বসন্ত যাই যাই। বেলা বাড়তে না বাড়তেই শুকনো গরম গা পুড়িয়ে দেয়। এই সময় এখানকার মানুষজন বর্ষা বাদলের জন্য হা-প্রত্যাশী হয়ে বসে থাকে। বৃষ্টি এলে গরম খানিক কমে, শরীর জুড়োয়। কিন্তু মাঝে মধ্যে বৃষ্টি নামার আগে আগেই কালান্তক ধুলোঝড় ওঠে। দমকা হাওয়ায় চূর্ণ মাটি উড়ে সূর্যের মুখ ঢেকে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে দিনের আলো নিষ্প্রভ হয়ে আসে। এক হাত আগের জিনিষ ভালো করে দেখা যায় না। মানুষ অন্ধের মত রাস্তা হাৎড়ায় ব’লে, লোকে ডাকে আঁধি। ধুলোর কুচি উড়ে এসে চোখে পড়ে। চোখ খুলে রাখা দায় হয়। আকাশের রূপ বদলাচ্ছিল। রোদের রঙ লালচে হয়ে আসছিল। ঝরা পাতার একটা ঘূর্ণি উঠতেই মতিলাল ড্রাইভার জিপ থামিয়ে দিল।
বেশ ছিল দিনটা। রৌদ্রকরোজ্জ্বল, ঝকঝকে। দিল্লী এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই চোখে পড়েছিল একজন কটকটে নীল রঙের জামা পরা সিড়িঙ্গেপানা লোক বুকের কাছে শমীকের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগে যতবার এসেছে মাধব এসেছে। সে শমীককে চেনে। এই লোকটা নতুন। শমীক হাত তুলেছিল। লোকটা এসে তার হাত থেকে লাগেজ নিয়ে এগিয়েছিল। শমীকের টিম ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে ট্রেনে এসেছে। তারা গতকালই সাইটে পৌঁছে গেছে। দিল্লীর হেড অফিস থেকে সাক্সেনা কোওর্ডিনেট করছে। বলে দিয়েছিল ইন্সপেকশনের কাজে ক’দিন এই জিপখানাই থাকবে। যে ড্রাইভারের ভরসাতে দিন রাত মাঠে ঘাটে ঘোরাঘুরি করতে হবে তার নামটা জেনে রাখা ভালো। জিপে বসে লোকটার নাম জিজ্ঞেস করেছিল শমীক। পান খাওয়া কালো কালো দাঁত বার করে বলেছিল - মতিলাল। মাধব একটা আর্জেন্ট কাজে আটকে পড়েছে। তাই মতিলালকে পাঠিয়েছে। সেই যে মুখ খুলেছিল মতিলাল, আর বন্ধ করেনি। বক বক করে শমীকের মাথার পোকা নড়িয়ে দিয়েছে। দিল্লীর জ্যামে ফেঁসে থাকতে থাকতেই তার অর্ধেক জীবন বৃত্তান্ত শুনে ফেলল শমীক। মতিলাল আটমি ফেল। আদি বাড়ি মেরাট। সে অঞ্চলে মার-ধাড় দাঙ্গা-ফাসাদ রোজকার ঘটনা। মতিলাল গুণি ছেলে। কম বয়সেই একটা খুনের কেসে জড়িয়ে পড়েছিল। থানা পুলিশের ঝামেলা এড়াতে মতিলালের বাবা ছেলেকে ভাইয়ের কাছে দিল্লী পাঠিয়ে দিয়েছিল।
দিল্লীতেই এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে হালকা লাঞ্চ করেছিল ঘন্টা আড়াই আগে। তারপর রওনা দিয়েছিল। শহরের চৌহদ্দি ছাড়াতেই খোলা মাঠ, বেহড়, দূরে ছোটো ছোটো পাহাড়। একটানা দু ঘন্টা চালানোর পর একটা অগোছালো ধাবায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল মতিলাল। রাস্তার ধারে অল্প একটু ফাঁকা জায়গা, একটা চালাঘর, সামনে একটা বেঞ্চ পাতা। চালার নিচে একদিকে একটা মাটির উনুন। আপাতত তাতে আগুন নেই। দুপুরের ডাল রোটির খদ্দেররা খেয়ে দেয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে চলে গেছে। এক পাশে একটা কেরোসিনের স্টোভে চায়ের জল ফুটছে। দুটো বাচ্ছা মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে কথা বলছে। দুপুরবেলার দু-চারটে উড়ো চায়ের খদ্দের সামলাচ্ছে।
বছর দশেক হয়ে গেল এই রাস্তায় জিপ চালাচ্ছে মতিলাল। মেরাট থেকে যখন দিল্লীতে চাচার আস্তানায় এসে উঠেছিল তখন তার বয়স সতেরো। চাচার সঙ্গে থেকে হাত পাকাতে বছর দুই। তারপর থেকে চাকার ওপরই ঘর বসিয়েছে। এই অঞ্চলটা সে নিজের হাতের পাতার থেকে ভালো চেনে। জানালো মেয়ে দুটির বাবাই দোকানের মালিক। এরা দুই বোন - বড়টি বড় জোর পনেরো ষোলো হবে। নাম কুসুম। শমীক দেখল বয়সের তুলনায় কুসুমের শরীরে যৌবন কিঞ্চিৎ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে। পিঠের টিপ বোতাম খোলা সাদামাটা ফ্রকের আড়ালে দেহাতী স্বাস্থ্য সামলে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। ছোটো বোনটি তুলনায় ক্ষীণজীবী। ছোটোখাটো চেহারা। তার নাম কাম্যা। দুজনেই নাকি স্কুলে যায়। পড়াশুনো করে। স্কুল থেকে ফিরে আসার পর বাবার দোকান সামলায়।
“কুস্সুম, সাহাবজীকো বঁড়িয়াসা চায়ে পিলাহ্।”
মতিলালের সঙ্গে যে তাদের পুরোন আলাপ, দেখেই বোঝা যায়। শমীক বেঞ্চে বসে দেখছে মতিলাল তাদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে। তার কোনো একটা রসিকতায় দুই বোন হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ল। মতিলাল দু কাপ চা নিয়ে ফিরে এল। একটা কাপ শমীকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ভারি ভালো মেয়ে। গ্রাম দেশে এদের মত লক্ষ্মী মেয়ে খুঁজে পাওয়া ভার। শমীক চায়ে চুমুক দিয়ে দেখল এলাচের গন্ধ ওড়া পুরু দুধের চা। চা শেষ করে হাত পায়ের জড় ভেঙ্গে রওনা দিতে না দিতেই হুড়মুড় করে আঁধি এসে পড়ল। তখনও মুখে চায়ের মিঠে স্বাদ জড়িয়ে আছে। জিপের তুলে দেওয়া কাচের বাধা ঠেলে ধুলো ঢুকছে। মুখের ভিতর দু একটা বালির দানা কিচ কিচ করছে। হাতের ঘড়িতে সময় দেখল সোয়া পাঁচটা। এখনও প্রায় দু ঘন্টার রাস্তা। মতিলাল জিপটাকে রাস্তার ধারে নামিয়ে রেখেছে। বলল, “স্যারজী, ইয়ে আঁধি জলদি রুখনেবালি নেহি হ্যায়। কেয়া করেঁ?”
শমীক কী করে জানবে — কেয়া করেঁ? মিনিট দশেক পরে মতিলাল নিজেই উপায় বাতলালো। কাছেপিঠে একটা ডাক বাংলো আছে। আজ রাতটা সেখানে কাটিয়ে গেলে কেমন হয়? এমনিতেই সন্ধে হয়ে আসছে। আঁধি তুফানের মধ্যে গাড়ি চালানো ঠিক হবে না। এর পর বিশ পঁচিশ কিলোমিটারের মধ্যে বড় কোনো গঞ্জ শহরও নেই। ভোরবেলা অর্ধেক ঘুম থেকে উঠে রওনা দিয়েছিল শমীক। ক্লান্ত লাগছিল। শরীর বিশ্রাম চাইছিল। বলল, চল গিয়ে দেখা যাক।
জিপের দরজা লক করে রুমালে চোখ মুখ ঢেকে দুজনে এগোল। মতিলাল শমীকের লাগেজটা কাঁধে তুলে নিল। বেশি দূর নয়। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই লাল রঙের দোতলা বাড়িটা দেখা গেল। বেশ খানিকটা খোলা জায়গার মাঝখানে একানে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার পিছনে শাল সেগুনের জঙ্গল শুরু হয়েছে। মতিলাল গিয়ে হাঁকডাক করতে মুখে গামছা জড়িয়ে কেয়ার টেকার বেরিয়ে এল। মতিলালের চেনা লোক। আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেল।
ডাক বাংলো ফাঁকা। ক্বচিৎ কদাচিৎ কোনো সরকারি বাবু রাস্তা ভুলে থাকতে আসে। নীচে প্রশস্ত খাওয়ার ঘর, কিচেন। কেয়ার টেকার দোতলার সবথেকে দামি ঘরখানা খুলে দিল। শমীক ভিতরে ঢুকে দেখল আয়োজন মন্দ নয়। ডবল বেডের খাট, পরিষ্কার বিছানা চাদর। এমনকি দেওয়ালে একখানা উইন্ডো এয়ার কন্ডিশনারও লাগানো রয়েছে। স্যুইচ টিপে চালাতে গোঁ গোঁ শব্দ করে সেটা কাজ করাও শুরু করল। শমীক স্বস্তি পেল।
কেয়ার টেকার ঘরে জলের জাগ রাখতে এসেছিল। মতিলাল তাকে ডেকে বলল, “আর্রে বাবুয়া, সাহাবজীকো নাস্তা উস্তা নেহি করাওগে?”
“জরুর। আব্ভি লাতে।” লোকটাকে দেখে মনে হয় একটু ভিতু প্রকৃতির। চোখে মুখে সন্ত্রস্ত ভাব। যেন সর্বদা তটস্থ হয়ে আছে। পাছে কিছু ভুল হয়ে যায়। গামছাখানা এখন গলায় পাক দিয়ে কাঁধের ওপর ফেলা। সেটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে লোকটা পিছন ফিরল।
খানিক পরে দরজায় টোকা পড়ল। শমীক পোষাক বদলানোর জন্য দরজায় ল্যাচ লাগিয়ে রেখেছিল। ইতোমধ্যে ধুলিধূসর বাইরের পোষাক ছেড়ে পাজামা পাঞ্জাবী পরে নিয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে ঘাড়ে ঠাণ্ডা জলহাত দিয়েছে। দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। ঘরের সামনেই লম্বা টানা বারান্দা। সেখানে এক মুখ হাসি নিয়ে কুসুম দাঁড়িয়ে আছে। হাতে চায়ের কাপ আর জলখাবারের প্লেট।
বিস্মিত হয়ে বলল, “আরেহ্, তুমলোগ ইধারই রহেতি হো ক্যা?”
মেয়েটা মাড়ি বার করা হাসি হাসল, “হাঁজ্জী, পিতাজী ইস বাংলোকি দেখভাল করতে হেঁ।”
সে ঝুঁকে পড়ে পাকোড়া ভরা প্লেট খাটের পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখছিল। কুসুমের দিকে তাকিয়ে থাকতে অস্বস্তি হল শমীকের। মেয়েটা সরল। সদ্যপ্রাপ্ত যুবতী শরীর নিয়ে তেমন সচেতন নয়। চোখ সরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। হাওয়ার জোর কমে গিয়ে টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মেয়েটা যাবার সময় বলে গেল, “কুছ জরুরাত পড়ে তো আওয়াজ দিজিয়েগা।”
২
শমীক ঘুমিয়ে পড়েছিল। দরজা ধাক্কার শব্দ পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘুম ভেঙ্গে ঘরটা চিনতে পারছিল না। তারপর মনে পড়ল সে একটা অচেনা অজানা ডাকবাংলোয় রাত কাটাচ্ছে। মতিলালকে জায়গাটার নাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়নি। বাইরে থেকে উঁচু গলায় কে ডাকছে, “বাবুজী, খানা তৈয়ার।”
সম্ভবত কেয়ার টেকার লোকটাই। শমীক হাত ঘড়িতে দেখল সাড়ে আটটা। শমীক গলা তুলে বলল, “আতা হুঁ।” দেহাত অঞ্চলে রাত জলদি নামে। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে সাইটে পৌঁছে যেতে হবে। খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার। সাইট ইনচার্জকে একটা ফোন করে দেওয়া দরকার। না হলে ওরা চিন্তা করবে। দিল্লীতে হেড অফিসেও। ফ্লাইট ল্যান্ড করার পরে পরেই শিঞ্জিনী ফোন করেছিল। ওকে বলেছিল গন্তব্যে পৌঁছে ফোন করবে। মনে নেই। সে বেচারিও হয় তো দুর্ভাবনা করছে। মোবাইলটা বের করে দেখল ডিসচার্জ হয়ে গেছে। স্যুটকেস খুলে চার্জার খুঁজে পেল না। আনতে ভুলে গেছে। ঘরে একটা ল্যান্ড লাইন ফোন রয়েছে বটে। সেটা তুলে নিয়ে কানে দিল। অটুট নৈঃশব্দ। ঝড় জলে টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ভাবল পরে মতিলালের মোবাইলটা ধার করে খবর দিয়ে দেবে।
নিচে যাবার জন্যে ঘরের দরজা খুলতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে এল। বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটি থেকে ভিজে গন্ধ উঠে আসছে। মেঘ কেটে চাঁদ উঠেছে। গাছপালা জঙ্গল ভিজে হয়ে আছে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। টুপটাপ করে জল ঝরে পড়ার শব্দ। তাছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। বাংলোর পিছনে জঙ্গল শুরু হবার ঠিক আগে একটা খোলার চালের ঘর। সম্ভবত কেয়ার টেকারের পরিবার ওখানেই থাকে। লম্বা বারান্দা পার হয়ে শমীক নিচে নেমে এল।
সিঁড়ি দিয়ে নেমেই খাবার জায়গা। স্তিমিত আলোর নিচে লম্বা মেহগনী কাঠের টেবিল। স্টীলের বাটিতে করে ঢাকা দিয়ে খাবার সাজানো রয়েছে। একটা থালা উলটো করে পাতা। আঠারো কুড়ি বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে পাজামা আর সাদা হাত ওলা গেঞ্জি। বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা। শমীককে দেখেই ছুটে গিয়ে কেয়ার টেকার বাবুটিকে ডেকে আনল। ছেলেটার ব্যবহারের মধ্যে একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে। শমীক ধরতে পারছিল না। কেয়ার টেকারের পিছনে পিছনে মতিলাল এল। সেই বলল, ছেলেটা কুসুমের দাদা — বিনোদ। কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। বুদ্ধিশুদ্ধিও কম। বাবাকে বাংলোর রাখ রাখাইতে হাত বাটায়। শুধু দোষের মধ্যে কারণে অকারণে ক্ষেপে যায়। চীৎকার করে, থুতু ছিটোয়। মুখ দিয়ে অনর্গল অর্থহীন শব্দ করতে থাকে। তখন তাকে সামলে রাখা দায় হয়।
খিদে পেয়েছিল। খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেল। ঘন তূর ডাল, ভাত, হাতে গড়া রুটি, নেনুয়ার ভাজি আর চিকেন কারী। এই ঝড় জলের মধ্যে এরা চিকেনের আয়োজন কোথা থেকে করল কে জানে? মতিলাল চেয়ার টেনে পাশে বসে হাবিজাবি বক বক করছিল। খেয়ে দেয়ে মশলা চিবোতে চিবোতে তাকে জিজ্ঞেস করল, তার মোবাইলখানা কিছুক্ষণের জন্য ধার দিতে পারে কিনা। মতিলাল কপাল চাপড়ালো। বৃষ্টি বাদলার মধ্যে চিকেনের জোগাড়ে গিয়েছিল। জল ঢুকে তার মোবাইল কাজ করছে না। শমীক প্রমাদ গুনল। তার মানে আজ রাতে সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন। কী আর করা? কাল সাইটে পৌঁছে সবাইকে ফোন করে দেবে।
ওপরে উঠে আসার সময় খাবার জল পাঠিয়ে দিতে বলে এসেছিল। কাল সকালে লাগবে। শোবার আয়োজন করতে না করতেই দরজায় টোকা পড়ল। কুসুম জল নিয়ে এসেছে। দুটো পান সেজে এনেছে সঙ্গে, একটা ছোটো প্লেটে। কাছে এসে এগিয়ে দিল। শমীকের মনে হল প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার গা থেকে উঠে আসা গন্ধ পাচ্ছিল। শমীক মাঝে মধ্যে পাহাড়ে যায়। ট্রেকিং বুটের নিচে দলে যাওয়া বুনো ফুলের গন্ধের মতন, একটা দম বন্ধ করা গন্ধ। শমীক সরে দাঁড়াল। মেয়েটা পান জল দেবার পরও দাঁড়িয়ে আছে। শমীকের সন্দেহ হল গোলপানা মুখ, বড় বড় চোখ, চাপা নাক, পুরু ঠোঁটের গাঁওয়ার মেয়েটাকে যতটা সরল সাধাসিধে ভাবছিল, ঠিক ততটা হয় তো নয়। মেয়েটার কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? শমীকের রাগ হল। একটু কড়া করেই বলল, তার আর কিছু লাগবে না। কুসুম এবার যেতে পারে। কুসুম যেন কতকটা অনিচ্ছা নিয়ে চলে গেল।
পিছন থেকে কুসুমের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে হঠাতই শিঞ্জিনীর কথা মনে হল শমীকের। শিঞ্জিনী যখনই কাছে আসে ওর শরীর থেকে বিদেশী পারফিউমের মন কেমন করা গন্ধ পায়। শমীক জিজ্ঞেস করে বসে, “শিঞ্জিনী, তুমি কি বিদেশিনী? থাকো সিন্ধু পারে? পারফিউমের সমুদ্রে সিনান করে উঠে এলে? তোমার চুলে কি ঝিনুক লেগে আছে?”
শিঞ্জিনী খিল খিল করে হেসে বলে, “উফ! কত প্রশ্ন! ঝিনুক কোথায়? এটা তো চুলের ক্লীপ। এই দেখো।” বলতে বলতে সাদা রঙের ক্লীপ খুলে হাতে নেয়। ওর কালবৈশাখীর মেঘের মত কুঞ্চিত রাগী চুল গালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ আড়াল করে দেয়। এতদিনেও শিঞ্জিনীর গায়ের আসল গন্ধটা জানা হল না। শমীক ভাবল কিছু না জানিয়ে একদিন খুব ভোরবেলা শিঞ্জিনীদের বাড়ি চলে যাবে। ঘুমোতে যাবার আগে শিঞ্জিনী নিশ্চয়ই পারফিউম মাখে না। ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বুকের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা গন্ধ নেবে। যা শিঞ্জিনীর একান্ত ভাবে নিজস্ব। শিঞ্জিনী অবাক হয়ে চোখ মেলে তাকাবে। সদ্য ফোটা শিউলি ফুলের মত মুখখানা তুলে বলবে, “তুমি?” তারপর নিজের বিস্রস্ত পোষাক সামলে লজ্জা পাবে। শমীক যাবেই। তাতে তার হবু শ্বশুর শাশুড়ি আদেখলে ভাবে ভাবুক।
৩
ঘুম যখন ভাঙল শমীকের সারা শরীর ঘামে জব জব করছে। শোবার সময় একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে শুয়েছিল। আপাতত ঘর অন্ধকার। প্রাগৈতিহাসিক এয়ার কন্ডিশনিং মেসিনটিও স্তব্ধ। বুঝল পাওয়ার গেছে। ঘরে সবে ধন নীলমণি যে জানলাটি ছিল এ সি মেশিনটিই সেটির দখল নিয়েছে। আর কোনো জানলাও নেই যে খুলে দেবে। খানিকক্ষণ বিছানার জলজ সাহচর্য সহ্য করে উঠে পড়ল। বদ্ধ ঘরের মধ্যে সেদ্ধ হওয়ার কোনো মানে হয় না। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এসেই বুঝল পৃথিবীতে কোনো ঘটনাই কার্যকারণ ছাড়া ঘটে না। এই নামহীন জায়গায় গোত্রহীন ডাকবাংলোয় মাঝরাতে পাওয়ার চলে যাওয়ার একটা গূঢ় কারণ আছে। তাকে এই বারান্দায় টেনে বার করে আনার পিছনে কোনো অলৌকিক অভিসন্ধি কাজ করছে। ঝিঁঝিঁ ডাক থেমে গেছে। সমস্ত চরাচর নিস্তব্ধ। জঙ্গলের মাথায় চাঁদ হেলে পড়েছে। চারিদিকে এক অস্ফূট জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার জুঁই ফুল ফুটে আছে। রাত আড়াইটের সময় ঘর থেকে বেরিয়ে না এলে এই অপার্থিব দৃশটি অদেখাই থেকে যেত। এমন রাতে অহেতুক আত্মহননের ইচ্ছে হয়। মনে হয় পৃথিবীর সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন চলে গেলেই হয়। আচমকা একটা কোকিল ডেকে উঠল। ভাগ্যিস!
জঙ্গলের মধ্যে গাছপালার ফাঁকে জল চিক চিক করছে। ওখানে কি পশুরা জল খেতে, নুন চাটতে আসে? একবার তরাইয়ে বন বিভাগের বাংলোর বারান্দায় বসে একটা বড়সিঙ্গাকে জল খেতে দেখেছিল। জল খেতে খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে শিং বাঁকিয়ে দেখছিল পিছনে কোনো বাঘ গুঁড়ি মেরে আসছে কিনা। আজও কি কোনো বন্য পশুকে জল খেতে দেখতে পাবে? জলা জায়গাটা অনেকটা দূরে। এখান থেকে দেখা যাবে না। নেমে যেতে হবে। জ্যোৎস্নাতে চেনা জায়গাও অচেনা লাগে। আর এখানে তো কিছুই চেনে জানে না। রাস্তা হারিয়ে সারা রাত চন্দ্রাহত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। তার থেকে এই ভালো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা। এভাবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একদিন সে ওয়ার উলফ হয়ে যাবে। তখন আর জঙ্গলের রাস্তা চিনতে অসুবিধে হবে না।
খুব সুন্দর জিনিষের দিকেও একটানা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ ব্যথা করে। একবার চোখের পলক ফেললে অবশ্য অভ্যস্ত লাগে। মনে হয় যতটা সুন্দর লাগছিল ঠিক ততটা সুন্দর নয়। তাছাড়া আরও একটু ঘুম দরকার। কাল ইন্সপেকশনের কাজ শুরু হবে। সারাদিন রোদের মধ্যে চষতে হবে। ঘরে ফিরে যাবার জন্য দৃষ্টি নামিয়েছিল। অদ্ভুত একটা দৃশ্যতে চোখ আটকে গেল। নিচে খোলার চালের ঘরটার সামনে একটা চারপাই পাতা। তাতে একজোড়া মানুষ মানুষী ওলোট পালোট হচ্ছে। তাদের খোলা ত্বকে জ্যোৎস্না পড়েছে। চাঁপা রঙের আলোয় ঘাম শরীর চকচক করছে। মেয়েটিকে চিনতে অসুবিধে হয় না — কুসুম। ছেড়ে রাখা নীল জামা আর অবয়বের গড়ন দেখে লোকটাকেও চিনল — মতিলাল। লুকিয়ে সঙ্গম দৃশ্য দেখা অনুচিত। তবু শমীক তৎক্ষণাৎ সরে যেতে পারল না। কুসুমের সদ্যোদ্ভিন্ন পুষ্ট শরীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে তার কষ্ট হল। আপাত সুষমাহীন মেয়েটার মধ্যে একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে। শরীর-সর্বস্বতা দিয়ে নির্লজ্জভাবে আবেদন করে। এড়িয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। কুসুম আপাতত চারপাইতে পিঠ রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে। তার সঙ্গী পুরুষটি তার শরীর মন্থন করছে। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শমীকের শরীরেও আদিমতার সঞ্চার হল।
শমীকের মনে হল কুসুমের আলিঙ্গনআবদ্ধ ওই পুরুষটি যেন মতিলাল নয়। অসতর্ক মানুষের ঘাড়ে যেমন ভূত ভর করে সে মতিলালের শরীরে ভর করেছে। শমীক ভূত হয়ে গেছে। আসলে হয় তো উল্টোটাই, মতিলালই তাকে ভর করেছে। কিন্তু সে সঠিক বুঝল না। শুধু এটুকু বুঝল যে জ্যোৎস্নার নীচে মেয়েটির শরীরে সে আমূল প্রবিষ্ট হয়েছে। বেচারা মতিলাল! এখন সে আর সম্ভোগের আনন্দ পাবে না। তার বদলে শমীক কুসুমের উর্বরা মাটির মত শরীর কর্ষণ করবে। আদিগন্ত পাড় ভাঙ্গার অসম্ভব সুখ নেবে। পিপাসায় শমীকের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কুসুমের প্রেমহীন যৌনতা জলের মত আড়ম্বরশূন্য অথচ নিতান্ত দরকারি। সে কুসুমের দিঘির মত শরীরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আঁজলা ভরে জল নিয়ে ঠোঁটে দেবে।
রমণের চরম মুহূর্তে কুসুমের চোখ খুলে গেল। শমীক কি বারান্দার রেলিঙ্গের ওপর বেশি ঝুঁকে পড়েছিল? মনে হল কুসুম তাকে দেখতে পেয়েছে, অন্তত তার ছায়াশরীর। সে সঙ্গী পুরুষটিকে কিছু বলল। দোতলার বারান্দার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল। মতিলালও উঠে বসে ওপর দিকে তাকাল। শমীক বারান্দার থামের আড়ালে সরে এল। চোরের মত হেঁটে অন্ধকার ঘরে ঢুকে ছিটকিনি তুলে দিল। রমণ শেষের ক্লান্তিতে তার চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছিল। বিছানায় শুয়ে পা দুটো গুটিয়ে বুকের কাছে এনে ঘুমের নিচে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, আজ রাতের ভূত হয়ে যাবার গল্পটা কোনোদিন কি শিঞ্জিনীকে বলতে পারবে?
৪
ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেল শমীকের। হাত ঘড়িতে সময় দেখল আটটা বেজে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। অবসাদের কারণ খুঁজতে গিয়ে বেনো জলের মত কাল রাতের ঘটনাগুলো মনের মধ্যে হু হু করে ঢুকে পড়ল। কিছুই নয় অথচ একটা হালকা অপরাধবোধ তাকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। একটা সন্দেহ কাঁটার মত খোঁচা দিচ্ছে, এমন তো নয় যে মতিলাল আসলে তার অল্টার ইগো? রাতের আড়ালে লোভী জিভ বার করে নিচে নেমে গিয়েছিল। জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে বার করে দিল। অহেতুক মতিলালকে নিজের ঘাড়ে বসিয়ে রাখার মানে হয় না। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল। ব্রেকফাস্ট করে তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। নিচে নেমে দেখল খাওয়ার টেবিল ধূ ধূ করছে। বাইরে কোথাও একটা চীৎকার চেঁচামেচির শব্দ আসছে। শমীক গলা তুলে মতিলালকে ডাকল।
মতিলাল এল দু চার মিনিট পরে। মুখ ঝুলিয়ে। এসে বলল আজ সকাল থেকেই বিনোদ ক্ষ্যাপামি শুরু করেছে। হাত পা ছুঁড়ছে, গজরাচ্ছে। জামা কাপড় ছিঁড়ে কুঁচি কুঁচি করছে। শমীক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
মতিলাল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, সকাল থেকে কুসুম ভীষণ কান্নাকাটি করছে। ভাই বোনে আভাসে ইঙ্গিতে কী কথা হয়েছে। তারপর থেকে বিনোদ পাগলামি শুরু করেছে।
শমীক অবাক হল, কুসুম কান্নাকাটি করছে কেন?
মতিলাল শমীকের দিকে ফিরে তাকাল। ঠোঁট ছুঁচোল করে বলল, “কেয়া বাত কর রহে হো স্যারজী, আপকো নেহি পতা? কুসুম বোল রহি হ্যায় কে আপনে উসকা ইজ্জৎ লুটা, জবরদস্তি...।”
শমীক আকাশ থেকে পড়ল। বলে কী লোকটা? অবাস্তব কথা বলার একটা সীমা থাকবে তো? শমীক ধমক দিয়ে বলল, “বকোয়াস মত করো।”
ভাবল বলে, নিজের ক্রিয়া করমের দায় আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছো। বলতে গিয়েও থেমে গেল। তাহলে তো পরোক্ষে স্বীকার করাই হয়ে যায় সে লুকিয়ে দেখেছে দুজনকে। মতিলাল একটা আস্ত শয়তান। শমীকের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। ওকে এই ডাক বাংলোতে এনে তোলা থেকে কুসুমকে বারবার ওর ঘরে পাঠানো, পুরোটাই সম্ভবত আগে থেকে ছক কষে রেখেছিল।
মতিলাল ভালো করে নজর করছিল শমীককে। মিচকে হেসে বলল, “কেয়া সাহাবজী, বাচ্ছিকোভি নেহি ছোড়া? আভি মহল্লেবালোঁকো পতা চলে তো ইহাঁসে নিকালনা মুশকিল হো যায়েগা।”
শমীকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল মতিলালের আগাপাশতলা চাবকায়। বলল বটে, “কেয়া মজাক চল রহা হ্যায়?” কিন্তু গলাটা নিজের কাছেই দুর্বল শোনাল।
মতিলাল বলল, “মজাক নেহি হ্যায় সাহাব। আবভি উস্কে বাপকে সাথ কুছ সেটল কর লো। বাদমে ডাগদার পুলিশ আ যায়েগা তো লেনে কে দেনে পড় যায়েগা।”
শমীক বুঝল আচ্ছা ফাঁসা ফেঁসেছে। মতিলাল ছাড়া এখান থেকে বেরোনোও মুশকিল। গুম হয়ে বসে রইল। বাংলোর পিছন দিক থেকে আসা বিনোদের চীৎকার বাড়ছে। যেন একটা বন্য পশু আক্রোশে ফুঁসছে।
ঠিক তখনই বাংলোর সামনের দরজা ঠেলে কেউ ঢুকল। শমীক মুখ তুলে দেখল, সাক্সেনা। পিছনে পিছনে মাধব। শমীককে দেখে যেন দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাক্সেনা কাছে এসে শমীককে ধমক লাগালো, একটা ফোন করতে পারো নি? আমরা ভাবছি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কিনা। সাক্সেনা ভোর বেলা উঠে মাধবকে ডেকে খুঁজতে বেরিয়েছে। ওদের জিপের নম্বরটা ভাগ্যিস জানা ছিল। রাস্তার পাশে জিপটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।
মাধব মতিলালের দিকে তাকিয়ে ধমকাল, “কেয়া রে, ফোন কিঁউ নেহি লে রাহা থা, তু?”
শমীক হাতে স্বর্গ পেল। আড়চোখে মতিলালের দিকে তাকিয়ে দেখল জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয় মতিলাল তেমনি কুঁকড়ে গেছে। শমীক সাক্সেনাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বসাল। সাক্সেনা সামান্য অবাক হল। জিজ্ঞেস করল, বাংলোর পিছন দিক থেকে কিসের শোর শারাবা আসছে। শমীক কাল বিকেল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত সব ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বলল। মায় কাল মাঝরাতে দেখা মতিলাল আর কুসুমের প্রেমদৃশ্য পর্যন্ত। কিচ্ছু বাদ দিল না, কেবল নিজের ভূতাবস্থার কথা ছাড়া। সাক্সেনার হাত ধরে বলল, বিশ্বাস করো, আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ।
সাক্সেনা বলল, “শমীকজী, আপ পরেশান মত হো। মুঝে সামহালনে দো।”
সাক্সেনা মাধবকে আলাদা করে ডেকে কিছু বলল। মাধব ঘাড় নাড়ল। মতিলাল জবুথবু হয়ে এক কোণে বসে ছিল। কাছে গিয়ে তাকে কলার ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারল। মতিলাল চেয়ারের ওপর উলটে পড়ল। মাধব বলল, “ইস হারামীকে সাথ ওহ লেড়কীকা আশনাই চল রহে হ্যায় কুছ দিনোসে। সবকো পতা হ্যায়।”
মতিলালের ঘাড় ধরে তুলে এনে জোর করে শমীকের পায়ের ওপর মাথা গুঁজে দিল, “মাফি মাঙ্গ সাহাবসে।”
মতিলাল উবু হয়ে বসে হাত জোড় করে বলল, “ঔর নেহি হোগা সাহাব, ইস বারকে লিয়ে মাফ কর দো।”
বাংলোর পিছন দিক থেকে আসা সোরগোলটা আচমকা থেমে গেল। কেউ যেন কারো মুখ টিপে ধরল। জানলার কাচের বাইরে কতগুলো আবছা মুখ দেখতে পেল শমীক। বুঝতে পারল না ওই মুখগুলোর মধ্যে কুসুমের মুখটাও আছে কিনা। মাধব গজ গজ করতে লাগল, “ইসকো ভেজকেই গলতি কিয়া। শোচা থা বান্দা শুধার গয়া। চলো সাহাব, ম্যায় হি ছোড় দেতা হুঁ।”
সাক্সেনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেবে ভেবে পাচ্ছিল না শমীক। সাক্সেনা অবশ্য বলছিল, তারই ভুল। আগে থেকে খোঁজ খবর না করে মতিলালকে পাঠানো উচিৎ হয়নি। এমনিতেই সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে মাথাটা ভোঁতা হয়ে ছিল। মাধবের জিপে রওনা দিয়ে, চোখ বুজে খোলা জানলায় মাথাটা হেলিয়ে দিল। হু হু করে হাওয়া আসছিল। স্বস্তি লাগছিল। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলে যেমন লাগে। বিশ্বাস করতে ভয় লাগে যে সব কিছু ঠিকঠাকই আছে, একদম আগের মতই। চোখ বুজে চিন্তা ভাবনা গুলো পরপর সাজিয়ে নিচ্ছিল শমীক। হঠাৎ মনে পড়ল শিঞ্জিনীকে একটা ফোন করা দরকার। সাক্সেনার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা চাইল। তারপর ভাবল — নাঃ, থাক। আর একটু সময় যাক। নিজেকে আর একটু বোঝানো দরকার সে সত্যিই সম্পূর্ণ নিরপরাধ। জ্যোৎস্নার নিচে কুসুমের সঙ্গে মতিলালের যৌনমিলন একটা সংস্রবহীন বিক্ষিপ্ত ঘটনা। নিতান্ত মামুলী একটা এক্সিডেন্ট। এ ব্যাপারে তার কোনো দোষ নেই। আদৌ কোনও দায় দায়িত্ব নেই। তবু আর একটু বেলা হোক। উড়ো খই ঘটনাগুলো মনের মধ্যে আর একটু থিতিয়ে পড়ুক। তারপর না হয় শিঞ্জিনীকে ফোন করবে। পোঁছোনো সংবাদ দেবে।