাঁকে ইমরুল মানুষটাকে লক্ষ করছিল। ভীষণ ফর্সা তিনি, এ-দেশিয়দের মতো। গাল দুইদিকে ঝুলে পড়েছে, মুখে মাংস বেড়ে যাওয়ায় চোখ-নাক ভেতরে বসে গেছে। কালো কুচকুচে জোড়া ভুরু আর মাথায় একরাশ সাদা-কালো চুল।
‘বাতেন ভাই, যাবেন না ডাউনটাউনে? ছেমড়ি গো নাচ দেখবেন না? কাল তো ক্যানেডা ডে।’ আশিক পিটপিট করে তাকাল।
সেলফোন থেকে চোখ সরিয়ে ক্লাউনের মতো হাসলেন বাতেন ভাই, আশিকের দিকে এক লহমায় তাকিয়ে ফের সেলফোনের বোতাম টিপতে লাগলেন, সেইসাথে আড়চোখে তাকালেন ইমরুল ও প্রদীপের দিকে।
‘এটা কি আইফোন?’ ইমরুল প্রশ্ন করল।
‘না মোটোরোলা।’ বাতেন সাহেব না তাকিয়েই জবাব দিলেন।
‘এইবার ফোন রাখেন না। ডলার জমা হয় নাই?’ আশিকের কন্ঠে বিরক্তি।
‘লাস্ট স্টেপ। এখন সাবমিট টিপ দিমু।’
‘তাড়াতাড়ি টিপ দেন।’ আশিক বলল।
বাতেন সাহেব তাড়াতাড়িই টিপলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রোগ্রাম কখন?’
‘সারাদিনই তো।’
‘আচ্ছা। বসেন, একটু ওয়াশরুম থেকে আসি।’ বাতেন সাহেব ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলেন।
সেই অবসরে আটকে রাখা প্রশ্নটা আশিকের দিকে ছুড়ে দিল প্রদীপ, ‘বিষয়টা কীরে, মানে বলতেছিলি বৌদি নাকি চলে গেছে?’
‘হ্যাঁ। উনার ওয়াইফ উনাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করেছে।’ আশিক চাপাস্বরে বলল, ‘তার তিন ছেলেমেয়ের একজন নাকি মায়ের দ্বিতীয় বিয়েতে সহায়তা করেছে।’
‘কেইস তো পুরাই জটিল!’ প্রদীপ গলা আগের চাইতে আরো লম্বা করল--‘ওয়াইফ ডাইভোর্স দিল, বিষয়টা কী? ঝামেলা পাকাইছিল নাকি? গায়ে হাতটাত তুলছিল?’
‘কী জানি। আমি বাতেন ভাইয়ের কাছে অর্ধেক শুনেছি, আর অর্ধেক শুনেছি আরেকজনের কাছে। দুইজনের কথা জোড়া দিয়া বুঝলাম, অনেক সমস্যা আছে উনার বা উনার স্ত্রীর। প্রকৃত কী সমস্যা তা জানি না। কম্পিউটারে ফাইল হিডেন করে রাখার মতো।’ আশিক বলল।
‘হয়তো ব্যাকহোমে হাতের খেল দেখাতেন উনি। সেখানে ভাবি অসহায় ছিল। এখানে এসে সুযোগ হাতছাড়া করেননি। পুলিস ডেকে প্যাঁদানি দিয়েছে।’ ইমরুল মন্তব্য করল।
‘বাতেন ভাই মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার বিশ্বাস ছেলেমেয়েদের কোনো হাত নেই, সব তাদের মায়ের চাল।’ আশিক বলল।
‘মামলা করলে বাতেন ভাই নির্ঘাত হারবে, আরো ঝামেলায় পড়বে।’ ইমরুল বিড়বিড় করে বলল।
‘ওই যে আসছে।’ আশিক ইশারা করল। ইমরুল থেমে যায়। আর প্রদীপ গলা একবার লম্বা একবার খাটো কররে লাগল।
ফিরে এসে বাতেন সাহেব ছেতরে বসলেন চেয়ারে। ‘কফি খাইবেন না আর?’ তিনি অনির্দিষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
‘খাব,’ এটা এখনও শেষ করিনি।’ জবাব দিল আশিক ‘আপনি খেলে আরেকটা খান।’
‘বাতেন ভাই, আপনার সাথে এত কাগজপত্র, একটা ব্যাগ ব্যবহার করলেই পারেন। তুষারে-বৃষ্টিতে তো কাগজের বারোটা বাজবে।’ প্রদীপ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল।
‘ব্যাগ? ঝামেলার ব্যাপার ভাই। ছাতিও খুব খতরনাক জিনিস। ওইসব হাতে নিয়া মুভ করতে আরাম পাই না।’
‘কিন্তু ব্যাগ-ছাতা না থাকলে তো কাগজপত্র ভিজে পাঁচহাজার ডলারের... মারা যাবে।’ ইমরুলের নির্বিকার মন্তব্য।
‘ইমরুল, উনার যেখানে একশটা পকেট আছে সেখানে ব্যাগ হাতে নিয়ে অনর্থক ঝামেলা বাড়াবেন কেন?’ প্রদীপ বলল।
প্রদীপকে সন্দেহের দৃষ্টিতে জরিপ করলেন বাতেন সাহেব। বুঝে উঠতে পারলেন না, প্রদীপ তার সম্পর্কে ভালো না মন্দ বলল। তাই তিনি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলেন।
‘তারপর আর খবর কী আপনার?’ আশিকের প্রশ্নে বাতেন ভাই ঘোলাটে চোখে তাকালেন। মনে হলো তিনি কেঁদে ফেলবেন, কিন্তু কাঁদলেন না তিনি। হাসলেন। হেসেই বললেন, ‘আর খবর, মনে হয় চলে যাই যেদিকে দুই চোখ যায়। কিন্তু ছেলে-মেয়ে বউ তো এখানে। কই আর যাব?’
প্রদীপ উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। সেদিকে চমকে তাকালেন বাতেন ভাই। ইমরুলও পলকে প্রদীপের দিকে তাকাল। ‘একটু বিড়ি সেবন করে আসি,’ বলে প্রদীপ ইমরুলকে ইশারা করল।
ইমরুল উসখুস করছিল এতক্ষণ, প্রদীপের ইশারা পাওয়া মাত্র উঠে দাঁড়াল। আশিক সিগারেট খায় না। সে সেলফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে লাগল আর বাতেন সাহেব গমনরত এই দুইজনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন।
বাইরে এসে প্রদীপ একটা অট্টহাসি উগরে দিল। ইমরুল সংক্রমিত হয়ে বোকার মতো হাসল। প্রদীপ বলল, ‘না, মানে বাতেন সাহেবের কথায় হাসি পেল।’
ইমরুল মুখে চাপা হাসি নিয়ে একটা নেক্সট সিগারেট প্রদীপের হাত দিয়ে নিজের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘ভদ্রলোকের জন্য মায়া লাগছে। এমন ফাঁপরে কম মানুষই পড়ে।’ তারপর সে সিগারেটে পরপর কয়েকটি টান দিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছি অন্য কথা, উনাদের এতবছর বিচ্ছেদ হলো না, টরোন্টোতে এসে বিবাহটা হঠাৎ ধর্ষণের শিকার হলো!’
‘এরকমই হয় ইমরুল। আমার জানা মতে, অনেকেরই সংসার ভেঙেছে।’ প্রদীপ বলল, ‘পৃথিবীর সংসার-ব্যবস্থাকে লক্ষ করে বিধাতা একে একে ব্যালেস্টিক মিশাইল নিক্ষেপ করে খুক-খুক করে হাসছে।’
‘উনার অপরাধ কী, সেটা তো জানলাম না। হতে পারে উনি একটু আনকুথ গোছের, তাই বলে...।’
‘সংসার ভাঙতে বড় কারণ লাগে না এখানে। সবাই কমবেশি ফ্রাস্ট্রেশনে ভোগে, কারণ এখানে আছে প্রতিযোগিতা, তাই চাওয়া পাওয়ার সংঘাত বেশি হয়। তারপর আছে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়া এবং কাজ যুগিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা।’ সামান্য ইতস্তত করে প্রদীপ বলল, ‘ডায়াবেটিসের সুগার মাপার স্ট্রিপ কিনতে হিমশিম খাই। এক প্যাকেট স্ট্রিপের দাম ছিয়াশি ডলার। এটা আমার লেখাপড়ার ইন্স্যুরেন্সের অ্যালোকেশন অতিক্রম করে গেছে।’
‘ঠিক। আমারও একই দশা। ব্যাকহোম ডায়াবেটিস ছিল না। এখানে আসার পর ধরেছে।’ ইমরুল যোগ করল, ‘এরা আপনাকে মেরুদণ্ড সোজা করতে দেবে না। শিক্ষিত লোকেরা লেবারের কাজ করতে না পেরে লোন নিয়ে পড়াশোনায় ঢুকে যায়। পাস করেও চাকরি পায় না। তখন আবার লেবারের জব খোঁজে। তারপর যেই না কাজে যোগ দেয়, অমনি লোন পরিশোধের পত্র ঝুলতে থাকে চোখে সামনে।’
সপ্তাহান্তে কিংবা সাঁঝের বেলায় তিনবন্ধু আড্ডা দেয়। তিনজনের এই আড্ডাকে ইমরুল বলে আলাপন। আশিক আর ইমরুলের পরিচয় হয় লেখালেখির সুবাদে। পরে আশিক ইমরুলকে পরিচয় করিয়ে দেয় প্রদীপ কুন্ডুর সাথে। আশিক ও প্রদীপ ব্যাকহোমে ক্লাসমেট ছিল। পরবর্তীতে ইমরুল আর প্রদীপের বন্ধুত্ব গাঢ় হয় এখানে একই কলেজে লেখাপড়া করার কল্যাণে।
ত্রিরত্ন আবার কফি নিল। বাতেন সাহেব নিলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। জানালেন, জরুরি কাজ আছে। বাতেন সাহেব চলে গেলে ইমরুল ও প্রদীপ পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে এলো। অন্য টেবিলে কয়েকজন সাদা সিঙ্কহোল নিয়ে তর্ক জুড়েছে। ঢাকা শহরে স্থানে স্থানে ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা না থাকলে আর রাস্তায় ফাটল না দেখা দিলে তো কন্ট্রাক্টর আর সিটি কর্পোরেশনের লোকদের মাথায় বাজ পড়ে আর এখানে বাজ পড়ে দেখা দিলে। টরোন্টোর গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় সিঙ্কহোল দেখা দিয়েছে! ঘটনাটা আলোড়ন তুলেছে টরোন্টোবাসীদের মাঝে। এছাড়া, গত কয়েকদিনের বর্ষণে অনেক বাড়িতে ব্যাকইয়ার্ড ফ্লাড হয়েছে। মানে, বাড়ির পেছনে পানি জমে মৎস্য বিচরণযোগ্য জলাধারের সৃষ্টি হয়েছে। সিপি টোয়েন্টিফোর চ্যানেল সেসব বাড়ির মালিকদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে।
কীল স্ট্রিট ও রিচার্ডসন অ্যাভেনিউ’র মধ্যিখানে এগলিনটন অ্যাভেনিউ ওয়েস্টে ছয় মিটার দৈর্ঘ্য আর চার মিটার প্রস্থের প্রশস্ত গর্ত দেখা দিয়েছে যা গোটা একটা গাড়ি গিলে খেতে পারে।
‘গর্ত বটে!’ কান্ট্রিস্টাইলের ভেতরে ঝোলানো বিশাল স্ক্রিনে সিঙ্কহোলের ভিডিও দেখে প্রদীপ মন্তব্য করল, ‘তবু ভালো, ঢাকা শহরের মতো চোরা গর্ত না এটা। বড় গর্ত বলেই সে হা-হা করে হাসছে, যাতে সবাই সাবধান হয়ে যায়। আর ঢাকার গর্তগুলো এমনই চোরা যে কাউকে টের পেতে দেয় না, সোজা চালান করে নিজের পেটে।’
ইমরুল আগের প্রসঙ্গের রেশ ধরে বলল, ‘দোষটা আমারই। আসার আগে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল লেবারের কাজ করব কিনা। আর শুরুতেই যদি লেবারগিরি করতাম এতদিনে গাড়িবাড়ি হয়ে যেত। ভাবছি এবার চৌকিদারের কাজে নেমে পড়ব।’
‘ভালোই হবে। যে ডিগ্রি নিয়েছেন তাতে চাকরি না হওয়া পর্যন্ত সিকিউরিটির কাজ চালিয়ে যান।’ প্রদীপ কথাটা বলে আশিকের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, ‘তোর কী হলো, চুপ করে আছিস যে! কবিতা ঢুকল নাকি মাথায়?’
‘না, মন ভালো না।’
‘মন ভালো না থাকলে বাতেন সাহেবকে নিয়ে ডাউনটাউনে চলে যা। বৌদির সাথে কিছু হয়নি তো আবার? না, না। আমারও তো হয়...সবারই হয়।’ প্রদীপ ফ্যা-ফ্যা করে হাসল। আশিকও হাসল এবার, বলল, ‘সবারই একই অবস্থা, বউয়ের দাবড়ানিতে কাহিল।’
‘খালি বউয়ের বদনাম করে বেড়ান, না? এক নবাগতা ওদের টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আশিক বলল, ‘আরে বিউটি আপা যে! হঠাৎ কান্ট্রিস্টাইলে?’
‘বাংলাদেশ সেন্টারে একটা প্রোগ্রাম ছিল। আবৃত্তি করে ফিরছিলাম। কফির তেষ্টা পেল। অনুষ্ঠানে কফি ছিল না, চা ছিল। ভাবলাম কফি নিই এখান থেকে।’
‘ভালো করেছেন। কফি আমিই খাওয়াচ্ছি আপনাকে। বসুন, সময় আছে?’
‘একটু বসা যায়,’ বলে বিউটি বসল।
‘টরোন্টোর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র বিউটি আপা। পরিচয় আছে?’ আশিক তাকাল প্রদীপ ও ইমরুলের দিকে। বিউটি বলল, ‘ইমরুল ভাইকে চিনি। মানে নামে চিনি। ভালো লেখেন উনি।’
‘আর এ হচ্ছে প্রদীপ। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু।’
আশিক কাউন্টার থেকে কফি নিয়ে এলো বিউটির জন্য। বিউটি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আপনারা বুঝি বউ-বিষয়ক আলোচনা চালাচ্ছিলেন...।’
‘না, মানে শুধু বউদের দোষ হবে কেন?’ প্রদীপ অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল, ‘এই ধরুন না বাতেন ভাইয়ের স্ত্রী যে উনাকে ছেড়ে অন্য লোকের কাছে চলে গেল, সেই লোকটারও তো স্ত্রী ছিল। সেই লোক কেন আরেকজনের ঘর ভাঙল!’
বিউটি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। সেদিকে তাকিয়ে আশিক বলল, ‘না, শুধু স্ত্রীরাই দায়ি না, স্বামীদেরও দোষ আছে-- সেকথাই প্রদীপ বলতে গিয়ে বাতেন ভাইয়ের উদাহরণ দিল।’
চোখ সরু করে বিউটি জিজ্ঞেস করল, ‘বাতেন ভাইয়ের ওয়াইফ যাকে বিয়ে করেছে তার নাম জানেন?’
‘আজম। গ্যাস স্টেশনের মালিক।’ ইমরুল বলল।
‘আমিও শুনেছি, তবে আমার মনে হয় ভদ্রমহিলা এতটা না করলেও পারতেন...। আমাকে উঠতে হবে। উনি আবার পইপই করে শুধাবেন প্রোগ্রাম তো কখন শেষ হলো, এতক্ষণ কী করলে? আমি আবার মিথ্যে বা তাৎক্ষণিক বানিয়ে কিছু বলতে পারি না।’
বিউটি বিদায় নেবার পর তিনজন অফ হয়ে বসে রইল। নীরবতা ভেঙে প্রদীপ বলল, ‘আকর্ষণীয়া মহিলা।’ আশিক কাষ্ঠ হাসি দিল প্রদীপের মন্তব্যে।
রাত এগারোটায় বাসায় ফিরল ইমরুল। প্রদীপ ওকে গাড়িতে করা বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকেই বউয়ের ঝামটা খেল ইমরুল।
‘আড্ডা দিয়ে রাতবিরেতে বাসায় ফেরো। তিতলির জ্বর, সে খবর রাখো?’
‘তিতলির জ্বর! কই দেখি।' বলে মেয়ের কামরায় ঢুকল ইমরুল। তিতলির কপালে হাত রেখে বলল, ‘তাই তো। ঠিক আছে, রাতে টাইলেনল খেয়ে শুয়ে পড়বে তুমি। সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?’
মেয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দিল। তিতলির রুম থেকে বেরিয়ে ইমরুল বলল, ‘জ্বর আছে। টাইলেনল দিয়ে দাও। সকালে ডাক্তার দেখাব।’
কেয়া ফ্রিজে খাবার তুলে রাখছিল। কোনো মন্তব্য করল না। ইমরুল ডাইনিং চেয়ারে বসে বলল, ‘তিতলির জ্বর হতে পারে, তার সাথে আমার আড্ডা দেয়ার সম্পর্ক কী? আমি তো দুপুরে ওকে খাবার বেড়ে দিয়েছি, সে ভালোভাবেই খেল। তখন তো কোনোকিছু অস্বাভাবিক দেখিনি বা ওকে কিছু বলতে শুনিনি।’
‘বলছিলাম বাইরে থেকে তুমি আগে ফিরে এলে সন্ধ্যায়ই ডাক্তারের কাছে যেতে পারতাম।’
‘তাহলে আমাকে ফোন করলে না কেন! চলে আসতাম।’
‘ভুল হয়ে গেছে।’
‘তুমি আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। আর আড্ডা শব্দটা আমার পছন্দ না। এই শব্দটা এখানকার চালবাজ লোকেরা ব্যবহার করে। আমি বন্ধুদের সাথে কথা বলি, আলোচনা করি। তাতে কোনো পথ হয়তো খুলে যেতে পারে। আর আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলবে না। বিষয়টা আমার দিক থেকে শুরু হলে তুমি কূল পাবে না।’
এবারও কিছু বলল না কেয়া। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘আমি ঘুমোতে যাচ্ছি, সকালে ডিউটি আছে। পারলে তিতলির দিকে নজর রেখো।’
ইমরুল প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না, ঢাকনা উঠিয়ে রাতের বরাদ্দ দু’টি রুটি ও তরকারী টেনে নিল। ততক্ষণে কেয়া ঢুকে গেল বেডরুমে। খেতে খতে ইমরুল ভাবল: কেয়ার এটা বিচ্ছিরি স্বভাব। হুটহাট আপত্তিকর কথা বলে ফেলবে। সে চটে গেলে বা প্রতিবাদ করলে নরম বা গম্ভীর স্বরে ‘সরি’ অথবা ‘ভুল হয়ে গেছে’ বলবে। এই অভ্যেস তার হয়েছে এদেশে আগমনের পর থেকে। কেয়ার এসব অভ্যেস ও কথাবার্তা পূর্বপরিকল্পিত কিনা কে জানে, কেননা এইদেশে আসবার প্ল্যান বা ইচ্ছা ইমরুলের ছিল না। কেয়ার ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করতেই তার এখানে আসা।
রাতে জ্বর বেড়ে গেল তিতলির। ইমরুল থার্মোমিটারে দেখল একশ’ তিন। তিতলিকে জলের সাথে আরও একটা টাইলেনল দিয়ে রাত তিনটায় ইমরুল ঘুমোতে গেল। তিতলিকে স্কুল থেকে আনা নেয়া, ঘর দেখাশোনা, এমনকি রান্নাবাড়া করা তার ডিউটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতমাস থেকে কেয়া জব করছে। তেমন আহামরি কিছু না, চাইল্ডকেয়ার সেন্টারে আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেটর। কেয়া দুইবছর কলেজে আর্লি চাইল্ডহুড বিষয়ে পড়াশোনা করে পাস করেছে। আপাতত অন কল-এ কাজ করছে।
সকালে তিতলিকে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল ইমরুল। তিতলি গ্রেড সেভেনে পড়ে। ইমরুল বিয়ে করেছিল আটত্রিশ বছর বয়সে। ইমরুলের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ছেলেমেয়েদের ছোটো রেখে। ইমরুল তখন কলেজে পড়ত, ছোটো দুই ভাইবোন স্কুলে। তবে সংসারটা পানিতে পড়ে যায়নি। বাবা একটা একতলা বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। বাড়ির একাংশ ভাড়া দিয়ে আর বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইমরুল টিউশ্যানি করত। তারপর পাস ও চাকরি জোগাড় করতে এবং ছোটো দুই ভাইবোনের দেখাশোনা করতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছিল বিয়ে করতে। বিয়ে করবে না বলে ঘোষণাও দিয়েছিল। কিন্তু মায়ের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে সে।
২
এক উইকএন্ডে ইমরুল জানাল সে সিকিউরিটি জব করবে। ইমরুল এমন একটা কিছু বলুক, কেয়া আশা করত। কেয়া গদগদ হয়ে বলল, ‘তুমি ডায়াবেটিস নিয়ে নাইট ডিউটি করতে পারবে?’
কেয়া বোধহয় নিয়ম রক্ষা, তথা ভদ্রতা করতেই কথাটা পাড়ল। ইমরুল বলতে চাইল, ‘তাহলে করি না জব, কী বলো?’ কিন্তু সে কিছুই বলল না।
‘দিনে ডিউটি নেয়া যায় না?’ কেয়া জানতে চাইল।
‘না, প্রথম অবস্থায় ওরা দিনে ডিউটি দেবে না।’
‘আচ্ছা, তাহলে তুমি ভেবে দেখো সিকিউরিটির কাজ করবে কিনা।’ উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখাল কেয়া।
‘আমি করব এবং সহসাই।’ ইমরুল গম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা দিল।
টরোন্টোতে এসে প্রথমেই ইমরুল ট্রেনিং করে, সিকিউরিটির পরীক্ষা পাস করে লাইসেন্স নিয়ে রেখেছিল। পড়াশোনায় ঢুকে যাওয়ায় সিকিউরিটির কাজ করার দরকার হয়নি। এখন সেটা কাজে দিল। প্যারাগন নামের কোম্পানি ওকে সিকিউরিটি জব দিয়ে একটা বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ডিউটিতে দিল।
রাতে ডিউটি করে দিনে ঘুমিয়ে ইমরুলের কান্ট্রিস্টাইলে যাওয়া প্রায় বন্ধ হলো। দেখা সাক্ষাৎ বেশিরভাগ হতো উইকএন্ডে, কিন্তু শনি-রবিবারে ইমরুলের ডিউটি থাকায় সব গড়বড় হয়ে গেল।
...ইমরুল এখন জবরদস্ত পাহারাদার। যদিও এরা বলে সিকিউরিটি অফিসার। ওরা অনেক কিছুই বলে কিন্তু ইমরুল পাহারাদার ছাড়া অন্য কিছু বলে না। পাহারাদার বলার মধ্যে যে একটা প্রহসন লুকিয়ে আছে, ইমরুল সেটা প্রকাশ করতে চায়। ওর পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর পাহারাদারের নেতিবাচক দিকগুলো একবাক্যে খোলাসা করার নিমিত্ত সে পাহারাদার ছাড়াও আরো যথাযথ শব্দ খুঁজছে যাতে কেউ ‘আপনি কি করছেন’ প্রশ্ন করলে জবাবে যেন যুগপৎ নিজের পদ ও ভোগান্তি প্রশ্নকর্তার কাছে চটপট তুলে ধরতে পারে।
প্রতি নিস্তব্ধ রাতে ডিউটির ফাঁকে আগের জীবনের কথা ভাবে ইমরুল। ছকবাঁধা জীবন যাপন করত সে। অভ্যেসটা হয়ে গেছিল বাবা’র মৃত্যুর পরপরই--সংসারের দায়িত্ব ও বাস্তবতা অকে নিয়মনিষ্ঠ হতে শিখিয়েছিল। বিয়ের পর তাই সে রুটিনমাফিক জীবন যাপন করত। আর এখানে সবকিছুতে অনিয়ম--রাতে সে প্রেতের মতো নি:শ্বাস ফেলে বেড়ায়। কতকাল যেন সে জেগে আছে!
সরকারি চাকরিতে থাকাকালিন একবার সে একটা নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ডের তদন্তে গিয়েছিল, তার সাথে ছিল বন্দুকধারী দুইজন সিকিউরিটি গার্ড। এখন সে নিজেই গার্ড, আর পাহারা দেয় একত্রিশ তলা অ্যাপার্টমেন্টে ভবনে, যেখানের অধিকাংশ বাসিন্দাই ইমিগ্র্যান্টস এবং লেবার, যারা ব্যাকহোমেও লেবারের কাজই করত।
একরাতে ডিউটিতে এসে ইমরুল ভাবছিল--দু’জনের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে। পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার মাত্রা কমছে। কেয়া এখন অতি ব্যস্ত কর্মক্ষেত্র নিয়ে। ইমরুল জানে, কেয়া কাতর হয়ে উঠছে বাংলাদেশ ঘুরে আসার জন্য। নিজের তাগাদায় এসেছিল কেয়া। আসার কিছুদিনের মধ্যেই কেয়ার অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়--দু’জনের কেউ কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছিল না। কেয়া তখন ক্লিনারের কাজ করতেও প্রস্তুত ছিল। ইমরুল পড়াশোনার বুদ্ধিটা বের করে সামাল দিল পরিস্থিতি, টানাপোড়েন বেশিদূর এগুতে পারেনি। তিতলির চাইল্ড বেনেফিটের টাকা ও সাথে আনা কিছু অর্থকড়ির বদৌলতে উতরে যায় ওরা। দু’জনেই পড়াশোনায় ঢুকে সরাসরি লোনে চলল।
এখন দেখা যাক কেয়া কতদূর এগুতে পারে। ইমরুলের নিজের কোনো লক্ষ নেই। সে সামনে কিছু দেখতে পায় না। বর্তমান যেন চোখ মেলে আছে কাপালিকের মতো। কয়েকদিন মনের ভেতর ঘোরাফেরা করলেন বাতেন সাহেব। লোকটা দুর্ভাগ্যবান, কিন্তু যতটা তিনি দুর্ভাগ্যবান ততটা প্রকাশ ভঙ্গিতে নেই। একটা উত্তর আজও মেলেনি--কী এমন ঘটেছিল যে, বউ-ছেলেমেয়ে একযোগে তাকে ত্যাগ করল!
তার বর্তমান সাইটের মেয়াদ শেষ। কোম্পানি জানিয়েছে অন্য সাইটে তাকে দেয়া হবে। ইমরুলের মনে আনন্দ-শিহরনের ঢেউ খেলছে। ক’টা দিন তার অখণ্ড অবসর।
সাততলা অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বিকেলে মরিচগাছ আর টমেটো গাছের পরিচর্যা করে সে। কুল সামার থাকায় গাছগুলো তেমন বাড়ছে না। কান্ট্রিস্টাইলে যাবে কিনা ভাবছিল। সে প্রদীপকে ফোন দিয়ে বলল, ‘আলাপন চলবে নাকি? আশিককে ফোন করেছিলাম, সে তো ফোন ধরছে না!’
‘ধরবে না। সমস্যায় আছে।'
‘কী সমস্যা? কোনো বিপদ আপদ?’
‘আপনি আসুন, এলে বলব।’
৩
সামনে কফি নিয়ে রেইজিন টি-বিস্কুটের সদ্ব্যবহার করছিল ইমরুল। প্রদীপ সুইটেনার মেশানো কফি নিয়ে ইমরুলের মুখোমুখি বসল। প্রদীপ গম্ভীর মুখে বলল, ‘বৌদি আর আশিকের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে।’
‘বলেন কী! কেন?’
‘বৌদি নাকি দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করে আশিককে বলে ওইসব ছাইপাঁশ লেখালেখি ছেড়ে লেবারের কাজ ধরতে। আশিকও মেজাজ চড়িয়েছিল। বৌদি আলাদা হয়ে যাবার হুমকি দিয়েছে।’
‘আশিক ভাই একটা কিছু কাজ করুক।’
‘হ্যাঁ, আমি আশিককে বলেছি। সে বলল, এত বছর তো সে-ই স্টোরে কাজ করে সংসার চালিয়েছে, মাত্র কয়েকদিন হলো টিম হরটনে যোগ দিয়ে স্ত্রীর পাখা গজিয়ে গেছে।’
প্রদীপ খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে উঠল। বলল, ‘আপনি তো জব করছেন এখন। টাকা আসছে, বৌদিকে সামাল দেয়া যাবে। আর বৌদি অত মেজাজিও না। কিন্তু আমি ভাবছি আমার বউ না আবার আমাকে বেকার বলে উল্টোসিধে করে বসে।’
‘প্রদীপ, বৌদি ভালো মানুষ। আপনার প্রতি কেয়ারিং।’
‘তা অবশ্য ঠিক।’ প্রদীপ বলল, ‘সেই যে আমি পড়াশোনা করছি তিনবছর যাবৎ, একটা কমপ্লিট করে আবার আরেকটা প্রোগ্রামে ঢুকছি, আপনার বৌদি কোনো আপত্তিই করেনি; বরং সে আশাবাদী যে আমার একটা চাকরি হবে অচিরেই।’
প্রদীপ আবার বলল, ‘জানিনা কী হবে। হয়তো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আশিক না আবার মাথা গরম করে ফেঁসে যায়। আর পুলিসগুলো হারামীর একশেষ। এসেই দমাদম ঘুষি লাগায়।’
‘বলেন কী? ঘুষি লাগায় কেন!’
প্রদীপ বলল, ‘লাগাবে না? তারা এইসব শিকারের জন্য ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই হাতের সুখ মিটিয়ে নেয়।’
‘কিন্তু আইন তো তা বলে না।’
‘বলে না, তবে সবদেশেই লুপহোল, মানে ফাঁকফোকর আছে। অভিযোগ উঠলে পুলিস সোজা বলবে--লোকটা বউ পিটিয়ে আক্রমণাত্মক ছিল, তাই নিজেদেরকে সেফ রাখতে এবং লোকটাকে বাগে আনতে ঘুষি চালায়। ব্যস, মামলা শেষ।’
‘এই দিকটা তো ভাবিনি!’ ইমরুল বলল।
‘ভাবুন, সব দিকই ভাবুন এবং ভেবে ভেবে জীবনটা শেষ করে দিন।’ প্রদীপ আলোচনার সমাপ্তি টানার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়, ‘চলেন বাইরে গিয়ে আরেকটা বিড়ি ফুঁকে বাসায় যাই। আজ আপনাকে নামিয়ে দিতে পারব না। গাড়ি আনিনি।’
কান্ট্রিস্টাইলের বাইরে এসে দু’জন চত্বরমতো স্থানটায় দাঁড়িয়ে ধুম্র উদ্গীরণ করে যে যার পথে হাঁটা ধরল।
বাসায় ফিরতে ফিরতে ইমরুল ভাবল, বাস্তবতা বুঝি এরকমই। হয়তো বাতেন ভাই আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। যা তার জীবনে ঘটে গেছে, সেটা একটা ট্র্যাজিক আয়রনি। বাতেন ভাই কি ভাবিকে সন্দেহ করতেন? তার কি ওথেলো সিনড্রোম ছিল? এরকম প্রশ্ন মাথায় খেলল কেন!
ইমরুল হাঁটতে হাঁটতে সেকথাই ভাবছিল। মনে পড়ল তার--আশিক উচ্চারণ করেছিল এই শব্দটা, বাতেন ভাইয়ের প্রসঙ্গেই। তখন গুরুত্বের সাথে বিষয়টা ভাবেনি সে। এখন ভাবছে। আর আশিকের কী হবে? সে কি বিচ্ছেদের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে? হয়তো।
এরকম অনেক ‘হয়তো’ নিয়েই জীবন। সেখানে জটিলতা ও বিচ্ছেদ আছে। আশার আলোও ঝলকানি দেয়--হাঁটতে হাঁটতেই আরেকটা বিষয় ওর মস্তিষ্কে সুড়সুড়ি দিল। এবার সে সপরিবারে বাংলাদেশ যাবে। চাকরির সুবাদে তার হাতে এখন জমানো অনেক টাকা। হয়তো জমানো টাকার সিংহভাগই চলে যাবে ভ্রমণে। তা যাক, সময় তো আর টাকা না যে ব্যাংকে জমা করে রাখবে, তারপর দরকার মতো তুলে কাজে লাগাবে। কেয়া হয়তো আহ্লাদে বলে উঠবে, ‘স্বপ্নের মতো লাগছে!’ এতটুকু সে বউয়ের জন্য করবে। করতেই হবে...।
ঘোরলাগা অনিশ্চয়তা নিয়ে ইমরুল গন্তব্য পানে চলল। তার চলার সাথে বিছানো ঘষা আয়নার মতো অস্পষ্ট বর্তমান, উত্তরকাল আগলে আছে এক রোমশ কালো দানব।