• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৫ | ডিসেম্বর ২০১৬ | প্রবন্ধ
    Share
  • শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে : পাঠ ও দর্শন : মীরাতুন নাহার


    মরেশ বসুর লেখা উপন্যাস 'শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দে। সেটির নাট্যরূপ দিয়েছেন এই সময়ের খ্যাতনামা নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দ। রঙ্গলোক পরিবেশিত নাটকটির পরিচালক ও অন্যতম অভিনেতা শ্যামল চক্রবর্তীর আন্তরিক আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সেটি দেখার সুযোগ ঘটল সম্প্রতি। উপন্যাসটি পড়ে এবং তার নাট্যরূপকে অভিনীত নাটক হিসেবে দেখার পর কিছু ভাবনা মনের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে। সেগুলি বর্তমান আলোচনায় উপস্থাপন করা হল। উপন্যাসটিতে তুলে ধরা কিছু তত্ত্ব এবং নাটকটিতে দেখতে পাওয়া সেগুলির রূপায়ণ দর্শক আমাকে অতীতের আলোকে বর্তমানকে নিয়ে ভাবার খোরাক যুগিয়েছে। তাই উপন্যাসের মর্মকথা, নাটকের মূল সুরব্যঞ্জনা এবং আমার পর্যবেক্ষণলব্ধ ভাবনাকে এক তালে বাঁধার চেষ্টায় দু-চার কথা বলা।

    'শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে' উপন্যাসের মূল চরিত্র নাওয়াল — নাওয়াল আগারিয়া। নাওয়াল জন্মেছে বহু পুরুষ ধরে লোহা কাটার কাজে অভ্যস্ত ও দক্ষ শ্রমিক লছমন আগারিয়ার সন্তান হিসেবে এক হতদরিদ্র পরিবারে। লছমন পরিশ্রমী, নিজের কর্মে নিষ্ঠাবান এবং তার পারিবারিক পেশাটিকে সে অতিশয় গর্বিত চিত্তে তাদের বহু পুরুষের পেশা বলে গণ্য করে সেই মনোভাবকে সকলের কাছে প্রকাশ করে। বোঝা যায়, হতভাগ্য জীবনের সর্ববিধ বঞ্চনাকে সে সেই অহঙ্কারটুকু দিয়ে ঢেকে, মেনে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তবুও সে পারে না আর পারে না বলেই কারখানায় কাজ শেষ হলে আকণ্ঠ মদ পান করে ঘরে ফেরে এবং বউ ও বাচ্চাদের নির্দয় হাতে পেটায়। তার বউ সন্তানদের, তার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, লুকিয়ে রেখে নিজে মার খায় দাঁতে দাঁত চেপে আর অপেক্ষা করে যে, নেশাগ্রস্ত স্বামী মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে শীগগির থেমে যাবে। সে জানে, কর্মক্লান্ত ও নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন লছমন বেশিক্ষণ তাকে মারতে পারবে না। সে জানে, তার নাম বেদামী এবং সে নাম অর্থপূর্ণ কেননা সত্যি তার জীবনের কোন দাম নেই। নাওয়াল প্রতিদিন মায়ের মার খাওয়া দেখতে দেখতে বড় হতে থাকে, মায়ের আচরণ তাকে ভাবায় এবং একদিন দেখে, তার দরিদ্র শ্রমিক ও নেশায় মাতাল হওয়া বাপ অভূতপূর্ব একটি কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে। তার বাপ দুপয়সা মাইনে কাটা যাবে শুনে বেঁকে বসে। সে দৃঢ়স্বরে জানায়, সে এই অন্যায় মেনে নেবে না কিছুতেই। তার ভিতর-মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ প্রতিধ্বনি তোলে তার বাইরের কণ্ঠস্বরে। সে মার খায়। তবু প্রতিবাদে অনড় থাকে — একলাই। সহকর্মীদের আচরণে সে অবাক হয় বটে কিন্তু নিজের জেদ ছাড়ে না অন্যদের সমর্থন পাওয়ার প্রত্যাশা না রেখেই। সহকর্মী মজদুররা প্রথমে কেউ, ভয় পেয়েই, তার সমর্থক না হলেও পরে তার পথানুগামী হয় এবং সে যাত্রায় তাদের বেতন কাটা বন্ধ হয়। এরপর লছমনকে আর কখনও প্রতিবাদী হতে দেখা যায়নি। তবে সে বুঝে যায়, তাদের মজদুর জীবনের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মূল ঘটক কারা এবং কী প্রক্রিয়ায় তারা সেটি ঘটায়। কারখানার সাহেব ম্যানেজার ঠিকাদারবাবুকে দিয়ে মজদুরদের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করে। সেই ক্ষমতা হাতে পেয়ে ঠিকাদার নিজেকে ক্ষমতাধর ভেবে নিয়ে শ্রমিকদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার চালায়। সেই সত্যটি লছমন জানতে পেরেছিল সকল মানুষের নিঃস্বার্থ হিতাকাঙ্খী সাধু স্বভাবের উজাগর বাবার কাছে। সে বুঝে নিয়েছিল যে, ঠিকাদারবাবু আসলে মজদুরদের মজুরিতে ভাগ বসায়। সে শ্রমিকদের ঠকায় এবং একই সঙ্গে ঠকায় কোম্পানিকেও। শ্রমিকরা বেশিদিন এই প্রতারণা সইবে না এবং কোম্পানির সাহেবরাও তাকে চিনে নিতে পারবে। হলও তাই। সাহেবের নির্দেশেই ঠিকাদারবাবুকে সেদিন লছমন আগারিয়াদের দুপয়সার দাবি মেনে নিতে হয় এবং দরিদ্র দিনমজুর লছমন আগারিয়া তার 'এলাকার এক ইতিহাসের নায়ক' হয়ে পড়ে নিজেরই অজান্তে। সেদিন প্রথমে তার একলার এবং পরে তার সহকর্মীদের যে লড়াই শুরু হয়েছিল তাতে কোন স্বদেশীবাবু বা 'লন্ডনবালা কোন ইংলিশ কেডার ক্রান্তিকার কমরেডবাবু'কে নেতৃত্ব দিতে হয় নি, পরামর্শ দিতে হয় নি এবং 'লড়াইয়ের পথ আর কৌশল' শেখাতে হয় নি। একজন হতভাগ্য শ্রমিক নেহাতই জীবনের তাগিদে অনাহার অথবা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও 'শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল'। একটি মাত্র ঘটনা ঘটিয়ে সর্বহারা লছমন সেদিন জন্ম দিয়েছিল লড়াকু শ্রমিক শ্রেণীর। লছমনকে নিজে আর কিছু করতে হয় নি। সে আবার তার পেশায় নিমগ্ন হয়েছিল নিষ্ঠা সহকারে শ্রম দিয়ে নিজেকে ক্ষয় করার, অন্যের দ্বারা আয়োজিত, নীতি মেনেই। কিন্তু উত্তরসূরিতা ভিন্ন পথে চলে এবং সে পথ লড়াইয়ের হলেও মোড় নেয় নেতৃত্বের তীব্র ঝাঁঝালো নেশায় নেশাগ্রস্ত হওয়ার দিকে। তারপর যখন সে নেশা কেটে যায়, উপন্যাসের নায়ক বের হয় — শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে অন্ধকার রাস্তায় নেমে আলোর দিকে নজর রেখে। সেই নায়ক হল নাওয়াল — লছমন আগারিয়ার উত্তরসূরী পুত্রসন্তান।

    নাওয়াল বাবার মতো একই কাজে যোগ দিয়ে তরুণ বয়সে মালিকের হাতে মার খেয়ে মার হজম করতে পারে নি। সে প্রতিবাদ করে এবং সোচ্চার হয় প্রতিবাদে। সে তখন পাশে পেয়ে যায় ততদিনে তৈরি হয়ে ওঠা মজদুরদের নেতা ও তাঁর শ্রমিক দল। এরপর ঘটনা ঘটে চলে যেন দ্রুত, অবিরাম, অবধারিত প্রক্রিয়ায় যে ঘটনার গতিপথে বদল ঘটে যায় নাওয়ালের জীবন অবিশ্বাস্য ধারায়। সে নিজেই শ্রমিক নেতা বনে যায়। দু-দুবার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সে দলনেতাদের ঘনিষ্ঠ একজন অন্যতম নেতার ভূমিকা লাভ করে। দিন যায়। নাওয়াল বদলে যায়। বাবার মতো কেবল মদে নয়, সে নতুন নেশায় চুর হয়ে পড়ে নিত্যদিন এবং সেই নেশাটি হল নেতৃত্বের নেশা, যার সঙ্গে যুক্ত হয় তীব্র ভোগবাসনা। উপরতলার শিক্ষিত নেতারা ক্রমে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে ফেলে এবং তাকে নিজেদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অতঃপর ক্ষমতা থেকেও একটু একটু করে নাওয়ালকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। নাওয়াল শ্রমিকসন্তান হলেও নির্বোধ নয় কোনমতে। সে তথাকথিত পরিশীলিত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নেতাদের ভিতরের কুৎসিত কামনা-বাসনার রূপ দেখে ফেলে। বুঝে ফেলে তাঁদের নেতৃত্বের নেশায় মত্ত চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ। দেখতে পায়, তাঁরাও ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়িজনিত বিবাদ-বিরোধে লিপ্ত হয়ে পড়ে সর্বক্ষণ। সে শ্রমিক নেতা হয়েও যখন তাঁদের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ল তখন সে-ও তাঁদের কাছে বিরোধী শত্রু বলে গণ্য হল। তাঁদের প্রবল প্রতিযোগী হয়ে উঠল। নেতৃবর্গ এবং শ্রমিক শ্রেণী দুপক্ষের কাছেই সে অপ্রিয় হয়ে গেল কেননা, শ্রমিকরা তাকে তখন তাদের বন্ধু ভাবতে পারছে না আবার অন্যদিকে অহঙ্কারী উপরতলার নেতৃবর্গও তার সক্ষমতার পরিচয় পেয়ে তাকে স্বশ্রেণীভুক্ত নেতা বলে মানতে পারছে না আর। তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল এভাবে দুপক্ষের বিচারে। ক্রমে সে নিজেকে একজন পরাজিত ও নিঃস্ব মানুষ বলে চিনে ফেলল। সে ভাবতে পারল যে, আসলে সে 'গাড্ডা'য় পড়েছে এবং সেখান থেকে নিজেকে উদ্ধারের পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না। তবে উপরতলার সব নেতারা একরকমের নয়। ফলে সে সদাশয় একজনের সুপরামর্শ পায়। তিনি তাকে পথ বলে দেন — মুক্তিলাভের পথ। তিনি ভবনাথ গুপ্ত।

    নাওয়ালেরও জীবনে দিশারী হলেন তার 'ভবনাথদা'। যে শ্রমিক নাওয়াল তার 'বাবার দুপয়সা লড়াইয়ের পয়দায়িস মজদুর লিডর বিলসান সাহেবকে' মেরেছিল সে বদলে গেছে আমূল — দেখালেন তিনি তাকে। 'মজদুর দুনিয়া বানাবার' স্বপ্ন নাওয়াল হারিয়ে ফেলেছে কবে! 'মজদুর রাজ' গড়েছে সে? কেমন সেই রাজ? শ্রমিকরা বাবু বনেছে, সিনেমা দেখছে, জুয়া খেলছে, মেয়েদের ভোগ করার বস্তু হিসেবে দেখতে শিখে তাদের পিছনে ঘুরছে, ছিনতাইবাজ হয়েছে আর ডাক পড়লেই 'ঝাণ্ডার নীচে গিয়ে পুকার করছে। ত, এই মজদুর রাজ?' তার বাবাও তাকে এই চোখেই দেখে। দুপয়সার লড়াকু সে বোঝে না এই মজদুর রাজকে এবং মানেও না। সে তার ছেলেকেও নিজের ছেলে বলে মানে না এখন আর। ভবনাথ বুঝিয়ে দেন সৌখিন নেতাদের মূল চরিত্র — 'তোমাদের ওরা শেষ করে এখন নিজেরা লুটতে বসেছে। ওরা এখন দুনিয়ার পার্টিগুলোর সঙ্গে নিজেদের হিসাব নিকাশ করছে, কোথায় কী সুবিধা পেলে, ভারতে নিজেরা আরও বেশি ক্ষমতায় আসতে পারবে। ওসবের মধ্যে কোন আদর্শ নেই, আছে স্বার্থের চালবাজী। শেষ কথাটা জানবে। এটা আমার বিশ্বাস, পার্টি আর দিল্লির ঐ ঠাণ্ডা গোল ঘরটার যন্ত্র তোমাদের চুষে খেয়ে শেষ করে দিয়েছে।' এখন তবে - উপায়? 'এই তামাম দুনিয়াটা আর দেশে পার্টি, সবটাই ভেঙে নতুন করে বদলাতে হবে। এখন তুমি সেই বাস্তবটার খোঁজেই যেতে পারো। .... লড়াই হবে বাইরে, ঘরে, পার্টিতে।' ভবনাথদা বলে চললেন — '... মনে হলো, তুমি নিজের সঙ্গে লড়ছো, তোমার শেকড় খুঁজছো। খোঁজো, সেখানেই জবাব আছে।'

    ভবনাথ আরও বললেন, 'খোঁজো, নাওয়াল খোঁজো, আর এটাও জানবে অনেকেই খুঁজছে। খুঁজতে আরম্ভ করলে, তাদের সঙ্গেও তোমার যোগাযোগ ঘটে যাবে।' নাওয়াল বলল, সে তার বাবাকে বুঝেছে এবং সেভাবেই শেকড় দেখতে পেয়েছে। ভবনাথ তাকে উৎসাহ দিলেন। বললেন, উপায় আছে এখনও। জমানা বদলেছে। জমানাটাকে বুঝতে হবে। 'মার্কসের কথাটা মনে রেখো, দুনিয়াটাকে যে যেভাবেই দেখুক, একে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বদলাতে হবে। আর এখন যে পার্টির জঞ্জাল জন্মেছে, এগুলোকেও সাফ করতে হবে।' 'ভবনাথদা'র কথা নাওয়াল সবটা না বুঝলেও মুক্তিপথের সন্ধান সে পেল নিজের মতো করে। সে তার শেকড়ের সন্ধানের মধ্যে মুক্তি খোঁজাকেই তার লক্ষ্য বলে গণ্য করে ফেলল। 'ভবনাথদা' নিজেও কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারাদের মুক্তিকামী দল ছেড়েছিলেন। নাওয়াল তার বিলাসের জীবন ছেড়ে রাতের অন্ধকারে মুক্তির আলোর খোঁজে পথে পা ফেলল এবং ব্যাকুল আগ্রহে নিজের বস্তির মানুষদের মধ্যে ফিরবে বলে সেদিকেই ছুটে চলল। কাহিনীর এখানেই শেষ।

    এই উপন্যাস গল্প বলার উপন্যাস নয়। একটি মূল তত্ত্বকে খুঁজে পেয়ে সেটি তুলে ধরতে চেয়েছেন কাহিনীকার তাঁর পাঠকদের কাছে। ঘটনাবহুল নয় কাহিনী-বর্ণনাও। বরং কিছু ঘটনার বিবৃতি-মাঝে তত্ত্বটিকে গুঁজে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই কাহিনীস্রোত। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সেই লক্ষ্যেই স্থির থেকেছেন। তবু এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে হয় ছোট কলেবরের মধ্য দিয়েই বড় বার্তা দেওয়া উপন্যাসটিকে এবং পাঠশেষে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় বেশ কিছুক্ষণ।

    নাট্যদল রঙ্গলোক-ই আমাকে 'খোঁজ' দিয়েছে এই উপন্যাসের। আগে নাটক দেখে তারপর উপন্যাসটি হাতে পেয়ে পড়ে নিয়ে নাটকের সূত্র বুঝে নিয়েছি আরও ভালো করে এবং সেইসঙ্গে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা উপন্যাসটির মূল মর্মকথা। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সর্বহারাদের দলের বর্তমান হতদ্দশাই নাটক-দলটিকে ভাবিয়েছে এবং তাঁদের সেই ভাবনা তাঁরা সমরেশ বসুর কথার মাধ্যমে বর্তমান সময়ের সচেতন মানুষজনদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।

    উপন্যাসের নাম না বদল করে উপন্যাসের তত্ত্বকথাকে ভর করে তৈরি হওয়া নাটক শ্রবণ-মন কেড়ে নেওয়া সংলাপ শুনিয়ে দর্শককে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই কথাটি বুঝেছিলাম শেষ হয়ে আসা বছরের মার্চ মাসের ১৬ তারিখে রবীন্দ্র সদনের বিশাল হলঘরে দর্শক আসনে বসে। কান খাড়া করে শুনতে হয় নেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকা ব্যক্তির উচ্চার 'দুনিয়ার স্টিয়ারিং যাদের হাতে সেই গাড়িতে উঠতে হবে।' সর্বহারাদের নেতা হওয়ার বাসনা তাঁকে সেই গাড়িতে চড়ায়, নেশায় ঘোরায়। নাওয়াল, দরিদ্র শ্রমিকের সন্তান, ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে হঠকারী বনে যায়। দর্শক-মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই পরিবর্তন। তাকে চমকে দিয়ে মঞ্চে বেজে ওঠে — 'মুক্ত করো, অন্ধকারের এই দ্বার'।

    ভোটের হিসাবের রাজনীতির রূপ স্পষ্ট হয়ে যায় যখন শোনা যায় এমন সংলাপ যার মধ্যে সেক্যুলারিজম সম্পর্কিত জোরালো ভাষণ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তাহলে যে মুসলিম ভোটপ্রার্থীকে দাঁড় করানো হয়! সুবিধাবাদের খেলা? ভোটের রাজনীতির ভণ্ডামি এভাবেই ফাঁস হয়ে যায়!

    প্রাণটা হাহাকার করে ওঠে দর্শকেরও, যখন নাওয়াল-রূপী অভিনেতা সঞ্জীব সরকারের মুখে শোনা যায় — বাইশ বছর তুমি নেই 'দুপয়সার লড়াই জিতনেওয়ালা বাবুজি'। সে আরও বলে, 'মরে গিয়ে বেঁচে গেছো। আমি শুধু ভাষণ দিই। লড়াই ভুলে গেছি। মুঝে মাফ কর দে না বাবুজী!' কী গভীর তার সেই আর্তনাদ! এই ভূমিকায় সঞ্জীব সরকারের অভিনয় নিঃসন্দেহে দর্শকচিত্ত জয় করার মতো। এত কঠিন একটি চরিত্রের রূপায়ণ বড় কঠিন কাজ, সেই কাজটি তিনি সম্পন্ন করেছেন সাবলীল ভাবে। নাটকটির পরিচালক শ্যামল চক্রবর্তী নাওয়ালকে মুক্তির পথ দেখানো নেতা ভবনাথ গুপ্তের চরিত্র রূপায়ণে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন শারীরীক ভঙ্গিমা ও সংলাপ উচ্চারণে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্রটি নাওয়ালের জীবনে যেমন, তেমন উপন্যাসে এবং সেটির নাট্যরূপেও বিশেষ স্থান দখল করেছে। শ্যামল চক্রবর্তী চরিত্রটিকে তাই গুরুত্ব দিয়েই মূর্ত করেছেন তাঁর অভিনয়ে। পরিচালক হিসেবে তো বটেই, অভিনেতা হিসেবেও তিনি দর্শকমনে ছাপ রেখে দেওয়ার মতো ভূমিকা পালন করেছেন। লছমনের স্ত্রী বেদামীর এবং নাওয়ালের স্ত্রী লছমীর ভূমিকায় যথাক্রমে অপর্ণা বিশ্বাস ও মোনালী চ্যাটার্জীর অভিনয় ভালো লাগার মতো। লছমন আগারিয়ার চরিত্র রূপায়ণের পরিসরটুকু সীমিত হলেও সেখানেও শ্যামল সরকার প্রয়োজন মাফিক অভিনয় করেছেন। ঝকঝকে চেহারা ও গমগমে স্বরের মালিক নেতা বিনোদ সেনের চরিত্রে শুভ গুপ্তভায়ার অভিনয় নজর কেড়ে নেয়। পদ্মনাভ বসু তথা সমরেশ বসুর চরিত্রটিকে নাটকে পাওয়া বাড়তি লাভ। সেই ভূমিকা প্রসূন ব্যানার্জী তাঁর অভিনয় দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। বস্তুত রঙ্গলোকে-এর কুশীলবগণ কেউই এই নাটক পরিবেশনে কোথাও মাত্রা ছাড়ান নি। সেটি লক্ষণীয় এবং নাট্যসংস্থাটি প্রাসঙ্গিকতার কথা ভেবেই যে গুরুগম্ভীর নাটকটি পরিবেশন করেছেন দর্শকমহলে তা তাদের উপস্থাপনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কী সমাজতন্ত্র! কী সাম্যবাদ! সব মতবাদ পোষণকারীরাই মানুষের কাছ থেকে দূরে সরেছেন — দূরে যাওয়া চলছে।

    নাটকের একটি সংলাপ কানে বাজছে আজও — 'পার্টি কন্ট্রাক্টর ও ঠিকাদারদের মাথায় ছাতা হয়ে বসে আছে'। প্রখর সত্য এভাবে প্রকাশিত হয়েছে কেবল একটি বাক্যে এবং সেটি সম্ভব করেছেন নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দ। তাঁর নাট্যরূপদান সার্থক। 'তেভাগা আন্দোলনের শহীদ ক্ষমা করো' — এই উচ্চারণে নাটকের মধ্য দিয়ে শোনা যায় যেন একালের পথ ভুল করে বিপথে চলা সকল মানুষের মনের আর্তি! এ ব্যাপারে প্রশংসা লাভের দাবিদার অবশ্যই তীর্থঙ্কর চন্দ।

    লোচ্য নাটকটি 'লাল ঝান্ডা পার্টির' মূল আদর্শ থেকে সরে যাওয়া নেতাদের তীক্ষ্ণ সমালোচনা উপস্থাপন করেছে মঞ্চে, সমরেশ বসুর লেখা উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিয়ে। উপন্যাসটিও কেবল সর্বহারার দলের নেতাদের পথভ্রষ্ট হওয়াকেই চিহ্নিত করেছে। এই নেতারা যাদের উপর নির্ভর করে তাদের একজন প্রতিনিধির নাম বুলেট। বুলেট একজন ওয়াগন ব্রেকার এবং 'অনেক কটা খুনের মামলা আছে ওর বিরুদ্ধে। কিন্তু ও বেশ বুক ফুলিয়েই ঘুরে বেড়ায়। ... এখন গোটা এলাকা বুলেটের হাতে। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। ওর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।' এই বুলেটকে আগলে রাখে একজন এম. পি.! নেতাদের এমনই আদর্শহীন নেতৃজীবন! কোন্‌ দলের? শ্রমিক-মজুর-দের মুক্তিকামী দলের! কংগ্রেস দলের অধঃপতনও ঘটেছে আদর্শচ্যুত হওয়ার ফলেই, বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার আগে — একথারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে ও নাটকে।

    নাটকের দর্শক এবং পরে উপন্যাসের পাঠক হিসেবে আমাকে ফিরে তাকাতে হয়েছে বর্তমানের বাস্তবে। সেখানে আমরা কী দেখছি দেশবাসী? সমগ্র দেশে রাজনীতির কী রূপ দেখা যাচ্ছে?

    সমগ্র দেশে ক্ষমতার চূড়ায় থাকা একটি রাজনৈতিক দল এবং আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এবং অন্যান্য রাজ্যেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে কী একই কথা প্রযোজ্য নয়? দলে দলে কেবল বাহ্যিক রঙ বা নামের তফাত মাত্র চোখে পড়ে। বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, আর কোন পার্থক্য নেই। ক্ষমতায় বসলেই সকলের চেহারার অভিন্নত্ব ধরা পড়ে। নেতৃত্বের নেশায় মত্ত হতে দেখা যায় সকলকেই। আর দৃষ্টিকটূ হয়ে পড়ে তাদের একে অপরের প্রতি দোষারোপের ধরনে অভাবনীয় মিল। একজন স্বৈরাচারী নেতা অনায়াসেই বিরোধী দলের নেতাকে স্বৈরাচারী বলে অভিযুক্ত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন না। আবার দেখা যায়, সারাজীবন প্রতিবাদী ভূমিকায় থেকে ক্ষমতার আসন লাভ করেছেন যিনি তিনিই বিরোধীপক্ষ বা নাগরিকজন বা দেশবাসীর প্রতিবাদী ভূমিকার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং প্রতিবাদী অথবা প্রতিবাদকে সমূলে ধ্বংস করতে দ্বিধাবোধ করেন না একটুও। একই নেতৃত্বের নেশা সব দলকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয় এভাবে, তাদের মধ্যে নানাবিধ ভিন্নত্ব থাকা সত্ত্বেও।

    তবে উপন্যাস ও নাটকটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান বাস্তবের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য অনুধাবনযোগ্য। সেটি হল, বিপথগামী নেতৃবর্গের সকলেই, উপন্যাসে ও নাটকটিতে, পুরুষ চরিত্র কিন্তু বাস্তব আজ ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে জানিয়ে দেয় যে, মুখ্য ক্ষমতার আসনে আজ মেয়েরাও আসীন নেত্রীরূপে এবং দলীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যেও কিছুমাত্র কম নয় পুরুষনেতৃত্ব থেকে। এখন কোন উপন্যাস লেখা হলে এবং তার নাট্যরূপ সৃষ্টি হলে সেসবে এই পার্থক্যটুকুই কেবল ঠাঁই পাবে নেতাদের চরিত্রস্খলনের বর্ণনায়, আর কিছুতে নয়।

    পরিশেষে বলি, বর্তমানের ডান-বাম সকল দলেরই কেবল নাম আর বর্ণ ভিন্ন। বস্তুত ক্ষমতার আকর্ষণে সেসব দলের নেতা-নেত্রীগণ একই কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান গ্রহণ করেন পারস্পরিক শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও। ফলস্বরূপ, আজ আর কেবল নাওয়ালরা নয়, সমগ্র দেশে দুর্ভাগ্য-কবলিত বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। কেননা, নাওয়ালরা পিছনে পড়ে থাকলে দেশ এগোতে পারে না।





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : লেখকের সৌজন্যে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments