• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬২ | মার্চ ২০১৬ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • ফিরে পড়া বইঃ প্রমদারঞ্জন রায়ের “বনের খবর” : শ্রেয়সী চক্রবর্তী


    বনের খবর; প্রমদারঞ্জন রায়; প্রচ্ছদ: সত্যজিৎ রায়, অলঙ্করণ: শ্যামলকৃষ্ণ বসু; প্রথম প্রকাশ: 'সন্দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশিত, পরে গ্রন্থিত হয় ১৯৫৬-সালে (সিগনেট প্রেস থেকে, লীলা মজুমদারের সহায়তায়);বর্তমান লেখায় ব্যবহৃত প্রথম লালমাটি সংস্করণ (আদি সংস্করণের অভিন্ন রূপ), বইমেলা ২০১১; ISBN: নেই

    খন ওয়াইল্ড-লাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে বাঙালির এতো কদর ছিল না; আর না ছিল বন্যজন্তু ফটোগ্রাফির চর্চা। শিকারের সঙ্গে শিকারীদের ছবি নিশ্চয় তোলা হত। তবে তা ছিল আবার সাহেবসুবোরই একচেটিয়া! এহেন মান্ধাতার বাবার আমলে ঝুলি ভরে ঘন সবুজ জঙ্গুলে গন্ধই শুধু নয়; নিয়ে এলেন রোমহর্ষক মুচ্‌মুচে বনের খবর। কে বলুন তো? এক আলোকিত বাঙালি শ্রীযুক্ত প্রমদারঞ্জন রায়; ভারতবর্ষের একদম প্রথম দিককার বিখ্যাত অসমসাহসী সার্ভেয়ার এবং জরিপ বিভাগের হোমরাচোমরা অফিশিয়াল যিনি তিব্বত সীমান্ত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর আরো একটি পরিচয় হল তিনি নিজেই অত্যন্ত সুলেখক, শিকারী এবং প্রাতঃস্মরণীয় বাঙালি শ্রীউপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটভাই আর প্রখ্যাত লেখিকা শ্রীমতী লীলা মজুমদারের বাবা। এবং পাঠকের বিপুল প্রাপ্তিযোগ ঘটিয়ে এহেন মানুষের লেখাটি আবার অতীব সুস্বাদু।

    ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ এই সুদীর্ঘ বাইশ বছর ধরে ভারতবর্ষের তৎকালীন বিপুল সীমান্ত পূর্বে ব্রহ্মদেশ থেকে পশ্চিম দিকের বন্নু উপত্যকায় তিনি ঘুরে ঘুরে সুদক্ষ হাতে এবং কঠোর পরিশ্রমে সরকারী জরিপের কাজ করেছিলেন। তাঁর ভ্রমণের বেশিটাই দুর্গম জঙ্গল আর খাড়া পাহাড়। সঙ্গে ভালুক হাতি বাঘ ডাকাত আর অল্প কয়েকজন মানুষ! আর একদম প্রথম দিকে অভিজ্ঞতা তত বেশি ছিল না কিন্তু কর্মদক্ষতা আর নির্ভেজাল নির্মল দুষ্টুমি করার শিশুমন ছিল তাঁর হৃদয়ে। এই লেখাতেও সেই সরল শিশুমনের সার্বিক প্রকাশ ... তাঁর নিজের ভাষায় “বাঁদুরে বুদ্ধি”! জরিপের কাজে শিক্ষানবীশি করার সময়েই এক সিনিয়র সর্দারজীকে স্বার্থপরের মত বেশি কাজ করার সু(কিম্বা কু)ফল বুঝিয়েছিলেন প্রমদারঞ্জন জরিপ ম্যাপের উপর মিথ্যে নকশা এঁকে বেগার খাটিয়ে!!! টিমলি পাহাড়ের উপর এই কাজে তাঁর প্যাসিভ সঙ্গী ছিলেন সিনিয়র বাঙালি দাদারা। পরে সর্দারমশাই খুব রেগে গিয়ে প্রমদারঞ্জন সম্পর্কে বলেছিলেন, “এ ভেরি মিসচিভাস্‌ ফেলো”। তারও আগে এক বঙ্গতনয় সহকর্মী পাগলপারা পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে নার্ভাস লোকজনকে ভয় দেখানোর নেশাড়ু প্রমদারঞ্জনকে উপাধি দিয়েছিলেন “রেকলেস ফুল”! আর আজকের দিনে বনের খবর পড়ার পর আমরা হয়তো বলেই বসব তাঁকে ক্রেজি ফেলো! চাকরি জীবনের শুরুতেই এমন সব সাধুবুদ্ধি বহির্গত উচিত (কিম্বা অনুচিত) কাজ তথা সরল দুষ্কর্ম করতে পারার মতো বুকের পাটাওলা বাঙালির দেখা পাওয়া কত অদ্ভুত সৌভাগ্যের পাঠক তা বলামাত্রই জানেন! আর ঠিক ততটাই অদ্ভুত প্রমদারঞ্জনের অভিজ্ঞতা সংবলিত কলম। কলম ধরেছিলেন তিনি সন্দেশ পত্রিকার ছোটদের কথা ভেবে। কিন্তু তাঁর এই মজার কলম বড়দের জন্যও মেলে ধরলো অজানার হাতছানি।

    কত বিচিত্র নামের কত স্বপ্ন-কল্পনা-মায়া জাগানো খ্যাত কিম্বা অখ্যাত স্থানে পা রেখেছেন প্রমদারঞ্জন। সেইসব নাম যেন এই বই পড়তে পড়তে নিমেষেই পাঠকের মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় সুদূরপাল্লায়। দেরাদুন-কলকাতা-ব্যাঙ্গালোরের আপিস ছাড়া ব্রহ্মদেশের শান স্টেট, কেংটুং রাজ্য, সালাউইন নদী, উত্তরপশ্চিম সীমান্তের বেলুচিস্থান, লুশাই পাহাড়, বন্নু আর টর্চি উপত্যকা, চীনহিল্‌স্‌ কিম্বা জৈন্তিয়া পাহাড়, আসামের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে লেখক দিন কাটিয়েছেন বাঘ-ভালুক-বুনো মোষ-শুয়োর-হরিণ-বুনো হাতির মোকাবিলা করে। এক একটা বাঘ শুধু নিজেই শিকার করেননি; শুনিয়েছেন বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘ নিয়ে প্রচলিত কাহিনী এবং স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস আর কিংবদন্তীর কথাও। এমনকি বাঘে মানুষের বাসন গুনে মাথাপিছু হিসেব করে পরের বার খেতে এসেছে এমন উদ্ভট পরিস্থিতি কিম্বা গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচারী বাঘের অন্যায় প্রতিহিংসাপরায়ণতার দুঃসাহসিক গল্পও বাদ যায়নি তাঁর বিবরণে। আর বাঘের গর্জনে মানুষের যে কি সাংঘাতিক দুরবস্থা হয় তার বিবরণও বারে বারে এসেছে এমন এক হাস্যরসের বাহন হয়ে যা কিনা একান্তই বাঙালির সংস্কৃতি। পাখিরাও কম যায়না! কি সব রোমাঞ্চকর পাখি মারার গল্প। অথচ একবার কিন্তু সারসের মতো বিশাল পাখি মেরেও খাওয়া গেলো না তার খুব শক্ত মাংসের সাংঘাতিক দুর্গন্ধের জন্য। প্রমদারঞ্জন অবাক হয়ে দেখলেন সাপ খায় এমনও মানুষ, খাদ্য-অখাদ্য-কুখাদ্য বিচার না-করা তাঁর সাঁওতালি খালাসীরাও এমনকি সেই মাংস গলাধঃকরণ করতে পারল না! আর এইসব পরিস্থিতিতে কখনো হাতে বন্দুক থাকে বনের পথে আর কখনো বা একেবারে নিরস্ত্র। কখনো বনের পশু তম্বি করে চলে যায় মানুষের উপর কখনো বা জিতে যায় মানুষের বুদ্ধি। তখন তো বনে বনে বেড়ানোর এমন বিলাসও ছিল না বাঙালির মজ্জাগত। আর টিকিট কেটে কিম্বা সপরিবারে চিড়িয়াখানায় বা অভয়ারণ্যে গিয়ে বাঘ দেখার কথা ভবিষ্যতের কাঁধের ওপর দূরবীন রেখেও কেউ কল্পনা করে উঠতে পারেননি।

    আর দেখেছেন দু চোখ ভরে মানুষ। মানুষের চরিত্রগত বর্ণ-বৈচিত্র্য তো সীমাহীন। বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন রাজ্যের ছোটছোট জনবসতির বৈশিষ্ট্য, মানুষের স্বভাব, আচরণ, খাদ্যাভাস, ভাষা, ভয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার, পেশা ও নেশার দুরন্ত রঙিন ছবির অ্যালবাম এই ছোট্ট বই বনের খবর। বিচিত্র জীবনের বিচিত্র মজা! নিজের সহকর্মীদের জীবন্ত যাপনচিত্রের পাশাপাশি কথায় কথায় এঁকেছেন কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ঈর্ষা, ভালোবাসা, স্বার্থপরতা কিম্বা প্রতিহিংসার ছবি। বেণী আর সুচিৎ চাকরের গল্প তো চিরকেলে হাসির খোরাক। ফুটকিয়া, সর্দার, তহশিলদার, গ্রাম প্রধান, লুশাই পাহাড়ের লুশাই বুড়ো আজকের জগতে এরা সকলেই হারিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি এদের মনোবৃত্তি--সেই অনুভব এই বইয়ের পাতায় পাতায়। একটা গল্প উদ্ধার না করলেই নয়! শানস্টেটে "ভিখারি নামে একজন লোক অনেকদিন আমার সঙ্গে ছিল। দু-পয়সা রোজগার করার সুযোগ পেলে সে ছাড়ত না। বদ্যি বল, রোজা বল, ভিখারি একাধারে সব। বদবুদ্ধিও যথেষ্ট ছিল তার পেটে।

    "একটি শান ছেলে প্রায়ই আমাদের ক্যাম্পে আসত। শানদের গোঁফ নেই, আর আমাদের খালাসিদের প্রায় সকলেরই গোঁফ আছে। তা দেখে শান ছেলেটির ভারি শখ হয়েছে তার গোঁফ হোক। সে কত অনুনয় বিনয় করে খালাসিদের জিগগেস করে, কী করলে তার গোঁফ গজাবে। ভিখারি তাকে বলল, ‘গোঁফ চেষ্টা করলেই হতে পারে, কিন্তু তাতে খরচ আছে।’ ছোকরা তো শুনে বড়ই খুশি, খরচ যতই লাগুক সে দেবে। তার গোঁফ হওয়া চাই-ই। তখন ভিখারি খুব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘পুজো করতে হবে। তাতে ফুল চাই ধূপ-ধুনো চাই, আর দুটো সাদা ধবধবে মোরগ আর চার সের চাল।’

    "সেই ছোকরার গোঁফের বড়ই দরকার, বলা মাত্রই সে সমস্ত জিনিস এনে হাজির করল। ভিখারিও নতুন উনুন তৈরি করে ভাত আর মোরগ চড়াতে একটুও দেরি করল না। যতক্ষণ রান্না হচ্ছিল, ততক্ষণ সে ধূপ-ধুনো নিয়ে বেশ জমকালো রকমের পুজো করল, বিড়-বিড় করে অনেক মন্ত্রও আওড়াল। তারপর সব খালাসি মিলে মোরগের ঝোল আর ভাত পেট ভরে খেয়ে, পরে সেই উনুনের কয়লা, রেড়ির তেল আর একটু চিনা কালি দিয়ে খাসা মলম তৈরি করে সেই শান ছোকরাকে বলল, ‘এই মলম দিয়ে বেশ করে গোঁফ এঁকে, নাকে মাথায় কাপড় জড়িয়ে রাত্রে শুয়ে থাকবে,সকালে উঠে দেখবে এয়া বড় গোঁফ হয়ে আছে। লেকিন্‌ খবরদার, একটুও যেন মুছে না যায়, তাহলে আর গোঁফ হবে না।”

    বলাই বাহুল্য সেই সরল সাদা ভালোমানুষ শান যুবকের ঘুমের ঘোরে মুছে যাওয়া গোঁফ আর কোনোদিনই গজাতে পায়নি!

    আর অদ্ভুতভাবে প্রমদারঞ্জনের সঙ্গে থাকত সরল কিন্তু নির্বোধ খালাসির দল। যাদের উপর রাগ করেও রাগ ধরে রাখা যায় না। তাদের কাণ্ডকারখানাও কিছু কম আকর্ষক নয়। হয় তারা শিকারের সময় বন্দুকে গুলির বদলে ‘ছিটা’ ভরে রেখে দিয়েছে, নয় ঠিক সময়ে বন্দুক আনেনি সঙ্গে, নয়তো ঠিক শিকারের সামনেই ‘শিকার শিকার বাবু মারো’ বলে চেঁচিয়ে শিকারের দফা রফা করে দিয়েছে। এমনি সব ঘটনার চরম নিদর্শন হল বাঘ দেখেও চিনতে না পারা। এক খালাসির পিছনে পিছনে শ্যাডো করে আসছিলো বাঘ আর সে বেচারা কখনো বাঘ দেখেনি তাই ভেবেছে অন্য কোনো জানোয়ার! লেখক বুঝতে পেরে সাবধান করতে গিয়ে বললেন, “আরে শের থা রে?” সাদাসিধে খালাসি তার উত্তর দিলো, “নহি হুজুর! শের হোতা তো হামকো খা ডাল্‌তা নহি?”!

    এমনি সব জমজমে গল্পের উপচে ওঠা ঝুলি হল বনের খবর। সেখানে বর্মিদের গ্রামে ‘ঙাপ্পি’ রান্নার গন্ধে লেখকের নাড়িভুঁড়ি পাকিয়ে ওঠা আর তার বদলে লুচি আর খিচুড়ির অসহ্য ‘দুর্গন্ধে’ বর্মীদের উলটে খাবার উগরে আসা গল্পের পাশেই আগুনের আঁচে ঝলসে উঠেছে ভয়ঙ্কর হিংস্র হাড়হিম করা ডাকাতদলের সঙ্গে ডাকাবুকো প্রমদারঞ্জনের বুদ্ধির টক্কর। ওয়াজির আর মালিকের (ডাকাত সর্দারের পদমর্যাদা) সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার স্পর্ধা তিনি পেয়েছিলেন বোধ করি ব্রিটিশ-সরকারী লোক হওয়ার দরুন। তবে ডাকাতের থেকে বাঘ ভালো। মনে রাখতে হবে এই লেখা ধারাবাহিক ভাবে যখন সন্দেশে প্রকাশিত হয়, বিখ্যাত শিকারী জিম করবেট তখনো লেখেননি তাঁর কুমায়ুন-রুদ্রপ্রয়াগ অঞ্চলের অভিজ্ঞতা (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জিম করবেট ডাকাত ধরতেও সহায়তা করেছিলেন একটা সময়ে তাঁর বন্ধু পুলিস কমিশনার ফ্রেডি ইয়াং-কে; দ্রঃ “বেহড় বাগী বন্দুক--‘তরুণ ভাদুড়ী’)। তবে প্রমদারঞ্জন পেশাদার শিকারী ছিলেন না। ছিলেন প্রখর দৃষ্টিশক্তি আর বিবেচনার আধার। তাই শিকার ভালোই করতেন। তাঁর বুকের তলায় ছিল পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। কত শতবার যে তিনি সাক্ষাৎ পেয়েছেন হিংস্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মৃত্যুদূত বাঘের এখন সত্যি সেসব অলীক পরণকথা! প্রমদারঞ্জনের লেখা জুড়ে মচমচে শুকনো পাতা ঝরার গন্ধ। সাধারণ বাঙালিজীবনের উত্তেজক কল্পনাতেও এমন মন উচাটন অভিজ্ঞতার স্বাদ পাওয়া সচরাচর সম্ভব হয় না। তার ওপর তিনি ছিলেন কলকাতায় মধ্যবিত্ত সংসারী বাঙালির নিত্য প্রতিবেশী, আপাদমস্তক সোজারকম সামাজিক মানুষ। কিন্তু তাঁর জীবনের ছুঁয়েছেনে তুলে আনা কাহিনীর অপূর্ব সাহিত্যিক প্রকাশ তো বাঙালির বই-ভাণ্ডারের এক সানন্দ প্রাপ্তি। এ যেন ঠিক আসলে গল্প হলেও সত্যি।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments