• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৩ | জুন ২০১৬ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা: বিক্কলেজের গপ্পো, গানের গল্প গল্পের গান, পরশুরাম উবাচ, হব্বা খাতুন : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || টম ব্রাউন’জ কলেজ ডেজ ||

    ‘বিক্কলেজের গপ্পো’—লেখক--অসীম দেব; সুলেখা প্রকাশনী, কলকাতা। ISBN নেই।

    না, সে-লেখক এ’লেখারও কোনো খোঁজ পাবেন না!

    না, না, আমি প্রবাদপুরুষ টমাস হিউজ-সাহেবের কথা বলছিনা। এ’লেখক ছিলেন এক বিলুপ্ত-বিস্মৃত-অনামী জন! ১৯৭০-নাগাদ এক চটি বই লেখেন উনিঃ ‘ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে অমিতাভ’! সেকালে এ’বই যে শুধু শিবপুর-যাদবপুর-খড়্গপুরের ছাত্রদের হাতে অবাধ ঘুরতো তা নয়, হিন্দু-হার্ডিঞ্জ হস্টেল থেকে দিল্লি-কলেজের বাঙালি ছাত্রকুলেও সমান জনপ্রিয় ছিল এ-বই। কারণ, নামটা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের হলেও গপ্পটা আবহমানের! এর প্রমাণ, আজ প্রায় অর্ধশতক পরে এই সোশাল-মিডিয়ার রমরমে যুগে এসেও তার ফুলস্টিম বেরিয়ে যায়নি। ফেসবুকে এক জনপ্রিয় ক্লোজড-গ্রুপ রয়েছে Engineering College-e Amitava, যার সদস্য-সংখ্যা সাতশ’র বেশি ও রেগুলার পোষ্ট পড়ে! হ্যাঁ, সে অনুপ্রেরণাকর বইটার নায়ক অমিতাভই ছিলো কিনা, বর্তমান বইটির যেমন সত্যজিৎ! সিনেন না নাকি এই সত্যজিৎরে? কী বললেন, চেনেন না? না, না, সিনেন সিনেন। z।নতি পারেন না! কারণ, এ’সত্যজিত, ঐ দেখুন, আয়নার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এবং তার বয়স আজও বাড়েনি। আজও তার থুতনিতে হালকা দাড়ির আভাস, ইতি-উতি তাকানো বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষুদ্বয়...

    ***

    সেই ১৮৩০-এ ইংল্যান্ডে শ্বেতাশ্বের গাল্‌চে-সবুজ অধিত্যকা থেকে রাতের ডাকগাড়ি চড়ে রাগবি-স্কুলে পড়তে আসা একাদশবর্ষীয় টম ব্রাউনের সঙ্গে ১৯৭০-এর গোড়ার উত্তর কলকাতার এঁদো কলোনি থেকে বাস বদলে ৫৫ নং ধরে শিবপুরে আসা সত্যজিতের কোনো মূলগত ফারাক ছিল কি? না, বয়সটা কেবল ধেনোর বছর ছয়েক বেশি ছিল, আর চোখের তারাটা নীল না হয়ে কালো। এই। কিংবদন্তীর বি ই কলেজে প্রথম ঢুকে তার কলোনিয়াল-স্টাইল ক্লক-টাওয়ার, সবুজ ঘাসে মোড়া লন, লেক... দেখে মাথা ঘুরে যাবে না এমন কিশোর কমই আছে। তার ওপর আছে লেডিজ হস্টেল, জিম, প্রথম ধোঁয়া টানা... আর ... আর ... আরও কত আকর্ষণ! বস্তুত, প্রথম ইস্কুল ছেড়ে কলেজে ঢোকাটা যে-কোনো ছাত্রছাত্রীর কাছেই এক ডানামেলা! তার ওপর সে যদি আবাসিক হস্টেল হয় তাহলে তো কথাই নেই। যাঁরা হস্টেলে কখনো থাকেননি, তাঁরা এর শিক্ষার পৌঁছ্‌টা ঠিক কদ্দূর হয়ে থাকে, বুঝবেন না। আমাদের কালে ঘরের চারজনের জন্যে দু’-একটাই কমন টুথব্রাশ রাখা থাকতো শুনে আজকের আধুনিকা কন্যা তো প্রায় ভির্মি যায়!!

    ***

    আর, অসীমের বইএর মূলসুরটা এইতারেই বাঁধা! বইয়ের পাতায় পাতায় ছাপা সেকালের সাথীদের সাদাকালো ফটোগুলো দেখতে দেখতে আবছা যেন চেনাচেনা লাগে ...ঐ....ঐ....আজকের এক আইভি-লীগ কলেজের ডিন তো ঐ উনি বহুজাতিকের প্রধান তো ইনি নাট্যকার... হ্যাঁ, শুধু নামী পণ্ডিত-বিজ্ঞানীই নন বি ই কলেজ থেকে কালে কালে বিনয় মজুমদারের মত কবি, নারায়ণ সান্যালের মত লেখক, প্রণব রায়ের মত সুরকার বা বাদল সরকারের মত নাট্যকারও বেরিয়েছেন যে! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজেরই ছাত্র ছিলেন, যাদবপুর! অসীমের কাজটা এই কারণেই কঠিন ছিল। যাঁর যাঁর কাছে এ’সব গল্পগুলো চেনা, যে-বৃদ্ধ হয়তো সেই গল্পের নায়ক ছিল, তাঁদের কাছে তো এই বই হট কেক! বাকিদের কাছে? খুব বোরিং লাগবে না অন্য বুড়োদের গল্প শুনতে? কিন্তু উপস্থাপনার জোরে, গল্প বলার সাবলীলতায় উৎরে গেছে সওয়া-শ’ পৃষ্ঠার বইখানি। যদিও সেই হাস্য-টেম্পো কোথাও কোথাও যে একঘেয়েমি-দোষে দুষ্ট নয়---বলা যাবে না। কারণ, এই ‘বিক্কলেজের গপ্পো’-র পরিসরখানি, ঘোষণামতই অধুনা-বৃদ্ধ লেখকের চারদশক-প্রাচীন ছাত্রকালের কিছু চুলবুলে অভিজ্ঞতাতেই সীমাবদ্ধ; গুরুগম্ভীর আলোচনা কিছু নেই এতে। অতএব লেগস্পেশ কম।

    কিছু কিছু অধ্যায়ের নাম শুনলে সুরটা পষ্ট হবেঃ ‘সত্যজিৎ ও ঘোড়া স্যার’, ‘পাগলা দাশু’, ‘বাবা-কাহিনী’, ‘পিপি’... এবংবিধ। সবচে’ মন কেড়েছে ‘সত্যজিতের গ্রান্ড ফিস্ট’! মেস-ম্যানেজার হয়ে লুঙ্গি পরে তার পাঁঠা কিনতে যাওয়া, বা ছাগলকে হাগিস-প্যাক পরিয়ে দেবার প্রস্তাব... মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল প্রণম্য বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের অবিনশ্বর গণশা চরিত্রকে! ‘সত্যজিতের রি-ইউনিয়ন’ অধ্যায়টিও কম যায় না, যেখানে তার ফর্দাফাঁশ!! আর নামগুলো কী কী সব একেক মহারথীর... কারো নাম দৈত্য, তো কারো নাম কাৎলা তো কেউ মগা, ঝাঁটা, পদু, হুলো, লেটো! (সেই ‘পোকা’ আজকে এক আই আই টি র ডিরেক্টর হয়েছে!.. ভাবা যায়?)। তার ওপর ছিল ‘ঘোড়া-স্যর’, ‘ল্যাংটো-বাবু’, ‘ক্যামেল-বাবু’, ‘ফোন-দাদু’-র দল। সত্যি, পড়তে পড়তে বয়স কমে যায়। এখানেই বইটির সাফল্য। না, অসীমের কলম তুখোড় নয়। অনভ্যাসের হোঁচট অনেক রয়েছে। তবু মূল লক্ষ্যে অবিচল... পাঠককে নিয়ে যেতে হবে তার কৈশোরে, ভুলিয়ে দিতে হবে পঞ্চাশোর্ধের বেদনা! আর আজকের কচিকাঁচাদের কাছে? আজকের (নাম-বদ্‌লে) আই আই ই এস্টির কোনো থার্ড ইয়ারের ছাত্র এই বই পড়তে পড়তে হাসবে মুচকি মুচকি... সেই আদি পরম্পরার কথা ভেবে। পরম্পরা! ক্লাসে আসব পান করে আসায় হেডস্যার কানাইবাবু কান পাকড়ে এক ছাত্রকে বের করে দিয়েছিলেন। সে-বেচারি হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েও বলতে বলতে গেলো, ‘এ’ তো, স্যর, সেই ডিরোজিওর আমল থেকেই...’

    ***

    এ’বইয়ের ভাষায় স্ল্যাং-এর অতি প্রাধান্য! ঘ্যাম, ভাতি, হেব্বি-মাল, জক-মারা, ভাট বকা, ঢপ-দেওয়া, গ্যাস-খাওয়ানো, রেলা-মারা, ফোট্‌... এ’সব শব্দে যাঁর ভুরু কুঁচকে উঠবে, না, এ’-বই তাঁর জন্যে নয়। তবে, ‘স্ল্যাং’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ স্মরণ করিঃ ‘কোনো এক বিশেষ/নির্দিষ্ট দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ও প্রচলিত শব্দাবলী’! তবে? তবে কোথাও কোথাও যেন একটু বেশিই বর্ডারলাইন-কেস হয়ে গেছেঃ ‘প্রথমবার দেখায় লাবণীর কোমরের মাপজোক চেয়ে বিশাল মাল ছড়িয়েছিল রুণাল’ (পৃঃ ১০৩), বা ভর্তি হবার আগেই ‘লাইন-মারা’! সেটা অবশ্য র‍্যাগিঙের অঙ্গ ছিল। আর, এখানেই আবাসিক শিক্ষায়তনের এক স্পর্শকাতর বিষয় চলে এলোঃ র‍্যাগিং! কতদূর পর্যন্ত সেটা সহনীয়, কতদূর সেটা ইন্ডাকশন প্রসেসের অঙ্গ---সেটা বিতর্কিত বিষয়। লেখক যদিও কখনই বলবেন না বা মানবেন না যে তিনি র‍্যাগিত হয়েছিলেন (পৃঃ ১৮)। সে-বিতর্ক ছেড়ে লেখককে একটা মস্ত বধাঈ দিতে হয় ‘প্ল্যানচেট’ অধ্যায়ে, এতো বছর পরে এসেও, গোটা এক চতুর্দশপদী পুরো স্মরণ থেকে নাবিয়ে দিয়েছেন বলে (প্ল্যানচেটিত অবস্থায় মাইকেলের লেকা!)... যার প্রথম ক’টা লাইনঃ

    “ছিনু বসে গার্ডেন বারে মেঘনাদেরে স্মরি।
    বিদ্যার সাগর মোরে নাহি দিলো টাকা...”
    ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধু, সাধু! থুড়ি, রাম রাম!!

    ***

    না, লেখকের কালে বি ই কলেজে ‘টমাস আর্নল্ড’-এর সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক শঙ্কর সেন, দূর্গাদাস ব্যানার্জীদের শিক্ষা-সাহচর্য পেয়েছিলেন লেখক, তার সকৃতজ্ঞ উল্লেখ রয়েছে, হাসি-চুটকিলার ঊর্ধে উঠে যা মন ছুঁয়ে যায়। প্রচুর সাদাকালো ফটো রয়েছে। অপরিচিতজনের কাছে এতো লোকজনকে দেখা ক্লান্তিকর। ভালো লেগেছে কয়েকখানি স্কেচ, যদিও শিল্পীর নাম নেই কোথাও। মুদ্রণপ্রমাদ বেশ কয়েকটি, ...বিশপ কলেজকে জেশপ লেখা ৩৯ পৃ। বইটির প্রোডাকশন মধ্যমানের, দামখানি যা আকাশছোঁয়া, পয়সা দিয়ে কেউ কিনবে না এ’ বই, দাতা ছাড়া। তবে লেখকের প্রথম বই বলে ও উদ্দেশ্যে সাফল্যহেতু ফার্স্ট ডিভিশন মার্ক্স প্রাপ্য। দশে ছয়।



    || আহা, শিবঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচিফলের মালিকা...||

    গানের গল্প গল্পের গান--অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রকাশকঃ আজকাল, কলকাতা-৯১; প্রথম প্রকাশঃ জানু ২০১৪; ISBN: 978-81-7990-156-4

    ১৯৭৮ সালে একটা বাঙলা ছায়াছবি এসেছিল, ‘বালক শরৎচন্দ্র’। এক সপ্তাহও চলেনি ছবিটা। কিন্তু আজ প্রায় চারদশক পরেও গায়িকা হৈমন্তী শুক্ল যে জলসা বা টিভি অনুষ্ঠানেই আসুন না কেন, শ্রোতারা ‘শিবঠাকুরের’ ফরমায়েশ করবেনই করবেন।

    হৈমন্তীও বয়ঃজ্যেষ্ঠ সুরকারের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করেই গেয়ে থাকেন সে-ছবির এ’গানখানি: আহা, শিবঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফলের মালিকা! ‘আজ এতো বছরেও যে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে গানখানি তার কারণ এর অতি সরল, তাই মনকাড়া, সুর!’ বলেন হৈমন্তী। এই সুরকারের নাম শ্রীঅভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (জ. ১৯৩০)। সন্ধ্যা-দ্বিজেনহেন স্বর্ণযুগের যে কয়েকটি স্তম্ভ আজও আমাদের মধ্যে বিরাজমান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন অভিজিৎ; সেযুগের হেমন্ত-সলিল-নচিকেতা-সুধীন হেন নক্ষত্রমাঝে যিনি স্বস্থান বজায় রেখেছিলেন যথেষ্ট মুন্সিয়ানায়, মাথা উঁচু করে! ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’, ‘সবাই চলে গেছে’ বা ‘তোমার দু’চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’-হেন গান বাঙালি ভোলে কী করে?

    তবে সুরকার অভিজিৎ ছিলেন এক নিভৃতচারী মানুষ। নৈলে, যিনি সেকালে হেমন্ত-শ্যামল-মানব-প্রতিমাকে দিয়ে গাইয়েছেন বহু বহু অবিস্মৃতব্য গীত, যিনি আজ এই ৮৬ বছর বয়সেও সমান মুন্সিয়ানায় শুভমিতা-শ্রীকান্তদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি এতটা অলক্ষ্যে থাকেন কী করে? আর যেখানে হেমন্ত-মান্না-মানব-তরুণ থেকে আরতি-নির্মলা-হৈমন্তীর সঙ্গে ছিল তাঁর অতি হার্দিক সম্পর্ক? এ’হেন বহু বহু গাইয়ে-বাজিয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিল/আছে অভিজিতের, আর সে-সব গল্প পড়তে পাওয়ার জন্যেই এই বই।

    ***

    একজন সুরকার বাঙলা সঙ্গীতের জগতে আজ ষাট-পঁয়ষট্টি বছর রয়েছেন এক নাগাড়ে---এটাই বোধহয় তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার ও স্বীকৃতি। এর পেছনে তাঁর গুরুদেব কবি-সন্ন্যাসী শ্রীপরমানন্দ সরস্বতীর এক আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা কাজ করে চলেছে, সেটা বারে বারে স্মরণ করেছেন অভিজিৎবাবু। আর উনি পেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না বাবু, সলিল চৌধুরী প্রমুখের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও পথনির্দেশনা। এ’বই মূলতঃ এই সকল সুরতারকাদেরই গল্প। অজস্র এনিকডোট ছড়িয়ে আছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়, যেগুলো পড়তে পড়তে চলে যাওয়া এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।

    কয়েকটি শোনাইঃ

    *১৯৫৪-তে যখন শ্যামল মিত্র অভিজিতের সুরে ‘ছিপখান তিনদাঁড়’ গাইলেন শ্রোতারা তার মধ্যে সলিল চৌধুরীকে খুঁজে পেলেন কারণ ইতোমধ্যেই হেমন্ত ‘পাল্‌কি চলে রে’ গেয়ে মাতিয়েছেন। কিন্তু ‘ছিপখান’-এর সুর ‘পালকির গান’-এরও দু’বছর আগে করেছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরু সলিল চৌধুরীর অকুণ্ঠ প্রশংসা ও প্রেরণা নিয়েই। এ’গান সলিলই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখান শ্যামলকে এবং গানের সঙ্গে অর্গানটিও তিনিই বাজিয়েছিলেন।

    *গানের জগতে অভিজিৎ কিন্তু সুরকার নয়, গণনাট্য সঙ্ঘের গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেন। সলিল চৌধুরী তাঁর আরেক কিংবদন্তীগীত ‘সেই মেয়ে’ প্রথম গাইয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েই! এ’গান আজ এক মাইলস্টোনের দর্জা পায় বটে, সেদিন কিন্তু ‘ময়নাপাড়ার কালো মেয়ে’-র মধ্যে কিছু উন্নাসিক বাঙালি রবি ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি’-র প্যারোডি খুঁজে পেয়েছিলেন, এবং সেই মত নিন্দা হয় অভিজিতের, এক পাঁড় কম্যুনিস্টের পাল্লায় পড়ে রবিঠাকুরের প্যারোডি করার জন্যে।

    আজ যদিও সে গান ইতিহাস!

    ***

    সনৎ সিংহ। প্রবীর মজুমদার। ক্ষিতীশ বসু। অনল চট্টোপাধ্যায়, মিল্টু ঘোষ... আধুনিক বাঙলা গানের সঙ্গে যুক্ত এমন বেশ কিছু প্রতিভার কথা অভিজিৎ শুনিয়েছেন পরম যত্নে-মমতায়, যদিও এঁদের অনেকে তো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন! অভিজিৎ সবচেয়ে বেশি সুর করেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। তাঁর কথাও তাই বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে। আরেক ব্যক্তিত্ব এইচ এম ভি র ম্যানেজার পবিত্র মিত্র মশায় (অনবদ্য গানও লিখে গেছেনঃ ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে...’--লতা)। কী যত্নে, মুন্সিয়ানায় ও এক জহুরির চোখ দিয়ে এই ঢাকাই মানুষটি কলকাতার সঙ্গীতজগতকে প্রতিপালিত করে গেছেন, অতি নিকট থেকে দেখা কেউ ছাড়া তা জানা অসম্ভব। পবিত্র মিত্রকে ‘স্বর্ণযুগের রূপকার’ আখ্যায়িত করেছেন লেখক, খুব ভুল বলেননি। প্রবীর মজুমদারের কথাও বারবার এসেছে লেখকের কলমে। অকালপ্রয়াণ না ঘটলে সলিল চৌধুরীর অন্য দুই শিষ্য অভিজিৎ-অনলের মতই আরও ভাস্বর হয়ে উঠতেন প্রবীর, সন্দেহ নেই, যদিও এক ‘ও তোতা পাখি রে’-র গীতিকার-সুরকার হিসেবেই অমরত্ব পান প্রবীর।

    ছুট্‌কাহানির আকর এ বই ।

    * জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা হেমন্তকে ডাকলো ভবানীপুরের এক ক্লাব এক সদ্যপ্রয়াত টেকনিসিয়নের স্মরণ-জলসায়, হেমন্তের হেমন্ত হয়ে ওঠার পিছনে যাঁর অবদান ছিল। পুরো পারিশ্রমিক ও বম্বের আপ-ডাউন এয়ারফেয়ার চেয়ে ঠারেঠোরে নিন্দা কুড়োন হেমন্তকুমার। অনুষ্ঠানের দিন স্টেজে উঠে সম্পূর্ণ টাকাটা বিধবার হাতে তুলে দিয়ে হেমন্ত বললেন, এইভাবে না দিলে টাকাটা হয়তো বৌদির হাতে পৌঁছতো না! নিন্দুকদের চোখে জল। এইজন্যেই না হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চারদশক ধরে কলকাতার বাঙলা গানের জগতের অভিভাবক ছিলেন!

    * বা, রাত দেড়টায় ফোন, ‘অভিজিৎদা, আমি ঝামেলা বলছি।’ ‘ঝামেলা বলে ঝামেলা? এত রাতে ফোন কেন?’ গায়িকা নির্মলা মিশ্রের ডাকনাম ‘ঝামেলা’। তখন গাইছিলেন অভিজিতের সুরে ‘বলো তো আরশি তুমি মুখটি দেখে’। অসম্ভব হিট হয় গানটি। সুরের একটা জায়গা প্রাঞ্জল করতেই অত রাতে...। তাঁর নিবেদনপ্রাণতার তারিফ করেছেন অভিজিৎ!

    * কিংবা, সেই দুই মহারথীর অনর্গল বাক্যালাপ? ১৯৫৮ অভিজিৎ তখন সবে সবে এসেছেন ফিল্ম মিউজিকের জগতে, সলিল চৌধুরীর সাগরেদ হিসেবে। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র সেট। এক সন্ধেয় শ্যুটিং শেষে ক্লান্ত ঋত্বিক ও সলিল মুখোমুখি... কথোপকথন তাঁদের ... বিষয়ঃ ‘একাকীত্ব’! দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে বাক্যালাপ শোনা নবীন অভিজিতের জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা! চমৎকার লিখেছেন এই বইয়ে সে-গল্প।

    ***

    কয়েকটি মতান্তরের প্রসঙ্গে আসি এবার (লেখা প্রিয় হলেও সর্বদাই তার সঙ্গে একমত হতে হবে কে বলেছে?)।

    * দ্বিভাষিক ‘একদিন রাত্রে’/‘জাগতে রহো’ ছবিতে মান্না দের ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’-কে লেখক মুকেশের ‘জিন্দগী খ্যাব হ্যায়...’-এর চেয়ে শ্রেয়তর মাতাল-গীত বলেছেন। মান্না দের পরম ভক্ত হয়েও বলি, না, এ’গানটি অন্ততঃ মুকেশজী অনেক উপযুক্ত গেয়েছেন। এখানে গায়কের নাম ভুল করে মহ. রফি লিখে ফেলেছেন লেখক, মুকেশ হবে।

    *সাচ্চা কম্যুনিস্ট সলিল চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের অগাধ ভক্ত ছিলেন, বহু জায়গায় পড়েছি/শুনেছি। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রয়াণে সলিল কাছাগলায় অশৌচ পালন করেছিলেন চৌদ্দ দিন যাবৎ -- অভিজিতের লেখা এ’তথ্যের পুষ্টি পাইনি আর কোত্থাও।

    ***

    ‘আজকাল’ প্রকাশনার এমন দু’একটি গান-বইয়ের কথা আমরা আগেও ‘পরবাস’-এর এই কলমে পড়েছি (উদা. হিমাংশু দত্ত, সং-৪৮, বা সুধীন দাশগুপ্ত, সং-৬১)। বর্তমান বইখানিও সেই অনন্য স্থপতি শ্রীমান অলক চট্টোপাধ্যায় মশায় দ্বারাই কৃত। ভাগ্যিস লিখিয়েছিলেন! নৈলে এমন চমৎকার বই পেতাম কোথায়? অভিজিৎ বন্দ্যো-র লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এ’ সে পত্রিকায় কিছু নজরে পড়লেও পুস্তকাকারে আজকালই প্রথম বার করলেন।

    একটা আপত্তির কথা এই প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ করে রাখিঃ জানু ২০১০এ এই ‘আজকাল’ প্রকাশনালয়ই অভিজিৎবাবুর লেখা একখানি বই বের করে, চার বৎসর পরে জানু ২০১৪ যার দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছেঃ ‘বাংলা গানের পথচলা’। বর্তমান আলোচ্য বইখানিরও প্রথম প্রকাশ জানু ২০১৪, অর্থাৎ আগেরটির ২য় সং-এর সাথে সাথেই। এবং এই দু’টি বইয়েরই বক্তব্য, স্টাইল, বিষয়াবলী ৯৫% এক, বহু বহু বাক্যবন্ধও! একই লেখকের ঠিক একই বিষয়ের ওপর লেখা বইকে দুই আলাদা নামে দুই আলাদা মলাটে (ও দুই আলাদা ISBN নম্বরে) উপস্থাপনা ও বিক্রি করা পাঠক-ঠকানো ছাড়া কিছু নয়।

    ‘আজকাল’-হেন এক সৎ হাউজের কাছে এটা অনভিপ্রেত ছিল।

    ***

    এহ বাহ্য! রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাঙলা গান আজ পৌনে শতাব্দী কাল অতিক্রম করে গেছে। নানান ফুলের ডালি তার পায়ে, গলায় বহুবিধ মালিকা। তবু তারই মধ্যে সে-শিবঠাকুরের গলায় বৈঁচিফলের মালিকাখানি দুলতেই থাকবে, দুলতেই থাকবে! হয়তো ভবিষ্য কোনো গবেষক আবিষ্কার করে ফেলবেন, না, আসলে সেটি বৈঁচিফলের নয়, ছিল এক গোপন রতনহার!! সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আগামীর শ্রোতা ঋণীই রয়ে যাবে।

    আমরা মুগ্ধ পাঠক-শ্রোতা করজোড়ে বিনম্র প্রণাম জানাই এই বরিষ্ঠ সুরকারের উদ্দেশ্যে।

    প্রণাম!!


    || পরশুরামের কথা অমৃতসমান... ||

    পরশুরাম উবাচ--....উদ্ধৃতি-সংকলন---সংকলকঃ দীপক গোস্বামী; ‘পাতাবাহার’ প্রকাশনা, কলকাতা-১০, প্রথম প্রকাশ : মাঘ ১৪২০; ISBN 978-93-83200-07-8

    “আধুনিক বাঙালী লেখকরা বুঝেছেন যে সেক্স অপীলই হচ্ছে উৎকৃষ্ট গল্পের প্রাণ....আসল কথা, এদেশের কথাসাহিত্য এখনও সতীত্বের মোহ কাটাতে পারেনি।”

    অধ্যাপক-বন্ধুর প্রশ্নে ফ্যাসাদে পড়লাম, কারণ, বলতে পারিনি এই উদ্ধৃতি কার?

    ‘তা’লে এটা বল্‌’:

    “আমার মতে মোটর-কারও যা, পরিবারও তা । ঘরে আনা সোজা; কিন্তু মেরামতী খরচ যোগাতে প্রাণান্ত।”

    ‘এ’হেন বচন তো আজকাল মুখবই খুললেই হাজারো....’, বলি।

    ‘উঁ হুঁ। হৈল না।’, বন্ধুর তৃতীয় বাণঃ ‘এটা?’

    “একটু আঁষটে গন্ধ না থাকলে যেমন কাঙ্গালীভোজন বা বাঙালীভোজন হয় না, তেমনি একটু কামগন্ধ না থাকলে মামুলী বা প্লেটনিক কোনও প্রেমই হবার জো নেই।”

    ***

    অসম্ভব রাশভারী মানুষ! পার্সিবাগানের গলিতে তাঁর হাম্বার গাড়িখানা ঢুকছে দেখলেই পাড়ার ছেলে-ছোকরার দল বৈকালিক আড্ডা ফেলে রোয়াক খালি করে দিত। উনি কিন্তু কথা বলতেন অত্যল্প। চেহারাও দশাশই কিছু ছিল না। তিনি ছিলেন ‘পরশুরাম’ রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০)। রসায়নের মহাপণ্ডিত, বেঙ্গল কেমিক্যালের ডিরেক্টর আবার অভিধানকার এবং প্রভাত মুখুজ্জ্যের পাশাপাশি আধুনিক বাঙলা রসসাহিত্যের আদিপুরুষও বটেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রাজশেখরকে ‘রাতারাতি মহীরুহ হয়ে যাওয়া সাহিত্যিক’ বলেছিলেন! হ্যাঁ, এই মানুষটির কলম দিয়েই ঐ ঐ রসালো বচনরাজি বেরিয়েছে, রাশভারী যিনি এমনই ছিলেন যে মেজদার ভয়ে কৃতী ছোটভাই ‘ভারতের ফ্রয়েড’ গিরীন্দ্রশেখর সর্বদা তটস্থ থাকতেন! (আবার গিরীন্দ্র তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়ও ছিলেন বটে)

    ***

    না, পরশুরামের জীবনী লিখতে এ’কলম ধরিনি, তা পরবাস-পাঠকদের অনবগতও নয়। এক ছোট্ট প্রকাশনালয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল সম্প্রতি। ছোট্ট। নব্য। নামটি তাহার বেশঃ ‘পাতাবাহার’। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় তাদের বিপণীটিও ছিমছাম। চমৎকার ব্যবহার। এদের বুকলিস্ট দেখে মুগ্ধ হইচিঃ ‘পঞ্চমহেশ্বর’, ‘শ্রীকৃষ্ণ অভিধান’, ‘অব্যক্ত’ (আচার্য জগদীশচন্দ্র), ‘বাংলার পাখি’ (জগদানন্দ রায়) ইত্যাদি ইত্যাদি...। সুলভমূল্যহেতু গুটিকয় খরিদও করে ফেলা গেছে, যেমন এ’খানি।

    ***

    দেড়শতাব্দী-প্রাচীন Barlett নয়, বাঙলাভাষায় ‘উদ্ধৃতি-অভিধান’ রচিত হতে শুরু করেছে নেহাতই হাল আমলে। ‘প্রেমের কবিতা-উদ্ধৃতি’ বা ‘দুই-বাংলার কবিতা’-র উদ্ধৃতি... এমন বই চোখে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম থেকে উদ্ধৃতির বাইরে এই প্রথম আরেক সাহিত্যিকের উদ্ধৃতি-সংকলন নজরে এলো, তিনি পরশুরাম ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারেন, রবীন্দ্র-পরবর্তীতে যিনি বাঙলাসাহিত্যের অভিভাবকের আসন গ্রহণ করেছিলেন, অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে!

    ***

    অভিধান কেবল শব্দের হবে কেন? বিষয়ের, অতি অতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়ের, ভাবের... নানান ধরনের অভিধান হয়, হতে পারে, তার কিছু বুঝি, বেশিরভাগ না-বুঝি... যখন BCL বা ন্যাশনাল লাইব্রেরির ‘রেফারেন্স সেকশন’-এ’ ঘুরি। ‘উদ্ধৃতি-অভিধান’ এমনই এক পুঙ্খানু বিষয়। The Oxford Dictionary of Quotations এর পাতা প্রথমবার ওল্টাতে ওল্টাতে কোনো কোটেশনে চোখ-আটকে মনে হয়েছিল, আরে এ’লেখা তো আমার পড়া, তবু সে-পৃষ্ঠায় তার পুনরাবিষ্কার নতুন দ্যোতনা আনলো। যেমন এ’বইতেঃ

    “দৃশ্যমান জগতটা নিছক মায়া, আর নারী সেই মায়াসমুদ্রের ভুড়ভুড়ি, তাদের আকার আছে, কিন্তু বস্তু নেই।” [প্রেমচক্রঃ হনুমানের স্বপ্ন]। এ’গল্পখানি তো পড়াই ছিল, তবু এ’লাইনটি মন-ছেড়ে গেছে কেন? এই দেখো, এ’-অভিধানে আলাদা/নতুন করে পড়লুম বলেই না মজাটা নতুন করে পেলুম, যেটা সটান-পাঠে ছেড়ে গেছি। হ্যাঁ, এখানেই উদ্ধৃতি-অভিধানের জয়, কৌটোর ঢাকনাখানি ঠিক ঠিক জায়গায় খুলে দেয়!

    যেমন, ‘ধুস্তুরী মায়া’ কে না পড়েছে? কিন্তু সেখানে যে এই মোক্ষম লাইনটা ছিল, সেটা ছিল চাপা পড়ে মনের কন্দরেঃ

    “ফুর্তিরও সাধনা দরকার হে, জোয়ান বয়স থেকে অভ্যাস করতে হয়।”

    অথবা,
    “সেন্ট ফ্রান্সিস আর পরমহংসদেব খাঁটি কথা বলে গেছেন, কামিনী আর কাঞ্চন দুই রাবিশ; লোহার তূল্য কিছু নেই” [পরশপাথর]

    অথবা, “সাহিত্যে কালো-বাজার নেই কিন্তু চোরাবাজার অবারিত। বাঙালী লেখক ইংরিজী থেকে চুরি করে, হিন্দী লেখক বাংলা থেকে চুরি করে, এই হল দস্তুর” [রামধনের বৈরাগ্য] (আজকের গোবলয় শুনলে খচে যাবে)

    সংকলক শ্রীমান দীপক গোস্বামী চমৎকার সাজিয়েছেন বইটির বিষয়বস্তু। বর্ণানুক্রমে ‘আদর্শ’, ‘আদিরস’, ‘আর্ট’, ‘ঈশ্বর’... করে করে ‘স্বর্গ’, ‘স্বার্থপরতা’ হয়ে ‘হিমালয়’ পর্যন্ত ১৮৪টি বিষয়ের ওপর এক বা একাধির উদ্ধৃতির ডালি সাজিয়ে ধরেছেন পরশুরামের নিরানব্বুইটি ছোটগল্প ও কয়েকটি কবিতা থেকে। চমৎকার! পরশুরামের প্রকাশিত গল্প-সংগ্রহ নয়টি ও কবিতা সংকলন একখানি। সেগুলি দুই খণ্ডে স্থান পেয়েছে ‘পরশুরাম গল্পসমগ্র’-তে (এম সি সরকার প্রকাশনা)। সেই পীতবসন জনপ্রিয় রচনাবলীটিই ভিত্তি এই বইটির। যদিও সেকথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার দরকার ছিল কোথাও। বইটির শেষে দু’টি দীর্ঘ বর্ণানুক্রমিক পরিশিষ্টে রয়েছেঃ (১) উৎস-গল্পের নাম, প্রকাশকাল ও উদ্ধৃতিসংখ্যা, এবং (২) এ’বইয়ে ঠাঁই পাওয়া ভূক্তিগুলির এক সম্পূর্ণ সুচি। খেটে কাজ করেছেন বটে সংকলক, সাধুবাদ প্রাপ্য। কলম নিয়ে নাড়াচাড়া করেন যাঁরা, তাঁদের কাছে এ’বই এবং এ’গোত্রের আগে-আনেওয়ালা হয়তো আরও কিছু বই (যেমন, অন্নদাশঙ্কর, মুহ. শহীদুল্লাহ্‌, বুদ্ধদেব বসু...) বড্ডই কাজের হবে সন্দেহ নেই।

    ***

    তাঁর কালে ভারতশ্রেষ্ঠ কমার্শিয়াল আর্টিস্ট যতীন সেন মশায় (১৮৮২-১৯৬৬) কিন্তু কেবল বেঙ্গল কেমিক্যালেই রাজশেখরের সহকর্মী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন দ্বারভাঙার প্রাইমারি ইস্কুলের সহপাঠীও! বেয়াল্লিশ বছরের ফটিক যখন প্রথম কলম ধরলেন, লিখলেন ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ (১৯২২), ছবি আঁকতে ডাক পড়ল যতীনের। তার পরেরটুকু ইতিহাস! তাঁর আঁকা ছবি ‘হড্ডি পিল্‌পিলায় গয়া’, ‘তিন কত্তি তিন’, ‘যাঃ..’ বা ‘ভুশুণ্ডীর মাঠে’... ভোলা যায়? এমন বেশ কিছু ছবি বর্তমান গ্রন্থটিতে ঠাঁই পেয়েছে, সেটা উপরি প্রাপ্তি। প্রচ্ছদ-চিত্রটিও যতীনের আঁকা পরশুরাম!

    ভূমিকাতে সংকলক-মশাই বানান অবিকৃত রাখা-না-রাখা নিয়ে একটি অনর্থক বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। সংকলক কোন্‌ অধিকারে মূলের বানান বদলাতে পারেন, বোধগম্য হৈল না। যদিও শেষে অবিকৃতই রেখেছেন। নতুন প্রকাশনালয়ের কাজের মান ভালো। যদিও বানান ভুল অনেক চোখে পড়েছে। এমনকি ‘ভূমিকা’-তেই দুইবার ‘অবিভাবক’ ছাপা হয়েছে। ‘সংকলন’ না লিখে শীর্ষে ‘সংহৃতি’ লেখা হয়েছে, বেশ, নতুন। শেষে দু’টি উদ্ধৃতি দিয়ে ইতি টানি, একটি না-পাওয়ার অপরটি পাওয়ার।

    ১. গৃহিণী চুনি-পান্নার মালা গলায় পরিয়া বলিলেন, ‘দেখতো কেমন মানাচ্ছে’? আমি বলিলাম, ‘চমৎকার! যেন পরস্ত্রী!’ [কচি-সংসদ]---পরশুরামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উক্তি। এই সংকলনে পাইনি। তার ঠিক পরেরটুকু থেকে আছে, অবশ্য।

    আর পেলাম যেটা সেটাও মন্দ নয়। অধ্যাপক বন্ধু যদি এইটি শুধোতেন, গোল্লা নয়, মাইনাস পেতুম, কারণ এটি যে পরশুরামের কলম দিয়ে বেরোতে পারে, ভাবিনি,

    “গরম দেশে বৎসরে ন মাস ধুতি পাঞ্জাবি শাড়ি ব্লাউজ ছাড়াই স্বচ্ছন্দে দিগম্বর হয়ে থাকতে পারো। তবে হ্যাঁ, কাঁধ থেকে ফিতে দিয়ে একটা ঝুলি ঝোলাতে হবে, তাতে টাকাকড়ি...আরশি-পাউডার আর মুখে লাগাবার রঙও রাখতে পারো। ইউরোপ-আমেরিকার মেয়েদের তবু একটু বুদ্ধি আছে, তারা ক্রমশ দিগম্বরী হচ্ছে...” [মাঙ্গলিকঃ নীল তারা]। পড়া ছিল না, এখন পড়লাম।

    এখানে তিনটে স্মাইলি দিতে ইচ্ছে করছেঃ

    হেঁ হেঁ হেঁ!!



    || সেই শৈল-সানুদেশ, সেই কৈরবী কবয়িত্রী ||

    “হব্বা খাতুন” [‘ভারতীয় সাহিত্য কে নির্মাতা’-সিরিজ]—কাশ্মীরিভাষায় মূল লেখকঃ শ্যামলাল সাধু (হিন্দিতে অনুবাদ শিবন কৃষ্ণ রায়না-দ্বারা); সাহিত্য অকাদেমী; রবীন্দ্র ভবন, নঈ দিল্লী-১; প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৮, পুনর্মুদ্রণঃ ১৯৯৮,২০০৯; ISBN: 978-81-260-2731-6

    ভারতবর্ষে আর কোথাও কোনো কবির নামে পর্বতশৃঙ্গ আছে কি? বিশ্বে, কোনো poetess-এর নামে? (বাঙলায় এক্কেবারে না চললেও, হিন্দিতে কিন্তু মহিলাকবি-অর্থে ‘কবয়িত্রী’ অতি প্রচলিত শব্দ। তৎসম শব্দ হিসেবে আভিধানিকও বটে)। কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তে আজও স্রোতস্বিনী-কলকলয়িতা শ্যামলে শ্যামল উপত্যকামাঝে ঐ দূরে দেখা যায় সুউচ্চ হব্বা খাতুন পর্বতশৃঙ্গ! আজ চারশ’ বছর ধরে কাশ্মীর গেয়ে চলেছে হব্বার গান, পঞ্জাব যেমন বুল্লেশাহের, বাঙলা চণ্ডীদাসের। না, সে কোনো ঈশ্বরপদাশ্রিত উচ্চ দার্শনিকভাবের সঙ্গীত নয়, আকুল প্রেমের গান... প্রেমাস্পদকে হারানোর কাতর সুর... ভাসে... ভাসে কাশ্মীরের আকাশে বাতাসে... কান পাতলে যেন আজও শোনা যায়!

    ***

    কাশ্মীরি ভাষা ও সাহিত্য ভারতের প্রাচীনতমের একটি। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক থেকে এ’ভাষা আপন রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। চতুর্দশ শতকে শৈবসাধিকা লল্লেশ্বরীর (খৃ ১৩২০-৯২) পদে কাশ্মীরি-সাহিত্যের প্রকৃত পুষ্টি হলো, তাঁর সমসাময়িক নন্দঋষির (শেখ নূরুদ্দিন ওয়ালি. খৃ ১৩৭৭-১৪৪০) কাব্যে আরও। না, এঁদের প্রভাব কিন্তু কিচ্ছু পড়েনি আমাদের হব্বা খাতুনের (খৃ ১৫৫৪-১৬০৯) গানে---যাঁকে আখ্যায়িত করা হয় ‘কাশ্মীরি বুলবুল’ নামে। বস্তুতঃ, গ্রাম্যবালিকা হব্বার সামান্য অক্ষরজ্ঞানের অধিক বিদ্যেই ছিল না বোধহয়। তাঁর সব গানই তাই লোকমুখে গেয়ে গেয়ে চলে আসছে আজ চারিশতাব্দীব্যাপী! এক গ্রাম্য মুসলিম কৃষকের কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজপুত্র ইয়ুসুফ শাহ্‌ চাক্‌ তাঁর পাণিগ্রহণ করলেন, নাম দিলেন ‘জুন’---কাশ্মীরিভাষায় চন্দ্রমা, ইন্দু! কিন্তু বেশিদিন সুখ সইলো না জুনের কপালে। দিল্লিশ্বর আকবর কাশ্মীর জয় করে বন্দীরাজা ইয়ুসুফকে পাঠিয়ে দিলেন বাঙলায়। ফেরার পথে বিহারে তাঁর প্রয়াণ ও সমাধি। এদিকে বিরহিণী হব্বার রোদনসুরে মথিত হচ্ছে কাশ্মীরের পাহাড়-নদী-অধিত্যকা! গেয়ে বেড়ান সেই চন্দ্রমাসমা কবিঃ ‘মালি নেও হো...’ বা ‘গাহ্‌ চোন পবন গটি/অকি লটি ইয়িহম্‌ না...’!!! ১৯৭৮-এ পরিচালক বশীর বাদগামি হব্বাকে নিয়ে এক কাশ্মীরি ফিল্ম বানান, যাতে উর্বশী-নায়িকা রীতা রাজদানের রূপে কাশ্মীর মাতোয়ারা! (ইয়ু টিউবে দেখুনঃ https://www.youtube.com/watch?v=Qd8l4hStRWw&list=PL6i4qB133pTyeEsrXzO60XvFjiyWFfTFO) আফশোস অবশ্য রয়েই গেছে, কারণ হব্বার জীবনোপর আধারিত মুজফ্‌ফর আলির ‘জুনি’ (ডিম্পল-বিনোদ খান্না) ছবি মুক্তি পায়নি কখনও, পেলে আরেকটা ‘উমরাও জান’ হয়তো পাওয়া যেত!

    ***

    এ’সব ফিলিম-টিলিমের গপ্প থাক, বর্তমান বইটির কথায় আসি। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিল-মোতাবেক সরকারি ভাষাই রয়েছে ২২টি, তার মধ্যে ডোগরি বা কোঙ্কনির মত কমসংখ্যক ভাষাভাষীরও উল্লেখ্য সাহিত্যিক রয়েছেন, যেমন, দত্তু কবি (ডোগরি) বা, বামন শেনয় গোয়েম্বাব (কোঙ্কনি)। এতোগুলো ভাষা তো কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। তবে কি এই এই সাহিত্যকারের রচনার রসাস্বাদনে বঞ্চিত হবো? কেন, সেই জন্যেই তো ভারতীয় ‘সাহিত্য অকাদেমী’ রয়েছে, যাঁদের ‘ভারতীয় সাহিত্য কে নির্মাতা’-সিরিজের তন্বী তন্বী কেতাবগুলি নানান ভারতীয় ভাষা থেকে অন্য ভাষায় (বেশিরভাগ হিন্দিতে) চমৎকার অনুবাদগ্রন্থ খুঁজে পাবার স্থান। এই শৃঙ্খলায় যেমন ওড়িয়া সাহিত্যের ভগীরথ ফকিরমোহন সেনাপতি রয়েছেন, তেমনি আছেন ডোগরি কবি পরমানন্দ অলমস্তজী, মৈথিল কবি গঙ্গানন্দ সিংহ! বর্তমান গ্রন্থটিও এই সিরিজেরই। ষাটটি পৃষ্ঠার মধ্যে কী চমৎকার ধরে নেওয়া গেছে এই কিংবদন্তীর কবয়িত্রীকেঃ ‘হব্বা খাতুন’! এ’হেন বই না থাকলে আদৌ কখনো এই মহিলাকবির নামই শুনতাম না হয়তো।

    ***

    কাশ্মীরিভাষা-সাহিত্যের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। আরবি অক্ষরের আগে নাগরী-আশ্রিত সারদা (‘সরস্বতী’)-হরফে লেখা হত এই ভাষা। আজও কাশ্মীরি হিন্দুপণ্ডিতগণ এই অক্ষরেই লেখেন, বিশেষতঃ ধর্মীয় ক্রিয়াদিতে। ‘পঞ্চতন্ত্র’কার বিষ্ণু শর্মা, প্রথম ইতিহাসকার কল্‌হনও কাশ্মীরিই ছিলেন। কাশ্মীরি-সাহিত্যে দীননাথজী বা লালা লক্ষ্মণজীর মত হিন্দুকবিগণ মামুদ গামি ও রসূল মীর হেন মহানহস্তীর সাথে একই দর্জা পেয়ে থাকেন। বর্তমান বইটির লেখক শ্রী শ্যামলাল সাধু কাশ্মীরিতেই লিখেছিলেন এই জীবন-কাব্যালেখ্য, সরল হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন শ্রী শিবন কৃষ্ণ রায়না। চমৎকার করেছেন, আমা-হেন গোলা লোকেরও বুঝতে ও রসাস্বাদনে অসুবিধে হয়নি কোনো। বস্তুতঃ, মূলতঃ লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা গানগুলোকে নথিবদ্ধ করাই এক কঠিন কাজ, তার আলেখ্য ও ভাষ্যরচনা আরও। এ’বই যদিও কোনো ‘রচনাসমগ্র’ নয়, এক প্রাথমিক-পরিচিতি গ্রন্থ। প্রথম অধ্যায়টি তো অতি উপাদেয়! মাত্র সাত-আট পাতার মধ্যে ভাষা-সাহিত্য-সমাজের প্রেক্ষাপটে সেই ষোড়শ শতাব্দীর কাশ্মীরকে ধরে নিয়েছেন লেখক যেখানে হব্বার জন্ম ও গীতরচনা। শৈব কাশ্মীরে ইসলাম এসে গেছে তদ্দিনে, ফার্সিভাষার প্রভাব শুরু হয়েছে। মহাকবি ফিরদৌসি-রুমি-হাফেজের সৃষ্টিতে মাতোয়ারা সেই সুরলোকসম উপত্যকা ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয় অধ্যায়ে হব্বার জীবনকথা... তাঁর গ্রাম্য কুঁড়ে থেকে রাজপ্রাসাদে উত্তরণের গল্প, ইয়ুসুফের সঙ্গে তাঁর প্রেমগাথা। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস।

    হব্বার গীতিকাব্যের আলোচনা এসেছে অতঃপরঃ

    ‘লদয়ো দআন পোশ ত হী... ’ (আমি ডালিম-যুঁইয়ের ফুলডালি হাতে...)...।
    গেয়েছেনঃ

    ...প্রাণপ্রিয় মোর, তোমায় খুঁজে ফিরি পর্বতে কন্দরে অরণ্যে অরণ্যে...তুমি কোথায় তুমি কোথায়?... তবে কি চুরি করে নিয়ে গেল তোমায় কোনো পরনারী?...

    গ্রাম্য কোমল নারীমনের স্বাভাবিক হাহাকার! কিন্তু কী সুরে কী শব্দবন্ধে গেয়ে গেছেন হব্বা...! কাশ্মীরিভাষা তো জানি না, তবু তাঁর সুর-বাণীর পৌঁছ্‌টা আজও অনুমেয়—এই চারশত বৎসর পরেও!

    আরেকটি জনপ্রিয় গীত (এটি ফিল্মটিতেও ছিল): ‘গাহ্‌ চোন পবন গটি/অকি লটি ইয়িহম্‌ না...’ [হায়, প্রিয়, একবার যদি এসে যেতে তুমি... তোমার জ্যোতিতে আঁধার দূর...]। আরেকটি বিষয়ও কি লক্ষণীয় নয়? সাধারণত আমরা যেকোন ভাষায় যত প্রেমগীত জানি/শুনি, তাতে দয়িত আহ্বানে দয়িতাকে, থাকে নারীর রূপবর্ণনা। কিন্তু এক অপরূপা নারী তার স্বামী ও প্রেমাস্পদের আহ্বানে আকুল, গানে তার রূপবর্ণনাও রয়েছে — এ’এক বিশেষ অভিজ্ঞতা বটে!

    যেটা সবিশেষ উল্লেখ্য, সেটা হব্বার মৌলিকতা। নূরুদ্দিন ওয়ালির কাব্য তার আগে থেকেই কাশ্মীরে অতি জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু গ্রামীণ কবি হব্বার গানে তার প্রভাব কিছুই নেই। হব্বা যখন গান ‘যদি প্রভু না চাহেন, একমুষ্টি শস্য নিয়ে বাঁচে কি কেউ জীবনভোর?...’ সেটা অক্ষরপরিচয়বিহীন কবির অন্তরের অন্তস্থল থেকেই উঠে আসে। আর, হব্বার মাত্র এই একটি গানেই ঈশ্বরপ্রসঙ্গ সামনে এসেছে, নতুবা পরমেশ্বরপ্রসঙ্গ সরাসরি কোথাও নেই। এটাও কি আশ্চর্য নয় যে যেকালে কাব্য-গাথা অবশ্য অবশ্যই ঈশ্বরভাবাশ্রিত হত (ঠিক সেই সময় সময়েই বঙ্গদেশে শ্রীবৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবত’ লিখছেন। উত্তরভারত মাতাচ্ছেন শ্রীতুলসীদাসজী) তখন সম্পূর্ণ মানবিক সুখ-দুঃখ-প্রেমগাথা নিয়ে এক উল্লেখ্য ভারতীয় কবি তাঁর সৃষ্টিতে মেতে থেকেছেন আজীবন! কতটা আধুনিক! ভারতীয় সাহিত্যমালার কবরীতে হব্বা খাতুনের মূল্যাঙ্ক-বিচারের শেষ নিরীখ এইটাই হওয়া উচিত!

    ***

    পরিশিষ্টে চৌদ্দখানি কিতাবের তালিকা রয়েছে! হব্বার ওপর এতো বই লেখা হয়েছে, সেটাও তাঁর গুরুত্বের প্রমাণ। তার আগে, শেষ অধ্যায়ে, লেখক শ্যামলাল সাধু ‘প্রভাব’-প্রসঙ্গে উপমা টেনেছেন সাড়ে-তিনশ’ বছর পরের কবি মহাদেবী বর্মার ‘নীহার’ কাব্যেরঃ ‘...তুমকো পীড়া মেঁ ঢুঁড়া, তুম মেঁ ঢুঁড়ুঙ্গী পীড়া’!! মহাদেবীজীকে তো ‘দুঃখবাদিনী’ ছায়া-ছায়া-কত-ব্যথার কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়েই গিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় কাব্যে সেই ধারাটার শুরুয়াৎ যে হয়ে গিয়েছিল প্রায় চারশতাব্দী পূর্বেই---কাশ্মীরি কবি হব্বা খাতুনের সুরে সুরে—এইটাই হৈল নবোপলব্ধ জ্ঞান!

    কত কীই যে জানার বাকি!



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)