• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • জলের যুদ্ধ : চম্পক সৌরভ


    ভুলুয়ার মনে অনেকদিন ধরেই রাগ জমা হচ্ছিল। বছরের পর বছর ধরে, সত্যি কথা বলতে কী, প্রায় আবহমান কাল ধরে বঞ্চনার, অপমানের শিকার হয়ে আসছে তারা — রাগ তো হওয়ারই কথা। শুধু ওদের এই সুন্দরগড় গ্রামেই নয়, এমনকী শুধু মধ্যপ্রদেশেই নয়, সারা ভারতবর্ষ জুড়েই সেই কোন আদ্যিকাল থেকে চলে আসছে এই অত্যাচার। উচ্চবর্ণের মানুষেরা দলিতদের মানুষ তো দূরের কথা, জানোয়ারেরও অধম মনে করে।

    ভুলুয়াদের গ্রামে একটাই মাত্র পানীয় জলের ইঁদারা, আর সেটা স্বাভাবিকভাবেই সমাজের মাথাদের দখলে। দলিতদের পানীয় জলের দরকার হলে (সেটা তো রোজই হয়), ওই ইঁদারার কাছে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। বাবু-বিবিদের মর্জি হলে তারা ওদের কলসিতে জল ঢেলে দেয় — তবেই তেষ্টা মেটে। বাবুদের ইচ্ছেটা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। এই হপ্তায় তো মাত্র এক দিন এক কলসি জল জুটেছে ভুলুয়াদের। ওর স্ত্রী ললিতা গত তিনদিন ধরে ফিরে আসছে খালি হাতে। আজ তো চরম অপমানিত হতে হয়েছে। বাবুরা বলেছে, 'তোদের যদি এতই জলতেষ্টা, তাহলে নিজেদের কুয়োর ব্যবস্থা করে নে না। আমাদের জল নোংরা অপবিত্র করতে আর দেবো না তোদের।'

    ললিতার চোখে জল, নিজের জল তেষ্টা, সবটা মিলে ভুলুয়ার মনে একটা অদ্ভুত জেদের জন্ম হলো; ললিতাকে বলল, 'ঠিক আছে, নিজেদের কুয়ো নিজেরাই খুঁড়ে নেব।'

    ওর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে ললিতা কিছু বলতেই পারল না; যদিও জানে, এ এক অসম্ভব প্রতিজ্ঞা।

    পরদিন ভোর হতেই ভুলুয়া বেরিয়ে পড়ল কোদাল আর গাঁইতি নিয়ে, ললিতাও চলল ওর পিছু পিছু। একটা জায়গা বেছে নিয়ে ভুলুয়া কোদাল চালাতে শুরু করল। ললিতা মাটি সরাবার কাজে হাত লাগাল। ভর দুপুর পর্যন্ত এইই চলল। ললিতা বাড়ি গিয়ে ক-টা রুটি বানিয়ে নিয়ে এলো, সঙ্গে পেঁয়াজ আর লঙ্কা। খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হলো মাটি খোঁড়া। সকালে কাজে যাবার সময় অনেকে উঁকি মেরে গিয়েছে; ফেরার সময় তাদেরই কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়ল, 'কী করছিস রে ভুলুয়া?'

    — 'কুয়ো খুঁড়ছি।'

    — 'কেন রে?'

    — 'নিজেদের কুয়ো থাকলে আর বাবুদের পায়ে ধরতে হবে না জলের জন্য।'

    শুনে সকলে অবাক তো হলই, চলে যাবার সময় ভুলুয়াকে পাগল বলতেও ছাড়ল না।

    ভুলুয়া কিন্তু একটুও দমলো না — ওর মাটি খোঁড়া থামল না। এভাবে দু-দিন গেল, তিন দিন গেল, চার দিন গেল — গর্ত বেশ গভীর হয়েছে এখন। কাজ থেকে ফেরা দলিত মানুষদের চোখে মুখে এখন তাচ্ছিল্যের বদলে বিস্ময়। পরদিনই দু-জন এসে হাত লাগাল ভুলুয়ার সঙ্গে। কাজের গতিও বাড়ল। পরদিন আরও দু-চারজন কাজে যাওয়ার পথে আর ফেরার পথে সাহায্য করল। সেদিনই ভেজা মাটির দেখা মিলল। সাত দিনের মাথায় ওদের আনন্দ আর বাঁধ মানল না — জলের দেখা মিলেছে। অল্প অল্প করে জল বেরিয়ে কুয়ো ভরে উঠছে।

    পরদিন ওদের গ্রামে তো বটেই, চারপাশের গ্রামেও এই অদ্ভুত খবর ছড়িয়ে পড়ল — দলিতরা নিজেদের জন্য পানীয় জলের কুয়ো খুঁড়েছে। এ খবর সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। সাংবাদিকেরা এসে ভুলুয়ার ইন্টারভিউ নিয়ে গেল, সেটা ছাপাও হলো। খবরের কাগজটা ভুলুয়াকে দিতে, তাতে নিজের ছবি দেখে খুশিতে ওর মুখ চকচক করে উঠল — ও কোনোদিন ভাবতেও পারেনি ওর ছবি কাগজে বেরোবে। কিন্তু কী লেখা হয়েছে জানতেই পারল না ভুলুয়া — ও যে ওর অন্যান্য সাথীদের মতোই নিরক্ষর। এবার ভুলুয়া আর একটা প্রতিজ্ঞা করল। লেখাপড়া শিখবে। জলের যুদ্ধে জিতেছে ও — লেখাপড়ার যুদ্ধেও ঠিক জিতবেই জিতবে, অন্যদেরও সামিল করবে এই যুদ্ধে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)