এদেশে ছোট ছেলেমেয়েদের জীবজন্তু পোষার খুব চল। তুলতুলে লোমওয়ালা কুকুর বা বিড়াল দেখতেও খুব সুন্দর ও বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে বা যত্ন করতে শেখায়। আমারও সেই ইচ্ছা ছিল কিন্তু আমার দুই মেয়েরই লোমওয়ালা পশুদের ওপর ভীষণ অ্যালার্জি। তাই নীচের স্তরের প্রাণীদের ওপর নির্ভর করতে হল। মেয়েদের ছোটবেলায় ওরা পুষেছে — গোলডি নামক গোল্ডফিশ, রোমিও ও জুলিয়েট নামে দুটি হার্মিট কাঁকড়া, বহু স্যালামান্ডার, ব্যাঙাচি, শামুক ইত্যাদি — হপি নামক একপেয়ে ফড়িং, অনেক কালো পিঁপড়ে — তাদের মাটির গুহায়, একটা সুন্দর কচ্ছপ এবং প্রচুর কালো শুঁয়োপোকা যারা সুন্দর প্রজাপতির বদলে কালো রোমশ মথ-এ পরিণত হয়ে আমাদের হতাশ করে।
তারপর একদিন এল স্লিংকি!
স্লিংকি প্রায় চারফুট লম্বা, বাদামী কালো বিষহীন সাপ। এখানে এরকম সাপ খুবই দেখা যায়। মেঠো ইঁদুর ও পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বাগানে সকালবেলা রোদ পোয়াচ্ছিল — পড়ে গেল আমার দশ বছরের কন্যার চোখে। ব্যস আর যাবে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে বাক্সবন্দী। কন্যা তার নামকরণ করল — স্লিংকি! বড় কাচের অ্যাকোয়িরামে শুকনো পাতা ও খবরের কাগজের টুকরোর মধ্যে স্লিংকির নতুন বাসা সাজানো হল।
স্লিংকি আমাদের বাড়িতে বেশ ভালই ছিল সাত-আট মাস। অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় সাপ পোষায় ঝামেলা অনেক কম। এরা বেশ চুপচাপ, বাক্সবন্দী, নোংরা টোংরা করে না। তাদের একমাত্র বায়না — জ্যান্ত খাবার চাই। এই জাতীয় সাপেদের প্রিয় খাবার নাকি উচ্চিংড়ে। তাও চাই জ্যান্ত। পোষা পশুর দোকান থেকে থলেভর্তি উচ্চিংড়ে কেনা হল। ওদের রাখা হল ফ্রিজে। ঠান্ডায় ওরা খুব নিস্তেজ হয়ে যায় তখন তুলে খাঁচায় ছাড়া সুবিধা।
উচ্চিংড়েদের জ্যান্ত রাখতে খাবার চাই — mealy worm — সাদা রঙের ছোট্ট পোকা। তাও কেনা হল এক বাক্স। রাখা হল ফ্রিজেই। তাদেরও চাই খাবার — পচা আলু। রাখা হল একগাদা পচা আলু — ঐ ফ্রিজেই। বেশ জীববিজ্ঞান সম্মত ফুড চেইন তৈরি হল আমাদের রেফ্রিজারেটরে। আমিও আমার মেয়েদের বিজ্ঞানশিক্ষায় খুব উৎসাহিত।
সাপেদের খাওয়াটাও খুব মজার। আমরা যখন এক মুঠো নির্জীব উচ্চিংড়ে ঢেলে দিই, স্লিংকি ওদের গ্রাহ্যই করে না। একটু পরে যখন উচ্চিংড়েগুলো সজীব হয়ে লাফালাফি শুরু করে তখনই সাপটা বিদ্যুৎগতিতে ছোবল মারে।
একদিন যা হওয়ার তাই ঘটল।
স্কুলে যাবার তাড়াহুড়োয় আমার মেয়ে সাপের বাক্সের ঢাকনাটা ভাল করে বন্ধ করতে ভুলে গেছিল। সাপেদের একটুখানি ফাঁকই যথেষ্ট। ঐ ফাঁক দিয়েই সাপ অদৃশ্য! তখন আমাদের ওখানে প্রচণ্ড শীত। ঘরদোর আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ। যাবে কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে গেল। আমার ভয় হয়তো জলের পাইপে বা টয়লেটে আটকে গেছে, রাতের অন্ধকারে পা দিয়ে মাড়িয়ে বসব। আমার কন্যার ভাবনা স্লিংকি হয়তো ভুলে কোনো ঘরে ঢুকে পড়েছে — বেচারার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে খুব — এক এক মুঠো উচ্চিংড়ে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেই প্ল্যান নাকচ করলাম — সারা বাড়িময় উচ্চিংড়ের লাফালাফি চলুক আর কী!
কীটনাশক-ওয়ালা, অর্থাৎ, এক্সটার্মিনেটর ডাকা হল। তারাও কোনো সাহায্য করতে পারল না। আমাদের প্রতিবেশী তার পোষা বিড়াল ধার দিল — যদি সাপটাকে ধরতে পারে। কিন্তু সে বড়লোকের আদুরে বেড়াল — খাবারের জন্য এক চুলও নড়তে অভ্যস্ত নয়। আরেক বন্ধু পরামর্শ দিল প্রত্যেক ঘরের কোণে কানাচে ন্যাপথলিনের গুলি ছড়িয়ে রাখতে। সাপেরা নাকি ঐ গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তাই করলাম। সারা বছর ধরে ন্যাপথাগুলির গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করতে লাগল। সাপের নামগন্ধও নেই। হয়তো কোনো ফাঁকে ঐ বরফ ঠান্ডার মধ্যেই পালিয়েছে। আমরা আর কখনো তার দেখা পাইনি।
আমার মেয়েরা এখনো মনে করে স্লিংকি ঘরের কড়িবরগায় কোথাও লুকিয়ে আছে — হয়ত বা এখনও চিলে কুঠুরিতে ইঁদুরের সন্ধানে।