তখন আমরা চীরকুণ্ডা থানায়। সে সময় চীরকুণ্ডা ছিল বাংলা বিহারের বর্ডার থানা। পশ্চিম বাংলার দিকে পড়ছে বরাকর আর বরাকর নদীর ওপরের ব্রিজ পেরিয়েই চীরকুণ্ডা। তখন খুব সম্ভব নাইনে পড়ি। শাড়ী পরার খুব শখ। নিজেকে লেডি প্রমাণ করার (বড় হয়ে গেছি তা সকলকে বোঝানো) একটা সহজ উপায় ছিল শাড়ী পরা। সালোয়ার কামিজ, লং স্কার্ট, জিনস--এসবের চলই ছিল না। বাবা আমাকে একটা গাঢ় গোলাপী রঙের কমলাটে হলুদড়-পাড় শাড়ী কিনে দিয়েছিল, সেটা আমার এত ভাল লাগত যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব পরতাম। একদিন চান করতে গিয়েছি, শাড়ীটা আর গামছা দেওয়ালের ওপর রেখেছিলাম চান সেরে পরব বলে। কি দেখলাম জানো? আঁচলের কাছটা ভিজে ভিজে লাগছে, কেমন যেন চিবনো চিবনো মত। আমাদের কালিন্দী গরুর মেয়ে ধবলীর কাপড়-জামা চিবনো স্বভাব ছিল। চানঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখি ঠিক যা ভেবেছি তাই, উনি আমার শাড়ী দিয়ে জলযোগ সেরে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কি আর করা, বাড়ির পোষা গরুর গায়ে চট করে হাত তোলা যায় কি?—দিম্মুআনু এই মেলে তোকে আমাদের চানঘরগুলোর কথা একটু বলতে ইচ্ছে করছে। আজকের দিনে চানঘর আর আমরা বলি না, মা অবশ্য বিহারীদের দেখাদেখি বলত গোসলখানা। এখন এদের সাজসজ্জার বাহার যেমন বেড়েছে নামও পাল্টে গেছে--আমরা বলি বাথরুম। তা আমাদের সব থানার চানঘরই ছিল উঠোন পেরিয়ে একটা এক মানুষ উঁচু দেওয়াল ঘেরা জায়গা। কোথাও কোথাও তার ওপর টিনের চালা থাকত কোথাও খোলা আকাশ। কিন্তু আশপাশের সব বাড়িই এক তলা ছিল বলে চিন্তা ছিল না। রাতে ঘর খুলে উঠোন পেরিয়ে চানঘরে যেতে কোনোদিন ভয়ও করেনি। তবে তাল গাছে তাল পাড়ার জন্য লোক উঠলে তারা ‘তাড় তাড়’ আওয়াজ দিয়ে জানান দিত চানঘরে সে সময় জেনানারা যেন না যায়--সে সময় এটাই ঠিক ছিল, আজ ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এসে যায় ফেলে আসা দিন গুলোর কথা ভেবে। কিন্তু তোমার মার দিদার হাতে আমদের ওইসব সামান্য বাড়ি, চানঘর আয়নার মত ঝকঝক করত তাও মনে পড়ছে। আদর জেনো।
স্নেহের আনু,
একদিন তুই বলেছিলি পোস্ত বড়া তোর খুব খুউব ভাল লাগে। আরে আমারও যে তাই। জানিস আনু অনেক দিন তোকে এক নামে ডেকেছি। কদিন অন্য নাম দিতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে। চল আজ থেকে তুই হলি আমার পোস্ত বড়া! এতে তো কারো ক্ষতি হবে না, কি বল, এখানে তো কেবল তুই, আমি আর আমদের ছোট ছোট গপ্পো ভরা মেলের দুনিয়া।—দিম্মাআজ তোকে আমাদের বাড়ির পোষা পাখি, গরু, কুকুরদের কথা বলব। ধবলীর পরই মনে আসছে কালিন্দী (ধবলীর মা), জলি, টমি ও রুপুর কথা। আজ এরা কেউ আর নেই রে কিন্তু প্রিয় দিম্মা ঠাম্মার কথা ভাবলে যেমন হাসি আপনি আপনিই এসে যায় তেমনি ওদের নানা রকম দুষ্টুমি-ভরা কাণ্ডকারখানার কথা ভাবলেই মনটা খুশী খুশী হয়ে ওঠে।
কালিন্দীকে আমার বাবা তখনকার দিনে ছয়শো টাকায় কিনেছিল, বাবাই নাম দিয়েছিলো কালিন্দী, কালো রঙের গরু বলে। ও কিন্তু খুব কালো ছিল না, একটু খয়েরী রঙ মেশানো ছিল, এই ধর না খানিকটা তোর মাথার চুলের মত। কালিন্দী এত শান্ত ছিল যে ওর শান্ত ভাবটা ফুটে উঠত ওর চোখে। এমনিতে লোকে বলে কেমন যেন গরুর মত বোকা বোকা ভাব। কিন্তু আমার কালিন্দীর চোখ দুটো বেশ লাগত। কেমন ঠাণ্ডা, মা লক্ষ্মীর মত। (মা লক্ষ্মী শান্ত, ধীর এমনটাই আমরা ধরে নিয়েছি, তাই বিশেষ করে মেয়েদের আমরা ভাল বলতে চাইলে লক্ষ্মী মেয়ে বা লক্ষ্মীশ্রীই বলি কিন্তু এটা জানবি আমাদের এই লক্ষ্মী মেয়ে কিছু ব্যাপারে খুবই চঞ্চলা, মানে খুব ছটফটে, একটু নোংরা ঝোংরা সইতে পারেন না)। তা আমাদের এই কালিন্দী দিনে ছ-সের দুধ দিত--সকালে তিন বিকেলে তিন। (সেরের মাপ আর নেই, এখন দুধ, জল বা তেলের মাপ তো লিটারেই হয়)। মা মনের আনন্দে নানান খাবার বানাতো, কখনো পায়েস, কখনো ক্ষীরপুলি। আবার ছুটিতে বাড়ি আসার সময় হলে আমার জন্য থাকত বড় কাঁসার বাটিভরা ঘন ক্ষীর! যেটা আমার ভাল লাগত না সেটা হ’ল সারাদিন কাঠের মরা আঁচে বসানো ঘন হয়ে যাওয়া দুধ গরমের দুপুরে (তাও আবার বিহারের গরমকালে), এই চারটে পাঁচটার মাঝামাঝি খেলতে যাওয়ার আগে খেয়ে বেরনো--কিন্ত আমরা মা হলেও মা দুগ্গা তো আর ন’ই যে সবার মন বুঝে ফেলব! কিছু করার ছিল না তাই। তবে এখন মনে হচ্ছে বাড়িতে একটা টম ক্যাট থাকলে বেশ হ’ত তাই না?
মরা আঁচ কথাটা তোর কাছে নতুন তাই লিখছি কাঠের উনান যখন নিভে যায় তখনো তার খানিকটা আগুন ছাইচাপা থাকে। তাকেই বলে মরা আঁচ। আমাদের ফ্রিজ ছিল না তাই মা ডেকচি ভরা বাড়ির গরুর ঘন দুধ উনানে বসিয়ে রাখতো, আঁচে থেকে থেকে সেই দুধ আরো খানিক ঘন হলদেটে হয়ে উঠত--শুধু দুধের কথাই কেন আজ সেই আঁচে বসানো কালো তেবড়ে যাওয়া, টোল খাওয়া ডেকচিটাও চোখে ভাসছে, মার বাড়ির অতি সাধারণ বাসনটাকেও যেন কত একান্ত নিজের মনে হয়।
এই কালিন্দীই যখন বুড়ো হয়ে গেল বাবা তখন ওকে বেচে দেবার কথা ভেবেছিল, মা বলেছিল ‘ও খুব লক্ষ্মীশ্রী, দুধ দিতে না পারলেও বাড়িতেই থাক।' তবে শেষ পর্যন্ত কালিন্দীর কি হয়েছিল আমার মনে নেই। জানিস আনু, জীবজন্তু পোষার সমস্যা এই যে শেষ দিন অবধি আমরা তাদের যত্ন করতে পারি না। বিশেষ করে গরু বা ছাগলের। দু্ধ দেওয়া বন্ধ করলেই মনে হয় ওদের জন্য খরচ করে লাভ নেই। আমেরিকায় শুনেছি পোষা জীবজন্তুকে কষ্ট দিলে তার শাস্তি আছে। আমাদের দেশেও বড় বড় শহরে কিছু ব্যবস্থা আছে যার দ্বারা জীবজন্তুদের প্রতি কষ্ট দেওয়া বন্ধ করা যায়। আজ এখানেই শেষ করছি। পরের মেলে জলি টমির কথা লিখছি। আমাদের কালিন্দীকে তোমার কেমন লাগল জানিও।
স্নেহের
পোস্ত বড়া বাবু,
লিখেছিস মা লক্ষ্মী কি তোর মত ছটফটে? ঠিক তোর মত না বোধহয়। তুই এখনও ছোট, খেলে বেড়াস, তাই তোকে বলি চঞ্চল, ছটফটে। আর মা লক্ষ্মী অগোছালো নোংরা বাড়ি দেখলেই সেখানে থাকেন না। তাই ওনার আর এক নাম চঞ্চলা। আর মা না থাকলে সে ঘরে শান্তি নেই, আমরা তাই বলে থাকি। তা যাই হোক এই মেলে জলি, টমি, রুপুর কথাই বলব--তুই ভারি ব্যস্ত হয়েছিস ওদের গল্প শুনতে। তবে মামের কাছে জানলাম তুমি নাকি একটা দুধেলা গাই পোষার জন্যও তাকে ব্যস্ত করেছ। সোনা আজকের দিনে তোদের ওই এপার্টমেন্টে তো কেউ গরু পুষতে দেবে না, তবে বড় হয়ে ইচ্ছে হ’লে তুমি একটা ফার্ম হাউস করতে পার যেখানে তুমি অনেক ভাল জাতের গরু রাখতে পারবে। তবে তুমি বোধহয় একটু একটু আমারই মত, আমার কি ইচ্ছে করে জানো? পিছনের বাগানে একটা বাচ্ছা হাতি পুষতে আর মাঝে মাঝে তার পিঠে চড়ে বেড়িয়ে বেড়াতে।--দিম্মাএবার আসি বাকিদের কথায়। আমাদের জলি খুব ছোট্ট সাদা কালো মেশানো নেপালী কুকুর ছিল। সারা গা কালো আর পেটটা সাদা। ও টমির অনেক পরে আমাদের বাড়ি এসেছিল কিন্তু কি জানি কেন আমরা সব সময় বলতাম জলি টমি। জলি ভীষণ বদমেজাজি, রাগী ছিল কিন্তু আমরা দুই বোনে ওকে নিয়ে কত খেলা করেছি। আমার বোন ওকে চাদরে বেঁধে পিঠে ফেলে বলত ‘চল তোকে ধোবার বাড়ি দিয়ে আসি, বড্ড ময়লা হয়েছিস।’ কখনো হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ওর গায়ের এঁটুলি বেছেছি আমরা।
টমি ছিল সাদা ধবধবে, গা ভর্তি ভেড়ার মত পাকানো পাকানো লোম, মাথাটা কালো, মধ্যিখানে সাদা সিঁথি, মেজাজটিও ভেড়ার মত ঠাণ্ডা। জলি ওকে হাজার বকলেও গায়ে মাখত না। তবে দুজনেই কালিন্দীকে খুব বকত। টমি খেতে ভালবাসত কমলালেবু আর গরম ফুলকো রুটি দেখে জলির সে কি নাচ।
রুপু আমাদের পোষা টিয়া। মার কাছে শুনেছি আমাদের এক সিপাহীজী ছ-আনা পয়সা দিয়ে রুপুকে কিনে দিয়েছিল আমার বোনকে। এইখানে বলি রুপু নামটা কিন্তু আমাদের দেওয়া নয়। বিহারে বোধহয় সব টিয়াকেই সাধারণ মানুষ রুপু বলত। বাবা চাইত রুপু খুব হরে কেষ্ট হরে রাম বলুক। কিন্তু ও সীতারাম বললেও বাড়ির যে যা বলত খুব তাড়াতাড়ি তা শিখে ফেলত। আমরা বলতাম ‘রুপু সীতারাম’ তাই ও-ও পুরোটাই বলত। আবার আমার মা ওর এইরকম কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠত বলে কিছুদিন পরই সীতারামের সাথে মায়ের হাসি জুড়ে দিয়ে পাখি বলত ‘রুপু সীতারাম হা হা’। আর বাবা বলত ‘তোমার পাখি কেবল ছোলা ধ্বংস করে ঠাকুরের নাম করে না।’ পোষা পশু-পাখিদের কথা বলে ফুরোবার মত নয় বোধহয়--বিকেল চারটে বাজলেই আমাদের তারাচাঁদকে (আমার বোন সদ্য ইংরেজি শিখে যার নাম দিয়েছিল মুন স্টার) রুপু বলত ‘ইকুলে যা কুঁড়িকে নিয়ে আয়।’ কচি নামটা পাখির কাছে হয়েছিল ‘কুঁড়ি’। এছাড়া জলি টমি কালিন্দীকে বকা ঝকা করা তো ওর একটা বড় কাজই ছিল। এদের নিয়ে হাঁস মুরগিদের নিয়ে আমার মা বেশ আনন্দেই দিন কাটাত। হাঁসের ছানা ফুটলে প্লাস্টিকের গামলায় জল আর ফুল দিয়ে তাদের সাঁতারও শেখাত।
আবার এক থানা থেকে বদলি হয়ে অন্য থানায় যাওয়ার সময় হাঁস মুরগি, কুকুর খাট-বিছানার সাথে উঠত লরির পিছনে, মা বাবা বোনকে নিয়ে লরির সামনের সীটে, রুপু থাকত খাঁচাশুদ্ধু মায়ের কোলে। (আনাই মনে একটা ছবি ভেসে উঠল, তুই অনেক অনেক ছোট তাও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বলেই নি কি বলিস? বড় হয়ে তুই না হয় মিলিয়ে নিস। মনে পড়ে গেল টমাস হার্ডির ‘ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড’-এর কথা যেখানে নায়িকা বাথশিবা এভারডিন মালপত্তর বোঝাই ঘোড়ার গাড়ির ওপর বসে আছে; পাশেই খাঁচায় পোষা ক্যানারি পাখি।)
আসলে কি জানো পোস্ত বড়া বাবু, আজকের দিনে এই ধরনের জীবন কেউ ভাবতেই পারবে না। কিন্তু আজ সব ভেবে মনে হয় আমার বাবা-মা এই ঘুরে ঘুরে চাকরি ভালোই বেসেছিল। আদর জেনো।
আদরের পোস্ত বড়া,
মেলে জানতে চেয়েছিস ছ-আনা কী। জানিস আমি লেখার পরই ভাবছিলাম এটা তুই জানতে চাইবি। এখন ভারতে আমরা একশো পয়সায় এক টাকা ধরি। যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন ষোলো আনায় এক টাকা ধরা হ’ত। সেই হিসেবে ছ-আনা খুব একটা দাম নয়। গল্প মানেই বোধহয় কথার পিঠে কথা। জানিস এই ষোলো আনা শব্দটা চির কালের হয়ে আছে এক মহান সাধকের কথায়। তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ। উনি কাউকে সব দেওয়ার কথা উঠলে বলতেন ‘তোকে ষোলো আনাই দোব’। কারণ ষোলো আনার পর এক টাকা হয়ে যায়, বাকি কোনো আনা আর নেই। এখানে ষোলো মানে পুরোপুরি। গল্পও হ’ল, খানিক বাংলাও শেখা হ’ল,--কি বলো?--দিম্মাআনাই, এতদিন তোকে বিহারের কথাই বলেছি, আজ খড়্গপুরের (যেখানে আমরা এখন আছি) গল্প করব।
কানে আসছে লোহার উপর হাতুড়ি পেটার শব্দ, আর গতকাল থেকে জানলার বাইরে চোখ পড়লেই দেখছি বাড়ির সামনে শ্রীবাস্তব আন্টির বেড়ার ধারের ল্যাম্প পোষ্টটা ভাঙার কাজ চলছে। তোমাকে মেল করাই হয় নি অনেক দিন, তাই বোধহয় জানো না আমাদের খড়গপুর আই,আই,টিতে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েরিংএর (মাটির তলা দিয়ে তার নিয়ে যাওয়া) কাজ শুরু হয়েছে। কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে আর সেই মাটি খোঁড়াখুঁড়ির জেরে আমাদের বাগানের কি হাল হয়েছিল কি বলি।
আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েরিংএর উপকারিতা অনেক শুনেছি কিন্তু ওভারহেড ওয়েরিং দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। বিকেলবেলা ডেয়ারী ফার্মের কাছের ওভারহেড তারে বাঁশপাতি পাখিরা খুব কিচির মিচির করে ঝাঁক বেঁধে এসে খানিক বসে আর গোল হয়ে হয়ে উড়ে যায়। পড়ন্ত রোদে ওদের ডানা কেমন কচি কলাপাতা রঙ ধরে আবার ছায়ার দিকে ঘুরে গেলে গাঢ় সবুজ দেখায়। হাঁটতে বেরিয়ে তোমার মাসি আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখি। আর আমাদের বাড়ির সামনের ইলেকট্রিক তারে ঠিক সন্ধেবেলা বসে থাকে ফিঙে আর খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকে টিউব লাইটটার দিকে, উদ্দেশ্য একটাই--সুযোগ বুঝে পোকা ধরে খাওয়া। জানোতো আনু খুব মেঘ করলে তারগুলো সেই মেঘ-মেঘ আকাশের গায়ে একরকম লাগে, আবার শীতকালের নরম রোদে আর এক রকম। আর খুব জোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলে জলে ভেজা কাক যখন মাথা ঝাঁকিয়ে তারে বসে গা ঝাড়ে বেশ মজা লাগে দেখতে। কখনো আবার যদি দেখি তারে আটকে একটা মরা বাদুড় ঝুলছে মন খারাপ লাগে।
সব কিছু ঠিকভাবে চলার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েরিংএর প্রয়োজন আছে মানতেই হয়। কিন্তু আমার আর তোমার মাসির মত মানুষদের তাকিয়ে থাকার একটা দৃশ্যও বোধহয় অনেকটাই পালটে গেল। হারিয়ে গেল পাখিদের দোল খাওয়ার একটা জায়গা।
তবে মন বোধহয় কেবল মানুষেরই খারাপ হয়, ইলেকট্রিকের তার নেই ঠিকই, কিন্ত পাখিদের মন খারাপ দেখছি না খুব একটা, ওরা দিব্যি দোল খাচ্ছে কেবেল টিভির তারে।
-দিম্মা
পুনঃ- বাঁশপাতি নামটা আমার বাবার কাছে শুনেছিলাম। স্বনামধন্য পক্ষীবিদ শ্রদ্ধেয় সেলিম আলি তাঁর ‘বুক অফ ইণ্ডিয়ান বার্ডস’-এ বলছেন এই পাখিদের বাংলা নাম ‘বাঁশপাতি’। হিন্দী নাম ‘পতরিঙ্গা' বা 'হরিয়াল’। ইংরাজি নাম ‘স্মল বি ইটার’। ‘বুক অফ ইন্ডিয়ান বারডস’ ১৮৮ পাতা, সেকশন ২৯৫, প্লেট ৩৮, নম্বর ৪। মামকে বোলো বইটা পেলে তোমাকে পাতা খুঁজে দেখিয়ে দেবে। আমার কাছেও বইটা আছে, তুমি যখন আসবে তখন নাহয় দেখিয়ে দোব।
আমার আদরের সঞ্চাই মন ছোটপানা মন,
এবার ক্যাম্পাসের আমগাছ গুলোতে খুব আম ধরেছে। তুমি তো মার সাথে মার্কেটে গিয়ে আম কিনে আনো, গাছে ঝুলন্ত আম কিন্তু ভারি সুন্দর লাগে দেখতে। আর ঝড়ে পড়ে যাওয়া আম কুড়োতে তো ভারি মজা! সুফলা দিদির ছেলেমেয়েরা গ্রাম থেকে পড়তে এসে, বই খাতা ফেলে আম কুড়োবার জন্য যা হুটোপাটি লাগিয়ে দেয় তা দেখার মত।--দিম্মাআমাদের আমের চাটনি খাওয়ার ইচ্ছে হলে বাজারে দৌড়তে হয় না। বড় একটা লগা নিয়ে টুলের ওপর চড়ে পেড়ে নিলেই হ’ল। আগে লগা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলি। একটা খুব লম্বা বাঁশের সরু দিকের মুখটা অল্প চিরে আর একটা পাতলা ইঞ্চি দশেক লম্বা বাঁশ আটকে দেওয়া হয় তাতে যাতে করে যে কোনো ফলকে পেঁচিয়ে টান মারলেই সেটা পড়ে যায় গাছ থেকে। অনেক সময় বাঁশের ছোট কঞ্চি না পাওয়া গেলে একটা শক্ত লোহার হুক (বেশ বড় জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত) বেঁধে দেওয়া যেতে পারে।
তবে চুপি চুপি অন্যের বাড়ির বেড়াগেট ঠেলে ঢুকে আম কুড়োনোতে একটা দুষ্টুমি ভরা আনন্দ লুকোনো থাকে, সময় পেলে খুঁজে দেখিস। ছোটবেলা তোর দাদুনও নাকি প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় গামছা পরে কোন বুড়ির বাড়ির পেয়ারা পাড়ত।
বারান্দায় বসে তোকে মেল করছি আর দেখছি যারাই পথ দিয়ে যাচ্ছে তাদের মাথা ঘোরানো মোরামে পড়ে থাকা আমের দিকে--হাতে বড় বড় প্ল্যাস্টিকের ঝোলা। আমার বাগানের আম, দেখেও নিতে পারছে না ওরা, আমি বসে আছি তাই।
এখন সকাল ছটা, মুখ তুলে দেখলাম দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গেটের কাছে ঘোরাঘুরি করছে। ইচ্ছে আম কুড়োবে। দরজা খোলার সময়ই দেখেছিলাম দুটো সিঁদুরে আম পড়ে আছে। আমাকে দেখে ক্ষুদে দুটো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গেটের কাছে। অনেক ডাকাতে কোনোরকমে ভিতরে ঢুকে আম কুড়িয়েই দে ছুট!
আর একদিন সকাল সকাল উঠে দেখি ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা জানান দিচ্ছে। ঘর অন্ধকারই ছিল, পর্দা খানিক সরিয়ে দেখি গেটের বাইরে সবুজ শাড়ি পরা ফোল্ডিং ছাতা হাতে এক মহিলা। নজর বাগানের মোরাম রাস্তার ওপর পড়ে থাকা হলদে সবুজ পাকা পাকা আমের দিকে, বড় লোভ লোভ মুখে তাকিয়ে আছেন! খুব আস্তে আস্তে গেটটা খুলেও ফেললেন। আমাকে দেখেছেন কিন্তু। আবার কি ভেবে গেট খোলা রেখেই চলে গেলেন। আমি ডাকলাম, আম নিতে বললাম। উনি কিন্তু পিছন ফিরে দেখলেন না চলে গেলেন।
আমের গল্প সিঁদুরে আম দিয়েই শেষ করব। এত সুন্দর আম আমি আগে কখনো দেখিনি। যত পাকে খোসার রং হলুদ থেকে কমলা, কমলা থেকে লাল হয়ে যায়। খেতেও মিষ্টি, তবে একটু আঁশ আছে এই যা। তোমার দাদুন তাই বিশেষ পছন্দ করেন না। আমার তো বেশ লাগে, নিজের বাগানের আম তো, তাই বোধহয়।
আমের মত মিষ্টি একটা চুমো দিলাম।
আনাই,
অনেকদিন পরে এবার বর্ষা নেমেছে। দিনটা ছিল, দাঁড়া মনে করি তেইশে জুন, প্রায় দশদিন লেট। গত বৃহস্পতিবার ছিল সেদিন। শনিবার থেকে তার জের বেড়েছে। গতকাল ছিল সোমবার। সারাদুপুর সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে জানো, আর এখন দেখছি কাকগুলো ভিজে ভিজে গেটের ওপর বসছে, কি আবার খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে মাটি থেকে, বোধহয় কেঁচো, এতদূর থেকে বুঝতে পারছি না।--দিম্মাএইমাত্র একটা কাঠবেরালি ছুটে পালাল মোরাম দিয়ে। জানিস প্রিন্সটনে দেখেছি বড় বড় খয়রিটে কমলা রঙের কাঠবেরালি। এখানকার কাঠবেরালি ছাই রঙের হয়। পিঠে সাদা কালো ডোরা। সবাই বলে শ্রী রামচন্দ্র পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করেছিলেন, তার দাগ। আর সাইজে ওরা প্রিন্সটনের গুলোর ছোট ভাই-ই বলতে পারিস। আজ এই অব্দি কেমন!