আর নয়। মেয়ের বাবার ভরসাতে থাকলে আর ইহজীবনে নাতি নাতনির মুখ দেখা হবে না। এ বেশ বোঝা হয়ে গেছে সুমিত্রার। এবারে কোমর বেঁধে নিজেকেই লাগতে হবে। এই বোধোদয় হতেই সহকর্মী থেকে সহমর্মী সবাইকে, মানে যাকে বলে জনে জনে, মেয়ের বায়োডেটা ধরিয়ে দিয়েছে সে। সাথে সাথে এও বলে দিয়েছে যে তার গোঁয়ার গোবিন্দ মেয়ে বেঙ্গালুরু ছেড়ে কোলকাতা আসার নামও করে না। কাজে কাজেই বেঙ্গালুরুবাসী বাঙালি ছেলেই চাই। তা শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এমন তিন চারজন সুপাত্রের সন্ধানও মিলেছে। এইবারে আসল পরীক্ষা। মেয়ে দু' সপ্তাহের ছুটিতে কোলকাতা আসছে। তাকে রাজি করাতে হবে পাত্রদের সাথে দেখা করতে।
আজকেই মেয়ের ছুটির প্রথমদিন। এবং তিনি রাত আটটার আগেই বাড়ি ফিরে এসেছেন বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা শেষ করে। মনে তো হচ্ছে আজ দিনটা শুভই। প্রথম রাতেই বেড়াল মারার সাহসী পরিকল্পনা নিয়ে মেয়ের বাবাকে জলদি জলদি শুতে পাঠিয়ে দিয়েছে সুমিত্রা। ওয়োম্যান টু ওয়োম্যান টকে আজ মেয়েকে পর্যুদস্ত করতে বদ্ধপরিকর সুমিত্রা। ভাবতে গিয়ে বুক কাঁপছিল না এমনটা নয়। ওই মেয়েকে সে ঢের চেনে। কাঁথা থেকেই হিটলার। তবু চেষ্টা না করে কি আর পারে? মাতৃকর্তব্য বলেও তো একটা কথা আছে না কি? মেয়ের অনাছিস্টি বাপ সেকথা শুনে চিরচেনা হাড়জ্বালানে মিচকে হাসিটা হাসতে হাসতে একটা প্রবল খটোমটো ইংরিজি বই বগলদাবা করে বেডরুমে ঢুকে পড়লেন। এইবার সুমিত্রার ওয়োম্যান টু ওয়োম্যান টকের সময়।
জলটল খেয়ে, বারদুয়েক গলা খাঁকরিয়ে গুটিগুটি পায়ে সুমিত্রা হাঁটা দিল বাইরের ঘরের সোফার দিকে। গিয়েই মাথাটা একটু ঘুরে উঠল। তার সাতাশ বছরের কন্যারত্নটি একটি কটকটে হলুদ রঙের হাফপ্য্যন্ট ও তার আপন বাবার একটি রং জ্বলে যাওয়া ফতুয়া পরে একহাতে কোকের ক্যান ও আরেক হাতে টিভির রিমোট নিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে চ্যানেল চেঞ্জ করে যাচ্ছে। কার্গিল যুদ্ধের সৈনিকদের কথা ভেবে মনে প্রচণ্ড বল এনে সুমিত্রা ডেকে উঠল, "বাবা শুনছো?" এ মেয়েকে তুই বলার সাহস তার দু'জোড়া দাদুদিদা ছাড়া আর কারোরই হয়নি কোনদিন। মেয়ের উত্তর, "কান তো খোলাই আছে। বলে ফেল।" সুমিত্রা নিরাপদ টপিক ফেসবুক দিয়ে কথা শুরু করল। কী করে ছবি আপলোড করতে হয় দিয়ে শুরু করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিতর্কিত বিষয়ে পৌঁছে গেল। জিজ্ঞাসা করে ফেলল মেয়ে কেন ফেসবুকে তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করছে না। মেয়ের কাটা কাটা উত্তর, "তুমি কি আমার বন্ধু?" এদিকে মেয়ের বাপ কিন্তু প্রথম দিন থেকে মেয়ের ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। ঘোর অনাচার আর কি। কিন্তু আজ আরো অনেক বড় যুদ্ধ আছে। ছোট ছোট ব্যাপারে আটকে গেলে হবে না। আবার একটু আজেবাজে বকার পরে সুমিত্রা ট্র্যাকে ফিরল। মেয়ের পুরোনো বন্ধুদের কথা, কে কোথায় চাকরি করছে, কার কোথায় বিয়ে হল এসব গল্পে ঢুকে পড়ল। মেয়েও টুকটাক উত্তর দিচ্ছে। সুমিত্রা পায়ের নিচে শক্ত জমি টের পেল। মনে মনে ভাবল এইবারে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। হুঁ হুঁ বাবা যতই হোক, ও-ই আমার পেটে হয়েছে। আমি ওর পেটে নয়।
সুমিত্রা বলেই ফেলল, "বাবা পড়াশোনা তো হল, চাকরিও হল, কদিন আগে একটা প্রোমোশনও হল। এবার তো বিয়ে করে সংসার ধর্ম করার সময়।"
"সংসার না ধর্ম সেটা আগে ঠিক করে বলো তো মা?"
"আরে ওটা তো মুখের বুলি। কথাটা হল গিয়ে যে বিয়ের বয়সে তো হয়েই গেছে। আমরা ছেলে দেখি?"
"আমরা কেন? গৌরবে বহুবচন? বাবাকে এর মধ্যে টানা কেন?"
"আচ্ছা আচ্ছা। বাবা নয়। আমিই। নাকি তুমি কাউকে পছন্দ কর? তেমন কেউ থাকলে আমাদের আপত্তি নেই সে ছেলে যদি তোমার যোগ্য হয়।"
"নেই।"
"তাহলে আমি দেখি?"
"না।"
"না কেন? তুমি কি তাহলে সন্ন্যাসিনী হবে?"
সুমিত্রা বেশ বুঝতে পারছে এই মোনোসিলেবলের সাথে আর বেশিক্ষণ লড়া যাবে না।
"পাগল নাকি? সন্ন্যাসিনী হলে মাল খাব কি করে?"
সুমিত্রা (মনে মনে) আহা কি মুখের ভাষা। প্রকাশ্যে করুণ সুরে, "তাহলে ছেলে দেখতে মানা করছ কেন?"
"আমি বিয়ে করব না।"
সুমিত্রা প্রাণ হাতে করে, "ইয়ে মানে তুমি কি মেয়েদের ভালবাস?"
"বাসি।"
সুমিত্রা কাঁদোকাঁদো স্বরে, "কাকে?"
"কাকে মানে? আমার এত এত মেয়ে বন্ধু তাদের সবাইকে ভালবাসি তো। দিদাকে ঠামিকে তোমাকে সবাইকে তো ভালবাসি।"
সুমিত্রা প্রচণ্ড বোকা বোকা মুখ করে, "তাহলে বিয়েতে আপত্তি কেন?"
"বিয়ে মানেই একটা ছেলে ফুল টাইম আর তার বাড়ির লোক পার্ট টাইম আমার ঘাড়ের ওপরে ড্রামা করবে। উফ্ফ। ইম্পসিবল।"
"আহা তা কেন? বিয়ে মানেই কিছুটা মানিয়ে নেওয়া। তা সে তো সব্বাই করে।"
"আমাকে সুখে থাকতে ভুতে কিলোয় না।"
-----
-----
সুমিত্রার শেষ অস্ত্র চোখের জল সহযোগে "দিদি কি সুন্দর বুড়ো বয়সে নাতনি নিয়ে আনন্দ করছে। আমার ফাটা কপালে কোনই সুখ নেই।"
দিদির একমাত্র মেয়ে রিমি যে কিনা এই মিমির থেকে বছর পাঁচেকের বড়, এই বছর দুয়েক আগে একটি ডিসনি প্রিন্সেস তুলে দিয়েছেন বাবা মার কোলে। সুতরাং...
"কে বলল তুমি নাতি নাতনি পাবে না? আমি তো কেবল বলেছি বিয়ে আমি করব না।"
এবারে সুমিত্রা পুরো ফ্ল্যাট। খাবি খেতে খেতে কোনরকমে প্রশ্ন করল, "মানে????" (মুখের উপরে এতগুলো জিজ্ঞাসা-চিহ্ন নিয়ে)।
"কয়েকটা জায়গাতে কথা বলেছি সিঙ্গল মাদার হিসেবে বাচ্চাকে অ্যাডপ্ট করার ব্যাপারে। এক জায়গাতে বলেছে ওরা রাজি যদি আমি প্রমাণ করতে পারি যে আমার যা চাকরি তাতে করে আমি বাচ্চাকে যথেষ্ঠ সময় দিতে পারব।"
এবারে আর পারল না সুমিত্রা। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, "লোকে কী বলবে? আমরাই বা লোককে কী বলব? তোমার দিদা আর ঠামি এখনো বেঁচে আছেন। ওঁরা তো শকেই মারা যাবেন!"
"বাবার সাথে আমার আগেই কথা হয়ে গেছে। ফ্যামিলি পিআর-টা বাবা দেখে নেবে। বাইরের পিআর-টা আমাকে সামলাতে হবে। ইট্স আ ডিল।"
অতঃপর সুমিত্রার হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমন্ত স্বামী-কাম-চিরশত্রুর উদ্দেশ্যে অজস্র কটুকাটব্য করতে করতে বেডরুমে প্রত্যাবর্তন।
ভোরের আলো চোখে পড়তেই ধড়ফড় করে উঠে বসল সুমিত্রা। আচমকা টের পেল পাষাণভারটা আর নেই। কাল রাতে অসম্ভব আতঙ্ক, দুঃখ আর লজ্জা নিয়ে এ-ঘরে এসেছিল সে। ভাবতে ভাবতে কখন যেন সেগুলো বদলে গেছে গর্বে, আনন্দে, শান্তিতে। সে যা পারেনি, তাদের জেনেরেশন যা পারেনি, তার উড়নচণ্ডী মেয়েটা তাই করতে চলেছে। সামর্থ থাকতেও তারা এই দুনিয়ার কোটি কোটি অনাথ শিশুর একজনকেও ঘর দিতে পারেনি। আর তার মেয়েটা, তার ছোট্ট হিটলারটা, তাই করতে চলেছে। হ্যাঁ, আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি অনেক কথাই বলবে। অবশ্য কবেই বা বলেনি? সে আর তার স্বামী যখন ছোট মেয়েটাকে বড় করতে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছে তখন লোকে বাড়ি বয়ে বলে গেছে "মেয়ে তো! পরের বাড়ি তো চলেই যাবে! তার জন্য..." কেউ কেউ সহানুভূতির সুরে শুনিয়ে গেছে, "ছেলে তো নেই তোমাদের। বুড়ো বয়সে কি যে হবে!" সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও বলে গেছে, "মেয়েকে তো তোমরা ছেলে করে বড় করছ!" মনে খালি প্রশ্ন উঠত আজও কি বাবা-মার পরিশ্রম, ভাল স্কুল, ভাল পরিবেশ সবই শুধু পুত্রসন্তানের পাওনা? মেয়ে সন্তানকে সেসব দেওয়া মানেই তাকে ছেলে করে বড় করা? তা আজও না হয় কথা উঠবে।
কিন্তু আজ তার মাতৃত্ব সার্থক। সে পেরেছে এই পৃথিবীকে একটা গোটাগুটি মানুষ দিতে। যে বাবা-মার বুড়ো বয়েসের লাঠি, কর্মস্থলে অক্লান্ত কর্মী, আর পৃথিবীর একটি শিশুর সব না পাওয়াকে একা হাতে বদলে দেবার ম্যাজিসিয়ন মাম্মা হতে চলেছে।