এক দুই তিন থেকে শুরু করে একশো দুশো তিনশো ... এক হাজার দুহাজার তিন হাজার ... এক লক্ষ ... এক কোটি। কতদূর যাব সংখ্যা গুণতে গুণতে? পাশ্চাত্য মতে মিলিয়ন বিলিয়ন ট্রিলিয়ন। মিলিয়ন হল ১০৬ — আমাদের দশ লক্ষ বা নিযুত। বিলিয়ন ব্রিটিশ মতে মিলিয়ন মিলিয়ন — অর্থাৎ একশো কোটি, ১০১২, আমেরিকান মতে এক হাজার মিলিয়ন, ১০৯. ট্রিলিয়ন আমেরিকান মতে মিলিয়ন মিলিয়ন ১০১২, ব্রিটিশ মতে মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন, ১০১৮। ভারতীয় অঙ্কশাস্ত্রও পিছিয়ে নেই — কোটি পেরিয়ে অর্বুদ ১০৮, শঙ্খ ১০১২, পরার্ধ ১০১৭, যা হল শত সহস্র লক্ষ কোটি। পিছিয়ে নেই বলছি কেন? বলা উচিত শূন্যের ধারণার আবিষ্কর্তা হয়ে ভারতীয় অঙ্কশাস্ত্রই দিগ্দর্শী হয়েছে হাজার মিলিয়ন ট্রিলিয়নকে সুসংবদ্ধ অঙ্কের প্রতীকে প্রকাশ করতে। সংখ্যাকে প্রতীক হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সব প্রাচীন সভ্যতার আদিকালে। আবার বর্ণলিপির মাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়েছে তাদের নাম, যাদের আমরা জানি সংখ্যাবাচক শব্দ হিসাবে — এক দুই তিন ... লক্ষ কোটি পরার্ধ ... ওয়ান টু থ্রি ... হান্ড্রেড থাউজেন্ড মিলিয়ন ট্রিলিয়ন।
সংখ্যা মানুষকে প্রভাবিত করেছে তার জীবনযাত্রার প্রতি স্তরে। সময়কে সে বেঁধেছে সংখ্যার বাঁধনে, অনুপল বিপল পল দণ্ড প্রহর দিন মাস বৎসর থেকে কল্পের ধারণা পর্যন্ত ৪৩২ কোটি বৎসর — যা কিনা ব্রহ্মার এক অহোরাত্র। অন্যদিকে সংখ্যা স্থান করে নিয়েছে তার ক্রিয়াকর্মে তার মুখের ভাষায় — নানা সমাসবদ্ধ শব্দ ও শব্দবন্ধে ঘটেছে তাদের প্রকাশ। কোন কোন সংখ্যা শুভসূচক বিবেচনায় সামাজিক ক্রিয়াকর্মে ও ধর্মীয় আচরণে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে অন্যদের তুলনায় বেশি পরিমাণে — তাদের নিয়ে এ-জাতীয় শব্দসংখ্যাও তাই বেশি। সংখ্যা নিয়ে অনেক শব্দ সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে তৎসম শব্দ হিসাবে, আবার কিছু কিছু শব্দ বাংলাভাষার নিজস্ব। তৎসম শব্দগুলিতে প্রতিভাত হয়েছে মূলত তাদের ব্যক্তার্থ বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ (denotation); অন্যদিকে অধিকাংশ বাংলা শব্দগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের জাত্যর্থ বা লক্ষ্যার্থ (connotation)।
কোন সংখ্যাবাচক শব্দ নিয়ে গঠিত সমাসবদ্ধ শব্দ স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ করবে সেই সংখ্যক বিষয় বস্তু ভাব বা ব্যক্তিকে। যেমন : একতলা, দোতলা, তিনতলা, ত্রিজগৎ — স্বর্গ মর্ত্য পাতাল, চতুর্বেদ — ঋক্ সাম যজুঃ অথর্ব, পঞ্চপাণ্ডব — যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল সহদেব, ষড়ঋতু — গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত, সপ্তাহ — সপ্ত অহ: অর্থাৎ রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র ও শনিবার, অষ্টপ্রহর — দিবারাত্রির আটটি বিভাগ, নবগ্রহ — সূর্য চন্দ্র মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র শনি রাহু ও কেতু অথবা বুধ শুক্র পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস নেপচুন ও প্লুটো; দশাবতার — মৎস্য কূর্ম বরাহ নৃসিংহ বামন রাম বলরাম, পরশুরাম, বুদ্ধ ও কল্কি।
এই তালিকায় যোগ করা যেতে পারে একতরফা একচালা একমুঠো একশৃঙ্গ একবস্ত্র বা একবাস একনিষ্ঠ একপত্নীক একদেশদর্শী দুপেয়ে দুআনি দোচালা দোফসলি দোভাষী দোমোহানি দুতরফা ইত্যাদি।
বেশি সংখ্যক হলেই সমাহার বা সমষ্টি। এই সমষ্টি কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে-কোন সাধারণ সমষ্টি নয়, এরা বিশিষ্ট বা নির্দিষ্ট। যেমন: ত্রিকাল — অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, ত্রিগুণ — প্রকৃতির তিন ধর্ম বা গুণ সত্ত্ব রজঃ তমঃ, চতুরাশ্রম — ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বানপ্রস্থ সন্ন্যাস, পঞ্চকন্যা — অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী, পাঁচফোড়ন — জিরে কালোজিরে মেথি মৌরি রাঁধুনি (যদিও সাধারণত জিরে আর রাঁধুনি বাদ), ষড়রিপু — কাম ক্রোধ লোভ মদ মোহ মাৎসর্য, সপ্তর্ষি — মরীচি অত্রি অঙ্গিরা পুলস্ত্য পুলহ ক্রতু বশিষ্ঠ, সপ্তস্বর — ষড়জ ঋষভ গান্ধার মধ্যম পঞ্চম ধৈবত নিষাদ, অষ্টধাতু — সোনা রূপা তামা পিতল কাঁসা রাং (টিন) সিসা লোহা, নবরত্ন — মুক্তা মাণিক্য বৈদূর্য গোমেদ বজ্র বিদ্রুম পদ্মরাগ মরকত নীলকান্ত, দশকর্ম — হিন্দুদের দশরকম সংস্কার যথা গর্ভাধান পুংসবন সীমন্তোন্নয়ন জাতকর্ম নামকরণ অন্নপ্রাশন চূড়াকরণ উপনয়ন সমাবর্তন বিবাহ। এই তালিকায় যোগ করা যেতে পারে ত্রিবেণী ত্রিদোষ ত্রিপাপ চতুরঙ্গ চতুর্বর্ণ চতুষ্পাঠী পঞ্চপল্লব, পঞ্চবটী, পঞ্চগব্য, ষড়দর্শন, সপ্তসাগর, অষ্টবসু, নবপত্রিকা দশমহাবিদ্যা ইত্যাদি।
কোন কোন শব্দ আবার শুধুমাত্র সমষ্টি না-বুঝিয়ে সেই সংখ্যা বা সমষ্টিধারী ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে। যেমন: একতারা, দোতারা, দুসুতি (কাপড়), দোনলা (বন্দুক), ত্রিনয়ন/ত্রিনেত্র/ত্রিলোচন — শিব, ত্রিশূল — তিনফলা যুক্ত শিবের অস্ত্র, চতুরানন — ব্রহ্মা, পঞ্চমুখ/পঞ্চানন — শিব, পঞ্চনদ — পঞ্জাব, পঞ্চপ্রদীপ — আরতির জন্য পাঁচমুখ বিশিষ্ট প্রদীপ (কিন্তু পঞ্চপাত্র — পূজায় ব্যবহৃত তাম্রপত্র, পাঁচের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই), ষড়ানন — কার্তিক, সপ্তপর্ণ — ছাতিম, দশানন — রাবণ। সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই তিন গুণের সমষ্টি ত্রিগুণ, কিন্তু তার অধিকারিণী ত্রিগুণা — বিশিষ্টার্থে দুর্গা।
আলোচিত এইসব শব্দগুলোতে সংখ্যার নিজস্ব অর্থই প্রকাশ পাচ্ছে। এদের অধিকাংশই তৎসম। সংখ্যা নিয়ে বাংলার নিজস্ব শব্দ অথবা শব্দবন্ধ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যার নিজের অর্থ ছাপিয়ে বিশেষ অর্থবাহী। এক দিয়েই শুরু করা যাক। ধরা যাক, একঘরে কিংবা এককাট্টা। একঘরে হল জাতিচ্যুত বা সমাজচ্যুত। এককাট্টা বলতে বোঝায় এক উদ্দেশ্যে বা যুক্তিতে দলবদ্ধ। কথাটা এসেছে হিন্দি 'ইকট্ঠা' থেকে। তেমনি একচোখো মানে একচক্ষুবিশিষ্ট নয় (যেমন একচক্ষু হরিণ) — এর মানে পক্ষপাতদুষ্ট। এরকমই বিশেষ অর্থবাহী আরো শব্দ:
একচুল - লেশমাত্র, একচ্ছত্র - পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী, একনায়ক - একচ্ছত্র নেতা, একঘেয়ে - নূতনত্ব বর্জিত, একরাশ - প্রচুর/স্তূপীকৃত, একশেষ - চূড়ান্ত, একবাক্যে - সর্বসম্মতিক্রমে, একবগ্গা - একগুঁয়ে, একরোখা - ক্রুদ্ধস্বভাব, একবর্ণ - কিছুমাত্র, একহারা - রোগা, একমনে - একাগ্রতার সঙ্গে, একটুকু - সামান্য, একগাল - গালপর্যন্ত বিস্তৃত (হাসি), একগলা - পেট থেকে গলা পর্যন্ত, একপেট - পেটভর্তি, একলাফে - অতি দ্রুত, একলষেঁড়ে - স্বার্থপর।
একচুলের মতো একরত্তিও বোঝায় একটুখানি। 'রত্তি' এসেছে ওজনের পরিমাপ 'রতি' থেকে, যা সোনা ওজনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় একটা কুঁচফলের ওজনে। আশি রতিতে এক তোলা বা এক ভরি - বর্তমান কালের ওজনে ১১.৬৬৪ গ্রাম। প্রসঙ্গত, সোনা ওজনে ব্যবহৃত হতো আর এক পরিমাপ 'মাষা' ('মালী কহে এক মাষা/ স্বর্ণ পাব মনে আশা' — রবীন্দ্রনাথ), যা এক তোলার এক দশমাংশ। আমরা 'একদম' আর 'একদমে' দুটো শব্দই ব্যবহার করি। এদের অর্থ কিন্তু বিভিন্ন — একদম বলতে বোঝায় একেবারেই বা মোটেই, একদমে অতিদ্রুত। একান্ন হল পঞ্চাশের পরবর্তী সংখ্যা, কিন্তু একান্নবর্তী এক পরিবারভুক্ত — যেখানে একই অন্ন ভাগ করে খাওয়া হয়। একচেটিয়ার অর্থ এক ব্যক্তি বা এক প্রতিষ্ঠানের আয়ত্ত এমন। কথাটা এসেছে শ্রেষ্ঠী থেকে - শ্রেষ্ঠী > চেট্টি > চেটিয়া। তামিলনাড়ুতে চেট্টিয়ার আর কর্ণাটকে শেঠি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পদবি। উত্তর ভারতে শ্রেষ্ঠী হয়েছে শেঠ। বাগ্ধারায় 'এক'-এর প্রয়োগ পাচ্ছি 'এক আঁচড়ে', যার অর্থ সামান্য দেখেশুনে বা পরীক্ষা করে - 'এক আঁচড়ে বুঝে গেছি'। 'এক ক্ষুরে মাথা কামানো' বলতে বোঝায় একই দলভুক্ত হওয়া। 'একহাতে কাজ করা'র অর্থ আর একটা হাতকে কাজে না-লাগানো নয়, কোন কাজ কারোর সাহায্য না-নিয়ে নিজে নিজে করা। তেমনি কেউ যদি একহাত দেখে নিতে চায়, বুঝতে হবে সে একটা প্রতিশোধ নেবার কথা বলছে।
দুই-এর ঘরে এসে পাচ্ছি দুমুখো দুফলা দুমুঠো দুপাত্তর দু-পা দুটো পয়সা ইত্যাদি। দুমুখো বললে যেমন দুইমুখবিশিষ্ট (ছুরি) বোঝায়, আবার বোঝায় এমন লোককে যে দুরকম কথা বলে। দুফলা হল দুই ফলাবিশিষ্ট, কিন্তু দোফলা বছরে দুবার ফল দেয় এমন (আম) - জমির ক্ষেত্রে দোফসলি। দোআঁশলা বোঝায় বর্ণসংকর (কুকুর), আবার দুরকম পদার্থের মিশ্রণজাত (মাটি)। দুই কথাটির মধ্যে কোন ক বর্ণ না-থাকলেও একা বা একলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলা হয় দোকা কিংবা দোকলা। দ্বিধার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দুই ভাগে বিভক্ত ('ধরণী দ্বিধা হও'), কিন্তু বহুল ব্যবহৃত সংশয় বা মনের ইতস্তত ভাব বোঝাতে ('হে মাধবী দ্বিধা কেন' - রবীন্দ্রনাথ)। দ্বিরাগমনের অর্থ দুবার আগমন হলেও তা বিশেষভাবে বোঝায় বিয়ের পর বধূর দ্বিতীয়বার পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে আগমন। দ্বিজ দুবার জন্মেছে এমন, কিন্তু বিশেষভাবে বোঝায় উপনয়ন-নিষ্পন্ন ব্রাহ্মণকে।
দুকথা শোনানো ঠিক দুটো কথা নয়, কড়া কথা শোনানো। দু-পা যাওয়া দুমুঠো বা দুপাত্তর খাওয়া ঠিক সংখ্যানির্দিষ্ট গমন ভক্ষণ বা পান নয়, এরা স্বল্পতার সূচক। 'দুটো পয়সার মুখ দেখা' কিন্তু স্বল্পতা বা প্রাচুর্য দুটোই বোঝাতে পারে। 'অনেক কষ্ট করে সে এখন দুটো পয়সার মুখ দেখছে', আর 'দুটো পয়সার মুখ দেখে সে এখন ধরাকে সরাজ্ঞান করছে' — দুটি বাক্যে এই পার্থক্য প্রতীয়মান। 'দুই দুই করা' বলতে বোঝায় পক্ষপাতিত্ব - তৎসমে দ্বিচারণ। দ্বিচারিতা কিন্তু একই সঙ্গে দুজনের সাথে প্রণয়। বাংলা বাগধারায় দু-নম্বরি হালফিলের আমদানি। ব্যবহার ভেদে এর অর্থের ভিন্নতা রয়েছে — দু-নম্বরি লোক হল দুর্নীতিপূর্ণ লোক, দু-নম্বরি কারবার হল বে-আইনি কারবার, দু-নম্বরি মাল হল নকল জিনিসপত্র।
আরো এগিয়ে যাওয়া যাক। একলাফের মতো তিনলাফে পালিয়ে আসার অর্থ অতি দ্রুত চলে আসা। যখন বলা হয় 'তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে' তখন তিনকাল তৎসম ত্রিকালের সমর্থক নয় — অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ না-বুঝিয়ে বোঝায় শৈশব যৌবন প্রৌঢ়ত্ব। 'তিনমাথা যার/ বুদ্ধি নেবে তার' — এই তিনমাথার অধিকারী বয়োবৃদ্ধ, বসার সময়ে যার উত্থিত দুই হাঁটু মাথার বরাবর চলে আসে। তেমাথা কিন্তু তিনরাস্তার সংযোগস্থল - যেমন চৌমাথা পাঁচমাথা। তেএঁটের সঙ্গে তিন আঁটির তালের কোন সম্পর্ক নেই, এর মানে হল কুচক্রী বদমাশ। দু-নম্বরির মতো ইঙ্গ বঙ্গ মিশিয়ে হয়েছে তিন ডবল চার ডবল — যথাক্রমে তিনগুণ আর চারগুণ বোঝাতে, যদিও এদের সরাসরি অর্থ হওয়া উচিত ছয়গুণ আর আটগুণ। চৌকাঠ যে-কোন চার কাঠের টুকরো নয় — ঘরের দরজার চার কাঠের ফ্রেম, আরও বিশিষ্ট অর্থে সেই ফ্রেমের নীচের আনুভূতিক অংশ। চার কোণ বিশিষ্ট কোন জিনিসের নাম হয়েছে চৌকো, যেটা আবার অনেকের সবিশেষ বর্ণনায় হয়ে দাঁড়ায় চারচৌকো। 'চারচাকা' মানেই গাড়ি, কিন্তু চৌঘুড়ি যে চার ঘোড়ায় টানা গাড়ি তা আমরা মনে রেখেছি কি? এ হল জুড়ি গাড়ির অভিজাত সংস্করণ। বলা বাহুল্য, জুড়ি চৌঘুড়ি দুইই এখন প্রায়-অবলুপ্ত। তেমনি 'পোয়া' এক অবলুপ্ত পরিমাপ, কিন্তু শব্দটি অবলুপ্ত নয় — চারপোয়া পাপ বা পুণ্য বলতে এক সের না-বুঝিয়ে তখনকার মতো এখনও বোঝায় পাপে বা পুণ্যে পরিপূর্ণ। কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো হলেও আমরা বলি চৌচির হল, যার অর্থ চার খণ্ড হওয়া। দুঃখে বা বিরহে হৃদয়ও চৌচির হয়, বুক ফাটার মতো রূপকার্থেই। অন্যদিকে হৃদয় ভরে ওঠে চার চক্ষু এক হলে বা চার চোখের মিলন হলে — এই শুভদৃষ্টি কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়।
'পাঁচজনে পাঁচকথা বলবেই' — বোঝাই যাচ্ছে এই পাঁচজন পাঁচ সংখ্যাতেই সীমিত নয়, যেমন 'দশে মিলি করি কাজ'। পাঁচকথা নানাকথা। পাঁচকথা পাঁচকান হয়, অর্থাৎ লোকসমাজে ছড়িয়ে পড়ে। 'পাঁচটা কথা শোনানো' কিন্তু কটুকাটব্য। পাঁচজন থেকেই এসেছে পঞ্চায়েত, কিন্তু কাউকে 'পঞ্চায়েতি করতে এসো না' বলার অর্থ তাকে মোড়লি করতে বারণ করা হচ্ছে। পঞ্চভূত আর পাঁচভূত এক নয়। পঞ্চভূত হল জগতের উপাদান — ক্ষিতি অপ্ তেজ মরুৎ ব্যোম। কারোর সম্পত্তি পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খাচ্ছে বললে বোঝায় পরিবারের বাইরের লোকজন অন্যায়ভাবে উপভোগ করছে। পঞ্চত্বপ্রাপ্তি কিন্তু যথাযথ পঞ্চভূতে মিলে যাওয়া, অর্থাৎ মৃত্যু। পঞ্চব্যঞ্জন বা পাঁচপদে খাওয়া ঠিক পাঁচ সংখ্যায় সীমিত নয়। কয়েকটি বাগধারা পাচ্ছি যেখানে সংখ্যাবাচক শব্দটির প্রয়োগ বিভ্রান্তিকর। কেউ বাড়াবাড়ি করলে বলা হয় 'সাপের পাঁচ পা দেখেছ?' — সাপের এক পা বা দু-পা বললেও তো সেই একই অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা বোঝানো যেত! কারোর সৌভাগ্য বর্ণনায় বলা হয় 'তার এখন পাথরে পাঁচ কিল' — কিলের সংখ্যাকে পাঁচেই বা বেঁধে দেওয়া হল কেন! 'সাতখুন মাফ' হল কারোর গুরুতর অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া, আক্ষরিকভাবে খুনের অপরাধ নয়। কিন্তু এ-ক্ষেত্রেই বা অন্য কোন সংখ্যা নয় কেন, যেমন সাত চড়ে রা না-বেরোনোর ক্ষেত্রেও। 'সাত সতিনের ঘর' হল যে-সংসারে চুলোচুলি লেগে আছে — এখানেও সংখ্যায় দু একটা কমবেশি হলেও তো একই ফল হতো। সাত নিয়ে আরো বাগধারা রয়েছে। 'সাতে পাঁচে না-থাকা' - নির্লিপ্ত থাকা, কিন্তু 'সাত পাঁচ কী ভাবছ?' বললে বোঝাবে দিনের শুরুতেই অহেতুক নানাকথা কী ভাবছ'। কোন বই-এর নাম যদি হয় 'বাংলা ভাষার সাত সতেরো', তাহলে তাতে বাংলাভাষা নিয়ে নানাকথার অবতারণা বা আলোচনা আছে — এবং সেগুলো অহেতুক নয়। 'সাত পাকে বাঁধা'র অর্থ কি বিশদ করার দরকার আছে বাঙালির কাছে!
আটে পাচ্ছি আটপৌরে - অষ্টপ্রহর বা সদাসর্বদা ব্যবহার করা যায় এমন; আটকড়াই - জন্মের আটদিনের অনুষ্ঠান যেখানে আটরকম কড়াই-এর উপচার। আটকপালে বা আটকপালি বলতে বোঝায় হতভাগা বা হতভাগি। আহ্লাদে আটখানা হবার অর্থ আট টুকরো হওয়া নয়, আনন্দে অধীর হওয়া। আটঘাট বেঁধে চলা মানে সমস্ত দিক সামলে চলা। অষ্টরম্ভা মানে আটটা কলা নয় - এর অর্থ 'কিছুই নয়', ঘোড়ার ডিম। নয় আর ছয় নিয়ে নয়ছয়, যা বোঝায় বিশৃঙ্খল অবস্থা। শুধু ছয় নিয়ে বিশেষার্থক শব্দ কিছু পাচ্ছি না। ছয়লাপ বলে বাংলায় যে শব্দ ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে ছয়ের সম্পর্ক নেই — কথাটা এসেছে ফারসি 'সয়লাব' থেকে, এর অর্থ পরিপূর্ণ বা ছেয়ে গেছে এমন। দশ নিয়ে পাচ্ছি দশমীদশা, যার অর্থ শেষ অবস্থা — দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীই সম্ভবত এর উৎস। পাঁচকথা শোনানোর মতোই দশকথা শোনানো। দশচক্রে ভগবান ভূত বলতে বোঝায় দশজনের চক্রান্তে ভালো লোককে খারাপ প্রতিপন্ন করা।
দশের পরবর্তী বিপুল সংখ্যাভাণ্ডার থেকে খুব কম সংখ্যাই এসেছে বাংলা বাগধারায়। রয়েছে বারো ভূত - পাঁচ ভূতের মতোই অনাহূত বাইরের লোকজন, উনিশ বিশ - অতি সামান্য পার্থক্য, সাড়ে বত্রিশ ভাজা - ভিন্নধর্মী জিনিসের বা কাজের মিশ্রণ, যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন - খুব কম পার্থক্য। আর আছে বহুসংখ্যক বোঝাতে শঙ্খ পরার্ধ নয় - শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে, কোটি কোটি - এই কোটি পর্যন্তই।
সংখ্যাবাচক শব্দের আর একটি শ্রেণিবিভাগ আছে, যারা ক্রমনির্দেশক, যেমন — প্রথম দ্বিতীয় নবম দশম বিংশ ত্রিংশ ইত্যাদি। এদের বলা হয় পূরণ বাচক সংখ্যা (ordinal numbers)। এরা সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় বিশেষণ হিসাবে — দ্বিতীয় ভাগ, চতুর্থ শ্রেণি, নবম অধ্যায়, বিংশ শতাব্দী। দ্বিতীয়া থেকে শুরু করে চতুর্দশী — এরা তিথির নাম। তিথি হিসাবে কিন্তু প্রথমা উল্লিখিত হয় না, তার পরিচিতি প্রতিপদ নামে। আবার চতুর্দশীর পরের তিথি পঞ্চদশী নয় — অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমা, যদিও ষাটের দশকের এক জনপ্রিয় গানে পেয়েছি 'আকাশে পঞ্চদশীর চাঁদ'। পঞ্চদশী যথার্থভাবে বোঝায় পঞ্চদশবর্ষীয়া ('ওগো তুমি পঞ্চদশী, পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে'—রবীন্দ্রনাথ)। অনুরূপ অর্থে ত্রয়োদশী চতুর্দশী ষোড়শী সপ্তদশী অষ্টাদশী। লক্ষণীয়, এগুলোর সমতুল্য কোন পুংলিঙ্গ শব্দ নেই; অনেকখানি পেরিয়ে যেটা আছে সেটা হল বাহাত্তুরে, যার অর্থ খুব প্রীতিপ্রদ নয় — ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধ।
গ্রন্থ সহায়তা :
সংসদ বাংলা অভিধান ।