সাড়ে তিন জন লোককে টপকে, একজন প্রৌঢ়র পেটে গুঁতো মেরে লাফ দিয়ে অটোতে উঠলো বিজন। সন্ধের এই সময়টায় যাদবপুর থেকে জায়গা খালি পাওয়াই দুষ্কর। “খুচরো আছে তো? পরে কিন্তু ঝামেলা করবেন না... " গর্জে ওঠে চালকের চাঁচাছোলা সাবধানবাণী।
এদের এই রোজকার বায়নাক্কা গা-সওয়া বিজনের। তার পকেটে আজ সব বড় নোট, কিন্তু মুখে কিছু বলে না সে। প্রায়দিনের মতোই আজও ম্যানেজ হয়ে যাবে নিশ্চয় কিছু একটা। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর অটোওলার সাথে তর্ক-বিতর্কে যেতে রুচি হয় না তার। তাছাড়া সে নিতান্তই গোবেচারা ভালো মানুষ টাইপের। কারুর সাথে তর্ক তো দূরস্থান, গলা তুলে কথা বলাটাই তার পক্ষে অসম্ভব।
সুকান্ত সেতুর মুখে যানজটে আটকে অটো। এমন সময় ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর - সরু সরু হাত-পা, ঢলঢলে সাদা হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরা, তেল চপচপে চুল পাট করে আঁচড়ানো - একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে এসে দাঁড়ায় অটোর সামনে। মুহূর্তে একটা মিষ্টি মনমাতানো গন্ধে ভরে ওঠে জায়গাটা। চকচকে চোখে বিজনের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে - “তাজা গোলাপ ছিল স্যার, এখুনি এনেছি - নিন না, আপনি যা দেবেন। …”
সত্যিই তাজা ফুলগুলো। সন্ধের অন্ধকারেও ওদের অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হলো বিজন। ফুলগুলো থেকে যেন এক বলিষ্ঠ চাপা লাল দ্যূতি ঠিকরে বেরিয়ে রাতে মিশে গিয়ে অন্ধকারকে আরো মায়াবী করে তুলেছে।
“একশোর খুচরো আছে তোর কাছে?” - ফুলগুলো নিয়ে নেওয়াই মনস্থির করে বিজন। শুভ্রা কে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। তাছাড়া খুচরোর সমস্যাও মিটবে।
“খুচরো নেই তো ওঠেন কেন? বাসে গেলেই পারেন!" - পিচ করে রাস্তায় পানের পিক ফেলে কদর্য মুখভঙ্গি করে বলে ওঠে অটোচালক। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, সেই তরুণী নার্ভাস ভঙ্গিতে হ্যান্ডব্যাগ হাতড়াতে থাকে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। পাশে বসা বিজনের মেয়েটাকে দেখে বড্ড মায়া হয়। বাঘাযতীন থেকে উঠেছে, উঠেই বিজনের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলেছিল “বা: কি সুন্দর ফুলগুলো, দারুণ মিষ্টি গন্ধ।"
“আমার কাছে আছে, দাঁড়াও।" ফুলওলার কাছ থেকে পাওয়া খুচরো দিয়ে মেয়েটার ভাড়া মিটিয়ে দেয় বিজন।
“আরে ছি ছি আপনি আবার কেন।...” ব্যস্ত হয়ে ওঠে মেয়েটা।
“আরে ঠিক আছে কতই বা ভাড়া। ...”
গড়িয়ায় পৌঁছয় অটো। “ভাই আরেকটু এগিয়ে যাবে? তাহলে আমাকে একটু কম হাঁটতে হয়।"
“হবে না। … গাড়ি আর যাবে না, ভাড়াটা..." বলে হাত বাড়ায় চালক। পকেটে কিছু খুচরো এখনো রয়ে গেছে, তবু বিজন একটা ১০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়। চালক যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। বাছা বাছা শব্দে আক্রমণ করতে লাগলো বিজনকে।
কতটা বিজনের কানে গেছিল বলা যায় না। ধৈর্যের বাঁধ তারও ভেঙেছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি সে। চালক বিজনের থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে ঘুরে তাকায়, পলকেই তার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়।
জ্ঞান হারানোর আগে সে অনুভব করে একটা জমাট লাল আলোয় ভরে উঠেছে তার অটো। চাপা গোঙানি ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে।
একদল বিস্ময়-বিমূঢ় লোক ঘিরে রয়েছে সুবলের অটো। খোলা রাস্তায় কে বা কারা এমন নৃশংসভাবে ওকে খুন করতে পারে কারুরই মাথায় ঢোকে না। ত্রাস বিস্ফারিত ঠিকরে বেরিয়ে আসা সুবলের চোখ যেন চিৎকার করে কিছু বলতে চাইছে। তার শীতল মৃতদেহের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা প্রচুর লাল গোলাপের পাপড়ি - এখনো তাজা, সুগন্ধে ভরপুর।
ক’দিন ধরে আবার প্রচণ্ড গরম পড়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হন্ডা সিটির দরজা খুলতেই গরম হল্কা ঝাপটা মারে পুনমের মুখে। বিকেল চারটে, এবার একটু একটু করে অফিস ফেরত লোকেদের ভিড় বাড়বে। জন্মাষ্টমীর বাজারটা চটপট সেরে ফেলতে হবে। রিমলি আর পীয়ুষ স্কুল থেকে ফিরবে ছটায়, বেশি দেরি করলে চলবে না পুনমের । ওদের খাবার অবশ্য করাই আছে, বিজয়া খেতে দিতে পারবে। সমস্যাটা অবশ্য ওদের বাবাকে নিয়ে। বাড়ি ফিরে পুনমকে না দেখতে পেলে কুরুক্ষেত্র বাধাবে পঙ্কজ।
ফর্দ সাথেই আছে। কিষেণজির সাজপোশাক, অলংকার, পুজোর সরঞ্জাম তো আছেই, এছাড়াও পুজোর দিনে বেশ কিছু অতিথি আসবে বাড়িতে, তাদের আপ্যায়নের জন্য ধোকলা লাড্ডু ইত্যাদি খাবারদাবারও আজই কিনে নিতে হবে। প্রথমে ভগবান দাসের দোকানে যাওয়াই স্থির করলো পুনম।
“আইয়ে ম্যাডাম …. আরে এ রামখিলাওয়ান শর্বত লে আও..." পড়ন্ত বিকেলে দোকানে উপস্থিত গোটা দুই খদ্দেরকে ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে ভগবান দাস। পুনমরা বহুদিনের খদ্দের - ওর শ্বশুরবাড়ি এবং বাপের বাড়ির যেকোনো অনুষ্ঠানে বহুদিন ধরে মিঠাই সাপ্লাই করে আসছে ভগবান দাস।
হাতে বিশাল লাড্ডু-পেঁড়ার প্যাকেট নিয়ে দোকান থেকে বেরোয় পুনম। জিনিসগুলো গাড়িতে রেখে বাকি বাজারটা করবে কি? বৃন্দাবন কত দূরে গাড়ি পার্ক করেছে কে জানে! মোবাইলে ওকে ধরতে চেষ্টা করে পুনম। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। কে জানে কোথায় আছে লোকটা - হয়ত অন্য ড্রাইভারদের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে আর কোনো দিকে খেয়ালই নেই!
“দরকারের সময় না পাওয়া গেলে মাসে মাসে ওর মোবাইলের বিল ভরে কি লাভ!”-- রাগত স্বগতোক্তি পুনমের। এখন এই ভারী প্যাকেট কতক্ষণ বইতে হবে কেজানে। আরো দুবার ফোনে চেষ্টা করলো পুনম - কোনো লাভ হল না। ভিড়টা আস্তে আস্তে বাড়ছে। তার সাথে বাড়ছে রাস্তার রোল-চাউমিনের দোকানিদের ব্যস্ততাও। খুন্তির ঠুং ঠাং আওয়াজ, অসহ্য গরম, চিকেন রোল-চাউমিনের তীব্র গন্ধ - সব মিলিয়ে গা গুলিয়ে ওঠে পুনমের। বিয়ের পর জয়পুর থেকে কলকাতায় এসেছে আজ প্রায় ১৫ বছর - এখনো আমিষের গন্ধ সহ্য করতে পারে না পুনম।
পঙ্কজকে ফোন করে ড্রাইভার সম্পর্কে একরাশ বিরক্তি উগরে দেয় পুনম। মিটিং-এ আছে এই অজুহাতে তার অভিযোগকে পঙ্কজ তেমন পাত্তা না দেওয়ায় মাথাটা আরো গরম হয় পুনমের। এমন সময় ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর - সরু সরু হাত-পা, ঢল ঢলে সাদা হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরা, মাঝখানে সিঁথি করা চুল পাট করে আঁচড়ানো - একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ নিয়ে এসে দাঁড়ায় পুনমের সামনে। মুহূর্তে একটা স্নিগ্ধ মনমাতানো গন্ধে ভরে ওঠে জায়গাটা। ধোঁয়া-ধুলো দূষণের পোড়া গন্ধ, রাস্তার খাবারের তীব্র রেশ, এতগুলো মানুষের শরীরের গন্ধ সব ছাপিয়ে একটা মোহময় মিষ্টি গন্ধ আবিষ্ট করে পুনমের শরীর মন - তার সব ঘৃণা, রাগ বিরক্তি যেন কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়ে তাকে ভরিয়ে দেয় এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে।
উদগ্রীব চোখে পুনমের দিকে তাকিয়ে মিহি গলায় ছেলেটা বলে ওঠে - “একদম ফ্রেশ দিদি, অভি লায়া - লিজিয়ে না। কিমত আপকি মর্জি। …”
সত্যিই তাজা ফুলগুলো। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ওদের অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হলো পুনম। ফুলগুলো থেকে যেন এক চিরন্তন হলুদ আলো বিচ্ছুরিত হয়ে বিকেলটাকে আরও মোহময় করে তুলেছে।
ড্রয়িংরুমে সাইড টেবিলের ফুলদানিতে ভালই মানাবে এগুলো। ছেলেটাকে দেখে মায়াও হলো পুনমের। পুরো গুচ্ছটাই কিনে ফেলল ও।
এবার হাতের সব জিনিস গাড়িতে জমা না করলে বাকি বাজার করা প্রায় অসম্ভব। তখনি পিক পিক করে মোবাইল বেজে উঠলো পুনমের। এতক্ষণে বাবুর টনক নড়েছে। কোনরকমে দুহাতে ফুল খাবার সামলে ফোন ধরে পুনম।
দেড় ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে বাজার করে ক্লান্ত পুনম। বড্ড খিদে পেয়েছে। হলদিরাম কাছেই আছে - কিছু খেয়ে নেবে নাকি? কচুরি বা ধোকলা? নাঃ, আরো ভারী কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। বাড়িতে থাকলে এইসময় এক চা আর সামান্য ডালমুট ছাড়া কিছুই খায় না পুনম, আজ এত খিদে পাচ্ছে কেন? হয়ত এত ঘোরাঘুরির জন্যই! ফর্দ মিলিয়ে দশটা দোকানে ঘুরে সবকিছু দেখেশুনে কেনা কি কম পরিশ্রমের!
রোলওয়ালাদের এখন ব্যবসার পিক টাইম। ঘর্মাক্ত কলেবরে একের পর এক খদ্দেরদের জঠরের আগুন নিবিয়ে চলেছে ওরা। দিনের পর দিন অফিস ফেরতা লোকগুলো এই ছাইপাঁশ খেয়ে কি করে বেঁচে থাকে কে জানে! এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনে অনেকটা হেঁটে চলে এসেছে পুনম। হঠাত সম্বিৎ ফিরে থমকে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করে ও দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট গুমটি রোলের দোকানের সামনে। এদিকটা মূল বাজারের চেয়ে খানিকটা দূরে। খাবারের দামও নিশ্চয় খুব সস্তা - যেটা দোকানের সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরদের পোশাক-আশাক আর ভাষা শুনলে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। কালো মুশকো দোকান মালিক বিশাল চাটুতে একের পর এক পরোটা ভেজে চলেছে, আর তার সাগরেদ ক্ষিপ্র হাতে তাতে মাংসের পুর ভরে এগিয়ে দিছে খদ্দেরদের দিকে।
পুনমকে দেখে সবাই অবাক চোখে তাকায় - প্রায় সবার দৃষ্টিতেই বিস্ময় মেশানো লোলুপ দৃষ্টি। এই পরিবেশে দামী পোশাক পরিহিত সম্ভ্রান্ত যুবতীর আবির্ভাব এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার বৈকি!
বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে পুনমের। তবু এই ছায়াময় পরিবেশ, ভাজা পরোটা আর মাংসের গন্ধ, এতগুলো লোকের সম্মোহনী দৃষ্টির চৌম্বকশক্তি এক চুল নড়তে দেয় না পুনমকে। আশ্চর্য - গন্ধটা খারাপ লাগছেনা পুনমের - বরঞ্চ ওর খিদেটা আরো উস্কে দিচ্ছে।
“বিফ না চিকেন?” - পুনমের দিকে তাকিয়ে ঘরঘরে গলায় জানতে চায় দোকানি।
এ কি করতে চলেছে সে! বাড়ির লোক জানতে পারলে কি হবে! তার চেয়েও বড় কথা কিষেণজি কি তাকে কোনদিন ক্ষমা করবেন? কিন্তু, অপরাধবোধের মেঘ সামান্য উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায় পুনমের মন থেকে।
“বি - বিফ ”- মোহাছন্ন পুনম অস্ফুটে বলে ওঠে।
হাতে পাওয়া মাত্রই রোল-এ কামড় বসায় পুনম। পরম তৃপ্তিতে ভরে যায় ওর শরীর-মন। এই অভূতপূর্ব স্বাদ থেকে কিভাবে এতদিন বঞ্চিত ছিল ও?
সদ্য নেমে আসা সন্ধের হলুদ অন্ধকারকে চিরে দেয় একদল লোকের ঘোলাটে সাদা দাঁতের বিকট অট্টহাসি।
“ভাগ এক্ষুনি। …শালার ক্যামেরা গুঁড়িয়ে দেব ফের এদিকে এলে" -- লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে কন্সটেব্ল; দ্রুত পা চালিয়ে সরে পড়ে অপরেশ। এইসব অবশ্য ওর গা-সওয়া। কপাল ভালো থাকলে কোনো কোনো দিন দু-একটা স্কুপ ছবি জুটে যায় বৈকি। অপরেশ হলো আক্ষরিক অর্থেই নিশাচর। গভীর রাতের কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে ‘চিত্তাকর্ষক’ ছবি তুলে নামী সংবাদসংস্থাকে বিক্রি করাই তার পেশা। কোথায় ব্রিজের তলায় জুয়ার ঠেক - পুলিস জেনেও চোখ বুজে রয়েছে - খচ করে একটা ছবি নিয়ে আনন্দবাজার-এ পাঠিয়ে দাও - দুই সপ্তাহের অন্নসংস্থান। বা কোথায় কোন পার্টি থেকে বেরিয়ে কোনো কেউকেটা চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে কল-গার্লকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল - সুযোগ বুঝে একটা ছবি - ব্যাস। আজকাল প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে এইসব ছবি বা ভিডিওর দারুণ চাহিদা - পাবলিক এইসব গোগ্রাসে গেলে। বলা বাহুল্য কাজটা খুব একটা আরামের নয়। কখনো কখনো প্রচণ্ড ঝুঁকিও নিতে হয় অপরেশকে। তবু কোথাও যেন একটা অদ্ভুত নেশা আছে রাতের শহরের বিভিন্ন অচেনা অন্ধকার খাঁজের ছবি ক্যামেরাবন্দী করার মধ্যে।
অপরেশকে লোকে চেনেই ওর চাপ দাড়ি, পুরু চশমা, এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল আর গলায় ঝোলানো ক্যামেরা দিয়ে। ছবি তোলার নেশা অপরেশের অল্প বয়েস থেকেই। কলেজে পড়ার সময়ে টিউশনির টাকা জমিয়ে আর কিছুটা ধার করে সে একটা ডি-এস-এল-আর কিনে ফেলে। সেই থেকে ওই ক্যামেরাই তার সবসময়ের সাথী। তার তোলা একটা ছবি - একটা নেড়ি কুকুরের মুখ থেকে একটা ভিখিরি বাচ্চা প্রাণপণে পাঁউরুটির টুকরো কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে - ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকেও ছাপা হয়।
কলেজ পাশ করার পর ফ্রিল্যান্স ছবি তুলেই মূলত চালায় অপরেশ। আর রয়েছে কিছু খুচরো টিউশানি। আজকাল ফ্রিলান্সারদের আর তেমন কদর নেই। সব সংস্থারই নিজস্ব লোক থাকে বিভিন্ন ধরনের ছবি তোলার জন্য। রেষারেষিও প্রচুর। অপরেশ একবার চাকরি নিয়েছিল একটা ছোট সংবাদপত্রে স্পোর্টস ফটোগ্রাফার-এর। কিন্তু সেবার ইস্ট বেঙ্গল মাঠে ডু-ডং এর গোল করার মোক্ষম মুহূর্তে ‘এখন-এখানে’ কাগজের এক সাংবাদিকের ইচ্ছাকৃত কনুই এর গুঁতো খেয়ে হাতটা কেঁপে গেল। তারপরই সে ঠিক করে এই ইঁদুর দৌড়ে থেকে আর বাঁধা গতের ছবি তুলবে না। যে ধরনের ছবির ডিমান্ড প্রচুর কিন্তু চট করে ক্যামেরাবন্দী করার লোক পাওয়া যাবে না - সেই ধরনের ছবিই বিশেষত্ব হয়ে উঠলো অপরেশের। গভীর রাতের শহরে এই ধরনের ছবির উপাদান প্রচুর ছড়িয়ে থাকে। তাই রাতের শহর চষে বেড়ানো আর সেইসমস্ত উপাদান ক্যামেরায় ধরে ফেলার নেশাটা আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে অপরেশকে।
পুলিশের তাড়া খেয়ে চেতলা ব্রিজের এইদিকটায় চলে এলো অপরেশ। এখন সবে মধ্যরাত পেরিয়েছে। যদি সেই লোক আসেও, এখনো তার ঢের দেরি। গত কয়েক রাত ধরেই স্টোন্ম্যানের দর্শন পাবার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অপরেশ। স্টোন্ম্যান - সেই নব্বই-এর দশকে, অপরেশ যখন খুব ছোট তখন এর আবির্ভাব ঘটেছিল। কলকাতার রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা নিরীহ গরিব মানুষদের গভীর রাতে ভারী পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া - এটাই ছিল তার কাজ। বেশ কয়েক মাস এভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আচমকাই হারিয়ে যায় সেই লোক - পুলিশ ঘটনাগুলোর কোনো কিনারা করতে পারেনি। এতদিন পর আবার আরেক স্টোন্ম্যান-এর আবির্ভাব ঘটেছে। গত তিন মাসে একই পদ্ধতিতে সে চার জন নিরীহ ঘুমন্ত ফুটপাথবাসীকে হত্যা করেছে। পুলিশ এবারও কিছু করতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। সবকটা খুনই হয়েছে উত্তর কলকাতার আশেপাশে। তাই রাত বাড়লে পুলিশী নজরদারিও সেদিকেই প্রবল। তবে অপরেশের স্থির বিশ্বাস এবার স্টোন্ম্যান আঘাত হানবে দক্ষিণে। চেতলার এইদিকটাতেই ফুটপাথ আর অলিগলির রকে প্রচুর লোক রাত কাটায়। এদের বেশিরভাগই দিনের বেলা রিক্সা বা ঠেলা চালায় আর রাতে ফুটপাথের কোনো এক কোণাকে আশ্রয় করে নিশ্চিন্তে পাড়ি দেয় ঘুমের দেশে - এরাই স্টোন্ম্যান-এর আইডিয়াল টার্গেট। আর এদিকটায় মধ্যরাতের পর খুব একটা গাড়িঘোড়া বা লোক চলাচলও নেই। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু জুয়ার আড্ডাও রাত একটা-দেড়টার মধ্যে ভেঙ্গে যায়। বাকি রাতের নিস্তব্ধতা কালেভদ্রে চিরে দেয় কিছু শ্মশান ফেরত শ্রান্ত মানুষের হট্টগোল।
গত আড়াই সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে এই অঞ্চলে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে অপরেশ। ঘড়ির কাঁটা দুটো পেরলেই তার মধ্যে একটা অদ্ভুত চাঞ্চল্য দেখা দেয়। প্রায় সবকটা খুনই হয়েছে রাত আড়াইটে থেকে ভোর সাড়ে তিনটের মধ্যে - মানে নিশাচরেরাও সদ্য ঘুমিয়েছে আর খুব ভোরে ওঠার লোকেরাও তখন গভীরতম ঘুমে।
বেড়ালের মত ক্ষিপ্র অথচ নিঃশব্দ পায়ে এ গলি থেকে ও গলি ঘুরে ঘুরে ফেরে অপরেশ। ঘুমন্ত ফুটপাথবাসীদের ভালো করে পরখ করে দেখে - লক্ষ্য করে ওদের বুকের সমান তালে ওঠানামা। স্টোন্ম্যান যখন হানা দেবে তার কাজের প্রথম ছবিটা অপরেশকেই নিতে হবে - সেটাই হবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। আর যদি সাথে স্টোন্ম্যান-এর ছবিও নেওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। অপরেশের মনে একটুও ভয় নেই। স্টোন্ম্যান-এর মুখোমুখি পড়ে গেলেও সে ঘাবড়াবে না। সে জানে ওই ব্যক্তি নিশ্চই মুখোশের আড়ালে থাকবে, আর সে স্টোন্ম্যান-এর হিটলিস্ট-এ পড়ে না।
ক্লান্ত অপরেশ দম নিতে একটা ল্যাম্প-পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখ দুটো লাল, কোটরাগত, গাল ভেঙ্গে গেছে - সব মিলিয়ে উদ্ভ্রান্ত চেহারা। কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে পকেট থেকে একটা আধখাওয়া সস্তা সিগারেট বের করে। এই স্টোন্ম্যান-এর চক্করে গত কয়েক সপ্তাহ সে কোনো ছবিই তোলেনি। তাই কোনো উপার্জনও হয়নি। আর্থিক অনটন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কিন্তু আর সব কিছু উপেক্ষা করে যেন এক অদ্ভুত নেশায় মেতেছে সে। মাঝে মাঝে দিনের বেলা সে সুস্থ মস্তিস্কে ভাবার চেষ্টা করে কেন এমন করছে-- নিজেকে ধিক্কার দেয় ওই গরিব ফুটপাথবাসীদের পরোক্ষ মৃত্যুকামনার জন্য। দৃঢ় সংকল্প করে স্টোন্ম্যান-এর পেছনে আর নয়। কিন্তু রাত বাড়লেই কেমন যেন সবকিছু গুলিয়ে যায় ওর। সব ভুলে যেন নিশির ডাকে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে।
অসহ্য যন্ত্রণায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে কপাল। ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরায় অপরেশ। সস্তার হোটেলে খাওয়া আলুরদমের টক ঢেঁকুরে সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে ওর। এমন সময় ১৪-১৫ বছরের এক কৃষ্ণবর্ণ কিশোর - সরু সরু হাত-পা, ঢলঢলে ময়লা হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরা, উস্কোখুস্কো চুল - একগুচ্ছ কালো গোলাপ হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায় অপরেশের সামনে। জনমানবহীন রাস্তায় ছেলেটার আকস্মিক উপস্থিতি অবাক করে অপরেশকে। মুহূর্তে একটা মনকাড়া তীব্র মিষ্টি গন্ধে ভরে ওঠে জায়গাটা। এক অদ্ভুত মাদকতায় সব ইন্দ্রিয় যেন বিবশ হয়ে আসে অপরেশের।
মর্মভেদী দৃষ্টিতে অপরেশের অন্তর কাঁপিয়ে ভারি গলায় ছেলেটা বলে ওঠে - “একদম তাজা, এখুনি এনেছি - দেখুন না। ...”
নিকষ কালো ফুলগুলো যেন রাতের অন্ধকারকে আরো পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। এক অপরূপ কালো দ্যূতি যেন ফুলগুলো থেকে পাক খেয়ে বেরিয়ে উঠে রাতের অন্ধকারকে সমৃদ্ধ করছে। ল্যাম্প-পোস্টের স্বল্প হলুদ আলো যেন লজ্জায় ম্লান হয়ে রাতের গভীরে মিশে যেতে চাইছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত ফুলগুলো হাতে নেয় অপরেশ - তারপর দৃঢ় হাতে চেপে ধরে নাকের সামনে।
এরপর ঠিক কি ঘটেছিল অপরেশের মনে নেই। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার ঠিক তিনটে বিচ্ছিন্ন দৃশ্য মনে পড়ে। এক - অমানুষিক শক্তির বশবর্তী হয়ে সে একটা ভারী পাথর তুলে ফেলেছে, দুই - ফুটপাথে গড়িয়ে পড়া সদ্য বেরোনো গরম রক্তের স্রোত তার নিজের ধমনীতে এক অদ্ভুত হিল্লোল সৃষ্টি করছে, আর তিন - থেঁতলে যাওয়া মাথাটায় ফোকাস করে বার্স্ট মোড-এ সে পরপর বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিচ্ছে।
বিছানার পাশের টেবিলটায় রাখা ক্যামেরার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে অপরেশ ঠাহর করার চেষ্টা করে ব্যাপারটা ঘটনা নাকি দুঃস্বপ্ন!
“আই ওয়ান্ট ইয়ু টু গেট অল অব দোজ্ বাস্টার্ড্স! ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?"-- ঘর কাঁপায় মেজর ভার্মার গমগমে কন্ঠস্বর। এখনো রাত ফুরোতে ঢের দেরি। অ্যাকশন-এ বেরোনোর আগে তার অফিসারদের সাথে শেষবারের মতন প্ল্যানটা ঝালিয়ে নিচ্ছেন তিনি। উত্তর মিজোরামের কায়টুম গ্রামের কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্থায়ী শিবির। ভার্মা এবং তার বিখ্যাত অপারেশন 'টোট্যাল স্কাওয়ার'-এর বিশ্বস্ত সেনারা এখানে কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘাঁটি গেড়েছে। খবর আছে ভয়ংকর সিপি জঙ্গি গোষ্ঠির বেশ কিছু সদস্য আশেপাশেই গা ঢাকা দিয়ে আছে। সঠিক অবস্থান এখনো জানা যায়নি তাই গ্রাম কে গ্রাম আক্ষরিক অর্থেই চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছেন ভার্মা। আজকের টার্গেট কিতাং নামে একটা ছোট গ্রাম - গ্রাম না বলে বস্তি বলাই ভালো, ২০-২৫ ঘর চাষীর বাস। ওখানেই কোনো এক ঘরে নাকি আত্মগোপন করে আছে সিপির চাঁই সায়রাজ আখাম। দিনের আলো ফোটার আগেই তাই আঘাত হানতে হবে।
শরীরে বেশ একটা চনমনে ভাব টের পায় দেবদত্ত। সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার পর এটাই তার প্রথম আউটডোর পোস্টিং, তাই স্বভাবতই উত্তেজনাটা বেশি। তারপর ভার্মার ব্রিফিং আরো তাতিয়ে দিয়েছে তাকে। চটপট সব সরঞ্জাম গুছিয়ে তৈরি হয়ে নেয় সে। ওর রুমমেট মেজর কাপুর ওর ভেতরের চাঞ্চল্য টের পেয়ে মুচকি হাসে - “ফার্স্ট টাইম ইজ দ্য চার্ম মাই বয়। প্রথমবারের মত অভিজ্ঞতা আর কখনো হবে না বুঝলে! আর তাছাড়া ভার্মার সাথে যাওয়া মানে তো শুধু টগবগে অ্যাকশন নয় - কপাল ভালো থাকলে কিছুটা উপরি রিঅ্যাকশনে ফ্লুক হিসেবে জুটে যেতে পারে--" ট্রাকে উঠতে উঠতে চোখ টেপে কাপুর। কথাটায় তেমন আমল দেয় না দেবদত্ত। এখানে আসার আগেও সে ভার্মা সম্পর্কে অনেক কানাঘুষো শুনেছে। কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ এবং চূড়ান্ত পেশাদার হলেও ভার্মার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প চালু আছে বিভিন্ন রেজিমেন্টে। তবে এর বেশিরভাগটাই ঈর্ষাকাতর সহকর্মীদের রটনা বলেই মনে হয়ে দেবদত্তর।
দ্রুত গ্রামটাকে ঘিরে ফেলে ভার্মার বাহিনী। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের বিভিন্ন দিকে। ভীত, সন্ত্রস্ত হতচকিত গ্রামবাসীরা ভালো করে ঘুম ভাঙার আগেই দেখল ওদের চোখের সামনে সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে। গভীর জঙ্গলে যেমন বিদ্যুৎগতিতে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনি ভার্মা বাহিনী গ্রামের চারদিক ছারখার করে দিল। কিছু জোয়ান গ্রামবাসী পালাতে গিয়ে প্রাণ দিল বন্দুকের গুলিতে, কেউ বা আহত রক্তাক্ত হয়ে বন্দী হলো সেনাবাহিনীর ট্রাকে। ছেলে বুড়ো কাউকে রেয়াত করে না 'টোট্যাল স্কাওয়ার'। জঙ্গিদের সরাসরি ধরা না গেলেও ওদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছনো - এটাই উদ্দেশ্য ভার্মার।
ভার্মার ভারী বুটের লাথিতে ভেঙে গেল পলকা দরজা। আধো অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের এক কোণে কাঁথার নিচে সারা মুখময় আতঙ্ক এবং কোলে দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে আছে এক যুবতী। বোধয় একটাকে স্তন্যপান করাচ্ছিল। ঘরের চারদিকে একবার নির্মম দৃষ্টি বুলিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ভার্মা - “পাকড়াও ওকে!” ওর সঙ্গীরা ক্ষিপ্র গতিতে মেয়েটার চুল ধরে টেনে তোলে। হতচকিত দেবদত্তর বিস্ময় ভেঙে খানখান হয়ে যায় বাচ্চাগুলোর বুকফাটা আর্তনাদে।
“সো--হাউ ডিড ইট ফিল?” দেবদত্তর পিঠে চাপড় মারে কাপুর। আজকের অ্যাকশন মোটামুটি সফল। সায়রাজ আখাম ধরা না পড়লেও তার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এখন সেনাবাহিনীর কবলে।
এখনো ঘোর কাটেনি দেবদত্তর। এতগুলো নিরীহ গ্রামবাসী, বিশেষ করে মহিলাদের কেন ধরে আনা হলো সেটা সে এখনো বুঝতে পারছে না।
বিকেলের পর থেকেই সবার মধ্যে একটা চাপা চনমনে ভাব টের পাছে সে। কিছু বাছা বাছা অফিসারদের নিয়ে বিকেলের চা-এর পর মিটিং ডেকেছে ভার্মা। দেবদত্তও আছে সেই মিটিং-এ। বোধহয় পরবর্তী প্ল্যান অফ অ্যাকশন সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। এই ধরনের মিটিং-এ ডাক পাওয়া বেশ কৃতিত্বের। স্বভাবতই আজ দেবদত্তর পারফরমেন্স-এ খুশি ভার্মা।
“ইয়ু ডিড ওয়েল। ভার্মা তোমাকে উপযুক্ত প্রাইজ দেবেন।" মুচকি হাসে কাপুর।
এই সবে মিটিং শেষ হয়েছে। এখনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না দেবদত্ত। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। মিটিং-এর শেষে স্বভাবসিদ্ধ দৃপ্ত ভঙ্গিতে ভার্মা সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে “জেন্টলমেন, এখন সময় এসেছে নিজেদের ভালো কাজের ফল উপভোগ করার... “ তারপর নীচু গলায় “ক্যান্টিনে ... রাত আটটায়… আই উইল কিপ দ্য টল ডার্ক ওয়ান ফর মাইসেল্ফ। বাকিগুলো আপনাদের...”
পরে কাপুর জানায় এটাই ভার্মার ধরন। উনি কাউকেই বঞ্চিত করেন না। অধস্তনদের মধ্যে ভার্মার জনপ্রিয়তার এটা একটা অন্যতম কারণ - আর বাইরে ওর বদনামের। সেনাবাহিনীতে সবাই পরিবার পরিজন ছেড়ে এত দূরে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে দেশ সেবা করছে - এইটুকু তো ওদের প্রাপ্যই!
যে ভার্মার ছবিটা মনের মধ্যে ছিল দেবদত্তর - সৎ, নির্ভীক সেনানায়কের - তা যেন ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। ভার্মার নগ্ন নির্মম লালসাময় রূপ ক্রমশই প্রকট হয়ে বিবশ করে দেয় দেবদত্তকে। কানে ভেসে আসে সেই যুবতীর বুকফাটা কান্না।
কাঁধে একটা দৃঢ় স্পর্শে ঘোর কাটে দেবদত্তর “এসো! একটু টেনিস খেলা যাক্।"
ভার্মা, কাপুর এবং আরো কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে টেনিস ফিল্ড-এ এসে পৌঁছয় দেবদত্ত।
গেটের সামনে ১৪-১৫ বছরের এক পাহাড়ি কিশোর - সরু সরু হাত-পা, ঢলঢলে বাদামী ফুল সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট পরা, কদম ছাঁট চুল - একগুচ্ছ সাদা গোলাপ হাতে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। একটা মনকেমন করা মোহময় গন্ধে ভরে উঠেছে জায়গাটা। বাতাস ভারী করা যুদ্ধ বিরোধ অশান্তির কটু গন্ধ, পাহাড়ি হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো একটা চাপা অস্বাচ্ছন্দ্য যেন কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়ে চারদিক ভরিয়ে দেয় এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে। ভার্মা এবং অন্যান্য সকলেই আবিষ্ট হয় এক অপরূপ ভালো লাগায়।
নিরীহ চোখে ভার্মার দিকে তাকিয়ে ভীরু গলায় ছেলেটা বলে ওঠে - “একদম ফ্রেশ সার, অভি লায়া - লিজিয়ে না। ...আপ সব কে লিয়ে লায়া। ...”
পড়ন্ত বিকেলের সব ম্লানিমা মুছে দিচ্ছে ফুলগুলোর আভা। ভার্মা যেন চোখ ফেরাতে পারল না। বাকি সবারও একই অবস্থা। শুধু দেবদত্ত টের পায় কিছুক্ষণ আগের অস্বস্তিটা যেন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। প্রখর দাবদাহর পর প্রথম বৃষ্টির মতই একটা প্রশান্তি নেমে আসে ওর শরীর-মনে। মনে হয় পৃথিবীর সব কালো ধুয়ে মুছে সাফ করার জন্যই এই ফুলগুলোর আবির্ভাব।
“জেন্টল্মেন! সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করে ও ভালোভাবে সবকিছু খতিয়ে দেখে আমি ঠিক সব বন্দী রমণীদের ছেড়ে দেব ঠিক করেছি। তারা তাদের গ্রামে ফিরে যাবে। অপরাধের জোরালো প্রমাণ ছাড়া তাদের আর হেফাজতে নেয়া হবে না।"--
ডিনার টেবিলে ঘোষণা করেন ভার্মা। সবাই করতালি দিয়ে ওনার এই সিদ্ধান্তকে অভ্যর্থনা জানায়। শুধু কাপুর, দেবদত্ত এবং ভার্মার আরো কিছু বিশ্বস্ত অফিসার এতক্ষণে উপলব্ধি করে ওদের অপারেশনের আসল সাফল্য। সেনাবাহিনীর হয়ে দেশের হয়ে কাজ করার তাৎপর্য্ আবার নতুন করে বুঝতে শেখে ওরা।