ধুলি পাঁচ নম্বর উকুনটা মেরে, ছ নম্বরটাকে চুলের গোড়া থেকে তুলে আনল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে চেপে সবে মারতে যাবে, এমন সময় বাসি এসে তাকে ডাকল। দাওয়ার নীচে দাঁড়ানো উত্তেজিত বাসন্তী হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, কাল রাত্রে দিল্লী মেলের তলায় একটা লোক কাটা পড়েছে। এমন অবস্থা হয়েছে, লোকটাকে চেনা যাচ্ছে না।
খবরটা শুনে ধুলি বলল—‘হারামি শালা।' কাকে বলল, বাসিকে, নাকি কাটা পড়া সেই অচেনা লোকটাকে? নাকি বাঁ আঙুলে নখের উপরে রাখা পালিয়ে যাওয়া উকুনটাকে? যেটাকে সে ডানহাতের বুড়ো আঙুলের নখে চেপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। বিরক্ত মুখে ধুলি উকুনটাকে খুঁজতে লাগল। নিজের কোলের শাড়ির ওপর, মাটিতে। দেখতে পেল না, ছোট্ট পরগাছা এই পোকাগুলো কি শয়তান, কি শয়তান। ওইটুকু গতর হলে কি হবে, দাঁতের কি ধার। উকুনের আবার গতর, তার আবার দাঁত! কিছুক্ষণ খুঁজে ধুলি হাল ছেড়ে দিল। মাথার মধ্যে উকুনের জবরদখল রাজ্যপাটের জ্বালায়, পাগলির মতো দুহাতে মাথাটা চুলকে নিল খানিক। তাই দেখে বাসি ফিক করে হেসে উঠতে, ধুলি মুখ ঝামটে বলল— ‘আ মোলো, হাসছিস ক্যানে লা?' তবুও বাসি হাসছিল, হাসতে হাসতে বলল—‘জটে বুড়ি, তোমাকে ঠিক জটে বুড়ি লাগছে।'
‘আবাগীর বেটি, তুই জটে বুড়ি, তোর চোদ্দগুষ্টি জটে বুড়ির ছা।'
ধুলির গালাগালির দাপটে বাসির মুখ ম্লান হয়ে গেল। সে পলেস্তারা খসা পিলারের নোনাধরা ইঁটের গা খুঁটতে লাগল। তার নখের ডগায় লাল ইঁটের মিহিন গুঁড়ো। যেন মেটে রঙের সিঁদুর।
কাজকম্মের লোভ দেখিয়ে ছুকরি মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসে মাসীর হাতে তুলে দেওয়াই আড়কাঠিদের কাজ। চায়ের যেমন লিকার হয়, হয় ফ্লেভার, আর সেই মতো যেমন তার দাম ওঠা পড়া করে। ছুকরিদেরও ‘লিবার’ আর ‘ফিবার’ অনুযায়ী মাসী দর দেয়। মাসীর প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার চোখ জরিপ করে নিতে পারে, কোন ছুকরি কালে হয়ে উঠবে ঠমকদার ডবকা, আর কে হবে ম্যাদামারা কাঁদুনি। বাসি এ লাইনে সবে বছর তিনেক এসেচে। এখনো ঠিক যেন মন বসে নি। প্রথম বছরখানেক তো মাসীর সঙ্গে খুব আকচাআকচি। আজকাল অনেকটাই থিতু হয়ে এসেছে, বুঝে গেছে, যে জায়গায় সে এসে পড়েছে, সেখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। আর বের হলেও সে ফিরে যেতে পারবে না তার নিজের বাপ-ভাইয়ের সংসারে।
নষ্টমাগীকে ঘরে তুলে সংসারের অকল্যাণ ডেকে আনবে কোন বাপ, মা, ভাই, বোন? যদিও আরেকটা পথ আছে, রেলে মাথা দেওয়া কিংবা গলায় দড়ি। সে পথটার কথা বাসি ভাবে নি তা নয়, কিন্তু পছন্দ হয় নি। সে বাঁচতে চায়। মরে গিয়ে তার কি লাভ? কিংবা কি আহামরি ক্ষতি হবে তার পরিচিত পরিজনেদের। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে খুব জোর বলবে, ‘গেছে, ভালোই হয়েছে, আপদ বিদেয় হয়েছে।' বাসিকে ধুলির বেশ লাগে। বছর তিনেক এই লাইনে আসার পরেও সে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তার ফেলে আসা গ্রামজীবনের ছায়া। বাসির কথাবার্তায়, আচরণে ধুলি পরশ পায় সেই অনুভবের। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে সে আগ্রহের সঙ্গে বাসির কথা শোনে দুপুরের নির্জন অবসরে, তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।
ধুলির মুখঝামটা খেয়ে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো বাসন্তীর দিকে একবার তাকালো ধুলি। বেচারি মুখ হাঁড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হল ধুলির, বলল—‘কিরে, বাসি? বাজার যাবি না?'
বাসি কিছু বলল না, চোখ তুলে তাকালো, দু চোখে অভিমান। এই জন্যেই বাসিকে বড়ো ভালো লাগে ধুলির। এই লাইনে অভিমান করবে এমন আহাম্মক কে আছে আর বাসি ছাড়া? সকাল সকাল কার ঠেকা পড়েছে তার এই মুখ ঝামটা শোনার, আর শুনলেও তাকে ছেড়ে দিত? সুদে আসলে মিটিয়ে দিত ধুলির মুখঝামটা। তিনধাপ নেমে, ধুলি বাসির কাছে দাঁড়াল, বাসির থুতনি ধরে বলল— ‘কিরে রাগ করেচিস? ওসব ভুলে যা, হঠাৎ মাতাটা গরম হয়ে উটেছিল। যাঃ, থলি নিয়ে আয়, বাজারে যাবি তো?'
ধুলির কথায় বাসি ফিক করে হেসে ফেলে, দু ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ে হাসিমাখা গালে। বাসি বাজারের থলি আনতে দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরের দিকে। তার দৌড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ধুলির মুখেও অল্প হাসি ফোটে।
কাল সন্ধের ঝোঁকে ঠিক যখন সেজেগুজে সে রেডি হচ্ছে, পাঁচু বদ্যি সুড়সুড় করে ঢুকে পড়েছিল তার ঘরে। ব্যাটা একনম্বরের মেনিমুখো, অলক্ষুণে আর উনপাঁজুরে। বদ্যির নামে ঢেঁড়াকাটি, মিনসে ক লিখতে কলমভাতে। জুতোর চামসে শুকতলার মতো মুখটা তেলপানা করে, সে যখন বলে, আমি হলাম গে পাঁচকড়ি বদ্যি। সে রগড় বড়ো কম নয়। তাদের পাড়ায় হাসির হল্লা ওঠে, মুখ খারাপের কল্লা ওঠে। মাসী ঘরের চালে ঝোলা এত্তবড়ো কদুর মতো দুই বুক দুলিয়ে বলে—ওলো শোন লো শোন, ভারেণ্ডাও বিরিক্ষি আর ত্যালাপোকাও পক্ষি। বদ্যি ব্যাটা যম হাতুড়ে, মিনসে বড়ো মাগ কাতুরে। ব্যাটা ভদ্দরনোকের পাড়ায় কল্কে পায় না, তাই চলে আসে আমদের বগলতলায়, আমাদের গা শুঁকতে।
পাঁচু বদ্যি, বদ্যি হোক বা না হোক, ধুলিকে একবার যে যমের দোর থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল সে কথাটা সত্যি। আর তারপর থেকেই মুখপোড়া মিনসে তার ন্যাওটা হয়ে বারে বারে ফিরে আসে। এত গাল খায়, নাতি-ঝ্যাঁটা খায় তবু হপ্তায় দু তিনবার তার আসা চাই। শ্যাওড়া ঝোপের ভুতের মতো কেলে হাঁড়িপানা মুখে পাকা চালকুমড়োর বীজের মতো দাঁত বের করে কি তার হাসি। দেখলে গতর রীরী করে। তবু এমন নেই আঁকড়ে দুনিয়ায় দুটো নেই। ঠিক সন্ধের ঝোঁকে আসে। সঙ্গে আনে রুটি আর মাংসের ভাঁড়। সঙ্গে একটা বোতল। কালও এসেছিল। ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর রুটির ঠোঙা আর ভাঁড় রেখে, বোতল নিয়ে জাঁকিয়ে বসল এসে ধুলির বিছানায়। চুল বাঁধছিল ধুলি, লাল ফিতের একটা প্রান্ত ধরেছিল দাঁতে, ঝেঁঝে উঠে বলেছিল—‘আজও এসে পড়লি হাড় জ্বালাতে? হাভাতে মিনসে, বিছানায় বসেছে যেন আমার সাতকেলে ভাতার। তোর জ্বালায় যে আমার রোজগার পাতি বন্ধ হবার যোগাড়, সে কতাটা জানিস, মুখপোড়া?'
পাঁচুবদ্যি তার মুখভর্তি চালকুমড়োর দানা সাজিয়ে হাসল, বলল— ‘বেশ হবে, চুলোয় যাক তোর রোজগার পাতির ধান্দা। কতবার তোকে বলেচি বল, আমি তোকে পুষবো। তুই শুধু আমার ...’
‘পুষবো, হাঘরে মিনসে, আমি কি বেড়াল ছেনা নাকি চন্ননা পাকি? বলি মুরোদ আছে? বে’ করে তোর ঘরে তুলতে পারবি?'
‘এ কতাও তোকে কমদিন বলেচি, বল? যাবি তো চল, কালই তোকে বে করে নে যাবো। যাবি? আমার সাতকুলে কেউ নেই, আর তোর সব থেকেও কেউ নেই, কিসের পিছটান বল দিকি?'
সারাটা রাত কাটিয়ে, ভোর রাতে বেরিয়েছিল পাঁচু। কালরাতে ধুলির রোজগার বলতে পাঁচুবদ্যির দেওয়া পঞ্চাশটা টাকা আর মদ রুটি মাংসের আধা বখড়া। বাজারের থলে আর ওই পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে ঘরের দরজায় শেকল তুলতে তুলতে ধুলির ঢেকার উঠল—মাংসের ঝোলের গন্ধ মাখা টক টক জল, আক্খুটে মিন্সে কোন হোটেলের মাংস এনেছিল কে জানে, শালা টোকো ঢেকারে গলা জ্বলে উঠছে ধুলির। মনে মনে অশ্রাব্য একটা গাল দিয়ে ধুলি উঠোনে নেমে হাঁক পাড়ল—‘কোন চুলোয় গেলি রে, বাসি। বাজারে যাবি বললি যে?'
খালপাড়ের পায়েচলা রাস্তাটা গিয়ে মিশেছে বড়ো রাস্তায়। নামেই বড়ো রাস্তা, বাস চলে না, বড় জোর মটোর গাড়ি আর রিকশ চলে। এই রাস্তা রেল লাইন ক্রস করে চলে গেছে বাজারের দিকে। বাজারের মোড়ে মেন রোড, এই পথে বাস চলে। ওদিকে ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি আর এদিকে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি পর্যন্ত এলিয়ে পড়ে থাকে সেই রাস্তা। লোকবোঝাই বাসগুলো কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায়। ড্রাইভার কণ্ডাক্টার খালাসি চা খায়, বিড়ি টানে, তারপর ক্যাঁকক্যাঁক-ক্যাঁকক্যাঁক হরেন বাজিয়ে, কানের মাথা চিবিয়ে, দৌড়ে চলে যায় গন্তব্যের দিকে।
রেলক্রসিংয়ের বাঁদিকে বেশ কিছুটা তফাতে লোকজনের জমায়েত্টা চোখে না পড়ে উপায় নেই। ভীমরুলের চাকের মতো কিছু ঢুকছে, কিছু বেরুচ্ছে। আর অনবরত ভনভন করে চলেছে। মজা দেখার লোকের কোনদিনই অভাব হয় না। এখানেও হয় নি। গুচ্ছের হাটুরে বাটুরে লোকের ভিড়ের মধ্যেও চোখে পড়ছে দুজনের খাকি উর্দি। তারমানে পুলিশেরও উদয় হয়ে গেছে। কৌতূহল মিটে যাওয়া একটা লোক সাইকেলে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলতে বলতে গেল ‘একদম কিমা বানিয়ে দিয়ে গেছে মাইরি...চেনার উপায় রাকে নি শ্লা।'
বাসি বলল ‘দিদি চ না একবারটি দেখে আসি।'
ধুলি ভিড়ের দিকে একবার তাকিয়ে নাক বেঁকাল—‘যেতে হয় তুই যা, আমি এইখানে ডাঁড়াচ্ছি, ওই গাদাগাদিতে আমি নেই বাবা।’
বাসি ক্ষুণ্ণমনে একবার তাকাল ধুলির মুখের দিকে, বেচারির খুব কৌতূহল, কিন্তু একলা যেতেও ভরসা হচ্ছে না। ধুলির হাত টেনে বাসি বলল ‘ও দিদি, চল্ না। একবারটি। যাবো আর চলে আসবো।'
বাসির আগ্রহে শেষমেষ রাজি হল ধুলি, ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল।
সাইকেলটা পড়ে আছে লাইনের একটু বাইরে, দুমড়ে মুচড়ে বড়ো সাইজের সেপটিপিনের মতো হয়ে গেছে। আর লাইনের ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে কালচে হতে থাকা রক্তের দাগ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাংসের টুকরো। মানুষ বলেও চেনা দায়। শরীরটা যে মানুষের বোঝা যায় জামা প্যান্টের টুকরো দেখে। নীল সাদা ডোরাকাটা জামার টুকরো আর খয়েরি প্যান্টের অবশিষ্ট। এই জামা ধুলি চেনে, চেনে বাসিও। এই জামা পরেই কালও এসেছিল সেই আক্খুটে মিনসেটা। পাঁচুবদ্যি। আদতে সে বদ্যি কিনা কেউ চেনে নি, আজও যেমন তাকে কেউ চিনতে পারে নি তার টুকরো হয়ে যাওয়া মাংসের তাল দেখে।
বাসিই প্রথম কথা বলল—‘ও দিদি, এতো পাঁচু বদ্যি গো।'
ধুলি আনমনে চেয়ে থাকল লাইনের দিকে। একটা নেড়ি কুকুর ঘুরে ঘুরে শুঁকে বেড়াচ্ছিল রক্তের দাগ আর ছিটিয়ে পড়ে থাকা পাঁচুবদ্যির টুকরোগুলো। ধুলি কোন উত্তর দিল না।
বাসি ধুলির একটা হাত ধরে বলল—‘দিদি এ পাঁচু বদ্যি না?'
অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা খাকি উর্দিধারি পুলিশের কানেও কথাটা পৌঁছল। আশে পাশের ভিড় সরিয়ে সে এগিয়ে এসে কটকটে চোখে বলল ‘আপনারা একে চেনেন?'
পুলিশ দেখে বাসি ভয়ে চুপ করে গিয়েছিল। ধুলি কোন উত্তর দিল না। পুলিশটা আবার জিগ্যেস করল—‘চেনেন? কতার উত্তর দিচ্চেন না কেন?'
ধুলি পুলিশের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল ‘চিনি।'
‘কে মালটা? নাম কি?'
‘পাঁচু, পাঁচু বদ্যি।'
পুলিশের ঘাগু চোখ ততক্ষণে ধরে ফেলেছে ধুলির আর বাসির আসল পরিচয়। এরা বাজারের মেয়ে, সকালে বাজারের থলে নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। স্বাভাবিক পুলিশি বুদ্ধিতে সে বুঝে ফেলেছে এদেরকে সম্মান-টম্মান দেখানোর কোন মানে হয় না। বরং এ ধরনের মেয়েরা তাদের স্বাভাবিক শিকার। শেয়ালের যেমন মুরগি। সাপের যেমন ব্যাং। তার গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসি খেলে গেল— ‘কি করে চিনলি, কে হয় তোদের?'
‘কেউ না।'
‘থালে? কি করে চিনলি?' কোন উত্তর দিল না ধুলি।
পুলিশটা কি বুঝল কে জানে, বলল—‘বাড়ি কোতায়, জানিস?'
‘না।' ঘাড় নাড়ে ধুলি।
‘বাড়িতে কে আছে জানিস?'
‘কেউ নেই।'
‘বাওব্বা, সেটা জানিস? তুইই থালে ওর সবকিচু নাকি রে?' পুলিশের একটা চোখ ছোট হয়ে এল, ঠোঁটের ফাঁকে মিচকে হাসি নিয়ে বলল, ‘তোর নাম কি?'
‘ধুলি।'
‘বটে? ধুলি, ফুলি, ফুলকলি? থাকিস কোথায়?'
‘খালপারে।'
‘সে তো দেকেই বুয়িচি। তোকে যে থানায় যেতে হবে ধুলি। লাশ সনাক্ত করে বয়ান দিতে হবে। আরে শালা লাশই বা বলছি কাকে, মাংসের টুকরো কটাকে সনাক্ত করতে হবে।'
বড়ো রাস্তায় সাইকেল ভ্যান এসে পড়েছিল। দুজন লোক সঙ্গে বাঁশ আর চটের ভারা নিয়ে লাইনের ওপর থেকে তুলে নিতে লাগল পাঁচুবদ্যির টুকরোগুলো। সরকারি ডোম। সাইকেলের সেপটিপিনটা পড়ে রইল লাইনের ধারেই। তাকে তো আর সনাক্ত করার দায় পড়ে নি। এইসব দেখতে দেখতে ধুলি বলল, ‘লাশটার কি হবে?'
‘কি আবার হবে? যা হাল হয়েছে, কাটাছেঁড়ার তো আর বালাই রাখে নি। রিপোর্ট টিপোর্ট লেখার পর, যা করার ডোমেরাই করবে।'
‘সৎকার?'
‘অ্যায়ায়াঃ, সৎকার না হাতি। কেন তুই করবি নাকি, ছেরাদ্দ, কিরিয়া করম?' পুলিশের গলায় বিদ্রূপের সুর।
‘করব।'
‘বলিস কি রে? এত দরদ? তবে যে বলছিলি কেউ হয় না তোর? হিঃ হিঃ হিঃ পীরিতের নাগর, বল?'
ধুলি কোন উত্তর দিল না। বাসন্তীর দিকে ফিরে বলল, ‘আমার ব্যাগ নিয়ে তুই বাজারে যা, বাসি। বাজার হয়ে গেলে কিছু টাকা নিয়ে থানায় আসিস একবারটি।'
‘টাকা? কত টাকা? কোতায় পাবো?' বাসি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল। ধুলি বাসির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে দিল তার গোপন সঞ্চয়ের হদিস।
আগে আগে বাঁশের ভারা নিয়ে ডোম দুজন, তাদের পিছনে দুই পুলিশ, সঙ্গে ধুলি চলল বাজারের দিকে। একটু পিছনে হাঁটছিল বাসন্তী হাতে দুটো বাজারের থলি নিয়ে। ওদের ঘিরে চলছিল নানান বয়সের কৌতূহলী বেকার লোকের ভিড়। তাদের নানান রসাল মন্তব্যে কান পাতা দায় হয়ে উঠছিল সারাটা পথ। সেই বাজারের মোড়ে মেন রোডে পুলিশের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।
বাসন্তী হাঁটছিল আর পিছন থেকে অবাক চোখে দেখছিল ধুলিদিদির দিকে। সে পাঁচুবদ্যিকে অনেকবার দেখেছে তাদের মহল্লায়। সে পাড়ায় এলেই ঠাট্টা এয়ারকির হল্লা উঠে পড়ত, ধুলিদিদি আর পাঁচুবদ্যিকে নিয়ে। সে দেখেছে প্রত্যেকবার মুখরা ধুলিদিদি গালি গালাজে বাপান্ত করে দিত পাঁচুর। তা সত্ত্বেও ধুলিদিদির ঘরে প্রায়ই আসত পাঁচু, এবং ধুলিদিদি ছাড়া কারোর ঘরে ঢোকার চেষ্টাও করেনি কোনদিন। দুপুরের নির্জন অবসরে দুয়েকবার পাঁচুর প্রসঙ্গ তুলে সে ধুলিদিদির কাছে অশ্রাব্য গালাগালি খেয়েছিল। তারপরে আর ধুলিদিদির কাছে কোনদিনই সে পাঁচুর প্রসঙ্গ তুলতে সাহস করে নি। অথচ আজ সেই ধুলিদিদি পুলিশের সঙ্গে চলেছে পাঁচুর লাশের সৎকার করতে! ধুলিদিদির মনের অন্ধকার রহস্যগুলো, বাসন্তীর চোখে যেন ধরা দিল অস্পষ্ট রেখার মতো।
গতকাল ধুলি যখন ঘরে ফিরল, সন্ধ্যে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। অনেকেই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে পড়েছে খদ্দের শিকারের আশায়, তার মধ্যে আছে মালতিও। মাল্তিটা বুকের জামার মধ্যে ন্যাকড়া ঠুসেছে খুব, এমন সেজেছে মনে হচ্ছে ফেটে পড়বে দমাস করে। মালতির সঙ্গে তার একদম বনে না, মাগীর বড্ড হিংসে কুটিল মন, মাসীর কানে দিনরাত মন্তর ঝাড়ে আর কানভাঙানি দেয়। চুকলিকাটা আর চুচকোমোতে পাকা হারামি একনম্বরের। ধুলি ওদের এড়িয়ে যেতে চাইছিল, পারল না। মাল্তি সুরমার গায়ে ঢলে পড়ে বলল, ‘হাঃ, অ দ্যাক লো, অ দ্যাক, পাঁচুবদ্যির বেদবা আসতিসে।'
হেসে ঢলে পড়ল মালতি, গুড়াখুর ছোপে কেল্টে দাঁত বের করে সে কি হাসি, ধুলির গতর যেন জ্বলে যায়। ধুলি কোন জবাব দিল না, মালতি তাও ছাড়ান দিলে না, বলল, ‘এর পর কি করবি রে ধুলি, সাদা থান পড়বি? হবিষ্যি খাবি আর নিরিমিষ ডাঁটাচচ্চড়ি চিবুবি? আর তো তবে পরপুরুষের মাতা চিবুতে পারবিনি ধুলি ...’
‘তোর মাতা চিবুবো, আঁটকুড়োর বেটি। তোর চোদ্দ গুষ্টির মাতা চিবুবো, নচ্ছার হারামাজাদি।' ধুলি হিসহিসিয়ে উত্তর দিল।
চোখ ঘুরিয়ে মালতি একইরকম ঢলে পড়া ভঙ্গিতে বলল—‘আমাদের মাতায় কি আর সে রস পাবি রে, ধুলি। ঘরে যা না, মাসি তোর কেমন মাতা চিবোয় দেখ গা। তোর গুমোরের মুখে নুড়ো ঝ্যাঁটা কেমন গুঁজে দেয় দ্যাক।
সে কথা ধুলির চেয়ে বেশি আর কে জানে। দুপুরে বাসি যখন তার কাছে থানায় গেছিল, বাসির মুখেই সে শুনেছে, পাড়ায় তাকে নিয়ে রীতিমতো সভা বসে গেছিল মাসীর ঘরে। ঘরের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে মাসী নাকি তার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছে। সঙ্গে বাসিকেও ছেড়ে কথা বলে নি। ধুলির প্রতি বাসির উথলে ওঠা দরদ আর দিন রাত্তির গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করা একদিনেই বের করে দেওয়ার হুমকিও শুনতে হয়েছে বাসিকে। তার নিজের যাই হোক, তার জন্যে বাসির দুর্গতি হোক এটা ধুলি মোটেই চায় না।
কাল সেই সন্ধেয় ফেরার পর থেকে মাসির বুলি শুরু হয়েছে, রাত্রে কিছুক্ষণের জন্যে বিরাম ছিল, সকাল থেকে আবার শুরু হয়ে গেল। আজ ধুলির ঘুমই ভাঙল মাসির মধুর বচনে। ধুলি ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় এসে বসল। মাসি ঘর থেকে বের হয় নি এখনো, কিন্তু ঘর থেকেই মাসির গলা শোনা যাচ্ছে এমনই সে গলার তেজ—
‘পাঁচুবদ্যি তোর কোন বাবাকেলে ভাতার রে, আবাগির বেটি। সে হারামজাদার পোষা রক্কিতেও তো তুই নোস। তার জন্যি তোর এত কিসের দরদ লা? সে মড়া তো মরে বেঁচেছে। তুই কেন তার জন্যি পুলিশের খপ্পরে গিয়ে ঝাঁপালি, মুখপুড়ি হারামজাদি? জানিস না, পুলিশ একবার ছুঁলে বায়ান্ন ঘা! এরপর পাড়ায় যদি পুলিশের আসা যাওয়া চালু হয়, তাহলে তোর কিন্তু এ পাড়ার বাস তুলে ছাড়বো হতভাগি, অলুক্কুণে হাড়জ্বালানে। নাতি মেরে বের করে দেব রাস্তায়। আমার বুকের ওপর বসে তোর ঐ বাঁটনা বাঁটা চিরজম্মের মতো যদি ঘুঁচিয়ে দিতে না পারি তো আমারও নাম ...’
ধুলি পাঁচ নম্বর উকুনটা মেরে, ছ’ নম্বরটাকে চুলের গোড়া থেকে তুলে আনল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে চেপে সবে মারতে যাবে, এমন সময় বাসি এসে তাকে ডাকল। বাসির দুচোখে শঙ্কার ছায়া, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল—‘তোর তো জমানো পয়সা সব শেষ, ধুলিদিদি। আজ বাজার যাবি কি করে? খাবি কি?'
বাসি জানে, কাল সকাল থেকে এখনো পর্যন্ত জল ছাড়া একটি দানাও ধুলির পেটে পড়ে নি। কাল রাত্রে বাসি অনেকবার ভেবেছিল, তার খাবারটা ধুলিদিদির সঙ্গে ভাগ করে খাবে। কিন্তু সাহসে কুলোয় নি, ধুলিদিদির প্রতি তার এই আদিখ্যেতা পাড়ার চোখে পড়বেই, মাসির কানে সে কথা তুলে দেবার লোকেরও অভাব হবে না। আর একথা জানাজানি হলে আগুনে ঘি পড়ার মতো কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।
ধুলি কোন উত্তর দিল না দেখে বাসি নীচুস্বরে আবার বলল—‘আমার থেকে চুপিচুপি কিচু ধার নে, দিদি, পরে শোধ করে দিস। এখন চ বাজার যাই। কাল থেকে কিচু খাস নি, রান্না বান্না করে দুটো মুখে দে, দিদি।'
ধুলি তাও কোন উত্তর দিল না। সে ঠিক করেছে আজ একবারের জন্যেও চোখ সরাবে না। কাল উকুনটা পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আজ আর নয়। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখে চেপে পুটুস করে উকুনের শরীরটা ফাটিয়ে দেওয়ার আগেই ঝাপসা হয়ে এল তার দৃষ্টি। তার দুচোখে ভরে উঠল জল, আর সেই সুযোগে পালিয়ে বাঁচল ছ’ নম্বর উকুনটা। জলভরা চোখে বাসির মুখের দিকে তাকাল ধুলি, বাসির মুখটাও ঝাপসা। অস্ফুট স্বরে ধুলি বলল, ‘হারামি শালা।'
কাকে বলল, পালিয়ে যাওয়া উকুনটাকে, মাসিকে, নাকি এই অসময়ে জল বয়ে আনা তার দুটো চোখকে?