শরদিন্দু বন্দোপধ্যায় ব্যোমকেশের প্রথম গল্প সত্যান্বেষীতে ব্যোমকেশের চেহারার একতা ছবি একেছিলেন। প্রথম দেখাতেই তার মনে হয়েছিল সে শিক্ষিত, মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, সংযতবাক, সহৃদয়, মনস্বিতা, গাম্ভীর্য। বয়স ২৩/২৪। গায়ের রঙ ফর্সা। বেশ সুশ্রী। সুগঠিত চেহারা। মুখে চোখে বুদ্ধির ছাপ। তার চরিত্রের লিখেছিলেন এইভাবে- বাইরে থেকে তাকে দেখে বা তার কথা শুনে একবারো মনে হয়না তার ভেতর অসামান্য কিছু আছে। কিন্তু একবার খোচা দিয়ে বা প্রতিবাদ করে যদি উত্তেজিত করা যায় তখন ভেতরের চেহারাটা কচ্ছপের মত বাইরে বেরিয়ে আসে। স্বল্পভাষি কিন্তু একবার ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে যদি চটিয়ে দেখা যায় তখন ছুরির মত শানিত ঝকমকে বুদ্ধি সংকোচ সংযমের পর্দ্দা ছিড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসে। চুরুট খায়। ঘরের মধ্যে ঘন ঘন পায়চারী করে। হ্যারিসন রোডের বাড়ীর তিনতলায় থাকে। তিন চারটে ঘরের মধ্যে একটা ঘর ব্যোমকেশের নিজস্ব সেখানে কারুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। বই ঘরটা একাধারে তার লাইব্রেরী ল্যাবরেটরী মিউজিয়াম আর গ্রীনরুম।
ব্যোমকেশের চেহারার মধ্যে (...?) শরদিন্দু সঠিক লেখেননি সে কতফুট লম্বা ছিল। যে কখনো অভিনয় জগতে ছিল না বোঝা যায় অথচ গ্রীনরুমে সমস্ত রকম মেকআপের সাজ সরঞ্জাম থাকতো এবং নিজেই নিজের ছদ্মবেশ ধারণ করত ও অজিতকেও ছদ্মবেশ ধরিয়ে দিত। খবরের কাগজ পুঙ্কানুপুঙ্খ পড়ত। সন্দেহজনক খবর কি বিজ্ঞাপন (...?) দিয়ে রাখতো। বিভিন্ন সময়ে খুনীদের ব্যবহার করা অস্ত্র মিউজিয়ামে রেখে দিত। এটাও জানা যায় দেশপ্রেমিক ছিল। কালো টাকাপুড়িয়ে প্রথম স্বাধীনতা দিবসে সে দেশের কালো টাকার বিরুদ্ধে (...?) প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
বাংলার চলচ্চিত্রে বহুবছর আগে সন্তু দে শজারুর কাটা ছবি তৈরী করেছিলেন। তারপর বহুবছর ব্যোমকেশ অস্পৃশ্য ছিল প্রযোজকদের কাছে। মাখখানে স্বপন ঘোষালের মগ্ন মৈনাক এবং সত্যজিতের চিড়িয়াখানা। এখন কয়েকবছর ধরে ব্যোমকেশের সিরিয়াল চলছে।
(...?) বাংলা হিন্দি মিলিয়ে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ন'জন অভিনেতা। অজয় গাঙ্গুলী, উত্তমকুমার, শুভ্রজিত দত্ত, আবীর চ্যাটার্জী, সুজয় ঘোষ, ধৃতিমান চ্যাটার্জী, যীশু সেনগুপ্ত, গৌরব চক্রবর্তী এবং সুশান্ত রাজপুত।
সমস্ত পরিচালকই ব্যোমকেশকে ধূতি পাঞ্জাবী কালো ফ্রেমের চশমায় তার চেহারাটা রেখেছেন। শুধু ধৃতিমান শার্ট প্যান্টে। তিনি একমাত্র বৃদ্ধ ব্যোমকেশ। উত্তমকুমার মাঝবয়সী। বাকী সবাই যুবক ব্যোমকেশ।
যদি উত্তমকুমার থেকে যীশু সেনগুপ্ত পর্যন্ত ব্যোমকেশের চরিত্রচিত্রন পাশাপাশি রাখা যায় দেখা যাবে, উত্তমকুমার করেছেন মধ্যবয়সী ব্যোমকেশ। চরিত্রের তীক্ষ্ণদৃষ্টি, অবলোচন, ধীর স্থীর ভাব, সত্য অন্বেষণ করার ধারার প্রশ্নোত্তরগুলো অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই উত্তম ব্যোমকেশকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখেনি কিংবা সংঘাতের সামনে দেখা যায়নি কিংবা রিভলবার বা ঘুষোঘুষি করতে দেখা যায়নি। আদ্যন্ত এক বাঙালী মধ্যবিত্ত সাবলীল ব্যোমকেশ। পক্ষান্তরে আবীর যীশু শুভ্রজিত সুশান্ত রাজপুত গৌরব চক্রবর্তীর ব্যোমকেশ একেবারেই যুবক ব্যোমকেশ। মোটা চশমা যতই দেয়া হোকনা এদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এরা মুখে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। এদের জেরা করার ধরনের মধ্যেও একটা যৌবনের ছটফটানি রেখে দেয়া হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই অবশ্য একটা ধীর স্থির ভাব বজায় রেখে গেছেন। এর মধ্যে বরং যীশু সেনগুপ্তর ব্যোমকেশ অনেক ধারালো হয়ে বেড়িয়ে এসেছেন যতটা আবীর বা গৌরব পারেননি। যীশু রিভলবার ব্যবহার করেছেন। সাগ্নীককে চড় মেরে যে একশনটা করেছেন সেটা সরাসরি শরদিন্দুর ভাষা থেকে উঠে আসা ব্যোমকেশ - একবার চটাইয়া দিয়ে যদি উত্তেজিত করা যায় মুহুর্তে সানিত ছুরির মত ব্যোমকেশ কচ্ছপের মত বাহির হইয়া আসে। - যীশু হুবহু এই জায়গাটা (...?) ধরেছেন। হাটায় চলায় যীশুর ব্যমকেশ অনেক সপ্রতিভ অনেক খেলোয়াড়চিত। ধূতিপাঞ্জাবীতে অনেক দ্রুত অন্যদের চেয়ে। আবীর যেমন মুখের ওপর কড়া ভাষায় জবাব দিতেও অসম্ভব ভদ্রতা বজায় রাখে। গৌরব যেমন অভদ্রতা একেবারেই করে না। যীশু করে এবং দাপটের সঙ্গে করে। অন্যদিকে বয়স্ক ব্যোমকেশ ধৃতিমান ব্যোমকেশের চেহারাতে একজন মনস্ক অভিজ্ঞ চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। একশনধর্মী একেবারেই নয়। খুব সহজ স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে সুরাহা করেন।
ছোটপর্দার ব্যমকেশ হিসেবে রজত কাপুর এবং গৌরব চক্রবর্তী যথেষ্ট ভালভাবে চরিত্রটাতে মেলে ধরেছেন। গৌরবের সাংসারিক ব্যোমকেশ একটা নতুন পাওয়া। কিন্তু চেহারায় গৌরব বড্ড ছোট্টখাটো যেটা ব্যোমকেশ ভাবলে যায় না। সীমান্তহীরা গল্পে এক জায়গায় শরদিন্দু লিখছেন- খুলির মধ্যে পঞ্চান্ন আউন্স ব্রেন ম্যাটার আছে। হনু আর চোয়াল উচু, (...?) মুখ, বাকা নাক, ত্বরিতকর্ম্মা কুটবুদ্ধি (...?)। ইনটিউনান খুব বেশি। রিজনিং পাওয়ার মন্দ ডেভেলপড নয়। কিন্তু এখনো ম্যাচিওর করেনি। আটের ওপর বুদ্ধির বেশ শৃঙ্খলা আছে। বুদ্ধিমান বলা চলে। এই যে ব্যোমকেশ সম্বন্ধে তার ভেতরের চরিত্রটার ছবি আকলেন এর সঙ্গে গৌরব চক্রবর্ত্তীতে বা আবীরকে মেলানো মুস্কিল।
চলচ্চিত্রে ব্যোমকেশের চরিত্রচিত্রকে যে অভিনেতারা অভিনয় করে এসেছেন যদি তাদের ক্রম তাদের অভিনীত (...?) সাজাই তাহলে আমি এভাবে বলতে পারি
যুবক ব্যোমকেশের চরিত্রে প্রথমেই যীশু তারপর আবীর, শুভ্রজিত। অজয় গাঙ্গুলী, সুজয় ঘোষ
মধ্যবয়সী ব্যোমকেশের চরিত্রে একমাত্র উত্তমকুমার
বৃদ্ধবয়সী ব্যোমকেশ চরিত্রে ধৃতিমান চ্যাটার্জী
ছোট পর্দ্দায় ব্যোমকেশের চরিত্রে রজতকাপুর গৌরব চক্রবর্তী
হিন্দিতে সুশান্ত রাজপুত বেশ ভাল।
আর ব্যোমকেশের চরিত্রচিত্রনে যে পরিচালকরা ভালমত খেটে চরিত্রটা দাড় করিয়েছেন তাদের ক্রমপর্যায়ে রাখবো সত্যজিত রায়, অঞ্জন দত্ত, ঋতুপর্ন সেনগুপ্ত, অরিন্দম শীল। এরা কেউই ব্যোমকেশকে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ধুতি পাঞ্জাবীর বাইরে নিয়ে যাননি। সত্যজিতবাবুর মাপ ব্যবহার করাটা যতটা সিনিক ততটা ব্যোমকেশকে তুলে ধরা নয়। অঞ্জন দত্ত একেবারে শরদিন্দুর ভাষা থেকে যীশুকে তুলে ধরেছেন। অরিন্দম শীল আধুনিক করে তুলেছেন অনেকটাই। আর ব্যোমকেশকে প্রকাশিত করতে অজিতের চরিত্রটাকে অঞ্জন দত্ত অরিন্দম শীল যতটা মনোযোগ দিয়েছেন অন্যরা ততটা নয়। সন্তুদে (...?) ওপর গল্পটা বলে গেছিলেন। অজিতের চরিত্রে শ্বাশ্বত অসাধারণ। শৈলেন মুখার্জীও ভাল।
চলচ্চিত্রে ব্যোমকেশের জোয়ার এসেছে। গোয়েন্দা গল্প প্রযোজকরা তুলতে চাইতেন না কারণ ছবিটা কেউ দুবার দেখবেনা কারণ খুনীকে সেটা তারা প্রথমবার দেখেই জেনে যাবেন। তাই। কিন্তু এখন লোকে দেখছে কারণ চরিত্রগুলো আরও লার্জার দ্যান লাইক হয়ে বেড়িয়ে আসছে। অঞ্জন দত্ত যেমন টেকনিকে রশোমন-ছায়া ফেলেছেন তার ছবিতে। তেমনি রহস্যের ধারাটা নানান পঠে আকর্ষনীয় করে তুলে দেখাচ্ছেন পরিচালকরা। তাই লোকে দুবার দেখছে।
এখন অপেক্ষা নতুন নতুন ব্যোমকেশের গল্পে কত নতুনভাবে, কত গভীরভাবে, আরো নিখুঁত করে ব্যোমকেশকে উপস্থাপিত করতে পারেন পরিচালকেরা।
তাপস চক্রবর্তী।