কাছে-দূরের কক্ষপথে; কেতকী কুশারী ডাইসন; প্রথম প্রকাশ: মে ২০১৫; কারিগর - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৮১৬ ; ISBN: 973-93-81640-56-2
আলোচ্য বইটি শ্রীমতী কেতকী কুশারী ডাইসনের প্রবন্ধের পঞ্চম সংকলন। বইয়ের নামটি চমৎকার — একদিকে এতে আছে কাছের কালের ও দূরের কালের রচনা। অন্যদিকে এখানে পাই কাছের মানুষ, পরিচিত ও অপরিচিত (আমার কাছে) মানুষ; তাঁদের ব্যক্তিত্ব বা রচনার কথা, এবং যাঁরা দূরের কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ, তাঁদের কথা। লেখিকা সেই দ্বিবিধ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করেছেন আর এই পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে লেখিকার ব্যক্তিত্ব, রুচি, মানসিকতার নানা পরিচয়। ৮১৬-পৃষ্ঠার এই সুবৃহৎ বইটির রচনাগুলির সর্বাঙ্গীণ পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়, অগত্যা অভিলাষকে সংহত সংক্ষিপ্ত করতেই হবে বর্তমান রচয়িতার সামর্থ্য অনুযায়ী। কী কী ধরনের লেখা আছে এখানে? লেখিকার ‘মুখবন্ধ’ মেনে বলা যেতে পারে — এখানে আছে স্মরণ, ব্যক্তিগত কথা, গ্রন্থ সমালোচনা, বিবিধ যুগোচিত প্রসঙ্গায়ন। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, একাল ও সেকালের তুলনা, অনুবাদ, বানান সমস্যা, ইত্যাদি বিভাজন ও সংযুক্ত করা যায়। কয়েকটি লেখার কিছু নির্বাচিত পরিচয় দেবারই চেষ্টা করব।
আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কেতকীর একাধিক গ্রন্থ আছে, যেগুলির মৌলিকতা ও বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতা সহজেই চোখে পড়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধে তিনি দেখান গীতরচয়িতা রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর বর্ণদৃষ্টির ছায়া পড়েছে। রঙের স্বরূপ সম্পর্কে অননুভবকে অতিরিক্ত ধ্বনিঝঙ্কারে, রঙ, রাঙা, রঙিন ইত্যাদি শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে তিনি প্রকাশ করেন। তাঁর বর্ণদৃষ্টি গানের ভাষায় প্রভাব ফেলেছে রীতিমত। রবীন্দ্রগান নিছক গান নয়। কাব্য, নাটক, সঙ্গীত নৃত্যের রচিত মহানদীর উর্মিমালা। রবীন্দ্র বর্ণান্ধতার প্রভাব নাটকে এই দিক থেকে বিচার্য মনে করেন। কেতকীর মতে — রবীন্দ্র নাট্যকল্পনার একটা বড়ো অংশ কাব্যসঙ্গীত নৃত্যধর্মী। এ-জাতীয় সৌন্দর্যসৃষ্টিতে অভিপ্রেত নাটকের আস্বাদন নির্ভরশীল একটা গোষ্ঠীগত উদ্যমের ওপর। 'রক্তকরবী' তাঁর মতে অপেরা অথবা ব্যালে উপাদানে গঠিত। রবীন্দ্র নাট্যকলা গভীর অর্থে সঙ্গীতধর্মী কাব্যকলার সম্প্রসারণ। 'ডাকঘর'কে মনে করেন একটি দীর্ঘকবিতা যা পার্থিব মানুষের অসহায়তাকে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রচিত্রের মতো রবীন্দ্রনাট্যেও জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের প্রভাব আছে। ভাষার ঔজ্জ্ব্ল্যই রবীন্দ্রনাটকের এক প্রধান গুণ। এইসব মন্তব্য অনুধাবন-সাপেক্ষ এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা এ-সম্পর্কে কোনো বিতর্কে যাননি, হয়তো কেতকীর মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার মনে করেননি। 'রবীন্দ্রজিজ্ঞাসার পথে' এবং 'রবীন্দ্রনাথের রঙের ভুবন' প্রবন্ধ দুটি তাঁর দুটি প্রসিদ্ধ গবেষণা কাজের সূত্রে পড়লে কাজ দুটির সারাৎসার এবং কর্মপদ্ধতি বুঝতে সুবিধে হয়।
বুদ্ধদেব বসুর রচনার ওপর দুটি প্রবন্ধ আছে। একটি গ্রন্থ-আলোচনা। দুটি আলোচনাই যথেষ্ট ভাল, অন্তত: বুদ্ধদেব রচনা বিষয়ে এরকম লেখা ইতিপূর্বে পড়িনি। বুদ্ধদেব বসুর ভ্রমণ সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় প্রথমেই জানানো হয়, তাঁকে প্রতিভা বসু ঘরকুনো এবং অন্যরা পরিজন নির্ভরশীল বললেও তিনি বেড়াতে বেশ ভালোবাসতেন। তাঁর যৌবনের বেশ কয়েকটি কবিতা ভ্রমণ নিয়েই। কেতকীর মতে বুদ্ধদেব ‘বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ শিল্পীদের একজন’ — মন্তব্যটি অবশ্যই অংশত সত্য। তাঁর কাব্যে উপন্যাসে মননে ভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং ভ্রমণ ‘জ্ঞান আহরণের পথ ও তা গ্রন্থপাঠের সম্প্রসারণ’। তাঁর ভ্রমণসাহিত্যের ভাষা উদার দুর্বার, সেখানে মেলে কবির কলমে গদ্য। লেখিকা প্রথমাবধি ভ্রমণ বিষয়ক রচনার, কবিতায় ভ্রমণের চিহ্ন বিষয়ে চমৎকার উল্লেখ ও আলোচনা করেছেন। ‘দেশান্তর’ বইটিতে আছে পাশ্চাত্যের নানা অঞ্চলের প্রসঙ্গ, কিছু খ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক মন্তব্য। কিন্তু, বুদ্ধদেবের ভ্রমণ রচনায় যাকে বলে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন (আমি ট্রাভেল গাইডের কথা বলছি না)-এর অভাব আছে। আর তাঁর ভ্রমণে আছে মহার্ঘ্য হোটেলে অবস্থান, জানালা দিয়ে প্রকৃতি নিরীক্ষণ, সেখানে নেই যে-কোনো অঞ্চলের মানুষজনের সঙ্গে আলাপের, সাধারণ জীবনযাত্রার ধরন, ইত্যাদির। পায়ে হেঁটে ভ্রমণ তাঁর ছিল না। বরং জীবনযাত্রার, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার পার্থক্য নিয়ে কিছু ভাবনা, যা ইতিপূর্বে পাওয়া গেছে কম। তাঁর রচনায় আবিষ্কৃত হয়েছে মানস ভ্রমণ, নিষ্ক্রিয় ভ্রমণ, স্মৃতির ভ্রমণ; সাহিত্যে প্রতিফলিত ভ্রমণ আছে তবে ‘পথিক অস্তিত্বের বিশেষ দার্শনিকতা’ আছে কি না তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। প্রকৃতির প্রাসঙ্গিক বর্ণনা অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু গন্তব্যের প্রসঙ্গ, জরুরি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তিনি চলে যান প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মন্তব্যে, আলোচনায়। রেমব্রাঁ বিষয়ক লেখাটি অনেকদিন পর আবার পড়লাম, তাতে শিল্পী বিষয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য আছে, অনেক বিহ্বল করা ছবির কথা আছে, কিন্তু রেমব্রাঁ যে কারণে বিশিষ্ট সেই আলোছায়ার মায়ার কথাটি নেই।
বুদ্ধদেবের কবিত্ব বিষয়ে কেতকীর আলোচনা যথেষ্ট উদ্দীপক, বুদ্ধদেবের ‘বহুমুখী প্রতিভা’ সম্পর্কে মতদ্বৈধতা নেই, যদিও ‘নিয়ত গতিশীল’ কিনা এ নিয়ে সংশয় আছে কিছু মানুষের। তাঁর কবিতা অনুধাবনে ‘কবিতার শত্রু ও মিত্র’ বইটির স্বীকারোক্তি, অনুবাদক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অধ্যবসায় নিয়ে আমাদের সংশয় নেই, কিন্তু এ প্রবন্ধ পড়ে, তুলনামূলকতা না থাকায় বুদ্ধেদেবের যথার্থ স্থানটি নির্ণয় হয় না। তাঁর ‘বাক্যবিন্যাসের পেশীময়তা’ সম্পর্কেও ভিন্নমত পোষণ করি, যদিও তাঁর গদ্যের অন্তর্লীন ধী ও ভাবমুখ্য স্বাতন্ত্র্য মেনে নিতে কষ্ট হয় না।
প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ বইটির রিভিয়ু করতে গিয়ে তিনি যা বলেন তা হল — প্রতিভা মূল মহাভারত পড়েননি। ইরাবতী কার্ভের একটি বিচক্ষণ রচনা এবং কালীপ্রসন্নর মহাভারত পড়ে এই অরণ্য পরিচয়ে নামা কিন্তু বিপজ্জনক। এখানে কথাসাহিত্যিকের অন্তর্দৃষ্টি খুব বেশি এগোতে সহায়তা করে না, ‘কঠোর বাস্তববাদী দৃষ্টিতে’ গল্পগুলোকে যাচাই করতে হলে মহাভারতের আলোচনার, তার সমাজপ্রেক্ষণের কিছু প্রত্যাশিত রেফারেন্স পড়ে নেওয়া দরকার। নারীর ‘খরদৃষ্টি’ ছাড়াও দরকার আরো অনেক কিছু, নইলে কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরের চরিত্র বিশ্লেষণেও ‘সিদ্ধিলাভ’ অসম্ভব। বিভিন্ন রচয়িতার নিজস্ব মনোভাবের প্রতিবিম্ব বুঝতে গেলে মহাভারত পাঠান্তর বিষয়ক কিছু আলোচনায় চোখ বুলোনো দরকার। তাই বুদ্ধদেব ও প্রতিভার আলোচনা, লেখিকা ঠিকই বলেছেন, ‘পরস্পরের পরিপূরক’ কিন্তু তা সাহিত্যিকের আলোচনা, প্রাচীন সমাজ সচেতন সাহিত্যিকের আলোচনা নয়। দুজনেই মুখ্য কয়েকটি চরিত্রের 'পুনর্নির্মাণ' করেছেন কিন্তু সন্তানের বৈধতা অবৈধতা মহাভারতের মুখ্য সমস্যাই নয়।
শিবনারায়ণ রায়ের ‘বিবেকী বিদ্রোহের পরস্পরা’ বইটির আলোচনা সূত্রে কেতকী রেনেসাঁ, রামমোহন, তসলিমা প্রসঙ্গ তুলেছেন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঙ্গত দ্বিমত পোষণ করেছেন। তসলিমা প্রসঙ্গে শিবনারায়ণের অভিমতকে, তাঁকে ভলতেয়ার সার্ত্র কাম্যুর ঐতিহ্যের অন্তর্গত বলাটা পছন্দ করেননি, পশ্চিমবঙ্গীয় অবক্ষয় প্রসঙ্গে শিবনারায়ণের অভিমত তাঁর পছন্দের নয়। সহমত পোষণ করে বলি তাহলে শিবনারায়ণের স্বভাব বিদ্রোহী ভঙ্গির সারবত্তা কোথায়? তাঁর বিদ্রোহী সত্তা কেন এখানে অর্থাৎ বঙ্গে তেমন পাত্তা পায় না? লেখিকার বুক রিভিউ-এর একটি বৈশিষ্ট্য — গ্রন্থোক্ত প্রসঙ্গের সঙ্গে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার বিনিময় — যাতে লেখা হয়ে ওঠে সরস।
কেতকী শুধু কবি কথাসাহিত্যিক নাট্যকার প্রাবন্ধিক নন, বাংলা বানান বিষয়েও তাঁর সুস্পষ্ট জেহাদ আছে। দেবপ্রসাদ ঘোষ রচিত ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বানান’ বইটির আলোচনা সূত্রে দেবপ্রসাদের পরিচয় দিয়ে তাঁর অভিমতের দুটি মূল সূত্র তুলে ধরেন — (ক) একটা জীবন্ত সচল ভাষার উচ্চারণ মুখে মুখে বদলাতেই থাকে। তাই বানানকে উচ্চারণ অনুযায়ী কোনো কাঠামোর মধ্যে পুরো বেঁধে ফেলা অনুচিত; (খ) বানান পদ্ধতিকে অতীতের সঙ্গে, শব্দগত ব্যুৎপত্তির সঙ্গে যোগ রাখতে হয়। ভাষাকে সম্পূর্ণ ফোনেটিক করা যাবে না। দেবপ্রসাদের বিরোধ ছিল সুনীতিকুমার, রাজশেখর, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও, যাঁরা বানান সংস্কারে অনেক জোড়াতালির পক্ষে ছিলেন। দেবপ্রসাদ বাঙলা লিপিতে দীর্ঘ ঈ-র প্রয়োজনীয়তা বুঝতেন। তাঁর রচনাশৈলী একই সঙ্গে ধারাল এবং কৌতুকরসে সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর তর্কগুলি আজকের পাঠকদের কাছে ঔৎসুক্যকর ঠেকবে। দেবপ্রসাদের বক্তব্য আজকে বানান নৈরাজ্যের কালে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
‘প্রসঙ্গ: অনুবাদ’ রচনাটি অসাধারণ। তাঁর নিজস্ব অনুবাদের অভিজ্ঞতা, অনুবাদ দেখার অভিজ্ঞতা এবং অনুবাদ বিষয়ক উপলব্ধির নানা স্তর মিশিয়ে রচনাটি বিশিষ্টতার মাত্রা অর্জন করেছে। ব্যক্তিক প্রসঙ্গে রচনাটি শুরু হলেও তিনি চলে যান প্রাচ্যবাদ বিষয়ে সাঈদের বক্তব্য এবং ওরিয়েন্টাল স্কলার হবার ইচ্ছা সংকুচিত হবার প্রসঙ্গে। তারপর বলেন অনুবাদ করার ক্ষেত্রে একভাষিতার সীমাবদ্ধতা কাটানো, একাধিক ভাষার হাবভাব সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন, অনুবাদ বিষয়ে টেকনিকাল অনুশাসন আয়ত্ত করা এবং সর্বোপরি সৃষ্টিশীলতার লক্ষ্য বজায় রাখার কথা। কেতকী ‘সৃষ্টিশীল অনুবাদ’-এর পক্ষপাতী, চেনার সঙ্গে অচেনাকে মেলানোর, আধা দেশী আধা বিদেশী-করণের পক্ষে, তবে একেবারে দেশী করাতে তাঁর আপত্তি, কারণ অনুবাদ পড়ার উদ্দেশ্য — ‘অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণ’। কিন্তু মনে হয় এই দোআঁশলা করার মাত্রাজ্ঞান অনেক সময় অনুবাদকদের থাকে না, যা বিষ্ণু দে’র এলিয়ট অনুবাদ, অলোকরঞ্জনের গ্রীক নাটক অনুবাদে দেখা যাবে। একথা কেউই অস্বীকার করবে না যে ‘বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতু বাঁধবার এক ঈর্ষণীয় ক্ষমতা রয়েছে অনুবাদ সাহিত্যের’। নতুন কথাটা হল এই যে ‘অনুবাদের ভাষাটাকে পাঠকগোষ্ঠীর সময় ভাষা’ করার। তবে প্রশ্ন উঠবে পাঠকগোষ্ঠীর সময় তো flexible, রবীন্দ্রযুগে ‘ব্রাউনিং পঞ্চাশিকার (সুরেন্দ্র মৈত্র) বা ‘শেলী সংগ্রহ’র ভাষা তো ২০১৬তে বদলাতে হবে, তাই না। ‘সমুদ্রের মৌন’ যতোদূর জানি ‘গল্প’ নয় এবং এর দুটো অনুবাদ আছে — বিষ্ণু দে ও অরুণ মিত্রর। দ্বৈভাষিক দক্ষতা সম্পন্ন অনুবাদক (বিশেষত: কবিতার) পাওয়া খুবই শক্ত। গদ্য অনুবাদে অর্থানুসরণের দায়িত্ব বেশি, বিশেষত: কাব্যময় টেক্সট-এ দায়িত্বটি সাহিত্যজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। চমৎকার বলেছেন অনুবাদের দ্বিবিধ ভূমিকা বিষয়ে। তা হল সাহিত্যের উৎসভাষার সম্পদ সম্পর্কে খবর (ও আগ্রহ সঞ্চার) দান এবং গ্রহীতা ভাষাকে সমৃদ্ধকরণ। এর কিছু উদাহরণ থাকলে ভালো হত। (যেমন— নাজিম হিকমতের অনুবাদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যভাষার বদল, বুদ্ধদেবের বোদলেয়র অনুবাদ প্রভাবে ষাটের বাংলা কবিতায় কিছু বদল)। অনুবাদে মূলের কিছু ফুল ফল টিপিকাল কালচার প্রসঙ্গ না বদলানোই ভালো, যা কেতকীর মতো নবোকভও বলতেন। (উনি মূল বজায় রেখে একটু টীকা দেবার পক্ষে) হাল আমলে মূল ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে (যেমন সাহিত্য অকাদেমির প্রযত্নে) সে বিষয়ে উনি আগামী দিনে কিছু বলবেন আশা রাখি।
‘স্বাধীনতা তুমি’ স্বাধীন ভারতের উপলব্ধির স্তরান্তর বিষয়ে বেদনা/বিষাদ ভরা মূল্যায়ন। রবীন্দ্র চিন্তার মূল্যায়ন ৩২৮ পৃষ্ঠার চমৎকার, যদিও সে উত্তরাধিকার আজ এমনকী শান্তিনিকেতনে যথেষ্ট ক্ষয়িষ্ণু এবং একদল চিন্তক যাবতীয় পরিত্রাণ ভূমি সন্ধান করেন রবীন্দ্রনাথে এটাও ভাবার বিষয়। সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আজ বহিরঙ্গে সেক্যুলার অন্তরঙ্গে নয় এ ব্যাপারটি ভারতীয় সমাজজীবনে বহুদৃষ্ট। বাক্স্বাধীনতা বাঁচিয়ে রাখার যে পশ্চিমবঙ্গীয় ঐতিহ্যের কথা বলেছেন তা যে যথেষ্ট তথ্যসমর্থিত নয় সেটা বোঝা যায় শিল্পীর স্বাধীনতা বিষয়ক ধারাবাহিক (দেশ পত্রিকায়) স্বীকারোক্তিতে, জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর সামনে অগ্রগণ্য বাঙালি সাহিত্যিকদের ভূমিকাতে। উনি ঠিকই ধরেছেন 'দেশ' পত্রিকা মনন অপেক্ষা বিনোদনকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এটি আমারও অভিজ্ঞতা। বড় প্রকাশনার জঘন্য গল্প ও কবিতার প্রশংসাপূর্ণ রিভিউ, পছন্দ না হলে একই বইয়ের একাধিক রিভিউ এসব ঘটে চলেছে। কেতকী বিশ্বায়ন-আগ্রাসী সংস্কৃতি ও জীবনকে যেমন লক্ষ্য করছেন, তেমনি ধর্মান্ধতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সেটাও দেখছেন। ক্রমশ: তা বাড়ছে, বিশেষত: সাম্প্রতিককালে। ‘দেশজ সংস্কৃতির মাটি থেকে ছিন্নমূল হয়ে ইংরেজীচর্চা’ এবং তত্ত্বসর্বস্ব সাহিত্যবিচার এবং পি.এইচ.ডি মুখী সিলেবাস মনস্ক গ্রন্থ রচনার যে ঝোঁক এসেছে তা অভিনিবিষ্ট কাজের প্রতিবন্ধক। এর সঙ্গে ধর্মান্ধতা ও খেয়ালখুশী অনুযায়ী ইতিহাস ও দেশনায়ক পাল্টানো, কেচ্ছা রাজনীতি ও দুর্নীতির প্রাবল্য, দেশের সার্বিক জনতার ক্রমদুর্দশা ও অট্টালিকা ফ্লাইওভার মলশোভিত নাগরিকতা, বিদেশী শক্তির ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজজীবনে নতুন অনুপ্রবেশ, সিরিয়াস পাঠ ও কাজের বিপক্ষে প্রচারক নব্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় প্রভৃতির ভূমিকা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের কয়েকটি কালো দিক নিশ্চয়ই তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে না পড়ার কথা নয়।
‘মাদার টেরেসা: বাস্তবের আলোকে’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর। আমার মনে হয় সমস্ত কলকাতাবাসীর এই বিষয়টি জানা উচিত। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মাদার টেরেসা একজন করুণাময়ী নারী হিসেবে পরিচিত কিন্তু প্রকৃত ঘটনা অন্যরকম। তিনি মানুষের কষ্ট লাঘব অপেক্ষা খৃষ্টীয় স্বর্গের জন্য আত্মা জোগাড়ে আগ্রহী। ম্যালকম মাগারিজই বি.বি.সি.র এক তথ্যচিত্র মারফৎ তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেতে সাহায্য করেন। কিন্তু টেরেসার কাজকর্ম মানবতান্ত্রিক নয়, ধর্মতাত্ত্বিক। অন্যদিকে কলকাতা যে দৈন্য দুর্দশা জঞ্জাল মলিনতা পূর্ণ এবং ইনি ত্রাণকর্মী এই ধারণা ছড়িয়েছে বিশ্বে, ফলে ‘টেরেসা ফ্যাক্টর একটা নঞর্থক ভূমিকা পালন করেছে’। তাঁর ‘কাছে ঘেঁষা অতি কঠিন’, তাঁর মধ্যে খোলামেলা মনোভাব ও দায়িত্ববোধের অভাব। তিনি যাদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন তারা ‘খুবই তমসাচ্ছন্ন চরিত্রের’। বৃটেনে চিকিৎসাব্রতী ডাক্তার অরূপ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বই ‘মাদার টেরেসা: দি ফাইনাল ভার্ডিক্ট’ মারফৎ অনেক কথা প্রমাণ করেছেন। টেরেসা আশ্রয়শালাগুলোর যত্ন ব্যাপক ত্রুটিযুক্ত, তিনি যত মানুষকে সাহায্য করেছেন তার চাইতে ঢের বেশি মানুষকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁর প্রতিমা ও কীর্তির মধ্যে আছে ‘বিরাট ফারাক’। তিনি প্রতারণার সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অন্যরা এতে মদত দিয়েছেন। তিনি ভারতের বাইরেই সময় কাটাতেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাবার পর। দানধর্মী ক্রিয়াকলাপের গল্প বাইবেলের ছাঁদে গল্প, একই গল্পের নানা রূপ আনতেন। তাঁর কাজকর্ম মোটেই ভালোবাসাপ্রসূত নয়। বাজারে চলতি কথা তিনি অনর্গল বাংলা বলতে পারেন, যা সত্য নয়। মাগারিজ লোকটি যিনি খ্যাতিবর্ধনের সূচনাকারী তিনি ইহুদী বিদ্বেষী, নারীসংসর্গে আসক্ত, ধর্মীয় জীবনযাপনে কৌশলী। তিনিও তাঁর ডায়েরিতে কলকাতাকে নিন্দার্হ করে এঁকেছেন। টেরেসার নোবেল শান্তি পুরস্কারের নেপথ্যে বারংবার ভূমিকা নেন কুখ্যাত রবার্ট ম্যাকনামারা। জীবনের শেষ পঁচিশ বছরে কলকাতার কোনো বস্তির ভিতরে তাঁকে দেখা যায়নি। তিনি মোটেই প্যারিসে চিকিৎসা প্রশিক্ষণ পাননি যা বিজ্ঞাপিত। সারা পৃথিবী থেকে প্রাপ্ত খেলনা ও জামাকাপড় যা কলকাতায় আসে তা বেচে দেওয়া হয় ফুটপাতে, স্থানীয় দোকানদারদের কাছে। অত্যন্ত প্রচারমনস্ক মহিলা। কলকাতায় গত পঞ্চাশ বছরে নানা বস্তি-উন্নয়ন পরিকল্পনার একটির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন না। টেরেসা আশ্রয়শালাগুলির ভিতরের দৃশ্য মর্মান্তিক। শিশুভবনও তাই। টেরেসা-পুরাণ প্রচারে দমিনিক লাপিয়েরের বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাঁর আয়ব্যয়ের হিসাব নিকাশের গল্প গোলমেলে। তিনি শেষ চেষ্টা চালান পুণ্যাত্মা বলে ঘোষিত হওয়ার এবং পূর্ণমাত্রায় সন্ত বলে ঘোষিত হওয়ার দিকে। অথচ টেরেসা সারা জীবন অবিশ্বাসের জ্বালায় পুড়েছেন। এতো কথা কজনই বা জানে।
‘সাহিত্যের পঠনপাঠনের সেকাল আর একাল’ প্রবন্ধের লক্ষ্য প্রবন্ধ নামের মধ্যেই প্রত্যাশিত। কেতকী জানান, তাঁর ছাত্রজীবনে টেক্সটগুলো সহমর্মিতার সঙ্গে পড়ে নেওয়া, ক্রিটিকদের কথাবার্তায় তুলনায় কম গুরুত্ব দেওয়ার কথা। সাহিত্য কর্মের ঐতিহাসিক পটভূমি, ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফর্মেশন, লেখক বা লেখক গোষ্ঠীর দেশ কালের প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতিক বাতাবরণ জানানোর দায়িত্ব নিতেন শিক্ষকরা। তাছাড়া ইংরাজী সাহিত্য অধ্যয়নে একাধিক ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, ইংরাজী ভাষার ইতিহাস দেখাটা ছিল আবশ্যিক। অক্সফোর্ডে টার্মপেপারে আলোচ্য লেখক বিষয়ে তরুণ গবেষকের উপলব্ধিকেই গুরুত্ব দেওয়া হত। তত্ত্বের ঊর্ণাজাল আগ্রাসন সৃষ্টি করেনি। এরপর তিনি এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্বের নঞর্থক দিক নিয়ে, পোস্টকলোনিয়াল তত্ত্বের প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করেছেন। আমার মনে হয়ছে এখানে সাহিত্য পঠন পাঠনের সেকাল যতটা গুরুত্ব পেয়েছে একাল সে তুলনায় ততটা মনোযোগ পায়নি। আমার দীর্ঘকালীন শিক্ষকতাজীবন এবং গবেষণা পরিচালনা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তর গবেষণাপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার কিছু কথা এখানে সংযুক্ত করা প্রয়োজন মনে করি। কেতকী তত্ত্বের আগ্রাসন সম্পর্কে বলেছেন, আমি বলবো ভারতীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্ব পড়ানো এবং তত্ত্ব প্রয়োগ দুটোই যথেষ্ট পরিমাণে ভ্রমাত্মক। বহু গবেষক গবেষিকাকে প্রশ্ন করে জেনেছি অনেক বেসিক জিনিসই তারা রপ্ত করেনি, রপ্ত করতে শেখানো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকও বেসিক জিনিস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি অথচ একটা অহং ফণা তুলে আছে। সর্বোপরি, এক্ষেত্রে ইউ.জি.সি.-র ভূমিকা মারাত্মক। বিভিন্ন সেমিনারগুলিতে গবেষকদের যেভাবে নম্বর সংগ্রহে উৎসাহ দেওয়া হয় তাতে গবেষণাপত্রের দ্রুত রচনার প্রলোভন আছে। ক্লাসেও বেসিক পড়ানো হয় না, সেমিস্টার প্রথায় সময় নেই, এ আক্ষেপ শিক্ষকরাই করে থাকেন। ফলে সাহিত্য পাঠ, সে বিষয়ে লেখার মধ্যে আছে একটা চটজলদি ভাব। কেতকী খোঁজ নিলে জানতে পারবেন যত সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ বেরোয় তার একটা বড়ো অংশই ছদ্মবেশী নোটবই মাত্র। পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা পাঠ্যসূচিতে সাহিত্য গুণান্বিত প্রসঙ্গের গুরুত্বহানি ঘটেছে প্রশ্নের মধ্যে। প্রকাশ কল্পনার মর্যাদা নেই আর রচনাও অবহেলিত। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। ইংরেজি বিভাগের দাপট স্বাধীন ভারতে বেড়েছে (পৃ ৪৭৭) — ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু দাপটে যতটা ফাঁকা আওয়াজ, তাতে সারবত্তার একান্ত অভাব। ইংরেজির অধ্যাপক এবং ছাত্রছাত্রীরাও তাদের বিষয়গুলি প্রত্যাশিত মাত্রায় চর্চা করায় আগ্রহ বিসর্জন দিয়েছে।
স্মৃতিকথা পড়ার আলাদা চার্ম আছে আমার কাছে। ব্যক্তিকে নতুন ভাবে জানা হয়, প্রসঙ্গ সম্পর্কে কৌতূহল জাগে, স্মৃতিকথক সম্পর্কে ধারণা বিকশিত হয়, স্মৃতির বিষয় আমাকে নতুনভাবে ভাবায়। লোকে বলে, বয়স হলে স্মৃতিকথা লেখা ও পড়ার টান বাড়ে। আমি কিন্তু স্মৃতিকথা পড়ে আসছি তরুণ বয়স থেকেই। সাগরময় ঘোষকে, তাঁর পরিবারবর্গকে চিনতাম কাছে থেকে। সাগরবাবুর সম্পাদক সত্তার, যোগ্য সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা দানে তাঁর ভূমিকা কেতকীর ক্ষেত্রেও আর একবার প্রমাণিত হল। কেতকী যখন স্বনির্বাচিত আলোচ্য বইপত্র সম্পর্কে তাঁর ‘আন্তর্বিদ্য’ প্রবণতার কথা জানান তখন সাগরময় জানান — ‘তোমার নির্বাচনই শেষ কথা’। এমনকি তাঁর কবিতার বই ছাপার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নানা সাহায্য করেন। কর্মপ্রেরণা, সমর্থন, গুণগ্রাহিতা, স্নেহ — এই চতুবর্গ ফললাভ পেয়ে লেখিকাকে ভাগ্যবতীই বলতে হবে। তাঁর শিক্ষক সুবোধ সেনগুপ্ত সম্পর্কে কথা একাধিক লেখায় আছে। কৃতবিদ্য কেতকী জানান — শেক্সপীয়র কমেডি বিষয়ে সুবোধবাবুর বইকে তাঁরা ছাত্রজীবনে মনে করতেন ‘অবশ্যপাঠ্য’। সহপাঠীর সঙ্গে কলেজ পত্রিকা বিষয়ে করিডরে আলোচনায় তাঁর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিপাত, ক্লাসে সন্দেশ বিনিময়ের কালে বকুনি খাওয়া, বিদেশে পড়তে যাবার ব্যাপারে সার্টিফিকেট দান, সুবোধবাবুর স্মৃতিকথা সম্পর্কে সপ্রশংস মন্তব্য, অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ সম্পর্কে সুবোধবাবুর দৃষ্টিভঙ্গি, স্বামী সহ সাক্ষাৎকালে মুমূর্ষু, সুবোধবাবুর ছাত্রীর কাজের জন্য খুশী হওয়া ইত্যাদি পড়ে এই অধ্যাপক মানুষটিকে চেনা যায় নতুন করে। আমরাও তাঁকে খুব ভয় করতাম। ওর ভাগ্নে লোকসঙ্গীত গায়ক কালী দাশগুপ্তের সঙ্গে দোতলায় দেখা করতে যাবার সময় ত্রস্ত থাকতাম। দেখতাম ইজি চেয়ারে শুয়ে আছেন, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে দুধারে নানা অভিধান ও বই।
নারী হিসেবে আত্মপরিচয় বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার কঠোর সুশৃঙ্খলা ও মেধাবী পথের কথা তিনি বলেছেন নানা উপলক্ষে নানা রচনায়। একদিকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিকাশ অন্যদিকে তাঁর সৃষ্ট নানা রচনায় সেই আত্মপরিচয় প্রকাশের নানা দিক, নানা ফর্মের কথা। এই বিষয়টি নানা কারণে অভিনব — কারণ, তাঁর পাশ্চাত্যে জীবনযাপন, সারা পৃথিবী ব্যাপী ভাষণাদি ও আলাপচারিতায় মেধা বিনিময়। বাবার, মায়ের, স্বামীর, সতীর্থদের, বিদেশে নানা ক্ষেত্রে যাপন, শিশু কোলে গবেষণা শুরু, শিক্ষকতা, ফ্রি ল্যান্সিং, অথচ কেন্দ্রে অব্যাহত থাকে মাতৃভূমি অখণ্ড বাংলাদেশে। গবেষণার জন্য ভাষা শিক্ষা, আর্জেন্টিনায়, ইংলন্ডে অনুসন্ধান, রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা নিয়ে বিজ্ঞানস্পৃষ্ট সাহিত্য গবেষণা — আমাদের বিস্মিত করে বারংবার। আমরা যারা তাঁর স্বজনবর্গের বাইরের মানুষ তাদের কাছে কেতকীর আত্মপরিচয় ঘোষণার নানান মাত্রা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। দ্বিতীয়ত: যেসব মহিলারা সাহিত্যের কাজকর্ম করছেন তাঁরা কিছু কিছু প্রেরণা পাবেন। তৃতীয়ত: যেসব তরুণ গবেষক কাজে নেমেছেন, নামতে যাচ্ছেন, তাদেরও শিখতে চাইলে অনেক কিছু শেখার থাকল।
প্রথম পৌষমেলা দেখার স্মৃতি কথাটি নিজের প্রথম দেখার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে গিয়ে দেখলাম একেবারেই আলাদা। কেতকীর চার বছর পর আমি এ মেলায়। ওঁর স্মৃতি, স্নান, খালি পায়ে হাঁটা, অকারণ হাসা, বারণের খাদ্য খাওয়া, স্বাধীনতা ভোগ, পৌষস্মৃতিকে বাংলা ও ইংরেজি কবিতায় ধারণের মধ্যে। আমার স্মৃতিতে শীতের রাত্রে ব্যান্ডেলে গাড়ীবদল, মিষ্টিওলাদের সান্নিধ্য, ভোরবেলায় হাঁটতে হাঁটতে বৈতালিক, পূর্ণদাস নবনীদাসের বাউল গান, ছবি বন্দোপাধ্যায়ের কীর্তন শোনা, যদৃচ্ছা পদব্রজন, বাবার জন্য কারুকার্যখচিত লাঠি কেনা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি উপহার পেয়ে স্কুলজীবনের প্রথম দিকেই রোমাঞ্চিত হই, পৌষমেলা সে রোমাঞ্চ বাড়ায়। তখন কে জানত, ওই শ্রীক্ষেত্রেই চাকরিসূত্রে, অন্য সূত্রে কেটে যাবে বেশ কয়েকটি বছর। অন্য একটি রচনা মারফৎ জানলাম শ্রীযুক্ত নিমাইসাধনের অনুরোধেই রবীন্দ্রকবিতার ইংরেজি অনুবাদে তিনি প্রবৃত্ত হন, রবীন্দ্র-ওকাম্পো পত্র বিনিময় সাহিত্য অকাদেমি মারফৎ প্রকাশে তিনি সাহায্য করেন। তাঁর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সূক্ষ্মদর্শী মানবতার পরিচয় আছে এ লেখায়। আছে ‘ভগ্ননীড় বিশ্বভারতী’ বইটির মধ্যেকার প্রজ্ঞা, যুক্তি, নির্ভীক সত্যভাষণ, মমত্ব, কর্তব্যবোধ, মালিন্যবর্জিত চিন্তাশীলতা, রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শের প্রতি মমত্ববোধ। স্বনামধন্য চক্ষু-শল্যবিদ কিরণ সেনের সাহায্য এবং পরে ড: জ্যোতির্ময় বসুর ভূমিকা কেতকীর সাংস্কৃতিক চর্চায় যে ভূমিকা নিয়েছিল তা পড়ে আমরা ভাবতে পারি এখনও দু চারজন এমন চিকিৎসক আমাদের জুগিয়ে গেছেন আশাভরসা।
‘মেয়েদের আত্মবিবৃতিদান’ প্রবন্ধটি দুটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি হল— কেতকীর লেখার নিজস্ব প্যার্টানটি উপলব্ধি করার ব্যাপার। তিনি আত্মজৈবনিক আঙ্গিকের সম্প্রসারণ রীতি পছন্দ করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমশ: তিনি সমাজগত অভিজ্ঞতায় পৌঁছাতে চান। যাঁরা কেতকীর নানা প্রবন্ধের পাঠক তাঁরা এই প্যার্টানটি লক্ষ্য না করে পারেন না। দ্বিতীয় বিষয়টি হল— নারীর আত্মবিবৃতি দান ও ভিন্নতা বোঝাতে কয়েকটি বই বেছে নিয়েছেন। তার মধ্যে আছে ওকাম্পোর টেস্টিমোনিয়োস, তসলিমার আমার মেয়েবেলা ও উতল হাওয়া, ফতিমা মোর্নিস্সি-র ড্রিমস অফ ট্রেসপাস, এবং বিয়ন্ড দ্য ভেইল এবং আয়ান হির্সি-র দ্য কেজড ভার্জিন। মেয়েরা শূন্যে নয়, বাস করে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জালের ভিতরে — এটা উল্লিখিত সব কটি বইয়েরই সদৃশ ব্যাপার যদিও দেশ ও সমাজভেদে সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় কীভাবে কতোটুকু ভিন্ন হয়েছে, কেন তা হয়েছে সেটা বলতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর আর একটি মন্তব্যও ভাববার মতো। সেটি হল — স্মৃতিচারণা তাই কখনোই শতকরা একশো ভাগ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস নয়। প্রামাণিক ইতিহাস তৈরি করতে হলে সমসাময়িক অন্যান্য সাক্ষ্য অবশ্যই জড়ো করতে হয়। তাঁর মনে হয়েছে ‘তসলিমার আত্মবিকৃতি সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের সামনে প্রসারিত একটি জটিল কেস স্টাডি’। মরক্কোর সমাজবিজ্ঞানী ফতিমা মের্নিস্সির বাস্তব অভিজ্ঞতার পুন:নির্মাণ, দ্বিতীয়টিকে বুঝতে চান মুসলিম সমাজে স্ত্রী পুরুষ সম্পর্কের তাত্ত্বিক ভিত্তি। অন্যদিকে সোমালিয়ার হির্সি জানান ইসলামী নারী নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটি। এই বইগুলির একটা তুলনামূলকতার ছোট্ট প্রয়াসও রচনাটিতে বিদ্যমান।
শিবনারায়ণ স্মৃতি বিষয়ক নিবন্ধটি ভালো লেগেছে লেখিকার আবেগদীপ্র অথচ মনন-সতর্ক ভঙ্গিমার জন্য। রচনায় মুখ্যত শিবনারায়ণের কৃতজ্ঞ সান্নিধ্য, পৃষ্ঠপোষকতা, নিরন্তর উৎসাহদান যেমন তেমনি শিবনারায়ণের কিছু গদ্য ও কবিতার মূল্যায়ন আমাদের ভালো লাগে। শিবনারায়ণের মধ্যে ছিল নিজ নি:সঙ্গতা ও ট্রাজেডির বোধ, বিশ্বজনীন মানবতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, আর্ত, হৃদয়াবেগতাড়িত কবিস্বভাব। স্বীকার করেছেন ‘আমার চিন্তার বিবর্তনে তাঁর একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে’। অন্যদিকে শিবনারায়ণের চিন্তায় কিছু প্রভাব পড়েছে কেতকীভাবনার। সন্দেহ নেই তিনি ‘সদানির্মীয়মান, জঙ্গম ব্যক্তিত্বের মানুষ’। গবেষক-সম্পাদক হিসেবে তিনি অক্লান্ত ও পরিশ্রমী। মানবেন্দ্রজীবনী তাঁর ‘দায়বদ্ধ ভালোবাসার এবং একনিষ্ঠ অনুসন্ধানের ফসল’। তাঁর কাজের মধ্যে ছিল 'ব্যাপ্তি ও গভীরতা’। তিনি এক জিজীবিষু রোমান্টিক। ডায়াস্পোরিক দিকটা ফুটেছে তাঁর রচিত নানা কবিতায়। শিবনারায়ণের প্রতি আমার আগ্রহ ও মুগ্ধতা তৈরি হয় ‘প্রবাসের জার্নাল’ পড়তে পড়তে। তার পর নানা লেখা পড়েছি, ২/১ টি বক্তৃতাও শুনেছি — মুগ্ধ হয়েছি কখনও, কখনও বা ক্ষুব্ধ আবার বিরক্ত হয়েছি কোনো কোনো চিন্তার স্ফুলিঙ্গে।
‘বিলেতে বাঙালীর বেশে’ নামক ছোট্ট লেখায় প্রথম ইংল্যান্ড যাত্রার কথা আছে। শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য শাড়ির আড়ালে ট্রাউজার পরার কথা আছে। ইংল্যান্ডে থেকেও অব্যাহত বাংলা শেখা চালিয়েছিলেন তিনটি বৈশিষ্ট্যের আনুকূল্যে — মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতায়, প্রয়োজনীয় ভাষাগত বনিয়াদ রপ্ত থাকায়, প্রকাশের নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম পাওয়ায়। যথার্থই বলেছেন, তিনি প্রকৃতঅর্থে বহুমাত্রিক, যদিও আগ্রহ সতত নতুনের দিকে, সৃজনশীল পরীক্ষা নিরীক্ষায়।
অম্লান দত্ত বিষয়ক লেখাটিও মর্মস্পর্শী। কেতকীর সৌভাগ্য আশির দশকে তাঁর সৌহার্দ্য পেয়েছিলেন। তাঁর স্বনির্ভরতা, একাকীত্ব প্রিয়তা, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় আগ্রহ, বন্ধু সাহচর্যে উজ্জ্বল আনন্দ অনেকের মতো তাঁকেও মুগ্ধ করে। আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর মধ্যে এক দৃঢ়চেতা সন্ন্যাসী, খ্যাপাটে বাউল, নরম মনের কিশোরকে।
পূর্বোক্তদের — মানে শিবনারায়ণ কিংবা অম্লান অপেক্ষা সমীর সেনগুপ্ত অনেক পৃথক, অনেক সীমিত সামর্থ্যের মানুষ। সমীর মুলত: বুদ্ধদেব, শক্তি ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তথ্যমূলক কয়েকটি বই লিখেছেন। বুদ্ধদেব সূত্রেই কেতকী সমীরের রচনার প্রতি কৌতূহলী হন। বুদ্ধদেব বসু বিষয়ক বইটি কালানুক্রমিক। কেতকী কিঞ্চিৎ বিস্মিত বুদ্ধদেব ও শক্তি এই দুই পৃথক ঘরানার কবির প্রতি সমীরের অব্যাহত আকর্ষণ কীভাবে। বুদ্ধদেব বিষয়ক বইটিতে তিনি সুবিবেচনা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তাঁর মধ্যে ছিল একজন গ্রাফিক আর্টিস্ট সত্তা। তিনি এক সুভদ্র, সংবেদনশীল, জিজ্ঞাসু ও গ্রহিষ্ণু মনের মানুষ। এই রচনাটির শেষাংশে বোদলেয়র অনুবাদ প্রসঙ্গে অরুণ মিত্র ও বুদ্ধদেব বসুর অবদান বিষয়ে ছোট্ট আলোচনা আছে। বুদ্ধদেবের অনুবাদে ‘প্রাণ ও হৃদয়ের বিরামহীন স্পন্দন’ আছে এটা লক্ষ্য করেন রাজু আলাউদ্দিন। অথচ তিনি ফরাসী জানেন না। আলাউদ্দিন ‘প্রখ্যাত বোর্হেস বিশেষজ্ঞ’ এটাও যাচাই করার ইচ্ছে রইল।
সুনীলের লেখার, মানুষটির তিনি ভক্ত। কবিতার অনেক পংক্তি স্মৃতিস্থ। তাঁর কবিতায় যৌবন যন্ত্রণার অনাড়ষ্ট প্রকাশ ও নারী বিষয়ে একটা দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। শিক্ষা সাহিত্যের ব্যাপারে সাহায্য করতে সদাই তৎপর। হয়তো দৈনিকের লেখা বলেই সংক্ষিপ্ত।
পরিশিষ্ট অংশে রবীন্দ্রবিষয়ক কয়েকটি বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার আছে। সিমোন দ্য বোভোয়া-র একটি অনুবাদ বাংলা পত্রিকায় দেবার জন্য একটি নাতিবিস্তৃত ভূমিকাও আছে। দুটোই খুবই মূল্যবান। আর আছে কেতকীর দুটি সাক্ষাৎকার, নিয়েছেন সুমনা দাস সুর। প্রথমটি ডায়াস্পোরিক লেখিকা হিসেবে তাঁর ভূমিকা। সমগ্র পৃথিবীকে স্বদেশ মনে করার তাৎপর্য, বিশ্বায়নের অভিঘাত, দ্বিভাষা মাধ্যমে প্রকাশে পার্থক্য, তাঁর রচনায় রাজনৈতিক অভিঘাত, রবীন্দ্র বিশ্লেষণে মোহমুক্তি এবং বিশ্লেষণমুখিতা, অনুবাদে রবীন্দ্র ও বুদ্ধদেবকে বেছে নেওয়া, রচিত কোনো কোনো উপন্যাসে পাঠক অবস্থান, মেয়ে ও পুরুষ লেখকদের রচনারীতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃত বক্তব্য রেখেছেন। বিশ্বায়ন বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা ইতিপূর্বে পাইনি (তাঁর লেখায়) তাই আরো মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার আসছে লেখিকার কবিসত্তার স্বরূপ, কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, কবিতায় ডিটেলিং, দুটি ভাষায় কবিতা লেখায় মনোভঙ্গির ব্যাপার, রবীন্দ্র ও বুদ্ধদেবীয় কবিতা চর্চার পরিচয়, মাতৃভাষায় কাব্যচর্চায় ইউরোপীয় বর্তমান, ইংলন্ডে পোয়েট লরিয়েট এবং অক্সফোর্ডে প্রোফেসর অফ পোয়েট্রি নির্বাচন নিয়ে হৈ চৈ ইত্যাদি। এই দুটি লেখার কিছু কিছু বক্তব্য, হয়ত সংক্ষেপে, ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি। কয়েকটি বিষয় এই পরিশিষ্টে গুরুত্ব পেয়েছে, স্পষ্টতর হয়েছে, তুলনামুলক পরিপ্রেক্ষিত মিশেছে।
কেতকী-পরিক্রমা করতে গিয়ে কয়েকটি কথা মনে হয়। আমার মতে সাম্প্রতিক কালের বাংলা প্রাবন্ধিকদের মধ্যে লিঙ্গ নির্বিশেষে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সৃজনশীল রচনা ও মননশীল বিতর্কমূলক রচনায় একই কালে সিদ্ধহস্ত। তাঁর একটা নিজস্ব স্টাইল গড়ে উঠছে আর ফুটে ওঠে নানা বিষয়, ব্যক্তি ও প্রসঙ্গ বিষয়ে তাঁর কুয়াশাকাটানো দৃষ্টিভঙ্গি। দ্বিতীয়ত: বিষয়ের বিস্ময়কর বিচিত্রতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তৃতীয়ত: তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং পদে পদে সতর্ক পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত পাঠক জানেন তাঁর মধ্যে আছে একটা যুদ্ধমনস্ক স্পিরিট। এটা গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে বিকশিত হতে পারার কারণে। কেতকী কোনো তত্ত্বের গর্তে পড়তে রাজী নন এবং একালের প্রচল, আদৃত কয়েকটি তত্ত্বের তীব্র বিরোধী। তাঁর রচনা, এই বইয়ের রচনা পড়তে পড়তে কেতকী নিজের কিছু কবিতা ও উপন্যাসের স্বকৃত মূল্যায়ন আমরা পাই, যা সিরিয়াস পাঠককে বিচারের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। সবশেষে দুটি নঞর্থকতার কথা বলব। তিনি প্রতিষ্ঠিত কবি অথচ তাঁর এ-বইয়ের গদ্যে আছে অতিবিস্তার। হয়তো বিষয়টি ভালো করে বুঝিয়ে বলার অভিপ্রায় থেকেই এটা ঘটে। দ্বিতীয়ত: এই বইতে বেশ কিছু প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি আছে। কিন্তু যেহেতু এটি তাঁর ইদানীংকালের পৃথিবী পরিক্রমাকালীন প্রসঙ্গায়ন তাই অনেক পুনরাবৃত্তি এসে যাবেই। বই করতে গিয়ে এডিট করতে গেলে লেখা বিশেষের অঙ্গহানি হতে বাধ্য। অতএব এই পুনরাবৃত্তি মেনে নিতেই হবে। তাঁর রচনাধারা আরও অনেককাল অব্যাহত থাকুক, আমরা সেই পরিণততর উপলব্ধিসমূহ থেকে অনেক কিছু শিখবার জন্য উৎসুক থাকলাম।