—তাহলে যাবেন নাকি?
— একবার যাবেন নাকি?
— সবাই তো যায়। সব্বাই ....
— চুপিচুপি। একা ....
— জীবনের কোনো – না – কোনোদিন। কোনো – না – কোনো সময়ে ...
— ওইঘরে। ওই অন্ধকারে ...
— নিজের সাধের আলোটি জ্বালিয়ে ....
— নিজের সেই মুখশ্রীটি দেখতে ....
— বিশ্বাস হচ্ছে না তো? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথাগুলো? তাহলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। বলতে হয় একেবারে গোড়া থেকেই —
বহুকাল আগের কথা। এক ছিলো আয়নার কারিগর। কাঁচের টুকরোর পিছনে নিপুণ হাতে ‘পারা’ লাগিয়ে তৈরী করতো নিখুঁত একেকটা আয়নার ফলক। তার হাতের তৈরী আয়নার চাহিদা ছিলো বিরাট। তাই তার উপার্জনও ছিলো যথেষ্ট। আর ছিলো স্ত্রী এবং বারো বছরের একটি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে এক সুখী পরিবার।
এতো সুখ কি কারো চিরকাল থাকে?
হঠাৎই একদিন রাত্রে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু ঘটলো তার। নিশ্চিন্ত সংসার পড়ে গেলো গভীর সংকটে। জমানো অর্থ শেষ হয়ে গেলো কদিন বাদেই। কারিগরের স্ত্রীকে বেরোতে হোলো কাজের খোঁজে। আর তার ছেলেটিকে হাতে তুলে নিতে হোলো কাঁচের ফলক। তার বাবার ব্যবসাটিকে কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটি দিয়ে তৈরী করতে চেষ্টা করলো একেকটি আয়নার ফলক।
এতটুকু ছোটো শিশুর দ্বারা কি তাই হয়?
এইভাবে বহুকষ্টে একটি আয়না বানানো হয়ে গেলে সে অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সেই আয়নাটির দিকে। সে বুঝতে পারলো যে তার হাতের আয়নায় যা কিছু দেখা যাচ্ছে তা সবই অস্পষ্ট। অর্থাৎ হয় নি। কিচ্ছু হয় নি। বেশ খানিকক্ষণ চুপটি করে বসে থেকে কি মনে করে আবার একটা কাঁচের ফলক হাতে তুলে নিলো সে। টপটপ করে ঝরে পড়লো তার চোখের জলের বড়ো বড়ো ফোঁটাগুলো ওই ধুলোপড়া কাচটার ঊপর।
পারদের চেয়েও ভারী ছিলো নাকি সেই চোখের জলের আস্তর?
এইবার শুরু করলো ও সাংঘাতিক পরিশ্রম। দিন নেই রাত নেই খাওয়া নেই ঘুম নেই — একের পর এক কাচের টুকরো নিয়ে একমনে পারা লাগিয়ে আয়না তৈরীর চেষ্টা করে যেতে লাগলো ক্ষ্যাপার মতো। শেষপর্যন্ত একদিন তৈরী হোলো সত্যিই একটি নিখুঁত আয়না। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও দেখলো নিজেকে। অনেকক্ষণ ধরে। কেমন যেন বুড়োটে মার্কা চেহারা হয়ে গেছে তার। সারা মুখে অজস্র অভিজ্ঞতার কাটাকুটির ছাপ।
তাহলে কি অনেককাল কেটে গেলো এই নিখুঁত আয়না বানাতে গিয়ে?
যাইহোক। এতদিনের পরিশ্রম সফল হোলো ওর। ওর হাতে তৈরী হতে লাগলো একটার পর একটা নিখুঁত আয়না। আর সে কথা ছড়িয়ে গেলো চারিদিকে। দূর দূর থেকে এসে গেলো অনেক খরিদ্দার। অর্থাৎ দেদার বিক্রিবাটা। আর এলো নামযশ—‘দুনিয়ার সেরা আয়না বানানোর কারিগর’। ও কিন্তু প্রতিটি আয়না বানানোর পর সেটির সামনে এসে অনেকক্ষণ ধরে নানাদিক থেকে খুঁটিয়ে দেখতো সেটিকে। আর নিজের মনেই বলতো — “এটাই সবচেয়ে সেরা – সবচেয়ে নিখুঁত আয়না – এর ভিতর দিয়ে যা কিছু দেখছি সবই তো মনে হচ্ছে সত্যিকারের জিনিস – সরাসরি দেখছি – আয়নায় দেখছি বলে মনে হচ্ছে না তো।”
এইভাবে একনাগাড়ে ঘাড়গুঁজে আয়না তৈরী করতে করতে ও কি কোনটা আসল আর কোনটা ছায়া তা গুলিয়ে ফেলছিলো?
এইসময় একবার মাঝরাতে ও স্বপ্ন দেখলো – অজস্র ছোটো বড়ো আয়নার মাঝখানে ও দাঁড়িয়ে আছে – নিজেই নিজেকে যেন ঘিরে রিয়েছে নানান কোণ থেকে – আর কেউ কোত্থাও নেই – ওর হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগলো – আর ঠিক তখনই ওর সামনে এসে দাঁড়ালো ওর বাবা — “ভয় পাস না - ভয় পাস না – এরা তো সব ছায়া”
ও বললো — “কক্ষনো না – এরা সবাই – প্রত্যেকে – হুবহু আমি – দেখছো না ?”
— “না রে খোকা – আয়নায় যা দেখা যায় তা সব ছায়া – সব মিথ্যে”
— “তাহলে?”
— “আয় – আমার সঙ্গে আয়"
— “কোথায়?”
ও সামনের দিকে এগোতে গিয়েই হঠাৎ যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো আর তারপর যেন হু হু করে তলিয়ে যেতে লাগলো কুচকুচে কালো অন্ধকারে
— “কী হোলো? কী হোলো আমার? আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না কেন? বাবা! ও বাবা!” — ও চিৎকার করে বলেছিলো। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো ওর।
এই স্বপ্নটা কি সত্যি হয়েছিলো ওর জীবনে?
এই স্বপ্নটা কিন্তু ও ভুলতে পারতো না কিছুতেই। মাঝে মাঝেই মনে হোতো ওর বাবার কথাগুলো — “সব ছায়া – সব মিথ্যে”। তখনই মনে হোতো – “সত্যিই তো – বাইরে থেকে যা কিছু দেখা যায় ততটুকু দেখানোই কি আয়নার শেষ কথা? সব ক্ষমতা?” এইসব ভাবনা মাথায় নিয়েই চলতো তার দিনরাত্তিরের কাজ। একদিন একটা প্রকাণ্ড আকারের ফরমায়েসী আয়না তৈরী শেষ করে ও অভ্যেসমতো এসে দাঁড়ালো সদ্য তৈরী আয়নাটার সামনে। মনে হোলো — “নাহ্। ঠিক হয় নি। কোথাও যেন কোনো খুঁত আছে।” কিন্তু খুঁতটা যে কি তা কিছুতেই ধরতে পারলো না। ফলে ওর মেজাজটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। জিনিসটা যে ওর নিজের হাতের তৈরী তা ভাবতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না ওর। আর তখনই আপনা থেকেই ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়লো ওই বিশাল আয়নাটা - ওর চোখের সামনেই।
আয়নার কি মন থাকে যে ওর মনের কথা বুঝে সে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলো এইভাবে?
ও হতভম্বের মতো তাকিয়ে দেখলো ব্যাপারটা। তারপর কি মনে করে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিলো ওই আয়নার একটা ভাঙা টুকরো। টুকরোটার ভিতর তাকিয়ে দেখে চমকে উঠলো ও। এতো হুবহু ওর মুখের ছায়া নয়! বরং ওর বাবার মুখের স্পষ্ট আদল! দূরের সবুজরঙের তরমুজটাকে ওই আয়নার টুকরোয় কেমন দেখায় দেখতে গিয়ে ও দেখলো তরমুজটার ভিতরের ঘন লালরঙের আভা কি আশ্চর্যভাবে ফুটে বেরোচ্ছে বাইরের খোসার সবুজ রঙকে যেন ভেদ করে!
তাহলে এটা কি কোনো জাদু আয়না ছিলো?
আয়নার টুকরোটাকে হাতে নিয়ে ও খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর কি মনে করে দৌড়ে গিয়ে আয়নাটা ধরলো তার বুড়ি মায়ের বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া ক্লান্ত মুখটার সামনে। আর তখনই দেখতে পেলো সেই আয়নায় জ্বলজ্বল করছে এক সতেজ সুন্দর মুখশ্রী! ব্যস্। এইবার ও নিশ্চিন্ত হোলো। নিশ্চিন্ত হোলো এই ভেবে যে এতদিনে ও এমন আয়না তৈরী করতে পেরেছে যা দেখিয়ে দেয় কারও অন্তরে কি আছে। সেটা কারো মুখ হোক কিংবা অন্য কিছু। ও ভাবলো — 'যে আয়না শুধু বাইরের চেহারার ছায়া দেখায় না – ভিতরের চেহারাটাও দেখিয়ে দেয় - তার দাম হবে অন্যরকম।'
তাহলে কী মূল্য পেলো ও এই আয়না বানিয়ে?
প্রথম আয়নাটা ও বিক্রি করেছিলো সেখানকার সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীকে বেশ চড়া দামে। আরো কয়েকজন হোমরাচোমরাও কিনলো ওই আয়না। ফলে ব্যবসা হোলো ভালোই। কিন্তু এরপরেই ঘটলো কয়েকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। ধনী ব্যবসায়ীটি ওই আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠেছিলেন। আয়নার ভিতর তাঁকে দেখাচ্ছিলো যেন একটা বীভৎস শকুন! রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি আছড়ে ভেঙে ফেললেন ওই আয়নাটিকে। শুধু উনি নন। যারা যারাই কিনেছিলো ওই আয়না তাদের সবাই – কেউ রাগে – কেউ দু:খে – কেউ ঘেন্নায় আর অবিশ্বাসে দূর করে দিলো নিজেদের সামনে থেকে ওই আয়নাগুলোকে।
এইভাবে বাতিল হওয়ার সময় ওই আয়নাগুলো কী ভাবতো নিজেদের সম্পর্কে?
এদিকে সমস্ত ব্যাপারটা হু হু করে রটে গেলো চারিদিকে। মারাত্মক বদনাম হয়ে গেলো ওর। ব্যবসা একেবারে শেষ হয়ে গেলো। নিজের চমৎকার জীবনে এতো বড়ো বিপদ ও নিজেই ডেকে আনলো এইভাবে। একদিন সকালে একগাদা বিক্রি না হওয়া আয়নার সামনে ও ঘোরাঘুরি করছিলো আন্মনে। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলো সেগুলোকে। আর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলছিলো — “কেউ চায় না কেউ চায় না নিজের ভিতরে কি আছে তা নিজের চোখে দেখতে।”
তখন ওই সার সার আয়নায় ওর মুখের ছায়াগুলো নানা দিক থেকে কি অদ্ভুতভাবে তাকিয়েছিলো তার দিকে?
তখনই হঠাৎ ওর মনে হোলো — ‘ব্যাপারটা যদি উল্টো করে দেখার চেষ্টা করা যায় তো কেমন হয়?’ সঙ্গে সঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো ওর মাথায়। আবার ও বসে পড়লো কাচের টুকরোগুলোকে নিয়ে। শুরু হোলো নতুন করে পরীক্ষা নিরীক্ষা। দিন-রাত এক করে মাথা গুঁজে পাগলের মতো একের পর এক আয়না তৈরী করে যেতে লাগলো। হঠাৎ একদিন ভোররাতে ও একটা ছোট্ট গোল আয়নার টুকরো নিয়ে চলে এলো ওর ঘুমন্ত মায়ের পাশে। তারপর ওই আয়নার টুকরোটা আস্তে করে চেপে ধরলো তাঁর কপালে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো তাঁর। আর তখনই ও ওই আয়নায় চোখ রেখে হৈ হৈ করে উঠলো — “পেরেছি। আমি পেরেছি।” এদিকে আয়নাটা তখন ওর হাত ফস্কে পড়ে কোথায় গড়িয়ে চলে গেলো কে জানে।
ওই ছোট্ট আয়নাটা কি তখন জানতে পেরেছিলো শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে?
ওই আয়নাটা ওর মায়ের কপালে বসিয়ে সেখানে চোখ রেখে ও দেখতে পেয়েছিলো একটি ঝকঝকে সুন্দর মুখ যার বিরাট বড়ো বড়ো চোখ দুটো যেন কোথায় কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে – সেই মুখখানি তার নিজের! অর্থাৎ এই সেই আয়না যা অন্য কারো কপালে বসিয়ে নিজেকে সেই আয়নায় দেখলেই দেখতে পাওয়া যায় সেই অন্যজন তাকে কিভাবে দেখে। অর্থাৎ অন্যজনে কাউকে কিভাবে দেখছে তা জানতে পারার আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার হয়ে গেলো! আর সেটাই ছিলো সেইসময়ে ওর জীবনের সবচেয়ে জরুরী জিনিস। তাই অনেক খুঁজে-পেতে বের করা হোলো সেই লুকিয়ে পড়া আয়নার টুকরোটাকে। এইবার সেটিকে নিয়ে ও চললো ওর সবচেয়ে আপনজনের কাছে।
আয়নাটা কি চেয়েছিলো এইভাবে ওর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনার সঙ্গী হতে?
সেই আপনজন অর্থাৎ ওর একান্ত ভালোবাসার মেয়েটির কাছে পৌঁছে অতি উৎসাহে ও তার কপালে রাখলো সেই আয়নাটা। যেমনটি করেছিলো ওর মায়ের বেলায়। আয়নায় এইভাবে নিজেকে কেমন দেখায় তা জানার জন্য ওর ধৈর্য্য আর ধরছিলো না যেন। কিন্তু ও শিউরে উঠলো ওই আয়নার টুকরোয় নিজেকে দেখে! কি কুৎসিত! কি কদাকার! আয়নার টুকরোটা হাতের মুঠোয় নিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো। তারপর কোনোক্রমে বেরিয়ে এলো মেয়েটির বাড়ি থেকে। ফেরার সময় আয়নাটাকে আছড়ে ফেললো রাস্তায়। আয়নাটা অটুট রইলো। কি মনে করে সেটাকে আবার কুড়িয়ে নিয়ে হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো। হাত চিরে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো আয়নাটা।
এইভাবে রক্তে ভিজে গিয়ে ওই আয়নার চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন হোলো?
বাড়ি ফিরে ও যেন কেমন একটা অদ্ভুত মানুষ হয়ে গেলো। একরাশ কাচের টুকরো নিয়ে বসে থাকতো। সেগুলোর কোনোটার গায়ে কখনো খানিকটা পারা লাগিয়ে ফেলে রেখে দিতো এখানে সেখানে। রোদে। জলে। অন্ধকার কোণে। কিংবা খোলা আকাশের নীচে। এইসময় এক ভীষণ ঝড়বৃষ্টির রাতে বিরাটভাবে বাজ পড়েছিলো ওর বাড়ির পিছনের গাছটায়। পরদিন সকালে বাজপড়া ঝলসানো গাছটার নীচে ও দেখতে পেলো পড়ে আছে সেই কবেকার রক্তমাখা আয়নার টুকরোটা। আর সেই আয়নার টুকরোয় দেখা যাচ্ছে একটা ভারী সুন্দর প্রজাপতি বসে আছে ঘন সবুজ পাতার ডগায়। ও চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো কোত্থাও কোনো প্রজাপতির চিহ্নমাত্র নেই। আয়নায় দেখা গাছের পাতাটা ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখলো সেখানে বসে আছে একটা শুঁয়োপোকা! শুঁয়ো পোকাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে খুব গভীরভাবে কিসব ভাবতে লাগলো ও।
এই শুঁয়োপোকা আর প্রজাপতির ধাঁধাঁ কি ও নিজের জন্য নিজেই তৈরী করলো শেষটায়?
অনেকক্ষণ এইভাবে বসে থাকার পর ও আয়নাটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো একটা বুনো ফুলের কুঁড়ির দিকে। আয়নায় দেখতে পেলো সেটাকে দেখাচ্ছে যেন একটা প্রকাণ্ড ফোটা ফুল। এইবার আয়নাটা হাতে নিয়ে ও পাগলের মতো একদৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লো। বহুদিন বাদে লোকালয়ের মধ্যে এলো ও। খানিকটা দূরে গিয়ে দেখলো একটা পুরোনো বাড়ির বারান্দায় একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ওর হাতের আয়নায় তাকেই দেখাচ্ছে যেন এক ঢাল কালো চুলে রাজকন্যার মতো রাঙা সুন্দরী। ও হঠাৎ আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকালো। তারপর যেন ভূতে পাওয়ার মতো চিৎকার করে বলে উঠলো — “পৃথিবীর সেরা আবিষ্কার আমার হাতে। যে কোনো কিছুর ভবিষ্যৎ রূপ দেখা যায় আমার এই আয়নায়”।
কিন্তু নিজের মুখটা কি ও দেখেছিলো তখন এই আয়নায়?
তখন হঠাৎই ওর মনে হোলো — “এই বার সময় এসেছে। সময় এসেছে এতদিনের দু:খ কষ্ট হেনস্থার হিসেব মিটিয়ে দেওয়ার। কারণ যেকোনো কিছুর ভবিষ্যৎ নির্ভুলভাবে দেখতে পাওয়ার জিনিস এখন হাতের মুঠোয়। অতএব – "অতএব এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী লোকটিই হোলো এই আয়নার প্রথম ক্রেতা। যথেষ্ট চড়া দামেই বিক্রী হোলো সেটা। ও নিশ্চিত হোলো এইভাবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ও ফিরে পাবে ওর হারিয়ে যাওয়া সমস্ত নাম–যশ–সম্মান। এদিকে এর দুদিন বাদেই ওর তলব এলো ওই সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকটির কাছ থেকে। ও যেন জানতোই যে এই ডাক আসবে।
কিন্তু কীভাবে তৈরী করেছিলো ও নিজেকে এর জন্য?
একদল সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকা লোকটি কোনো ভণিতা না করেই ওকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো — “ওই আয়নায় আমার ভবিষ্যৎ দেখা যাবে তাই না?” ও উত্তর দিলো — “শুধু আপনার কেন? সবার। প্রত্যেকের। যেই এসে দাঁড়াবে ওই আয়নার সামনে তখুনি — ওকে থামিয়ে দিয়ে লোকটি বলে উঠলো — “চমৎকার। তা তুমি নিজে ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছো তোমার ভবিষ্যৎ?” ও থতমত খেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই লোকটি বলে উঠলো — “এদিকে এসো – দেখবে এসো তোমার ভবিষ্যৎ।” বলেই ওর সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে বললো — “আয়নাটা নিয়ে আয় ওর সামনে।”
সেইসময় আয়নাটা কি পেরেছিলো ওর সত্যিকারের ভবিষ্যতের চেহারাটা দেখাতে?
তারপর হঠাৎ চিৎকার করে লোকটা বলে উঠলো ওর সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্যে — “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এটার চোখদুটো উপড়ে ফেলে দে এক্ষুনি। যাতে আর কোনোদিনও এইসব জিনিস বানাতে না পারে।” ওর কথা শেষ হতে না হতেই সেই সাঙ্গোপাঙ্গের দল হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর – আর নিমেষের মধ্যে ওর হাত পা বেঁধে ধারালো ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুবলে দিলো ওর চোখের মণিদুটো। “দেখছিস? দেখতে পাচ্ছিস তোর ভবিষ্য?” — বলে হো হো করে হেসেছিলো লোকটা। সেই সঙ্গে মহা উল্লাসে হেসেছিলো ওর সঙ্গের সব লোকজন। ও তখন দেখতে পাচ্ছিলো ওর বাবাকে। শুনতে পাচ্ছিলো — “আয়। খোকা আমার সঙ্গে আয়।” যন্ত্রণায় হিম হয়ে যেতে যেতে ও নিজেই নিজেকে বলেছিলো — “এটাই সব শেষ নয়।”
এরপর ওই অন্ধলোকটার আর আয়না বানানো তো দূরের কথা – বেঁচে থাকাই কি সম্ভব?
এরপর কতোকাল কেটে যাবে কে জানে – এক মহা দুর্যোগের রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে চারদিক – এর মাঝে দুজন – একটি ছেলে ও একটি মেয়ে – সম্ভবত তারা পরস্পর খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু – একসঙ্গে জীবনের পথে চলতে গিয়ে ভাগ্যের হাতে বিধ্বস্ত হয়ে কিভাবে যেন এসে পড়বে একটা পোড়োবাড়ির মধ্যে – যেখানে জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই – চারিদিকে অজস্র ভাঙাচোরা জিনিসের স্তূপ – আর নিকষকালো অন্ধকার – তবু তা বাইরের প্রকৃতির আক্রোশের চাইতে ভালো – তাই তারা ঠোক্কর খেয়ে এগোতে এগোতে এসে পড়বে একটা বড়ো ঘরে – সে ঘরে অন্ধকার যেন একটু কম - কোথায় যেন একটা আলো জ্বলবে টিমটিম করে – ওরা এসে দাঁড়াবে একটা বিরাট আয়নার সামনে – আর তখনই দেখতে পাবে ওই আয়নায় দেখা যাচ্ছে এক জোড়া নবদম্পতির মূর্তি – অর্থাৎ তাদের স্বপ্নসাধ্য ছবিটি – ওরা অবাক হয়ে ওই আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকবে – তারপর অস্ফূটে বলে উঠবে – ‘একি! এতো আমরা! যেমনটি চেয়েছিলাম!’ কথাগুলো বলার সাথেসাথেই ঘরের টিমটিমে আলোটা যেন হঠাৎ আরো কমতে থাকবে – ঘরটা ঢেকে যাবে গাঢ় অন্ধকারে – ওরা অজানা আতঙ্কে পরস্পরের হাত শক্ত করে চেপে ধরবে – কিন্তু একটু বাদেই একটা হালকা নরম আলো এসে ঘরটাকে যেন ভরিয়ে দেবে – ওরা অবাক হয়ে দেখবে তাদের সামনের আয়নাটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে হয়ে গেছে একটা বিশাল স্বচ্ছ কাচ – যার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাচের ওপারে একটা আস্ত কঙ্কাল – স্থির বসে আছে – ওদের মুখোমুখি – আয়নাকে ধরে – আঁতকে উঠে ওরা দুদ্দাড় করে বেরিয়ে পড়বে ওই পোড়োবাড়িটার থেকে – আর বাইরে এসেই বুঝতে পারবে দুর্যোগ কেটে গেছে – আকাশে দিনের প্রথম আলোর ছোঁয়া।
ওরা দুজনেই বাইরে এসে স্বস্তির শ্বাস নেবে।
ছেলেটি বলবে – “কি সাংঘাতিক!”
মেয়েটি বলেবে – “কি রকম যক্ষের মতো বসে আছে।”
ছেলেটি উত্তর দেবে – “হ্যাঁ। ওই আয়নাটাকে নিয়ে।”
মেয়েটি ম্লান হেসে বলবে – “আয়না নয় কাচ। আয়নাটা আমাদের মনের ভুল।”
এই কথা বলার সময় ওরা কিন্তু জানতেও পারবে না যে আয়নাটা আসলে চলে গেছে ওদের প্রত্যেকের কাছে। আলাদা আলাদা ভাবে। ওদের অজান্তে। ওই ঘরের আবছায়া থেকে ওদের মনের আঁধারভুবনে। ওদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। নির্জনে।
শুধু ওদের নয়। এদের থেকে যে মানুষই যাবে ওই অন্ধকারে – ওই বাড়িতে – ওই ঘরে – গিয়ে দাঁড়াবে ওই আয়নাটার সামনে – তখন তার অজান্তেই – তার মনের অতলে ...
— তা আপনি কখনো যান নি বুঝি? ....
— ওই অন্ধকারে? ....
— ওই ঘরটায়? ....
— দেখেন নি কখনো ওই আয়নায়? ....
— একান্তে? ....
— সযত্নে? ....
— নিজের অধরা মাধুরীকে? ....
— তাহলে ....
(গল্পটির প্রথম অংশটি Primo Levi-র 'The Mirror Maker' গল্পের দ্বারা প্রাণিত)