বার্গহফ্গার্টেন! ছোট পাহাড়টার পাদদেশে ম্যাজেন্টা রঙের গোলাপ গুল্মে ভরে রয়েছে। মায়াবী কুয়াশায় মোড়া ‘হেন্ড্রিচ্’ উপত্যকার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে ঘনসবুজ গাছে ভরা শহর—লিনৎজ্। মসৃণ স্বর্গ-কাঁচ ঘষে ঝুলছে মনোহারী বগেন্ভিলা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবিতে বেশ কিছু সময় ধরে যথার্থ এক্সপ্রেশন খোঁজার চেষ্টা করলেন তিনি। পাহাড়-চূড়ায় এই কাচমহলে ইভার সাথে প্রায়ই অবসর কাটাতে আসেন শর্ট-হাইটের অল্পবয়সী জার্মান চ্যান্সেলার। কিছুক্ষণ আগেই তাঁকে সুয়েজ খালসমেত গোটা ইংল্যান্ডটাই মার্বেল প্লেটে পরিবেশন করা হয়েছিল। বিশ্বমানচিত্রের আদলে তৈরী ফর্টি সেভেন্থ বার্থডে কেকে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছে মন্ত্রীসভা। কেকটা থেকে ইংল্যান্ডের অংশটিই প্রবল উচ্ছ্বাসে বেছে নেন ন্যাশনাল সোসালিস্ট। কিছু ক্রিম লেগে আছে এখনও বাটার ফ্লাই গোঁফে যা অনূর্ধ্ব দশ শিশুর সারল্য ফুটিয়ে তুলেছে তাঁর মুখে।
পশ্চিম দেওয়ালের তাকে সারি সারি ফাইল সাজানো। গেহাইমে স্টাটেস পুলিংশাই, সংক্ষেপে গেস্টাপো। তারই এক পাশে ছোট টেবিলটায় বসে লিখছেন তিনি, তাঁর সংগ্রামের দ্বিতীয় সংস্করণের সংযোজনী ইস্তেহার। মেঝেয় হাঁটুমুড়ে বসে তাঁর প্রাণসখা ‘ব্লন্ডি’। তখনই সিঁড়িতে মৃদু পদশব্দ শোনা গেল। ‘হাইল ফ্যুয়েরার!’—প্রচারমন্ত্রী গোয়েবেল্স্। ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে চারটে। ব্যাপার কি? এইসময়?—‘কাম ইন্’।
—’উই গট্ হিম স্যার!’ একটা পরিষ্কার লাল কাপড়ে মোড়া জিনিসটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন মন্ত্রী। ‘দ্য র্যাভেন্'স ডিক্সনারি’। মিউনিখ সেন্ট্রাল চার্চের পার্দ্রী জোনাথনের লেখা। রাগে-ঘৃণায় জ্বলজ্বল করে উঠল ফ্যুয়েরারের সম্মোহনী চোখ। ‘ঐ ডেভিলকে এখনই নিয়ে এসো আমার সামনে!’ তাঁর আজ্ঞাই এ দেশের আইন ও চূড়ান্ত পরিণতি। একটা গোঙানির শব্দ কাছে আসছে ক্রমশ:। রক্তমাখা বেয়নেট হাতে এস. এস. গার্ড হাজির করল তাঁর সামনে জোনাথনকে। সাদা ধবধবে তার ড্রেসে চাপ চাপ রক্তের দাগ। কাচমহলে স্তব্ধতা!
—‘একটা কথা আমি প্রায়ই আমার বক্তৃতায় বলি জোনাথন! মিথ্যাকে ক্রমাগত প্রচার করতে থাকলে তা সত্যি বলে গণ্য হয়। আমাদের ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের বিরুদ্ধে তোমার মিথ্যা প্রচার ফ্রাঙ্কফুর্টের বুকে অনেককেই বিপথে চালিত করেছে। তোমায় আমি শেষ একটা সুযোগ দেব। কাল বার্লিন রেডিওতে অকপটে স্বীকার কর, তুমি যা বলেছো সব মিথ্যা! জিউইশ্ ইন্ফ্লুয়েন্সে, রাজি আছ তুমি?’
—‘নেভার্! আপনার জেনোসাইড কাজকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য আমাদের হাতে আছে। কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পগুলোতে সংশোধনের নামে মৃত্যুযজ্ঞ চলছে! সারা পৃথিবীর কাছে আপনার ভালোমানুষী মুখোশ খুলে দেব আমি!’
—‘তাই? আচ্ছা জোনাথন, তোমার এই ডিক্সনারিতে নাকি ইচ্ছাপূরণের জাদু আছে? সত্যি নাকি? পারবে আমায় বিশ্বের সম্রাট করে দিতে? আর্যাধিপত্য ফিরিয়ে দেবে পৃথিবীতে?’
—‘আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছি স্যার! জানতাম ডিক্সনারিটা খারাপ হাতে পড়তে চলেছে। সো, আই হ্যাভ্ এনচ্যান্টেড ইট্ উইথ্ এ ক্লজ্! আপনি যদি ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা করেন, ইউ উইল্ এনকাউন্টার র্যাভেন!’
—‘ফু:, যত্তসব গাঁজাখুরি। গুডবাই প্রিস্ট, ব্লন্ডি, একে শেষ করে দাও!’
মুহূর্তে শিকারী নেকড়ের মত তাঁর প্রিয় ‘ব্লন্ডি’ ঝাঁপিয়ে পড়ল জোনাথনের উপর। পৈশাচিক আর্তনাদ, নখের আঘাতে ফালাফালা হতে লাগল পার্দ্রী! ফিন্কির মত ছিটকে এল রক্ত তার কাটা নলি থেকে। অপারেশন শেষ করে বিশ্বস্ত অ্যালসেশিয়ান ফিরে এল মনিবের কোলে। তার মাথায় স্নেহের হাত রাখল আগামী ভবিষ্যতের ঘৃণ্য চরিত্রটি। তারপর রক্তলাগা হাতে তুলে নিল ডিক্সনারিটা নিজ ইচ্ছে জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে।
কাচমহলের লাগোয়া বারান্দায় একটা মেপল্ ট্রির শাখা এসে পড়েছে। তাতে কখন যে এস্ এস্ গার্ডদের চৌকষ পাহারা এড়িয়ে অস্ট্রিচের আকারের একটা দাঁড়কাক এসে বসেছে কেউ খেয়ালই করেনি। স্নাইপারের দৃষ্টিতে বিঁধে ফেলেছে তার টার্গেট অ্যাডলফ্কে। সেদিনই যে তাঁর দ্রুত পতনের পরোয়ানা লেখা হচ্ছিল, জানতেই পারেননি নাৎসীসম্রাট!
১৯৪৫ সালের মে মাস। বার্লিনের বহুরূপী আকাশে ভরা অ্যাশট্রের মত শুকনো মেঘেরা ঘাঁটি গেড়েছে। এ মেঘ বৃষ্টির জন্য নয়। ভ. চুইকভের নেতৃত্বে রেড আর্মি যে প্রবল গোলাবর্ষণে হোলি খেলেছে রাইখ্ চ্যান্সেলারি বাঙ্কারে—এ তারই ফলশ্রুতি। কালচে লাল বারুদ রঙে রাঙানো ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়ে রুশ সেনা ইভ্যাকুয়েট করেছে নাৎসী হেড কোয়ার্টার। হিটলারের প্রাইভেট রুম এখন ন্যাড়া শ্মশান। এদিক সেদিক দিয়ে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া, জ্বলছে আগুন। পিয়ানো, সোফা, ভায়োলিন, আধপোড়া লক্ষ লক্ষ ফাইল, বিসমার্কের দশ ফুট উঁচু বুক অবধি ছবি—একে একে সব ট্রাকে তোলা হল। সীমান্ত পেরিয়ে বহুদূর নিয়ে যাওয়া হবে এসব। পৌঁছে যাবে রাশিয়ার আর্কাইভে। পকেট হাতড়ানো খুচরো পয়সার মত এস্. এস্ গার্ডদের হন্যে হয়ে খুঁজছে যমদূতেরা। সিভিলিয়ানদের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের বার্তা—‘প্লিজ আপনারা ভয় পাবেন না। কমরেড স্টালিন ইজ্ ইয়োর ফ্রেন্ড্!’ নাকে আসছে কাঁচা কেরোসিনের গন্ধ, পুড়ছে ন্যাশনালিস্টদের ঘৃণ্য পতাকা! এতসবের মধ্যে ছোট্ট জার্মান ছেলেটা নজর এড়িয়ে গেছে সকলের। বাঙ্কার সংলগ্ন বাগানে মৃত বগেনভিলার গাছটার পাশে পড়ে রয়েছে বইটা। ট্রাকে তুলতে গিয়ে কখন যে পড়ে গেছিল, বোমার আঘাতে গজিয়ে ওঠা কাদা ভরা গর্তে পড়ে রয়েছে। ছেঁড়া বোতামের ফাঁক দিয়ে নিজের শরীরে এঁটে নিল সে, ডিক্সনারিটা।
—‘একটা ডিক্সনারির এমন অদ্ভুত ক্ষমতা থাকতে পারে? দেখ্ সায়ন, আমি গাঁজাখোর হতে পারি, তবে গণ্ডমূর্খ নই!’
—‘বেশ তো, বিশ্বাস যখন করছিস্ না পরখ্ করতে দোষ কি? কি বলিস্ তাতুন?’ আইপ্যাডে ‘দ্য র্যাভেন্'স ডিক্সনারি’ সার্চ করতে করতে বলল সায়ন। নাহ্, ব্যাংককে ও নামে একটা হোটেল আছে বটে, তবে কলকাতায় তো কিছু নেই।—‘খবরদার, ঐ ভুল তোরা করিস্ না! লোকটার কথাগুলো সত্যিও তো হতে পারে!’ তাতুনটা বরাবরই একটু ভীতু মতন। সেমিস্টারে সায়ন অরূপরা যখন পকেটের চিট্ফান্ড থেকে টপাটপ উত্তরগুলো কাট্পেস্ট করে, তাতুন তখন চিবিয়ে পেনের মাথা খেলেও উঁকিঝুঁকি মারে না।
—‘ও. কে., যা করার তাড়াতাড়ি কর। আমায় এক্ষুনি বেরতে হবে।’ ওয়াট্স-অ্যাপের টুং টাং-এ মন দিল অরূপ।
—‘কেন? শ্রেয়ার কাছে যাবি বুঝি?’ ফট্ করে মাথায় রক্ত ছুটে গেল অরূপের। শ্রেয়ার সাথে তার ডেটের ব্যাপারটা সায়ন জানল কি করে? সে তো বলেনি। তবে কি শ্রেয়াই? ভালোবাসা চোরাবালির মত। বিশ্বাস-অবিশ্বাস পাশাপাশি ঘর করে—ঝিনুকের মুক্তো ও নীলমৃত্যুর সাথে। ফার্স্ট ইয়ারে সায়ন কিভাবে পাগল হয়ে উঠেছিল ওই মেয়েটার জন্য অরূপ আজও ভোলেনি। প্রত্যাখ্যানের ক্ষত যে কোনো সময়েই প্রত্যাঘাত হয়ে উঠতে পারে।—‘তাতে তোর কি শালা ... !’ প্রবল ঘৃণায় মুখটা ফিরিয়ে নিল অরূপ।
‘আবার শুরু করলি তোরা?’ শ্রেয়াকে নিয়ে এই ট্র্যাঙ্গুলারিজিম্ ভালো লাগে না তাতুনের।
—‘শোন! ডিক্সনারিটা কিনে আমিই যখন নিয়ে এসেছি, আর কাউকে দেব না’। নোংরা কাপড়টায় বইটা মুড়ে উঠে গেল সায়ন।
—‘যা যাহ্, ওতে আমি ইয়ে করি। কোথাকার আলাদিন আমার, ডিক্সনারিতে জিন্ লুকিয়েছে!’ সায়নের কলেজ ব্যাগটায় সপাটে একটা লাথি কষিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অরূপ।
কৈখালি মোড় থেকে হাঁটাপথে মিনিট দশেক গেলে ‘ওংকার অ্যাপার্টমেন্ট’। থ্রি এ-র এই টু. বি. এইচ্. কে-তে তিনবন্ধু ভাড়ায় আছে। তাতুন-সায়ন-অরূপ। সায়ন আর তাতুন বড় ঘরটা ভাগাভাগি করে থাকলেও, ঘরের বেশিরভাগটাই দখল নিয়েছে কলেজস্ট্রীট পাড়ার পুরোনো বই। পড়ার নেশা, বলা যায় পড়া আর নেশা—সবেতেই পার্টনার তারা। অরূপ আবার একটু মেটিরিয়ালিস্টিক্। ওদের মাঝে তাতুনের একমাত্র চিন্তা, তাদের বন্ধুত্বে চিড় যেন না ধরে। বলা বাহুল্য কারণটা আন্তরিক, ফ্ল্যাট ভাড়া নয়। ফ্ল্যাটটা বেশ পুরোনো ধরনের। তাছাড়া তিনদিকে গা সিঁটিয়ে নতুন আবাসন ওঠায়, আলো ঢোকে না তেমন। এখানে সেখানে ড্যাম্প ধরছে। সিঁড়ির পাশে খানিকটা গায়ের জোরেই সাড়ে সাতশোর মত এই স্পেস্টা বের করে তৈরি ফ্ল্যাটটা।
দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। ভারী পদক্ষেপে অরূপ সিঁড়ির দিকে নেমে যেতেই, খাটের তলা থেকে বইটা আবার বের করল সায়ন।
—‘তুই কি এটা দিয়ে ইচ্ছে পূরণের কথা ভাবছিস্?’ আতঙ্কে সাদা হয়ে এসেছে তাতুনের মুখ।
—‘ধুর যত্তসব বক্ওয়াশ্! ওরকম আবার হয় না কি? তবে মালটা যখন এনেছি একটা ট্রাই মারতে দোষ কি? কাকে চাওয়া যায় বলতো? সানি লিওনি?’
কলেজ স্ট্রীট মোড়। ‘দিলখুসা কেবিন’-এর উল্টো ফুট। ‘আদি মোহিনী মোহন’-এর থেকে শিয়ালদার দিকটায় দু’পা এগোতেই বাঁ হাতে ট্যামার লেন বলে একটা শুকনো গলি পড়ে। ওখানে পাকা ইঁটের একটা পুরোনো বইয়ের দোকান—‘রেনেসাঁ’। হিচকক্, ব্র্যাম্ স্ট্রোকারের পাশে জায়গা পেয়েছে অদ্রীশ বর্ধনরাও। সেখানে দাঁড়িয়ে খুঁটে খাওয়ার মত করে বই বাছছিল সায়ন আর তাতুন। মাঝে মাঝেই ক্লাস বাঙ্ক্ মেরে এ চত্বরে ঘাঁটি গাড়ে ওরা। আজও তেমনই এক দিন।
—‘দাদা, এই বইগুলো নেবেন?’ নীল জিন্স আর হোয়াইট টপে ফর্সা ছিপ্ছিপে মেয়েটা, ল্যাপটপের ব্যাগ খুলে দস্যু মোহন অমনিবাস, ব্যোমকেশ ... বইগুলো টেবিলের ঊপর নামিয়ে রাখতে লাগল। সিঁথির পরিচয়টুকু না রাখলে কলেজ স্টুডেন্টই মনে হতো। সায়নের অবশ্য লাইসেন্সড্ গাড়িই বেশি পছন্দ।
—‘না ম্যাডাম, ব্যোমকেশের আর তেমন কাটতি নেই। সবাই সিনেমাই দেখছে। দস্যু মোহন তো স্বাধীনতারও আগের—মার্কেট নেই। লাগবে না!’
—‘প্লিজ্ নিয়ে নিন না! আচ্ছা এটা তো নিন!’
—‘কি এটা? কাকের মত--ডিক্সনারি? না না, নিয়ে যান্। বি. টেকের ম্যাট্রিক্স থাকলে আনবেন। ইভেন্ সেমিস্টার।’
—‘আচ্ছা কত দেবেন? ডিক্সনারিটা নিয়ে নিন প্লিজ? পঞ্চাশে নিন।’
—‘মাথা খারাপ? দশ টাকাও খাটাব না এতে।’
—‘আচ্ছা ঠিক আছে। এমনিই রাখুন।’
পেছন ফিরেই সোজা হাঁটা লাগাল মামণি সেন্ট্রালের দিকে।
কেসটা কি? বইটা ফ্রিতেই দিয়ে মেয়েটা চলে গেল? কিন্তু কেন? তাতুন একদৃষ্টে চেয়ে বইটার দিকে। ততক্ষণে অলরেডি ‘অনীশের সেরা ১০১’ এক কপি ঝোলায় চালান করেছে সায়ন, পেশাদার কারবারির মত। বই চুরির এই নেশাটা ওর মজ্জাগত, জিনগতও হতে পারে। মনে মনেই হাসি পেল তাতুনের। ‘মালটা যখন ফ্রিতেই পেয়েছে, আমিও এক পয়সা দেব না!’
—‘ধুর্, তোর সবটাতেই না বাড়াবাড়ি! চল্ তো কফি হাউসে টেবিল খালি পাব না এরপর।’ বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধে নেমেছে। এ চত্বরে সময় বদ্ধ হাওয়ার মত দম টেনে রয়। দোকানদারটা ঝাঁপ বন্ধ করতে ব্যস্ত। ঘড়ি বলছে সাড়ে ছ’টা।
—‘বস্, আমি বলছি শোন। বইটায় কিছু তো লোচা আছে!’
—‘ঢপের গোয়েন্দা আমার! চলতো!’ ট্যামার লেনের বন্ধ দোকানগুলোর শাটারে হানা দিচ্ছে পাল-পাল ইঁদুরের দল। সায়নের চোখ ইশারায় বইটা আড়াল করতে বলল ওকে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিমরাজি তাতুন সাথ দিল তার। কাজটা নির্বিঘ্নে সেরে ফেলে, কাল্টি দিল ওরা সেখান থেকে। ছুট দিল অ্যালাবার্ট হল। রিনোভেশানে নবকলেবর পেয়েছে কফি হাউস। সাদা বোর্ডে কালো মার্কার—চিহ্ন রেখে গেছে সৌম্যব্রত। শখের কবি—
“অ্যাশট্রেতে ভালোবাসা ব্যস্ এতে মন ভারি
পাপোশেতে মুছে ফেলি আপোষের সাথে আড়ি।।"
ইয়ং রবি ঠাকুরের মুখে ভক্ ভক্ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিশ্বের রহস্যসাহিত্য এঁটো টেবিলে উপুড় করল তারা। হালের স্টিফেন কিং থেকে অ্যাম্ব্রোস্ বিয়ার্স্—টাইম ট্রাভেলের ফাঁকে ঢুঁ মেরে গেল মি: রে, মানবেন্দ্র পাল, আরও কত কে! বঙ্কিম চ্যাটার্জি ধরে ফেরার সময়, রাস্তা পেরোতে গিয়ে সায়নের চোখ গেল দোকানটার দিকে।
—‘আরে দাদা, বলছি তো। বইটা ঘন্টা দুয়েক আগে এক ভদ্রমহিলা আমায় বেচে গেলেন। কিন্তু এখন পাচ্ছি না। কে যে ঝাড়ল!’
—‘তুমি বুঝতে পারছো না! ডিক্সনারিটা আমার বিশেষ দরকার! ওটা যারই হাতে যাবে ... ও ভার্জিন্ মেরি, হ্যাভ্ মার্সি!’
গালভর্তি সাদা দাড়ি, কনুইয়ের কাছে হাল্কা ময়লা লাগা ফুলশার্ট। ডান হাতে বুকে কাল্পনিক ক্রস্ আঁকলেন ভদ্রলোক।
—‘ও সব ইচ্ছেপূরণ-টুরণ বুঝি না। এ কি মগের মুলুক? যা চাইবে তা পাবে? আবার বাম্বুও খাবে? ফাজলামি ছাড়ুন তো! নেই তো কি করব? আপনার জন্যেই তো আবার খুললাম দোকানটা। কোত্থেকে যে সব জোটে এসে!’
তাতুনের দিকে ফিরে ভুরুতে তরঙ্গ ছুঁড়ে দিল সায়ন। ভাবখানা এমন যেন—‘কি হে চাঁদু, বলেছিলাম না লোচা আছে?’
—‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না রে। বইটা যদি সত্যিই ...।‘
—‘ঝট্পট্ পা চালা। সাড়ে সাতটার ব্যারাকপুর মিস্ হয়ে যাবে।’
সায়নের মাথায় তখন রহমান ভাইয়ের ক্যাফে। কৈখালি পৌঁছেই ছুটবে সেখানে। পুরো বইটার এক কপি স্ক্যান মারবে। ফোকটেই যখন হয়, তারপর দু’চার জায়গায় হাত সাফাইয়ের ক্যালিটা শোনাবে ফেসবুকে।
ডিক্সনারিটার মলাটে একটা দাঁড়কাকের অবয়বে জন্তুর ছবি। পা’টা খুব কষ্ট করে দেখলে মানুষেরই বলে মনে হয়। কোণের দিকটায় কালচে লাল মত, জমাট বেঁধে শুষ্ক রক্ত। ভেতরের পাতাগুলো রুল টানা খাতার মত, আর তার উপর ছাপানো লেখাগুলো হস্তাক্ষরের আদলে খোদাই করা মনে হচ্ছে।
—‘প্লিজ, ফেলে দে বইটা এক্ষুণি! লোকটার কথা বিশ্বাস কর বা না কর, আমার অনুরোধটুকু রাখ্ !’ বলল তাতুন অসহায়ভাবে।
কিন্তু সায়ন একরোখা। বইটির সূচনায় মায়াবী টানে লেখা মিউনিখের এক পার্দ্রীর অসমাপ্ত জীবন-ইতিহাস। সেন্ট্রাল চার্চের কনফেসন্ রুমের এক কোণে টিমটিমে বাল্বের আলোয় বসে জোনাথন, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ঘরের কোণে। যেখানে একটা আবছা ছায়ায় ফুটে উঠেছে র্যাভেন! বইটিতে প্রার্থনার যে-রীতি লেখা আছে তা পড়ে ফ্ল্যাটের ঘরটা সেই মতো একটু সাজিয়ে নিল সায়ন। ব্যাগ থেকে জেসাস্ ক্রাইস্টের ক্রুসিফিকেশনের ছবিটা বের করে, বোর্ডে আটকে হেলান দিয়ে রাখল পূবদেওয়ালে। তারপর ধূপ জ্বেলে মেঝেয় একেবারে কেন্দ্রে বইটা রেখে বসে পড়ল সে। চারটে পেন দিয়ে মেঝেয় প্লাস চিহ্ন বানাল। তারপর একটার পর একটা পাতা উল্টাতে লাগল। তাতুনের মাথার পেছনে বেশ টের পাচ্ছে সে, হাতুড়ি পেটার মতো প্রশ্নেরা নেমে আসছে। সাময়িক স্বস্তি জ্বলতে থাকা ক্লাসিক। ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতায় এক নির্দিষ্ট শব্দে হাত রেখে কি বললো সায়ন। মিনিট তিনেক মত, ঘরের ভেতর দেওয়াল ঘড়ির টিক্টিক্ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
—‘কি রে কিছু বুঝলি?’ অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল তাতুন।
‘ধুর্ $ % # ! অলৌকিক জাদুবিদ্যা না গুষ্টির ইয়ে। বেকার--আই. পি. এল. টা দেখা হল না।’
তাতুনের মনে কেমন যেন আশঙ্কা। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ‘কি চাইলি রে?’
উত্তরে সায়ন শুধু ডিক্সনারির একটা লাইনে তর্জনী নিক্ষেপ করল, —‘... তোমার ইচ্ছে তোমার একান্ত ব্যক্তিগত। বর্হিপ্রকাশে এর তীব্রতা লঘুতর হয়ে বাস্তবায়নের সম্ভাবনাকে প্রশ্নচিহ্নের কাঠগড়ায় এনে ফেলে। তাই এ বিষম বস্তু গোপনে লালন কর। তবে তোমার একটি মাত্র ইচ্ছেই সফল হবে। আর সাবধান! এর সূত্রেই বিনাশ সুপ্ত। ইচ্ছেপূরণের পথেই তুমি ডেভিল্কে প্রত্যক্ষ করবে। মা মেরী তোমার সহায় হন। আমেন্!’
এরপর আর ওকে জিজ্ঞেস করা যায় না। অনেকক্ষণ সিলিং-এর দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে রইল তাতুন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁট ধারাবাহিকভাবে মাথায় এসে লাগছে। জন্মের আলস্য এসে ধরা দিল তার ক্লান্ত চোখের পাতায়। ঘুরন্ত পাখার শব্দে ঢলে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙাল বোটকা সিগারেটের গন্ধ আর ব্যস্ত গাড়ির হর্ন। চিক্চিকে রোদ চোখে ঝলমল করতেই, চোখ মেলল সে। ‘অরূপ রাত্রে ঘরে ফেরেনি! লাইট জ্বলছিল ওর ঘরে। ফোন করে যাচ্ছি, স্যুইচ্ড অফ্।‘ একটানা কথাগুলো বলেই ফিল্টারটা ঠোঁটে নিল সায়ন। রাতে সাফ করা অ্যাশট্রে ইতিমধ্যেই ভস্মে ভরে গেছে।
—‘মানে? সন্দীপের মেসে খোঁজ নিয়েছিস?’
—‘যায়নি’।
—‘বাগুইহাটিতে ওর মামী থাকে না? ওখানে ...?’
—‘ওর মামীই ফোন করেছিল একটু আগে। আমাদের দুপুরে খেতে যেতে বলছিল সবাইকে। ওকে ফোনে পাচ্ছে না।‘
—‘সে কি? ও যদি না ফেরে আর? মানে ওকে না পেলে ... আমরা!’
—‘ইডিয়টের মত করিস্ না তো, ভাবতে দে।’
—‘আচ্ছা তুই ঠিক কি উইশ্ করেছিলি বল তো কাল?’
—‘মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন্?’
—‘সরি!’
—‘হোয়াট – সরি? তুই বোধ হয় ভুলে গেছিস্, অরূপ আমারও ভালো বন্ধু।’
—‘সরি ভাই, জানিস্ তো এসব সিচুয়েশনে আমার মাথাটা পুরো চুলকে যায়! ...’
দিনের উজ্জ্বল আলো হলদে রোদ হয়ে চেপেছে পুরোনো মলাটে। নিষ্পাপ শিশুর মত লাগছে ছবিটা। রাতের নৃশংসতা সময়ের সাথে বদল এনেছে তার চেহারায়, শৈথিল্য পেশীতে। দৈবশক্তির গপ্প স্রেফ্ বইটার ইউ. এস্. পি., সত্যি নয় মোটেও। সে সব ঠিক আছে, কিন্তু আমার ইচ্ছের সাথে তো অরূপ কোনোভাবেই যুক্ত নয়। মালটা যে কোথায় ঘাপটি মেরে আছে? নাইট আউট করলে তো ওরা তিনজন একসাথেই যায় বরাবর। কাল সত্যিই শ্রেয়ার সাথে ডেট্ ছিল ওর ? তুক্কাটা ঠিকই বিঁধেছিল তবে! তাই বলে না জানিয়ে এমন বেপাত্তা, এমন তো আগে হয়নি কখনো? এদিকে তাতুনটারও গল্প উপন্যাসের বাইরে কোনো বুদ্ধি নেই। শ্রেয়াকে ফোন করে দেখা যায় একটা। দু’বছর আগের মুহূর্তগুলো কি আজও ঘৃণা ভরে পুষে রেখেছে সে? ক্ষমা চাওয়া আজও বাকী রয়ে গেছে। ধুর্! ফালতু ন্যাকামো যত।
থাক্। দরকার পড়লে তাতুনকে দিয়ে কল্ করানো যাবে। হাজার এলোমেলো চিন্তা মাথার খুপরিতে এঁটে বসেছে সায়নের। ঠিক তখনই জানলা দিয়ে নীচে দেখতে পেল সে, কাকে? শ্রেয়া? ব্যাপারটা কি, একেবারে ফ্ল্যাটের নীচে?—‘হ্যালো! এখানে? উপরে এসো! থ্রি- এ’।
পিয়ানোর ধ্বনিতে সুর তোলা বাতাসের হরবোলা রঙ গুলে দিল নিমেষে শক্ত পাথরের মত সায়নের মন। শ্রেয়াকে সে পাগলের মত আজও ভালবাসে। কিন্তু ‘বন্ধুর জন্যে এটুকু কুরবানি কোই বাত নেহি! আরে কেরালায় নাকি নারী পুরুষের চেয়ে বেশি। তেমন সেন্টু খেলে সেখানে চলে যাবো। এক দু পিস ফর্সা মামণি ঠিক জুটিয়ে নেব!’ তাতুনকে ঠিক এমনটাই বলেছিল সে বছর দুয়েক আগে। ঐ একবারই স্বভাবকে ছাপিয়ে বেশিই তরল হয়ে পড়েছিল সে। সামলে নিতেই, আবার ঠেকবাজ্!
—‘হঠাৎ এখানে? সরি অরূপ তো রুমে নেই। ...’
—‘কেন তোমার কাছে আসতে নেই বুঝি?’ খস্খসে সায়নের হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিল শ্রেয়া। চোখ তার আজ বাণে পাগলপারা! ওর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। সরু ফালি চুল গাল বেয়ে নেমে এসেছে বট শিখরের মত। নগ্ন কোনো নারী-স্থাপত্যের মত ওকে, হ্যান্ডকাফে বাঁধতে চাইল পিয়াসী সায়ন। ঠুনকো ভদ্রতা বাধ সাধায় বলল, ‘না মানে দরকার থাকলে তো ...’—কথা ফুরাতে দিল না শ্রেয়া। সায়নের থুতনিতে প্রশ্রয়ের চিহ্ন-চুম্বন এঁকে দিল সে। শক্ত হয়ে সে সিগন্যালে জেগে উঠল সায়নের পৌরুষ। ওকে জড়িয়ে ধরে কপট অভিযোগ জানাতে চাইল শ্রেয়া।
—‘হোস্টেলের ল্যান্ডলাইনে কে প্রায়ই ফোনে চাইতো আমায়? কে ফুল রেখে দিত আমার ডেস্কে? ‘সুনীতা’ নামে ফেক্ প্রোফাইলটা তুমিই বানিয়েছিলে না? আমি তো সত্যি ভেবে ফেলেছিলাম। ... তুমি সবসময় আমার ফ্রকপরা ছবিটা সাথে রাখো না?’
বলতে বলতে মেঝে থেকে ডিক্সনারিটা তুলে নিল সে। আশ্চর্য, শ্রেয়ার ছবি এখানে এলো কি করে? ‘অরূপ কাল রাতে আমায় সব জানিয়েছে। তুমি এত ভালোবাসো আমায়! আমিই তোমায় বুঝতে পারিনি! ইউ নো, অরূপকে কোনোদিনই প্রেমিক মনে করিনি আমি। কলেজে কে কি বলল, আই গিভ্ আ ড্যাম! তোমায় আমি বরাবর ঈর্ষা করতাম। সেই তুমি ...।‘ রুমালে মুছে নিল সে চোখের জল আর গলতে থাকা সি. সি. ক্রিম যা ঢেকে রেখেছিল শ্রেয়ার সারল্য। ‘পরে আসব আমি--’ কাঁদতে কাঁদতে দূরে চলে গেল সায়নের হারানো ভালবাসা। বলা উচিত, এতদিনে চুম্বক মন পেল লোহার দৃঢ়শীতল স্পর্শ। সে স্পর্শে, সঞ্চার হয় আস্থা ও অহংকার। কাছাকাছি এল তাদের মন। তবে কাছে দূরের সমীকরণটাই আপেক্ষিকতার আলম্ব বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল কিছুই যেন মিলছে না। আবার সব মিলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখনো জানে না সায়ন, এ আপাত সুখ কিসের অশনি সংকেত?
অরূপ হঠাৎ অমন করে গুছিয়ে মিথ্যেকথাগুলো কেন বলতে গেল? কোনো মেয়ের পেছনে জীবনের অমূল্য মুহূর্তগুলো নষ্ট করার ছেলে আর যেই হোক সায়ন নয়! দু’বোতল বীয়ারে বিন্দাস্ ভাসিয়ে দেবে সে। অরূপের ব্যাগ থেকে ধোঁয়ার সরঞ্জাম বার করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার দেখেছে সে বেনামি চিঠি শ্রেয়ার জন্যে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে সে দেখত শ্রেয়াকে। সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। শ্রেয়াকে চিনতে আর বাকী নেই সায়নের। অরূপের মত আরও কত জায়গায় যে মন দেওয়া নেওয়ার খেলা চলে শ্রেয়ার, কে জানে! কোথাও বা মাত্রা ছাড়িয়েওছে কে বলতে পারে? মেয়েদের মন জাদুকরের পায়রার মত, এই আছে তো ঐ ভ্যানিশ! সে যাক্ গে, আজ হঠাৎ এমনভাবে তার জন্য ঘুঁটি সাজিয়ে দিয়ে গেলেন কোথায় মহামানব?
তবে কি আর করা যায়, পরিবেশ যখন অনুকূলে, নীরবতায় সম্মতি দেওয়া যাক। এভাবে যখন সে সোনালি স্বপ্নের ক্যানভাসে বেঁধে ফেলতে চাইছে আগামী সুখী ভবিষ্যৎ, ঠিক সেইসময় সব যেন ভেঙে চুরামার হয়ে গেল। মোবাইলটা বেজে উঠতেই
—‘হ্যালো ...’--ওপার থেকে দৃঢ় পুলিশী কন্ঠস্বর। ‘মুচিপাড়া থানা থেকে বলছি। গান্ধীমোড়ের কাছে এক্সপ্রেস হাইওয়েতে একজন স্পট হয়েছে। তার মোবাইলে আপনার একানব্বইটা মিস্ড্ কল পেলাম। আপনাকে একবার এখানে আসতে হবে। ...’
ফোনটা রাখতেই জড়বৎ হয়ে খাটে বসে পড়ল সায়ন। মিস্ড্ কল? ফোনটা তো সুইচ্ অফ্ বলছিল? ... তাছাড়া বাইক নিয়ে ও দুর্গাপুর হাইওয়েতে কি করছিল? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় শিরায় তার যেন থমকে গেল রক্তপ্রবাহ।
তাতুন পাগলের মত প্রশ্ন করে চলেছে, কার উদ্দেশ্যে জানা নেই। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হতে চায় না। অরূপ আর নেই? হঠাৎ করেই তীব্র আর্তনাদে ভেঙে পড়ল তাতুন। —‘হোয়্যার ইজ্ দ্য র্যাভেন্? আমি অরূপকে ফিরে পেতে চাই! সেন্ড্ হিম ব্যাক্!’
—‘পাগল হয়েছিস্ নাকি তুই? আরে ও যে আর বেঁচে নেই!’
—‘চুপ কর্! আগেই সন্দেহটা হয়েছিল আমার। তুইই কাল ওকে খুন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলি! ইউ আর দ্য মার্ডারার! আমি সবাইকে বলে দেব!'
’—'বিশ্বাস কর, আমি তো শুধু শ্রেয়াকে পেতে চেয়েছিলাম! আমি অরূপকে ...?’
তাতুন ততক্ষণে মেঝেয় বসে পড়েছে—‘এ’, ‘বি’, ..., ‘কিউ’, ‘আর্’। তারপর ‘আর ই’ ... শেষে খুঁজে পেতেই ডান হাতের তর্জনীটি বসালো ‘Resurrection!’ বলতে লাগল মনে মনে—‘'র্যাভেন! তুমি ঈশ্বর অথবা শয়তান, যেই হও না কেন, আমাদের বন্ধু অরূপকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও! ফিরিয়ে দাও!'
অপলক আর্দ্রনয়নে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের দিকে চেয়ে আছে সায়ন। বন্ধুত্বের প্রমাণ কি মুখে বলে দেওয়া যায়? দেখতে দেখতে ঘড়িতে ঘন্টাখানেক সময় এগিয়ে গেল। নাহ্, র্যাভেনের অভিশাপ আর নতুন কোনো অঘটন বয়ে আনেনি। ব্যাপারটার সাথে ‘র্যাভেন্'স ডিক্সনারি’র কোনো যোগ নেই। থানা থেকে আবার ফোন করেছিল। এখনই বেরোতে হবে। ঝোঁকের মাথায় ইচ্ছেটা করে ফেলে তাতুন ঠিকই, কিন্তু পরিণাম ভেবে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছিল তার। মৃত বন্ধু ফিরে আসলে কি ভয়ানক কাণ্ডই না ঘটতো! আরও মিনিট দশেক কেটে গেল। অ্যাশট্রেতে উপচে পড়ছে দুমড়ানো পোড়া ফিল্টারগুলো। তাতুনের অমূলক ভয়টা থিতিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ:।
হঠাৎ যেন কালচে ঘোলাটে মেঘ কোথা থেকে এসে মুড়ে নিল আকাশটা। ফিনফিনে বাতাস পেল প্রবল বেগ। কালবৈশাখীর মত ভয়ানক অসময়ী এ ঝড়! এমনসময় ‘ঠক্! ঠক্!’ বেশ জোরে কেউ ধাক্কা দিল দরজায়। আবার! চমকে উঠল সায়ন! ঠোঁটে সাদাটে ভাব! স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ! তৃতীয়বার বেশ জোরে শোনা গেল শব্দটা! ‘কে?’ গলা কেঁপে উঠল সায়নের। ‘অরূপ ফিরে এসেছে! ভয়ে ঠিক্রে বেরিয়ে আসছে তাতুনের চোখ দুটো। ‘কি যা তা বলছিস্! তা কি করে হবে? চল্ দেখি!’ ভয়ের কম্পনে গুটিয়ে গেছে দুই বন্ধুই। কাঁপা কাঁপা হাতে সায়ন দরজা খুলতেই, এক ঝলক ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া ছুটে এল ভেতরে। কিছু না আগামী দুর্যোগের পূর্বাভাস আর কি! দরজা বন্ধ করতেই একসাথে চোখ গেল তাদের। খোলা জানলা দিয়ে ঢুকছে এলোপাথাড়ি হাওয়া। যা ভাসিয়ে লণ্ডভণ্ড করছে ঘরটাকে। শুকনো পাতারা এ ঘরেই যেন বেছে নিয়েছে আশ্রয়। ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। কিন্তু মেঝেয় পড়ে থাকা ডিক্সনারির একটা পাতাও নড়ছে না। যেখানে খোলা পাতায় জ্বল জ্বল করেছে ঐ শব্দটা—‘Resurrection!’
কাঠের টেবিলের জিনিসপত্রগুলো কখন যে সব ভেঙেচুরে পড়েছে মাটিতে, কোনো শব্দই কানে আসেনি তাদের। টেবিলের উপরে তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে খুব চেনা হাতের লেখায়, লিখে দিয়েছে কেউ, এই শব্দদুটো—
‘হাই, ফ্রেন্ড্স!’
১৩ই ডিসেম্বর
‘তরুণীর দেহ মিলল ট্রান্সফর্মারের তলায়’
—রাজারহাট মেন রোডে, আকাঙ্ক্ষা মোড়ের কাছে বি. এল. ৩৬ ট্রান্সফর্মারের নীচে সন্ধ্যা মিত্র নামে বছর তেইশের ...
‘গাড়িতে যুবকের লাশ’
—রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট দিয়ে যাওয়ার সময় লাল ইনোভা-টার দরজা খোলা দেখে সন্দেহ হয় ট্রাফিক সার্জেনের। ব্যাকসিটে অজয় মুখোপাধ্যায় নামে আই. টি. কর্মীর ...। পাশে খোলা ল্যাপটপে স্ক্রিনে ...।
‘মাথার শিরা ছিঁড়ে ব্যবসায়ীর মৃত্যু’
—কাল রাতে সাড়ে দশটা নাগাদ তাজপুর বীচে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রী রাজন রুইয়ার মৃত্যু হয়। সন্দেহজনক কোনো কারণ এখনো অবধি পাওয়া যায়নি। ডাক্তারের মত, বাধর্ক্যজনিত কারণেই ব্রেনে রক্তপ্রবাহ কমে করোনিয়াস্ নার্ভ ফেলিওর। তবে হঠাৎ প্রচণ্ড শক্ পেলেও এমনটা হতে পারে। ভয়ের কি কারণ থাকতে পার? পরিবারসূত্রে তেমন কোনো লাইফ থ্রেট্ বা চিন্তার কিছু ছিল না বলেই জানানো হয়েছে। একমাত্র ছেলে শ্রী সাওনকে কোম্পানির দায়িত্ব বছর তিনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া শেয়ার মার্কেটে রুইয়া গ্রুপের বুলিশ্ গ্রাফ্। তদন্তে নেমে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দু’টো বীয়ারের বোতল ছাড়াও উদ্ধার করেছে তাঁর ল্যাপটপ্। শেষ ডাউনলোডেড একটা পি. ডি. এফ্।
‘আনন্দবাজার পত্রিকা’টা চার ভাগে মুড়ে টেবিলের তলায় ছুঁড়ে দিলেন পাদ্রী সাহেব। বড্ড দেরি হয়ে গেল! একমাস ধরে খবরের কাগজগুলো মৃত্যুর বিবরণে লাল হয়ে উঠেছে। চ্যাটবক্সে, সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ঘুরছে অদ্ভুত এক যোগসূত্র। টেবিলে রাখা গ্লাস। গোল কাচ বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রেড্ ওয়াইন। ... ছেলেগুলো এ কি সর্বনাশ ডেকে আনল! 'ও ভার্জিন মেরি, হ্যাভ্ মার্সি!’
গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেসটার দিকে চেয়ে দেখলেন তিনি। লক্লকে আগুনের শিখা লেগেছে মলাটে, পুড়ছে ‘দ্য র্যাভেন্'স ডিক্সনারি’। তবে সে অভিশাপ রুখবে না এতে! ওয়েবলিঙ্কে বইছে অবাধে সায়নের স্ক্যান্ড্ কপি!
ঈশ্বর সহায় হন!