• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৩ | জুন ২০১৬ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • অনন্য বাস্তবঃ কড়াপাক নরমপাক : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    কড়াপাক নরমপাক; রঞ্জন ঘোষাল; রঞ্জন ঘোষাল; প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল, ২০১৬; দে'জ পাবলিশিং; পৃষ্ঠাঃ ৩৩২; ISBN: 978-81-295-2718-9

    (রঞ্জনদা এক রঙ্গিন ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। তাঁর কথা ভূভারতে কে না জানে? স্বল্পাধারে তাঁকে ধরার বাতুলতা করব না। শুধু তাঁর সাম্প্রতিকতম অণুগল্প সংকলনটির বিষয়ে দু-চার কথা বলব। একান্তই নিজস্ব বোঝাবুঝির ডায়েরি। একশ’টি অণুগল্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। পাঠক যদি উপকৃত হন সে তাঁর এবং রঞ্জনদার গুণ।)

    ছোটো গল্প তো জানি, অণুগল্প আবার কী বস্তু? কেবল মাত্র দৈর্ঘে ছোটো হলেই কি সেই গল্পকে অণুগল্প বলা যায়? বাঙালি লিখতে বসলেই প্যাঁচকাটা কলের থেকে জল পড়ার মত হুড় হুড় করে শব্দ পড়ে। তা বেশ! এক খানা ছোটো গল্প লিখে সেটাকে মুড়িয়ে আড়াই তিনশো শব্দর মধ্যে এনে ফেলতে পারলেই, ব্যাস! অণুগল্প রেডি। পথ-চলতি পাঠক স্মার্ট ফোনের স্ক্রীনে চোখ রেখে একখানা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিলেন। আগুন ফিল্টার পর্যন্ত পৌঁছোনোর আগেই গল্প শেষ। পদ্মপাতায় জলের মত কয়েকটি শব্দ টুপ করে গড়িয়ে গেল। পাঠকের মনন এবং স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত করার দায় রইল না।

    বাংলা গল্প সাহিত্যে অণুগল্পের আনুষ্ঠানিক অনুপ্রবেশ সম্ভবত গত শতকের শেষ দিকে। অবশ্য এখনও এই ফর্মটি অভিযোজনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন নামী ও অনামী লেখকের হাত ধরে আপাতত তার সঠিক জেনেটিক কোড খুঁজে নিচ্ছে। তাই তার গতি প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে এক কথায় বলা যায় যে বিন্দুতে সিন্ধু দেখার আয়োজন না থাকলে কোনো গল্পই অণুগল্প হয়ে ওঠে না। সেই অর্থে রঞ্জন ঘোষালের একশটি অণুগল্পর সংকলন “কড়াপাক নরমপাক” বাংলা অণুগল্পর রীতি নির্ধারণে পথিকৃৎ হয়ে থাকবে।

    রঞ্জন ঘোষালের নিজের কথায় অণুগল্প টি-টোয়েন্টি – আই পি এল ক্রিকেট ম্যাচ। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টান টান উত্তেজনা। খেলা যত শেষের দিকে গড়ায় ততই উত্তেজনার পারা চড়ে। তাই যদি হয় তবে তিনি শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতানো মহীন্দার সিং ধোনি। গল্প শেষ করার জন্য যত্ন করে জমিয়ে রাখেন বিস্ফোরক হেলিকপ্টার শট যা স্টেডিয়ামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে অবশ্য অন্তিম ট্যুইস্টের পরও অনিবার্য পরিসমাপ্তি থেকে যায়। দর্শক প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের ড্যাম্প স্ক্যুইবটি না দেখে স্টেডিয়াম ছাড়তে পারে না। “অণুগল্পে থাকবে বাক্‌সংযম, ক্ষিপ্র গতি, মেধাসন্নিধান অথবা অনুভব-নিবিড়তা বা দুটোই।” এই তাঁর প্রস্তাব। আঁতিপাঁতি করে খুঁজলেও তাঁর গল্পে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দ পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না কোনো অযৌক্তিক প্রয়োগও। বস্তুত যুক্তিগ্রাহ্যতা তাঁর লেখার বিশেষ গুণ। ঘটন-অঘটন সর্বদাই গল্পকে মূল স্রোতের অভিমুখে ঠেলে দেয়। আশ কথা পাশ কথা ঠিক ততটুকুই যা গল্পকে তর তর করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। নিবিড় অনুভবের রাশ টানতে গিয়ে অণুগল্প লেখককে সম্ভবত নির্দয় হতে হয়। লেখকের সংযম গল্পগুলিকে মেদহীন করেছে। ফলত পাঠক পড়ার সময় কখনই ক্লান্তি বোধ করেন না। বরং শেষটুকু জানার জন্য অস্থির এবং উদগ্রীব হয়ে থাকেন।

    রঞ্জন ঘোষালের গল্প মানেই অন্য পৃথিবীতে ভ্রমণ। সেই পৃথিবী শুধু দেশ নয় মাঝে মধ্যে কালও অতিক্রম করে যায়। যখন যেখানে যায় সেখানকার মানুষের মত কথা বলে, পোষাক পরে (হাতে খড়ি, চারু বাক্‌)। বাগবাজারের ঘাটে দাঁড়িয়ে খাটো ধুতি, পকেটওয়ালা হাফ শার্ট পরিহিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুকুজ্জে কিশোর কেশব চন্দ্র নাগকে বলেন, “বিজ্ঞান আর কারিগরী বিদ্যে শিখতে অঙ্ক ছাড়া যে এক পা-ও চলবেনিকো (পৌনে তেরোর নামতা)।” উপাচার্য ত্রিগুণা সেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিল সাফাইয়ের কন্ট্রাক্ট নিয়ে বকাবকি করেন কেমব্রিজ ফেরত নীলাদ্রিশেখরের পিসতুতো দাদাকে (আশ্চর্য মলম)। বিদ্যাপতি “শরমের ভারে তাইনের (রামানন্দ মিশ্র) বক্ষেই মুঁহ্‌” লুকায় (চম্পূ কাব্য)। মনগড়া বায়োপিক এই অণুগল্প সংকলনটির একটি অনন্য প্রজাতি। সময় অতিক্রম করার আর একটি অনায়াস যান হল তাঁর কল্পবিজ্ঞান গল্প। ২১১৬ সালে আমের আচারের তেল দিয়ে মাখা মুড়ি, নারকোল ফলা কাঁচা লঙ্কার সঙ্গে তরিবৎ করে খেতে খেতে সেজমামা কচু আর ভাগ্নী বুঁচির আড্ডা চলছে। মামা মারা গেছে ২০৫৩ আর ভাগ্নী ২০৬৭। রঞ্জন ঘোষালের কল্প-ভবিষ্যতেও মায়াময় অতীত লুকিয়ে থাকে (১০০ বছর পরে, অসময়ের গান)। শুধু কল্প-বিজ্ঞানের গল্প গুলিতেই নয় অনেক গল্পেই সময়ের সরল গতি ভেঙ্গেচুরে তিনি এক অন্য বাস্তবের সন্ধান করেন। সময়কে পেরিয়ে যাওয়া অণুগল্পর একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। এই অণুগল্পগুলি কেবলমাত্র খণ্ড-মুহূর্তের চালচিত্র নয়, স্থান কালের গণ্ডী পার হয়ে তাদের গতায়াত সাবলীল। সেই অর্থে গল্পগুলি চতুর্মাত্রিক।

    কিছু কিছু গল্পে লেখক মানুষের হৃদয় খুঁড়ে তুলে এনেছেন সুখ দুঃখ লজ্জা বেদনা (মধুমতীর টিফিন, নির্বাক)। সেই গল্পগুলির মধ্যে আমার প্রিয়তম হল “মেহেবুব টেইলার্স”। কলেজ স্ট্রীটের মেহেবুব টেইলার্সের কাটিং মাস্টার দীন্‌শা ওস্তাগর ডিফরেনশিয়াল ক্যালকুলস কষে সাহেব বাড়ির ট্রাউসার্সের কাপড় কাটে। গল্পটি তার গর্বিত কর্মদক্ষতার নিপুণ আলেখ্য। কিন্তু গল্পের শেষে অপরিসীম লজ্জায় দীন্‌শা ওস্তাগরের কর্ণমূল রক্তিম হয়ে ওঠে। তার কারণ “মেয়েছেলের পেন্টুল কাটছে দীন্‌শা ওস্তাগর! এর চেয়ে মশারী শিলুনোও ছিল ভালো।” লেখক মুহূর্তে ছুঁয়ে যান অধোবদন দীন্‌শা ওস্তাগরের মর্মান্তিক কষ্ট, লজ্জা, আত্মধিক্কার। কবি যশোধরা রায়চৌধুরী পটভূমিকায় বলেছেন, “কত রকম রসের কত রকম অণু বা পরমাণু গল্প যে সাজিয়ে রেখেছেন রঞ্জন এই কটি পাতায়।” আঁকিবুঁকি ইশকুলের উনিশ বছরের দিদিমণি আয়নার কথা ধরা যাক। সারা জীবন নিজের বাপ মায়ের ঝগড়ার সাক্ষী থেকেছে। তাই মাম্মা-ড্যাডি খেলা তিন বছরের দোলনা আর প্রায় সমবয়স্ক ময়ূখের ঝগড়া থামানোয় সে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু বড়দের ঝগড়া সামলে সে শেষ রক্ষা করতে পারে না (আয়না)। বড় মমতায় লেখক এঁকেছেন আয়নার জীবনের আয়নায় নিজের কান্নাধোয়া মুখ দেখার অনুভব।

    রঞ্জন ঘোষাল সুপটু চিত্রকর। রামকিঙ্করের স্কেচের মত অল্প কয়েকটি রেখায় মূর্ত করে তোলেন গল্পের সামগ্রিক অবয়ব। খুব জানেন ধূসর রঙের ওপর গাঢ রঙের পোঁচ দিতে। পিতামহ ঘড়িতে একটা বাজার আগের বারো মিনিট পরিচারক নবীনদাদা থেকে শুরু করে রুচিরাদের জার্মান শেফার্ড ক্লারা পর্যন্ত সবাই নিয়মমাফিক চলে। এই গল্পটির প্রায় সর্বস্ব জুড়ে সময়ের নিস্পৃহ পদক্ষেপ। কিন্তু শেষ লাইনে পৌঁছোতে পৌঁছোতে রুচিরা হঠাৎ যাদু বাস্তবতায় ভর দিয়ে পাখি হয়ে উড়ে যায় মেঘেদের রাজ্যে, মাম্মার কাছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাঠকের চোখ ভরে আসে (বারো মিনিট)। বস্তুত পাঠকের ইমোশন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন তিনি। অণুগল্পে অ্যাবস্ট্রাকশনের ব্যবহার অপরিহার্য। কথনের পরিমিতি এই শ্রেণির গল্পগুলিকে অনন্য করেছে (নির্বাক, অন্ধ স্কুলের ছেলে)। তিনি জানেন কোন ইঙ্গিতটি পাঠকের গ্রে সেলকে উদ্বুদ্ধ করে, কোন বিষয়টি অচ্ছাব রাখাই শ্রেয়। “দোয়েলপাখি” গল্পে হাঁটুভাঙা দ চেয়ার দোয়েল পাখি হতে চায়। আমার পড়ে মনে হল একাধিক অল্টার ইগোর কথোপকথন। পাঠক যদি অন্যরকম ভাবতে চায় দোষ নেই।

    গল্প সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত শৈলীগুলির সফল প্রয়োগ করেছেন স্বল্পায়তনে। তৈরি করেছেন নিজস্ব এক ঘরানা। দেখলেই চেনা যায় রঞ্জন ঘোষালের অণুগল্প। রূপকাত্মক (খ্যাঁক প্যাঁক) থেকে যাদু বাস্তব (সেকেণ্ড প্রিয়োড) সর্বত্র তাঁর অবাধ গতিবিধি। অতীন্দ্রিয় মায়া বাস্তবে পাড়ি দেন অনায়াসে (গ্রহের ফের, দৈব ফুলুট)। অথচ কখনোই আঙ্গিক প্রকট হয়ে ওঠে না। শৈলী যাতে গল্পকে ছাপিয়ে না যায় সে জন্য তিনি অত্যন্ত যত্নবান। তাঁর গল্পে ফর্ম ভাঙার অজুহাতে চেষ্টাকৃত অসহ্য আঁতলামির নগর-সংকীর্তন নেই। বরং নদীর ধারের খোলা হাওয়া আছে। বাউল গানের গভীর সরলতা আছে। তিনি মূলত গল্প-কথক। মাস এন্টারটেনর। তাঁর লেখা পাঠককে চুম্বকের মত টেনে রাখে। দম ফেলার ফুরসৎ দেয় না।

    অনুপম রায় তাঁর লেখার চারটি গুণের কথা বলেছেন – “বুদ্ধিমত্তা, ভাষার ওপর দখল, সেন্স অফ হিউমর এবং শার্প উইট”। এই চারপায়ে ভর দিয়ে বাঘের মত দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জন ঘোষালের একশ’টি অণুগল্প। রঞ্জন ঘোষালের প্রেমের গল্পও কোনক্রমে নেকু-পুষু-মুনু নয় বরং সেসব গল্পে চিরকালীন ভালবাসার বাঘ বেরোয় (এসেছো প্রেম, কোন কাননের ফুল)। যেমন বইয়ের শুরুতেই “যুদ্ধং”। সম্ভবত উত্‌সর্গ গল্প। বুদ্ধিমত্তা, শার্প উইটের কথায় মনে পড়ল “টাইকোটিস”, “পেনশন টেনশন”, “সুদিনের জন্য” ইত্যাদি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি? তাঁর লেখা তীক্ষ্ণধার অসির মত। অথবা বলা ভালো শাঁখের করাতের মত, আসতে যেতে কাটে। প্রখর বুদ্ধির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে যোগ হয়েছে রসসিক্ত বাচন ভঙ্গি আর দুরন্ত কল্পনাশক্তি। একটা কথা না বললেই নয়, অদ্ভুত রসের প্রতি তাঁর আকর্ষণ দেখেছি অনেক গল্পেই। অন্যদিকে সহজ রসিকতায় তিনি মহারাজ, বিশেষ করে যখন তা নিজের ওপর প্রয়োগ করেন (আতঙ্কবাদ)। কিছু গল্প অবশ্য “নেহাত্‌-ই গালগল্পো”। তা হোক, পড়ার পর মন ভালো হয়ে যায়।

    রঞ্জন ঘোষালের উপমা তিনি নিজেই। ইদানীং বাংলায় এই জনারের গল্প সংকলন আমার চোখে পড়েনি অন্তত। অলঙ্করণে শ্রী দেবাশীষ দেব এবং এলেনা নেস্তেরোভা এক কথায় অসাধারণ। তাঁদের ছবি গল্পগুলির মর্যাদা বাড়িয়েছে। লেখকের চিন্তা ভাবনাকে যথার্থ রূপ দিয়েছে। তাছাড়া সেগুলি গল্পগুলির মাঝখানে উপযুক্ত যতিচিহ্ন। না হলে হয় তো এক নিঃশ্বাসে পড়তে পড়তে দম বন্ধ হয়ে আসত। প্রকাশক দেজ পাবলিশিং। মুদ্রণপ্রমাদ যৎসামান্য। বইটি সংগ্রহ না করলে পাঠক অনবধানে বাংলা গল্প সাহিত্যের অনিবার্য মোড়টি ছেড়ে যাবেন। পরে কেঁদে কূল পাবেন না।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments