• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • নিমাইচাঁদ : সৌগত বসু


    বিবার মাত্রই ছুটির দিন, আনন্দের দিন, একটু আয়েস করে কাটাবার দিন। কিন্তু ধীমানের জীবনে রবিবার মানেই ধোলাই। না না, ধীমানকে ধরে কেউ ধোলাই দেয় না, বরং ধীমানকেই ধোলাই দিতে হয় — যত রাজ্যের জামাকাপড়। একটু টিভি দেখা, একটু গল্পের বই পড়া, একটু গান শোনা, একটু খেলাধুলো করা — কোনকিছুরই ফুরসত তার হয়ে ওঠে না সেদিন।

    না, ধীমান ধোপা নয়। ধীমানের চোদ্দপুরুষেও কেউ ধোপা ছিলেন না। ধোপা হওয়ার মত অ্যাম্বিশানও ধীমানের কোনকালে ছিল বলে মনে হয় না। বরং ধোপাদের ও কোনকালেই সহ্য করতে পারত না। সমগ্র ধোপাকুলের ওপর ধীমানের এই রাগের কারণ শুধুমাত্র একজন ধোপা। ধীমান তার এই সামান্য কয়েকবছরের জীবনে শুধুমাত্র ওই একজন ধোপাকেই চাক্ষুষ দেখেছে। কিন্তু ওই একজনই যেভাবে তার জীবনটাকে ধুয়ে নিংড়ে শুকনো খট্‌খটে করে তুলেছে তাতে ধীমানের পক্ষে ধোপাদের ভালমানুষ ভাবা খুবই চাপের।

    ধীমানের বয়স চোদ্দ। ক্লাস নাইনের ছাত্র। দক্ষিণ কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। বাড়ির লোক বলতে ওর বাবা, মা, কাকা, কাকিমা, খুড়তুতো বোন আর এক জাঁদরেল জ্যেঠামশাই। জ্যেঠামশাই মারাত্মক কড়া মেজাজের মানুষ। উনি বিয়ে করেননি, অল্পবয়সে ধীমানের ঠাকুরদা আর ঠাকুমা মারা যাওয়াতে ধীমানের বাবা কাকা ওই জ্যেঠামশাইয়ের হাতেই মানুষ। ওনার ভয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ। ওনার অনুমতি ছাড়া বাড়িতে মশাও বোধহয় কাউকে কামড়াতে সাহস পায় না, এমনই প্রতাপ ওনার। বাড়ির সবাই জ্যেঠামশাইকে যেমন শ্রদ্ধা করেন, তেমনি ভয়ও পান।

    যাদের কথা বললাম, এরা সবাই হচ্ছে এই গল্পের পার্শ্বচরিত্র। এবার মুখ্যচরিত্রের কথায় আসা যাক। ধীমানদের বাড়ির কুলধোপা — নিমাইচাঁদ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। কুলধোপা। কুলপুরোহিত, কুলবধূ, কুলদেবতা যদি হতে পারে, তাহলে কুলধোপা হবে নাই বা কেন? ধীমান যবে থেকে এই পৃথিবীর আলো দেখতে শিখেছে সেই তবে থেকেই নিমাইচাঁদকে দেখে আসছে। নিমাইচাঁদের বয়স এখন পঁচাত্তর। শোনা যায় এই নিমাইচাঁদের বাবা নাকি ধীমানের ঠাকুরদাকে প্রথম জীবনে কলকাতায় ব্যবসা শুরু করার জন্য কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই তখন থেকেই নাকি এই দুই পরিবারের মধ্যে বেশ একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছে। সেই কবে যে নিমাইচাঁদের এই বাড়িতে প্রথম পদার্পণ তা ধীমানের জ্যেঠামশাইও সঠিক বলতে পারেন না। আলকাতরার মত গায়ের রং, মাথাজোড়া একটা চক্‌চকে টাক, দাড়িগোঁফ কামানো। ধবধবে সাদা ফতুয়া আর খাটো করে পরা সাদা ধুতি। ধোপার ধোপদুরস্ত সাজপোশাক চোখে পড়বার মতন। নিমাইচাঁদের বাড়ি নৈহাটি। প্রতি রবিবার সে ধীমানদের বাড়িতে হাজির হয় এক বিরাট পোঁটলা কাঁধে করে। তাতে রাজ্যের কাচা কিম্বা ইস্তিরি করা জামাকাপড়। যার যার জামাকাপড় তাদের ফিরিয়ে দিয়ে আবার সেই পোঁটলা ভরে জামাকাপড় কাচতে কিংবা ইস্তিরি করতে ফেরত নিয়ে যায় সে আবার নৈহাটি।

    ব্যাপারটা ধীমানের বরাবরই আশ্চর্য ঠেকে। কলকাতা শহরে কি আর ধোপা নেই? এখান থেকে নৈহাটিতে জামাকাপড় কাচতে পাঠানোর কী দরকার? কিন্তু জ্যেঠামশাইয়ের নির্দেশ, তাই বড়দেরই কিছু বলবার জো নেই, ধীমানের তো এখনো ভোট দেওয়ারই বয়স হয়নি। তার ওপর আবার লোকটা কাচার জন্য পয়সাও নেয় না। সেই কোনকালে জ্যেঠামশাই নাকি নিমাইচাঁদকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে রেখেছেন। সেই টাকা থেকেই নাকি এখনও অ্যাডজাস্ট হয়ে চলেছে। জ্যেঠামশাই নাকি ওই হিসেব রাখেন। কিন্তু এই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে ধোপার খাতা নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে জ্যেঠামশাই যে কী হিসেব রাখেন তা নিয়ে ধীমানের বাবা আর কাকার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। নিমাইচাঁদ কিন্তু নিশ্চিন্ত। ও শুধু মনের সুখে কাপড় কেচেই খালাশ। ও জানে যে তার এই কাচা কাজের পাকা হিসেব রাখছেন জ্যেঠামশাই। নিমাইচাঁদ কাপড় কাচতে আগে নিত দেড় টাকা আর ইস্তিরি করতে নিত এক টাকা। জ্যেঠামশাইয়ের ধমকে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে তিনটাকা আর দু-টাকা। কিন্তু এই রেটে যে কতদিন কাপড় কাচলে সেই টাকা শোধ হবে তা কেউ জানে না।

    নিমাইচাঁদ প্রতি রবিবার ধীমানদের বাড়িতে আসে। জ্যেঠামশাই ছাড়া বাড়ির আর কাউকে সে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। হৈহৈ করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে, তারপর হাতের কাছে জামা, প্যান্ট, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, পায়জামা, গেঞ্জি, সাড়ি, ব্লাউজ, শায়া থেকে ঘর মোছার ন্যাতা পর্যন্ত — যা ঝুলতে দেখবে তাই নিমাইচাঁদ নিজের ঝোলার মধ্যে পুরে নেবে। আর তাকে নিয়ে বাড়ির লোকজনের কী বাড়াবাড়ি! সারা বাড়ি যেন নিমাইচাঁদের জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত! আবার জামাকাপড় একটু বেশি নোংরা হলে বাড়ির লোকজনকে ধমক-ধামক দিতেও ছাড়ে না সে। তার ওপর নিমাইচাঁদের জন্য বাড়িতে কী ভালোমন্দ রান্নার ব্যবস্থা! ভালো মাছ, মুড়ো দিয়ে কচুর শাক, সোনামুগ ডাল!

    জ্যেঠামশাইয়ের কড়া হুকুম — নিমাইচাঁদকে যেন পরিবারের একজনের মতন খাতির করা হয়। এই সব দেখে দেখে ধীমানের মাথা গরম হয়ে যায়। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে শুরু হবে ধীমানকে ধরে নিমাইচাঁদের অমৃতবাণী। ভালো করে পড়াশোনা না করলে তাকে নিমাইচাঁদের মতন ধোপা হতে হবে, চাকরি করে জ্যেঠামশাইয়ের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিমাইচাঁদের এতো মাতব্বরি ধীমানের অসহ্য লাগে।

    নিমাইচাঁদের আরেকটা মজার ব্যাপার আছে। ওর কাছে যে জামা কাচতে যায়, সেই জামা যে কবে ফেরত পাওয়া যাবে তা কেউ জানে না। তুমি দিলে হয়ত একটা জিন্স প্যান্ট, ফিরে পেলে হয়ত একটা কটন প্যান্ট। কার প্যান্ট সেটা, আর তোমার প্যান্টই বা কার কাছে গেলো, সে খবর নিমাইচাঁদ ছাড়ো, স্বয়ং নদের চাঁদ নিমাইও বোধহয় জানেন না। প্রতিবারই নিমাইচাঁদ কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, আপাতত এই প্যান্টটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিন, খুঁজেপেতে পরে আসল প্যান্টটা ঠিক এনে দেবো। তা সে সত্যিই এনে দেয়, সপ্তাহ দুই-তিনেক বাদে। এতো ভুলোমন সত্ত্বেও জ্যেঠামশাই একে ছাড়বে না। তার ওপর কেচে আসা জামাকাপড় পরতে গেলেই শুরু হবে গা-সুড়সুড় করা। জামাকাপড় ঝাড়লে দেখা যাবে তার ভিতরে কচিকচি ঘাস। কোথায় কোন মাঠে জামাকাপড় কেচে শুকোতে দিয়েছিল, সেই কাঁচা কাজের ফল এই কচি ঘাস।

    এইবার ধীমানের রাগের কারণটা ফাঁস করা যাক। বয়সের নিজস্ব নিয়মে ধীমান একটু আধটু নেশাভাং ধরেছে। তাও বিড়ি-সিগারেট নয়, এই একটু আধটু পান মশলা, গুটকা ইত্যাদি। তা নিমাইচাঁদ যদি ধীমানের প্যান্টের পকেটে একটা পান মশলার প্যাকেট দেখতেই পেয়ে থাকে, তাহলে সেটা চেপে গেলেই কি হত না? ভালমানুষ সেজে জ্যেঠামশাইকে না জানালেই কি হচ্ছিল না? জ্যেঠামশাইয়ের লাঠির ঘা এখনো ধীমানের পিঠে কালসিটে হয়ে লেগে আছে। মার খেতে ধীমান ভয় পায় না, ছোটবেলা থেকে তো জ্যেঠামশাইয়ের হাতে কত মারই খেয়েছে। কিন্তু এবারের মারটা যত বেশি না পিঠে লেগেছে, তত বেশি লেগেছে ধীমানের আত্মসম্মানে। একটা সামান্য ধোপার এত বাড়বাড়ন্ত! ধীমানকে এর শোধ তুলতেই হবে।

    সুযোগও এসে গেল কয়েকদিনের মধ্যে। ধীমান একটা গিফ্‌ট কুপন পেয়েছে যার মাধ্যমে ও একটা ফুললি অটোম্যাটিক ওয়াশিং মেশিন পেতে পারে। ধীমান চুপিচুপি কথাটা তার কাকিমাকে জানায়। তার কাকিমার বহুদিনের শখ বাড়িতে একটা ওয়াশিং মেশিন কেনার, কিন্তু জ্যেঠামশাইয়ের ভয়ে সাহস করে কাউকে বলতে পারেন না। এখন হাতের সামনে এমন সুযোগ পেয়ে কাকিমা ধীমানের কাকাকে তাঁদের দলে টেনে ওয়াশিং মেশিনটা নিয়েই আসেন বাড়িতে।

    ওয়াশিং মেশিন দেখে বাড়ির সবাই খুব খুশি। সবাই জানল ধীমান এই গিফ্‌ট কুপনটা পেয়েছে স্কুলের একটা কুইজ কম্পিটিশনে জিতে। শুধু জ্যেঠামশাই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছেন। কারোর সাথেই ঠিক করে কথা বলেন না। ওনার বক্তব্য, নিমাইচাঁদ গরীব মানুষ। সবাই যদি ওয়াশিং মেশিনেই নিজেদের জামাকাপড় কাচতে শুরু করে তাহলে নিমাইচাঁদের পেট চলবে কী করে?

    ধীমানের কথাটা শুনে খুব রাগ হয়।

    মানুষ অভ্যাসের দাস। ক্রমশঃ বাড়ির সবাই সেই ওয়াশিং মেশিনে আসক্ত হয়ে পড়ল। প্রতি রবিবার নিমাইচাঁদ আসে, খাওয়াদাওয়া করে, কিন্তু ওর জন্য রাখা জামাকাপড়ের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। এখন শুধুমাত্র জ্যেঠামশাই তাঁর জামাকাপড় কাচতে দেন। নিমাইচাঁদের সেই ফিচেল হাসি ক্রমশঃ যেন ফিকে হয়ে আসছে বলে মনে হয় ধীমানের। এতদিনে ওর প্রতিশোধ পূর্ণ।

    পর পর দু-সপ্তাহ নিমাইচাঁদ এলো না। তৃতীয় সপ্তাহের রবিবার সে আবার হাজির। কিন্তু তার ঝোলা মডেলদের মতন “সাইজ জিরো” হতে ঝুঁকেছে বলে মনে হল ধীমানের — আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করল তার। নিমাইচাঁদ ঝোলা থেকে একটা জিন্সের প্যান্ট বার করে জ্যেঠামশাইকে বলল —
    এই দেখুন দাদাবাবু। খোকাবাবুর এই প্যান্টটা কাচতে দিয়েছিলেন, কিন্তু এটা ভুল করে রসুলপুরের আব্বাস মিয়াঁকে ফেরত দিয়ে ফেলেছিলাম। ওনার নীল রঙের লুঙ্গি দিয়েছিলেন কাচতে, তার বদলে এই নীল রঙের প্যান্ট ফেরত দিয়েছিলাম। মিয়াঁরও বয়স হয়েছে, নানান জামাকাপড়ের মধ্যে আলাদা করে এটা আর খেয়াল করেননি। তা ওনার লুঙ্গিটা কি আমি আপনাদের বাড়িতে ভুল করে দিয়ে ফেলেছি?

    ধীমানের ডাক পড়ে। ধীমান ওর শখের জিন্স প্যান্ট ফেরত পেয়ে যেন ধড়ে প্রাণ পেলো। কিন্তু লুঙ্গির ব্যাপারে বাড়ির কেউই কিছু বলতে পারল না। তখন নিমাইচাঁদ জানতে চাইল, আচ্ছা খোকাবাবু, তোমার প্যান্ট বলে আমি যেটা তোমায় দিয়েছিলাম, সেটা কী?

    ধীমান ওর ঘর থেকে একটা টেরিকটের প্যান্ট নিয়ে আসে। সেই প্যান্ট দেখে নিমাইচাঁদ চমকে ওঠে।
    — সেকি গো খোকাবাবু? এই প্যান্ট তোমার কাছে ছিল? কী যে ভুলো মন হয়েছে আমার! তিন হপ্তা ধরে এই প্যান্ট খুঁজে খুঁজে হয়রান। জানেন দাদাবাবু, এটা আমার বড়ছেলের প্যান্ট। ছেলেটা আমার মানুষ হয়েছে গো আপনাদের আশীর্বাদে। বিএ পাশ করে একটা সরকারী চাকরিও পেয়েছে আপনাদের আশীর্বাদে। আগের মাসে আমাদের নৈহাটিতে কোন একটা টিভি চ্যানেল থেকে কী যেন একটা অনুষ্ঠান হল... ও হ্যাঁ, “বৌদিগিরি”, তা সেই অনুষ্ঠানে আপনাদের আশীর্বাদে আমার বড় বৌমা প্রথম পুরস্কার পেয়েছে — সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে আপনাদের আশীর্বাদে সবচেয়ে বেশি কাপড় কেচে। পুরস্কারটা কী জানেন দাদাবাবু? একটা ওয়াশিং মেশিন। তাতে নাকি জামাকাপড় নিজের থেকেই কেচে একেবারে শুকনো খট্‌খটে হয়ে বেরিয়ে আসে। বয়স হচ্ছে তো, তাই শরীর আর দেয় না। তাই বৌমা বলল, বাবা এবার থেকে আপনি এই ওয়াশিং মেশিনে সব জামাকাপড় কাচবেন। তা সেই ওয়াশিং মেশিন কেনার কুপন নিয়ে আমার বড় ছেলের কলকাতার কোন আফিসে আসবার কথা। ছেলের আবার আমারই মতন ভুলো মন। আমায় কাচতে দিয়েছিল সেই কুপন-সমেত প্যান্ট। তারপর আমি কাকে যে এই প্যান্ট দিয়ে ফেলেছি কিছুতেই তা মনে করতে পারছিলুম না। খালি ভাবছিলুম, যদি কোনও অসাধু লোকের হাতে এই কুপন পড়ে... যাকগে খুব বেঁচে গেছি, আপনাদের আশীর্বাদে এই কুপন আপনাদের হাতেই পড়েছে।

    এই বলে নিশ্চিন্ত মনে নিমাইচাঁদ সেই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকায়। কিন্তু কোথায় সেই কুপন! ভালো করে প্যান্ট ঝেড়েও তা পাওয়া যায় না। নিমাইচাঁদ হতভম্ব হয়ে একবার জ্যেঠামশাই, একবার ধীমানের দিকে তাকায়। জ্যেঠামশাই বিচক্ষণ মানুষ, তিনি সহজেই আঁচ করতে পারেন যে সেই কুপনের অবদানই হচ্ছে ধীমানের এই কুইজ জেতা ওয়াশিং মেশিন। তিনি একবার ধীমানের দিকে তাকান, ধীমান মাথা তুলে তাকাতে সাহস পায় না। ধীমান দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে এই প্যান্ট নিমাইচাঁদের নিজের বেরোবে। জ্যেঠামশাই ধীমানের থেকে নজর ঘুরিয়ে নিয়ে নিমাইচাঁদকে বলেন—
    শোনো নিমাইচাঁদ, আমি হিসেব করে দেখেছি যে আমাদের বাড়িতে তোমার মোটামুটি দুহাজার টাকার মতন বাকি। আর ওই ওয়াশিং মেশিনটার দাম হল গিয়ে প্রায় দশ হাজার টাকা। তাহলে আমাদের থেকে তোমার প্রাপ্য থাকে আরও আট হাজার। এই টাকা শোধ করতে হবে তো আমাদের। প্রতি রবিবার তুমি যেমন আসো আসবে তোমার জামাকাপড় নিয়ে। এই জামাকাপড় তুমি আমাদের বাড়িতে কাচতে দিয়ে এখানেই সারাদিন বিশ্রাম করবে। ধীমান তোমার সমস্ত জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে কেচে, শুকিয়ে তোমায় বিকেলের মধ্যে ফেরত দিয়ে দেবে। তুমি সেসব নিয়ে একেবারে সন্ধের ট্রেনে নৈহাটি ফিরে যেও। আর হ্যাঁ, আমি নিজে হিসেব রাখব। যতদিন না পর্যন্ত আমাদের থেকে তোমার প্রাপ্য এই আট হাজার টাকা শোধ হচ্ছে, ততদিন এই ব্যবস্থা চলবে।

    সেই সেদিন থেকেই ধীমান প্রতি রবিবার পাড়া, বেপাড়ার হরেক লোকজনের কাপড়চোপড় ওয়াশিইং মেশিনে কেচে চলেছে। কবে যে আট হাজার টাকা শোধ হবে সেই নিয়ে ধীমান আর ভাবে না, জামাকাপড় কাচতে আজকাল ধীমানের ভালোই লাগে। ওদিকে নিমাইচাঁদের আপ্যায়ন বাড়িতে খুব বেড়ে গেছে। সেদিন মরশুমের প্রথম ইলিশ এলো, প্রতিবার মুড়োটা ধীমানের পাতেই পড়ে। কিন্তু এবার সেই মুড়ো নিমাইচাঁদের পাতে। নিমাইচাঁদও যেন ধীমানকে দেখিয়ে দেখিয়ে দুচোখ বুজে তাতে একটা কামড় বসাল। অটোম্যাটিক ওয়াশিং মেশিনে অটোম্যাটিক মিউজিক বাজতেই ধীমানের হুঁশ ফিরল। প্রথম খেপের জামাকাপড় শুকিয়ে গেছে, দ্বিতীয় খেপের জামাকাপড় কাচতে দিতে হবে এবার।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments