• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৩ | জুন ২০১৬ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • দুই বুড়োর গঙ্গাযাত্রা : রাহুল মজুমদার


    গোমুখ

    ছাব্বিশে অক্টোবর, দু হাজার পনেরো

    রাত সাড়ে আটটা

    সূচনা হলো দুই বুড়োর (একজন বাষট্টি, অন্যজন ঊনসত্তর) গঙ্গাযাত্রার। ছাড়ল দুন এক্সপ্রেস।

    সাতাশে অক্টোবর

    সকাল পাঁচটা পঞ্চান্ন

    কোডারমা পেরোল।

    সকাল ছটা চুয়ান্ন

    গয়া আগয়া — শুধু চা নেহি আয়া।

    সকাল সাতটা একুশ

    কষ্ট। অপেক্ষার কষ্ট।

    সকাল আটটা একান্ন

    অনুগ্রহনারায়ণ রোড। প্রায় প্যাসেঞ্জার এই ট্রেন চা-ওলাদের অনুগ্রহরহিত।

    সকাল ন-টা সাতাশ

    ডেহরি- অন- সোন। আগাছার জঙ্গলভর সোন ‘নদী’ পার করেও চায়ের দেখা নেই।

    সকাল ন-টা ছেচল্লিশ

    সাসারাম। চা না পেলেও ব্রেকফাস্ট জুটল।

    সকাল দশটা তিপ্পান্ন

    কর্মনাশা। চা না পেয়ে সর্বনাশা।

    সকাল এগারোটা বেয়াল্লিশ

    মুঘলসরায়। স্বাগত উত্তরপ্রদেশ। এবার যদি চা জোটে!

    দুপুর বারোটা আটচল্লিশ

    বারাণসী। অবশেষে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটল — চা, না পেলেও কফি জুটল।

    বিকেল পাঁচটা পাঁচ

    রামরাজত্বে, মানে অযোধ্যায়।

    রাত ন-টা ছাব্বিশ

    অব ছোড় চলে লখনউ নগরী —

    আঠাশে অক্টোবর; ভোর পাঁচটা ঊনপঞ্চাশ

    মুরাদাবাদ জিন্দাবাদ; ঘুম থেকে উঠেই চা — আহ্।

    সকাল আটটা সাত

    মুয়জ্জমপুর নারায়ণ — নাম বটে!

    সকাল আটটা আটত্রিশ

    লক্সর।

    সকাল ন-টা সাতচল্লিশ

    হরিদ্বার। গঙ্গাযাত্রার প্রথম পর্বের সমাপ্তি।

    সকাল দশটা দশ

    আলুর পরোটা সম্বল করে দুই বুড়ো উত্তরকাশীর বাসে।

    দুপুর বারোটা চল্লিশ

    ঋষিকেশ, অগ্রখাল, ফকোট, খাড়ী পেরিয়ে পেটপুজোর বিরতি সেলুপানিতে।

    বেলা একটা আঠারো

    এবার বাসের পেটপুজো। তেল খেয়ে চাঙ্গা হয়ে বাস আবার গা-ঝাড়া দিল।

    বেলা একটা চল্লিশ

    চম্বা। ইনি হিমাচলী নন, গঢ়ওয়ালী চম্বা।

    বেলা দু-টো দশ

    খারকোট। কার কোট?

    বেলা দু-টো বাইশ

    খাদের ধার ঘেঁষে এসে সুলিয়াধার পার করল বাস।

    বেলা দু-টো ছত্রিশ

    এত কাণ্ড করে কান্ডীখাল।

    বেলা পৌনে তিনটে বাজতে একমিনিট

    অলেঝ! অ-লেজ হলেও বুঝতাম।

    বেলা পৌনে তিনটে বেজে দুমিনিট

    রত্নোগাড। কোথায় বা রত্ন, কোথায় বা গার্ড!

    বেলা তিনটে তেরো

    কমান্দ। মানে কী? কম্যান্ড!

    বেলা তিনটে তিপান্ন

    টানা চল্লিশ মিনিট দৌড়ের পর কন্ডীসৌর।

    বিকেল চারটে একুশ

    চিনিয়ালিসৌড় পীপলমন্ডী। নাম বলতে বলতে পার হয়ে গেল জায়গাটা।

    বিকেল চারটে ছত্রিশ

    বড়েথি বা ধরাসু পেরিয়ে গেলাম ‘সুঁ’ করে।

    বিকেল পৌনে পাঁচটা

    ধরাসু বেন্ড। যমুনোত্রী, বড়কোটের যাত্রীরা নেমে পড়ল। সুয্যিমামাও নেমে পড়েছেন — পাহাড়ের আড়াল হওয়ার তাল ।

    বিকেল পাঁচটা সাত

    ডুন্ডা। গুণ্ডার বড়ভাই নাকি?

    বিকেল পাঁচটা চব্বিশ

    নাকুরি। বাচেন্দ্রি পাল-এর জন্মস্থানকে না করতেই হলো।

    বিকেল পাঁচটা বত্রিশ

    মাতলী। ইন্দ্রের সারথি এখানে!

    ‘প্রায়’ সন্ধে পাঁচটা তেতাল্লিশ

    সুড়ঙ্গ পেরোচ্ছি — মানে উত্তরকাশী আলারে।

    সন্ধে পাঁচটা ঊনপঞ্চাশ

    উত্তরকাশীমেঁ উতরা।

    ‘রাত’ সাতটা সতেরো

    চিরকালের ভান্ডারী হোটেলেই রাত কাটানো। দিনের ব্যস্ত উত্তরকাশী এখন বিশ্রামের উদ্যোগ নিচ্ছে।

    রাত আটটা নয়

    গোটা উত্তরকাশীর সঙ্গে আমরাও নিস্তব্ধ; রাস্তার আলোগুলো পর্যন্ত ঝিমোচ্ছে। শুধু বিনিদ্র ভাগীরথী ছুটে চলেছে নিরন্তর।

    ঊনতিরিশে অক্টোবর; সকাল ছ-টা

    সকালের চা-টা ঘুম, শীত দুটোই ভাগায়। পরপর দু’গ্লাস লাগল ধাতস্থ হতে।

    সকাল সাতটা বত্রিশ

    বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে গঙ্গোত্রীর বাসের পেটে। তার আগে নিজেদের পেটে আলুর পরোটার পুলটিস দিয়েছি।

    সকাল সাতটা পঞ্চান্ন

    উত্তরকাশী গা ঝাড়া দিয়েছে — পথে লোকজনের ব্যস্ত আনাগোনা। আমাদের বাসও গা ঝাড়া দিল।

    সকাল আটটা পাঁচ

    গঙ্গোরী। এখান থেকে আগোড়া হয়ে পা চালিয়ে যাওয়া যায় ডোড়িতাল। আমরা অসিগঙ্গা (?) পেরোলাম।

    সকাল আটটা দশ

    গণেশপুর। সবে আড়মোড়া ভাঙছে সূর্যকিরণের পরশ পেয়ে।

    সকাল আটটা এগারো

    নেতালা। বাস জোরসে চালা।

    সকাল আটটা উনিশ

    হিনা। কাউকেই তো দেখি না!

    সকাল আটটা তেইশ

    মনেরি। ভাগীরথী বাঁধে বাধা পেয়ে শরীর ছড়িয়েছে।

    সকাল আটটা তেত্রিশ

    নলুনা। না-লুনা, না নলু-না?

    সকাল আটটা চল্লিশ

    আলোছায়া মাখতে মাখতে লাটাসেরা।

    সকাল আটটা চুয়াল্লিশ

    মল্লা ভটওয়াড়ি।

    সকাল আটটা আটান্ন

    বেশ খানিক নেমে এসে ভটওয়াড়ি। বেশ গঞ্জ।

    সকাল ন-টা আঠারো

    হেলগু গাডকে টপকানো গেল।

    সকাল ন-টা চব্বিশ

    সুনগর। এত তাড়াতাড়ি পেরোলো যে, সু না কু বোঝার সুযোগই পেলাম না।

    সকাল ন-টা উনত্রিশ

    গঙ্গানানী। গতবারের মতো এবারও এই ঊষ্ণ-প্রস্রবনের পাশে বসে চা-পকোড়ায় ঊষ্ণ হলাম।

    সকাল ন-টা তেতাল্লিশ

    লোহারী নাগ। ভাগ বাপ ভাগ!

    সকাল দশটা ষোলো

    সুখী। দুঃখী হওয়ার কোনও কারণ তো চোখেই পড়ল না।

    সকাল দশটা একুশ

    পেরোলাম জসপুর বেন্ড।

    সকাল দশটা আঠাশ

    আবার নদী পার।

    সকাল দশটা চল্লিশ

    হরশিল। আবার মুগ্ধ হলাম। আবার আফশোস থাকতে না পারার। ছায়ামাখা শীতল পথ।

    সকাল পৌনে এগারোটা

    ধরালী। ছোট্ট জনপদটা বড়ই মনোমুগ্ধকর। এখান থেকে সাততাল যাওয়া যায়।

    সকাল এগারোটা তিন

    আবার নদীলঙ্ঘন।

    সকাল এগারোটা এগারো

    লঙ্কা। রাবণের দেখা মিলল না এবারও। চট করে চলে এলাম নদীর এপারে নিরাপদেই। পথ কিন্তু চড়ছে। বাসের গজগজানি বাড়ছে। নদী পেরিয়েই জঙ্গলঘেরা ভৈরোঘাঁটী। ভৈরব মন্দিরে ভক্তরা পেন্নাম ঠুকল। গঙ্গা-মাকে দেখতে গেলে নাকি এঁর কাছ থেকে ক্লীন-চিট নিতে হয়।

    সকাল এগারোটা একচল্লিশ

    আবার গঙ্গোত্রী। বাস থেকে নামতেই গঙ্গোত্রী শীতল (আক্ষরিক অর্থে) অভ্যর্থনা জানাল। গঙ্গাযাত্রার দ্বিতীয় পর্বের এখানেই ইতি।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা

    আবার সেই কীর্তিলোক হোটেলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

    বেলা দুটো বাইশ

    গোমুখের অনুমতিপত্র (পারমিট) জোগাড় করলাম।

    সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা

    দিনটা ঘুরে ফিরেই কাটল। সেই গঙ্গামন্দির, ভগীরথের তপস্যাস্থল, মহাদেবের জটা থেকে ভাগীরথীর সূর্যকুণ্ডে ঝাঁপ, দোকানপাট, সুদর্শন আর পুণ্যতোয়া ভাগীরথী। পুরানো হয় না। সন্ধ্যা হতেই সূয্যিমামা ডুব দিয়ে লেলিয়ে দিলেন শীতবুড়োকে। এখনই ৭.৪ ডিগ্রি। রাতে আরও নামবে।

    রাত আটটা সাত

    রাতের খাওয়া সারা। চার ডিগ্রির ঠাণ্ডা ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকিয়ে ছাড়ল।

    তিরিশে অক্টোবর; ভোর চারটে চৌত্রিশ

    ঘুম ভেঙে টের পেলাম ঘরের ভেতরেই ১.৭ ডিগ্রি। বাইরে না জানি কত!

    সকাল সাতটা সতেরো

    পরপর দু গ্লাস চা গিলে কাঁপুনি কমানো গেল।

    সকাল আটটা তিন

    গোমুখের পথে পা পড়ল দুই বুড়োর।

    সকাল আটটা সাত


    গঙ্গোত্রী মন্দিরের সামনে থেকে

    মন্দির চত্বর এখন জনশূন্য — না, শূন্য নয়, আমরা ছাড়াও জনা তিনেক হাজির এই পাঁচ ডিগ্রির ঠাণ্ডায়। এবার সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। সুদর্শন আর মাতৃশিখর অভয় দিল।

    সকাল আটটা বাইশ

    পা-ভাঙা সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম মূল পথে। শুরু হোলো দুই বুড়োর গঙ্গাযাত্রার ফাইনাল পর্ব।

    সকাল আটটা ঊনপঞ্চাশ

    ডানদিকে ভাগীরথীর উদ্দাম নাচের ওপারে জঙ্গল-জড়ানো পাহাড় উঠে গেছে আকাশে; সুদর্শনের পুরোটা দর্শন করা যাচ্ছে। বাঁদিকেও অরণ্য আকাশ ছুঁয়েছে। মাথার দিকে গাছপালা ঝেড়ে ফেলে ন্যাড়া পাথর দাঁত বের করে হুমকি দিচ্ছে। এসে পড়েছি কনখু। এখানে মন্দির আর আশ্রম ঘেঁষে ‘গঙ্গোত্রী জাতীয় উদ্যানে’র প্রবেশদ্বার।

    সকাল আটটা আটান্ন

    পারমিট দেখিয়ে পাথর বাঁধানো পথ ধরে আবার এগিয়ে চলা দুলকি চালে।

    সকাল ন-টা চোদ্দো

    এতক্ষণ চা-হীন চলন অসহ্য — অতএব চা-বিরতি। আসলে ফ্লাস্ক থেকে গ্লাস হয়ে গলা পর্যন্ত চা যাওয়ার ফাঁকে বিশ্রাম।

    সকাল দশটা ছয়

    আবার চা-স্টপ, আবার বিশ্রাম। ফ্লাস্ক ফাঁকা হলো।

    সকাল এগারোটা উনিশ

    পায়ের নিচের পাথরের বাঁধুনি এখন অনেক আলগা। প্রথম দিনের হাঁটায় আমি চিরকালই ল্যাবেন্ডুশ। ধপ করে পথের ধারের পাথরে বসে পড়লাম। গলা শুকিয়ে উঠেছে। চা শেষ, জল আনা হয়নি। এর ফল ভুগতে হবে। কনখু থেকে সঙ্গী হয়েছেন ধর্মরাজ। এমন নিষ্পৃহ নিষ্কাম কুকুর জন্মে দেখিনি।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা

    গলা যে শুকিয়ে কাঠ। এপারের পাহাড়ে গাছপালারা বড়ই সংখ্যালঘু, তাই ছায়ারও দেখা নেই। চীড়বাসা এখনও ঘন্টা আড়াইয়ের পথ। ছায়ার বরফের ছোঁয়া থাকলেও রোদ বড় চড়া। ধর্মরাজের কি তেষ্টাও পায় না!

    বেলা বারোটা ঊনপঞ্চাশ

    এ কী দেখছি! সাক্ষাৎ অমৃতধারা। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝিরঝিরিয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। জলই যে জীবন, তার আজ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। প্রাণ ঠাণ্ডা করে ঠাণ্ডা জল খেলাম। ধর্মরাজ নির্বিকার।

    বেলা একটা ছত্রিশ

    বোল্ডার ভরা পথ ঝোরাকে নড়বড়ে অস্থায়ী সাঁকোয় টপকে দোতলা সমান বোল্ডারের স্তূপে হারিয়ে গেছে। ওপাশে চীরগাছের বন উঁকি মারছে। ধর্মরাজ বরফ গলা জলেই তেষ্টা মেটালেন।

    বেলা একটা বিয়াল্লিশ

    চার হাত পায়ে বোল্ডার বেয়ে উঠে আবার পথের দেখা পেলাম। অনেকক্ষণ বাদে চোখ জুড়ানো সবুজ দেখে মন ভরে গেল।

    বেলা পৌনে দু-টো


    চীড়বাসা

    চীড়বাসার অস্থায়ী আস্তানা — লোহার ফ্রেম ঘিরে পলিথিনের দেওয়াল ছাদ। এত পরিশ্রমের পর মনে হচ্ছে স্বর্গপুরী। আজ এখানেই ইতি। পাদমেকং ন গচ্ছামি। চটীওয়ালারাও শেষ দিনে এমন অযাচিত দুই খদ্দের পেয়ে মহাখুশি। আজই ওদের এখানে এবছরের মতো শেষ দিন।

    বেলা দুটো

    একটু ধাতস্থ হতে সামনের চীড়বনটা চোখে পড়ল। পিছনে নদীর ওপারেই চীড়বাসা শৃঙ্গ। ৩৬০৯ মিটারে বসে খিদের মুখে আলুপরোটা অমৃতসমান বলে মনে হচ্ছে। ফেলে আসা পথের ও-প্রান্ত থেকে শ্রীকন্ঠ শৃঙ্গ আমাদের নিরাপদ দেখে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল। ধর্মরাজ আমাদের যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে নিশ্চিন্তে রোদ্দুর পোয়াতে বসল।

    বেলা চারটে চোদ্দো

    চীড়বনে ঘুরে বসে সময় কাটছে। সুয্যিমামার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও নেমেছে ৭.৫ ডিগ্রিতে। পুণ্যার্থীদের আনাগোনা চলছে, অবশ্য আনাই বেশি গোনার চেয়ে। তাদের লক্ষ্য ভুজবাসা, আরও পাঁচ কিলোমিটার। অতএব বসে দম নেওয়া, জল-চা, আবার চলা। সকলেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঁকে। শুধু একটি দল এলো যারা চীড়বাসাতেই ভাগীরথীর তীরে ক্যাম্প করে থাকবে, তাদের দলনেতা কারাটে দেবু — দেবকিঙ্কর ঘোষ। ওর দলের কয়েকজন অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন, তাই তাকে খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।

    বিকেল পৌনে পাঁচটা

    দেবুর দলের বাকিরাও এসে পড়েছেন। দেবুর চিন্তার অবসান।

    ‘রাত্রি’ ছ-টা ছাব্বিশ

    চারদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু চটীর মধ্যে একখানা সোলার ল্যাম্প আর আগুনের আভা। শুকনো কাঠকুটো দিয়ে শীত তাড়াবার ব্যবস্থা করা হয়েছে — তাপমাত্রা এখন চার ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। চা-পর্ব চলছে।

    রাত পৌনে সাতটা

    একদল তীর্থযাত্রী ভুজবাসার দিক থেকে আঁধার ফুঁড়ে হাজির। এসেই ধপাস — তেলচিটে তোষকে শরীর এলিয়ে দিল। চা-জল-বিস্কুট-বিড়ি আর গল্প চলল মিনিট দশেক; তারপর আঁধার ফুঁড়েই তারা রওনা দিলেন গঙ্গোত্রীর উদ্দেশে। ধন্য সাহস। ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষকে কতটা সাহস ক্ষমতা দেয়, সেটা এই অভিযানে বারবার দেখেছি। সব বয়সের মানুষ, শিশুরাও বাদ নেই, এই দুর্গম পথে চলেছেন নির্দ্বিধায়, অশঙ্কচিত্তে। এঁদের অধিকাংশের কাছে উপযুক্ত গরম পোশাক নেই, নেই পায়ে চটি বা জুতো — পা-ফেটে রক্ত ঝরছে, তবু ভক্তদের মুখের হাসি অমলিন, দেখা হলেই ‘জয় গঙ্গামাঈ’ বলে সম্ভাষণ করতে ভুল হয় না। সত্যিই ভক্তির দুর্বার শক্তি।

    রাত সাতটা সাত

    আগুনের বেড়া টপকে ১.৫ ডিগ্রির শীত অনবরত ধাক্কা মারছে। সামনের দিকটা ঢাকা না হলে কাল সকালে এক জোড়া কুলফি পাওয়া যাবে নির্ঘাৎ। চটীওয়ালারা দিনভর ব্যস্ত ছিল জিনিসপত্র গোটানোয়, এখন ব্যস্ত জমে থাকা জঞ্জাল ধ্বংসে। আমাদের সময় কাটছে আগুন পুইয়ে আর আঁধার মেপে।

    রাত আটটা তেতাল্লিশ

    অবশেষে সামনের দিকটা ঢাকা পড়েছে পলিথিনে। খাবারও পেটে পড়েছে। ডাল, সয়াবিনের সবজি আর গরমাগরম রুটি। তাই শীতের সাময়িক ছুটি। এরপর ঘুমবাবাজীর কোলে উঠে পড়ব। বাইরে এখন শূন্য ডিগ্রিমাখা চাঁদের আলো লুটোচ্ছে চীড়বাসার শরীরে।

    একতিরিশে অক্টোবর; ভোর পাঁচটা পঞ্চাশ

    পলিথিনের আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে এলাম। আকাশ সবে তার কালো আলোয়ানটা কাচতে বসেছে। চাঁদমামা পশ্চিম আকাশ থেকে শূন্য ডিগ্রির ঠান্ডা হাসি পাঠিয়ে দিল। চারদিক নিজ্‌ঝুম, নিস্তব্ধ — ঝিঁঝিরাও বোধহয় কম্বল মুড়ি দিয়েছে। কাল রাতে ভগীরথের আমলের তোষক কম্বলের মাঝে রাত মন্দ কাটেনি। প্রথমবারে পাতবার পর কেউ ভুলেও সেগুলো কাচতে কখনও বোধহয় সাহস পায়নি। তবু এই নির্জনে এই সাড়ে এগারো হাজার ফুটে ঘুমোবার সময় সেকথা একবারও মনে হয়নি।

    সকাল ছ-টা আঠারো

    সূয্যিমামা ওপার থেকে চীড়বাসা শৃঙ্গের বরফে আলপনা এঁকে দিলেন।

    সকাল ছ-টা ছত্রিশ

    চা তৈরি হচ্ছে দেখেই ঠাণ্ডাটা এক ঝটকায় কয়েক ডিগ্রি কমে গেল।

    সকাল সাতটা

    চা-টা খেয়ে তৈরি। চটীওয়ালা বন্ধুরা ব্যস্ত শেষবেলার প্যাকিংয়ে।

    সকাল সাতটা পনেরো

    পলিথিন খোলা শুরু হয়েছে। আজ দুপুরে যারা আসবে, তারা জানবেই না, এখানে কোনও চটী ছিল এতদিন। বেরোবার মুখে বন্ধুরা এক বোতল পেপসি আর বিস্কুট উপহার দিল। সকালটা খু-উ-ব সুন্দর হয়ে উঠল। খুশিমনে পা রাখলাম পথে।

    সকাল সাতটা বাইশ

    পেরিয়ে এলাম বনের মাঝে। বনের মাঝে বনবিভাগের বন্ধ বাংলো। বনটাও ফুরিয়ে এসেছে।

    সকাল সাতটা পঞ্চান্ন

    প্রথম বিশ্রাম। বোল্ডার ফেলা পথ মাড়িয়ে এসে বোল্ডারে বসে পেপসি আর বিস্কুট খেতে খেতে রোদ্দুর মাখা — আহাহা।

    সকাল আটটা চুয়াল্লিশ

    ঊষর পাহাড়ের গায়ে একটা ধ্বসা অঞ্চল পেরিয়ে এলাম। ভাগীরথী অভয় দিল, ‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই’।

    সকাল আটটা পঞ্চান্ন

    একটা জমে যাওয়া নালা টপকালাম। পায়ের তলায় পাথরের গায়ে ভারগ্লাস (পাতলা বরফের আস্তরণ) — সাবধানে চলতে হচ্ছে। তবে পথ এখন অনেকটাই সহজ। দূরে ভৃগুশৃঙ্গের দেখা পেয়ে একটা পেপসি-ব্রেক নিয়েই নিলাম। ভাগীরথীর কলকলানি অব্যাহত।

    সকাল ন-টা নয়

    এই সেই ধ্বস নামা পাথর গড়ানো অঞ্চল। বাঁদিকে পাহাড়ের শুকনো গায়ে অসংখ্য বোল্ডার নেমে আসার জন্য তৈরি প্রতিটা বাঁকে — শুধু উত্তাপ আর বাতাসের ধাক্কার অপেক্ষা। নিচে ভাগীরথী তাদের লোফার জন্য তৈরি।

    সকাল ন-টা উনত্রিশ

    নিরাপদেই পেরিয়ে এলাম রকফলিং জোন। বোল্ডারগুলো দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখালেও নেমে আসেনি। চীড়বাসায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম।

    সকাল ন-টা আটচল্লিশ

    আবার পেপসি-ব্রেক। ভৃগু এখন হাতের নাগালে — যদিও ভাগীরথীর ওপারে। ঠান্ডাটাও বেশ কম — এখন প্রায় সাড়ে সাত ডিগ্রি।

    সকাল দশটা চব্বিশ

    আবার থামতেই হল। চড়াই ভাঙার সময় হঠাৎ দূর থেকে ভাগীরথী শৃঙ্গেরা উঁকি মারলে না থেমে থাকা যায়!

    সকাল দশটা বত্রিশ

    ওই তো নিচে ভুজবাসা (৩৭৯২মি:), ভাগীরথীর নাচ দেখছে।

    সকাল দশটা চল্লিশ

    এমন শীতল নিরুত্তাপ অভ্যর্থনা আশা করিনি লালবাবা আশ্রমে। বর্তমান বাবাজী লালচে চেহারা নিয়ে গেরুয়া সোয়েটার টুপি পরে নির্বিকার চিত্তে রোদ্দুর পোয়াতে লাগলেন — ফিরেও তাকালেন না। বেশ কিছুক্ষণ বাদে তাঁর এক চেলা এসে জানালেন, রাতপিছু মাথাপিছু তিনশো টাকা, আর চা-ফা হবে না। চা খেতে হলে GMVN-এর লজে যেতে হবে। বাবাজী নির্বিকার। এত বছর ধরে পড়ে আসা শুনে আসা আপ্যায়নের একেবারে উলটো ছবি। সোজা বোঝা উঠিয়ে পা বাড়ালাম GMVN-এর দিকে।

    সকাল দশটা বাহান্ন

    GMVN-এ থিতু হলাম। পরিষ্কার গদি দেওয়া খাটে সুন্দর ভাঁজ করা কম্বল, পরিষ্কার বাথরুম। গরম গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনটা ভালো হয়ে গেল।

    সকাল এগারোটা কুড়ি

    পেট ভর্তি করে, মন ভালো করে রওনা হলাম গোমুখের উদ্দেশে।

    সকাল এগারোটা একতিরিশ

    উঠে এলাম মূল পথে। এখান থেকে ভুজবাসাকে ছবির মত লাগছে। এবার গঙ্গাযাত্রার ফাইনাল পর্বের ফাইনাল ট্রেক।

    ঠিক দুপুর হতে দু-মিনিট

    আলগা বোল্ডারে ব্যালান্সের খেলার সাময়িক বিরতি। ডানদিকে নদীর ওপারে শিবলিঙ্গ শৃঙ্গ উঁকি মারছে। ভাগীরথী শৃঙ্গরা আকারে বাড়ছে। ভাগীরথীর রুমঝুম অব্যাহত।

    দুপুর একটা

    বোল্ডারের চড়াই উৎরাই চলছেই। উপত্যকা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। পথ এখন অনেক নিরাপদ। শিবলিঙ্গ আর ভাগীরথীর মাঝ দিয়ে আমাদের চলন।

    দুপুর একটা একুশ

    সোজা বোল্ডার ভরা ‘পথ’ চলে গেছে গঙ্গোত্রী হিমবাহের দিকে। আমরা নেমে চলেছি বিস্তৃত নদীতটের দিকে।

    দুপুর একটা তেইশ

    একটা আধা-মন্দির আধা-আশ্রম গোছের ‘ঘর’ পেরোলাম।

    দুপুর একটা ছত্রিশ


    গোমুখ

    গোমুখ (৩৮৯২মি:)। অবশেষে সফল হলো দুই বুড়োর গঙ্গাযাত্রা। খানিক দূরেই বিশাল হিমবাহের তলা থেকে বেরিয়ে আসছে ‘পবিত্র’ বারিধারা। আমরা পৌঁছবার খানিক আগেই হিমবাহ-প্রান্তের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে গোমুখের ওপর। তারই পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে মুক্তির আনন্দে ছুট লাগিয়েছে কিশোরী ভাগীরথী। তার হিমশীতল জল ছুঁয়ে আর একবার তাকালাম গোমুখের দিকে — কোনও দিক দিয়েই গরুর মুখের সঙ্গে কোনও মিল নেই, থাকার কথাও নয়। মূল শব্দটা ‘গোমুখী’, আর গো শব্দের প্রধান অর্থ পৃথিবী। যেখানে গঙ্গা হিমবাহের আড়াল থেকে বেরিয়ে পৃথিবীমুখী হয়েছে, সেটাই গোমুখী।

    বেলা দু-টো পাঁচ

    কাকা-ভাইপোর মুগ্ধতা এখনও কাটেনি। তবু ফিরতে তো হবেই। শেষবারের মতো ভাগীরথী নদী, ভাগীরথী শৃঙ্গ, গঙ্গোত্রী হিমবাহ, শিবলিঙ্গ শৃঙ্গকে দেখে নিয়ে মহা অনিচ্ছায় ফিরতি পথে পা রাখলাম।

    বেলা তিনটে বাজতে তিন

    পেরিয়ে এসেছি সেই জায়গা, যাবার সময় যেখানে প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে পেরিয়েছিলাম। একটা লুপের মতো অংশ, যার পনেরো ফুটে পথ বলতে কিচ্ছু নেই। ইঞ্চি ছয়েক চওড়া একটা ষাট ডিগ্রির ঢাল, মাথার ওপরে বেরিয়ে থাকা পাথরের খোঁচ ধরে পেরিয়ে যেতে হবে। এই শীতেও ঘাম বেরোনোর উপক্রম হয়েছিল। সেটা ফিরতি পথে নিরাপদে পেরিয়ে আসার পর একটু বিশ্রাম তো ন্যায্য পাওনা।

    বেলা তিনটে সাত

    শিবলিঙ্গ আড়াল হচ্ছে, ওদিকে ভৃগু নিজেকে জাহির করছে। ভাগীরথীরা অবশ্য স্বমহিমায় বিরাজমান।

    বেলা তিনটে আঠারো

    শুকনো ফল খাওয়ার ছলে বিশ্রাম।

    বেলা চারটে

    ভুজবাসায় GMVN–এর উঠোনে। আজ রাতে দারুণ ঘুমোবো।

    পয়লা নভেম্বর; সকাল ছ-টা ছেচল্লিশ

    মাইনাস ৫ ডিগ্রির ধাক্কা সয়ে একটা স্কেচ করলাম গরম চায়ের ভরসায়। ভোরের আলোয় রাঙা ভাগীরথী শৃঙ্গেরা।

    সকাল আটটা

    ব্রেকফাস্ট খেয়ে সকালের আলোমাখা পথে পা।

    সকাল দশটা আঠারো

    নিশ্চিহ্নপুর চীড়বাসা।

    বেলা দু-টো

    কনখু। আবার অরণ্য।

    বেলা দু-টো সাতান্ন


    গঙ্গোত্রী

    গঙ্গোত্রী। ইতি। দুই বুড়োর গঙ্গাযাত্রা সম্পন্ন হলো। ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments