বাংলাদেশি, তথা বাংলা ভাষাভাষী দুনিয়ার তাবৎ বাঙ্গালী জনগণের কাছে স্রেফ ‘একুশে’ শব্দটিই যথেষ্ট — ‘ফেব্রুয়ারী’র উল্লেখ ছাড়াই! যদিও আমাদের নিজেদের পঞ্জিকায় এ-তারিখটা ‘৮ই ফাল্গুন’, সে কথাও কিন্তু আমরা কেউ খেয়াল করি না, করার প্রয়োজন বোধ করি না। শুধু কি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে? ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে, ‘একুশে’ ইতোমধ্যে স্বমহিমায়, নিজের গৌরবময় স্থান করে নিয়েছে সারা বিশ্বে। ‘একুশে’ — আমার, আমাদের, এবং আমি বলব, এই পৃথিবীর (প্রায়) ৭০০ কোটি মানুষের, ‘অমর একুশে’!
‘একুশে’র সেই সর্বজনীন, অভূতপূর্ব, কালবিজয়ী ভাষা আন্দোলনের একজন প্রত্যক্ষ বা সরাসরি অংশগ্রহণকারী হিসেবে, এ দিনটি নিয়ে কিছু বলতে, লিখতে বা এ মহান দিনটির একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে গেলে, এতই আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ি যে, খেই ও পরম্পরাবোধ হারিয়ে ফেলার সমূহ সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করা যায় না।
‘একুশে’ নিয়ে কথা বলতে গেলে আলোচনায় পাকিস্তানের কিছু কথা আসা অপরিহার্য। ভারত (অখণ্ড) স্বাধীন করার আন্দোলন অনেক আগে থেকে শুরু হলেও (সর্বভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হয় ২৮শে ডিসেম্বর ১৮৮৫ তারিখে, একজন অভারতীয়ের ব্রিটিশ — বেসামরিক আমলা, স্কচম্যান আলান অক্টাভিয়ান হিউমের — নেতৃত্বে), ভারতকে ভাগ করে স্বাধীন সার্বভৌম দুটি রাষ্ট্র — ভারত ও পাকিস্তান — প্রতিষ্ঠার দাবী তুলনামূলকভাবে খুবই স্বল্প কালের, যদিও মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মুসলিম লীগ গঠন করা হয় ৩০ ডিসেম্বর ১৯০৬ সালে, আমাদের ঢাকায়, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ’র নেতৃত্বে এবং যার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন আঃ কাঃ ফজলুল হক (পরবর্তীতে ‘শের-ই-বাংলা’ উপাধিতে ভূষিত)। প্রকৃত প্রস্তাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জোরালো, সক্রিয় দাবীর সূত্রপাত হয় ১৯৪০ সনের ২৩-শে মার্চ — শের-ই-বাংলা আঃ কাঃ ফজলুল হকের উপস্থাপিত বিখ্যাত “লাহোর প্রস্তাব”-এর মাধ্যমে। অতঃপর শুরু হয় পাকিস্তান দাবীর পক্ষে সব রকমের পরিকল্পনা-আলোচনা-আন্দোলন। এক পর্যায়ে তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৯৪৫-১৯৪৬ এর সর্বভারতীয় ‘পাকিস্তান দাবী’ ভিত্তিক গণভোটে শের-ই-বাংলা কে হারিয়ে নির্বাচিত) ১৬ ই আগষ্ট, ১৯৪৬ কে ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’ বা ‘প্রত্যক্ষ কর্ম-কাণ্ড দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেন। এ-দিনেই শুরু হয় কলকাতার সেই অবর্ণনীয়, রোমহর্ষক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার শিকার হয়েছিল অগণিত মুসলমান ও হিন্দু। দাঙ্গা ছড়িয়ে যায় বিহারে, পাঞ্জাবে, এমন কি কোন, কোন প্রত্যন্ত জিলায় — যেমন নোয়াখালিতে, যেখানে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী তাঁর ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন বেশ কিছু দিনের জন্য। এর আগে, বিহারে অসংখ্য মুসলমান হতাহত হলেও, যে কোন সম্ভাব্য কারণেই হোক, মহাত্মার সেখানে যাবার বা উল্লেখযোগ্য তেমন কোন কর্মকাণ্ড আরম্ভ করার অবকাশ হয়নি। বাংলাদেশে, ঢাকার ‘জেনেভা ক্যাম্প’ ও অন্যান্য জায়গায় আজও বহু বিহারীদের উপস্থিতি বিহারের সেই দাঙ্গার সাক্ষ্য বহন করে।
এটা সর্বজন বিদিত যে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান হোতা ছিলেন মুম্বাইয়ের (জন্ম করাচীতে) তুখোড় ব্যারিস্টার, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (পরবর্তীতে যাঁকে “কায়েদে-আজম” উপাধিতে ভূষিত করা হয়)। পাকিস্তান আন্দোলনের মোক্ষম সময়ে (১৯৪৫–১৯৪৭) আমি বি এম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ছাত্র। উল্লেখ্য, এ সময়ই (১৯৪৬) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ — আমি আই এস সি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও একজন সাধারণ মুসলিম ছাত্র লীগ কর্মী। বরিশালের সে সময়ের একচ্ছত্র মুসলিম লীগ ছাত্রনেতা (পরবর্তীতে ‘বাকশাল’ খ্যাত) মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেবও তখন বি এম কলেজের (বেশ কয়েক বছর ধরেই চতুর্থ বৎসর বি এস সি’র) ছাত্র এবং ছাত্র নেতা বাহাউদ্দিন সাহেব (প্রাক্তন ছাত্র)। সে কালের (যুক্ত) বাংলার প্রখ্যাত, প্রথম কাতারের মুসলিম লীগ ছাত্র নেতাদের মধ্যে, মহিউদ্দিন, বাহাউদ্দিন, (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ বদরদ্দোজা এবং ওয়াসেক চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। তখনকার দিনে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ মুসলমান ছাত্রই মুসলিম লীগ করতেন, এবং, আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ও করেছি পাকিস্তান হাসিল করার জন্য। বঙ্গবন্ধু ঐ সময়ে বরিশাল এসেছিলেন উপরোক্ত ‘ডাইরেক্ট একশন দিবস’-এর পরে পরেই, মুসলিম ছাত্র লীগের সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোন জরুরী ব্যাপারে।
‘পাকিস্তান আন্দোলন’ যখন তুঙ্গে, তখন আমরা অনেক মজার মজার কাণ্ড করতাম পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন ও জোরদার করতে। যেমন, আমরা ক্লাসে রোল কলের সময় ‘ইয়েস স্যার’, ‘হিয়ার স্যার’ বা ‘প্রেজেন্ট স্যার’ না বলে বলতাম ‘পাকিস্তান’। অপর দিকে, হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা বলতো, ‘জয় হিন্দ’। সেই ১৯৪৪ সন থেকে চিঠি পত্রের (খাম বা অধুনালুপ্ত পোষ্টকার্ডের) ঠিকানায়, সবশেষে অপ্রয়োজনেও ‘পাকিস্তান’ শব্দটি লিখতাম। প্রায় সবাই ‘জিন্নাহ ক্যাপ’ পরতাম; গান গাইতামঃ ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, ‘চল, চল, চল, উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল, নীম্নে উতলা ধরণী তল…’ ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু…’ ইত্যাদি; স্কুল-কলেজে, শহরের অলি-গলিতে, পাড়ায়-পাড়ায় চলতো কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের নিয়ে সামরিক কুচকাওয়াজের মহড়া (খুব সম্ভব, ‘খাকসার আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছিল এটা) বরিশাল এলাকায় যার সার্বিক পরিচালনার নেতা ছিলেন মেহেন্দীগঞ্জের (মরহুম) মাওলানা নূরুজ-জামান। পাকিস্তান দাবী এতই জনপ্রিয়, সোচ্চার ও জোরালো ছিল যে, পরবর্তীতে জিন্নাহ’র সাথে মতান্তর হওয়ায়, লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক, বরিশালের শের-ই-বাংলাকে আমরা বরিশাইল্লারাই বরিশালের ষ্টীমার ঘাটে কালো পতাকা দেখিয়েছিলাম! কী লজ্জার কথা!!
এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, ভোগান্তি, মৃত্যু, দু’দিকে লক্ষ লক্ষ লোকের ঘর-বাড়ি ছেড়ে দেশ পরিবর্তনের ফসল, উপমহাদেশের সকল মুসলমানদের স্বপ্নের ‘পাকিস্তান’ এল ১৪/১৫ ই আগষ্ট, ১৯৪৭ তারিখে। ২০০ বছরের বৃটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে স্বাধীনতা লাভ ও মুসলিম রাষ্ট্র, ‘পাকিস্তান’ প্রাপ্তির সে আনন্দোল্লাসের কথা আজও মনের মুকুরে সমুজ্বল, যার একমাত্র তুলনা চলে ঠিক ২৪ বছর পরে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এর, সেই স্বপ্নের পাকিস্তান ভেঙ্গে, বাংলাদেশ প্রাপ্তির বিজয়োল্লাসের সাথে। আর কিনা, সেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সেই একই জিন্নাহ সাহেব নিজেই পাকিস্তানের ভিত্তির উপর মারলেন প্রথম কুঠারাঘাত, প্রথম বোম্বশেল! এমনকী, পাকিস্তানের মাত্র একটি বছর পূর্তির আগেই!!! আঘাত হানলেন একটা জাতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায়, তার মূল সংস্কৃতি-কৃষ্টির ধারক-বাহক মাতৃভাষার উপর! এত বড় রাজনীতিবিদ, প্রাজ্ঞ, ক্ষুরধারসম বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি কীভাবে করে বসলেন এমন পাহাড় প্রমাণ, মারাত্মক ভুল? কী? না, নিখুঁত, চোস্ত ইংরেজিতে ঘোষণা করলেন, “The state language of Pakistan shall be Urdu, and Urdu alone” — “পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু, এবং একমাত্র উর্দু”! ১৯৪৮ সনের মার্চ মাসের মাঝামাঝি (আমি তখন বরিশালে, বি এস সি’র ছাত্র) উনি প্রথম ও শেষবারের মত আসেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এবং উপরোক্ত ঘোষণা দেন এখানকার, এই দুর্জয় বাংলার, মাটিতে দাঁড়িয়ে — প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে ও পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। “না, না” প্রতিবাদের ঝড় উঠলো সাথে সাথে — শুধু ছাত্রমহলে না, সর্বত্র! এমন কথাও শোনা যায় (সত্য মিথ্যা জানা নেই) যে, জিন্নাহ সাহেব সেদিন নাকি কার্জন হলের পেছনের দরোজা দিয়ে পালিয়ে ছাত্রদের রোষানল থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন! ওনার এই ঔদ্ধত্বপূর্ণ ঘোষণার যুক্তি ও সাহস কোত্থেকে এল, এটা একটি গবেষণার বিষয় বলে আমার ধারণা। তখনকার পাকিস্তানের মোট লোকসংখ্যার শতকরা ৫৫ ভাগ ছিল বাংলা ভাষাভাষী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সব ক’টি প্রধান ভাষা মিলিয়ে — পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বেলুচী ও পস্তু ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা শতকরা ৪৫ ভাগ মাত্র! পশ্চিম পাকিস্তানের এ চারটি প্রধান ভাষার মধ্যে কোনটিই একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হবার মত যথেষ্ট উন্নত বা সমৃদ্ধ নয়, যার খুব একটি বড় প্রমাণ এই যে, স্যার আল্লামা ইকবালের মত অত বড় মাপের কবিও তাঁর নিজের মাতৃ ভাষায় পাঞ্জাবীতে লিখতে পারেননি অমূল্য তাঁর কাব্য সম্ভার — সাহায্য নিতে হয়েছে উর্দুর। আর, জিন্নাহ সাহেব কী করলেন? না, পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে নিজস্ব, অতি উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা — বাংলা ভাষা — থাকতেও আর এক দেশের একটি প্রাদেশিক ভাষা ধার ক’রে নিয়ে এনে চাপিয়ে দিতে চাইলেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। হয়তো মনে করেছিলেন যে, যে দেশের লোক তাদের নিজেদের, শের-ই-বাংলার মত মহান নেতাকে কোন মূল্য না দিয়ে তাঁর (জিন্নাহর) অঙ্গুলি-হেলনে সব কিছু করে যাচ্ছে, সে দেশের লোক ভাষার ব্যাপারেও তাঁর অযৌক্তিক কথাও মেনে নিবে বিনা বাধা বা দ্বিধায়। (যক্ষ্মায় আক্রান্ত) জিন্নাহ সাহেব মাত্র ক’য়েক মাস পরে, ১১ ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে, করাচীতে মৃত্যু বরণ করেন — ভাষা আন্দোলনের সার্বিক গুরুত্ব, ভয়াবহতা ও বাঙ্গালীর ঈপ্সিত, অনিবার্য ফলাফল না দেখেই। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। সব কিছু সত্ত্বেও, পাকিস্তান প্রাপ্তির এক বছরের মধ্যেই জ়িন্নাহ’র মৃত্যু সংবাদে মুষড়ে পড়েছিল সারা দেশ, দেশের বরেণ্য সব নেতা সহ আপামর জনগণ। অতি দীর্ঘ শোক মিছিলে দেখেছিলাম সবার চোখে অঝোর অশ্রু।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবার পর পরই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, আলাপ-আলোচনা-তর্কযুদ্ধ, সেমিনার শুরু হয় সর্বত্র। জ্ঞান তাপস, বহু ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আবুল কাসেম (বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক), জনাব আব্দুল হক, বি ডি হাবিবুল্লাহ সহ আরও অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে বাংলা রাষ্ট্রভাষার জন্য লেখালেখি ও আন্দোলন শুরু করেন, জিন্নাহ সাহেবের উপরোক্ত ঘোষণার আগেই — এমনকী, পাকিস্তানকে সরকারিভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করারও আগে থেকে। আর, সরকারিভাবে, পাকিস্তান জাতীয় এসেম্বলীতে সর্বপ্রথম ‘বাংলা রাষ্ট্র’ ভাষার দাবী তোলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্র লাল দত্ত। সে অনেক কথা, অনেক ইতিহাস।
অবশেষে এল ১৯৫২। এল ‘বাংলা রাষ্ট্র ভাষা’র দাবীতে ঘোষিত সেই কাল-বিজয়ী ২১ শে ফেব্রুয়ারী। এ সময় আমি এম এসসি (পদার্থ বিদ্যা) শেষ বর্ষের ছাত্র। প্রাদেশিক সংসদের অধিবেশন চলছিল তখন। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন সাহেব — হয়তো বা, করাচী থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা-ইংগিত বা আদেশেই — জারি করলেন ১৪৪ ধারা (যাকে সাধারণত শুধু চুয়াল্লিশ ধারাই বলা হয়)। যার মানে, উক্ত দিন রাস্তায় কোন শোভাযাত্রা, সভাসমিতি বা জন সমাগম ইত্যাদি করা যাবে না। একটু অবান্তর হলেও এখানে, আমার বিশেষ স্মৃতি হিসাবে, ব্যক্তিগত ছোট্ট একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন। আমাদের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. এস এম মিত্র। ওই সময়ে, মাত্র ক’য়েক দিন আগে, ওনার এক ধাপ পদোন্নতি হয় (খুব সম্ভব রিডার থেকে প্রফেসর)। ২০শে ফেব্রুয়ারী আমরা, সে বছরের সব চেয়ে জ্যেষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্ররা, স্যারকে ধরেছিলাম এ উপলক্ষে আমাদের (বিশ-একশজনের মত) মিষ্টি খাওয়াবার জন্য। স্যার নিজে আমাদের সাথে যাওয়ার অপারগতা প্রকাশ করে এক শ’ টাকা (চালের মণ তখন ১২ টাকা) দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা সবাই খুব ভাল একটি রেস্টুরেন্টে ভূরিভোজ করে, ‘রূপমহল’ হলে ম্যাটিনি সিনেমা শো দেখেছিলাম। সন্ধ্যার দিকে হলে (সলিমুল্লাহ মুসলিম বা এস এম হল) ফিরে দেখি চারিদিকে একটা থমথমে ভাব। ব্যাপার কী?
আসলে, চুয়াল্লিশ ধারা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে অতঃপর আগামী কাল — একুশে ফেব্রুয়ারী — কী করণীয় তা নিয়ে গরম আকাশ-বাতাস। উল্লেখ্য যে, সেকালে ছাত্র রাজনীতির পীঠস্থান ছিল আমাদের এস এম হল। ওখানেই নেয়া হত জাতীয় রাজনীতির ব্যাপারে বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত । আরও উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্তও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন ‘ডাকসু’র আবির্ভাব হয় নাই। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মধুর কেন্টিন’ ছিল রাজনীতির আর একটি প্রধান আলোচনা-আন্দোলন কেন্দ্র বা আখড়া, যেখানে সিঙ্গাড়া আর চা-এর পেয়ালা সামনে নিয়ে চলত হালকা থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা। যাই হোক, সন্ধ্যার পরেই এস এম হলে সভা বসল দীর্ঘ সময় ধরে এবং শেষমেষ স্থির সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, যে-কোন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পরের দিন ভাঙ্গা হবে সরকার ঘোষিত ৪৪-ধারা, এবং চালিয়ে যেতে হবে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন — ঝড়-ঝঞ্ঝা যা-ই আসুক! ওই আলোচনা সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম, বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন অকুন্ঠ সমর্থক ও সাধারণ কর্মী হিসেবে। সভায় উপস্থিত অনেকের নাম, প্রায় ষাট বছর পর, আজ আর মনে নাই; তবে, সর্ব জনাব তোয়াহা, ওয়ালী আহাদ, গাজীউল হক, ফতেহ লোহানী, মোস্তফা নূরুল ইসলাম, এম আর মুকুল (বজ্র-কন্ঠ), হাবিবুর রহমান শেলী, সৈয়দ শফিকুল হোসেন, আবদুস সামাদ আযাদ (তখন ওনার নাম ছি আব্দুল সামাদ — বাংলাদেশ দেশের পররাষ্ট্র হবার পর উনি নিজের নামটার একটু বদল করেছিলেন।) এস এম কিবরিয়া, এস এম আলী প্রমুখদের কথা পরিষ্কার মনে পড়ছে। ওদিকে বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে আটক। এঁদের অনেকেই আজ গতায়ু। অনুজপ্রতিম-বন্ধু, আমার অতি স্নেহের গাজীউল হককে ২০০৯-এ শেষবারের মত ঢাকায় দেখে এলাম, স্কোয়ার হাসপাতালে, শেষ নিশ্বাসের মাত্র কয়েক দিন আগে।
পরের দিন, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, সকাল ন’টার দিকে আমরা সব ছাত্ররা (এবং বহু উৎসাহী জনসাধারণ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (অবশ্যই পুরনো ভবনের, যেটা এখন পুরোটাই মেডিক্যাল কলেজের আওতায়) চত্বরে জমায়েত হলাম। কিছু বক্তৃতার পর-পরই শুরু হল ছোট ছোট দলে (৪৪-ধারার ৫ জনের সীমারেখা সংবলিত আইন বাঁচিয়ে) রাস্তায় বের হওয়া। ওদিকে রাস্তায় পূরা রমনা এলাকা ঘিরে মোতায়েন শত শত সশস্ত্র পুলিশ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, ৪৪-ধারার কোন তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নামল ছাত্র-জনতার ঢল — লক্ষ্য বা গন্তব্য, অধিবেশনে রত প্রাদেশিক সংসদ ভবন। পুলিশ উঠে পড়ে লেগে গেল আমাদের ছত্রভঙ্গ করতে — শুরু করল লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়াছুড়ি। আমরা অনেকে তখন রাস্তা থেকে নেমে, ইউনিভার্সিটির উত্তর দিকে (কার্জন হলের পশ্চিমে) ত্রিকোণাকার খেলার মাঠে নেমে পড়ি এবং ওখান থেকে ইট পাটকেল, যেখানে যা পেয়েছি ছুড়তে থাকি পুলিশের দিকে। ওদিকে, অনেক লোক পশ্চিম দিকে গিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাস (যেগুলো মূলি বাঁশের খলফা দিয়ে তৈরি ছিল) চত্বরে ঢুকে, ওখান থেকে চালায় পুলিশের প্রতি তাদের আক্রমণ। সম্পূর্ণ এলাকাটা যেন একটা শৃংখলাহীন রণাঙ্গনে পরিণত হয়ে গেল। এমনই অবস্থা যে, তখন কে কোথায়, কী অবস্থায় আছি বা আছে তা জানার উপায় নাই — প্রকৃতপক্ষে কোন নেতৃত্বও যেন কাজ করছিল না। বেশ খানিকক্ষণ পরে (বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশ বা এগারো হবে), ওরা একটা নতুন কৌশল উদ্ভাবন করল — দেখা গেল, ডজনে ডজনে ট্রাক, ভ্যান, লরী এসে গেছে। এলোপাথাড়ি আমাদের ধরে ধরে ঐ সব গাড়ীতে উঠিয়ে ৭/৮ মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেয়। আরও অনেকের সাথে আমাকে নামিয়েছিল বর্তমান বনানীর উত্তর দিকটায়। এ ভাবে বিরাট, বেসামাল ভীড়কে ছত্রভঙ্গ করতে ওরা বহু ছাত্র ও অংশগ্রহণকারীদের জোর করে দলে দলে বিভিন্ন দিকে, অনেক দূরে দূরে নিয়ে ছেড়ে দেয়। পায়ে হেঁটে ছাড়া ফেরার কোন উপায় ছিল না। এত সব সত্ত্বেও, শুনেছিলাম, ওদিকে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলছিল — বিভিন্ন দিক থেকে দলে দলে নতুন জনতা এসে মূল দলের সাথে যোগ দেয়ার কারণে।
লম্বা পথ পায়ে হেঁটে এসে (প্রায় দুটা/আড়াইটার দিকে হবে) এস এম হলের ডাইনিং হলে যখন খাচ্ছিলাম, তখনই শুনলাম ওই গুলির কথা, সেই ঐতিহাসিক ‘ভাষার জন্য প্রাণ দান’-এর কথা, অতীতের ইতিহাসে পৃথিবীর কোথাও যার কোন উদাহরণ নাই । ইতিহাস সৃষ্টি করল বাঙ্গালীরা, সৃষ্টি করল স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনার প্রথম সুদৃঢ় সোপান, শুরু হল স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাবার প্রথম পদক্ষেপ! মুখে, মুখে ছড়িয়ে গেল ভাষা শহীদদের নাম, (তখন পর্যন্ত অজানা) অমর, চিরস্মরণীয় সালাম, বরকাত, জব্বার, রফিকের নাম। সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত হল অবধারিত স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের প্রথম মাইলফলক!
এ বাবদে ওই সময়কার আমার একান্ত ব্যক্তিগত দু’একটি ঘটনার কথা খুব মনে পড়েঃ
—আমিও, শহীদ আবুল বরকাত এর মত, এম এস সি’র ছাত্র ছিলাম এবং আমার নামের প্রথম অংশ “আবুল” নামেই সমধিক পরিচিত ছিলাম আমার সব ঘনিষ্ঠ মহলে। ফলে আমার চেনা-জানা বহু লোকই — বিশেষ করে, বরিশালের অনেক লোক — আমারই মৃত্যু আশংকা করে, সন্ধ্যার দিকে, এস এম হলে আমার ১৭২ নং রুমে ভীড় করেছিলেন।
—২২ -শে ফেব্রুয়ারী ইউনিভার্সিটি বন্ধ ও কারফিউ জারী করা হয় এবং এস এম হল সহ, ছাত্রদের সব হল ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়। অগত্যা, মালপত্র নিয়ে নারিন্দায় আমার বোনের বাসায় যাই। রংপুরে চাকুরীরত আমার এক বন্ধু তখন, কার্যস্থলে যাবার পথে ঢাকায় ছিল। এ অবস্থায় সে আমাকে তার সাথে রংপুর বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ জানায় এবং আমি গ্রহণ করি তা। ওদিকে ঘটে আর এক কাণ্ড। আগেই “আমি নিরাপদ” মর্মে টেলিগ্রাম পাঠানো সত্ত্বেও, ওই এম এস সি’র ছাত্র ‘আবুল’-এর মৃত্যুসংবাদ বরিশাল পৌঁছলে, বাবাজান চলে আসেন ঢাকায়। বোনের বাসায় আমার বই-খাতা, মাল-পত্র, অথচ আমি নাই দেখে উনি কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না যে আমি রংপুরে বেড়াতে গিয়েছি। সে এক হাহাকার অবস্থা, কয়েকদিন পরে আমি ঢাকায় ফিরে এলে তবে তার অবসান হয়।
—রংপুরে মাত্র সপ্তাহ-খানেক ছিলাম। ওখানে পৌঁছানোর পরের দিন সকালে একটি রেষ্টুরেন্টে কারমাইকেল কলেজের একজন ছাত্রের সাথে (খুব সম্ভব তার নাম ছিল রকিবুল হাসান) আলাপ হয়। আমি সদ্য সদ্য ঢাকায় ‘ভাষা আন্দোলন’-এ অংশ নিয়ে এসেছি শুনে উনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং ঐ দিনই বিকেলে শতাধিক ছাত্রের একটা আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেন, যেখানে আমিই ছিলাম প্রধান বক্তা — বক্তৃতার বিষয় ঢাকায় ২১-শে’র কাহিনী।
একুশের অব্যবহিত পরের যে দুটো ঘটনা সবচেয়ে উল্লেখ্য, তা হলঃ শহীদ মিনার ও একুশের গান, ‘আমার ভাই এর রক্তে রাঙ্গানো…’। শহীদ মিনার এখন যে শুধু বাংলাদেশের সকল শহর-গ্রাম-গঞ্জে স্থাপিত, তা নয়। এ দিনটিকে ইউনেস্কো’র প্রবর্তনায় (ও জাতিসঙ্ঘের পূর্ণ সমর্থনে), “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” ঘোষণা দেয়ার বদৌলতে, শহীদ মিনার সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে শনৈঃ শনৈঃ — অনেক বড় বড় শহরে ইতোপূর্বে স্থাপিত হয়েছে ও হচ্ছে। এ আন্তর্জাতিক ঘোষণার সার্বিক কৃতিত্বের দাবীদার ক্যানাডায় বসবাসরত দুজন বাংলাদেশী — সর্বজনাব সালাম ও রফিক (কাকতালীয়ভাবে ভাষা-শহীদদের নামে যাদের নাম)। শহীদ মিনারের স্থপতি, (মরহুম) হামিদুর রহমান (মন্ট্রিয়লে এন্তেকাল ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকায় সমাহিত), একুশের গানের গীতিকার, আব্দুল গাফফার চৌধুরী ও সুরকার-শিল্পী, (মরহুম) আলতাফ মাহমুদের নামের সাথে সাথে এ দুজনের নামও বাংলাদেশী তথা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, সন্দেহ নাই। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে (শহীদ) আলতাফ মাহমুদ (ঝিলু)-র সাথে বরিশালে আমার পরিচয় সেই ১৯৪৬ থেকে — আমার এক ক্লাস নিচে পড়ত সে। ১৯৫৪ সনে (পূর্ব পাকিস্তানে সেবারের ভোটে মুসলিম লীগকে গো-হারা হারিয়ে, যুক্ত ফ্রন্টের অভূতপূর্ব জয়ের পরে) সে করাচী এলে, পূর্ব জাহাঙ্গীর রোডে, আমার বাসায় একসাথে ছিলাম এক বছরেরও বেশী। পরে (প্রয়াত) বিখ্যাত সুরশিল্পী ও সুরকার দেবু ভট্টাচার্য (বাঁশী) ও তিমিরবরণ (সরোদ) এবং নৃত্যশিল্পী (সস্ত্রীক) ঘনশ্যাম-শান্তা দের বাসায় চলে যায়, করাচীর পি ই সি এইচ সোসাইটিতে। শেষ দেখা জুলাই বা আগষ্ট, ১৯৭১ সনে, ঢাকা নিউ মার্কেটে, যার কয়েক দিন পরেই ওকে তুলে নিয়ে যায় পাক সেনারা — আর ফেরেনি। আমার অনেক সময় মনে হয় যেন ‘আমার ভাই এর রক্তে রাঙ্গানো…’ গানটি আমাদের জাতীয় সংগীতের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। ওদের হাতে মরে গিয়ে অমর হয়ে থাকল আলতাফ, তার অমর সুরসৃষ্টির জন্য!
পৃথিবীর সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে, জনসংখ্যার অনুপাতে, বাংলাভাষার স্থান এখন ষষ্ঠ। বাংলা ভাষা-আন্দোলনের প্রতীক আমাদের শহীদ মিনার সহ, একুশে ফেব্রুয়ারী এখন ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত পৃথিবীর সর্বত্র। আমাদের ভাষাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়-দায়িত্ব আমাদের — আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন। যারা বিদেশে আছি বা আছেন, তাদের একটি মহান ও গুরুদায়িত্ব হল আমাদের নতুন প্রজন্মকে বাংলাভাষায় অভ্যস্ত করানো। দেশে উর্দু হঠিয়ে বাংলা এনেছিলাম; এখন দেখা যাচ্ছে, ডিশ-কেবল ও হিন্দী সিনেমার বদৌলতে, ছেলে-পিলেরা বাংলার চেয়ে হিন্দীর প্রতি যেন বেশী আগ্রহী। সমাজের বেশীর ভাগ উঁচু স্তরের লোকের ছেলে-পিলেরা তো ইংরেজী মাধ্যমে পড়া-শুনা করে বলে, বাংলা জানেই না বললেও অত্যুক্তি হবে না। বড়লোকের ছেলে-মেয়েদের বিয়ের ভিডিও করা এখন অবশ্যকরণীয় দস্তুর হয়ে গেছে। কিন্তু, প্রায় শতকরা ৯০-ভাগ ক্ষেত্রে, ওই সব ভিডিও দেখে বুঝার উপায় নাই যে, ওগুলো বাংলাদেশীদের বিয়ে; কারণ, ভিডিওতে রেকর্ড করা সব গানই হিন্দী গান। মারাত্মক এ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রচলনের, কিছুটা হলেও, রোধ করার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সনে (যখন দেশে গিয়েছিলাম) আমি বেশ কয়েকটি ভিডিও কোম্পানীর দপ্তরে গিয়ে ব্যবস্থাপকদের সাথে আলাপ করেছিলাম এ-ব্যাপারটি নিয়ে। তাদের জবাব পরিষ্কারঃ “স্যার, আমরা ব্যবসা করি; গাহেগরা যে ভাবে চান আমাদের তাই করতে হয়!” এই অপকৃষ্টি আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাষার যে কী অপূরণীয় সর্বনাশটা (slow poisoning) করে চলেছে তা বলে বুঝানোর অপেক্ষা রাখে না — সহজেই অনুমেয়। এসব দিকে সতর্ক নজর রাখা আমাদের সবার কর্তব্য। অন্যদিকে, দেশের সকল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কলেজের পাঠ্য তালিকায় (কিন্ডারগার্টেন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত) বাধ্যতামূলকভাবে যথেষ্ঠ বাংলা অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত উচিত।
এক ভাষাভাষী পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার অবস্থা করুণ — ওঁদের রাষ্ট্রভাষা হিন্দী হওয়ায়, বাংলা ভাষার ব্যবহার ও গুরুত্ব ওখানে খুবই কমে গেছে ও যাচ্ছে। ওঁরা বাংলা ভাষার ভবিষ্যতের জন্য চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। তাই মনে রাখতে হবে যে, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা ও এর ভাবমূর্তি সমুন্নত করার গুরু দায়িত্ব আমাদেরই — বাংলাদেশের, বাংলাদেশীদের।
আবার কিছু ব্যক্তিগত কথা। আমি সেপ্টেম্বর, ১৯৫৪ থেকে জানুয়ারী ১৯৭০ পর্যন্ত (মাঝে পূর্ব পাকিস্তান অফিসে দেড় বছর ও ১৯৬৩-৬৪ সনে ক্যানাডায় প্রশিক্ষণে কাটানো ১৪ মাস বাদে) পাকিস্তানে (করাচী) সরকারী চাকুরী করেছি। এ দীর্ঘ সময়ে কোনও একুশে ফেরুয়ারী তারিখে আমি অফিসে যাইনি। এত চমৎকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উর্দুর মত একটা সমৃদ্ধ ভাষা শিখিনি (এটা কিন্তু আবেগের মাথায় নেহায়েৎই বোকামি করেছি — ভাষা শেখায় কোন দোষ নাই)। করাচীর অফিসে উর্দু যেটুকু বুঝতাম, তাও না বুঝার ভাণ করে ওদের বাধ্য করতাম ভিনদেশি ইংরেজীতে কথা-বার্তা বলতে, তবু উর্দুতে না। বাংলাদেশ স্থাপিত হবার সাথে সাথে আমার অফিসে (আমি একটি ছোট অফিসের প্রধান ছিলাম) সব নথিপত্র বাংলায় লেখা শুরু করেছিলাম — আমি প্রায় নিশ্চিত যে, এ বাবদে আমার সেই ছোট অফিসটিই ছিল প্রথম স্থানের অধিকারী। ব্যাংক হিসাবে সই, চিঠিপত্রের ঠিকানা ইত্যাদি আমি বাংলায় লিখি — এমনকী, ক্যানাডা থেকে দেশে পাঠানো চিঠিতেও (শুধু বাংলাদেশ কথাটা ইংরেজিতে লিখলেই চলে)। ক্যানাডায়ও বাঙ্গালীদের কাছে ডাকে কিছু পাঠালে, অন্তত নামটা বাংলা অক্ষরে লিখি। এ সব কারও কারও হাস্যোদ্রেক করতে পারে কিন্তু ভীষণ ভাল লাগে আমার নিজের কাছে — যেন নিজের মায়ের ভাষা থেকে দূরে সরে যেতে মন চায় না। ইচ্ছা করে যতটা সম্ভব আমার ভাষার কাছে থাকতে, যতটা সম্ভব আমার মাতৃভাষা ব্যবহার করতে! বিদেশে বসবাসকারী আমাদের অনেক বয়ষ্কদেরও (যারা বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায়ই পড়াশুনা করেছেন) দেখেছি যারা নাকি বাংলা ভুলে গেছেন! যারা ছোট বেলা থেকে বাংলাদেশে, বাংলায় কথাবার্তা ও লেখাপড়া করে এসেছি, তদের পক্ষে কী করে এটা সম্ভব তা কোনমতেই আমার বুঝে আসে না।
সব কিছু সত্ত্বেও, আমি ভীষণ আশাবাদী। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা আমাকে আরও বিপুলভাবে উদ্দীপিত করেছে আমার, আমাদের মাতৃভাষার নিশ্চিত উৎকর্ষ ও সর্বজনীয়তা সম্পর্কে।
—এই কিছুদিন আগে, মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত “কবিতা পাঠ” অনুষ্ঠানে দেখলাম বেশ কয়েকটি কচি কচি ছেলে-মেয়ে কোন নোট না দেখেই কঠিন কঠিন বাংলা কবিতা আবৃত্তি করল, গান গাইল। অত্যন্ত শুভ সংকেত। আনন্দে ভরে গেল সম্পূর্ণ মনটা। যখন প্রথম মন্ট্রিয়লে আসি, তখন এমনটা ছিল না।
—সত্যিকারের কিছু উৎসাহী নমস্য বাংলাদেশীর আপ্রাণ ও অদম্য চেষ্টায় বাংলা ভাষা এখন ক্যানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত। অচিরেই বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠ্য তালিকাভুক্ত হবে, কোন সন্দেহ নাই।
—২০০৯-এ বরিশালে আমার এক আত্মীয় (শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের অধ্যক্ষ) আমাকে ওনার কলেজে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন। আমার পাশে বসেছিলেন একজন জাপানী, যিনি আমার সাথে চমৎকার বাংলায় কথা বলছিলেন। উনি ওখানকার একজন শিক্ষক বা প্রশিক্ষক। জিজ্ঞেস করলাম, “এ দেশে কদ্দিন?” জবাব, “তিন মাস”; “এত অল্প সময়ে এমন সুন্দর বাংলা কী করে শিখেছেন?” উত্তর, “জ়াপানে, জাপানী শিক্ষকের কাছে!” একজন জাপানীর আর একজন জাপানী শিক্ষকের কাছে এমন নিখুঁত বাংলা শেখা! কী যে ভাল লাগলো! তা হলে, সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার দুর্বার অগ্রগতি সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে?
—মাত্র কয়েক দিন আগে, আমি মন্ট্রিয়লে একটি ট্যাক্সিতে উঠেই একদম হতবাক! কী, না, মরক্কোর ক্যাবীর ট্যাক্সিতে আমাদের আব্দুল আলীমের কন্ঠে ভাটিয়ালী গান — ‘নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে…’! বেশ কষ্ট হয়েছিল আনন্দাশ্রু সংবরণ করতে!
—সেদিন মন্ট্রিয়ল কোর্টে, জজ সাহেব আসার আগে, কোর্ট রুমে ঢুকে একেবারে তাজ্জব, উৎফুল্ল — খাঁটি কেবেকোয়া (কুইবেকের বাসিন্দা) পেষ্কারের (রেজিষ্ট্রারের) ড্রয়ারের ভেতর থেকে খুব মৃদু স্বরে ভেসে আসছে বাংলা গানের সুর — কী গান? শাহ নাজ রহমতুল্লার ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গায়’!!! আহা, কী যে অদ্ভুত আনন্দোচ্ছল মানসিক অবস্থা তখন আমার!
বলা বাহুল্য যে ওই ক্যাবী ও পেষ্কারের সাথে দীর্ঘ আলাপচারী হয়েছিল বাংলাভাষা, বাংলাদেশ ও আমাদের ‘একুশে’ নিয়ে।
এর পরেও আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষা নিয়ে আশাবাদী না হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে?
এ সংক্ষিপ্ত স্মৃতিকথা শেষ করার আগে, সবার বিবেচনার জন্য শহীদ মিনার সম্পর্কে আমার একটি আকুল, বিনীত আবেদন রেখে যেতে চাই। আমার জানা মতে, একই শহরে স্কুল, কলেজ, ও বিশেষ কোন কোন চত্বরে আলাদা আলাদা শহীদ মিনার স্থাপন করেছেন উৎসাহী ছাত্র ও জনগণ। এগুলো মাতৃভাষার প্রতি, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি, আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধা-সম্মানেরই সাক্ষ্য বহন করে, সন্দেহ নাই। যে অসীম আবেগ-উদ্দীপনার সাথে সে সময়ে এগুলো করা হয়েছিল তার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে এবং সবারই থাকা উচিত। তা সত্ত্বেও, এখন আমি মনে করি যে, একই জায়গায়, একই শহরে একাধিক শহীদ মিনার যেন আমাদের কেন্দ্রীভূত শ্রদ্ধা-সম্মানকে, খানিকটা হলেও, বিকীর্ণ বা বিচ্ছুরিত করে ফেলে। আমার বিনীত প্রস্তাব হল, যে কোন শহর বা জনপদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি মাত্র (প্রধান) শহীদ মিনারটি রেখে, বাকিগুলো সসম্মানে তুলে ফেলা হোক। যাতে ক’রে, সবাই একত্রে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারে এককভাবে একটি শহীদ মিনারের পদতলে। এতে আর একটি বাড়তি, কিন্তু বিরাট, লাভও হবে। সারা দেশের কথা সর্বসাকুল্যে আমলে নিলে, দেখা যাবে যে, এ ভাবে বেশ বড় পরিমাণের জমিও উদ্ধার হবে। অতিরিক্ত মিনারগুলো তুলে ফেলায় মনোকষ্টের বা মনঃক্ষুন্ন হবার দুর্বার কোন কারণ নাই।
বিজয়া দশমীর দিনে হিন্দু সম্প্রদায় এবং মোহাররম মাসে্র আশুরার দিন শিয়া মুসলমানরা যথাক্রমে তাদের যার যার অতি প্রিয় (অন্যান্য বিগ্রহ সহ) দুর্গা-প্রতিমা এবং তাজিয়াকেও তো বিসর্জন দেন, যদিও অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। সে ভাবে, বৃহত্তর জাতীয় ও অনাগত দিনের সাংস্কৃতিক স্বার্থে, প্রতি শহর-জনপদ থেকে অতিরিক্ত শহীদ মিনারগুলো যথোপযুক্ত সম্মান-শ্রদ্ধার সাথে তুলে ফেলা খুবই সমীচীন বলে মনে হয় আমার কাছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এতে করে প্রিয় বাংলা ভাষা বা অমর ভাষা শহী্দান, এদের কারুর প্রতি কোন প্রকার অবমাননা বা অশ্রদ্ধা দেখানো হবে না।
“সেদিন সুদূর নয়” যে, সারা পৃথিবীতেই একদিন আমাদের, বাংলাদেশীদের ‘একুশের শহীদ মিনার’ দেখা যাবে নিঃসন্দেহে; আর ভাষার জন্য প্রাণদানের পথিকৃৎ হিসেবে চিরদিনের জন্য চিহ্নিত থাকব আমরা, এই বাংলাদেশীরা!