• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৩ | জুন ২০১৬ | কবিতা
    Share
  • চারটি কবিতা : মফিজুল ইসলাম খান


    মা তোমার মতন

    যখন আমি মিশে যাই বিক্ষুব্ধ জনতার জঙ্গী মিছিলে
    প্লেকার্ড ফেষ্টুন হাতে অবুঝ শিশুর মতন অথবা প্রকাশ করি ক্ষুধার তাড়না
    লাগামহীন কালো অশ্বের মতন যেখানে সেখানে
    তখন কেউ করে না বারণ দেয় না উপদেশ সাবধানে থাকার।

    যখন বুলেটের নিখাদ ভালোবাসায় ছিটকে পড়ি দূরে, বহু দূরে উল্কার মতন
    অথবা ঝিলিক মেরে বিজলীর মতন থেমে যায় আমার হৃদয় কম্পন
    তখন এলোমেলো কুন্তলে কেউ আঁকড়ে ধরে না আমায়
    আঁখিনীরে কেউ হয় না সিক্ত, কারো কোমল বুক ভাসে না জলে।

    কলুর বলদের মতো ঘানি টেনে শেষ রাতে আমি যখন বাড়ি ফিরি
    বৃষ্টিজলে একাকার, থরথর কম্পমান, পেটে ক্ষুধা
    তখন কেউ দেয় না এগিয়ে গামছা টাওয়েল, খাবার থালা।

    তোমার মতন কাউকে পাইনি মা, তোমার মতন।



    বোশেখ তোমার কাছ নতজানু

    হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এগারো ঘাটে পেরিয়ে আবার এসেছি আমার কুঁড়ে ঘরে
    তোমাকে সালাম বোশেখ, তুমিই মহারাজ।

    তোমার শরীর জুড়ে ইবলিসের আস্তানা
    হাতি মারো না, ঘোড়া মারো না, রাজা উজির রাজকুমারের রংমহলে বাড়াও না হাত
    উড়িয়ে দাও কেবল আমার কুঁড়ে ঘর, মনা পাগলার নাও। মনা পাগলা
    কেঁদে কেঁদে বারবার শ্বাস নেয় হাসপাতালের নোংরা বারান্দায়।

    কেটে গেলে কিছুদিন তেরো ঘাট পেরিয়ে মনাপাগলা ফিরে আসে বিধ্বস্ত খেয়াঘাটে
    জংধরা নায়ে আলকাতরা লাগায়, বৈঠায় -- সরিষার তেল, মাথায় বাঁধে গামছা
    বদর বদর বলে তোলে পাল, ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয় মৃদু হাসির রেখা।

    পালে হাওয়া লাগার আগেই জানি না কোন্ জাদুবলে ভেঙে যায় তোমার ঘুম, মহারাজ
    জেগে ওঠো তুমি, তোমার আকাশফাটা বিলাপে কেঁপে ওঠে শস্যের ভুবন তরুলতা
    নিরন্ন মানুষ।

    আদি থেকে এই তো তোমার খেলা
    খেলছো অবিরাম মহাজন, তুমি এক দক্ষ খেলোয়াড়।

    হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এগারো ঘাট পেরিয়ে তোমার চরণে নতজানু আজ
    একটা চাল দাও দুরন্ত দুর্বার
    হাতি মারো ঘোড়া মারো রাজাউজির মন্ত্রী মারো উল্টে দাও তখতে তাউস
    নষ্ট রাজনীতির মরণ খেলা।

    একটা ঝড় তোল, শুরু করো একটা যুদ্ধ আপোসহীন, বীরে বীরে চলুক খেলা দুরন্ত দুর্বার।



    মায়াবীগোলাপ

    চুপি চুপি পালিয়েছি বাতায়ন খোলা বাতাসের বিপক্ষে পড়ে আছে সবুজ পর্দা
    কমিয়ে রাখা টেবিলল্যাম্প, স্তরে স্তরে সাজানো দেশী বিদেশী বই, খবরের কাগজ
    রংবেরঙের কাপড় কিছু মলিন স্মৃতি।

    বাগানের দরোজা খোল মালি, একটা গোলাপ দাও টকটকে লাল
    হৃদয় কন্দরে লুকিয়ে নিয়ে যাই শিল্পিত নগরে।

    সুবেদালী আজ নেই ছুটি গেছে সরব প্রান্তরে
    নোলকপরা বউ তার পরাগ ছিটাবে কাঁকনের রিনিঝিনি বিলাপে
    ছন্দিত উঠোন ভাসবে থইথই।

    ঘন কুয়াশায় শব্দহীন ডুবে আছে মা ও মাটি, গোয়ালঘর, শস্যের ভুবন, গাছগাছালি
    নিঠুর মালি, সারি সারি গোলাপ তোমার বাগানে পুড়ে পুড়ে ছাই হয় অন্তর জ্বালায়
    নিশিদিন আলোর পক্ষে খুলে রাখে সুবাসিত বুক প্রেমাক্ত সরোবর।

    একটু সদয় হও, আমাকে একটা গোলাপ দাও টকটকে লাল
    মায়ামায়া মুখ কাজলটানা চোখ আলতাবরণ পা
    নিয়ে যাই শিল্পিত স্বর্গে।



    ভাগ্যরেখা

    কোন কোন মানুষ জন্ম নেয় হাতের তালুতে ভাঙাচুরা ভাগ্যরেখা
    চলার পথে অনঢ় ব্যারিকেট খেয়ালি বিধির কুতকুত খেলা।

    কোন কোন মানুষ জন্ম নেয় আগাগোড়া ভাঙাচুরা চৈত্রের চৌচির মাটি
    কোন কোন মানুষ জন্ম নেয় সারবিহীন বৃক্ষ কালোর উদরে গুম হওয়া জমাট মাংস
    লুকিয়ে লুকিয়ে যে অস্তগামী সূর্য দেখে, মেঘে ঢাকা চাঁদ দেখে
    মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া জোছনা দেখে, কালবোশেখী ঝড় দেখে
    আগুনের লেলিহান শিখা দেখে, সারি সারি লাশ দেখে, এঁটো স্তূপে কুকুর মানুষের যুদ্ধ দেখে
    মনকাড়া বৃষ্টি দেখে না, দেখে না তারাদের লুকোচুরি খেলা মিটিমিটি হাসি ঘোমটায় ঢাকা চাঁদ
    নতুন দিনের আলোর ঝলকানি।

    কোন কোন মানুষ জন্ম নেয় নিয়তির আজন্ম বলি ব্যারিকেট ভাগ্যরেখা
    চৈত্রের চৌচির মাটি, শুকনো নদী, সারবিহীন বৃক্ষ, বুকে আগুন লাগানো ইটখোলা।


    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)