• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৩ | জুন ২০১৬ | গল্প
    Share
  • সেতুর শহরে : সুবীর বোস


    প্তর্ষি মণ্ডল, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু — আকাশে নয় — আমাদের পাড়াতেই থাকে। সময়-সুযোগ পেলেই – খুব স্বাভাবিক — আমরা দুজনে নিখাদ আড্ডা ছাড়াও একটু এদিক-ওদিক চক্কর কেটে আসার ব্যাপারেও যথেষ্ট মনোযোগী।

    তো সেই “চক্কর”এর তাড়নাতেই মাঝে এক রোববার বিকেলে সপ্তর্ষি প্রস্তাব দিল, চল লাল্টু, আজ একটু “কাব্য-ভ্রমণ” করে আসি। বললাম, হেঁয়ালি ছেড়ে বল তো বাবা কোথায় যেতে হবে। “আরে চলই না” বলে সপ্তর্ষি আমাকে সেদিন, অবাক কাণ্ড, সোজা নিয়ে গিয়ে বিজন সেতুর উপর দাঁড় করিয়ে দিল।

    এরপর প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে সপ্তর্ষি আমাকে – যে কিনা এর আগে বিজন সেতুর উপর থেকে অন্তত কয়েক হাজার বার বালিগঞ্জ স্টেশন দেখেছে — তাকে সেতু আর স্টেশনের টানাপোড়েন বোঝাতে শুরু করল। বিরক্ত আমি এরপর বলেই ফেললাম — ঘুরতে যাবি বলে এটা তুই কোথায় নিয়ে এলি? এটা কী ধরনের কাব্য-ভ্রমণ হে?

    আমার প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব না দিয়ে সপ্তর্ষি বেশ সিরিয়াস মুখে আমার হাতে একটা দু-টাকা দামের বাদামের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমি আসলে সেতুর সঙ্গে রেল-স্টেশনের সম্পর্কটা ঠিক কী রকম – আজ প্রায় সারাদিন এই উত্তরটাই খোঁজার চেষ্টা করছি। সে জন্যেই আর কী...

    সপ্তর্ষির অমন আঁতেল-মার্কা কথা শুনে — খুব স্বাভাবিক — মাথাটা বেশ গরম হয়ে গেল। ফলে একটু বাঁকা ভাবে বলেই ফেললাম, তা, উত্তরটা কি পেলি? প্রশ্নটা করে উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখি “লোডশেডিং” হয়ে গেছে। মানে সপ্তর্ষি একদম চুপ মেরে গেছে।

    আমরা যারা সপ্তর্ষিকে চিনি — তারা জানি সপ্তর্ষি মাঝে মাঝে নামী-দামি গোয়েন্দাদের মতো একদম চুপ করে যেতে ভালোবাসে। এ সময় ওকে হাজার প্রশ্ন করলেও কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। খুব বিরক্তিকর ঠিক সেই সময়টাতেই আমার মুখে একটা পোড়া বাদামের টুকরো পড়ে মুখটা একদম তেতো করে দিল। সে জন্যেই কিনা জানি না — আমিও “ধুত্তোরি তোর সঙ্গে আজ বেরনোই ভুল হয়েছে” বলে রেগে-মেগে একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেললাম। সপ্তর্ষি, জানি না, বিড়ির গন্ধে কিনা – এবার তার মৌনতা ভেঙে খুব গম্ভীরভাবে বলল, আমাকেও একটা বিড়ি দে লাল্টু। দিলাম। বিড়িতে জমিয়ে দু-টান দিয়ে সপ্তর্ষি বলল, হ্যাঁ, লাল্টু, কী যেন বলছিলি?

    — বলছিলাম ওই সেতু আর রেল-স্টেশনের সম্পর্কটা নিয়ে তোর রিসার্চ কত দূর এগোলো? কিছু পাওয়া গেল কি?

    — আওয়াজ দিচ্ছিস লাল্টু? তবে শোন। হ্যাঁ, কিছুটা তো পেয়েছি বটেই। বাকিটা জানতে আরও কয়েকদিন লেগে যাবে। সপ্তর্ষি বেশ চিন্তিত মুখেই কথাগুলো বলল।

    — কী রকম? আমার বক্র অনুসন্ধান।

    — ওই যে বললাম পুরোটা পাইনি। তবে যতটুকু পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে যে, সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ভিড়ে ভরা স্টেশন দেখতে খুব ভালো লাগে এমনকি নিজেকে সেই ভিড়ের একজন ভাবতেও বেশ ভালো লাগে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নিজে সত্যিই ওই ভিড়ের একজন হলে আর সেতুর দিকে নজর দেওয়ার কোনো মানে হয় না। হাতে সময় থাকলে — সে সেতু নেহাতই চোখে পড়ে গেলে অবশ্য আলাদা কথা। কথাগুলো একটানা বলে সপ্তর্ষি থামল।

    সপ্তর্ষির অমন হেঁয়ালি ভরা কথা শুনে ফের মাথাটা গরম হয়ে গেল। বললাম, তোর আজ কী হয়েছে বল তো? তখন থেকে এত আবোল-তাবোল বকছিস কেন?

    আমার তড়পানিতে কাজ হলো। সপ্তর্ষি বলল, আসলে আজ সকালে একটা খবর শোনার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ।

    — কোনও খারাপ খবর নাকি? আমাকে বলিসনি তো। — খারাপ খবর তো বটেই! — কী খারাপ খবর? উদ্বিগ্ন আমি শুধাই। — শুনলাম কমলদার মা তাঁর বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন।

    বাইপাশের গা ঘেঁষে যমুনা নদীর নমুনার মতো যে খালটা বয়ে গেছে তার পাশেই ঠেলে-ঠুলে গজিয়ে ওঠা এক উস্বাস্তু কলোনির সাদা-মাটা বাড়িগুলোতে আমরা যারা থাকি — তাদেরই একজন হল কমলদা মানে কমল দাস। যতদূর জানি কমলদা ট্রাম কোম্পানিতে ঠিকা-শ্রমিক হিসেবে চাকরি করেন। ঘটনাচক্রে আমাদের এলাকায় কমলদাদের এখন দুটো বাড়ি। ওই দুটো বাড়ির একটা আসলে কমলদার অবিবাহিত পিসির। সেই পিসির মৃত্যুর পর আপাতত কমলদা তার বউ আর ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেকে নিয়ে সে বাড়িতেই থাকে। শুনেছি কমলদার বউয়ের সঙ্গে কমলদার মায়ের তেমন বনিবনা নেই। আর সে জন্যেই অন্য বাড়িটায় কমলদার বাবা মারা যাবার পর এখন কমলদার মা একাই থাকেন। মাসীমা “সে কালের” ম্যাট্রিক পাশ। পাড়ার বাচ্চাদের মায়েরা অনেকেই মাসীমার কাছে তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়তে পাঠান। না, মাসীমা পড়িয়ে পয়সা নেন না। বাচ্চাগুলোকে উনি ভালোবেসেই পড়ান। কমলদার বাবা ট্রাম কোম্পানিতেই চাকরি করতেন। মেসোমশাইয়ের মৃত্যুর পর মূলত পেনশনের টাকাতেই মাসীমার চলে বলে শুনেছি। তবে এ কথাও সত্যি যে, কমলদা এবং কমলদার ছেলে কিন্তু মাসীমাকে খুব ভালোবাসে। রোজ দু-বেলা করে ওরা মাসীমার খোঁজ নিয়ে যায়। সেই মাসীমা বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন শুনে আমারও মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

    — বললাম, বলিস কী? কেন? তুই জানলি কী করে?

    — তোর প্রশ্নগুলোর এক এক করে উত্তর দিচ্ছি। খবরটা সম্ভবত সত্যি। মাসীমা কেন বাড়ি বিক্রি করছেন সেটা মাসীমাকে জিজ্ঞেস করেই জানতে হবে। আমি খবরটা পেয়েছি আমার ভাইপোর কাছ থেকে।

    — তোর ভাইপো কার থেকে শুনলো ব্যাপারটা? আমি আরও অনুসন্ধানী।

    — জানিসই তো আমার ভাইপো মাসীমার কাছে বাংলা পড়তে যায়। ওকে মাসীমা বলে দিয়েছেন — আর পড়তে আসতে হবে না কারণ উনি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন এবং বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছেন।

    কলোনিতে বেড়ে ওঠা আমাদের নিজেদের মধ্যে হিংসে আছে, ঝগড়া আছে। কিন্তু একই সঙ্গে কলোনির কেউ বিপদে পড়লে আমরাই আবার সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে জানি। সপ্তর্ষিকে বললাম, একবার মাসীমার সঙ্গে কথা বললে হয় না সপ্তর্ষি?

    — হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। আমি ভাবছি কাল সকালে একবার যাব মাসীমার কাছে। দেখি যদি কিছু করা যায়। তুই যাবি লাল্টু?

    — হ্যাঁ, যাব তো বটেই।

    — তাহলে ওই দশটা নাগাদ শুধু তুই আর আমি মাসীমার কাছে যাব। আর কাউকে বলিস না যেন ব্যপারটা।

    — না, না, কাউকেই বলব না। আমি সপ্তর্ষিকে নিশ্চিত করি।

    পরদিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা পৌছে গেলাম মাসীমার কাছে। মাসীমা তখন পাশের ঘরে পুজো করছিলেন। পুজো সেরে এ ঘরে এসে মাসীমা আমাদের দেখে হেসে বললেন, কী ব্যাপার — সকাল সকাল দুই মূর্তি একদম আমার ঘরে?

    সপ্তর্ষি কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলে ফেলল, মাসীমা ওই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে আমাদের কয়েকটা কথা বলার ছিল আর কী।

    সপ্তর্ষির এমনতর কথার জন্য মাসীমা মনে হল প্রস্তুত ছিলেন না। লক্ষ্য করলাম মাসীমার মাথাটা একটু যেন নুয়ে পড়ল, মুখের হাসিটাও উধাও। কিন্তু মিনিট-দুয়েকের মধ্যেই মাসীমা আবার স্বাভাবিক এবং বেশ স্পষ্ট করেই বললেন, হ্যাঁ, এ বাড়ি তো বাবা বিক্রি হয়েই গেছে। আমি এ বাড়িতে আর দিন সাতেক। তারপরেই...

    — তারপরেই? সপ্তর্ষি মাসীমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।

    — তারপরে আর কী — ওই বৃদ্ধাশ্রম...

    — কিন্তু কেন, কেন মাসীমা, আপনাকে এই বাড়ি বিক্রি করে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে বলতে পারেন? আমরা তো রয়েছি নাকি? সপ্তর্ষি একটু জোরে জোরেই বলল কথাগুলো।

    আমাদের এলাকার লোকজনের যেকোনো বিপদে-আপদে সবার আগে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নাম সপ্তর্ষি মণ্ডল। ফলে সপ্তর্ষিকে সবাই একটু অন্য চোখে দেখে, ভালোবাসে। সে জন্যেই সম্ভবত উত্তর দেবার দায় না থাকলেও — বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকা মাসীমা, সদ্য পুজো সেরে আসা মাসীমা খুব আস্তে আস্তে বললেন, ধরে নাও আমি আসলে সেই পুরোহিত — যাকে ভগবান নয়, শয়তান বেশি পছন্দ করে।

    মাসীমার কথা শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। সপ্তর্ষি বলল, মাসীমা অমন কথা বলবেন না। আপনি কমলদার মতো ছেলে পেয়েছেন...

    সপ্তর্ষির কথা শেষ হবার আগেই মাসীমা বললেন, তোমরা হয়ত জানো না যে, কমলের এখন আর চাকরি নেই। সে চাকরি গেছে তিন মাস আগেই।

    মাসীমার কথা শুনে আমি এবার ধন্ধে পড়ে গেলাম। কারণ সেদিন সকালেও আমি কমলদাকে আমরা দেখেছি ট্রাম কোম্পানীর খাকি পোশাক পরে অফিসের দিকে যাচ্ছে। সে জন্যেই আমি বলে ফেললাম, কিন্তু আজ সকালেও তো...

    মাসীমা আমাকে হাতে নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি ঠিকই দেখেছ লাল্টু — কিন্তু... — কিন্তু? — কিন্তু ওটা হল নাটক। — নাটক? এবারে অবাক সপ্তর্ষির প্রশ্ন।

    — হ্যাঁ, নাটক। গত তিন মাস ধরে ছেলেটা আমার — বাড়ির লোকজনের কাছে ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখার জন্য রোজ সকালে ওই খাকি পোশাক পরে বেড়িয়ে যায় আর ফেরেও অফিসের নিয়ম মেনে। সারাদিন কী করে — কোথায় খায়...ওর সংসার চলে কী করে আমি জানি না।

    — কিন্তু আপনি কী করে জানলেন যে কমলদার চাকরি নেই? সপ্তর্ষির অনুসন্ধান। — আমার নাতি বলেছে।

    এরপর মাসীমার থেকে জানতে পারলাম যে কমলদার ছেলে সজল কোনওভাবে ব্যাপারটা জানতে পেরে একদিন তার বাবাকে চেপে ধরে। কমলদা ছেলের কাছে স্বীকার করেন যে ব্যাপারটা সত্যি। একই সঙ্গে কমলদা ছেলেকে বলেন, ব্যাপারটা কিছুদিনের মধ্যেই মিটে যাবে তাই সে যেন আর কাউকে ব্যাপারটা না জানায়। কিন্তু নাতি তার ঠাকুমাকে ব্যাপারটা না জানিয়ে পারেনি।

    মাসীমার কথা শেষ হবার পর আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম। নিস্তব্ধতা ভেঙে সপ্তর্ষিই বলল, কিন্তু মাসীমা, এই বাড়িতে আপনার এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে...তা ছেড়ে...এই ভাবে...। আমাদের একটু বলতে পারতেন।

    সপ্তর্ষির কথা শুনে মাসীমা ফের চোখ নামিয়ে নিলেন। মনে হল, স্মৃতি সত্যিই তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে। কিন্তু মিনিট দুয়েক পরেই দেখলাম মাসীমা গলায় দৃঢ়তা এনে বললেন, এই ইট-কাঠ-পাথর সব তো কেবল মোহ সপ্তর্ষি। এসবের থেকে আমার কাছে আমার ছেলে এবং তার পরিবার অনেক দামি। আমার ছেলে কিছুতেই আমাকে এই বাড়ি বিক্রি করতে দিতে চাইছিল না। বড্ড ভালো ছেলে আমার। প্রতিদিন নিয়ম করে দু-বেলা আমার খোঁজ নেয়। আমি মা। আমার ছেলের এই অসহায় অবস্থার সময় আমি পাশে না দাঁড়ালে কে দাঁড়াবে বলো? এ ছাড়া দরকার তো আমারও আছে বাবা। তোমরা তো জানোই ট্রাম কোম্পানীর পেনসন কী রকম অনিয়মিত হয়ে পড়েছে আজকাল। এ ছাড়া নাতিটার পড়াশোনা আছে...।

    মাসীমা কমলদা সম্বন্ধে যা বলেছেন — তা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কমলদার মতো ছেলে হয় না। কমলদা এবং কমলদার ছেলে দু-বেলা করে মাসীমার কাছে আসে, গল্প করে, সময় কাটায়। কিন্তু কমলদার বউয়ের সঙ্গে যেহেতু মাসীমার যে কোনো কারণেই হোক কোনোদিনই তেমন বনিবনা নেই সম্ভবত সে জন্যেই আজ বাড়ি বিক্রির পরেও মাসীমা কমলদার বাড়ি না গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন।

    সপ্তর্ষি মনে হল শেষ চেষ্টা হিসেবে বলল, মাসীমা আপনি অনুমতি দিলে — যে এই বাড়িটা কিনেছে — তার সঙ্গে আমরা একবার কথা বলে দেখতে পারি।

    সপ্তর্ষির কথা শুনে মাসীমা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, না বাবা, ওই কাজটা করতে যেও না। সত্যি বলতে কী — যিনি এ বাড়ি কিনেছেন — তিনিও চাননি যে আমি এই বাড়ি বিক্রি করি। বেশ ভালো দাম দিয়েছেন। তা ছাড়া কলোনির বাড়ি বিক্রি করার অসুবিধাগুলো তো তোমরা জানোই। তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বাবা।

    বুঝলাম যা হবার হয়েই গেছে। তাই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মাসীমা, কমলদা আর আপনার নাতি রাজি হল আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে?

    — রাজি কী আর হয় বাবা। ওরা অবস্থায় পড়ে রাজি হয়েছে। আমি বলেছি বাড়ি বিক্রির একটা অংশ আমার নামে পোস্টাপিসে ফিক্সড করে দিতে। সেখান থেকে মাসে যা সুদ আসবে তাতে বৃদ্ধাশ্রমে আমার চলে যাবে। বাকি টাকাটা ওদের। নাতির পড়াশোনার ব্যাপারটাও তো ভাবতে হবে। ওদের বুঝিয়ে বলেছি, এই সাংসারিক ঝামেলা পার হয়ে আমি ওখানেই ভালো থাকব। ভাবছি পেনশনের টাকাটা, যখন যেমন পাব — এবার থেকে কমলকেই দিয়ে দেব। ওরা ভালো থাকলেই তো আমার ভালো থাকা।

    — কোন বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন কিছু ঠিক করেছেন? সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করে। — হ্যাঁ, ব্যারাকপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে – ঠিক করেছি ওখানেই থাকব।

    বুঝতে পারলাম সব একদম পরিকল্পনা মাফিকই চলছে। আমাদের আর কিছু করার নেই। তবু মাসীমার কাছ থেকে চলে আসার আগে সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মাসীমা, কমলদার যে চাকরি নেই — সেটা তো আপনারা জেনেই গেছেন। তবে কেন উনি আজও রোজ নিয়ম করে অফিসের পোশাক পরে সকাল বেলা বেরিয়ে পড়েন?

    — ওটা বাবা পাড়ার লোককে ফাঁকি দিতে...

    সারা রাস্তা কমলদার কান্না আর দৃঢ় মাসীমার একটানা সান্ত্বনাবাক্যর সাক্ষী থাকা আমরা বেলা এগারোটা নাগাদ পৌছলাম ব্যারাকপুরের “গিরিরাজ বৃদ্ধাশ্রম”এর গেটে। সত্যি বলতে কী সে বৃদ্ধাশ্রমের পেল্লাই গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢোকার পর আমাদের তো বটেই সম্ভবত কমলদার মন থেকেও খারাপ লাগাটা অনেকটাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। কারণ কমলদাকে দেখলাম কান্না থামিয়ে মাসীমার সঙ্গে বেশ কথাবার্তা চালাচ্ছে। বেশ নিরিবিলি, বিভিন্ন রকমের গাছ-পালার ছায়ায় এলিয়ে পড়া পর পর সার দেওয়া বৃদ্ধাশ্রমের ঘরগুলো দেখে সপ্তর্ষি ফিসফিস করে বলেই ফেলল, লাল্টু, বৃদ্ধাশ্রম সম্বন্ধে যে ধারণাটা ছিল তার সঙ্গে কিন্তু এই বৃদ্ধাশ্রমকে মেলাতে পারছি না।

    সপ্তর্ষি কথাটা খুব ভুল বলেনি। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা ওই বৃদ্ধাশ্রমে দেখলাম নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জন থাকেন। কেউ আছেন সত্যিই খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে এখানে এসেছেন। কেউ আবার অভিমানে চলে এসেছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু মনে হল, সবাই যেন জীবনের উপান্তে এসে সম্পূর্ণ অন্য সত্ত্বার সন্ধান পেয়ে তার সঙ্গে খুব করে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন।

    বৃদ্ধাশ্রমের অফিসে প্রাথমিক কাজ সেরে বেরনোর পরই “নতুন পড়শি”কে দেখতে ভিড় জমে গেল চারপাশে। সেই ভিড় থেকেই এক পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা, পরনে ম্যাক্সি — নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে মাসীমাকে বললেন, আমি রিনা ব্রাউন, তোমার ঠিক পাশের ঘরেই আমি আছি। প্রথম আলাপেই এত সহজে রিনা ব্রাউনের এই “তুমি”তে চলে আসা দেখে আমাদের তো বটেই — এমনকি কমলদারও খুব ভালো লাগল। পাশ থেকে অন্য এক প্রতিবেশী আমাকে ফিসফিসিয়ে বললেন, উনি নিজেকে “রিনা ব্রাউন” ভাবতে ভালোবাসেন। ওটা ওনার আসল নাম নয়।

    প্রাথমিক আলাপ পর্ব শেষ হবার পর মঞ্চে ফের রিনা ব্রাউন। মাসীমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দু কলি শোনাই”? কেউ কিছু বলার আগেই সপ্তর্ষির গলা শোনা গেল, হোক, হোক। রিনা ব্রাউন গাইলেন, “চরণ ধরিতে দিও গো আমারে”। সে গানে স্পষ্ট ধরা পড়ছিল দমের ঘাটতি — কিন্তু আন্তরিকতা এবং আর্তি দিয়ে সে ঘাটতি পার করে রিনা ব্রাউন যখন থামলেন — দেখলাম, এই প্রথম, মাসীমার চোখেও জল।

    মাসীমার ঘরে জিনিসপত্র ঠিকঠাক গুছিয়ে রেখে যখন বেরব বেরব করছি — বৃদ্ধাশ্রমের এক আবাসিক, একটু খর্বকায় — এক ভদ্রলোক এসে হাজির। বললেন, আমার আবৃত্তি না শুনেই চলে যাচ্ছেন যে বড়। এবারেও সপ্তর্ষি, শোনান, শোনান। আমরা আপনার আবৃত্তি শুনে তারপর যাব।

    ভদ্রলোক শুরু করলেন, “বর্তমানের কবি আমি ভাই...”। এখানেও দমের ঘাটতি টের পাওয়া গেল। তবু যে দক্ষতায় উনি কাজী নজরুল ইসলামের দীর্ঘ কবিতা “আমার কৈফয়েৎ” একবারও হোঁচট না খেয়ে শুনিয়ে দিলেন তাতে মন থেকে বলতেই হল, কুডোস। ভদ্রলোক হেসে বললেন, আমাদেরও দিন ছিল হে ভায়া। যুববাণীতে ছিলাম...

    সেদিন বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেরনোর সময় সপ্তর্ষি বলল, মাসীমা আমরা সামনের মাসেই ফের আসব। আপনার জন্য কী আনব বলুন?

    আমাদের অবাক করে মাসীমা উত্তর দিলেন, আমার জন্য পারলে কাজী নজরুল ইসলামের “সঞ্চিতা” বইটা এনে দিও। ওনার কবিতা আমার বড় প্রিয় আর আবৃত্তি করার লোক তো পেয়েই গেলাম।

    মাস খানেক পর এক সকালে আমি আর সপ্তর্ষি — হাতে “সঞ্চিতা” — ফের সে বৃদ্ধাশ্রমে। ভিতরে যিনি অফিস সামলান, আমাদের দেখে বললেন, একট অপেক্ষা করতে হবে। উনি একটু “হাঁটতে” গেছেন, এসে পড়বেন একটু পরেই।

    আমরা ওই “একটু পরে”র সুযোগে তখন কিছুটা দূরে একটু আড়াল খুঁজে বিড়ি ধ্বংস করছি। বিড়ির প্রায় শেষ পর্বে পৌঁছে হঠাৎ চোখে পড়ল — মাসীমা, পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি, “হাঁটা” শেষ করে বৃদ্ধাশ্রমে ফিরছেন একজন “সঙ্গী” সমেত। মাসীমার সে সঙ্গী খুব ফিটফাট এক বৃদ্ধ। লক্ষ্য করলাম দুজনেই খুব হাসছেন, গল্প করছেন। এভাবেই দুজনে বৃদ্ধাশ্রমের মূল দরজার ঠিক সামনে। এবারে ভিতরে ঢোকার পালা। কিন্তু এখানেই বিপত্তি।

    মূল দরজার সামনে — সম্ভবত নতুন পাইপ লাইন বসানোর জন্য বোঝা যাচ্ছিল বেশ কিছু খোঁড়াখুঁড়ির কাজ হয়েছে। যাতায়াতের জন্য ভরসা কেবল একটা সরু কালভার্ট – যেটা পেরিয়ে ঢুকতে হবে বৃদ্ধাশ্রমে। বয়স্ক লোকজনের পক্ষে দ্বিতীয় কারোর সাহায্য না নিয়ে ওই সামান্য রাস্তাটুকু পেরনো বেশ ঝুঁকির বলে আমাদের অন্তত মনে হয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম না মাসীমা কী করে ওই জায়গাটুকু পার হবেন।

    আমি আর সপ্তর্ষি দুজনেই মাসীমাকে সাহায্য করব বলে দু-পা এগিয়েছি ঠিক তখনই — সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। দূর থেকে দেখলাম মাসীমার সঙ্গী সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক পরম যত্নে মাসীমার হাতে ধরে সে কালভার্ট পার করে আস্তে আস্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমের ভিতরে।

    সপ্তর্ষি বিড়বিড় করল, দেখ লাল্টু, মাসীমা কী সুন্দর সেতু পেরিয়ে স্টেশনের ভিড়ে মিশে যাচ্ছেন।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: সঞ্চারী মুখার্জী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments