সেসব কথা না বলাই ভাল কেন না এখনকার লোকেরা ‘সফট সফট’ কথা শুনতে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এই কথাগুলো হয়ত উদ্ভট ও বিদঘুটে ঠেকবে এবং তারা হয়ত অবিশ্বাস করবে কিংবা ঘৃণায় মুখ ফেরাবে অথবা কিছু না বলে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে যেন হিন্দি সিনেমার আইটেম সং দেখছে নিতান্ত অনিচ্ছায়। অথবা এমনও হতে পারে কেউ কেউ বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলবে ইংরেজিতে দু একটি কটু কথা। তাই আমার মনে হয়েছিল সেসব কথা না বলাই ভাল, কাউকে না জানানোই ভাল এবং এখনো আমি তাই বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাসের পিছনে সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী আরো কিছু যুক্তি আছে কিন্তু সেসব যুক্তি এখন আর আমি এখানে উপস্থাপন করছি না এই কারণে যে, যেসব কথা এখানে আমাকে বলতে হচ্ছে, বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে। সুতরাং, ওইসব যুক্তির যৌক্তিকতা থাকা কিংবা না থাকায় কিছু আসে যায় না।
তাহলে শুরু করা যাক। কথা আর বাড়াই না। ঠিকসময়ে কথা শুরু করতে না পারলে কথার পিঠে কথা আসে। তখন কথায় কথায় কথা বেড়ে যায় এবং কথারা ঠিক যেন বুনো লতানো কোনো উদ্ভিদের মত পেঁচিয়ে ধরে সবকিছু। এই ধরা নিজের সর্বস্ব অবলম্বন করে প্রগাঢ় ভালবাসায় না তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর অবজ্ঞায় তা ঠিক বুঝা যায় না। কখনোই বুঝা যায় না।
সুতরাং, শুরু করা যাক।
আমি সেদিন দেখতে পেলাম মেলার একটা ছোট স্টলের উপরে লেখা এখানে জাদু শেখানো হয়। কৌতূহলবশত সেখানে যাই এবং এটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল... তা অনেকেই বলবেন। আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমি কিছুই মনে করি না। কারণ আমি এটা বেশ ভালোভাবেই জানি যে আমার মনে করা বা না করায় কিছুই যায় আসে না।
আমি ছিলাম সাধারণ এক গৃহস্থ লোক এবং অসফল একজন কবি। আমার কবিতার ব্যর্থতা নিয়ে লিখতে গেলে একটা মহাকাব্য হয়ে যাবে। আমি তাই কখনোই চাই না সে বিষয়ে কিছু বর্ণনা করতে। শুধু বলি আমি চেয়েছিলাম কিছু পরিবর্তন। আমার কবিতাগুলোর উদ্দেশ্যও ছিল তাই। কিন্তু কবিতাগুলোর ব্যর্থতার জন্য কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের কিছুই হয়নি। আমি কিছুই করতে পরিনি এই ধরনের একটা হতাশার বোধ আমার ভিতরে কাজ করত সবসময়। আমি ছিলাম একজন হতাশ মধ্যবয়স্ক লোক যার গাল দুটি ভাঙা। আমার চেহারা দেখেই যে-কোনো সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিযুক্ত মানুষ বুঝতে পারত যে আমি জীবনের স্তরে স্তরে ব্যর্থ হওয়া একটি প্রাণী।
আমার এই ব্যর্থতায় আমার কোনো কষ্ট ছিল না আসলে। অথবা সাধারণ লোকেরা ব্যর্থতায় যেমন কষ্ট পায় সেরকম কষ্ট পেতে পেতে আমি এরকম অবস্থায় পৌঁছেছিলাম যে জাগতিক কোন দুঃখ কষ্ট আমাকে আর স্পর্শ করত না।
মূলত আমার জীবন ছিল ভাঙাচোরা। এবং সেই কারণেই সম্ভবত আমি জাদু শেখানোর স্টলটির প্রতি আকৃষ্ট হই। পোকা যেমন আকৃষ্ট হয় আগুনের প্রতি। জাদু শেখানোর দোকানের প্রতি আমার আকর্ষণ পোকাদের আগুনের প্রতি আকর্ষণের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না।
আমি জাদু শেখানোর দোকানটিতে প্রবেশ করি। সেখানে একটি বৃদ্ধ লোক বসে ছিল। তার সামনে একটি ছোটো টেবিল। টেবিলের উপরে কয়েকটি ছোটো ছোটো পুতুল। এই পুতুলগুলো নিয়েই লোকটি বসে ছিল। তার গাল ভাঙা, চোখ দুটি কোটরাগত। মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি। মাথায় বিবর্ণ হ্যাট। তাকে কেউ একজনের মতো মনে হচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন আমার মনে পড়েনি সে ‘কেউ’টা আসলে কে।
আমি দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভাঙা গলায় লোকটি জিজ্ঞেস করল — আপনি কেমন আছেন?
আমি এই প্রশ্নে বেশ বিব্রত হলাম। কারণ এসব অহেতুক প্রশ্ন। অহেতুক প্রশ্নের উত্তর আমি দেই না অনেকদিন হল।
আমি লোকটাকে ভাল করে দেখছিলাম। তার জ্বলজ্বলে চোখ, হাতে চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাওয়া শিরা উপশিরা, মুখে ভাবলেশহীন ভঙ্গি। কতকটা যেন আমার মত। মিল খুঁজে পেয়ে যেন ভাল লাগল।
আমি সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কীরকম জাদু শেখান?
লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। আমি দেখতে পেলাম তার চোখের পলক পড়ছে না। প্রায় মিনিট তিনেক এভাবে তাকিয়ে থাকার পর সে গলার স্বর নামিয়ে খসখসে কন্ঠে বলল, কীরকম শিখতে চান গুরু?
আমি কৌতুকবোধ করলাম। বললাম, আমি কীরকম শিখতে চাই সেটা ব্যাপার না। আপনি কীরকম শেখাতে পারেন সেটাই আসল।
লোকটি আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পুতুলের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ঠিকই বলেছেন। আসলে আপনাকে শেখানোর মত কিছুই জানি না আমি। আমি এইসব মেলায় এসে বসি। বাচ্চারা আসে, আসে কিছু কৌতূহলী লোক। তাদের কিছু ট্রিক্স দেখাই। শিখিয়ে দেই। ম্যাজিক ট্রিক্স।
আমি বললাম, আমাকে তাই শেখান।
লোকটা ইতস্তত করে আবার আমার দিকে তাকাল। তার চোখদুটি কিছুটা লাল। সে ভাঙা গলায় বলল, কী শিখতে চান?
আমি বললাম, ম্যাজিক। যা দিয়ে সব পার হয়ে যাওয়া যায়। দ্রুতবেগে। মুক্ত পাখির মতো ঘন স্বাদের নীল আসমানের ভিতর দিয়ে এবং খুব সম্ভবত আসমান ভেদ করে নিরন্তর।
লোকটা বলল, আর ফিরে আসা যায় শীতের শিশিরের মত দূর্বাঘাসে?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমার কবিতা পড়েছেন না কি?
লোকটা হাসল। সে এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমার হাতে একটি মাটির পুতুল তুলে দিয়ে বলল, এটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোজা চলে যান। কখনো পিছনে ফিরবেন না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটাই ম্যাজিক?
লোকটা বলল, হ্যাঁ। এটাই ম্যাজিক।
জিজ্ঞেস করলাম, দাম কত?
লোকটা বলল, ন্যায্য মূল্য পাঁচ টাকা।
আমি লোকটাকে পাঁচ টাকার একটি নোট দিলাম। সে ভাবলেশহীন ভাবে টাকা পকেটে রেখে আমার হাতে তুলে দিল একটা মাটির পুতুল। আমি এটা ছুঁড়ে ফেলে ভেঙে তার কথামতো সোজা হাঁটতে লাগলাম। জীবনে এই প্রথমবারের মত হাঁটতে আমার ভাল লাগছিল। আমি হাঁটতেই থাকলাম। কখনো পিছনে ফিরিনি। সোজা হেঁটেছি শুধু। এখনো হাঁটছি। হাঁটা শুরু করার একদিন পর একবার শুধু শহরের উপকন্ঠে এসে দু মিনিটের জন্য থেমেছিলাম পত্রিকা কেনার জন্য। এই দু মিনিট পায়ে অনুভব করেছি অসহ্য যন্ত্রণা। তারপর পত্রিকা নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করার পর সে যন্ত্রণা উধাও হয়েছে। মনে এসেছে উৎফুল্লতা, চঞ্চলতা এবং হালকা অনুভূতি। যে পত্রিকা নিয়েছিলাম সেটি হঁটতে হঁটতেই খুলে দেখেছিলাম প্রথম পাতার এক কোণে বেশ বড় করে ছেপেছে, “গতকাল মূলরাস্তার পাশে মারা গেছেন শহরের সর্বশেষ কবিঃ কারণ অজ্ঞাত।”