• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা: পদ্মপত্রে জলবিন্দু, রূপোলী খুর, আশালতা সিংহের গল্প-সংকলন, Muslims against Partition : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || ‘বিটুইন দ লাইন্স’ নয়, এবাভ। গব্যঘৃতে জারিত ||

    পদ্মপত্রে জলবিন্দু; প্রতাপকুমার রায়; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল ২০০৪; ISBN: 81-7756-415-3

    ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পাশে ধর্মতলা স্ট্রিটের চৌরাহে এক ঝালমুড়ির দোকান ছিল। হাত আটেক বহরে দেওয়ালে ঠাসা এক ছোট্ট দোকান, সামনে বড় বড় কাঁচের বয়ামে ডালমুট-ছোলাসেদ্ধ-চিনেবাদাম রাখা। শহরে অসংখ্য এমন দোকানের ভিড়ে অনন্য ছিল এটি। দীর্ঘ ক্রেতার কাতারে কত দাঁড়িয়েছি, ওদের সঠিক মশলার মিশ্‌টি আস্বাদনের লোভে। সেদিনের পর থেকে নোলা বেড়ে গেল আরও। কোন্‌দিন? যেদিন সদ্য-প্রকাশিত ‘আজকাল’ কাগজে পড়েছিলুম সেই ঝালমুড়ির দোকানের ইতিহাস-ভূগোল সমেত পুরো বায়োডেটাঃ পূর্বে বাঙালির মুড়ি খাওয়ার পরম্পরার সঙ্গে পশ্চিমে গুজরাটিদের ভিজে মুড়ি (পড়ুন, ভেলপুরি) খাওয়ার গল্প। সে ১৯৮০ দশকের কথা হবে বোধহয়। স্বয়ং প্রকাশক মশায় শ্রীপ্রতাপকুমার রায় এক সাপ্তাহিক কলম লিখতেন কলকাতার নানান খাবার ঠেক নিয়েঃ অনাদির মোগলাই থেকে কেষ্টকাফের ব্রেইজ্‌ড্‌ কাটলেট থেকে প্যারামাউন্টের শরবৎ। সে-সব পড়ে পড়ে কখনও ‘নকুড়’ কখনও ‘সিরাজে’ হানা দেওয়া ... লিমিটেড বাজেটের ভেতরও! সে প্রায় বছর-চল্লিশ পুরনো মন-কৌটোর ঢাকনাটা ফের আজ খুলে দিল এই বইঃ ‘পদ্মপত্রে জলবিন্দু’। জিভে জল, চোখেও।

    নতুন কোথাও বেড়াতে গেলে তার দুর্গ-অট্টালিকা-নদীতট দেখে আসি; শাড়ি-সালওয়ার কেনা হল, নব্যজনের সঙ্গে বাতচিত হৈল,... বেশ। বেশ? এতেই জেনে ফেল্লুম সেখানকার সংস্কৃতি? আরে বাপু, আসল কাজটাই যে বাকি। পেটপুজো! টু বি মোর প্রিসাইজ, জিভপুজো। শুধু পেটের গহ্বর বোজালেই তো হবে না, সে যাত্রাপথেরও জয়জয়কার হওয়া চাই, শুরু যার জিহ্বায়। তাই না দেশে দেশে যুগে যুগে এতো আয়োজন... লখনৌ কবাব বানায় তো মান্দ্রাজে মোলায়েম উত্তাপম্‌, রাজপুতানার বাফ্‌লা-বাটি আর অহোমে কেয়াপান। সত্যিই, চেখে না দেখলে একটা জাতকে চেনা যায় না কক্ষণো। আর প্রথিতযশা প্রকাশক প্রতাপ রায় মশায় আজীবন এটাই করে গেছেন। নৈলে বাঙ্গালোরে পাবলিশার্স-কনফারেন্সে গিয়ে অশোক সরকার/কানাইলাল সরকার মশাইরা যখন আসন্ন সভা নিয়ে উদ্বিগ্ন, পি কে রায় তখন দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে নতুন এমটিআর (মাবল্লি টিফিন রুম)-এর ইড্‌লির বাটি নিয়ে বসে যান প্রাতঃরাশ সারতে? হুঁ হুঁ বাবা, যতই বলো, জিভে না ফেললে একটা জাতকে পুরোপুরি চেনা যায়না কখনোই।

    অধ্যা. কিকুনায়ে ইকেদা ছিলেন এক প্রখ্যাত জাপানি রসায়নবিদ্‌। ১৯০৮-এ’ তাঁর যুগান্তকারী অনুমানঃ মিষ্ট-অম্ল-তিক্ত-লবণাক্ত ... এই চারের বাইরেও আরেক স্বাদগ্রন্থি আছে, নাম দিলেন তার ‘উমামি’ (ইং yummy থেকে)। তারও প্রায় একশ’ বছর পরে অতিসদ্য বিজ্ঞানীগণ যখন সত্যি সত্যিই সেই স্বাদগ্রন্থি আবিষ্কার করলেন, প্রতাপবাবু তখন আর নেই। থাকলে দেখতেন তাঁর এ’ আত্মজীবনীগ্রন্থ অন্য এক মাত্রা পেয়ে গেছে। সাধে কি আর চার্লস ডারউইন বলেছিলেন, ভাষার পরেই মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হলো রন্ধন!

    সত্যজিৎ-সিদ্ধার্থশঙ্কর প্রতাপচন্দ্রের ক্লাসমেট, প্রেসিডেন্সি ফিজিক্সের প্রাক্তনী প্রতাপকুমার রায় মহাশয় সেই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির বাঙালি ছিলেন যাঁরা স্যুট-টাই পরে আপিস করলেও আচারে-অনুষ্ঠানে পাটভাঙা কাঁচিমার্কা ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতেন না। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-মশাই আজও তাই বন্ধু প্রতাপের গল্পে নালেঝোলে হন। অতি উপাদেয় আত্মজীবনী লিখেছেন প্রতাপবাবু যার শুরু ত্রিশের দশকের মেদিনীপুরে পেডি-ডগলাস-বার্জ হত্যার কালে। তারপর প্রেসিডেন্সি/হিন্দু হস্টেল হয়ে বারাণসীর ‘ভু’ (BHU)। পদার্থবিদ্যার ছাত্রের কর্মজীবন শুরু হলো কিন্তু একটু অন্যরকমভাবেইঃ শেয়ার-মার্কেটের ব্রোকার হিসেবে.... অচিরেই লক্ষ্মীলাভ---বাইশ বছরের যুবক সেকালে লক্ষাধিক টঙ্কার মালিক! কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ‘বাজারের’ পতন ও ছাপাখানার জগতে আগমন। তার থেকে ধনকুবের রামকৃষ্ণ ডালমিয়ার নজরে আসা ও ক্রমে ‘টাইম্‌স্‌ অব ইন্ডিয়া’ হাউসের উচ্চতম শিখরে আরোহণ। জিভে তার গ্রহণের মত পরিপাশকে দেখার দৃষ্টিটাও প্রতাপের তারিয়ে তারিয়ে, আচমকা গলাধঃকরণ করে নয়। এটাই তাঁর লিখনের বৈশিষ্ট্য, নৈলে তাঁর নানা তাবড় তাবড় সাহিত্যিক-সাংবাদিক সুহৃদের ভিড়ে প্রতাপ কিন্তু কদাচই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না, ছিলেন সংবাদপত্রের নামী প্রকাশক হিসেবে। কিন্তু তিনিই যে এই কলম ধরলেন এখানে, এক অতি সুখপাঠ্য গ্রন্থের জন্ম হলো ... সাড়ে তিনশ’ পৃষ্ঠা কোথা দিয়ে উবে গেল যেন!

    কত কত যে ঘটনা, ব্যক্তি ও বিষয় এসেছে প্রতাপের পঞ্চাশ বৎসরব্যাপী এই জীবনীগ্রন্থে তা সংখ্যাবদ্ধ করলে লিস্টি অতি দীর্ঘ হবে; তবে তার মধ্যেই কোথাও কোথাও যে যে লাইন বেরিয়ে এসেছে ওনার কলমে... কবিতার মতো! জাঁদরেল উকিল পিতামহ ধর্মবিশ্বাসে ব্রাহ্ম ছিলেন, অতীব নিয়মনিষ্ঠ, আপন গৃহে নিভৃতচারী... কেবল তাঁর খড়মের শব্দে বোঝা যেত উনি বৈঠকখানায় যাচ্ছেন না দালানে না ছাদে। তাঁর অকাল প্রয়াণ যেদিন, চলেও গেলেন বড় অগোচরে, খড়মজোড়ার শব্দও শোনা যায়নি মোটেই! বা, তিতিরপাখির মাংসের তুলনা করেন প্রতাপকুমার সুন্দরী রমণীর হাস্কি ভয়েসের সঙ্গে, আর কুক্কুট-মাংসের সঙ্গে এর তুলনায় লেখেন ‘দীর্ঘাঙ্গিনী স্ত্রীলোককে ভালোবাসলে কি নাতিউচ্চ সুন্দরীকে আলিঙ্গন করা যায় না?’ অবশ্য, ভোজ্যস্বাদের বর্ণনায় শেষাবধি ভাষার দীনতা স্বীকার করে নেনঃ ‘শুধু সুপারলেটিভ বিশেষণ ছাড়া কলমে বর্ণনার কোনো ভাষা নেই’!

    এ’ বইখানির এক মস্ত আরকাইভ্যাল ভ্যালুও রয়েছে। ভারতের সংবাদপত্র-প্রকাশনার ইতিহাস জানতে গেলে এই দুই মলাটের মধ্যে যত যত তথ্য উপলব্ধ, অন্যথায় পেতে দশ-বিশখানি কেতাব ঘাঁটতে হবে। যেহেতু প্রতাপবাবু এই ক্ষেত্রে নিজেই জড়িয়ে ছিলেন অঙ্গাঙ্গী, তাঁর কাছে এ’ গল্পগুলি এসেছে বড় অনায়াসে। শেষে তাই ব্যক্তি ও বিষয়ভিত্তিক দু’টি ‘পরিশিষ্ট’ থাকলে বেশ হতো।

    ব্যক্তি তো অনেকেই এসেছেন, তবু তার মধ্যে দুই বন্ধুর গল্প বড্ড মন ছুঁয়ে যায়ঃ এক যাদবপুরের ‘কৃষ্ণা গ্লাস ওয়ার্কস’-এর স্থপতি সহপাঠি বিভূতি সরকারের (আজকের প্রথিতযশা সার্জেন ডাঃ কুণাল সরকার মশায়ের পিতৃদেব) অকালপ্রয়াণ, ও রবীন্দ্র-প্রয়াণের খবরে বহুগুণে গুণান্বিত সহপাঠী অহিভূষণ মালিকের (পরবর্তীকালের নামী কার্টুনিস্ট) গলায় উদাত্ত গান! পড়ে মন উদাস হয়।

    শুধুমাত্র আহার্য, বিশেষতঃ বাঙালির ভোজনবিলাস নিয়ে, বাঙলাভাষায় লেখা কিছুই হয়নি প্রায়। বিভূতিভূষণের মত পরম ভোজনরসিক সাহিত্যিক কিন্তু আহার্যের বর্ণনায় কলম ধরেননি। ছেলেবেলায় হেমেন রায়ের গপ্পে ‘মাছের কচুরি ও মাংসের সিঙ্গারা’-পড়ে আমরা প্রভূত আনন্দ পেতুম, যদিও। একমাত্র ব্যতিক্রমঃ বুদ্ধদেব বসু-হেন মহী্রুহ একবার লিখেছিলেন ‘আনন্দবাজার’-এ’, পরে যেটা কন্যার ‘বিকল্প’-প্রকাশনী থেকে বেরোয় ‘ভোজন শিল্পী বাঙালী’-বই হয়ে (রামানন্দ বন্দ্যো. র চিত্রশোভিত) [‘বুদ্ধদেব বসু বিভাগ’, পরবাস]। তাই প্রতাপকুমারের এই বইয়ে নানান ঘটনা-ব্যক্তিত্বের সন্নিবেশ ঘটলেও শেষ বিচারে একে স্বাদশিল্পের এক অনন্য দলিল হিসেবেই মনে রাখতে হবে। এটি শুধু বাঙলার নয়, ভারতের বহুবিধ খাদ্যাখাদ্যের এক সরস দলিল... স্মৃতিরসে জারিত সাহিত্য। এ’ বই থেকে শুধু নানা দেশ-প্রদেশের খাদ্য, খাদ্যাচার (food-etiquette)-এর গপ্পগুলি বার করে নিয়েই একটি পৃথক বই হয়ে যায় (সদ্য বেরিয়েছেও, আনন্দ থেকে)।

    বহু বহু ঘটনা/ব্যক্তিত্বের উল্লেখ থাকলেও কোত্থাও সালতামামির উল্লেখ নেই---সবই অন্য পরম্পরা থেকে অনুমান করে নিতে হয়---এটা বিভ্রান্তিকর। শ্রমিক-বিরোধ/ছাঁটাই-হেন প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে, কিন্তু তা বিএমএস না আইএনটিইউসি কোত্থাও উল্লেখ নেই। গুনে দেখিনি, গোটা পঞ্চাশ অধ্যায় রয়েছে বোধহয় বইটিতে, কিন্তু সংখ্যা/শিরোনাম, সূচিপত্র নেই। ফিরে পড়া/খোঁজা তাই কষ্টকর। ছাপার ভুল চোখে পড়েছে বহু। তবু বইখানি কিনেছি কেবল সাজিয়ে রাখতে নয়, পার্সি ‘পাতরানি মচ্ছি’ বা গুজরাতি ‘বাসুন্দি’-র খবর চট্‌ করে পেতে তাক থেকে পেড়ে পাতা খুলবো এর... চমৎকার ক্যালিগ্রাফিত প্রচ্ছদটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি (কৃষ্ণেন্দু চাকী-কৃত)। বাঙলাসাহিত্যের পাথারে এই বইয়ের একটা স্থান থেকে যাবে, সাহিত্যগুণে, স্বাদগুণে!

    পুনঃ--প্রতাপ-সুহৃদ খ্যাতকীর্তি সাংবাদিক শ্রীকুলদীপ নায়ার সাহেবের ‘বিটুইন দ লাইন্স’ বইটি তুখোড় জনপ্রিয় হয়েছিল এককালে---তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন লেখক এখানে। ‘...জলবিন্দু’ পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে এর অনেক উপর দিয়ে চলে গেছে প্রতাপের আত্মজীবনীগ্রন্থখানি। আর, স্বাদে তার নিখাদ গব্যঘৃতের খুশ্‌বু!



    || সে থাকবে আমার ঘরের বালালাইকা হয়ে ||

    রূপোলী খুর---প. বাজোভ। বঙ্গানুবাদঃ রেখা চট্টোপাধ্যায়; অলঙ্করণঃ ম উস্পেনস্কায়া; প্রকাশনাঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রা লি, কলকাতা-৭৩; প্রথম এন বি এ প্রকাশঃ বইমেলা ২০১০; ISBN: নেই

    ধূ ধূ তুষারপ্রান্তর থেকে উড়ে উড়ে আসছে এক নীলচে ফড়িং!

    ফড়িং,এখানে? নীল ফড়িং? না, ফড়িংটা শাদা, গায়ে তার এসে পড়েছে তুষারভেজা নীল চন্দ্রিমালোক! উড়ে উড়ে আসে সেই নীল ফড়িং। হাতে এসে বসতে দেখি, আরে এ’তো বই এক! বই! হ্যাঁ, বই! নীল তার গাত্রবর্ণ, হালকা যেন ফড়িং! পৃষ্ঠাসংখ্যা মাত্র ষোল। কিন্তু ঐ ‘সামান্য’ বই আসলে এক টাইমমেশিন, মুহূর্তে নিয়ে চলে যায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে, আজকের প্রৌঢ় আয়নায় তাকিয়ে দেখে, আরে এ’ কে? এ’যে সেই হাফপ্যাণ্ট পরা কিশোর... মধ্যকলকাতার বদ্ধগলি... ঘর্ম-কর্দম-প্যচ্‌প্যাচে... না, সে-আকাশে এক রামধনুও উঠতো, নাম তার ‘রাদুগা’! মস্কো/তাশখন্দের ‘রাদুগা প্রকাশনালয়’! রুশভাষায় ‘রাদুগা’-র অর্থ রামধনু যে! ‘দাদুর দস্তানা’, ‘মানুষের মত মানুষ’, ‘ভয়ংকর রোমহর্ষক ঘটনা’, ‘পিঁপড়ে ও ফড়িংয়ের গল্প’ ... শিশু-কিশোরদের জন্য এমন এমন কত স্বপ্নমাখা বই! ‘রাদুগা’-প্রকাশন অবশ্য এসেছে অনেক পরে, তার আগে ‘প্রগতি’, তারও আগে ... ক্রমে আসা যাবে এখন এ’সকল ইতিকথায়। এখন গল্পঃ

    গল্পের নাম ‘রূপোলী খুর’!

    ইউরেশিয়া সীমান্তের উরাল পর্বতশ্রেণী অঞ্চলের প্রাচীন উপকথায় ছিল এক অলীক হরিণের গপ্পো যে নাকি বরফের প্রান্তর পা ঠুকলে ঝরে পড়ে মণিমুক্তো! এই ‘রূপোলী খুর’ নিয়ে পরে শিশুনাটিকা হয়েছে, হয়েছে সিনেমা, অপেরাও। কিন্তু ষাটের দশকের বালক সে সবের খবর কী রাখবে ? সে তখন গোগ্রাসে গিলে চলেছে...

    “ককভানিয়া নামে এক বুড়ো ছিল আমাদের গ্রামে... ” সে আসলে ছিল এক ‘প্রসপেক্টার’... উরাল পর্বতাঞ্চলে নদীর তীরে তীরে বালি ঘষে ঘষে সোনা খুঁজে বেড়াতো সে। সেকালে ও’অঞ্চলে এ’হেন পেশার মানুষ নাকি বেশ ছিল। বাঙলাসাহিত্যে আরেক পরিচিত ‘প্রসপেক্টার’-এর গল্প পড়েছি না? ‘চাঁদের পাহাড়’-এর এলভারেজ। তা, আমাদের এই ককভানিয়া বুড়োর তিন কুলে ছিল না কেউ। তাই সে ভাবলে কোনো অনাথকে পুষ্যি নেবে। কোনো ছেলেকেই নেবে ভেবেছিল প্রথমে, কিন্তু তেমন কারোকে না পেয়ে শেষটায় তার প্রয়াত এক বন্ধুর মেয়েটিকে নিলো। নাম তার ‘ডালি’, মানে ‘উপহার’---রুশভাষায় পদারিয়ঙ্কা! কী চমৎকার নাম, না? এ’ মহাগ্রন্থের নায়িকা সে-ই; গ্রন্থের দৈর্ঘ্য যদিও ষোল পৃষ্ঠা!

    কিন্তু ছ’ বছরের বাচ্চাটি যাবে কেন অচেনা এক বুড়োর সঙ্গে থাকতে, যদিও পড়শি-খুড়ি তাকে ভরপেট খেতেও দেয় না? তাই বুড়ো গপ্প ফাঁদলো সেই হরিণের যার সামনের ডান পা ঠুকলে মণিমুক্তো ঝরে পড়ে তুষারপ্রান্তরে!

    এবার গিলেছে টোপ! খুকি দারিয়ঙ্কা চল্লো বুড়োর সঙ্গে গপ্পের বাকিটুকু শুনতে, একটাই শর্তেঃ তার রোঁয়াওঠা বিল্লিটাকেও নিতে হবে সঙ্গে। বেশ তো, চলুক না সেঃ ‘থাকবে সে আমার ঘরের বালালাইকা হয়ে!’

    শুরু হয়ে গেল গল্প।

    এরপর পরতে পরতে খুলে যাওয়া গল্পের ঠাসবুনুনি---এক শালপ্রাংশু বৃদ্ধের সঙ্গে সত্যিসত্যিই তার হাঁটুর বয়সী এক নাতনির বন্ধুতা। লেখক পাভেল বাজভ (১৮৭৯-১৯৫০)-সাহেবের হাতে কিন্তু পাতা বেশি ছিল না। সন্তানহারা, আদ্যন্ত কম্যুনিস্ট মানুষটি একটু সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন কালি-কলমে, নিবিষ্টি মনে যখন তাঁর দেশের, মানে উরালাঞ্চলের, লোকগাথা লিখে রাখতেন ছোট্ট ছোট্ট ছেলেপিলেদের জন্যে, যেন তাঁর সদ্যপ্রয়াত পুত্রেরই উদ্দেশে! গপ্পগুলির সাইজ কিন্তু ঐ দশ-বিশ পৃষ্ঠা মাত্রঃ মনে হয় যেন ‘টুনটুনির বই’ পড়ছি। বাজভের Silver Hoof (‘রূপোলী খুর’ ) প্রথম বেরোয় ১৯৩৮এ। পরে ‘রাদুগা’-প্রকাশনী থেকেই তাঁর উরাল-উপকথার সংগ্রহগ্রন্থ বেরোয়ঃ ‘মালাকাইটের ঝাঁপি’ (অনু. ননী ভৌমিক)। মূলতঃ, লোকগল্পকার হিসেবেই শিশু-কিশোরসাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন বাজোভ---আলেক্সান্দার পুশকিন, আন্দ্রেই প্লাতোনভ, নাদেঝদা টেফির মত দিকপালদের পাশাপাশি আরেক দিকপাল হয়ে।

    যত এগিয়েছে রূপোলী খুরের গল্প পক্ক হয়েছে তত। নিপুণ শিল্পীর মতো কয়েকটি কয়েকটি আঁচড়ে তার এনেছেন মাত্র চারিটি পদ দিয়ে, পড়ুন, চরিত্র নিয়েঃ বুড়ো, খুকি, বিল্লি আর, আর... ? কেন সেই রূপোলী খুর? সেই অধরা হরিণ, যার সামনের পা ঠুকলে... ! হেমিংওয়ের কত নাম ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ সী’ লিখে। বুড়ো ককভানিয়া ও খুকি দারিয়াঙ্কার গল্পও তেমনই। দুই অসমবয়স্ক মানুষের বন্ধুতা। অপূর্ব গাথা! কিন্তু পাভেল বাজোভকে আমরা হয়তো চিনতামই না সোভিয়েত প্রকাশনী স্বল্পমূল্যে পরদেশী এক বালকের হাতে ‘রূপোলী খুর’ তুলে না দিলে; যদিও বাজভ ইংরেজিভাষায় অনূদিত হয়ে গিয়েছিলেন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই, ১৯৪৪এ।

    এক ঘাঘু সোভিয়েতি-বাঙালি একবার বলেছিলেন, পৌনে শতাব্দীর জিন্দগিতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি শ্রেষ্ঠ কীর্তি কোথাও রেখে থাকে তো তার পুস্তক-প্রকাশনায় (ও মেট্রো রেল চালনায়)! যে দামে যে পরিব্যাপ্তিতে ও যে গভীরতায় শুধু তাদের দেশে নয় সারা বিশ্বের পুস্তকপ্রেমীদের হাতে বই তুলে দিত প্রগতি-মির-রাদুগা, সভ্যতার ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই। আর সোভিয়েত একাদেমির কাজ, যেমন, অনুবাদে? (সামান্য অন্য প্রসঙ্গ পাড়িঃ) সাইবেরিয়ার পূর্বতম প্রান্তের ছোট্ট এস্কিমো-গ্রাম উয়েলেন, যেখান থেকে রাজধানী মস্কোর দূরত্ব ছ’হাজার কি.মি.-র বেশি। এখানকার ব্যাধপুত্র ইয়ুরি সের্গেইভিচ্‌ রিটকিউ, যিনি লিখতেন মাতৃভাষা চুকচি-তে, কেবল অনুবাদের দৌলতে সাবেক সোভিয়েতের এক উচ্চবিক্রীত ও বহুপুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ছিলেন। আমাদের দেশে, উদাহরণস্বরূপ, ভাবা যেতে পারে যে, সাঁওতালি বা মণিপুরী কোনো সাহিত্যিক কেবল অনুবাদের দৌলতে ভারতের শ্রেষ্ঠ-বিক্রীত লেখক হয়ে পড়েছেন?

    ***

    ১৯৩১-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রকাশন সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষায় রুশ সাহিত্য ও জ্ঞানভাণ্ডারকে ছড়িয়ে দেবার ... প্রাথমিকতা শিশুসাহিত্যে! ১৯৩৯-এ মস্কোয় প্রতিষ্ঠা হল ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’, যা পরে ‘প্রগতি প্রকাশনা’ (১৯৬৩) ও তার থেকে শিশু-কিশোর অংশ বেরিয়ে ‘রাদুগা প্রকাশনালয়’ গঠিত হয়েছিল আরও পরে। সম্প্রতি বাঙলাভাষার পাঠকের জন্যে সুখবরঃ চমৎকার এক ব্লগপোস্ট হয়েছে, যা হল এ’সংক্রান্ত তথ্যের আকর, এবং কয়েকশ’ রুশ বইয়ের স্ক্যান্ড্ কপি সেখানে পাওয়া যায়, বিনিময়মূল্যঃ ভালোবাসা! (‘রূপোলী খুর’, অবিশ্যি নেই এঁদের লিস্টিতে)। দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করার মত প্রচেষ্টা এই বাঙালি তরুণ-তরুণীদের। বর্তমান লিখনের কিছু মালমশলা এঁদের থেকে নিয়েছি, সকৃতজ্ঞ স্বীকারোক্তি।

    সোভিয়েত-একাদেমি তাঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব রাখেনি বলেই না, উদা. মারিনা উস্পেনস্কায়ার (১৯২৫-২০০৭) মত ইলাস্ট্রেটর উঠে এসেছিলেন সেকালে, যিনি মূলতঃ শিশুসাহিত্যের ইলাস্ট্রেশনকেই জীবিকা করে নিয়েছিলেন? বাজভ সাহেব ‘Silver Hoof’ এর জন্যে দশে দশ পেলে উস্পেনস্কায়া দশে বিশ পান!! না, পাঠক, আমি এক তিল বাড়িয়ে বলছি না। ঐ দেখুন না মারিনা দিদিমণির কাজ, আজকের নেটের দৌলতে যা সহজলভ্য (কপিরাইট পিরিয়ডও সমাপ্ত অবশেষে)। যেমন, এই ছবিটি... যেখানে বুড়ো গেছে দারিয়াঙ্কাকে নিতে... খুকির ঐ ডাগর ডাগর চোখ তুলে তাকানো, বাঙ্ক থেকে ঝোলা আরেক খোকা, তো বিল্লির রাগ রাগ চোখে চাওয়া মেজখোকার দিকে যার পাতলুনে মস্ত তালি। কী ডিটেইলের কাজ। শুধু এই ছবিটির দিকে তাকিয়েই অর্ধ ঘণ্টা ঘোরে ঘোরে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আর ঐ ছবিটি, যেখানে খুকি চলেছে বুড়োর ঘরে তার হাতটি ধরে? কী ভরোসা তার চোখে, যতটা স্নেহ ককভানিয়া বুড়োর হেলানো ঘাড়ে। আর ঐটাতে, যেখানে মস্ত কাঠের চামচে দিয়ে স্যুপ খেতে খেতে বুড়ো শোনাচ্ছে তাকে রূপোলী খুরের গপ্প? শ্রেষ্ঠ ছবি অবশ্যই পেনাল্টিমেটটি--যেখানে সমস্ত ভয়ডর ভুলে খুকি মস্ত দরোজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে ‘রূপোলী খুর’-কে দেখতে পেয়ে! বাইরের আকাশে রূপোর থালার মত চন্দ্রমা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তুষারধৌত প্রান্তর। কী সাহস, দাদু সে-রাতে কুঁড়েতে ছিলও না। খুকির পায়ে দাদুর প্রমাণ-সাইজের বুটজোড়া! নাঃ, অক্ষম কলমে বাজভ-উস্পেনস্কায়াকে ধরার চেষ্টা আর করবো না। দশ পাতা লিখে যেমন বেনারসী রাবড়ি বা ময়দানী ফুচকার স্বাদ বোঝানো যায় না, তেমনি... কেন, এই তো এখন কলকাতার ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ফের ছেপে বের করেছে ‘রূপোলী খুর’---যার কথা লিখতেই না আজ কলম ধরা।

    ডেলিভারি একটা মস্ত বস্তুঃ কী ভাবে দিচ্ছি। এক শ্রেষ্ঠ শিশুপুস্তক, স্পর্শক্ষমতায় যা ‘এলিস...’ বা ‘আবোল তাবোল’-এর সমকক্ষ, কেবল উপস্থাপনার খামতিতে তার রসাস্বাদন যে কী পরিমাণ বিঘ্নিত হতে পারে বর্তমান প্রকাশনখানা হাতে না নিলে সেটা বোঝা যাবে না। এঁরা তো ‘দাদুর দস্তানা’, ‘সূর্য লুট’ ইত্যাদি বইগুলো 10.75 X 8.5 ইঞ্চি মাপেই ছাপলেন, তাহলে ‘রূপোলী খুর’-এর সাইজ হঠাৎ ছোট করে 9 X 7 ইঞ্চি করতে গেলেন কেন? যারা পঞ্চাশ বছর আগেকার সেই রাশিয়ান প্রডাকশনটি হাতে নিয়ে পড়েছিলেন, তাদের মনে তো সেই ছবি আঁকা হয়ে রয়েইছে, স্পর্শে সেই অনুভূতি... সেটা যে কী পরিমাণ বিঘ্নিত হলো! এটা একটা পরোক্ষ কারণ বটে উস্পেনস্কায়ার অনবদ্য ছবিগুলি সঠিক না খোলার। রঙীন ছবিগুলি একটাও খোলেনি ঠিক। আর সর্বোপরি যে কারণে... (কী যে করতে ইচ্ছে করছে ভাষায় আর লিখলাম না শালীনতা লঙ্ঘনের ডরে) ... অসংখ্য অসংখ্য বানান ভুল/মুদ্রণপ্রমাদ। ষোল পৃষ্ঠা এক শিশুপুস্তকে বাইশটি ছাপার ভুল আমারই চোখে পড়েছে, আরও গোটাকয় ফস্‌কে যে যায়নি জোর দিয়ে বলতে পারি না। এতো এলাকাড়ির কাজ, এক শিশুসাহিত্য নিয়ে? অমার্জনীয় অপরাধ। বর্তমান প্রকাশকের উচিৎ ওঠবোস্‌ করা।

    শেষ পর্যন্ত সেই রূপোলী খুরের হরিণটিকে ধরা গিয়েছিল কি, না কি সে মিলিয়ে গিয়েছিলো তুষারপ্রান্তরের হিমেল হাওয়ায়? দারিয়াঙ্কার বিল্লিটারই বা কী হলো, যে কিনা ‘ঘরের বালালাইকা হয়ে থাকবে’? ককেশাস-উরাল অঞ্চলের এক গ্রাম্য ‘একতারা’ (না, আসলে তিন-তারা) হলো ‘বালালাইকা’। এখন ইউটিউবের দৌলতে এর সুর শুনলুম বটে, তবে সেকালে সেই বালক শুধু এর নামটাই শুনেছিল মাত্র, সে ছিল তার এক না-পাওয়া মোহনবাঁশি... যার নামটাই কেবল শোনা গেছে, সুর ধরেনি কানে । ষাটের দশকের সেই মধ্যকলকাতার যৌথপরিবারে ‘রূপোলী খুর’ এতো জনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলো যে কারোকে আদর করে গৃহে ঠাঁই দেবার কথা উঠলে, ব্যাঙ্গার্থে বা সত্যিই, বৃদ্ধা ঠাকুমা পর্যন্ত বলে উঠতেন, ‘থাকবে সে আমার ঘরের বালালাইকা হয়ে’ (যেন ঘরের কোণে ঠেস্‌ দেওয়া দাদুর আদুরে তানপুরোটি!)। আর ঘরের কোণ থেকে আদুরে বিল্লিটা যেন ঠিক সেই সময়েই বলে উঠলো, ‘ঠিক্‌ক্‌...তুমি এক্কেবারেরেরেরে.....ঠিক্‌’।


    || আশালতার গল্প। আশা   লতার ||

    আশালতা সিংহের গল্প-সংকলন-২; অভিজিৎ সেন ও অনিন্দিতা ভাদুড়ী সংকলিত; যুগ্ম-প্রকাশকঃ দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ও স্কুল অব উইমেন্‌স্‌ স্টাডিজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রথম প্রকাশঃ জুন ২০০৭; ISBN-81-295-0786-2

    জানি না, ভাগলপুরের সঙ্গে বাংলার নারীমুক্তি আন্দোলনের কোনো কাকতালীয় যোগাযোগ আছে কিনা, কিন্তু ভাগলপুরের গৃহবধূ, বাংলার নারীমুক্তি আন্দোলনের আদি-‘পুরুষ’ বেগম রোকেয়ার শহরেই জন্ম নেন বাংলার আরেক ‘মুক্তনারী’, খৃ ১৯১১---যে বৎসর রোকেয়া প্রয়াত স্বামীর নামে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল’।

    ১৯২৮-এ’ উপেন গঙ্গো.র অভিজাত ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এক নিবন্ধঃ ‘বার্ট্রান্ড রাসেল ও অতীন্দ্রিয়বাদ’। লিখেছিলেন ভাগলপুরের এক তরুণী, বয়স তখন তাঁর আঠেরো ছোঁয়নি (তদ্দিনে অবিশ্যি বিয়ে হয়ে এসে দুবরাজপুরে): তাঁর প্রথম উপন্যাস “অমিতার প্রেম”-ও এই সময় নাগাদই প্রকাশিত হয়; আর ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের শুরুও ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে, কারণ যে ঔদার্য ও আধুনিকতা নিয়ে ভাগলপুরের ব্যবহারজীবী যতীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা আশালতাকে আশৈশব প্রতিপালন করেছিলেন, বীরভূমের ভয়ঙ্কর রক্ষণশীল জমিদারবাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে (১৯২৪) তার কণ্ঠপেষণ চললো, চলতেই থাকলো। রক্ষণশীল এতোটাই যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আশালতাকে শান্তিনিকেতনে এসে নৃত্যগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবার আমন্ত্রন জানালেও শ্বশুরালয়ে তা প্রত্যাখ্যাত হয় ‘ব্রেহ্মদের আড্ডায় গিয়ে নাচাগানা’ কোনো হিন্দু গৃহবধূর পক্ষে অশোভনজ্ঞানে! ভাবো!

    চিঠি লিখেছিলেন আশালতা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে (অগাস্ট ১৯৩৭), তাতে যেমন জমিদার-প্রজার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন ছিল, তেমনি কবির কাব্যের চাইতেও বেশি শ্রীনিকেতনের কর্মযজ্ঞের প্রশংসা ও অনুসন্ধিৎসা ছিল, আর শেষে লিখেছিলেন, “...মনে হয় যাদের কথা আমরা বড় একটা ভাবিনে, তাদের মাঝেও এমন মনুষ্যত্বের প্রকাশ রয়েছে যে জীবনের সমস্ত দিকগুলো আর একবার যেন আগাগোড়া স্থির হয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, অনেক দেখাই হয়তো ভুল দেখা হয়েছে।” হ্যাঁ, এ’কথা লিখেছেন ছাব্বিশ বছরের এক তরুণী প্রায় অশীতিপর এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ কবিকে!

    এই রকমই ‘ঠোঁটকাটা’ (নাকি ‘কলমকাটা’ লেখা উচিত?) ছিলেন ঔপন্যাসিক আশালতা সিংহ (১৯১১-‘৮৫)। নৈলে সেই ১৯২৮এই কি লিখতে পারেন যে নিজের সুবিধে ও আকাঙ্ক্ষা-মতো সন্তানধারণের স্বাধীনতা পেলেই নারী প্রকৃত স্বাধীন হবে? বা, নারীপুরুষের বন্ধুত্বে যৌনসম্পর্ক অস্বীকারের বিষয় নয়, সংযতপথে চালিত করার বিষয়? বা, একই সঙ্গে একাধিক পুরুষকে ভালোবাসতে না পারলেও সময়ের ব্যবধানে সেটা হতেই পারে? সুধী পাঠক, আশালতা ১৯৩০-৪০-এর দশকের লেখিকা ছিলেন, ২০৩০-এর নন (এখনও এ’হেন মতে বাঙালি পাঠক রে রে করে উঠবে!)। গত সংখ্যায় কাশ্মীরিকবি হব্বা খাতুন প্রসঙ্গে নারী দ্বারা পুরুষের অঙ্গরূপ বর্ণনার কথা পাড়া হয়েছিল, না? আশালতার প্রথম উপন্যাসে (১৯২৮) পড়ি নায়কের এলোমেলো চুলের সৌরভে অমিতার বিবশ ইন্দ্রিয়, তার পাঞ্জাবীর খোলা বোতামের ফাঁকে বক্ষকেশ দেখে তার... কী যেন...! কী বললেন, সময়ের চেয়ে ঢের এগিয়ে ছিলেন আশালতা, না? ঠিক্‌, এক্কেবারে ঠিক। সমকামিতার প্লটে সমকালীন উর্দু লেখিকা ইসমত চুঘতাঈ (১৯১৫-৯১)-এর ‘লেপ’ গল্প নিয়ে কম আলোড়ন হয়নি ১৯৪২-এ। তারও কিছু আগেই আশালতার ‘দুই নারী’ গল্পের সুধীরা যখন স্নানার্থী নীরেনকে লুকিয়েচুরিয়ে দেখতে চায়, বা, তার ‘চুলে এবং জামায় যে বিশেষ একটা সুগন্ধ আছে তাতে সুধীরা আত্মহারা হয়ে পড়ে, ওর ছন্নছাড়া গেঞ্জিটা যথাস্থানে তুলে রাখতে গিয়ে সেটার উপরে একটিবার মুখ না রেখে পারে না’... তখন মনে হয় প্রচারের পাশাপাশি নিন্দাও যে জুটবেই তা নিয়ে লেখিকার ভ্রূক্ষেপমাত্র ছিলো না! এটি আশালতার ভাগলপুর বাসকালীন লেখা, মানে বিবাহপূর্বকালে। ছাপা হয়ে বেরোয় পরে।

    এই দ্যাকো, এক গল্প-সংকলনের সম্বন্ধে দু’কথা লিখতে বসে সাতকাহন করে লেখিকার মূল্যায়ন শুরু হয়ে গেল, আগের কথাটা আগে না বলেই। বুড়ো বয়সের দোষ, বেশি কথা বলা। আশালতা সিংহের গল্প-সংকলন বের করেছেন কলকাতার দে’জ পাবলিশার্স, দুই খণ্ডে। দ্বিতীয় খণ্ডটি হাতে এসেছে ও গোগ্রাসে পড়া গেছে। স্বীকারে লজ্জিত হই, বহুকাল আগে দেশ-পত্রিকায় ওনার সম্বন্ধে দু’-একটা প্রবন্ধ ছাড়া তাঁর লেখার সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল না, সম্প্রতি হয়ে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ ও ‘স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরি’-তে পুরনো বই/পত্রিকা ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে এনার রচনাদি পড়ে বড্ড অবাক হওয়া গেছে।

    শুরুটা হয়েছিল গোয়েন্দা গল্প প্রসঙ্গে। সুকুমার সেন-মশায় তাঁর ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ (আনন্দ) গ্রন্থে ত্রিশ-দশকের এক মহিলা লেখিকার কথা পেড়েছেন। সে রহস্যগল্পখানি এই দ্বিতীয়-খণ্ডে স্থান পেয়েছে জেনে এটিরই আহরণ ও পাঠ। এবং খুল-যা-সিমসিম্‌! বাঙলাভাষায় ‘নারীবাদী’ লেখিকা বলতে সেই সেকালের রাসসুন্দরী-ফয়জুন্নেসা-সরলাবালা-স্বর্ণকুমারী সামান্য সামান্য পড়া ছিল, আশালতা দেখি দেড় কদম এগিয়ে! আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-৯৫) ও সুফিয়া কামাল (১৯১১-৯৯) এনারই সমবয়সী, দু’জনের কলমেই নারী এসেছে, কিন্তু আশালতার সুরটা পৃথক, অনেক bold, এমনকী naughty-র সীমানায়ও! এবং এই naughtyত্ব এসেছে সাবলীলতায়, প্রক্ষিপ্ত নয়। যদিও তাঁর জীবনযাপন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল এবং খোদ তাঁর স্বামী ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিরাগের উৎসও নাকি তাই?!

    বিয়ের আগে থেকেই, দিলীপকুমার রায়ের ‘ঘটকালি’-তে, আশালতার দীর্ঘ পত্রমিতালী ছিলো সমবয়সী বাঙলার এক শ্রেষ্ঠ কবির সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের পরে-পরেই যাঁর নাম আসে, এবং সে-সম্পর্ক জারি ছিল কবির বিবাহকাল পর্যন্ত (১৯৩৪), মানে আশালতা যখন দশবছরের বিবাহিতা ও দুই সন্তানের জননী। যদিও দু’জনের সাক্ষাৎ হয়নি। এই অবদমিত সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে পড়েছিল তাঁর ‘অভিমান’ গল্পে, যেখানে নায়ক অজিতকে অনুপ্রাণিত করেও নায়িকা তাকে দখল করতে চায়নি, সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে। নামের দ্যোতনাটি প্রণিধানযোগ্য। অজিত, মানে যাঁকে জয় করা যায় নি, ‘মার’ যাকে জয় করতে পারেনি। ভগবান তথাগতের অপর নাম অজিত। না, বন্ধু, এ’সকল তথ্য আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নহে, এতো জ্ঞানই নেই এ’ঘটে। বইটিতে এক অনন্য ভূমিকা লিখেছেন বাঙলাভাষার কিংবদন্তী অধ্যাপক শ্রীতপোব্রত ঘোষ মহাশয়, যাঁর থেকে চুরি করেই লিখলুম এ’কথা। হ্যাঁ, খবরে এ’ও অপ্রকাশ যে, এ’সময়ে আত্মহননের প্রয়াস করেন আশালতা! কারণ অজ্ঞাত। দুবরাজপুরের শ্বশুরালয় ছেড়ে গঙ্গাতীরে পিত্রালয়ে গিয়ে আরাম হন! বইটিতে ব্রোকেড-ব্রোচ-পরিহিতা আশালতার এক আলোকচিত্র রয়েছে, দুবলী-পাত্‌লী, নিরীহ মুখাবয়ব। কে বলবে এতো তেজস্বিনী?

    আশালতার সাহিত্যজীবন মেরেকেটে দুই দশকঃ ১৯২৮-এ’ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অমিতার প্রেম’ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘একাকী’ উপন্যাস বেরোয় ভারতবর্ষে। ছোটগল্প ‘বুদবুদ’ সজনীকান্ত ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে ছাপিয়ে দেন তাঁর ‘শনিবারের চিঠি’-তে। ‘সুরের উৎস’ বেরোয় প্রবাসীতে, ‘পুনরাবৃত্তি’ বিচিত্রা পত্রিকায়। ‘ক্রন্দসী’ উপন্যাস ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরোয় ১৯৩৯এ। প্রথম প্রকাশেই আশা ঝাঁকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাঙালি পাঠককুলকে তাঁর অতি-আধুনিক মনোভাব দিয়ে। বাঙালি পাঠক অভ্যস্ত ছিলো না এতোখানি এগিয়ে ভাবতে, বিশেষতঃ, নরনারীর সম্পর্ক প্রসঙ্গে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে সর্বমোট সতেরোটি উপন্যাস, চারটি গল্পগ্রন্থ, দুটি নাটক, একটি প্রবন্ধ-সংগ্রহ ছাড়াও নানান পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও খানপঞ্চাশেক গল্প ও প্রবন্ধ---চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে তাঁর এই সকল কীর্তি। তাঁর চারটি গল্পসংগ্রহের মধ্যে দু’টি এঁদের প্রথম খণ্ডে স্থান পেয়েছে, বর্তমানটিতে ‘লগন বয়ে যায়’ ও ‘মধুচন্দ্রিকা’ গল্পসংগ্রহের ১৯+ ২০টি গল্প রয়েছে। আর রয়েছে ২৬খানি এতাবৎ অগ্রন্থিত গল্প ও সেই গোয়েন্দা গল্পঃ ‘রহস্যভেদ’।

    শুধু এই লাইনটি খুঁজতে সাত সাতটি দিন গেছে, ভাই, লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিতে। ব্লার্বটির কথা বলছি। এমন বিতর্কিত ব্লার্ব কদাচ পড়িনি। লিখেছে, ‘নিট্‌শের একটি উক্তি আশালতার খুব ভালো লাগতো…’। আশালতা রাসেলের ভক্ত ছিলেন, খুব পড়তেন এইচ জি ওয়েল্‌স, অল্ডাস হাক্সলি। এটা জানা গেল। কিন্তু নাৎসীবাদের মন্ত্রগুরু নিট্‌শে? ইন্টারেস্টিং!! কিন্তু কোত্থাও হদিশ পেলুম না। আরও আশ্চর্য ও আপত্তিজনক যে প্রকাশক-মশাই আশালতাকে বেমালুম ‘ভণ্ড’ বলে দেগে দিয়েছেন এবং, অফ অল্ প্লেসেজ, ব্লার্বে!! কী? না, উনি শেষজীবনে সনাতনধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন, মোহনানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছে সন্ন্যাসে দীক্ষা নেন (১৯৬০) রীতিমতো বিরজা হোম করেঃ নাম নিলেন ‘আশাপুরী’ (দেশ পত্রিকায় সেই সময় সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও ছাপেন) তার দীর্ঘদিন আগেই লেখিকা সাহিত্যক্ষেত্র থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন। এবং, তাঁর এই সময়ের নানা রচনায় যৌবনের তেজ থেকে সরে এসে অনেক ঠান্ডা ঠান্ডা কথা লিখতে শুরু করেন। তাই তিনি ‘ভণ্ড’! বেশ, এই না হলে male chauvinism? ব্লার্ব লেখক পুরুষমানুষ, সন্দেহ নেইঃ সেই যেন আশালতার বিখ্যাত ‘রান্নাঘর’ গল্পের পতিদেবতা রমেশ, যে স্ত্রীর দৈনিক-কাগজে বিশ্বযুদ্ধের খবর পড়ায় ঘোর কুপিত, অন্যমনস্কে পটলের দোল্‌মার তার যথাযথ না-খোলার আশঙ্কায়। তপোব্রতবাবুও তাঁর দীর্ঘ ভূমিকাটিতে আশালতার এই ‘দ্বিচারিতা’-র তুলোধোনা করেছেন, যেটি অধ্যাপকের নৈর্ব্যক্তিকতা ছাপিয়ে পুরুষী-চশমা পরার কারণে বেশি হয়তো (এটিই, উদা. তসলিমা লিখলে অন্য স্বাদ আসতো)। আমাদের তো, সব ছাপিয়ে, আশালতাকে এক দুঃখী অভিমানী ভালোবাসার-কাঙাল বলে মনে হয়েছে, জীবনের কাছে আশার লতাটি যাঁর লতিয়েই গেছে লতিয়েই গেছে, মহীরুহ হয়ে উঠতে পারেনি কখনোই।

    শেষ বিচারে, আশালতাকেই বাঙলার প্রথম জুতসই নারীবাদী লেখিকা বলতে ইচ্ছে করছে তাই।



    || "তোমার কথা হেথা কেহ তো বলেনা... " ||

    MUSLIMS AGAINST PARTITION: Revisiting the legacy of Allah Bakhsh & other patriotic Muslims; Shamsul Islam; Publisher: Pharos Media & Publishing Pvt Ltd, New Delhi-25; First edition 2015; ISBN: 978-81-7221-067-0

    ঊনিশশ’ সাতচল্লিশে ভারতবর্ষ যদি বিভাজিত না হতো?

    কেন করো গো এমন মন-কেমন-করা প্রশ্ন? কে জানে এর উত্তর? কেন, সর্বজ্ঞ গুগুল? গুগল করে দেখো না এ’ প্রশ্নের। কত কত উত্তর আসে। ক্রিকেট-হকিতে যে আজকের বিশ্বশ্রেষ্ঠ দল হতো সেই অবিভক্ত ভারত সন্দেহ নাই তাতে। সমগ্র কাশ্মীর থেকে সুন্দরী কক্স’বাজারের বেলাভূমি, নানকান সাহিব থেকে শ্রীহট্টের শাহ্‌ জালাল মজহর ‘আমাদের’-ই তো হতো তাহলে, যেমন একই সঙ্গে লতা-নূরজহাঁ বা অন্নদা-ফৈয়জ আহমদ ‘আমাদের’ হতেন !

    কিন্তু, বাস্তবে দেশবিভাগ তো হয়েছে, হয়ে গেছে, হয়ে আছে। বেশিদিন পরে নয়, ১৯৫৮তেই মুসলিম লিগের দুই পুরোধাঃ চৌধরী খালিকুজ্জমান ও সুরাবর্দি-সাহেব পত্রালাপ করেছেন ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’-এর অসারতা নিয়ে, হতাশায়। জিন্নাহ্‌ তো পাকিস্তান ‘জিতে’ নিয়ে ১৯৪৭এ-ই ফেলে দেন এ তত্ত্ব। সাধে গান্ধীজি বলেছিলেন, Jinnah is fighting a case, not a cause? কিন্তু আজকের প্রজন্মের কাছে, যাঁরা স্বাধীন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে জন্মেছেন? তাঁদের কাছে তো অবিভক্ত ভারতবর্ষ অলীক বস্তু---দ্বিজাতিতত্ত্বই বাস্তব।

    কিন্তু এই দ্বিজাতিতত্ত্ব এলো কোত্থেকে, কী করে?

    ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামে তো নানাসাহেবের পাশে তাঁর মন্ত্রী আজিমুল্লাহ্‌ খাঁন কাঁধে-কাঁধে লড়েছেন, লক্ষ্মীবাঈ-টাঁটিয়া টোপের পাশাপাশি মৌলভি আহমদ শাহ্‌ ফৈজাবাদীও তো সমান সম্মানীয় ছিলেন, আছেন! তবে?

    ***

    সাতচল্লিশের দেশভাগ হয়েছিল লিগের গোয়ার্তুমিতে, যদিও কংগ্রেস সহ সমগ্র অ-মুসলিমগণ অখণ্ড ভারতই চেয়েছিল ... এ’হেন একটা ভ্রান্ত ধারণা গেড়ে আছে বটে। কিন্তু এ’হেন তত্ত্বের সবচে’ বড় ফাঁকটা হচ্ছেঃ উত্তরভারতের বিত্তশালী ভূম্যধিকারিদের সংগঠন মুসলিম লিগ কী করে সমগ্র ভারতীয় মুসলমানের প্রতিনিধি হয়ে পড়লো? উদা. এক মহীশুরী মুসলিমের কাছে দেশভাগ কেন কোনো গুরুত্ব পাবে আদৌ? (হয়তো তাঁর দাদা-পরদাদা টিপুর বাহিনীতে লড়েছিলেন এককালে, ইংরেজের বিরুদ্ধে!)। গান্ধীর দু’আনার সদস্যপদে কিছুটা সার্বিক রূপ দিলেও কংগ্রেসও তো আদতে উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণ হিন্দুদেরই দল ছিল। মুসলিম লিগের বাইরেও হাজারো মুসলিম মানুষ ও সংগঠন ছিল/ছিলেন যাঁরা তথাকথিত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’-র ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এঁদের মধ্যে কংগ্রেসের মুসলিম নেতাগণঃ মৌলানা আজাদ, রফি আহ্‌মেদ কিদোয়াই যেমন বিখ্যাত ছিলেন, যেমন বিখ্যাত ছিল সীমান্ত গান্ধীর পাখতুন বাহিনী ‘খুদা-ই-খিদমতগার’, ততটা খ্যাতি-স্বীকৃতি কিন্তু পায়নি পঞ্জাবের ‘মজলিশ-ই-আহ্‌রার-এ-ইসলাম’ বা, নিম্নবর্গীয় সংগঠন ‘মোমিন কনফারেন্স’ বা ব্যক্তি হিসেবে ডাঃ মুখতার আহ্‌মাদ আনসারি বা ‘দৈনিক বম্বে ক্রনিকলে’র সম্পাদক আবদুল্লা বরেলভী সাহেব । এমনকি গোঁড়া দেওবন্দ-স্কুলের প্রধান মৌলানা হুসেন আহ্‌মাদ মাদানি (পদ্মভূষণ, ১৯৫৪) সাহেবও এ’তত্ত্বের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং এ’নিয়ে পাকিস্তানের মন্ত্রগুরু স্যর মুহাম্মদ ইকবালের সঙ্গে তাঁর কঠোর পত্রাচার হয়। হ্যাঁ, ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিও কখনই দেশভাগের পক্ষে ছিল নাঃ কাকাবাবু, আবদুল হালিম, বা তাঁদের ছায়ায় ‘প্রগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্ট’-এর লেখকগণঃ সাআদাত হাসান মান্টো বা ঈসমত চুঘতাই কখনই দেশভাগকে সমর্থন করেননি, বরং ভারতভাগে প্রাণ কেঁদেছে এঁদের। আধুনিক ভারতেতিহাসের এ’ হলো এক ধোঁয়াশামাখা পর্ব, যার প্রথম উদ্ঘাটন শুরু করেন প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক মুশিরুল হাসান সাহেব (‘জামিয়া মিলিয়া’র প্রাক্তন উপাচার্য)। বর্তমান পুস্তকটিও সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে চলা তাঁর এক ভাবশিষ্যের ব্যাপক গবেষণার ফসল, শ’দুয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে চমৎকারভাবে উপস্থাপিত। মাথায় করে রাখার মত বই এ’খানি, ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রাখার মত তো বটেই।

    ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে লাল-বাল-পাল তিন স্তম্ভ। টিলকজী জাতীয়তাবাদের জোয়ার আনতে মহারাষ্ট্রে ‘গণপতি-উৎসব’ ও ‘শিবাজী উৎসব’ শুরু করে দিলেন ১৮৯৪-এ। তারও তিন দশক আগে গোঁড়া জাত্যাভিমানী রাজনারায়ণ বসুর শিষ্য নবগোপাল মিত্তির মশাই ‘হিন্দু মেলা’ শুরু করেছিলেন এই বাংলায়। এ’সবই ‘জাতি’-কে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস। বেশ। কিন্তু, কোন্‌ জাতি? ভারতের চল্লিশ শতাংশ মানুষকে বাইরে রেখে জাতীয় জাগরণ? এক ভারতীয় মুসলিম কোন্‌ যুক্তিতে ‘গণপতি-উৎসব’-কে নিজের উৎসব বলে মনে করবেন, শুনি? ‘পঞ্জাবকেশরী’ লালাজী তো আরও এক কদম এগিয়ে সেই ১৯২৪-এই লাহৌরের ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় দীর্ঘ আর্টিকেল লিখলেন বাংলা-পঃপঞ্জাব-সিন্ধ্‌ ও উঃপঃসীমান্ত নিয়ে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক অঞ্চল গড়ে তাদের সেখানে সরিয়ে দেবার প্রস্তাব করে! ভাবা যায়? ১৯৩৯-এ’ উপস্থাপিত জিন্নাহ্‌-সাহেবের দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের এই ছিল সম্ভবতঃ আদিতম সূত্র। তবুও এনাদের জাতীয়তাবাদী নেতা বলি আমরা!

    ভারতবিভাগের শিকড়টা কত গভীরে ছিল বোঝা কঠিন নয়ঃ উদা. আজও পঃবঙ্গের এক বাঙালি স্কুলছাত্র মারাঠিগুরু রামদাস বা শিখগুরুদের যত কবিতা পাঠ্যে পায়, কৈ বাবা ফরিদ বা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জীবনোপর আধারিত কোনো কবিতা তো পড়তে পায় না সে? শ্রীরূপ গোস্বামীর চাইতে খ্বাজা মৌনুদ্দিন সাহেব কি কম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন? ছেলেবেলায় রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়’ পড়তুম। ও মা, পরে জানতে পাই, ১৮৫৮-এ লিখিত তাঁর এই কাব্যের টার্গেট বৃটিশরাজ নয়, মুসলমান শাসক! কাব্যের নাম ‘পদ্মিনী-উপাখ্যান’। বোঝো!!

    এ’সব বিতর্কিত ও অপ্রিয় প্রসঙ্গ ছেড়ে বর্তমান বইটির কথায় আসি। চমৎকার ছিমছাম ও দ্যোতনাময় প্রচ্ছদটি দেখে প্রথমেই আকৃষ্ট। পড়তে থাকি পাতা খুলেঃ ... না, তিরিশের দশকের সেই লিগের ‘রমরমা’-র যুগে সকল মুসলিম মানুষই জিন্নাহ্‌র তত্ত্বের সামনে মাথা নোয়াননি। সিন্ধুপ্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আল্লাহ্‌ বক্স সুমরো (১৯০০-১৯৪৩) ছিলেন এমনই এক জব্বর বিরোধী, যাঁর ‘ইত্তেহাদ পার্টি’-কে সমঝে চলতো মুসলিম লিগও। সেই বিশের দশক থেকে খদ্দর পরতেন সিন্ধুর এই জমিদারপুত্র, জমিজমা সব দান করে দিয়েছিলেন; চার্চিলের অবজ্ঞা-মন্তব্যের জেরে ত্যাগ করেছিলেন ইংরেজের দেওয়া ‘স্যর’ এবং ‘খানবাহাদুর’ উপাধিও। সারা ভারত ঘুরে ঘুরে দেশভাগ বিরোধি মুসলিম শক্তিকে সংঘবদ্ধ করে গেছেন, যাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ‘আজাদ মুসলিম কনফারেন্স’-এর আয়োজন (এপ্রিল ২৭-৩০, ১৯৪০), লাহৌরে লিগের ‘পাকিস্তান-প্রস্তাব’ পাশের একমাসের মধ্যে যা আয়োজিত হয় দিল্লিতে। মালাবার-বালুচ-ওড়িশা-আসাম ... শুধু যে সমগ্র ভারতবর্ষের কোণা কোণা থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন তা নয়, এসেছিলেন প্রতিবেশী সিলোন-বর্মা থেকেও, বৃটিশ মুসলিম ডেলিগেশনও ছিল। কম করেও এক হাজার মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন উপস্থিত। অধিকাংশ খাদি ও গান্ধীটুপি শোভিত পাঁচ হাজার ডেলিগেট ও ত্রিশ হাজার মুসলমান ভারতীয়ের সে ছিল এক দর্শনীয় জমায়েত। বাঙলা থেকে হুমায়ুন কবীর সাহেব, ডাঃ আর. আহমেদ (কিংবদন্তি দন্ত-চিকিৎসক) প্রমুখ ভাষণ দেন। শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কংগ্রেস নেতা আসফ আলি।

    সারাভারতের কাগজে কাগজে তার খবর ছিল, দিল্লির হিন্দুস্তান টাইমস থেকে কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকা। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়া’ কাগজে মানবেন্দ্রনাথ রায় ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এ’ কনফারেন্স ভাঙতে আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হয় মুসলিম লিগ। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌ বক্সকে দাবিয়ে রাখা অসম্ভব জেনে তাঁকে এসাসিনেট করা হল (১৪ই মে ১৯৪৩)। তাঁর শিকারপুরের বাড়ির সামনেই গুলি করে পেশাদার খুনি। তালেগোলে খুনি অধরা থেকে গেছে আজও। বস্তুতঃ, আল্লাহ্‌ বক্স সুমরো-সাহেবই হলেন আলোচ্য বইটির নায়ক। নাহ্‌, তাঁকে মনে রাখেনি তাঁর প্রিয় দেশ, ভুলে গেছে। তাঁর কথা আজ আর কেহই বলেনা... মিছে কোলাহলেই...।

    ***

    অসাধারণ মুন্সিয়ানায় এই বিস্মৃত দেশভক্তের কাহানি শুনিয়েছেন লেখক শামসুল ইসলাম সাহেব (জ. ১৯৪৮)। বস্তুতঃ, এটি কোনো সাধারণ বই নয়, যেন এক গোটা অভিধান! যেমন, অষ্টম অধ্যায়ে এমন চৌদ্দটি মুসলিম সংগঠন ও ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন যাঁদের দেশভাগ-বিরোধিতা ছিল উদাহরণযোগ্য! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে তন্তুবায়-শিল্প (পড়ুন, খাদি), পাকিস্তান প্রস্তাব থেকে সকল প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার... এমন এমন সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে ‘প্রস্তাব’ নেওয়া হয় কনফারেন্স-এ, রয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ দলিলও। সুদীর্ঘ এক পুস্তক-নির্ঘণ্ট ইংরিজি-উর্দু-হিন্দির, এবং ঐ তিন ভাষার সাতান্নটি দৈনিক ও পত্র-পত্রিকার রেফারেন্স। সত্যিই, খেটে কাজ করেছেন শামসুল ইসলাম সাহেব ও তা ভাগ করে নিয়েছেন পাঠকদের সঙ্গে। শ্রেষ্ঠ অধ্যায় অবশ্যই নবমটি, যেখানে শমিম করহানি-সঘর নিজামি-জাফর আলি খানের মত সেসময়ের প্রতিনিধিস্থানীয় উর্দু কবিগণের কাব্যে ঢুঁড়েছেন দেশভাগের বেদনা, ছুঁইয়ে দিয়েছেন পাঠকের হৃদয়ে।

    কিন্তু এতো করেও শেষরক্ষা হলো না কেন? কেন আটকানো গেলো না ভারতবিভাগ এতো প্রয়াস সত্ত্বেও? কেন? শেষ দশম অধ্যায়টিতে তারই অশ্রুভরা বিচার। লিগের বাহুবল, অর্থবল ও বিভীষিকাসৃষ্টি, জঙ্গী হিন্দুত্ববাদিতার বাড়বাড়ন্ত, কংগ্রেসের দোলাচল (ও ক্ষমতালোভ) এবং আল্লাহ্‌ বক্স সুমরো-সাহেবের নিধন... শেষাবধি ডেকে আনলো অশ্রুভরা দেশবিভাগ।

    চমৎকার এক মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন অধ্যাপক হরবন্স মুখিয়া (জে এন ইয়ু)। এক ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে কত স্কোর হয় বইটির? দশে নয় ... আট ... নাঃ, সাত। কারণ চমৎকার তাত্ত্বিক উপস্থাপনা সত্ত্বেও পূর্বগৃহীত-সিদ্ধান্তে (a priori decision) নৈর্ব্যক্তিকতা ভেসে গেছে, যেটা historian-সুলভ নয়। নৈলে, সারা বইটিতে সমনামী আল্লাহ্‌ বক্স গাবোল (১৮৯৫-১৯৭২)-এর নামোল্লেখমাত্র নেই কেন? দু’জনেই ‘খানবাহাদুর’ উপাধিধারী, দু’জনেই একই সিন্ধুপ্রদেশের রাজনীতিবিদ ছিলেন, কাজও প্রায় একই সময় নাগাদ করে গেছেন। কিন্তু, সুমরো-সাহেব যতটাই পাকিস্তান-বিরোধি ছিলেন গাবোল-সাহেব ছিলেন ততটাই অনুগামী। তাই? আবার দেখুন, দেওবন্দ-স্কুলের মাদানি-সাহেবের ইকবাল-বিরোধিতার কথা যত সাতকাহন করে বলা হয়েছে, সেই স্কুলের ঘোষিত দেশভাগ-বিরোধিতার নীতির কথা অনুল্লেখিত রইলো কেন? দেওবন্দ মনে করতো, দেশভাগ না করেও সমগ্র ভারতকেই ক্রমে পূর্ণ ইসলামী করে ফেলা যাবে, তাই কেন খণ্ডের দিকে যাবো? ১৮৫৭ প্রসঙ্গে (চতুর্থ অধ্যায়) মন্ত্রগুরু আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদী-সাহেবের অনুল্লেখে দুখী হয়েছি।

    নেহ্‌রুর সুহৃদ, জাতীয়তাবাদী কবি শমিম করহানি সাহেবের চোখে-জল-আনা দু’টো পঙ্‌ক্তি দিয়ে লেখক বইটি শুরু করেছিলেন, সেটা শুনিয়েই এবার থামবোঃ

    “হমকো বাতলাও তো ক্যা মতলব হ্যায় পাকিস্তানকা?
    জিস জগহ্‌ ইস বক্ত মুসলিম হ্যায় নাজিস হ্যায় ক্যা ওহ্‌ জা?”

    [আমাকে বলো তো পাকিস্তানের অর্থ কী? এই যে-স্থানে আজ আমরা মুসলমানরা আছি, তা কি অপবিত্র?]

    “নেশ-এ-তোহ্‌মত সে তেরে, চিস্তি কা সীনা চাক্ হ্যায়।
    জল্‌দ্‌ বাৎলা ক্যা জমীন আজমীঢ় কী না-পাক হ্যায়?”

    [তোর আঘাত চিশ্‌তির বক্ষ বিদীর্ণ করেছে। জল্‌দি বল্‌, কি আজমীঢ় শরীফের জমিও অপবিত্র?]
    ১৯৩৩-র কেম্ব্রিজের এক অকিঞ্চিৎকর ছাত্র রহমত আলি প্রথম যখন দেশভাগের কথা বললেন সকলে অবাস্তব জ্ঞানে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ দেশমিলের কথা বললেও সেটাই হবে। জানিনা সে-বুড়ো ওপরে বসে মুচকি হাসছে কিনা।

    আর এই ইনি কিন্তু এক্ষুণি করাচির মাটিতে পাশ ফিরে শুলেন।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments