দ্যাখো— লক্ষ্য করে দ্যাখো— ঐ কাকটাকে—সমানে ঠুকরে যাচ্ছে ঐ নোংরা কাপড়ের পুঁটলিটাকে— কি যেন একটা খুঁজে বার করবে ঐ পুঁটলিটার থেকে— যেটা ভেসে যাচ্ছে এই আদি গঙ্গার ঘোলাটে জলে— দিনশেষের নিভৃত আলোয়— দ্যাখো ভালো করে দ্যাখো—
আসলে কাপড়ের পুঁটলি নয়— ভাগাড়ের কাক নয়— ভেসে যাচ্ছে এক আত্মারামের কাহিনী—দিনান্তের এই পুণ্যতোয়ায়— দ্যাখো।
বহুদিন আগের কথা হঠাৎ তলপেটের ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাতে। আমার ঘরে আমি একাই শুই। বউ শোয় পাশের ঘরে। একাই বাথরুমে গেলাম বেশ কষ্ট করে। বাথরুমে গিয়ে পেচ্ছাপ করতে গিয়ে দেখি যন্ত্রণা আরও দ্বিগুণ বাড়লো। ফোঁটা ফোঁটা করে পেচ্ছাপ পড়লো। সঙ্গে কয়েক ফোঁটা রক্ত। সেই রাতটা যেন এক যমযন্ত্রণায় কাটলো। পরদিন সকালে ব্যাপারটা আর চেপে রাখা গেল না। অর্থাৎ ডাক্তার-বদ্যি পরীক্ষা-নিরীক্ষা নার্সিংহোম-হাসপাতাল পরপর করে চলে এলো এবং সবশেষে পাওয়া গেল সেই মারণ রোগ। প্রস্টেট ক্যান্সার।
তারপর যা হয় তাই আর কি। অনেক ডাক্তার। অনেক মত। অপারেশন। কেমোথেরাপি। রেডিওথেরাপি। তাছাড়া হোমিওপ্যাথি আয়ুর্বেদিক তো আছেই। সবকিছু মিলেজুলে চিকিৎসা বলে একটা মহাযুদ্ধ শুরু হল। অবশ্য যুদ্ধের ফলাফল সবারই জানা ছিল। তাই শুরু হল আমার বেঁচে থাকার চরম যন্ত্রণা।
ঠিক এই অসহ্য যন্ত্রণার সময়ই মিহির এলো আমার কাছে। আমার ছোটো বেলার বন্ধু। বাড়ি পালিয়ে বহুকাল তন্ত্রমন্ত্র কি সব সাধনা করেছিল। তান্ত্রিক হিসেবে নয় একেবারেই বন্ধু হিসাবে। নিজেই আমার ঠিকানা যোগাড় করে হাজির হয়েছিল আমার বাড়িতে। ওকে সবকথাই বললাম।
“আমি তোকে কোন কবজ-মাদুলি রত্ন-টত্ন ধারণ করতে বলছি না”— বলে শুরু করল মিহির। অনেক কথার পর শেষ করল— “কতকিছুই তো করলি দ্যাখনা এটা করে”। বলে হঠাৎ করে উঠে গেল ও। মিহিরের কথাগুলো যদিও আজগুবি কিন্তু আন্তরিক বলে মনে হয়েছিল আমার। তাই এক দারুণ যন্ত্রণার রাতে ওর এই কথাগুলোকেই আঁকড়ে ধরলাম ডুবন্ত মানুষের মতো।
“ঈশ্বর না মানিস, পাপ-পুণ্য তো মানবি? এই শেষ বেলায় চেষ্টা কর যতটা পাপের বোঝা হালকা করা যায়। কিভাবে জানিস? সর্বশক্তিমানের কাছে গিয়ে নতিস্বীকার কর। স্বীকার কর সমস্ত গোপন কথা"— কিরকম অদ্ভুত স্বরে বলেছিল মিহির। “তাহলে লিখে ফেল তোর সমস্ত গোপন কথা। কোনো লুকোছাপা রাখিস না।” মিহিরের কথাগুলো আরেকবার মনে রেখে চেষ্টা করলাম একটা পুরোনো সবুজ ডাইরির পাতায় আমার পাপের কথা লিখতে।
“আজকাল প্রায়ই সাত্যকির কথা মনে পড়ে। সাত্যকি রায়। আমার ছেলেরই বয়সী ছিল। বনেদি বাড়ির ছেলে। শিক্ষিত। সৎ। কিন্তু আর্থিক অবস্থার অবনতি সাংঘাতিক। এদের পৈতৃক প্রপার্টির মর্টগেজের ব্যাপারে আমার কাছে এসেছিল। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছিলাম। সেই মতো ও এসেওছিলো কদিন বাদে। আমার সামান্য ভুলে বিরাট ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল ওর। সেটাকে ঢাকার জন্য ওকে আরও কয়েকটা ডকুমেন্ট আনতে বলেছিলাম। যেটা ওর পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ও জিজ্ঞেস করেছিল— 'তাহলে আমি এখন কি করব?' বলেছিলাম— 'ভবানীপুরে থাকো না? জগুবাজারের কাছে? ওখানে অনেক শাড়ীর দোকান আছে শুনেছি। যে কোনো একটা শাড়ীর দোকানে যাও। দেখেশুনে মজবুত দেখে একটা শাড়ী কেনো। তারপর রাতে ঝুলে পড়ো।' ও মাথা নীচু করে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমার কথাটা মেনেছিল অক্ষরে অক্ষরে। তিনদিন বাদে ওর ঝুলন্ত মৃতদেহটা ঘরের দরজা ভেঙে বের করা হয়। ওর টেবিলের উপর পড়েছিল দু-পাতার একটা সুইসাইড নোট। তবে সেখানে আমার নাম ছিল না দেখে খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম।"
এইটুকু লিখতেই অনেক সময় লেগে গিয়েছিল আমার। প্রথমে তো বসতেই পারছিলাম না। ঠিকমতো পেন ধরতে পারছিলাম না। লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন টেরই পাইনি। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানার পাশে পড়ে আছে ডাইরিটা। আর হাতে খোলা পেন। তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমে গেলাম। পেচ্ছাপে কোন জ্বালা নেই। ব্যথা নেই। অথচ এই ব্যথাটাই তো করতো ইদানিং। রক্তও পড়তো ফোঁটা ফোঁটা। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাওয়াটাই তো ছিল আতঙ্ক। লেখাটা শুরু করার পরেই কি আশ্চর্যভাবে সেটা যেন কেটে গেল। মনে হল মিহিরের কথাগুলো তো তাহলে মিথ্যে নয়। মিহিরকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। ঈশ্বরকেও।
এর সপ্তাহখানেক বাদে কোমরের ব্যথাটা আবার অসহ্য হয়ে উঠেছিল। সারারাত বসে থাকতাম বেতের চেয়ারটায়। দিনে তিনটে করে ব্যথার ওষুধেও কিচ্ছু হতো না। কেবল ঝিমধরা ভাব আসতো। মনে হলো— হ্যাঁ আরও একটা পাপের কথা বলতে হবে আমায়। নয়তো এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেই। ঐ রকম ঝিমধরা অবস্থাতেই একদিন রাতে ঐ সবুজ ডাইরিটা বের করে আবার লিখতে শুরু করলাম—
"সুকান্তিদা আমার অফিসেই কাজ করতেন। লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে। বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন। যার জন্য অনেকেই এই নিয়ে অনেক ঠাট্টা এমনকি নিষ্ঠুর রসিকতা করতেও ছাড়তো না। ওনার বউ ছিল পাগলাটে টাইপের। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত নিজের খেয়ালে। অফিসে একমাত্র আমিই সুকান্তিদাকে ভালোবেসে সম্মানের সঙ্গে কথা বলতাম। সুকান্তিদাও আমায় খুব ভরসা করতেন। একদিন আমায় একটা প্যাকেট দিয়ে বলেছিলেন— 'এটা রাখো এটায় তিরিশ হাজার টাকা আছে। অনেক কষ্টে জমিয়েছি তোমার বউদির জন্য। আমার অবর্তমানে— বুঝতেই পারছো— কোথাও একটা জমা করে দাওতো। আমি তো এসবের কিছুই বুঝি না। তুমি তো আমার আপনজন।' বুঝেছিলাম সুকান্তিদার ব্যাপারটা। খুব সাবধানে প্যাকেটটা বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে ভেবে রাখছিলাম কিভাবে কোথায় টাকাটা জমা রাখা যায়। ওনার স্ত্রীর জন্য। কিন্তু এসব কিছুই করতে হয়নি পরদিন পফিসে এসেই শুনলাম সুকান্তিদা গতরাতেই মারা গেছেন বাড়ি ফেরার পথে বাস অ্যাক্সিডেন্টে। সুকান্তিদার টাকার প্যাকেটটা তখন আমার কাছে একটা বিরাট ধাঁধার মতো লাগছিল।"একমাস বাদেই আমার বিয়ে। টাকার দারুণ টানাটানি। ভাবছিলাম যদি কারোর থেকে ধার পাওয়া যায়। মনে হলো সুকান্তিদা এই টাকাটা আমায় বোধহয় ধার হিসেবেই দিয়ে গেলেন। আমায় ভীষণ ভালোবাসতেন তো। এই ভাবেই নিজে নিজের যুক্তি তৈরী করে ফেললাম সারারাত ধরে। ঠিক করলাম এখন নিয়ে নিই টাকাটা পরে সুদ সমেত ওনার স্ত্রীকে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবো। টাকাটা খুব কাজে লেগেছিল আমার। কিন্তু সুকান্তিদার স্ত্রীকে সেটা কোনদিনও ফেরত দেওয়া হয়নি। ঠিকমতো খোঁজই নেওয়া হয়নি ওই মহিলার। অনেক দিন পর শুনেছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনে নাকি ভিক্ষে করতে দেখেছিল কেউ কেউ। ততদিনে অনেক প্রমোশন হয়ে গেছে আমার প্যাকেটটার কথা মুছেই গেছে মন থেকে।"
কোমরের অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও একটানা লিখেছিলাম কথাগুলো। তারপর লেখাটা শেষ করে দুটো ব্যথার ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে ওঠার সময় দেখলাম ব্যথাটা আর নেই। ভাবলাম ডবল ডোজ ওষুধের ফল। কিন্তু না। ওষুধের অ্যাকশন কেটে গেলে ব্যথাটার ফিরে আসার কথা। তা কিন্তু হলো না। ব্যথাটা যেন ভ্যানিশ করে গেল একেবারে। মিহিরের কথাগুলো এবার ধ্রুবসত্য বলে মনে হতে লাগল আমার।
এর কদিন বাদেই আমার মনে হচ্ছিল আমি একশো ভাগ নিশ্চিত যে এই যে এখন খেতে পারছি না— বমি বমি ভাব আসছে— লোকে বলছে এসব কেমোর সাইড এফেক্ট— এগুলোও চলে যাবে আমার শেষ স্বীকারোক্তির পর। কারণ আমার বিশ্বাস আছে। গভীর বিশ্বাস। মিহিরকে। ঈশ্বরকে। আমি তো হাতেনাতে ফল পেয়েছি। এই ডাইরি লেখার পর থেকে, নিজের পাপগুলো স্বীকার করার পর থেকে আমার পেচ্ছাপের জ্বালা আর রক্ত আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চলে গেছে সেই অসহ্য কোমরের ব্যথাটাও; এখন শুধু এই বমি ভাব আর অখিদে। যার জন্য কিছুই মুখে তুলতে পারতাম না। তাই আজ রাতেই অতি নির্লজ্জের মতোই লিখতে হবে আমার সবচেয়ে গোপন পাপের কথাটা। তিনদিন প্রায় কিছুই খেতে পারছি না।
“তখন আমার বয়স তেরো। রেণুপিসি থাকতো আমাদের বাড়িতে। বাবার মামাতো বোন। আমার চেয়ে বছর দশেকের বড়ো। শুনেছিলাম অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল রেণুপিসির। ওর বর ছিল পাগল। একদিন কোথায় যে উধাও হলো কে জানে সেই থেকেই রেণুপিসি থাকতো আমাদের বাড়িতে। ঠাকুর প্রতিমার মতো দেখতে ছিল রেণুপিসিকে। আমি ছিলাম বাড়ির সবার ছোটো। আমায় খাইয়ে দিতো। পড়ার বই খেলনা সব গুছিয়ে রাখতো। ও ছিল আমার ছোটো বেলার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু।"কিন্তু সেই বয়সটা যে আমার বড়ো খারাপ ছিল। কিম্বা আমি ছিলাম অতি বদ প্রকৃতির। কে জানে?
"সেদিন ধুম জ্বর এসেছিল আমার। বাড়ি শুদ্ধু সবাই গিয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। রেণুপিসি কোথাও যেত না। তাই ওষুধের শিশি আর জলপট্টি নিয়ে বসেছিল আমার পাশে। বারবার আমার মাথা ধুইয়ে দিচ্ছিল। মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল। ওই সময় আমি আধবোজা চোখে দেখিছিলাম রেণুপিসির আঁচল সরে যাওয়া ধবধবে ফর্সা শরীরটা। আমার শরীরের ভিতরটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। এর পর থেকেই আমার চোখে রেণুপিসির চেহারা একেবারেই বদলে গেল।”
এই পর্যন্ত লেখার পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলাম ডাইরি আর পেন আমার সামনেই পড়ে রয়েছে। সেই প্রবল বমি ভাবটা আর বুঝতে পারছি না। আবার লিখতে শুরু করলাম। কারণ সুস্থ হতে গেলে এই স্বীকারোক্তিটুকু আমায় করতেই হবে—
"রেণুপিসি কি বুঝতে পেরেছিল আমার এই পরিবর্তন? জানি না। কিন্তু এরপর থেকেই আমি রেণুপিসিকে স্পর্শ করতাম যখন তখন। রেণুপিসি কখনই আমায় বাধা দেয়নি। মনে হয় আমাদের মধ্যে এই নিয়ে একটা গোপন খেলা চলত সারাক্ষণ। তারপর একদিন এল তার চরম মুহূর্ত। সেদিনও বাড়িতে কেউ ছিল না। দাদুর শেষ অবস্থা। সবাই দেখতে গিয়েছিল। আমি যাইনি পেটের অসুখের মিথ্যে অজুহাতে। কারণ আমার মনে তখন অন্য চিন্তা ধিকধিক করছে।
এই পর্যন্ত লিখতে একবারও কোনো ব্যথা যন্ত্রণা বমিভাব টের পেলাম না। তাই যেন ঘোরের মধ্যে লিখে ফেললাম বাকিটা—
"রঙ ফলিয়ে বেশি করে বলার কিছু নেই। আবার কম করে বলারও কিছু নেই। সেইদিন দুপুরে রেণুপিসির শরীরে আমি আমার সমস্ত গোপন ইচ্ছাগুলো গেঁথে দিয়েছিলাম। তখন আমি ছিলাম ষোল আর রেণুপিসি ছাব্বিশ। তারপর রেণুপিসির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম কি অদ্ভুবভাবে বদলে গেছে তার দৃষ্টিটা। যেন দুটো পাথরের চোখ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। ‘কি হলো তোমার? কেন এভাবে তাকিয়ে আছো?’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তর পাইনি কোনোও দিন। কারণ এই ঘটনার পরদিনই রেণুপিসি ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। রেণুপিসির থ্যাঁতলানো মুখটা আমি মনে করতে চাইতাম না কিছুতেই।"
এই পর্যন্ত লেখার পর হঠাৎ শুরু হল বমি। আর সে কি সাংঘাতিক বমি। দৌড়ে বাথরুমে গেলাম। বমি করতে করতে সেখানেই লুটিয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখলাম বাথরুমের সাদা মেঝেয় লালচে ছোপ। রক্ত? তার মানে রক্ত উঠছে বমির সঙ্গে? ভাবতে না ভাবতেই টের পেলাম গলার কাছে কি একটা কষটা মতো ঘড়ঘড় করছে। তারপরেই প্রচণ্ড গা গোলানোর সঙ্গে বেরিয়ে এল এক দলা রক্ত। তারপরেই একটা ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল আমার চারদিক।
রক্তবমি করতে করতে যখন চোখে অন্ধকার দেখছিলাম তখনও আমার আবছা ভাবে মনে হচ্ছিল যে সব কথা বলার পর, সমস্ত সত্য অকপটে জানানোর পর কি হলো আমার? যখন থেকে ঈশ্বরকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম তখনই তিনি এ কি রসিকতা করলেন আমার সঙ্গে?
বাড়ির লোকজন আমার অচেতন শরীরটাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমার অতি পরিচিত হাসপাতালে ছুটলো, সেখানে বেডে দেবার আগে বুঝলাম ঈশ্বরের হিসাব কতটা নির্ভুল। জীবনের সব সত্যি কবুল করে দিয়েছি আমি। এরপর আর কোন্ ডাক্তারের সাধ্য আমার আত্মাকে আমার শরীরের খাঁচায় ধরে রাখে? তাই হাসপাতালের বেডে দেওয়ার সাথে সাথেই আমি ‘বডি’ হয়ে গেলাম। আর এখানেই শেষ হয়ে গেল, যাকে বলে কিনা— “এ স্টোরি টোল্ড বাই এন ইডিয়ট সিগনিফাইং নাথিং।”
এখান থেকেই শুরু হতে পারতো এক আশ্চর্য রোমাঞ্চকর কাহিনী। অন্তত তা হওয়ার সমস্ত উপকরণই ছিল। কিন্তু হতে পারলো না। এবার বলি সেই কাহিনীটি যার মুখ্য চরিত্র আমার ওই ডাইরিটি। আর আমি “স্বর্গত সুজন চক্রবর্তী” হয়ে গেছি ততক্ষণে।
মাঝারি সাইজের সবুজ রঙের ডাইরিটি পড়েছিল সুজন চক্রবর্তীর প্রায় লণ্ডভণ্ড বিছানার কোণটিতে। তাঁকে হসপিটালে নিয়ে যাবার পর তার স্ত্রী নমিতা এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই বিছানাটির সামনে। তারপর কি মনে করে বসে পড়লেন ওই বিছানায়। তখন ওনার চোখ গেল ওই ডাইরিটির দিকে। এই ডাইরিটি কিন্তু সুজন চক্রবর্তীর মতো ধবধবে ঝকঝকে চরিত্রের নয়। এর পাতায় পাতায় ভরে আছে অনেক কালো কালো কথা। তাই এই ডাইরি যদি কারো হাতে পড়ে— তাহলে সুজনের শ্বেতশুভ্র চেহারাটিতে এতো কালি ছিটবে যে—
এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কায় সুজন চক্রবর্তীর আত্মারাম ছুটে এলো ওই ডাইরির কাছটায়— আর অস্থির হয়ে ঘুরপাক খেতে লাগলো ডাইরির উপরে।
নমিতা যখন সবে মাত্র হাত বাড়িয়ে ডাইরিটা খুলে দেখতে যাবেন, তখনই সুজনের আত্মা— না কোনো দমকা হাওয়ায় ডাইরিটাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারল না— কিম্বা নমিতাকে একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারল না— কারণ এসব করার কোনও সামর্থ ছিল না তার—
বরং তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠল— একবার—দুবার—তিনবার। নমিতা বাধ্য হলেন সদর দরজার দিকে যেতে। আর দরজা খুলতেই দেখা গেল সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর ছোটো ছেলে। তাঁর বাবার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে।
সুজনের আত্মারাম কি এইভাবেই ডাইরিটাকে আড়াল করলো? কিন্তু কতক্ষণ? কতক্ষণ সম্ভব? এভাবে আড়াল করা? প্রচণ্ড ভয়ে আশঙ্কায় আর উৎকন্ঠায় সুজনের আত্মাটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওই ডাইরিটার পাশে। এর খানিক বাদেই সুজনের মৃতদেহ এল বাড়িতে। অতি যত্নে সেই বডিটিকে শুইয়ে দেওয়া হল তার প্রিয় বিছানাটিতে। সেখানে তখনও পড়ে আছে সেই ডাইরিটি। সুজনের আত্মাটি কি তখন বাধ্য হল অতিপ্রাকৃতিক কিছু ঘটাতে? সুজনের সম্মান রক্ষার জন্য? বোঝা গেল না। তবে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় এবং শোকে আত্মীয় পরিজনদের দেওয়া রজনীগন্ধার স্তূপে তখনই চাপা গেল সেই ভয়ঙ্কর বস্তুটি। কিন্তু সেগুলোও সরে গেল একসময়। সরে গেল সুজনের চন্দনচর্চিত মৃতদেহটিও। কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে। অর্থাৎ আবার ওই বিপদজনক জিনিসটি পড়ে রইল সেই বিছানার কোণে। যেখানে খানিক বাদেই তাঁর পুত্র-কন্যা নাতি-নাতনী প্রভৃতির চোখের সামনে সেটি আসতে বাধ্য। এবার কোন ভূতুড়ে শক্তিতে আত্মারাম রক্ষা করতে পেরেছিল ডাইরিটাকে?
খবরের কাগজ। সেদিন সকালের দুটো খবরের কাগজ। কাজের মানদা মাসি রেখে এসেছিল বিছানার উপর। যার নীচে চলে গিয়েছিল ওই ডাইরিটি। সেদিন ওঘরে কেউ খবরের কাগজ খুলেও দেখেনি। তাই সবার চোখের আড়ালে নিশ্চিন্ত ছিল ওই মারাত্মক বস্তুটি।
কিন্তু সুজনের আত্মারাম শান্তি পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল— যদি কেউ আসে— এই রাতে— বিশেষত ছেলেরা বা তার বউরা— এই ঘরে— তাহলে খবরের কাগজ সরাতে গিয়ে—
কিন্তু কেউ আসেনি তাদের সদ্যমৃত বাবার ঘরে। এমনকি তার স্ত্রীও না। তারা সবাই বাইরে বসার ঘরে কথা বলছিল।
কিন্তু পরদিন সকালে সুজনের আত্মারাম যে ভয়টি করছিল ঠিক সেটাই হল। অর্থাৎ ডাইরিটি তার ছোট নাতনি ডোনার চোখে পড়ল। তাহলে? তাহলে কি আত্মারাম তার অশরীরী ক্ষমতায় ডোনার দৃষ্টিটাকে অন্ধ করে দিল? কই তা তো না। সে তো খুব মন দিয়ে ডাইরিটাকে হাতে নিয়ে একটির পর একটি পাতা উল্টে দেখতে লাগলো। তারপর খুব যত্ন করে সেটিকে রেখে দিল তার দাদুর বইয়ের সেল্ফে। রাখার সময় নিজের মন খুব গর্বিত ভাবে বলেছিল— “অ্যামেজিং হ্যান্ডরাইটিং!” তাহলে?
আসলে ডোনা একলাইনও বাংলা পড়তে পারতো না। সে কানাডায় জন্মেছে আর সেখানেই বড়ো হয়েছে। অতএব তার হাত দিয়ে ডাইরিটি চলে গেল সুজনের বইয়ের র্যাকে। ডোনার কল্যাণে সুজনের আত্মারামের এতক্ষণে সামান্য স্বস্তি হল।
বাড়িতে অসুস্থ বৃদ্ধ মারা গেলে তার বসত ঘরটি পরিষ্কার করা হয়— বদলে দেওয়া হয়— সুজনের বেলাতেও মোটামুটি তাই ঘটেছিল। তার ঘর বদলে গেল তার ছোটো ছেলের স্টাডি রুমে। সুজনের বুক সেল্ফের বইগুলি এবং ডাইরিটি চলে গেল তাদের চিলেকোঠার ঘরে। তাহলে? আর কেন? এবার তো লোকের চোখের আড়ালে চলে গেছে সেই ভয়ঙ্কর বস্তুটা। তবে এবার তুমি বিদায় হও বাবা আত্মারাম। কিন্তু আত্মারাম তো বিদায় হলো না। নমিতার কখনও কখনও মনে হতো কেউ যেন পাস দিয়ে চলে গেল নি:শব্দে। বড় ছেলে সমীরও মাঝে মধ্যে টের পেয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু কেউই কাউকে কিছু বলেনি। কেবল বহুকালের কাজের মাসি মানদা ছাড়া— "দাদাবাবু কিন্তু এ বাড়িতে এখনও আছেন। আমি কতবার টের পেয়েছি।” সুজনের আত্মারাম খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি নয় যদি কেউ আবার আসে ছাদের ঘরে— তাহলে বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে—
কিন্তু কেউ আসেনি। অর্থাৎ কোন মানুষজন। কিন্তু এসেছিল সুজনের যাবতীয় ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। একদিন সকালে তার ম্যাট্রিকের মার্কসিট, ইউনিভার্সিটি সার্টিফিকেট, চাকরীজীবনের সম্মানিক শংসাপত্র এমনকি ছবি এঁকে পাওয়া সোনার মেডেলটি পর্যন্ত— চলে এল এই ছাদের ঘরে। তারপর এল একে একে তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের অনেকগুলি জিনিস— চশমা, ঘড়ি সিগারকেস, ট্রানজিস্টার— সবই স্থান পেল এ ঘরে। সেদিন সুজনের আত্মারাম চুপটি করে বসেছিল অনেকক্ষণ— এইসব জিনিসপত্রের পাশে।
এর কিছুকাল বাদে হঠাৎ এলো সেই দিন। দুদিনের মধ্যে খালি হয়ে গেল এই গোটা দোতলা বাড়িটার সবকটা ঘর। বড় বড় টেম্পো করে বেরিয়ে গেল সব আসবাবপত্র। অজস্র হাবিজাবি জিনিসের স্তূপে ভরে গেল বাড়ির সদর দরজার সামনেটা। এর মধ্যে একটা কাপড়ের পুঁটলিও ছিল। যার ভিতর ছিল সুজনের বিশেষ বিশেষ কৃতকর্মের কিছু কিছু নমুনা। যেমন— ম্যাট্রিকের রেজাল্ট, চাকরি জীবনের বিরাট শংসাপত্র, তাঁর আঁকার বিষয়ে নিউজ পেপার কাটিং এবং ওই ডাইরিটি। ভোরবেলায় রাস্তা সাফ করার লোকটির ঠেলাগাড়ি ভরে বাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া সমস্ত জঞ্জাল যথাস্থানে চলল বিদায় হতে। কাপড়ের পুঁটলিও কে যেন ভাসিয়ে দিল আদি গঙ্গার জলে।
দ্যাখো— ভালো করে লক্ষ্য করে দ্যাখো ওই পুঁটলিটাকে—
কেমন ভেসে যাচ্ছে আদি গঙ্গার ঘোলা জলে
আর আমি?
আমায় দেখতে পাচ্ছো?
এখনও মুক্ত হতে পারলাম না—
আজও আমার কৃতকর্মের আস্তাকুঁড় থেকে দূরে যেতে পারলাম না— উড়ে যেতে পারলাম না—
তাই এখনও ঘাড় গুঁজে একমনে ঠুকরে যাচ্ছি আমার ফেলে যাওয়া সমস্ত জঞ্জাল—
এই ভাগাড়ের কাকের চেহারায়—
আমি— এই সুজন চক্রবর্তীর আত্মারাম—