• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬২ | মার্চ ২০১৬ | গল্প
    Share
  • ব্ল্যাকমেল : আইভি চট্টোপাধ্যায়


    এক : ক্যানভাস

    নেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে। কেউ তুলছে না। নিশ্চয় ছবি আঁকছে মুকুল। ছবি আঁকার সময় এমনই অন্যমনস্ক তন্ময় থাকে ও।

    খবরটা না নিতে পারলে সুপ্রিয়াদি রাগ করবে,'সামান্য একটা খবর আনতে পারলি না? লোকটার নাম চাই শুধু। তোকে খুব বিশ্বাস করে মুকুল, তুই জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।।'

    তা করে। বিশ্বাস করে। জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলে দেবে। আসলে খবরটা শুনে ধাক্কা খেয়েছে সৌম্যই। দু’বছর ধরে পরিমলদার পেছনে পড়ে আছে সুপ্রিয়াদি। শিল্পীসংসদের সভাগুলোয় নিয়মিত হাজিরা, অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, নানা কমিটিতে জায়গা করে ফেলা, টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে সান্ধ্য-বিতর্কসভায় নিয়মিত মুখ দেখানো। ঠিক ঠিক এগিয়েছে। শিল্পীসংসদের দলের সঙ্গে সরকারী ব্যবস্থায় বিশেষ আমন্ত্রণে প্যারিস যাচ্ছে এবার সুপ্রিয়াদি, মোটামুটি সবাই জানত। প্যারিস। শিল্পী মাত্রের পীঠস্থান।

    'আমি এবার যাবই। অ্যাসোসিয়েশনের লিস্টেও নাম আছে আমার। ভাবিস না সৌম্য, তোর কথাও মাথায় আছে আমার। ছ’মাসের মধ্যে স্পেশাল টিম যাচ্ছে লন্ডন, তোর কথা বলা আছে পরিমলদাকে।'

    কাল ফোন করেছিল সুপ্রিয়াদি, 'খবর শুনেছিস সৌম্য? এতদিন ধরে লেগে আছি, এখন শুনছি মুকুলের নামও লিস্টে আছে। মুকুল! কোনো কমিটিতে নেই, কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না, দেমাক নিয়ে বসে আছে। কাকে ধরে ব্যাপারটা ম্যানেজ করল, খবর নে তো।'

    সৌম্যও কম অবাক হয় নি। শিল্পীসংসদের দলের সঙ্গে প্যারিস যাচ্ছে মুকুল! কি এমন আহামরি আঁকে মেয়েটা! কি করে, কাকে ধরে ম্যানেজ করল! কার সুপারিশ! শিল্পীসংসদের সভাগুলোয় কোনোদিন যায় না মুকুল। অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং-এ থাকে না। বিশেষ বিশেষ সময়ে মন্ত্রীর ডাকে যে মিছিলগুলোয় সবাই হাঁটে, সেখানেও দেখা যায় না। টিভিতে তো নয়ই। তাহলে? ঠিকই বলে সুপ্রিয়াদি, যেমন সরল সরল ভাব মেখে থাকে মুকুল আদতে তেমন নয়। রীতিমতো ক্যালি আছে। চুপিচুপি নিজের কাজ বগিয়ে নেবার ক্যালি। সরল ভাব দেখানোটা স্টাইল। কারো সঙ্গে মেশে না কেন,তার একটা ব্যাখ্যাও আছে। সুপ্রিয়াদিই বলছিল সেদিন, মুকুলের বর বড় চাকরি করে বলে এত দেমাক।

    হতেও পারে। সৌম্য নিজেও দেখেছে, কত লোকের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট ওদের। কেমন বঙ্গসম্মেলন ঘুরে এল। নাকি ওদেশ থেকেই কেউ নিমন্ত্রণ করেছে, স্পনসর করেছে। আজকাল ইন্টারনেটে মুকুলের ছবি থাকে, বিক্রী হয়। বরের ঘ্যামা চাকরি, পরমব্রতদার মতো সলিড গুরু। স্বামী আইআইটি, আবার আই-টি। বউয়ের কেমন চমত্কার ওয়েবসাইট বানিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেটে মুকুলের ছবি থাকবে না তো কি এই সৌম্য বসুর ছবি থাকবে?

    মুকুল সান্যালের নামের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছিল একটু একটু। গত বছর পর পর দু’টো প্রদর্শনী হল মুকুলের। সুবর্ণ বিদিশা মুকুল ভিক্টর আসলাম। পাঁচ শিল্পীর ছবির প্রদর্শনী। অ্যাকাডেমিতে। তারপর শীতের সময় মুকুলের একক প্রদর্শনী। দুবারই নানা পত্রিকায়, খবরের কাগজে রিভিউ। পরমব্রতদার ছাত্রী বলে কথা। নাম যশ অর্থ, ব্রাশ-তুলির সঙ্গে সঙ্গে কোন দড়িটা ধরে কখন টান দিতে হবে, গুরুই হাত ধরে শিখিয়ে দেবে মুকুলকে।

    একটু চেষ্টা করতেই আলাপ হয়েছে। আলাপের সূত্র ধরে বাড়ির বৈঠকখানা পর্যন্ত যাতায়াত শুরু হয়েছে। মাথামোটা বরটা কিছু বোঝেই না। মুখে একটা বিগলিত হাসি দিয়ে 'সুমিতদা’ 'সুমিতদা’ করে ব্যাটাকে পটিয়ে ফেলেছে। বরটা ছবি বোঝে না। সৌম্য টের পেয়েছে, সে নিয়ে মেয়েটার প্রাণে ব্যথা। ছবি নিয়ে আলোচনা খায় বেশ। ভেবেছিল, একটু প্রেম প্রেম খেলা করে ব্যাপারটা জমিয়ে নেবে। কিছুতেই কিছু না। সৌম্যকে পাত্তাই দেয় না। বুড়ো ঘুঘুর সঙ্গেই একটা কিছু আছে নিশ্চয়। আরে, কিছুই না থাকলে বাতাসে কথা রটে!

    সুপ্রিয়াদি একটা বিশেষ কাজ দিয়েছে এবার, 'কাজটা যদি করতে পারিস সৌম্য, আগামী বছর তোর বিদেশ যাওয়া বাঁধা। একক প্রদর্শনী, চিত্রকূট গ্যালারিতে ... তোর সামনেই সেদিন কথা বললাম কাজলদার সঙ্গে, দেখলি তো? সব ক’টা মিডিয়াকে ডাকব, বুঝলি? এ বছর আমি শিল্পীসংসদের সেক্রেটারি হচ্ছি। এবারের ট্যুরটা হলেই। সব ঠিক হয়ে আছে, শুধু মনোতোষদার সঙ্গে একটু জমিয়ে নিতে হবে। সাধে কি এই ট্যুরটায় যেতে চাইছি! মনোতোষদাকে একা পাব, প্যারাসাইটগুলো কেউ থাকবে না সঙ্গে। বিশেষত ওই রূপা মেয়েটা। ওহ, অসহ্য ন্যাকা একটা মেয়ে।’

    জানে সৌম্য। সুপ্রিয়াদির বন্দীগ্রাম-সিরিজের ছবিগুলো দারুণ হিট। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মহারাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকেও পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে। সুপ্রিয়াদির সঙ্গে থাকলে আখেরে লাভ আছে। যে যা-ই বলুক, গোষ্ঠীর সঙ্গে থাকার কিছু সুফল আছেই।

    অথচ এই মুকুল পাবলিকটার কথা যদি শোনো!

    ইচ্ছে করে সুপ্রিয়াদির কথা তুলেছিল সৌম্য, 'শিল্পীর দায়বদ্ধতা কাকে বলে, তা দেখালেন বটে সুপ্রিয়াদি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। সুপ্রিয়াদির বন্দীগ্রাম-সিরিজের ছবিগুলো দেখেছ মুকুল? কত প্রশংসা, কত প্রচার। কাগজে কাগজে রিভিউ। সব্বাই দারুণ প্রশংসা করছে।'

    মেয়েটাকে একটু তাতিয়ে দিতে চেয়েছিল। এতদিন ধরে দেখছে না সৌম্য? এই লাইনে সুযোগ পেলেই একে অন্যের সমালোচনা করে। ভাবখানা এমন, আমিই বিশ্বসেরা। বাকিরা কেউ আমার নখের যোগ্য নয়। স্মিত হাসি নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী দেখল, পিঠ চাপড়ে কত প্রশংসার কথা বলল। বাইরে বেরিয়েই অন্তত একশ’ খুঁত ধরবে। এসব জানা আছে সৌম্যর। তাতিয়ে দাও একটু, উত্তেজিত মানুষ অনেক কথা বলে ফেলবে।

    সেদিকে গেলই না মুকুল। অদ্ভুত এক তর্ক জুড়ল, 'ওগুলো কি সত্যিই ছবি? শুধুই লাল রঙের ব্যবহারে ছবি হয়? হয় লাল, নয় কালো। নইলে ধূসর নিঝুম ফ্যাকাসে। সত্যিই পৃথিবীতে আর রঙ নেই? সত্যিই ওই ছবিগুলো সমাজের ছবি? তুমি নিজে তাই মনে করো?’

    তারপর নানা তথ্য দিয়ে দিয়ে তর্ক। ছবি নিয়ে, সময় নিয়ে। যুদ্ধের সময়ের ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ছবির সঙ্গে তুলনা।

    সৌম্যর মাথায় অত কথা ঢোকে নি। এইসব পাবলিক নিয়েই মুশকিল।

    আরে বাবা, সমাজ বদলাচ্ছে। এখন বাজারের কথা ভাবতে হবে। শিল্প হল এক পণ্য। বাজারে যা চলবে, তাই তো শিল্পে দেখাতে হবে। তুমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে না-ই বা কেন? সময়ের সঙ্গে চলতে না পারলে কেউ মনে রাখবে না। তুমি তাকে ছবি বলে না চালাতে চাইলেই হবে?

    সেদিনও তো পিনাকীদাদের আড্ডায় কথা হচ্ছিল এই নিয়ে। আধুনিকতা আনতে হবে ছবিতেও। নতুনত্ব চাই, এক্সপেরিমেণ্ট চাই। ফ্লেক্সিবল না হলে চলে? পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে, সমাজ বদলে বদলে অচেনা হয়ে গেল, আর এ মেয়েটা অনড় হয়ে থাকবে?

    নাকি এসব কথাই ওর আকর্ষণ! পিনাকীদা বেশ হেসে হেসে বলেছে সেদিন, 'সুন্দরী মেয়েদের সব জায়গাতেই সুবিধে। বুড়োটা ঘায়েল হয়েছে ওই অস্ত্রে। সব ফোরামে, সব ইন্টারভিউয়ে, সব সভায় বুড়ো মাল মুকুলকে প্রোজেক্ট করে। হাইলাইট করে।'

    'বুড়ো মাল’ মানে পরমব্রতদা।

    আড্ডার সবাই খুব হেসেছে। কাজলদা শ্রেয়া স্বপন। মুকুলকে নিয়ে সবার ক্ষোভ। সুপ্রিয়াদিও হাসতে হাসতেই বলেছে, 'খুঁজে বার কর সৌম্য। পিনাকী ঠিক বলেছে। বুড়োটার সঙ্গে মুকুলের দু’একটা কথার নমুনা বলে দিস শুধু। তারপর দ্যাখ, আমি কি ব্যবস্থা করি।'

    মুকুলের সঙ্গে সুপ্রিয়াদির পুরোনো ব্যথার সম্পর্ক। সেই আর্ট কলেজ থেকে ক্রমাগত প্রচার পেয়েছে মুকুল। পরমব্রতদা সহায়। আর বিয়ের পর তো বরের স্ট্যাটাসের সুবাদে রমরমা। ক্যালকাটা ক্লাবে পর্যন্ত অবাধ যাতায়াত।

    ক’দিন আগে একটা 'ব্যবস্থা’ করেছিল সুপ্রিয়াদি। তার ফল হয়েছে এই যে, পরমব্রতদার বউ ফোন করেছিল মুকুলের বরকে। ফোন করে বলেছে, মুকুলের জন্যে তাঁদের সংসারে অশান্তি, মুকুলকে প্রচার করার জন্যে পরমব্রতদা নিজের যে শক্তিক্ষয় করেন, তাতে তাঁর নিজের এবং পরিবারের ক্ষতি হচ্ছে। মাথামোটা বরটা বেশ দু’চার কথা শুনিয়েছে মুকুলকে। কিছু তো আছেই, নইলে এমন রটে কেন!

    মুকুলের কাছেই সব শুনেছে সৌম্য। পেটের মধ্যে হাসি পাক দিয়ে উঠেছে, তবু গম্ভীর মুখে বসে বসে সব শুনেছে। কাঁদো কাঁদো মুখে মুকুল যখন বলছিল, 'জানো সৌম্য, যে কোনো মেয়ের ... সে যে বয়সের, যে স্ট্যাচার-এরই হোক না কেন ... যে কোনো মেয়ের ক্ষতি করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল তাকে দুশ্চরিত্র প্রচার করা। প্রমাণ করার কোনো দায় নেই, কথাটা হাটের মাঝে ছুঁড়ে দিলেই হল' ... তখন একটু খারাপও লেগেছিল।

    কিন্তু এই ঘটনা থেকেই একটা আইডিয়া। মেয়েটার দুর্বলতার হদিশ পাওয়া গেছে। সুপ্রিয়াদিকে বলেছে আইডিয়াটা। হেসে সৌম্যর থুতনি নেড়ে দিয়েছে সুপ্রিয়াদি, 'বেশ বুদ্ধি আছে ছোঁড়ার।'

    দুই : তুলি

    নেকক্ষণ ধরে বাজছিল ফোনটা। লালের সঙ্গে হলুদ মিলিয়ে তার সঙ্গে একটু সোনালি রঙ মিশিয়ে নতুন একটা রঙ তৈরি করছিল মুকুল। ফোনের আওয়াজটা কানে আসছিল দূরের মন্দিরের ঘন্টার শব্দের মতো। এইরকমই হয় ওর। কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না। আওয়াজটা থেমে গেল যখন, তখন হঠাৎ বুঝল।

    ইসস! কার ফোন কে জানে। পরমব্রতদার ফোন আসার কথা। সুমিতের ফোন হতে পারে। সুমিতের অফিসের কারো হবে না অবশ্য, তারা সুমিতের মোবাইলে করবে। মাযের ফোন ছিল না তো? কিংবা রুমকি ঝুমকি কারো? পাগলা সৌম্যটাও হতে পারে।

    এই রে! সৌম্যই বোধহয়। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ফেলল মুকুল। আজই তো বুধবার। দিল্লী থেকে ফেরার কথা সৌম্যর।

    এবার সর্বভারতীয় ছবির প্রদর্শনী দিল্লীতে। প্রবীণ শিল্পীদের সঙ্গে বেশ কিছু নবীন শিল্পী। মোট ঊনষাট জনের ছবি। টিভিতে রাষ্ট্রপতির প্রদর্শনী উদ্বোধন দেখিয়েছে। প্রদর্শনীতে অবশ্য সৌম্যর ছবি নেই। কিন্তু ওখানে একই সঙ্গে চলবে ওয়ার্কশপ, সেমিনার। ওয়ার্কশপের জন্যে ডাক পেয়েছে সৌম্য। মহারাষ্ট্র থেকে আসছে বিশাল রাজে। বিশাল আর সৌম্যর যৌথ ওয়ার্কশপ। খুব প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার।

    কি করে যে ভুলে গেল! সৌম্য ফিরে ফোন করবেই। এবার ছেলের অভিমান ভাঙাতে যে কত সময় লাগবে!

    'জানি জানি। তোমার কত্ত ফ্যান! সৌম্য বসুর মতো এলেবেলে একজনের ফোন ধরার সময় কোথায়!’

    হেসে ফেলল নিজের মনেই। পাগলা! এই ছেলেমানুষির জন্যেই সৌম্যর কাছে কোনো আড়াল রাখতে ইচ্ছে করে না। মুকুলের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট মুকুল বেরিয়ে উত্তর দেয়, 'তা তো বটেই। সারাদিন ফোন আর ফোন। ফ্যানের সংখ্যা রোজ বাড়ছে। কি করি বলো তো!’

    'তা আর হবে না! একে আর্টিস্ট তায় সুন্দরী। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বেস্ট আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পাবে তুমি। মুকুলজী, আপ কে সুন্দরতা কা রাজ ক্যা হ্যায়?’ দুষ্টু হাসবে পাজি ছেলে তখন, 'ক’দিন পর তোমার ইন্টারভিউ নিতে আসতে হবে তো, তাই রিহার্সাল দিচ্ছি।' তারপরই গম্ভীর হয়ে বলবে, 'আর এই যে একজন তোমায় সর্বক্ষণ এত স্তুতি করছি, সে বেচারার দিকে নজরই দাও না। আজও এসেছিল তোমার বুড়ো ভক্ত? নাকি তুমিই গেছিলে? উফফ! কি যে দেখলে বুড়োটার মধ্যে!’

    বুড়ো ভক্ত মানে পরমব্রতদা। নিজে পরমব্রতদাকে 'গুরু’ বলে ডাকে। এদিকে পেছনে এমন সব কথা বলে ফাজিল ছেলে, রাগবে কি হাসবে বুঝে উঠতে পারে না মুকুল।

    আর্ট কলেজের ছাত্র। মুকুলেরই মতো। পরমব্রতদার কাছে শিক্ষার হাতেখড়ি দু’জনেরই। অবশ্য ছেলেটাকে কলেজে কোনোদিন দেখেই নি। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে পরমব্রতদার ছবির প্রদর্শনীতে প্রথম দেখা। আলাপ করিয়েছিলেন, 'এই ছেলেটা, জাত আর্টিস্ট। বুঝলা? প্রচুর সম্ভাবনা আছে।' পরমব্রতদার যেমন স্বভাব, নাম ধাম কিছুই বলবেন না। আর্টিস্ট কিনা এই তাঁর কাছে মানুষের পরিচয়। কলেজে পড়ার সময় একবার লোকাল ট্রেনে চেপে এক অখ্যাত নদীর তীরে যাওয়া হয়েছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই বসে পড়েছিল রঙ তুলি কাগজ নিয়ে। একটা মেঠো ছেলেকে দু’হাতে জড়িয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন পরমব্রতদা, 'ছেলেটা জাত শিল্পী, বুঝলা? দ্যাখো, এই কাঠের টুকরোটায় কেমন ছবি এঁকেছে।'

    শুভময়, এখন প্রতিষ্ঠিত নামী শিল্পী হয়েছে, সেই শুভময়কে বলেছিলেন, 'ছবিটায় স্পেস কম্পোজিশন দেখছ? ভালো করে দ্যাখো, তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারবে। এই দ্যাখো, কোথায় কতটা জমি ছাড়বে, সে ব্যাপারে সংশয় নেই। অথচ আলোছায়ার রঙ বদল আনতে পেরেছে কেমন। আয়, তোরা সবাই আয়। দ্যাখ, এই লাইনগুলো কেমন স্পষ্ট ভারি করে টেনেছে। না শিখেই এমন! জাত শিল্পী।'

    সৌম্য নিজেই নাম বলেছিল, সাত বছরের জুনিয়র ছিল কলেজে। 'আপনাকে চিনি মুকুল, আপনার ছবি আমার কাছে আছে। অবন হলে আপনার এগজিবিশন ছিল শুনেছিলাম, হল না কেন বলুন তো? আমি ভেবে রেখেছিলাম, সেদিন নিজে থেকেই আলাপ করে নেব।'

    খুব পাকা ছেলে তো! সাত বছরের জুনিয়র, অথচ প্রথমেই 'মুকুল’ ডাক। মুকুলদি টুকুলদি কিচ্ছু নয়!

    আলাপের সেই শুরু। তারপর নানা প্রদর্শনীতে দেখা, যেচে নিমন্ত্রণ নিয়ে বাড়িতে এসে সুমিতের সঙ্গে আলাপ। এখন তো এ বাড়ির নিত্য অতিথি। সুমিতের সঙ্গে জোর আড্ডা। রাজনীতি সমাজনীতির কচকচি। সে সময় ছবি নিয়ে কথাই বলে না। সুমিত অবশ্য ছবি নিয়ে আগ্রহী নয়। পরিষ্কার বলে, 'ও আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়। তুমি আঁকো, আমার ভালো লাগে। তোমার ইচ্ছে, তোমার শখ। আমি ও সব বুঝি না।'

    বোঝো না, তবে আর্ট কলেজের পাশ করা মেয়েকে বিয়ে করা কেন বাপু! দেখে শুনে বিয়েটা দিয়েছিলেন দু’পক্ষের বাবা মা। প্রথম পরিচয়ের দিনে তো আর্ট নিয়ে, ছবি নিয়ে দিব্যি কথা বলেছিল সুমিত।

    পাশ করার পর অ্যাকাডেমির সামনে বসে থাকার দিন তখন। বাবা-মা দুজনেই চেয়েছিলেন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায় না থেকে বিয়েটা করে ফেলুক মুকুল। তাঁরা অন্তত নিশ্চিন্ত হন। আর্টিস্ট না হোক, আর্টের সমঝদার ছেলে না হলে বিয়ে হবে না, এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন। শান্ত মুকুল কোনোদিনই অবাধ্য সন্তান নয়। সুমিতের সঙ্গে কথা বলেও ভালো লেগেছিল। বিয়ে ঠিক হবার পর অন্তত এক বছর মেলামেশা, মন জানাজানি। অ্যাকাডেমির সামনেই দেখা হত রোজ। মুকুলদের কষ্ট, জীবিকা-উপার্জনের লড়াইগুলো সুমিতের জানা।

    মুকুল রুচিরা সুপ্রিয়া বিনয় প্রকাশ ভাস্কর, বন্ধুরা সবাই সারাদিনে একবার এসে অ্যাকাডেমির সামনেটায় বসত। শুভময় পাশ করে কমার্শিয়াল আর্টিস্টের চাকরি নিয়ে দিল্লী চলে গেল। ভাস্কর আর রুচিরা বিয়ে করল, ভাস্কর একটা ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে নিল। অ্যাকাডেমির আড্ডায় ভাস্কর রোজ আসত না আর, রুচিরা আসত।

    আড্ডা ছাড়া কি! কটাই বা কাজ পাওয়া যেত তখন! বিখ্যাত চিত্রকরদের ছবির নকল করার কাজও করেছে সে সময়। ছবিপিছু চার পাঁচশ’ টাকা মাত্র।

    আজকাল নাকি দুই আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই ছবিগুলো বিক্রী হত ছ’হাজার থেকে পঁচিশ হাজার টাকায়। অথচ আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা নামমাত্র টাকায় নিজেদের দক্ষতা বিক্রী করতে বাধ্য।

    মিডিয়ামটা অয়েল হলে এক একটা ছবি করতে সময় লাগে কম করেও কুড়ি পঁচিশ দিন। বর্ষাকাল হলে আরো বেশি। সুপ্রিয়া এইজন্যেই অ্যাক্রিলিক পেণ্টের কাজগুলো বেশি করে নিত। সাতদিনে কাজ শেষ, হাতে গরম গরম টাকা।

    অন্য শিল্পীর আঁকা ছবি কপি করা, এ কাজে তৃপ্তি কোথায়! দেখে দেখে স্কেচ করে দাও, ছবির সাইজ বড় হলে রঙের ব্যবহার একরকম ... ছোট হলে আরেকরকম। সেইটা মাথায় রাখো। ব্যস হয়ে গেল।

    এসব ছবি যাঁরা কেনেন, তাঁরা ছবি বোঝেন না। পিকাসোর ছবি, দালির ছবি চাই ড্রয়িংরুম সাজাতে। অফিসের কনফারেন্স রুম, কিংবা নিজের ব্যক্তিগত কেবিন। নকল হলেই বা। দেয়াল জুড়ে একখান রঙিন আভা থাকলেই হল। সে অ্যাবস্ট্রাক্ট হোক, কিংবা পোর্ট্রেট। কিচ্ছু যায় আসে না। ছবির রেপ্লিকা হলেই বা ক্ষতি কি!

    আর আজকাল তো কম্পিউটারে গ্রিড ফেলে ফেলে ছবির রেপ্লিকেশন হচ্ছে। আর্টিস্ট ছাড়াও যে কেউ করে দিচ্ছে। কম্পিউটারে অটোক্যাড ডিজাইন শিখে নিলেই হল। ম্যাথামেটিকাল ক্যালকুলেশন। হাসি পায় মুকুলের। 'আর্ট’, 'আর্টিস্ট’ এসব শব্দের পরিভাষাই বদলে গেল।

    এই তো কদিন আগে 'শ্রী গোবিন্দ বিদ্যার্থী সম্মান’ অনুষ্ঠানে এসে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন বর্ষীয়ান শিল্পী অনুভা গুণাকর। আজকাল নাকি প্রোজেক্টর দিয়ে ক্যানভাসে ছবির ইমেজ ফেলে একের পর এক নকল ছবি তৈরি হচ্ছে। মহারাষ্ট্র উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ সর্বত্র রমরমিয়ে চলছে এ ব্যবসা।

    'শিল্পের শুদ্ধতায় আর বিশ্বাস নেই মানুষের,’ বলেছিলেন অনুভা, 'আর্ট কলেজের ছাত্রদের বছর বছর এই স্মৃতি পুরস্কারের মূল্য কি!’

    বুকের মধ্যেটা ভারি হয়ে আসে এসব ভাবনায়।

    তিন : টেকনিক

    প্ল্যানমাফিক মুকুল সান্যালের সঙ্গে আলাপ সারা। 'আলাপের পর এবার প্রলাপ পর্ব,’ সুপ্রিয়াদির বাড়িতে আড্ডায় সেদিন বলেছে রূপা। আর্ট কলেজের এক ব্যাচের বন্ধু, ক’মাস আগেও সৌম্য দেখেছে, গগনেন্দ্র চিত্রশালায় মুকুলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছে রূপা। সুপ্রিয়াদির সঙ্গে এমন জোট বাঁধল কেন কে জানে। প্রচারের লোভ! অ্যাওয়ার্ডের চাহিদা! নাকি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার নেশা!

    বাঙালি কৃষ্টি, বাঙালি সংস্কৃতি এখন ফ্যাশন। শিল্পী সাহিত্যিক গায়ক অভিনেতারা সবাই নানা দলের অ্যাম্বাসাডর। লিস্টে সুপ্রিয়াদির নাম সবার আগে। সম্প্রতি একটা মিডিয়া হাউসের অ্যাম্বাসাডর হয়েছে। ঠিকঠাক খেললে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যসভার সাংসদ হচ্ছেই। রূপা একা নয়, সুপ্রিয়াদির চারপাশে এখন অনেক ঝিকমিকে ঝলকানি।

    তবে কথাটা মন্দ বলে নি রূপা। প্রলাপই বটে। 'আদর্শ’, 'শিল্প’, 'শিল্পীর অভিমান’, 'নিজের জন্যে সৃষ্টি' ... মান্ধাতা আমলের ধারণা আর মূল্যবোধ নিয়ে প্রলাপ বকে মুকুল সান্যাল। সমাজের সবটাই নাকি নিচের দিকে বয়ে চলেছে। মানুষের মাত্রাতিরিক্ত লোভ, অহঙ্কার, বিপুল অসংযম, অনর্থক কথার চাষ, অসম্ভব পণ্যমনস্কতা, অসম প্রতিযোগিতা। বাড়ি-গাড়ি, ফিক্সড ডিপোজিট-শেয়ার সার্টিফিকেট, হীরে-প্লাটিনাম। অতিরিক্ত ভোগ, অতি বিলাসের যাপন, ক্ষমতার দম্ভ, বিষয়সম্পত্তির আস্ফালন, মাটি নিয়ে কাড়াকাড়ি, দাবি নিয়ে মারামারি। অর্থের লোভ, যশের নেশা, পুরস্কারের আশায় মূল্যবোধের বলি।

    প্রায়ই তর্ক তোলে মুকুল, 'জীবন মানে শুধুই এই? কোনো বড় কাজের স্বপ্ন, মহৎ একটা উদ্দেশ্য থাকবে না জীবনের?’

    মাঝে মাঝে মাথাটা গরম হয়ে যায় সৌম্যর। তর্ক করে জোর গলায়, 'সমাজ যখন বদলাচ্ছে, তাল মিলিয়ে চলাটাই ঠিক। লোভই বলো, অসংযমই বলো ... প্রতিযোগিতা আছে বলেই জীবনের তাপ টের পাওয়া যায়। আর দুনিয়াসুদ্ধ লোক ভুল করছে? ভুল বলছে? দেখার চোখ থাকা চাই। বোঝার মতো মন থাকা চাই।'

    'বেশ তো। আমি না হয় বিপ্রতীপমুখীই রইলাম। তাতে তো কারো কোনো ক্ষতি নেই।'

    মুকুল আর তর্ক করে নি।

    উফফ, এমন কঠিন কঠিন বাংলা বলে না! বিপ্রতীপমুখী! হুঁ হুঁ বাবা, স্রোতের বিপরীতে টিঁকে থাকার এলেম তোমার নেই। তুমি এমন কিছু কেউকেটা নও। বড় বড় কথা! সুপ্রিয়াদি ঠিকই বলে, 'এই সব স্টাইল মেরেই মুকুল নিজেকে আলাদা দেখাতে চায়।'

    নানা আলোচনার ফাঁদে ফেলতে চেয়েছে সৌম্য। সব সময়ই একেবারে অন্য তর্ক এনে ফেলবে মুকুল। সুপ্রিয়াদির বন্দীগ্রাম সিরিজের ছবি নিয়ে যেমন হল। হুসেনের ছবি নিয়েও তাই। হুসেনের সরস্বতী নিয়ে আলোচনা সভাগুলোয় শিল্পীসংসদের পক্ষ থেকে শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ হয়েছিল। হুসেন চিত্রকর, তাই তাঁর স্বাধীনতা আছে এমন ছবি আঁকার। এই ছিল শিল্পীসংসদের বক্তব্য।

    শিল্পীসংসদের মিটিং-এ যায় না মুকুল। ওখানে নাকি দলাদলি, গ্রুপবাজি হয়। ইচ্ছে করে প্রসঙ্গটা তুলেছিল সৌম্য। মুকুলকে তাতিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছাড়ে নি।

    তবে তাতানো যায় নি মুকুলকে। ভুলভাল একটা তর্ক তুলল, 'আচ্ছা সৌম্য, শিল্পীর স্বাধীনতা কেবল শিল্পে সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? মানুষের প্রতি সম্মান, অন্য মানুষের আবেগের প্রতি সম্মান জানানোর ভাবনার মধ্যেও একটা স্বাধীন চিন্তা থাকে, না? শিল্পীর মন, খোলা আকাশে স্বাধীন চিন্তার মন।' এটাই মুকুলের স্টাইল। স্টাইল না বলে সিগনেচারও বলা যেতে পারে।

    এমন সহজ প্রশ্ন তুলল, সৌম্যই ভাবতে বসল খানিক। রাগ হয়, ভুলভাল তর্ক তোলে বলে ... কিন্তু প্রশ্নগুলো গিলে নিতেও হয়।

    আর একদিন কথা হচ্ছিল ছবির অশ্লীলতা নিয়ে। নগ্নতা নিয়ে। ইচ্ছে করে প্রসঙ্গ টেনে এনেছিল সৌম্য। কেমন এক আক্রোশের ইচ্ছে, ভদ্র সভ্যতার আড়ালে মেয়েটার গোপন কথা বার করে আনার ইচ্ছে। অথচ মুকুল সেদিক দিয়ে গেলই না। জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে আনমনে বলল, 'নোংরা মন না হলে নোংরা ছবি আঁকা শক্ত।'

    স্বীকার করতেই হবে, সৌম্যর ভাবনাটাও একটু ধাক্কা খেয়েছে। কেমন সুন্দর করে বোঝালো মুকুল, যথার্থ শিল্পীর হাতে নগ্ন ছবিও কেমন করে ঐশ্বরিক হয়ে ওঠে।

    'আমার বিশ্বাস, ছবি আঁকতে হলে ভালো মনের মানুষ হতে হবে। ক্যানভাস, রঙ আর তুলি থাকলেই ছবি হয় না। লোভ, অসংযম, ক্ষমতার নেশা, দুর্নীতি মনের ক্ষতি করে। ওসব থেকে দূরে থাকাই ভালো।'

    মানতেই হবে, মেয়েটার ক্যালি আছে। এমন করে বলে এক একটা কথা, সৌম্যই ভাবতে বসে। প্রথমদিকে পাত্তা না দিলেও সত্যিই আজকাল মাঝে মাঝে অন্যরকম ভাবনা আসছে। আজকের রক্তাক্ত হিংস্র আঁধারের ছবি দেখে মনে হয়, মুকুল সান্যাল ঠিকই বলে। মানুষের মনই বুঝি আজ অন্ধকার, হিংস্র, রক্তাক্ত। সুপ্রিয়াদির বন্দীগ্রাম-সিরিজের ছবিগুলো নতুন করে দেখতে বসে নিজেই দোলাচলে পড়েছে।

    মেয়েটা দুর্বল করে দিচ্ছে নাকি! শক্ত হয়েছে সৌম্য। একটা কিছু করতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

    আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বেরোবার পরের দিনগুলো ভুলে যায় নি সৌম্য। সেই কষ্ট, জীবিকা উপার্জনের পথের লড়াই মুকুলদেরও জানা নেই। আর মুকুল নিজে তো পরমব্রতদার মতো গডফাদার পেয়েছে প্রথম দিন থেকে। সাধে কি সুপ্রিয়াদির অত রাগ!

    শিল্পীমহলে সবাই বলে, পরমব্রতদা ফুরিয়ে গেছে। এখন তো মুকুল ছাড়া কেউ ওঁকে পাত্তা-টাত্তাও দেয় না। তবু বুড়ো ঘ্যাম নিয়ে থাকে। সবাইকে ধরে ধরে জ্ঞান দেয়। এই সেদিন সৌম্যকে জ্ঞান দিল। সৌম্যর ছবি নাকি আজকাল 'ছবি’ হচ্ছে না। যেন মন দিয়ে আঁকে।

    দোষের মধ্যে, সৌম্য জলের ওপর তেলরঙ ছড়িয়ে তার থেকে ছাপ তুলেছিল। মানে, ওই যাকে 'মার্বেলিং’ বলে সেইরকম। সুযোগ পেয়ে খুব জ্ঞান দিল পরমব্রতদা, 'মার্বেলিং দিয়ে আকস্মিক ছন্দের একটা খেলা হয়। এই যা। চমক দিয়ে শুদ্ধ ছবি হয় না সৌম্য। কথাটা মাথায় রাখিস।'

    আর বলবি তো বল, একেবারে মিডিয়ার সামনে! নতুন ছেলেমেয়েগুলোর সামনে! মাথা গরম হয়ে আছে সেদিন থেকেই। এমনই কপাল, ঠিক সেইসময়েই সুপ্রিয়াদির এই অফার, 'খুঁজে বার কর সৌম্য। বুড়োটার সঙ্গে ঠিক কেমন কেমন কথা হয়, খবর নে। তারপর আমি ব্যবস্থা করছি। দুটোকেই নেব এবার। একসাথে।'

    প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছে সৌম্য। ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু, ছাত্রীর সঙ্গে প্লেটনিক সম্পর্ক পাতিয়ে শিল্পী হয়েছে! সুন্দরী বড়লোক ছাত্রী। কেউ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না।

    ব্যাচের সবচেয়ে ভাবুক শিল্পী ছিল বিজন, যাকে শিক্ষকরা সবাই 'রেনোয়ার’ বলে ডাকতেন। রেনোয়ারের মতই স্পষ্ট কাটা কাটা লাইন দিয়ে ছবি আঁকত বিজন, এক রঙ থেকে আরেক রঙের ক্রমিক পর্যায়ে। প্রতি রঙের প্রতি বিভঙ্গে অপরূপ আলোর খেলা। খুব ঘোড়ার ছবি আঁকত বিজন।

    নানা রকম ঘোড়া। ঘোড়ার মুখ, ঘোড়ার লেজ, কেশর। ঘোড়া বিজনের প্যাশন। কেশর দুলিয়ে ছুটে চলা একলা অভিমানী ঘোড়া। পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে অহঙ্কারী ঘোড়া। একসঙ্গে ছুটে চলা চারটে সাদা কালো বাদামী ঘোড়া, ছবিটা দেখলেই গতি অনুভব করা যায়। মা-ঘোড়ার সঙ্গে শাবক-ঘোড়া। এক্কাগাড়ির লালচে বাদামী টগবগে ঘোড়া। টাঙ্গাগাড়ির রুগ্ন ম্লানমুখী ঘোড়া। বিজনটা বড্ড ঘোড়া-পাগল।

    কে জানে, ঘোড়ার মতই লম্বা দৌড়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল কিনা। বিজন এখন একটা বেসরকারী স্কুলের ড্রইংশিক্ষক। স্কুলটা নামী দামী, মাইনেপত্তর ভালই দেয়। তবু বিজনের চোখে সেই দীপ্তি নেই, উজ্জ্বল হাসিটা হারিয়ে গেছে।

    'কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না বিজন। এত অহং ভাব। তবু যদি আঁকার কাজেই বৈপ্লবিক কিছু করত! ঘোড়া ছেড়ে বেরোতেই পারল না। কে ওকে কাজ দেবে, বলো তো?’ পরিমলদা খুব বিরক্ত হয়ে বলছিলেন সেদিন।

    বইমেলায় দেখা হয়েছিল পরিমলদার সঙ্গে। বইমেলার কাজটা পেয়েছিল সৌম্য, কাজটা সুপ্রিয়াদির যোগাযোগেই হয়েছিল। 'এই সুযোগে পরিমলদার সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলতে পারবি। মুখ চেনা তো আছেই, এবার একটু লেগে থাক।'

    কবিতামঞ্চ তৈরি। ডানদিকের প্যানেলের কাজটা সৌম্য করবে। নীল সাদা রঙে ব্যাকগ্রাউন্ড হবে, প্রধান অতিথির প্রিয় রঙ। রূপা আর কৌস্তুভ করছে কাজটা। সঙ্গে কিছু জুনিয়র আর্টিস্টও রয়েছে। কাঠের টুকরো দিয়ে দিয়ে একতারা হাতে বাউল তৈরি করছে ইন্দ্রাণী। বাঁদিকের প্যানেলের কাজটা ও পেয়েছে। ডায়াসের ওপর নানা রঙের কাপড় দিয়ে চাঁদোয়া তৈরি হচ্ছে। কাজলদার ছাত্র একজন, অনুপম নাম বোধ হয়, করছে। সুপ্রিয়াদির সঙ্গে মঞ্চের ওপর আলপনার কাজ করছিলেন একজন শিল্পী। নাম মনে পড়ল না ... তবে চেনা মুখ ... টিভিতে নানা প্রচারে বিতর্কসভায় প্রায়ই দেখা যায় মুখটা।

    পরিমলদা পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করছেন। পরিমলদা তো কখনো একা থাকেন না। রাজ্যসভার সাংসদ হবার পর থেকে সব সময় একটা ভিড় ওঁর সঙ্গে থাকে। নানা বয়সী নানা আর্টিস্ট, মিডিয়ার লোকজন।

    ইচ্ছে হলেও সৌম্য বলতে পারল না, একজন সত্যিকারের শিল্পীকে যখন জীবিকার জন্যে নার্সারি ক্লাসে শিশুদের আঁকা শেখাতে হয় তখনকার কষ্টটা কেমন। বিজনের শিল্পীমনের অভিমান, যন্ত্রণা যদি শিল্পী হয়েও পরিমলদা না বোঝেন তবে কে বুঝবে!

    বিজন আপোষ করেছে জীবিকা উপার্জনের জন্যে, যেচে কেউ কাজ দেবে না জেনেই। সৌম্য আপোষ করেছে পরিমলদার মতো মানুষের সঙ্গে, ফরমায়েসী আঁকার কাজ করে বাজারে পরিচিতি ধরে রাখার জন্যে।

    একদিন বলেছিল বিজন, 'দেখিস, একদিন আমি সেই ছবিটা আঁকব। সেই ছবিটা, যেটা আঁকতে চাই আমি। সেই ছবিটা রোজ স্বপ্নে আসে আমার। আঁকবই একদিন।'

    তারপর এখন তো বিজন বাড়িতেও আঁকার ক্লাস শুরু করেছে। স্কুলে বাড়িতে নানা বয়সের ভাবী আর্টিস্টদের ছবি আঁকা শেখায়, আর রোজ রাতের বেলা একলা ঘোড়ার ছবি আঁকে। 'সেই ছবি’-টা এখনো আঁকা হয় নি বিজনের।

    মাথা গরম হয়ে যায় সৌম্যর। সবাই কোথাও না কোথাও কানেকশন লাগিয়ে কাজ উদ্ধার করে ফেলবে, আর এই বিজন সৌম্যরা বসে বসে আঙুল চুষবে? নাহ, ঠিক ডিসিশন। কোথাকার কে মুকুল, তার জন্যে সুযোগ ছাড়া চলবে না। এতদিনের আলাপ, পরমব্রতদাকে বলে একটা কাজ আজ পর্যন্ত পাইয়ে দিয়েছে? অথচ কোন অজানা কানেকশনের সুবাদে মুকুল সান্যাল সবাইকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

    পলকে চোয়াল শক্ত। কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় নয়। পিনাকীদা ঠিক বলে, সরলতা মুকুলের একটা ভান। ছবির রাজনীতিতে সবাই পাকা খেলোয়াড়। সুপ্রিয়াদির সঙ্গ ছাড়া নয় কিছুতেই। একমাত্র সুপ্রিয়াদিই সৌম্যর কথা মাথায় রাখে। মুকুল সান্যাল নয়।

    চার : নকশা

    কেমুল্ড আর্ট গ্যালারি। উষসীর ছবির প্রদর্শনী। নানা মাধ্যমে ছাপ-ছবি করেছে উষসী। কাঠখোদাই বা রিলিফ একরকম। এচিং বা ইনতাল্লিয়ো একেবারেই অন্যরকম। রেজিস্ট্রেশন মিলিয়ে রঙিন ছাপ তোলা খুব কঠিন। উষসী রিলিফের সঙ্গে এচিং মিলিয়ে ছবি করেছে, কাঠের ওপর মাদার ম্যাট্রিক্স থেকে নানা রঙের ছাপ। অপরূপ কাজ হয়েছে।

    মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মুকুল। একেবারে নতুন আইডিয়া। এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর ছবি দেখলে বোঝা যায়, ভাবনাচিন্তার জায়গায় অনেকখানি বিবর্তন হয়েছে। এই গ্যালারিতেই কিছুদিন আগে দেবপ্রতিম আর মধুজার ছবি দেখেও এমনই চমক লেগেছিল।

    মুকুলকে দেখে এগিয়ে এল উষসী। জড়িয়ে ধরল মুকুল, 'কি অসম্ভব সুন্দর কাজ করেছিস রে ...’

    উষসীর উজ্জ্বল দু’চোখে হাসি, 'তুমি তো কাউকে খারাপ বলো না মুকুলদি। সত্যি করে বলো, ভালো লেগেছে তোমার?’

    'খুব ভালো লেগেছে রে। সত্যি। এই ছবিটা ... এই যে বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটের রূপক করে এঁকেছিস ... জলের জায়গায় আগুন ... জাস্ট অসাধারণ!’

    আরেকটু উজ্জ্বল হল উষসী, 'থ্যাঙ্ক ইউ মুকুলদি।' তারপরেই ম্লান মুখ, 'জানো, পরমব্রতদা ছাড়া কেউ আসেন নি। আমাদের বন্ধুরা এসেছে। কিন্তু সিনিয়ররা একজনও নয়। তুমি এলে, কি ভালো যে লাগছে আমার!’ এই প্রথম একক প্রদর্শনী উষসীর।

    'আসবে আসবে, সবাই আসবে। এই তো তোর পথ চলা শুরু হল। হ্যাঁ রে, কোনো কাগজ থেকে কভার করতে আসে নি?’

    'এসেছিল। একটা ছোট কাগজ। আজ পরমব্রতদা বলে গেছেন, নিত্যদিন থেকে কভার করতে আসবে।' উষসীর দু’চোখে প্রথম এগজিবিশনের উত্তেজনা, উদ্দীপনা, সারল্য, সংশয়, আশঙ্কা।

    মুকুলকে দেখে এগিয়ে এসেছে আরো ক’জন নবীন শিল্পী। আরো একদফা হাসি। গল্প। বেরিয়ে এল মুকুল। বেরিয়েই সৌম্যর সঙ্গে দেখা। 'দেখে এলে?’

    'জাস্ট অসাধারণ কাজ। তুমি দেখেছ?’

    'আস্তে। আস্তে। চট করে অত প্রশংসা করো কেন? এই তো প্রথম এগজিবিশন।'

    কিছু না বলে একটু হাসল মুকুল। এখনো একক প্রদর্শনী হয় নি সৌম্যর, ওর মনটা তো খারাপ হবেই। ওর সামনে এত উচ্ছ্বাস দেখানো ঠিক হয় নি।

    'আচ্ছা, তুমি তো ভেতরে যাবে? আমি এগোই বরং।'

    'না, আমি ভেতরে যাব না আর। কেউ তো আসে নি দেখছি।'

    'চলো, তাহলে কোথাও বসে একটু কফি খাওয়া যাক।'

    'চলো, চলো। সুন্দরী আর্টিস্টের সঙ্গে বসে কফির স্বাদই আলাদা।' যাক, সৌম্যর ইয়ার্কি শুরু হয়েছে। মনখারাপটা কেটে যাবে।

    অনেক গল্প হল। উষসীর ছবির নতুনত্ব নিয়ে। অ্যাকাডেমিক ন্যাচারলিজম শৈলী নিয়ে। সেজানেস্ক এবং কিউবিস্টিক শৈলী নিয়ে। এই গ্যালারিতেই ক’দিন আগে শিবকুমারের ছবি দেখে গেছে সৌম্য। শিবকুমারের ছবি মূলত কিউবিস্টিক। নানা শিল্পীর ছবি নিয়ে, জীবন নিয়ে গল্প হল অনেক। উষসীর মতই কত শিল্পী একক প্রদর্শনীতে আশা জাগিযেও হারিয়ে গেছে, তাদের নিয়ে গল্প হল।

    এইরকম একক প্রদর্শনীতে শৈবাল দাসের গোলগাল আয়তচক্ষু রাধাকৃষ্ণের ছবি দেখে পছন্দ করেছিলেন বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক মহেশ ভার্মা। শৈবাল এখন কেবলমাত্র সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড সিন আঁকে। রঙের ব্যবহারেও স্বাধীনতা নেই, ছবিতে ইচ্ছেমতো এতটুকু ভাঙচুর করলেও মহেশজী রাগ করেন। অনন্ত পেরুমল নামে তামিলনাড়ুর যে শিল্পী জলরঙে প্যাস্টেলে তেলরঙে পেন্সিলে কালিতে শুধুই পশুপাখির ছবি এঁকে কলকাতার গান্ধার আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী করে গেছিলেন, এত বাহবা সম্মান পেলেন ... তিনিও নাকি সিনেমার সেট তৈরি করছেন আজকাল। ফরমায়েসি ছবি আঁকছেন।

    জোর গলায় তর্ক তুলল সৌম্য, 'ফরমায়েসি ছবি আঁকতে হলে খারাপ কি? পেশাগত দিকটা নিশ্চিন্ত হলে মনের আনন্দে নিজের ছবি আঁকাও হয় তো।'

    মুকুল হাসল, 'সৃষ্টির মূল লক্ষ্য কি? মানুষ কেন আঁকে? কবিতা লেখে? সাহিত্য করে? গান বাঁধে?’

    পাঁচ : ফর্ম

    ই আঁতলামিগুলো দেখলেই রাগ হয়ে যায় সৌম্যর। ভাবখানা দ্যাখো! এতই যদি সৃষ্টির আনন্দের ভাবনা, নিজে একক প্রদর্শনী করে কেন! কেনই বা প্রচারে থাকে! ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ। নিজের ওয়েবসাইট। ছবি এঁকে ছবি তুলে তুলে ইন্টারনেটে সাজিয়ে রাখা। দ্যাখো, দ্যাখো, আমায় দ্যাখো।

    হিপোক্রিসি! নিজে পরমব্রতদার সঙ্গে লেগে থেকে কেরিয়ার করে নিয়েছে, এখন জ্ঞান দিচ্ছে। এদিক দিয়ে সুপ্রিয়াদিকে অনেস্ট বলতে হবে। এক হাতে দাও, অন্য হাতে নাও। পরমব্রতদার মতো সাপোর্ট না-ই পাক, নিজে লড়াই করে লেগে থেকে থেকে একটা জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে। মুকুল সান্যালের সঙ্গে এতদিন লেগে থেকেও কন্টাক্টগুলোকে হাত করা গেল না। চালু মহিলা। শুধু নিজেরটা বোঝে। এখন বুঝেছে, উষসীর একক প্রদর্শনী দেখে মনখারাপ হয়েছে সৌম্যর। তাই ভালো ভালো কথা বলছে। ওই মিষ্টি মিষ্টি কথাই সার। কিচ্ছু করবে না সৌম্যর জন্যে। সৌম্যদের কারো জন্যে। এর চেয়ে সুপ্রিয়া ঘোষ ঢের বড় শিল্পী। জুনিয়র আর্টিস্টদের জন্যে ভাবে, কিছু করতে চায়।

    নাহ, কিছু একটা করতেই হবে এবার। কিছুতেই এ ভাবে হারিয়ে যাবে না সৌম্য। এই মেয়েকেই দেখিয়ে দিতে হবে, একক প্রদর্শনী কাকে বলে! কতদিন হয়ে গেল, একটা ভালো ছবি আঁকতে পারে নি। মাথায় এত দুর্ভাবনা থাকলে ছবি আঁকা হয়! সৌম্য বসু বুঝি হারিয়েই যাবে! নাহ, আর না। কঠিন হয়েছে মন। আর কোনো দুর্বলতা নয়।

    ধাপে ধাপে এগিয়েছে এবার। মুকুলের সঙ্গে ফোনের নানা কথা রেকর্ড। নানা প্রয়োজনে করা মুকুলের ই-মেল থেকে কেটে বেছে তিন তিনখানা জম্পেশ ই-মেল। মাখোমাখো প্রেমপত্র। নানা জায়গায় দেখা হলে ছবি তোলা। মুকুলের ছবি, পরমব্রতদার ছবি। বাছাই করে বিশেষ জায়গাগুলো এডিট করে যা একখান সিডি তৈরি করেছে মানস, দেখে সৌম্যর নিজেরই তাক লেগে গেছে।

    বইমেলায় কবিতামঞ্চের ছবি। ছবিতে মুকুলের আঁচল ধরে টেনে আনছে পরমব্রতদা। মুকুল বইমেলায় আসেই নি। পরমব্রতদা এসেছিলেন, সবার কাজ দেখতে। কি করে এখন প্রমাণ করবে কেউ?

    পরমব্রতদার স্টুডিও। মুকুলকে জড়িয়ে ধরে অন্ধকার পুরুষ। সৌম্য জানে ওটা একটা কাঠের পুতুল। পাগল শিল্পী নিজের পছন্দের মূর্তি গড়তে পেরে সত্যি পাগল হয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু মাথামোটা সুমিত তো তা বুঝবে না।

    সেইসঙ্গে ফোনের কথাগুলো এডিট করে করে যা একখানা সিনেমা বানিয়েছে মানস! সুমিত তো বটেই, শিল্পীমহলে মিডিয়ায় আড্ডায় আড্ডায় ঢি ঢি পড়ে যাবে। ফেসবুকেই যা হল্লা হবে!

    মানস প্রথমে কাজটা করতে চায় নি। সুপ্রিয়াদির বাড়িতে তরল পানীয়ের প্রবাহে শেষ পর্যন্ত কথা দিয়েছিল। মোটা টাকা নেবে অবশ্য। তা এরপর আর টাকার অভাব থাকবে না। মাথামোটা বরের টাকা দেবে মুকুল। পরমব্রতদাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না নিশ্চয়। কথাটা পাঁচকান করতে চাইবে না।

    আর এই অশান্তি, এই দুর্ভাবনায় ছবি আঁকা বন্ধ হবে। মন শান্ত না থাকলে ছবি হয়? নিজেকে দিয়ে বুঝছে না সৌম্য? মুকুল সান্যালের শিল্পী জীবন শেষ। বিশেষত যখন জানবে, আর কেউ নয় ... ব্ল্যাকমেল করছে সৌম্য। সেই সৌম্য, যাকে আজকাল সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে মেয়ে। যার সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করে, মনের সব কথা, সব ভাবনা ভাগ করে।

    সুপ্রিয়াদি বলেছে, কৌস্তুভের হাত দিয়ে সিডি পাঠানো হবে। মুকুল যেন বোঝে, সৌম্য একা নয়, সঙ্গে আরো লোকজন আছে। মুকুল যেন ভয় পায়, লজ্জা পায়।

    সুপ্রিয়াদি টাকা নেবে না। বলেই দিয়েছে, 'আমি শুধু চাই, মুকুলের ছবি আঁকা বন্ধ হোক। বুড়োটার সঙ্গে লটঘট করে শিল্পের নামে বদমাইশি করে বেড়ানো! ওই বুড়োটাকেও দেখে নিতে চাই। সেই কলেজের সময় থেকে মুকুল সান্যালকে তোল্লাই দিয়ে চলেছে!'

    সৌম্যরও টাকা দরকার নেই। কিন্তু মানস আর কৌস্তুভের খাঁই আছে।

    মনটা একটু কেমন করেছিল, যখন মানস সিডি হাতে দিয়ে বলল, 'সুপ্রিয়া ঘোষের ব্যাপারটা বুঝি। নানান কীর্তি করে নিজের ইমেজের বারোটা বাজিয়েছে। পরিমল মজুমদারই বল, আর কাজল সেনগুপ্ত ... সবাই জানে সুপ্রিয়া ঘোষকে ঠিক কোথায় কতখানি রাখবে। বর সুবিধের নয়, ফুলে ফুলে মধু খাওয়া টাইপ। ছেলেটা গোল্লায় গেছে। মুকুলের সঙ্গে ওর ব্যাপারটা স্রেফ জেলাসি। নইলে এমন কিছু কাজ পায় না মুকুল, যে ওকে নিয়ে প্রফেশনাল রাইভেলরি থাকছে। কোনো গ্রুপবাজিতেও নেই মেয়েটা। সোজা সাপটা কথা বলে, নিজের জগৎ নিয়ে থাকে। সুপ্রিয়াদির ব্যাপারটা তবু বুঝি, কিন্তু তুই? তুই কেন সৌম্য? তুই এই সর্বনাশা খেলায় কেন?’

    একটু থমকানো হয়েছিল। তারপর জামা থেকে ময়লা ফেলার মত ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে সৌম্য। ব্যাটা মানস। নিজে ঘুষ খেয়ে খেয়ে, পার্টিবাজি করে, নেতা মন্ত্রীদের পাশে পাশে মুখ দেখিয়ে মোটা হয়ে গেছে। পাবলিককে জ্ঞান দেবার বেলায় সেয়ানা।

    এবারের দিল্লী যাওয়াটা সুপ্রিয়াদি না থাকলে হত? পরিমলদাকে বলে বলে সৌম্যর নামটা কে তুলে দিল? মৃগেনের নাম তো ফাইনাল হয়ে গেছিল।

    'সৌম্য পরের বার যাবে, এবার মৃগেনকে বলা হয়ে গেছে,’ পরিমলদা বলেছিল সৌম্যর সামনেই।

    'আমার কথার একটা দাম নেই তোমার কাছে? নিজের জন্যে তো কিছু চাই নি, তবুও তুমি ...’ অভিমানের সুরে পরিমলদাকে ঘায়েল করেছিল সুপ্রিয়াদি।

    'যা, ব্যবস্থা করে দিলাম। আরো পাবি, শুধু সঙ্গে থাকিস।' পরে বলেছিল সৌম্যকে।

    জানে সৌম্য। সুপ্রিয়াদি একাই একশ’। নন্দনের রাঘবদার সঙ্গেও এমনই আত্মীয়তার সুরে কথা বলে। টিভির সব চ্যানেলে, ইন্টারনেটের পাতায় পাতায় সুপ্রিয়াদির মুগ্ধ ভক্ত। বুদ্ধিজীবী মিছিলে এই সেদিন অপর্ণা সেনগুপ্তর পাশে পাশে হাঁটছিল। সুপ্রিয়াদিকে চটানো চলবে না।

    কিছু একটা করতেই হবে সুপ্রিয়াদির জন্যে। নইলে কৌস্তুভ আর রূপা যা আঠার মতো লেগে থাকে সুপ্রিয়াদির সঙ্গে। এই তো কদিন আগে এই মিছিলে হাঁটা নিয়ে তর্কাতর্কির সময় নামী পত্রিকায়, নামী মিডিয়ায় সুপ্রিয়াদির হয়ে কত কথাই না বলেছে কৌস্তুভ। রূপা আরো এককাঠি এগিয়ে। ফেসবুকে সুপ্রিয়াদির নামে আলাদা গ্রুপ খুলে দিয়েছে। এবার সৌম্যর পালা। এমন কিছু করতে হবে, যা অন্য কেউ করতে পারবে না।

    ছয় : সাবজেক্ট

    'তুই ওই সৌম্যকে বেশি পাত্তা দিস না মুকুল,’ রুচিরা বলেছে একদিন, 'তোকে নিয়ে ওরা হাসাহাসি করে। গ্যালন গ্যালন মদ খায় ছেলেটা, তুই জানিস? গৈরিককে চিনিস তো? আমার ছাত্র? গৈরিক বলছিল আমায়, সুপ্রিয়ার সঙ্গে খুব খাতির সৌম্য বসুর। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কাজটা তোর পাবার কথা, আমরা সব্বাই জানতাম। পেলি না বলে কত দু:খ করছিলি না সেদিন? জানিস তুই, ও কাজ কে পেয়েছে? সুপ্রিয়া।'

    অবাক হয়েছে মুকুল। কই, সৌম্য তো বলে নি। দিল্লী যাবার আগের দিনই তো এসেছিল। শিল্পীসংসদের বিশেষ সভার কথা, মৃগেনের বদলে নিজের দিল্লী যাবার ব্যবস্থার কথা, সুপ্রিয়াকে নিয়ে পত্রিকায় বেরোনো কৌস্তুভের সাক্ষাত্কার ... কত গল্পই তো করল। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কাজটা মুকুলের হয় নি বলে কত আফসোস করল। কই, একবারও তো বলল না সুপ্রিয়া করছে কাজটা! রুচিরা মিথ্যে বলবে না, মুকুল জানে।

    'তুই চিরকাল একরকম সরল আর বোকা থেকে গেলি মুকুল। সৌম্য বসুর কাদের সঙ্গে ওঠাবসা, সেটুকু তো জানিস। তবু ছেলেটাকে বুঝিস না?’

    উষসীও বলেছে একদিন, 'মুকুলদি, তোমার সঙ্গে কি সুপ্রিয়াদি সৌম্যদাদের কিছু হয়েছে? সংসদের আড্ডায় তোমার সম্বন্ধে অনেক কথা বললেন সুপ্রিয়াদি। তোমার ছবিতে পুরোনো শিল্পীদের প্রভাব বেশি, নিজস্বতা নেই ... এইসব নানা কথা। সৌম্যদাও ছিল, হাসছিল। তুমি নাকি সৌম্যদাকে বলেছ, আজকাল আঁকতে পারছ না?’

    একটু খারাপ লেগেছিল সত্যিই। তবে সৌম্যকে খানিকটা চিনেছে মুকুল। ছেলেটার মধ্যে ছবির প্রতি একটা দুরন্ত ভালোবাসা। একটু সিরিয়াস হলে ভাল কাজ করতে পারবে। পরমব্রতদাও বলেন।

    সৌম্যকে উষসীর কথা বলেছে মুকুল। রুচিরার সাবধানবার্তাও। হো হো করে হেসেছে সৌম্য, 'খুব সাবধান মুকুল। আমি কিন্তু খুব খতরনাক। আমাকে বিশ্বাস কোরো না।'

    উজ্জ্বল দু’চোখ। খোলা গলার হাসি। এই ছেলেটার মধ্যে অনেকখানি প্রাণ। শিল্পী মন এমন প্রাণবন্ত না হলে হয়? উজ্জ্বল প্রাণ, হাসি হাসি মন। বিশ্বাস খুঁজেছে মুকুল, নতুন করে।

    কিন্তু ছবির জগতের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছে সৌম্য।

    ভয় করে। চূড়ায় ওঠার নেশাটা যে ভয়ঙ্কর! শেষে যদি অণিমার মতো হয়!

    চূড়ায় ওঠার নেশায় কলকাতা ছেড়ে মুম্বই চলে গিয়েছিল অণিমা। মুম্বইয়ের বিখ্যাত শিল্পী দিলীপ নাগরের ঘরনী অনুষ্কা নাগরে যে কলকাতার অণিমা, তা অনেকেই জানে না। ছবির জগতে দিলীপ নাগরে নিজেই একটা ইনস্টিটিউশন। অনুষ্কার সঙ্গে দিলীপ নাগরের লিভ-ইন সম্পর্কের কথা ট্যাবলয়েডগুলোর পছন্দের টপিক। সুযোগ্যা ঘরনী অনুষ্কা তাঁর সহকর্মিনীও বটে। রোজ অনুষ্কার হাত ধরে কত আর্টিস্ট কাজ পাচ্ছে। তবু অনুষ্কা আঁকার জগতে নেই।

    কি সুন্দর আঁকত অণিমা। স্নিগ্ধ জলরঙের ছবি। অয়েলের ছবি। চোখকে আরাম দেওয়া স্পেস সেন্স, কম্পোজিশন সেন্স। সেই অণিমা আর আঁকতে পারে না।

    সুমিতের সঙ্গে মুম্বই যাওয়া হয়েছিল। কাজের সুত্রে যাওয়া। সারাদিন সুমিতের কাজ, আর সন্ধেবেলা বেড়ানো। দু’দিনের জন্যে গোয়া যাওয়াও হয়েছিল।

    দুপুরগুলো একা একাই ঘুরে বেড়াত মুকুল। কত বছর পর অণিমার সঙ্গে দেখা। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নেমে এসেছিল।

    না না, অণিমা নয়। অনুষ্কা। রাস্তার মধ্যেই জড়িয়ে ধরেছিল মুকুলকে। জোর করে বাড়ি নিয়ে গেল। অনেক অনেক কথা জমে আছে অনুষ্কারও। একান্ত অনেক কথা।

    'অণিমা আর আঁকতে পারে না মুকুলদি। শুধুই চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন নিয়ে কি আঁকা হয়, বলো?’ আকুল চোখ দিশেহারা, 'নামী শিল্পীদের সঙ্গ করছি। দিলীপজিকে পরিবার থেকে কেড়ে নিয়েছি। রোজ আমার হাত ধরে কত কত আর্টিস্ট হয় কাজ পাচ্ছে, নয় হারিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ মুকুলদি, অনুষ্কা নাগরে না চাইলে শিল্পী হওয়া হয় না।'

    দু’হাতে মুখ ঢেকেছে অনুষ্কা, 'তবু আমি আঁকার জগতে নেই। রোজ বসি ক্যানভাস নিয়ে, রঙের প্যালেট নিয়ে। পারি না। রঙ দিতে গেলেই সব উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। আর কি কোনোদিন পারব না মুকুলদি?’

    'এই দ্যাখো,’ টেনে এনেছে একগোছা ছবি। পট জুড়ে ডানদিক থেকে বাঁদিকে বর্ণিল ঢেউ। নানা রঙ। কিন্তু ঢেউগুলোয় কাঁপন নেই। বর্তুলাকার কিছু ছাড়া ছাড়া ছবি। খাড়া খাড়া নানা আকার। অসম্পূর্ণ। 'দিলীপ এগুলোকেই বিক্রী করে দিতে পারে, জানো? অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম জাতীয় গালভরা একটা নাম দিয়ে। কিন্তু তুমি তো শিল্পী। তুমি বুঝবে। এগুলো ছবি নয়। আমি আর আঁকতে পারি না।'

    কেন অনুষ্কার ছবি আঁকা হয় না আর? আজ তো দিলীপ নাগরের মতো পৃষ্ঠপোষক সঙ্গে, তবু কেন ছবি হয় না?

    'আমি আমার সরলতা হারিয়েছি,’ ফিসফিস করে বলেছিল অনুষ্কা, 'শুদ্ধ মন না হলে কি ছবি হয় মুকুলদি!’

    সৌম্যকে অণিমার গল্প করেছে মুকুল। সৌম্য বেশ মন দিয়ে শুনেছে। কেমন একটা বিশ্বাস হয়েছে মুকুলের, সৌম্য ঠিক বুঝবে। পরমব্রতদা বলেছিলেন প্রথম আলাপে, ছেলেটা জাতশিল্পী। নানা গল্পে মুকুলের নিজেরও মনে হয়েছে, সৌম্য ছবির জগতের মানুষ। ছবি ওর প্রাণ। একদিন সত্যি সত্যি নামী শিল্পী হবে সৌম্য। অনেক বড় হবে।

    কিন্তু দিল্লী থেকে ফিরে সৌম্য আর যোগাযোগ করে নি। কি যে হল ছেলেটার! ফোন করে সাড়া মেলে নি। ই-মেলের উত্তরও আসে নি। ব্যস্ত হয়ত, এমনটাই ভাবছিল মুকুল। দুর্গাপুজো এসে গেছে। পুজোর ছুটিতে বসিরহাটের গ্রামের বাড়িতে যায় সৌম্য।

    গতকাল সে ভুল ভেঙেছে। দুর্গাপুজোয় শহরের সেরা প্রতিমা নির্বাচনের আমন্ত্রণ। মুখোমুখি দেখা সৌম্যর সঙ্গে। খুব অবাক হয়েছে মুকুল, কারণ সৌম্য মুখ ফিরিয়ে নিল। চেষ্টা করেও কথা বলতে পারে নি। চোখ সরিয়ে রাখল সৌম্য। স্পষ্টই এড়িয়ে গেল।

    কিন্তু কেন! বেশ অবাক হয়েছে মুকুল।

    সাত : রঙ

    মাঝরাতে একলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আকাশভরা তারার মাঝে একলা সৌম্য। মুখোমুখি একতলা বাড়িটায় এইমাত্র পড়ার বই বন্ধ করে উঠল অনুতোষদার ছেলে। কি যেন নাম ছেলেটার! চিন্ময়! নাকি তন্ময়! এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে ও। তারপর জীবনসংগ্রাম। কঠিন জীবন সংগ্রাম।

    সৌম্য হাসল আনমনে। ওই ছেলেটা নিজে নিজেই শিখবে একদিন। 'জীবন’, 'জীবনসংগ্রাম’ শব্দগুলোর মানে ঠিক কি হয়। আনমনেই মাথা নাড়াল সৌম্য। কে জানে কোনটা ঠিক। কোনটা বেঠিক। ঠিক ঠিক মানেটা যে কোন ফাঁকে ভুল হয়ে যায়! একজনের জীবনে যেটা ঠিক, আরেকজনের জীবনে সেটাই হয়ত মস্ত ভুল। আজন্মলালিত শিক্ষা, সংস্কার কোন ক্ষণে যে ভুল মনে হয়! জীবন হাতে ধরে শিখিয়ে দেয় সব। ঠিক ভুল, ন্যায় অন্যায়। সব।

    মুকুল এখন কি করছে কে জানে। অনেকদিন আগে একবার বলেছিল, মাঝরাতে উঠে আকাশভরা তারা দেখতে ভালো লাগে ওর। রাত পার হয়ে সকাল হওয়া দেখতে ভালো লাগে। আস্তে আস্তে আলোর রেখা এসে মায়াবী করে দেয় মস্ত আকাশকে। তারাগুলো লুকিয়ে পড়ে এক এক করে ... 'আমি স্পষ্ট দেখেছি জানো? আর কাউকে তো বলতে পারি না, তুমি ঠিক বুঝবে তাই বলছি। স্পষ্ট দেখি পৃথিবীটা, ঘাস মাটি গাছপালা আকাশ বাতাস হাসছে। আস্তে আস্তে আলো ছড়িয়ে পড়ে, দিগন্ত পর্যন্ত হেসে ওঠে, জেগে ওঠে প্রাণ। আমি নতুন করে ভালোবেসে ফেলি। কি সুন্দর এই পৃথিবী! কি অপরূপ এই জীবন! ভাগ্যিস মানুষ জন্ম পেলাম!’

    আজ সৌম্যও জাগবে। সকাল হওয়া দেখবে। সত্যি সত্যি হাসবে পৃথিবী? মানুষ জন্ম! মানুষের আকৃতি পেলেই বুঝি মানুষ হয় সবাই? সৌম্য কি একজন মানুষ? তার দিকে চেয়েও হাসবে আকাশ?

    খুব অবাক হয়েছে মুকুল। না তাকিযেও বুঝতে পারছিল সৌম্য। কিন্তু সৌম্যই বা কি করে! সৌম্যর যে নিজেকে শাস্তি দিতেই হবে।

    মুকুল কোনোদিন জানতে পারবে না হয়ত, সৌম্য ওর কতখানি ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার উপায় নেই। তাই সৌম্য আর মুকুল সান্যালকে চিনবে না। আর কোনোদিন আলোর কাছে গিয়ে নিজের মনের দগদগে ক্ষতটাকে দেখবে না। কিন্তু মুকুলের সঙ্গে দেখা হবে জেনেও কেন যে না গিয়ে থাকা হল না!

    দিল্লীতে বসেও সুপ্রিয়াদির কথাই ভেবেছে সৌম্য। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত সৌম্য। দিল্লী আসা সত্যি খুব লাভের ব্যাপার হয়েছে। অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কন্টাক্ট না থাকলে কি এ জগতে কোন কাজ হয়!

    জাহির খানের আগামী ছবিতে ছবি আঁকার একটা কাজ পেয়েছে সৌম্য। ছবির প্রধান চরিত্র একজন চিত্রশিল্পী, ছবিতে তাই আঁকা ছবির বিশেষ গুরুত্ব। দুটো ছবি আঁকার জন্যে যে পারিশ্রমিক অফার করেছেন এঁরা, তা অনেক। জাহির খানের ছবির সূত্র ধরেই আসবে আরো অনেক কন্টাক্ট। মহারাষ্ট্রের শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার পর যে তামিল শিল্পীর সঙ্গে ওয়ার্কশপ চলছে, তিনি তো চেন্নাই আসার কথা বলেই রেখেছেন।

    মনে মনেই সুপ্রিয়াদিকে ধন্যবাদ দিয়েছে অনেক। ফিরে গিয়েই সিডিটা পাঠিয়ে দিতে হবে। ঋণ স্বীকার। তারপর আর পেছন ফিরে তাকানো নেই।

    কিন্তু তারও পরে ঠিক কবে থেকে এমন হল, মনে নেই সৌম্যর। কলকাতা ফিরে এসেও সিডি নিয়ে যাবার কথা ভেবে রেখেছে। দিল্লীর কাজের কথা ফোনে সুপ্রিয়াদিকে বলার সময় আবেগে গলা ধরে এসেছে। খুশি হয়েছে সুপ্রিয়াদিও, 'আর ভাবনা নেই তোর। কলকাতার ছবির জগতও এবার তোকে মান সম্মান দেবে। বুঝলি? এই হল নিয়ম। বাইরে থেকে সম্মান পেলেই কলকাতায় কদর।'

    সিডি তৈরি। সুপ্রিয়াদি রোজ তাড়া দিচ্ছে। ঋণ স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু কি যে এক আলস্য!

    ব্ল্যাকমেলের সিডিটা পেয়ে অবাক হয়ে যাবে মুকুল। এমন যে কেউ করতে পারে, তা ভাবতেই পারে না বোকা মেয়েটা। নার্ভাস হয়ে শাড়ির আঁচলের কোনাটা মুঠোয় পাকাবে বারবার। চোখেও জল আসবে। আর যা বোকা মেয়ে, সৌম্যকেই ফোন করে বসবে তারপর। পরমব্রতদাকে ফোন করবে না। গুরু যে ঈশ্বর! ঈশ্বরকে কি মানুষের সমতলে নামিয়ে আনা যায়! ভুলভাল বিশ্বাস মেয়েটার। সৌম্যকেই ফোন করবে মুকুল।

    অকারণেই মুকুলের কথা ভেবে চলেছে সৌম্য। ঘুমে, আধো জাগরণে। মনের মধ্যে দু’রকম পরস্পরবিরোধী খেলা। কি যে একটা আকর্ষণ! আবার কোথায় যে একটা বাধা! ব্ল্যাকমেল করতে গেলে এমন দুর্বলতা মানায়?

    আচ্ছা, মুকুল যখন জানবে ... জানতে পারবেই ... সৌম্যই নাটের গুরু? কেমন লাগবে ওর?

    ছবির জগতের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না মুকুল। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ... বলা ভালো অঘটনগুলো ... স্পর্শই করে না ওকে। অবলীলায় বিশ্বাস করে সবাইকে। কেমন এক মায়ার স্বরে কথা বলে। ঘোর লেগে যায়। এই তো দিল্লী আসার আগেই ... কোন এক অণিমার কথা বলছিল। অণিমা নাকি আর ছবি আঁকতে পারে না। বলতে গিয়ে মুকুলের চোখ ভরে জল এসেছে।

    আচ্ছা, সৌম্যর জন্যেও কি জল আসবে মুকুলের চোখে? নাকি বিশ্বাসঘাতকের প্রতি ঘৃণায় শুকনো হয়ে যাবে মুকুলের মায়াবী চোখ? প্রবল আঘাতে বুকের মধ্যের অনুভূতির ঝরনা শুকিয়ে যাবে?

    কি ভেবে ফোন টেনে নিয়েছিল। সুপ্রিয়াদি। 'কি রে সৌম্য?’

    'না বলছিলাম, যদি এমন হয় ... সিডি দিলাম তোমায়, প্ল্যানমতো সব হল ... শুধু মুকুল জানল না যে সিডিটা কে করল, মানে আমিই যে সিডিটা করিয়েছি ...’

    'ভয় পাচ্ছিস নাকি?’ খুব হাসল সুপ্রিয়াদি, 'বরটা খুব সন্দেহপ্রবণ, বুঝলি? সুন্দরী বউ, আর্টিস্ট ... এমনিই চাপে থাকে। যতই ঘ্যাম চাকরি করুক, কমপ্লেক্স আছে। আমি জানি। ওইজন্যেই তো পরমব্রতদার বউয়ের ফোনের পর মুকুলের ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এবার দুদিক দিয়ে ধরব। একদিকে পরমব্রতদার সঙ্গে ঢলাঢলির প্রত্যক্ষ প্রমাণ ... তোদের সিডি। অন্যদিকে মুকুল জানতে পারবে, ব্ল্যাকমেল করছিস তুই। তুই আমাদের লোক। আর দম থাকবে ওর? আহ্লাদী পুতুল এমন শক পাবে, একেবারে চুপ হয়ে যাবে। কাকে সামলাবে তখন? বর ঘর-সংসার, নাকি কেরিয়ার? সিডি পরমব্রতদার বউয়ের হাতে গেলে কি হবে, সেটাও ভেবে রাখ। পুরো ব্যাপারটাই আমাদের পক্ষে। বুঝলি? ভয় পাস না। মুকুল সান্যালের কেরিয়ার শেষ।'

    সৌম্য তবু চুপ করেই রইল। 'শোন সৌম্য, মুকুল কোনোভাবেই এসব বাইরে জানাজানি হতে দেবে না। ওর আত্মসম্মান জ্ঞান বেশ টনটনে। আর যদি বলেও, আত্মপক্ষ সমর্থনের কি প্রমাণ দেবে? সিডিটা মিথ্যে, সে প্রমাণই বা করবে কি করে? শুধু শুধু কেচ্ছা হবে। মুকুল সান্যাল সেটা হতে দেবে না। তুই মিথ্যেই ভয় পাচ্ছিস।'

    সাড়া না পেয়ে এবার অভিমানের সুর সুপ্রিয়াদির গলায়, 'বেশ। যদি না চাস, তুই না হয় পিকচারে থাকলি না। কৌস্তুভ করবে, পলাশ করবে। একদিক থেকে ভালই হবে। তুই ভালোমানুষের মতো মুকুলের কাছে যাবি। ওর রিঅ্যাকশন দেখে আমাদের জানাবি। তুই সিডিটা দিয়ে যা আমায়। আর দেরি করিস না।'

    'ভালোমানুষের মতো।' মতো, ভালোমানুষ হয়ে নয়। ভালো মানুষ দূরের কথা, মানুষের মতো হয়েই কি যাওয়া হবে মুকুলের কাছে?

    'রিঅ্যাকশন।' প্রতিক্রিয়া। সমান এবং বিপরীত ক্রিয়া। মুকুলের কি সমানভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবার অবস্থা থাকবে?

    পরের দিন নিজে থেকেই ফোন করেছিল সুপ্রিয়াদি, 'কি হল সৌম্য? এতখানি এগিয়ে কি এমন হল? তুই কি এমন ভাবছিস যে, এ লড়াই শুধু আমার? ভেবে দ্যাখ, পরমব্রতদার বউয়ের ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলেই মুকুল বা পরমব্রতদা ঘুঁটি সেট করতে পারে নি। নইলে আজ তোর জায়গায় মুকুলই হয়ত দিল্লী ঘুরে আসত। এইরকমই হয় রে সৌম্য, যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর। তোর জন্যে কে ভাবে, কে করে রে সৌম্য? ওই মুকুল আর তার গুরু পরমব্রত? ভেবে দেখিস।'

    সৌম্যই বা কঠিন থাকে কি করে? সুপ্রিয়াদির কাছে অনেক ঋণ না সৌম্যর?

    আট : ছবি

    কিন্তু নিজের কাছেও যে অচেনা হয়েছে সৌম্য বসু। অন্য কেউ না, আর কারো কথা নয়, বারে বারে মনে হয়েছে শুধু মুকুলের কথা। সরল বিশ্বাস। সৌম্যর 'ভালো মানুষ’ মুখোশ, সেই মুখোশকেই মুখ ভেবে গভীর বিশ্বাস করেছে মেয়েটা। এই সরল বিশ্বাসের সুযোগ নেবার পরেও কি শিল্পী থাকবে সৌম্য? ছবি আঁকতে পারবে? কাকে ব্ল্যাকমেল করবে সৌম্য? মুকুলকে, নাকি নিজেকেই?

    আর পরমব্রতদা? যাঁর কাছে ছবি আঁকার হাতেখড়ি? বিষয়বস্তু, ফর্ম, টেকনিক, রস, গুণ, রঙ, নকশা, পারস্পেকটিভ ... এক এক ক্লাসে এক একটা জিনিস নিয়ে শেখা। শুধু আঁকা নয়, ছবি দেখতে শেখা।

    সাধারণ মানুষের যে ধারণা, ছবিতে একটা গল্প থাকা চাই। ছবিটা যেন কিছু বলে। পরমব্রতদা শিখিয়েছিলেন, সার্থক ছবিতে গল্প থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। ছবির বিচার হয় এই দেখে যে, রসোত্তীর্ণ প্ল্যাস্টিক শিল্পসৃষ্টির কাজে শিল্পী তাঁর উপাদানগুলো ঠিক ঠিক ব্যবহার করতে পেরেছেন কিনা।

    জোলা, জেমস জয়েস ... এঁদের ছবি কেন রিয়ালিস্ট ... অথচ রিয়ালিস্ট হয়েও রেমব্রান্ট, ভেলাস্কেথ বা সেজান কেন আলাদা ... পরমব্রতদা ব্যাখ্যা করে বোঝাতেন। ঘন্টার পর ঘণ্টা। কোনো আলস্য নেই শিক্ষকের ভূমিকায়। শিক্ষক তো অনেকেই ছিলেন, কিন্তু আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েদের হিরো একজনই। পরমব্রতদা। কাকে ব্ল্যাকমেল করবে সৌম্য?

    গতকাল সুপ্রিয়াদির কাছে গিয়েছিল। 'পারলাম না সুপ্রিয়াদি। সিডিটা নষ্ট করে দিয়েছি। মানসের কম্পিউটারে বসে নিজে এক এক করে সব ফাইল মুছে দিয়েছি।'

    খুব রাগ করেছে সুপ্রিয়াদি, 'তুইও সৌম্য? বেইমানি করতে একটু হাত কাঁপল না তোর? এমনি করে বাঁচাতে পারবি মুকুল সান্যালকে? এক আকাশে দুই নক্ষত্র থাকে না। মুকুল সান্যালকে আমি শেষ করবই। খুব ভুল করলি, মনে রাখিস।'

    বেইমান বিশ্বাসঘাতক সৌম্যকে সুপ্রিয়াদি ক্ষমা করবে না। জানে সৌম্য। আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন শেষ। একক প্রদর্শনীর আশাও নেই আর। এখন শিল্পজগতে সুপ্রিয়া ঘোষের কথাই শেষ কথা। সবরকম ক্ষমতা দিয়ে সৌম্যর কেরিয়ার শেষ করে দেবে সুপ্রিয়াদি।

    শেষরক্ষাও হবে না। সব দিক দিয়ে প্রতিশোধ নেবে। নিজে থেকেই মুকুলকে সব বলবে সুপ্রিয়াদি, সৌম্য তার কতখানি ক্ষতি করতে চেয়েছে। নিজের সদর্থক ভূমিকায় এ সর্বনাশ আটকেছে, এমন কথাও বলতে পারে। সৌম্য জানে।

    তবু অলীক এক অচেনা শান্তি। অদ্ভুত এক প্রশান্তি। সমুদ্রে মেশার ঠিক আগে মোহানার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে নদী। এর পর সমুদ্রে মেশা ছাড়া আর কোনো কথা নেই।

    বারান্দা ছেড়ে ঘরে ফিরেছে এবার। অনেকদিন পর সৌম্যর ক্যানভাসে রঙের ঢেউ। পটের নানা জায়গায় নানা বিভঙ্গ। নদীর স্রোতের মতো বহতা রেখার তরঙ্গ। নানা বর্ণছায়া। নানা রঙ। শায়িত লীলায়িত সজীব লহরী। রেখাগুলো প্রাণ পেয়ে জেগে উঠছে। কোথাও রেখাগুলো মিশে যাচ্ছে একাগ্রতায়, বুকের গভীরে। কোথাও ছড়িয়ে পড়ছে দিগন্ত পেরিয়ে। কোথাও এসে মিলছে একটি বিন্দুতে, গাঢ় হয়ে। কোথাও আকাশমুখী।

    আজ এই মুহূর্তে হয়ত বা এক নির্জন অতি-দুর্লভ প্রায় দৈবী মুহূর্তের জন্ম।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments