• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬২ | মার্চ ২০১৬ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • তেতো এক সময়ের কেন্দ্র থেকে পরিধি : সন্দীপন চক্রবর্তী



    ‘আমার জীবনের ও কবিতার কেন্দ্র একটি অন্ধকার, একটি বিষণ্ণতা ও সর্বনাশ।’
                   —যশোধরা রায়চৌধুরী

    ‘Her wounds came from the same source as her power’
                   —অ্যাড্রিয়েন রিচ

    কবিতা সংগ্রহ; যশোধরা রায়চৌধুরী; প্রচ্ছদ : শোভন পাত্র; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারী ২০১২; সপ্তর্ষি প্রকাশন ; পৃষ্ঠাঃ ২০৮; ISBN: 978-93-81180-49-5

    বাংলা কবিতায় নয়ের দশকের কবিদের মধ্যে অন্যতম যশোধরা রায়চৌধুরী। মোটামুটি ১৯৯২-৯৩ সাল থেকে তাঁর লেখা ছাপা শুরু হয়। ১৯৯৬-তে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘পণ্যসংহিতা’ এবং ১৯৯৮-তে দ্বিতীয় কবিতার বই ‘পিশাচিনীকাব্য’ বেশ সাড়া জাগিয়ে তোলে সমসাময়িক বাংলা কবিতার মানচিত্রে। নিজের লেখা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যশোধরা বলেছেন, ‘আমার লেখায় কোনো স্কুপ নেই, সময়ের পদপাত আছে।’ কিন্তু কেন তাঁর কবিতায় ‘সময়ের পদপাত’ এত জরুরী? কারণ তাঁর মতে, ‘কবিতা নিজেই একটা স্ক্রিনের মতো। কবিতা হচ্ছে একটা রিফ্লেক্টর—যাতে সময়ের ছায়াটা পড়ে। কাজেই কবিতা পাল্টেও যায় যেমন, তেমনি কবিতার মধ্যে আবার সময়কে বোঝাও যায়।’ তাই যশোধরার কবিতাকে বুঝতে হলে, বুঝতে হবে তাঁর সময়ের চরিত্রকেও। কবি হিসেবে তাঁর প্রস্তুতিপর্ব ও প্রকাশের সময়টায়, সারা পৃথিবী এবং আমাদের দেশ জুড়ে কী কী ঘটছে একঝলক দেখে নেওয়া যাক—১৯৮০-৯০-এর দশকে ভারতে আঞ্চলিকতার আবেগ পৃথক পৃথক রাজ্যের দাবীতে সোচ্চার। আটের দশকের শেষ দিকে সোভিয়েতে গর্বাচভ, চিনে জিয়াং জেমিন ও আমেরিকায় জর্জ বুশের উত্থান। এরপর সময়ের সঙ্গে একের পর এক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি ভেঙে পড়বে ধীরে ধীরে। নব্য-সংস্কারপন্থী মতাদর্শ বিশ্বায়নের নামে গড়ে তুলবে এমন এক আধিপত্যকামী প্রকল্প, যা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের জয় উদ্‌যাপন করবে। বাজারায়ন এবং বেসরকারিকরণকে ঘোষণা করা হবে পৃথিবীর অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হিসেবে; রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে সেখানে চিহ্নিত করা হবে অযোগ্য ও উৎপাদনবিরোধী হিসেবে ...

    ১৯৮৯ — বেজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রের জন্য ছাত্রদের বিক্ষোভ, সেনাবাহিনী বিক্ষোভ দমন করলো। কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানির সরকার ইস্তফা দিল। চেসেস্কুর ক্ষমতাচ্যুতি।

    ১৯৯০ — সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রের উপর একাধিপত্য ত্যাগ করলো। নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি। দুই জার্মানির মিলন। রাতারাতি কুয়েত দখল করলো ইরাক। আমেরিকা উপসাগরীয় অঞ্চলে ২ লক্ষ সেনা পাঠালো।

    ১৯৯১ — উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের ফলে আমেরিকার একমাত্র সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠায় একমেরু বিশ্বের সূচনা। সামন্ততান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির প্রতি চিনের কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের সমর্থন। ভারতে রাজীব গান্ধী হত্যা। মনমোহনের বাজেট। উদারীকরণের হাওয়া। চালু হল স্যাটেলাইট চ্যানেল।

    ১৯৯২ — বাবরি মসজিদ ধ্বংস।

    ১৯৯৩ — বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় মুম্বাইয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আবার তার প্রতিশোধ নিতে মুম্বাই বিস্ফোরণ। এই প্রথম ভারতীয় সমাজে প্রবলভাবে ঢুকে পড়লো আণ্ডারওয়ার্ল্ড এক ডনের নাম—দাউদ ইব্রাহিম। গ্যাট চুক্তিতে রাজি ১১৭টি দেশ।

    ১৯৯৪ — ‘বর্ণবৈষম্যের ইতি’ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়িত্বে এলেন ম্যান্ডেলা। সুস্মিতা সেনের ‘মিস ইউনিভার্স’ এবং ঐশ্বর্য রাইয়ের ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ খেতাব জয়।

    ১৯৯৫ — বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত। সবচেয়ে বেশিদিন ধরে চলা ফিল্মের রেকর্ড তৈরি করলো ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’।

    ১৯৯৬ — ভারতে সাইবার জমানার শুরু। ইন্টারনেট এলো দেশে।

    ১৯৯৮ — পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশ। বিল ক্লিন্টন ও মনিকা লিউইনস্কির যৌন কেলেঙ্কারি।

    ১৯৯৯ — কার্গিল যুদ্ধ। ড্রয়িংরুমের টিভিতে সেই যুদ্ধের টাটকা ছবি দেখা এবং তাও বিনোদনের বিষয় হয়ে ওঠা।

    অর্থাৎ এমন একটা সময়ের মধ্যে বিকাশ হচ্ছে এই কবির, যখন চারপাশের চেনা পরিচিত জগৎ এবং তার মূল্যবোধগুলোও আমূল পাল্টে যাচ্ছে। ছোটবেলায় পাওয়া শাশ্বতর ধারণার সঙ্গে আর চারপাশকে মেলাতে পারে না এই কবির প্রজন্ম। এই নতুন প্রজন্মের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক সব্যসাচী ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে—‘আজকের পুঁজিবাদী বিজয়ের পর্বে ভুবনায়ন এবং নানা দেশে বঙ্গসন্তান ছড়িয়ে পড়ার ফলে যে সংস্কৃতি তৈরির পথে, তার আদর্শ বিদেশি—অথবা আরও যথাযথ শব্দে, দেশবিহীন—এক প্রজন্মের সংস্কৃতি, যে প্রজন্মে প্রত্যেকে নিয়ত সাইবর-স্পেইসের পথে মনসা ত্রিভুবনং গচ্ছতি।’ ফলে, শাশ্বতর বদলে মানুষের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে তাৎক্ষণিক। তাই এই কবিকে বলতে হয়, ‘অবচেতন নয়, আমরা শিকড়হীন এক নিছক মুহূর্তিক যাপনের কথা বলি’ বা ‘আমরা তো সেই নষ্ট প্রজন্মের লেখক, অবিশ্বাস আর শ্লেষ আমাদের মজ্জা পর্যন্ত খেয়ে নিয়েছে।......সমাজের ওপরে কটুকাটব্যই করা হল শুধু। লেখা হল তাৎক্ষণিক অনুভূতিমালা।’ সেই অনুভূতিমালার মধ্যে জেগে ওঠে এই দুই বিপরীত মেরুর মধ্যে টানাপোড়েনে রক্তাক্ত এক শ্লেষ, তির্যক এক ভঙ্গি। একদিকে ‘চতুর্দিকের উদ্ভট ঘটনাবলী দেখে’ তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে ‘এক নিবিড় ঠাট্টা’। আবার তিনি প্রতিটি মানবসম্পর্কের ভেতরেই দেখতে পান ‘বিপজ্জনকতা ও গুপ্তঘাতের সম্ভাবনা’। আরেকদিকে তাঁর নিজের কবিতা সম্পর্কে বলেন, ‘বিষয় আমার চারপাশেই ছড়িয়ে আছে। সেগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে কবিতা লিখেছি চিরকাল, তাই আমার কবিতা মিনিমালিস্টিক এবং দৈনন্দিনতার মধ্যে আশ্চর্যের খোঁজ করে।’ অথচ, এসব নানা বেসুর বা ডিসকর্ড এসে, শেষ পর্যন্ত বেজে ওঠে একটিই সুরে। ‘জ্যাজ বাজনার ভেতরে যে ভাবে সামঞ্জস্যে থাকে নানা আপাত বেসুরো কর্ড’, ঠিক সেভাবেই, এই আপাতবিরোধী বিন্দুগুলোও এসে কোনো এক সামঞ্জস্যে মিলে যায়, বেজে ওঠে যশোধরার কবিতায়।

    নয়ের দশকের শুরু থেকেই, একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, গ্লাসনস্ত, বিশ্বায়ন, বাণিজ্যিক প্রাচীর ভাঙা, ডিসইনভেস্টমেন্ট—এসবের ফলে ভিতরে ভিতরে হয়তো তৈরী হয়ে ওঠে একধরনের বিষণ্ণতা, একধরনের মায়াহীন মোহহীন ভাবনা; আবার আরেকদিকে অসম্ভব নতুন পণ্য ঢুকতে শুরু করা, বিউটি পার্লার, এস টি ডি বুথ, এফ এম রেডিও, কেব্‌ল্ টিভি—সব মিলিয়ে শুরু হল সে এক তুলকালাম পণ্য-ধামাকার যুগ, যখন যেদিকে তাকাই, সেদিকেই চোখে পড়ে—

    এ বড় অনন্য ঠ্যাং বড় বেশি মোহময় ঠ্যাং
    এ বড় নির্লোম বড় চেয়েচিন্তে ধার করা ঠ্যাং

    আর নানা বিরোধী চরিত্রের সমন্বয়ে সেই সময়কে তুলে আনার জন্য তাই লাগসই হতে হল কবিতার ভাষাকেও। ফলে যশোধরার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামই হয়ে উঠলো ‘পণ্যসংহিতা’। আর এই নতুন সময়ের নতুন দুনিয়াকে ধরতে তাঁর লেখায় উঠে আসলো শ্লেষ, তেরছা চিত্রকল্প, নতুন ট্যারাবাঁকা এক শৈলী। পণ্যস্তুতির ছলে তিনি ঘটাতে শুরু করলেন সাবভার্সন—

    দেহবোধ থাকলেই তাকে ঘাড় ধরে মাটিতে শুইয়ে দেওয়াও থাকবে
    কেউ কেউ নিজের প্রেমিকাকে অক্ষিকোটরের মধ্যে ঢুকিয়ে, তালাবন্ধ করে
    তারপর বাহিরে যাবে, সফট পর্নোবিতরণের দোকানে
    যেখানে প্রতিটি জঘন্য পত্রিকার সঙ্গে ফ্রি দেওয়া হয়
                                                     একটি করে মেয়ে

    ..................................................................... .....................................................................
    ঢুক ঢুক ঢুক ঢুক ঢুক ঢুক
    মধ্যিখান দিয়ে হেঁটে যাবে ভিক্ষুণীরা, ন্যাড়ামুণ্ডু বারবি ডলেরা

    নিরুদ্বিগ্ন, ক্রেতাহীন হয়ে যাবে গোটা একটা দেহের বাজার।
    এখানে তাই একের পর এক কবিতার নাম হয়ে উঠতে থাকে ‘বাতাসানুকূল কৌটো’, ‘প্রচ্ছদকাহিনি মে-জুন সংখ্যা’, ‘উইন্ডো শপিং’, ‘বিশেষ ত্বকসংখ্যা’, ‘সংবাদ পরিক্রমা—দশটা দশ’, ‘বিউটি পার্লার’ ইত্যাদি। কিন্তু যদি সর্বক্ষণ মুক্ত বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তারই ভাষায় কথা বলতে হয়, তাহলে সেই অতিরিক্ত ভোগ থেকেও একধরনের বিরক্তি, একটা প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা উঠে আসে। তাই যশোধরাকে লিখতে হয় —

    তুই কি ভেবেছিস বলত, ক্ষত অনাবৃত করবি, আছাড়িপিছাড়ি খাবি, সব ওপেন, সব উন্মুক্ত, সব পাবলিক? এমনকি প্রেমে পড়লেও কবিতা: পাবলিকের সম্পত্তি, এমনকি প্রেম ভেঙে গেলেও কবিতা, পাবলিকের সম্পত্তি? তোর লজ্জা করে না?

    তাঁর জীবন ও কবিতার কেন্দ্রে যে বিষণ্ণতা ও অন্ধকারের কথা তিনি বলেন, তারও উৎস হয়তো এখানেই—যে জীবন ভোগ করছি আর যে জীবনে থাকতে চেয়েছিলাম, তার মধ্যে অসেতুসম্ভব এই যোজন যোজন দূরত্বে। কিন্তু এ এমনই এক মায়াবী সময়, যখন তিনি টের পান নিজের ভিতরের এই পিশাচিনীরূপ—

    এই জগতের আমি মর্মস্বরূপিনী, আমি কালো
    এত কালো হৃদয় যে অন্তঃকরণকেও সাদা মনে হয়
    সবচেয়ে অন্যায়কারিণী এই তেতো, নীল অন্তঃকরণই
    আমাকে শেখাত কোনভাবে যায় তিমিরসঙ্গমে।
    টের পান—
    ভুল এত ভাল খেতে, ফুচকা আর কোকাকোলা খেয়ে
    তুমি বুঝতে না কখনও।
    আর আক্ষেপ হয়—
    আমাকে তো দিতে পারো অল্পস্বল্প উত্তমসুচিত্রা, কড়া করে
    আজও ওইসব খেতে পারি।
    তাই নিজের সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতে হয়—
    এরকম ভোঁতা ও শব্দের প্রতি অসম্ভব পাগলদায়িনী
    কবিকে কি বলো তোমরা : অবৈধ জটিলাকৃত করে দেওয়া ছাড়া
    আর কি বা করতে পারি : ভাল তো বাসতেই পারব না,
    জেনে গেছি।
    সমসময়ের এই জটিল দেয়া-নেয়ার মধ্যে দিয়েই চলতে চলতে তাই লিখে যেতে হয় সময়ের সেই বেদনাকে। তাছাড়া কোনো উপায় নেই; কারণ কোথাও বেদনা ছাড়া সূর্যালোক নেই। যশোধরা জানেন যে এই—
    প্রত্যাখ্যান, কুকুরের ঝুলে পড়া জিভ
    প্রত্যাখ্যান, অবিচার, ভালবাসাহীনতা, অশিব
    প্রত্যাখ্যান, একা ঘর, লাল মেঝে, একা একা লুডো
    প্রত্যাখ্যান, খোলা ছাদ, নয়নতারা ফুল, ধুলো, মুঠো।
    আর সেই প্রত্যাখ্যানের রাস্তা হিসেবেই তাঁর কবিতায় তাই উঠে আসে শ্লেষ, বিদ্রূপ আর কৌতুকের ঝলকানিময় গরল। কারণ, তাঁর মনে হয় ‘জীবনানন্দ যে বলেছিলেন, সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়, দ্বেষ, আমি সম্পূর্ণ সমর্থন করি। এবং আরো ভাবি, সৃষ্টির মনের কথা শ্লেষও। আর তাই, আমার কলম থেকে আলোকময় পংক্তি বেরোয় না। আমি পলিটিকালি কারেক্ট কবিতা লিখতে পারি না।’ বরং তিনি লিখে যান যে—
    প্রত্যাখ্যানমাত্রে এক একটি কবিতা
    প্রত্যাখ্যানের আছে বিন্যাস, অন্বয়।
    প্রত্যাখ্যানের আছে অলংকার, ভ্রম।
    প্রত্যাখ্যানের আছে শিল্পসম্ভাবনা।
    আর এই ঠাট্টা, কৌতুক বা শ্লেষের লক্ষ্য অধিকাংশ সময়েই তিনি করে তোলেন নিজেকে। এ ঠাট্টা যেন ঠিক ‘মজা করা’ নয়, বরং ‘মজা মারা’। কৌতুকময় শ্লেষের সেই ট্যারাবাঁকা ভাষাকেই তিনি তাঁর বেদনার, এমনকী জীবনদর্শনেরও ভঙ্গি করে তুলে বাংলা কবিতার প্রচলিত ধরনটিকে বেশ ধাক্কা দিতে চেয়েছেন। ‘সময়ের পদপাত’ ধরতে চেয়ে তাঁর কবিতায় তাই উঠে আসে তৎসম ও দেশি অনার্য শব্দের সঙ্গে ইংরেজি ও হিন্দি শব্দ মেশানো একধরনের সাজাওট, এক সিন্থেটিক ভাষাভঙ্গি, যার মধ্যে দিয়ে ধরা পড়ে সমসাময়িক জীবনের গতির অস্বাভাবিক দ্রুততা এবং ফ্লাকচুয়েশন। মাঝেমাঝেই সেখানে ব্যবহার হয় নানা ব্যাক রেফারেন্স, কিন্তু তা সামগ্রিকভাবে রেফারেন্সিয়াল হয়ে ওঠে না।

    ‘পণ্যসংহিতা’ (১৯৯৬), ‘পিশাচিনীকাব্য’ (১৯৯৮)-র পর খানিকটা নতুন বাঁক নিয়ে এলো ‘চিরন্তন গল্পমালা’ (১৯৯৯) আর ‘রেডিও-বিতান’ (১৯৯৯)। কবিতার দৃষ্টি আণুবীক্ষণিক থেকে দূরবীক্ষণিক হল। রাত্রিকে বহুগুণ করে বর্ণনা করলেন, যেন দিন। উঠে এল এক আলোকিত অন্ধকারের কাটা-কাটা ছড়ানো-ছিটানো গল্প। নানা বয়ানে। সে এক নতুন ঢেউ। তারই মধ্যে ঢুকে এলো প্রেম কী মহাসমারোহে! প্রণয়। বিবাহ। আর তারপর সংসার। সন্তান জন্মের বিস্ময় ... আনন্দ ...। শিশুসন্তানের জন্য মায়ের মমতা। শিশুদের ভাষা। ১৯৯৫ থেকে ২০০১ এই দীর্ঘ ছ’বছরের অভিযাত্রা থেকে তৈরি হয়ে উঠলো ‘আবার প্রথম থেকে পড়ো’ (২০০১)। তারও চার বছর পর ২০০৫-এ প্রকাশিত হবে ‘মেয়েদের প্রজাতন্ত্র’। এরপর যশোধরার লেখা বেশ বড় বাঁক নেবে। পাল্টে যাবে অনেকটাই। ২০০৮-এ প্রকাশিত হল ‘কুরুক্ষেত্র অনলাইন’, ২০১০-এ ‘ভার্চুয়ালের নবীন কিশোর’। আগের থেকে অনেকটাই বদলে গেছে ভাষাভঙ্গি, বদলে গেছে চিন্তাভঙ্গি। হয়তো ‘আবার প্রথম থেকে পড়ো’ (২০০১) থেকে ‘কুরুক্ষেত্র অনলাইন’ (২০০৮)-এ এসে পৌঁছনোর জন্য তাই সময় লাগলো সাত বছর। আর এই বদলে যাওয়ার মাঝপথের চিহ্নগুলো ধরে রাখল ‘মেয়েদের প্রজাতন্ত্র’। নানা দিক থেকে বদল হলেও একটা ব্যাপার কিন্তু কখনও বদলায়নি যশোধরার কবিতায়—কবিচেতনার ইনটিগ্রিটি। কারণ যশোধরা জানেন যে ‘বারবার নিজেকে চেতাবনী দিয়ে, কশাঘাত করে চেতনা ফিরিয়ে এনে, নিজের ইনটিগ্রিটি বজায় রেখে যেতে হবে’। তাই অনায়াসেই তিনি লিখতে পারেন যে—

    তৈলতা, মলিন সন্ধ্যাকাল
    কলকাতা কবলে আছে জনশূন্য পার্ক স্ট্রিটগুলো
    আমাকে সামান্য চাপ দাও
    আমি এই শব্দকে মসৃণ করব, লুব্রিকেট, হোচিমিন বাগানে বাগানে
    ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আঙুল ছোঁয়াব আর টাটা সেন্টারের পদমূলে
    রেখে আসব অনন্য ক্রেডিটকার্ড, ধার…
    ধার করে ঘৃত খাচ্ছি, ধার করে খাচ্ছি ধারা ধারা
    বিশুদ্ধ ধারায় পড়ছে তোমার মলিন, সান্ধ্য, তৈলাক্ত বাতাস
    বায়ুচাপভূত, শুকনো, ডিসেম্বর, লুব্রিকেট করো আগাগোড়া
    মেট্রোর গর্ভের থেকে উঠে আসছি আমরা সব উর্বর, নষ্ট মহিলারা
    এই কবিতাটি প্রসঙ্গে যশোধরা জানাচ্ছেন যে, এটি ‘লেখা ১৯৯৫ এর আসপাশে। কেন লিখেছিলাম এই কবিতা? কেননা রোজ মেট্রোতে যাতায়াত করতে করতে আর মলিন শীত সন্ধ্যার দূষণপৃক্ত কলকাতা, তার হলদেটে ফগলাইট, পুরো দিনযাপনটাকেই হলদেটে আলোয় ভরে দিত। প্রতিটি হলদে আলোর নিচে দাঁড়ানো মেয়েই তখন প্রচণ্ডভাবে নষ্ট বেশ্যার মত মনে হয়, হত।’ তাই তাঁর আরেকটি কবিতার নামই হয়ে উঠতে পারে ‘গণিকা জীবন’। তিনি নিজেই জানান&mdash‘অন্য একটি কবিতায় লিখেছি মন খারাপের কথা। জানালায় দাঁড়ানোর কথা। নষ্ট হয়ে ঊঠতে চাওয়ার চিত্রকল্প বার বার হানা দেয়।’ যেমন ‘খুকিদের জন্য কবিতা’য় লেখেনঃ
    মেয়েরা কখনো তত প্রাপ্তবয়স্ক হয়না, জানি।
    একমাত্র স্বৈরিণীরা ছাড়া। আর স্বৈরিণীরা আমাকে বলেছে
    যখন কাপড় খোলে তারা, একা—আজানুলম্বিত
    আয়না থেকে বেরিয়ে সবুজ
    সবুজাভ শীত একটা, পাকিয়ে পাকিয়ে ধরে দেহ
    পোড়লে পোড়লে (??) খুলে আসে
    প্রাপ্তবয়স্ক মেধা, হাড়গোড়, পোষাক, খাটের নিচু রড।
    এটাই প্রমাণ, আর ওরাও তো ভয় পায় এটাকে, কাজেই
    পুরুষের সামনে ছাড়া তারা জামাকাপড় খোলে না।
    বাকি মেয়েরা চেতনাবিহীন
    অপাপবিদ্ধতা। এক ধুমসি ব্যাপার। কোন হাড়গোড় নেই তো, তাদের
    বড় বড় আঁখিপল্লব আছে : খুকিভাব, সেলুলয়েডের।
    এদের কি প্রেমে পড়া যায়?
    ডলপুতুল মেয়েদের কথা ভাবলে প্রেম পায় না, তবু
    প্রেমে পড়ি, জানি যে কখনো
    পর্নো বই পড়ানো যাবে না
    ব্লু ফিলিম দেখানো যাবে না
    স্বাদু আর পুষ্টিকর কবিতাও বোঝানো যাবে না।
    সুতরাং প্রেমকরাকালীন আমি চোখ বুজে থাকি
    এবং স্বৈরিণী ভাবি … সব মেয়েকে … সর্বদা … কারণ …
    অথবা দশমহাবিদ্যার একজন ছিলেন যে ধূমাবতী, তার নাম আশ্রয় করেই ‘ধূমাবতী’ কবিতায় লেখেনঃ
    আমাদের শহরের বহুলাংশ কালো ও প্রোথিত
    আকন্ঠ জঞ্জালে। বাকি যে কটি বিন্দুতে সবুজের
    থ্যাঁতলানো, ঘষটানো রঙ, আমাকে সেখানে নিয়ে চলো
    আমি খুব পরিক্লান্ত, টাল খেয়ে গড়িয়ে গিয়েছি লোকালয়
    আরো মফস্বলে: যেন পাঁজরের ভাঙা হাড় উঁচনো উঁচনো
    সবুজের মধ্য থেকে সাদা সাদা বেরিয়েছে, ইস্পাতের রড
    দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন জাগর শরীর থেকে টেনে
    সাঁড়াশিতে টেনে তুলছো প্রোথিত বিষয় …
    কালো ও বিষন্ন হাত বাতাসের, সেও নেমে এসেছে এখন
    গলি ধরে দাঁড়িয়েছে কয়লার ধোঁয়ায় তৈরি মেয়ে সব, ঠায়:
    বেশ্যা আর যৌনকর্মী, তোমরা তবে কোথায় দাঁড়াবে?
    আজকেও, এই ২০১৬-তে, কিঞ্চিৎ সমাজতত্ত্ব আর অনেকটা অভিজ্ঞতা মিলিয়ে, আমরা দেখতে পাই, ‘কতটাই না এক রয়ে গেছে ছবিগুলো, ঘটনাগুলো, আর স্টিরিওটাইপগুলো’ । আর তাই, সেই জন্যই, আমাদের কবিতার ম্যাপে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন তিনি—তাঁর কবিতা। আবার তাই ফিরে ফিরে পড়তে হয় তাঁর কবিতা, ক্রমানুসারে, পরতে পরতে খুলে, নিজেকে আর নিজের চারপাশকে নতুন আবিষ্কারের আশায়। সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর এই কবিতাসমগ্র।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments