উপক্রমণিকা
নৈহাটি টাউনকে পশ্চিমে রাখিয়া রেলব্রীজ পার হইয়া পূর্বদিকে কিছু পথ হাঁটিবার পর যেস্থানে আমাদের বসতি স্থাপিত হইয়াছিল সে গ্রামের নাম দেউলপাড়া। গ্রামের এই নামকরণ কবে, কোনকালে, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হইয়াছিল ইহার বিবরণ পূর্বাপর কোনদিনই জানার কোন উপায় ছিল না। হয়তবা কোনও নামের অপভ্রংশ হইয়া থাকিবে।
আমার এদেশে প্রথম আসা স্বামীর অসুস্থতার বার্তাবাহক টেলিগ্রাম পাইয়া। তখন পূর্ববাংলার ময়মনসিং শহর হইতে একদিনেই নৈহাটি পৌঁছানো যাইত। জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হইতে ব্রহ্মপুত্র পার হইয়া সিরাজগঞ্জ ঘাটে আসিয়া ট্রেন ধরিতে হইত।
সকালের ট্রেনে রওয়ানা হইয়া বিকাল হয় হয় এমন সময় পৌঁছোইলাম রানাঘাট স্টেশনে, সঙ্গী মেজদার কাছে জানিলাম স্টেশনের নামটি। রানাঘাট স্টেশন হইতে ট্রেন ছাড়িল। রেলপথের দুই ধারে সারি সারি অগণিত খোলার ঘর। খোলা কি আমি জানিতাম না। মনে হইল চালের ওপর সারি সারি এত গ্লাস কেন? পরে জানিলাম মাটির তৈরি এই জিনিসগুলির নাম খোলা, এদেশে ছনের বদলে ঘরের চাল তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়া রেললাইনের দুইধারের দৃশ্য দেখিতেছিলাম, সবই আশ্চর্য লাগিতেছিল।
বিকাল আনুমানিক চারটায় আসিয়া পৌঁছিলাম নৈহাটি স্টেশনে। এখন যেস্থানে রিকশা স্ট্যান্ড তখন সেইস্থানে সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া থাকিত। ঘোড়ার গাড়ি চাপিয়া পৌঁছিলাম কাঁঠালপাড়ার ঠাকুরপাড়ায় মেজননদের বাড়ি। আমার কর্তা ও তাঁর এক ভাই তখন থাকিতেন এই বোনের বাড়িতে।
আমার কর্তা তখন এমনই অসুস্থ যে নিজে নিজে পাশ পরিবর্তনের ক্ষমতাও ছিল না। তাৎক্ষণিক কোন উত্তেজনা তাঁহার পক্ষে ক্ষতিকর হইতে পারে বলিয়া আমার আসিবার সংবাদ তাঁহাকে জানানো হয় নাই। দিন তিন চার শুধু মাথার কাছের জানালা পথে উঁকি দিয়া তাঁহাকে দেখিলাম। অতঃপর অসুস্থতার সূচনা কীসে তাহার বৃত্তান্ত জানিলাম। সে’সময় ভগীরথ দশহরার দিন নৈহাটির গঙ্গায় সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন হইত। নৈহাটি ফেরিঘাট হইতে নদীয়া মিলের নিকট কাঁঠালপাড়া ঘাট পর্যন্ত সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পর প্রথমে সর্দিজ্বর, তারপর প্যারাটাইফয়েডে তিনি শয্যাশায়ী হইয়াছেন।
এই সময় দেড়মাসের মত আমাকে নৈহাটিতে বাস করিতে হইল। এইবার আমার জীবনের প্রথম শহর বাসের সময় যে সমস্যার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহার বৃত্তান্ত একটুখানি বলিয়া লই।
নৈহাটি শহরে তখন চারিদিকেই দালানকোঠা, গাছগাছালি বেশি নাই, বাড়িতে কোনও স্ত্রীলোকও নাই যে কথা বলিব। ননদ দেশের বাড়িতে, বাকিরা সকলেই পুরুষ, দিনে সকলেই কাজে চলিয়া যাইতেন, খাবার সময় মাত্র বাড়িতে আসিতেন। উড়ে ঠাকুর রান্না করিত, কাজের জন্যও লোক ছিল। সারাদিন কোন কাজ নাই, কথা বলার সঙ্গী নাই, বাহিরে যাইবার উপায় নাই, কারণ একাকি সম্ভবও ছিল না। ওড়িয়া ঠাকুর চাকরের নিজেদের মাতৃভাষায় কথাবার্তা কিছুই বুঝি না। আর ঠাকুরের রান্না তো মুখেই তুলিতে পারিতাম না। কয়লার উনুনের রান্নার গন্ধ, এখানকার মিলের চালের গন্ধ আমার সহ্য হইত না। মাঝে মাঝে নন্দাইদের পরিচিত কিছু মহিলারা আসিতেন, কথাও বলিতেন, আমি এদেশীয় ভাষাও ভালো বুঝিতে পারিতাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করিয়া তাহাদের দিকে তাকাইয়া থাকিতাম। কিছু পরে তাঁহারাও চলিয়া যাইতেন। আরও এক সমস্যা ছিল পায়ে চটি পরিয়া রাস্তায় বাহির হওয়া। এ অভ্যাস তো দেশে কখনো আয়ত্ব করিতে হয় নাই। পায়ে চটি দিয়া হাঁটিতে গেলেই চটি পা হইতে খুলিয়া যাইত। এই অবস্থায় জেদ ধরিলাম এখানে থাকিব না, দেশে চলিয়া যাইব।
এইবার বয়োজ্যেষ্ঠ, পিতৃসম নন্দাই চেষ্টা শুরু করিলেন এখানে মন বসাইবার। কন্যাসমা শালাজকে ভুলাইবার নানা উপায় বাহির করিতে লাগিলেন। বাড়িতে দেশের বাড়ির মত বড়ো আস্ত মাছ আনা হইতে লাগিল, আমাকে দিয়া নানা ভাবে রান্না করাইয়া কাজের মধ্যে রাখিবার চেষ্টা আরকি! প্রাতঃকালে কর্তাকে সঙ্গে লইয়া আমাকে গঙ্গার ধারে বেড়াইতে লইয়া যাইতেন। সাঁতার কাটিতে চাহিলে সে ইচ্ছাপূরণের চেষ্টাও হইল, কিন্তু কর্তার বারণে স্রোতস্বিনী গঙ্গায় সাঁতার কাটা হইল না, ডুব দিয়া স্নান করাই হইল।
কিন্তু আমার দেশে ফিরিয়া যাইবার বায়না বন্ধ হইল না। একদিন আমাদের রামকৃষ্ণ টকিতে সিনেমা দেখাইতে লইয়া গেলেন। সিনেমাটির নাম ছিল ‘গৃহলক্ষ্মী’। কিন্তু অনভ্যস্ত চোখে সিনেমার কলা কুশলীদের চলফেরা, কথাবার্তা সবই আমার কাছে খুব দ্রুত মনে হইল। বুঝিবার আগেই চিত্র চলিয়া যাইত।
দেখিতে দেখিতে রথযাত্রা আসিয়া পড়িল। নন্দাই রথের মেলায় লইয়া গেলেন আমাদের। সাতদিনই লইয়া গেলেন। আষাঢ় মাসে এই মেলা বসিত পূর্ব কাঁঠালপাড়ায়, রেললাইনের পুবদিকে, সর্বজনবিদিত সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ির সংলগ্ন মাঠে। তাঁহারই পূর্বপুরুষের স্থাপিত গৃহদেবতা ঁরাধাবল্লভ জিউকে কেন্দ্র করিয়াই এই মেলা হইত (এখনো হয়)।
মেলার সাতদিন দেবমূর্তিকে মন্দিরের নিত্যপূজার সিংহাসন হইতে আনিয়া মেলার মধ্যে গুঞ্জাবাড়িতে রাখা হইত। সেখানেই পূজা হইত। সাতদিন সাতটি বেশে দেবমূর্তিকে সাজানো হইত। তখন মেলা খুবই সুশৃঙ্খল ছিল, ভক্তিপূর্ণ এক জাঁকজমক ছিল। অতিরিক্ত মানুষের ভিড় হইত না। সেই সাতদিন দেবমূর্তিকে নৌকাবিলাস, কালীয়দমন, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ, ইত্যাদি নানা বেশে সাজাইবার পর সপ্তম দিনে হইত রাজবেশ। সে সাজ ছিল সবচেয়ে মনোহর। অতি দক্ষতার সহিত, শাস্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী বেশকার দেববিগ্রহকে সাজাইতেন।
মেলায় আসিত নানা জায়গার মাটির পুতুল, ভালো কাঠের সুদৃশ্য খেলনা, ঘরকন্নার নানা জিনিসপত্র, গাছের চারা নিয়া আসিত দোকানীরা, কাচের চুড়ির দোকান, বাদাম ভাজা, পাঁপড় ভাজার দোকানও বসিত।
তথাপি, কিছুতেই আমার মনের আনন্দ ফিরিল না। মেলার আনন্দ মিটিতে না মিটিতেই আমার আবার সেই দেশে ফেরার বায়না শুরু হইল। একবগ্গা বায়না বন্ধ করিতে ডাকাইয়া আনা হইল গরিফা স্কুলের শিক্ষক, আমার মেজদাকে। ফল হইল না। তখনও দেশ ভাগ হয় নাই, পাসপোর্ট ভিসার দরকার হইত না। কর্তা আর সকলে রাগান্বিত হইয়া আমাকে দেশে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। কর্তার পরিচিত বাংলাদেশগামী এক বিশ্বস্ত ব্যক্তির সহিত আমাকে আর আমার ছোট দেওরকে দিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকাল সাতটায়, নৈহাটি স্টেশনে ময়মনসিংহ যাইবার ট্রেনে তুলিয়া দেওয়া হইল। এইভাবে আমার প্রথমবারের নৈহাটি বাসের সমাপ্তি হইল।
কিন্তু ঈশ্বরের বিধান অন্যরূপ। স্বাধীনদেশের স্ত্রী-কন্যাদের সম্ভ্রম হানিকর পরিস্থিতিতে পূর্ববাংলার বাস উঠাইয়া দুই বছর পরই আবার আসিতে বাধ্য হইলাম নৈহাটিতে। আবাল্যের মধুর স্মৃতিজড়ানো বাংলাদেশকে বিদায় জানাইয়া পাকাপাকিভাবে নৈহাটিতে আসিলাম, ১৯৪৭ সালের দ্বীপান্বিতা কালীপূজার পরে।
১৯৪৬ সাল হইতেই বাংলার গ্রামদেশের শান্তির আবহাওয়া ক্রমশঃই উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছিল। পরের শরতে শ্বশুরবাড়ির গ্রামের এক হিতৈষী প্রজা, আমার কর্তার বিশেষ বন্ধু, শিক্ষক নবাব আলী গোপনে শ্বশুর মহাশয়কে অনুরোধ করিয়া বলিয়া গেলেন, “যত শীঘ্র সম্ভব বাড়ির দুই বউ আর বয়স্থা মেয়েকে যেন কলকাতায় পাঠাইয়া দ্যান।” কোনক্রমে দুর্গাপূজা মিটিল, কালীপূজার দিন সকালে শ্বশুর মহাশয় আমাকে লইয়া রওয়ানা হইলেন নৈহাটির উদ্দেশ্যে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্রহ্মপুত্র পারাপারের প্রচলিত জলপথটি বন্ধ ছিল। একখানি গোদারার নৌকায় ঘুরপথে নদী পার হইয়া ময়মনসিংহ স্টেশনে পৌঁছাইলাম দুপুরে। এবারের যাত্রাপথ দীর্ঘ হইল, ঘুরপথে ট্রেন চলিতেছে। দুপুরে ট্রেনে চড়িয়া আন্দাজ রাত্রি আড়াইটার সময় পৌঁছাইলাম সান্তাহার স্টেশনে। সেখান হইতে রাত তিনটায় নৈহাটির ট্রেনে চড়িলাম। সান্তাহার স্টেশনে, এত রাতে আঠারো বছরের যুবতী বধূকে লইয়া একাকি প্রবীণ শ্বশুর মহাশয়ের যে আতঙ্কগ্রস্থ অবস্থা দেখিয়াছিলাম তাহার কারণ সেদিন বোধগম্য হয় নাই। মানুষ যে সেদিন পশুর পর্যায়ে পৌঁছিয়াছিল সে কথা জানিতেন বলিয়াই, আলোআঁধারি স্টেশনে আমাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখিতে তিনি সন্ত্রস্ত ও ব্যস্ত ছিলেন। আমি যত মানুষজন দেখিতে চাহিতেছিলাম, ততই তিনি আমাকে আড়াল করিয়া দাঁড়াইতেছিলেন।
সেবারের কলিকাতাগামী ট্রেনে কোন আলো ছিল না, জল ছিল না। গোটা কামরায় নীরবতা আর নীরন্ধ্র অন্ধকারে মানুষজন আড়ষ্ট হইয়া বসিয়াছিল। এক যাত্রীর পায়ের কাছে টিমটিম করিয়া একটি হ্যারিকেন জ্বলিতেছিল, তাহাতে মানুষ বোঝা যায় না। চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে ট্রেনে কাটাইয়া শ্বশুর মহাশয় আমাকে লইয়া নৈহাটিতে পৌঁছাইলেন পরদিন বিকালে। ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়া কাঁঠালপাড়ায় ননদের বাড়িতে পৌঁছাইলাম।
দুই দিন সেখানে থাকিয়া চলিয়া আসিলাম রেলস্টেশনের পুবদিকে দেউলপাড়া গ্রামের এক ভাড়াবাড়িতে। শুরু হইল জীবনের নতুন এক অধ্যায়। বাড়ির মালিক এক বিধবা মহিলা। অতি সজ্জন, তাঁহার ছোট দুটি শিশুপুত্র হইল আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। বাড়ির চারদিকে গাছপালা। আম, কাঁঠালের গাছ আছে, সামনেই একটি ছোট্ট পুকুর। পরিবেশ খানিকটা দেশের বাড়ির মত, কথাবার্তা বলার লোকও আছে। মহিলা খুবই অন্তরঙ্গ। তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখাইলেন। তিনি আমার অভিভাবকের ভূমিকাতে ছিলেন। কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়া, আটা মাখিয়া রুটি করার নিখুঁত কায়দা শিখাইলেন। ছেলেমানুষ বউটির উপরে যেন অপদেবতার নজর না পড়ে সেজন্য আমার ওপর তাঁহার নানা নিষেধাজ্ঞাও ছিল। ভিনদেশে মহিলা অভিভাবকহীন অবস্থায় তাঁর এই অভিভাবকত্ব আমার অনেক কাজে আসিয়াছিল।
এইভাবে এক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর একদিন সন্ধ্যাবেলায় চারিদিকে কলরব শোনা গেল। পথচলতি মানুষজনের খুব উত্তেজিত আলোচনা শোনা গেল। অদূরেই এক সম্পন্ন এদেশীয় ব্যক্তির বাড়িতে রেডিও ছিল, সেখান হইতে “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম”, এই রামধুনের সুর ভাসিয়া আসিতেছিল। আমার কর্তা অফিস হইতে বাড়িতে ফিরিলে শুনিলাম মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হইয়াছে।
নানা রকম ঘটনার মধ্য দিয়া ১৯৪৮ সাল কাটিল। ১৯৪৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি অসামান্য রূপের পসরা লইয়া জন্ম নিল আমার স্বল্পজীবী প্রথমা কন্যা ‘কৃষ্ণা’। আর এই বছরেই নৈহাটিতে সর্বপ্রথম উদ্বাস্তু কলোনীর পত্তন হইল--১নং বিজয়নগর কলোনী।
১৯৪৮ সালের মধ্যভাগ হইতেই দেউলপাড়া গ্রামে বাংলাদেশ থেকে অগণিত বাস্তুহারা মানুষের আগমন শুরু হইয়াছিল। স্বাধীনতালাভের বদলে প্রাপ্ত উপহার বঙ্গভঙ্গ, বাংলার এতদিনের সহবাসী মানুষদের হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত করিয়া একে অপরের শত্রুতে পরিণত করিয়াছে। তাহারই ফলে অগণিত বাস্তুচ্যুত মানুষের আগমন ঘটিতে লাগিল। নৈহাটি জংশন স্টেশন, অদূরেই মা গঙ্গার অবস্থান, পূর্বদিকে অসীম বসতিহীন প্রান্তর। জলেজঙ্গলে পূর্ণ অনাবাদী পতিত সেই জমির দিকে দিকে সর্বহারাদের নজর পড়িল।
এত বিপুল সংখ্যক ছিন্নমূল মানুষের দুর্দশা দেখিয়া কিছু উৎসাহী যুবক, প্রবীণ, লড়াকু মানুষ, আর কিছু ছিন্নমূল মরীয়া মানুষ স্থির করিলেন জোর করিয়া সেইসব জমি দখল করিয়া মাথা গোঁজার ঠাঁই করিবেন।
ঘটনার দিনটি ছিল ১৯৪৯ সালের কোজাগরী পূর্ণিমার রাত। বিকালে দেখিলাম গ্রামসুবাদে আমার কর্তার এক ভাগ্নে, ভূপেন চৌধুরি আসিলেন, মামার সঙ্গে নীচুগলায় কিছু বলিলেন, আর এক বড় ঝুড়ি ডিম, আর ব্যাগভর্তি চালডাল রাখিয়া গেলেন। কর্তাকে জিজ্ঞাসা করিলেও তিনি কিছু বলিলেন না। নীরবে কাঠের জ্বালে ডিমগুলি সিদ্ধ করিলেন, আর বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি বসাইলেন।
সন্ধ্যা হইতেই ছায়ামূর্তির মত মানুষের আনাগোনা শুরু হইল। রান্না খিচুড়ি আর ডিম সিদ্ধ লইয়া যাইতে লাগিল আরও ডিম ও চালডাল দিয়া যাইতে লাগিল। কর্তা রান্না করা খাবার তাহাদের যোগান দিতে লাগিলেন।
রাত গভীর হইলে দূরে সামান্য কোলাহল শোনা যাইতে লাগিল। কোলের মেয়েকে দুধ খাওয়াইতে জাগিয়া দেখিলাম কর্তা না ঘুমাইয়া, ঘরের উত্তর দিকের জানালা দিয়া চাহিয়া বসিয়া আছেন। মেয়েকে ঘুম পাড়াইয়া, নিঃশব্দে তাঁহার পিছনে দাঁড়াইয়া জানালা পথে নজর করিলাম। দেখিলাম অদূরে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত এক প্রান্তরে যেন ভৌতিক মানুষজনের দ্রুত চলাফেরা চলিতেছে।
প্রায় সারারাত এইরকম চলিয়াছিল। রাত্রি প্রভাত হইলে মানুষজন দেখিল বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়িয়া চারটি খুঁটির উপরে কাপড়ের ছাউনি দিয়া অসংখ্য অস্থায়ী ঘর উঠিয়া গিয়াছে। প্রতি ঘরে একটি জলের কলসি, মাটির হাঁড়ি-কড়াই আর একটি উনান লইয়া এক একটি সর্বহারা পরিবার আশ্রয় লইয়াছে। এলাকায় প্রবেশের পথে দুইটি গাছের ডালে দড়ি দিয়া একটি কাপড় টাঙাইয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে লেখা, ‘এক নম্বর বিজয়নগর উদ্বাস্তু কলোনি’।
কয়েকদিনের মধ্যেই নিকটের সমস্ত বাঁশবাগানের বাঁশ আর সম্পন্নদের খড়ের গাদার খড় রাতারাতি উধাও হইয়া বাস্তুহারা কলোনির ঘর তৈয়ারি হইতে লাগিল। দেশকে স্বাধীন করিবার যজ্ঞে বাংলাদেশের যে মানুষদের আশ্রয়হারা হইয়া উদ্বাস্তু নামে পরিচিত হইতে হইয়াছিল, তাঁহারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করিয়া লইল। সংঘশক্তির জয় হইল। বাংলায় আসা সব বাস্তুহারাদের পথ দেখাইল এই কলোনি। এই নৈহাটির বুকেই একে একে আটটি কলোনি গড়িয়া উঠিল।
ইহাদের যাঁহারা সাহায্য করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন মহাদেব ভট্টাচার্য, মাখন ভট্টাচার্য, নিরঞ্জন সমাজপতি, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী, দ্বিজেন ঘোষ, ভূপেন চৌধুরি আরও অনেকে। এই সময়ের ঘটনা, দিন, তারিখ আমার মনে থাকার কারণ, এই বছরেই ৩৪ দিন হামজ্বরে ভুগিয়া, আমার নয় মাসের কন্যাটি এই “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী” হইতে বিদায় লইয়াছিল।