• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬২ | মার্চ ২০১৬ | গল্প
    Share
  • দেবীর সাথে : স্বপ্না মিত্র


    মিগ্রেশনের লাইন পেরিয়ে, হুইল চেয়ারে বসে, শ্রীরাধা এক নতুন দেশে ঢুকছে। শূন্য থেকে শুরু করে বিদেশের মাটিতে আবার সংসার সাজাবার চ্যালেঞ্জ সহ। চ্যালেঞ্জই বটে। বয়সে রং সাইড অফ চল্লিশ, স্বজনবিহীন নতুন দেশ, ভগ্নস্বাস্থ্য, সব্যসাচীর নতুন পোস্টিং। নতুন পোস্টিংও অনিচ্ছার সাথে, সব্যসাচী এবং ম্যানেজমেন্ট, দুপক্ষেরই। ব্যাঙ্গালোরে বাড়ি দেখে সব্যসাচী তো চলেই যাচ্ছিল। শেষমেশ ডাক্তারের পরামর্শে, শ্রীরাধার স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে, শুধুমাত্র মেডিকেল কারণে সব্যসাচী বিদেশে পোস্টিং নিতে রাজি হয়। পার্থিব বিরূপতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, হুইল চেয়ার থেকে পুনরায় শ্রীরাধা বিদেশের মাটিতে ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে।

    হুইল চেয়ারে বসে এয়ারপোর্টের এমাথা থেকে ওমাথা যেতে যেতে শ্রীরাধা চারিদিক তাকিয়ে দেখছিল। কোন কোন যাত্রী শ্রীরাধাকেও লক্ষ্য করছিল নিশ্চয়ই। তার মাথায় ছোট ছোট কদমছাট চুল, গায়ের রঙ পোড়াটে বাদামী। গোটা অবয়ব জুড়ে রোগের ক্লিষ্টতা, শুধু চোখদুখানি ছাড়া। শ্রীরাধার প্রায় পল্লবহীন চোখে এখনও সৃষ্টিছাড়া কৌতূহল, উত্তেজনা। কৌতূহল নতুন দেশের জন্য, উত্তেজনা নতুন সংসারের কারণে।

    সেই এলো তারা বিদেশের মাটিতে ঘর বসাতে। তবে এমন ঘর কি শ্রীরাধা চেয়েছিল? এমন কারণে ঘর বাঁধা যেন অতি বড় শত্তুরেরও না হয়। তার দুচোখে ব্যথা ঘনিয়ে ওঠে। উত্তেজনা, ব্যথাকে সাথে নিয়ে শ্রীরাধা এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোয়।

    অ্যাটেনডেন্ট ছেলেটি, যে হুইলচেয়ার ঠেলছিল, শ্রীরাধাকে হাত ধরে নামায়। শ্রীরাধার হ্যান্ডব্যাগ তার হাতে ধরিয়ে দেয়। ব্যাগে আছে নতুন বাড়ির চাবি। শ্রীরাধা ব্যাগটিকে শক্ত করে চেপে ধরে, বা যে সংসার পিচ্ছিল হয়ে তার হাত ফস্কে পড়ে যাচ্ছিল, সেই সংসারে ঢোকার প্রবেশপত্র, বাড়ির চাবির গোছায় হাত বুলিয়ে নিশ্চিন্ত হয়, এখনও সংসার শ্রীরাধার অপেক্ষায় আছে।

    এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে শ্রীরাধা দুচোখ ভরে দেখে। আঃ, কি সবুজ! কি সুন্দর ছিমছাম সাজানো! কেমন ডলস হাউসের মত নিখুঁত পথঘাট! ফিটফাট মানুষজন! শ্রীরাধা নিজের দিকে তাকায়। তার সৌন্দর্য তো পুড়ে খাক হয়ে গেছে। সে বুঝি আজ বাতিলের দলে। জীবন্মৃতের মাঝামাঝি কোন এক থিকথিকে শ্যাওলা ভরা অবস্থানে।

    উফ, সে কি ভীষণই বেমানান চতুর্দিকের এই সৌন্দর্যের সাথে, শ্রীরাধা ভাবে। সে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যায়। আপন অসৌন্দর্যকে আড়াল করার অভিপ্রায়ে মুখ নিচু করে। হ্যাঁ, নিচু। শুধু মুখ নয়, তার গর্ব, তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে খানখান হয়ে সমতলেরও নিচে কোন এক অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। চ্যালেঞ্জ সেই আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারেরও।

    শ্রীরাধা সব্যসাচীর ডাকে ফিরে তাকায়। দেখে, ট্যাক্সিতে মাল তোলা শেষ। এখন শ্রীরাধার উঠে বসার অপেক্ষা। তারপর ট্যাক্সি ছুটবে নতুন গন্তব্যে। নতুন গন্তব্যে শ্রীরাধা সব্যসাচীর তেইশ বছরের পুরনো সম্পর্ককে পাথেয় করে নতুন সংসারের ভিত স্থাপন হবে। সংসারে ওরা তো মাত্র দুজন। একমাত্র ছেলে তোতন আছে কলেজের হোস্টেলে। সে এখন এঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারে।

    চাবি ঘুরিয়ে নতুন বাড়িতে ঢুকে শ্রীরাধার মনের উথাল-পাথাল থেমে পড়ে, চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি জানালা, ব্যালকনির বাইরে সবুজের ঢল। ফাঁকে ফাঁকে নীল সমুদ্রের উঁকিঝুঁকি। সমুদ্র জলে রৌদ্ররাশির হাজার বিচ্ছুরণ। ইতিউতি নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় জাহাজ। শ্রীরাধা বুক ভরে শ্বাস নেয়। এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যে এমন মনোহর বাসা শ্রীরাধার অতি প্রয়োজন ছিল। সে সুন্দর করে ফ্ল্যাটটিকে সাজাবে।

    সাজাবে? কিন্তু আবার যদি কিছু হয়? আবার যদি উথাল-পাথাল ঢেউ ওঠে? আবার যদি সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে? থাক বাপু, দরকার নেই। সাজসজ্জার, আদিখ্যেতার। ওতে কুদৃষ্টি পড়ে, নজর লাগে। যেমনটি লেগেছিল শ্রীরাধার দিল্লীর সংসারে। অসুখ এসে সুখকে দুরমুশ করে চলে গেল। রেখে গেল বুক ভরা আতঙ্ক আর ঘুম কাড়া স্মৃতি। এখন থেকে শ্রীরাধা শুধু প্রয়োজনটুকু নিয়ে বাঁচবে, যেটুকু না হলেই নয়। শুধু বেঁচে থাকা। শ্রীরাধা যে বাঁচতে চায়। অনেক অনেকদিন। মা ঠাকুমার মত, দিদি ননদের মত, আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের মত, স্বাভাবিক আয়ুতে সমৃদ্ধ হয়ে।

    সব্যসাচীর সাথে ঘুরে ঘুরে শ্রীরাধা নতুন বাড়ির জিনিস কেনে। এক শপিং মল থেকে আরেক শপিং মল ঘুরে সে হাঁফিয়ে পড়ে। তবু যায়। এখনও সব্যসাচী ডাকে যে! আচ্ছা, এটা কোন মাস? অগাস্ট না? এবছরে সেপ্টেম্বরের শেষে পুজো। এখানে পুজো হয়?

    সেকথাই শ্রীরাধা সব্যসাচীকে ডিনারের সময় বলছিল। শ্রীরাধা বলে, পুজো তো এসে গেল। তোমাদের অফিসে কোন বাঙালী আছেন? এখানে দুর্গাপুজো কোথায় হয়? আমাদের মেম্বার হতে হবে না?

    —আমাদের অফিসে কুণাল বসু আছেন। উনি বলছিলেন মেম্বার হওয়ার জন্য। এখানে নাকি খুব ধূমধামের সাথে পুজো হয়।

    —ফর্ম এনেছ? সেপ্টেম্বর তো এসে গেল।

    —এই শরীরে তুমি পুজো প্যান্ডেলে যাবে?

    —ওমা! যাবো বৈকি। ষষ্ঠীতে মায়ের মুখ না দেখলে হয়? আর সন্ধিপুজো? তুমি বাপু তাড়াতাড়ি মেম্বার হয়ে নাও।

    —কুণালদা বলছিলেন, মেম্বারশিপ ফি আর পুজো ওভারহেডও থাকে। তাতে ষষ্ঠী থেকে দশমী, পাঁচদিন দুবেলা ফ্রি লাঞ্চ এন্ড ডিনার। তুমি তো বাইরে খাবে না। শুধুশুধু পয়সা নষ্ট।

    —কবে থেকে এত পয়সা গুনতে শুরু করলে? তাছাড়া মেম্বার ছাড়া মায়ের মুখ যদিনা দেখতে দেয়! সে ভারি অমঙ্গলের ব্যাপার। তুমি বাপু কালই মেম্বারশিপের ফর্ম ভরে দিও।

    প্রত্যেক আরম্ভেরও একটা আরম্ভ থাকে। তেমনই বিদেশে সব্যসাচী শ্রীরাধার নতুন সংসার শুরু করার পেছনেও লম্বা ইতিহাস আছে।

    শ্রীরাধারা দিল্লীতে থাকতো। সাজানো গোছানো নিজেদের ফ্ল্যাট। দুটো গাড়ি। একটি নিজস্ব, অপর টি কোম্পানির। সব্যসাচী কোম্পানির গাড়িতে ঘোরাফেরা করে, ড্রাইভার সহ অন্যটি থাকে শ্রীরাধার জিম্মায়। একমাত্র ছেলে নামীদামী স্কুলে পড়ে, লেখাপড়াতে যথেষ্ট ধারালো।

    সব্যসাচী কর্পোরেটের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতগতিতে উঠছে। সুখ যেন শ্রীরাধার আঁচলে বাঁধা, পোষা পাখি। এইতো ওরা ইউরোপ ট্যুর করে এলো। পুজোর সময় কেরালা যাবার প্ল্যান। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীতে বন্ধুবান্ধব, কলিগদের উপহারে ঘর ভরে যায়। শ্রীরাধার সংসার অনেকটা সেই বিজ্ঞাপনের মত, ওনারস প্রাইড নেইবারস এনভি।

    নিজের দিদি, বৌদি, ননদদের সাথেও শ্রীরাধার আপেক্ষিক অবস্থান দ্রুত পাল্টে গেল। শ্রীরাধার দামি শাড়ি গয়নাকে ওরা তির্যক চোখে দেখে। শ্রীরাধার ছবির মত সংসারকে নিঃশব্দে জরিপ করে যেন। যেন কিসের এক প্রতীক্ষা। এই অঢেল সুখের কারণ, ভগবানের একচোখামির কৈফিয়ত চায় বুঝি।

    ভগবানের একচোখামির প্রমাণ শ্রীরাধাও পেয়ে যায়। তোতনের তখন ক্লাস টুয়েলভ। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ শ্রীরাধার ক্যান্সার ধরা পড়ে। খাঁচা খুলে সুখ পাখি হাওয়া। রাতারাতি দিল্লীর ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে শ্রীরাধাকে নিয়ে সব্যসাচী চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়, সুচিকিৎসার আশায়। এই চিকিৎসায় শ্রীরাধার প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়ে পড়েছে বড় নাজুক, দুর্বল। পলিউশন একেবারেই সহ্য হয় না। তাই ধূলোবালি ধোঁয়ায় ভরা দিল্লীতে আর ফেরার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে সব্যসাচীর বিদেশের মাটিতে পোস্টিং নেওয়া, শুধুই শ্রীরাধার স্বাস্থ্যের কারণে।

    দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। আজ ষষ্ঠী। কেমোথেরাপির পর শ্রীরাধার দুর্বল পাকযন্ত্র উপোসের অনুপযুক্ত। তাই শ্রীরাধা আজ উপোস করেনি। ষষ্ঠীকে মনে রেখে সে নিরামিষ খেয়েছে মাত্র। তবে বিকেলে অবশ্যই সব্যসাচীর সাথে পুজো প্যান্ডেলে যাবে। চিকিৎসার পর শ্রীরাধার প্রথম দুর্গাপুজো। সে মনে মনে কিছুটা উত্তেজিত, সে যে মরণের মুখ থেকে ফিরে এলো, এখনও বেঁচে আছে। আবার এ পৃথিবীর দোলদুর্গোৎসব দেখতে পাবে।

    কিছুটা ভীতও। এদেশের প্রথম পুজো। এখানকার হালচাল কেমন? বিকেলে কি পরে যাবে শ্রীরাধা? এখানে তো একটাও শাড়ি নেই তার। বাকি পোশাকও কি সাধারণ! সেই যে কুসংস্কার, ন্যূনতম প্রয়োজন নিয়ে বেঁচে থাকো, পার্থিব চাহিদা অধিক হলে তোমার বেঁচে থাকার অধিকারকেও খর্ব করা হবে।

    শ্রীরাধা ওয়ারড্রব থেকে একজোড়া সাধারণ প্যান্ট শার্ট বার করে। গয়না তো সে পরে না। কানে ছোট দুল বা গলায় তিরতিরে একটা হারও নেই। শুধু বাঁহাতে লোহা বাঁধানো, সব্যসাচীর পরমায়ুর প্রার্থনায়।

    শ্রীরাধার কপালে টিপ নেই, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। সিঁথি কোথায়? শ্রীরাধার পিঠ ছাড়ানো এক ঢাল কালো চুল তো ঝরে শেষ। নতুন চুল উঠেছে। তবে এখন তা ব্রাশের মত, খোঁচা খোঁচা সোজা সটান দাঁড়ানো। তার সাথে আইসিং অন দ্য কেক, এক মাথা কালো চুলের পরিবর্তে সদ্য ওঠা চুলের অনেকটাই ধূসর।

    শ্রীরাধা আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বেয়ে বড় বড় জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। এত নিষ্ঠুর? ভাগ্য এত নিষ্ঠুরও হয়? যাক গে। চোখের জল মুছে শ্রীরাধা তৈরি হয়। তৈরি হওয়া? তৈরি হওয়ার তো কিছু নেই! রোগের কারণে প্রসাধনও তার জন্য বারণ। এমনকি ট্যালকম পাউডার, রাতক্রিম অবধি। কোনরকম বাড়তি রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে শ্রীরাধার না আসাই শ্রেয়।

    শ্রীরাধা একটা কালো ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট পরে নেয়। আলমারি খুলে বার করে পুরনো মূল্যবান ইটালিয়ান পার্স, যা কিনা বিপণন সমাজে শ্রীরাধার অবস্থান নির্ধারণ করে দেবে।

    অফিস থেকে ফিরে সব্যসাচী চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিউজ দেখছিল। শ্রীরাধা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, চলো।

    সব্যসাচী বলে, রেডি?

    শ্রীরাধা বলে, রেডির আর কি! শার্ট আর প্যান্ট তো।

    সব্যসাচী হেসে বলে, আরে বাপু, এখানে কেউ অত সাজবে না। একি কোলকাতা?

    শ্রীরাধা বলে, থাক। তাছাড়া সাজলে আমাকে মানাতও না। যা ভূতের মত চেহারা হয়েছে।

    সব্যসাচী কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

    পুজো প্যান্ডেলে ঢুকে সব্যসাচী অবাক, শ্রীরাধা পুরো ‘থ’। পুজো প্যান্ডেল দৈর্ঘ্যে প্রস্থে, চাকচিক্যে ঔজ্জ্বল্যে, সাজসজ্জায় কোলকাতা থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে যেন। প্রতিটি নারী পুরুষ সুসজ্জিত। প্রত্যেকের পরনে হালফ্যাশনের রুচিসম্মত পোশাক। সব দল বেঁধে ঘুরছে, খাচ্ছে, আড্ডা মারছে, নিছক বসে আছে। উজ্জ্বল পোশাক, উচ্ছল হাসি, আনন্দ যেন মূর্তি হয়ে পুজো প্যান্ডেলে নেমে এসেছে।

    মায়ের পুজোয় এমনই তো হওয়ার কথা, এমনটাই তো চাই। শ্রীরাধার সেই পঙক্তিগুলি মনে পড়ে, অনেকটা এইরকম। শুনেছে সে মা এসেছে ঘরে / বিশ্ব আনন্দে ভেসেছে / মার মায়া পায়নি কখনও / মা কেমন দেখিতে এসেছে / তাই বুঝি আঁখি ছলোছলো/ বাষ্পে ঢাকা নয়নের তারা / চেয়ে বুঝি মার মুখপানে / বালিকা কাতর অভিমানে / বলে মাগো এ কেমনধারা? / এত হাসি এত বেশ এত তোর রতনভূষণ / তুই যদি আমার জননী / মোর কেন মলিন বসন?

    না, এখানে মলিন বসন পরিহিতা কোন কাঙালিনী নেই। সকলেই বসনে, ভূষণে, সৌভাগ্যে মায়ের যথার্থ সন্তান। শ্রীরাধা নিজের দিকে তাকায়। সেই এদের মাঝে ব্যতিক্রম বুঝি। সে পায়ে পায়ে মায়ের বেদীর দিকে এগোয়। সামনের সারির চেয়ারে কুণ্ঠিত হয়ে বসে।

    ওই যে কলাগাছ। নবপত্রিকা বসানো হবে। বোধনের ব্যবস্থা হচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পুজোর আচারের সাথে শ্রীরাধা স্থানীয় মহিলাদেরও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

    কি সুন্দর ওরা! প্রত্যেকের গায়েই দামী পোশাক, ভারী গয়না। কি সহজভাবে মহিলারা মায়ের বেদীতে উঠে মায়ের পাশে পাশে ঘুরছে ফিরছে। ওমা, মায়ের কপাল থেকে সরে যাওয়া চুল কেমন আঠা দিয়ে সেঁটে দিল দ্যাখো! ওদের আচরণে কোন দ্বিধা নেই, কুণ্ঠা নেই। ওরাও মায়ের সাথে সাথে মর্ত্যে অবতরণ করেছে যেন! ওই যে সবুজ কাঞ্জিভরম পরা মেয়েটা, লম্বা ফর্সা বড় বড় চোখ, সবসময়ই মায়ের কাছটিতে। মহিলারা কারণে অকারণে মা দুর্গা ও তার ছেলেমেয়েদের পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ ফলের থালা হাতে, কেউ বা ফুলের ডালি নিয়ে, কেউ বা নিছকই দূর্বা বেলপাতা বা শাঁখ হাতে ঘুরছে। শ্রীরাধার মনে হয় মা দুর্গাই যেন এই মহিলাবৃন্দকে কাছে ডেকেছে বা এই মহিলাদের সৌভাগ্য তাদের সশরীরে মায়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

    শ্রীরাধার খুব ইচ্ছে করে মায়ের পাশে যেতে, একবার মাকে ছুঁয়ে দেখতে। সে নিজের ইচ্ছেকে প্রতিহত করে দূর থেকে মাকে প্রণাম করে বাড়ি ফেরে।

    ডিনারের পর রাতপোশাক পরে শ্রীরাধা একা ব্যালকনিতে এসে বসেছে। সামনে রাতের সমুদ্র। থৈ থৈ কালো জল। জাহাজের বুকে দিপদিপে আলো। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। সমুদ্রের নোনা হাওয়া শ্রীরাধার চোখেমুখে ঝাপট মারে। স্মৃতির দরজায় অনুরণন ওঠে।

    আচ্ছা, এত মানুষ থাকতে বেছে বেছে শ্রীরাধার কেন লিম্ফোমা হল?

    —প্রবাবিলিটি, স্রেফ প্রবাবিলিটি।

    —না। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার ছোট থেকে কি কি অসুখ হয়েছে? যাদের অনেক ভারী ভারী অসুখ করে, তাদের মধ্যে লিম্ফোমা হওয়ার প্রবণতা বেশি।

    —এখন তো ভালো হয়ে গিয়েছ। ওসব কথা ভেবে লাভ?

    —লাভ লোকসানের প্রশ্ন নয়। ব্যপারটা একটু খতিয়ে, একটু তলিয়ে দেখা। এত লোক থাকতে ঈশ্বর আমাকেই কেন রোগটা দিলেন? আমি কি পাপী? ধনী হয়ে দরিদ্রকে ফাঁকি বা সবল হয়ে দুর্বলের ওপর অত্যাচার? নাকি রজঃস্বলা অবস্থায় ঠাকুরঘরে ঢুকেছিলাম বা আমিষ খেয়ে অঞ্জলি?

    —অমন করে বল না। ঈশ্বর সদা মঙ্গলময়। তাঁর কাছে আমরা সবাই সমান, সন্তানতুল্য।

    —তাই যদি হয় তবে শাড়িতে গয়নাতে জৌলুসে ঠাসা ঐ মহিলারা কেমন ভ্রমরের মত মায়ের বেদীতে ঘুরঘুর করছে আর আমি চিকিৎসায় ক্লিষ্ট পিষ্ট শ্রীরাধা এক কোণে একাকিনী বসে আছি কেন?

    —কি বলতে চাও?

    —ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে অমনভাবে মায়ের পাশটিতে যেতে, মাকে ছুঁয়ে থাকতে। ওই সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটির মত সৌভাগ্যে ঝলমল করে মায়ের বেদীর মাঝখানটিতে প্রদীপ হয়ে জ্বলতে।

    —ঈশ্বর তোমাকে রোগ দিয়েছিলেন, সাথে প্রতিকারও তো দিয়েছেন। জনের মত অমন ডাক্তার।

    শ্রীরাধার মনে পড়ে জনের কথা। শ্রীরাধা সব্যসাচীর জীবনে জন যেন এসেছিল ঈশ্বরের দূত হয়ে। জনের চেহারার মধ্যেই একটা প্রশান্ত ভাব, মুখে স্মিত হাসি, চোখের চাহনিতে বরাভয়। ভয় দেখান না আবার অযথা আশার বানীও শোনান না। পারফেক্ট ব্যালেন্সড পারসোনালিটি। রোগের প্রতিকার নিয়ে যখন শ্রীরাধা সব্যসাচী অকূল পাথারে, বিদেশ বিভূঁইয়ে এক বিদেশী ডাক্তারই তাদের দেখিয়েছিল সঠিক পথ, আলোময় গন্তব্যস্থল। জনের ব্যবহার ছিল প্রেমময়, করুণায় স্নিগ্ধ। অস্ট্রেলিয়ার ওই হাসপাতালের মেডিটেশন রুমে দেওয়াল জোড়া কয়েকখানি অপূর্ব পেন্টিং আছে। প্রত্যেকটি যীশুকে নিয়ে। জনের মুখ যেন অবিকল ওই পেন্টিংয়ের যীশুর মত, ঋজু অথচ কঠিন নয়, করুণায় ভরা তবে অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না। এত বড় রোগে, এত পয়সার চিকিৎসায়, শ্রীরাধার ক্ষেত্রেও কিছু বিভ্রাট হয়েছিল বৈকি। তবে দেশ কালের ঊর্ধ্বে উঠে জন মানুষের প্রতি মনুষ্যত্বের হাত বাড়িয়েছিলেন, রোগের প্রতিকারের জন্য যথাযথ চিকিৎসা।

    আজ অষ্টমী। রাত দশটা বেজে চল্লিশ মিনিটে সন্ধি পুজো। শ্রীরাধা এসেছে পুজোমণ্ডপে, সব্যসাচীর হাত ধরে। শ্রীরাধা চেয়ারে বসে, পুজো দেখবে। ওই তো সেই মেয়েটি। আজ পরেছে নীল পৈঠানি, কানে ঝুমকো, গলায় সীতাহার। পুজোর বেদীর ঠিক মাঝখানটিতে মেয়েটি আঁচল ছড়িয়ে বসে। সাথে জুটেছে আরও একদল ভ্রমর। তারা গুনগুনিয়ে, রক্তরঞ্জিত চম্পককলি অঙ্গুলি দিয়ে নীলোৎপলের একটি একটি পাপড়ি খুলছে, সন্ধিপুজোর প্রস্তুতি হিসেবে। একপাশে সোনার মত ঝলমলে সুন্দর প্রদীপদানিটি। একসাথে একশো নয়খানি শিখা জ্বলে ওঠার প্রতীক্ষায়। চিরকালই সন্ধিপুজো শ্রীরাধার বড় প্রিয়, তার সাথে সে পুজো যদি রাতে হয়। অষ্টমী আর নবমীর সন্ধিক্ষণে এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, দেবী যখন মহিষাসুরকে অর্থাৎ অশুভকে ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ করেন। জোড়হাতে সন্ধি পুজোর মন্ত্র শুনতে শুনতে শ্রীরাধা একদৃষ্টে মায়ের দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ তার মনে হয়, চিন্ময়ীর চোখে কি ঝিলিক? চোখের পাতা পড়লো কি? অসুর কি আরও একটু বুক চিতিয়ে পড়ে গেল? অশুভর পরাজয় হয়ে শুভর জয় হল!

    শ্রীরাধার গায়ে কাঁটা দেয়। এমন করে কোনদিন সে মায়ের সাথে একাত্ম হতে পারেনি। সে দুহাত জোড় করে প্রণাম করে। প্রার্থনা করে, তার শরীরের ক্যানসারের বীজও আজ যেন ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ হয়ে সমূলে উৎপাটিত হয়। সে যেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে।

    শ্রীরাধা পিঠে সব্যসাচীর হাতের স্পর্শ পায়। সব্যসাচী সস্নেহে বলে, তুমি তো পুরোপুরি সুস্থ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর কিছু হবে না। শ্রীরাধা বলে, কেন এমন হল বল তো? এক রোগের কারণে, দেশ ছেড়ে ঘর ছেড়ে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে!

    দেখতে দেখতে সেই বিদেশ বিভূঁইও শ্রীরাধার আপন হয়ে গেল। পাঁচ বছর কেটে গেছে। স্থানীয় মানুষজনের সাথেও শ্রীরাধার অল্পস্বল্প পরিচয় হয়েছে। এখন শ্রীরাধা একটু আধটু সাজে, সোস্যালাইজিং করে। তোতন সদ্য প্রেম করে বিয়ে করেছে। অ্যামেরিকার মাটিতে তাদের টোনাটুনির সংসার। এইবার পুজোয় সব্যসাচী বাড়ি থাকবে না, অফিস ট্যুর। শ্রীরাধা একদম একা।

    শ্রীরাধা ভাবে, সে যদি দুর্গাপুজোয় মায়ের কাজ করে, সেই সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটির মতো, কেমন হয়?

    পুজো এসে গেল। আজ ষষ্ঠী। ষষ্ঠীর সন্ধেবেলায় শ্রীরাধা একাই সেজেগুজে পুজো প্যান্ডেলে বোধন দেখতে এসেছে। আজ সে আর সামনের চেয়ারে বসেনি। তারও দু-চারটি চেনা লোক হয়েছে যে। সে দাঁড়ায় মায়ের বেদীর পাশে, মহিলাদের ভিড়ে।

    ওই যে সবুজ শাড়ি। আজ সে হলুদ ঢাকাই পরেছে। মায়ের বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে নবপত্রিকায় জল ঢালছে। শ্রীরাধার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি। আজ সবুজ শাড়িকে তার আর চাঁদের দেশের মানুষ মনে হয় না। ওই সবুজ শাড়ির সাথে, আগামীকাল শ্রীরাধাও মায়ের জন্য ভোগ রাঁধবে।

    এখানকার দুর্গাপুজোয় মায়ের ভোগ, সে এক এলাহি ব্যাপার। শ্রীরাধাকে নিয়ে মোট আঠেরো জন মহিলা আজ সপ্তমীর সকালে ভোগ রাঁধবে। ভোর ছটা থেকে শুরু হয়েছে রান্নার প্রস্তুতি। মহিলারা কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে কুটনো কুটছে, বাটনা বাটছে। একসাথে সাতটা উনুন জ্বলছে দাউদাউ করে। বড় বড় ডেচকিতে, কড়াইয়ে রান্না হচ্ছে। অনেকটা আগেকার দিনের বিয়ে বাড়ির মতো, যখন বাড়ির মহিলারা নিজের হাতে রান্নাঘর সামলাতেন। কুটনো কাটা হল, সবাই মিলে রান্নাও হল।

    এতক্ষণ তো রান্না হল পুজো প্যান্ডেলের পিছনে, ভোগ তৈরির রসুইঘরে। এইবার সেই ভোগ পিছনের রসুইঘর থেকে পুজোর বেদীতে যাবে, পুরোহিত মশাই অর্পণ করবেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, পূজা শেষে মায়ের ভোগ বিতরণ হবে উপস্থিত দর্শকবৃন্দের মাঝে। মায়ের ভোগ নিজের হাতে তৈরি করে অর্পণ করা, এ যেন, আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রভু আমার, প্রিয় আমার।

    পিছনের কিচেন থেকে মায়ের ভোগ যাবে দর্শনার্থীদের সামনে দিয়ে। ফলে মহিলারা, পরিচিত মহিলাদের সামনে দর্শন দেওয়ার জন্য চকিতে চুল আঁচড়ে ফেলে, সেরে নেয় পুনরায় রূপটান। চুল আঁচড়েই শেষ হয় না। এ যেন সেই পাড়ার স্টেজের নাটক। একই অভিনয় গুন নিয়ে প্রত্যেকেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে চায়। এখানে চরিত্র বলতে বাহকের কাজ।

    পিছনের কিচেন থেকে দশজনের সামনে দিয়ে ভোগ হাতে পুজোর বেদীতে ওঠা। আঠেরো জন সদস্য। নয়টি ভোগের থালা, নয়টি জলের গ্লাস, চারটি মিষ্টি, ফুল, শাড়ির ডালা। মোট বাইশজন বাহক প্রয়োজন। কোনরকম সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে হয়। মন্তব্যে। “প্লিজ কেউ কিছু মনে করো না, যারা নতুন তারা জলের গ্লাস নেবে, যারা পুরনো তারা ভোগের থালা।" বক্তব্যটি একবার নয়, মৌলিকতা প্রমাণের প্রয়োজনে বারবার বলা হয়।

    এক প্রজাপতি ভোগের থালা হাতে নিয়ে ফোড়ন কাটে, জলই তো আসল, জল ছাড়া জীবন চলে!

    শ্রীরাধার মাথা চড়তে শুরু করে। সে এদেশে নতুন বলে নয়। জলের গ্লাস ধরতে তার আপত্তি নেই, বরং স্বস্তি। বহনের কষ্ট কম। কিন্তু এ কি ছেলেমানুষি! পায়ে পা দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করা, নতুন পুরনো বিভেদ তৈরি করা!

    তারা আঠেরোজন পুজোর থালা, জলের গ্লাস, মিষ্টির ডালি হাতে মায়ের বেদীর দিকে এগোয়। চারিদিকে অনেকগুলি ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে। শ্রীরাধা আঁচলটা গায়ে টেনে নেয়। তার দুহাতে জলের গ্লাস। অন্য মহিলাদের সাথে সে বেদীতে ওঠে, মায়ের পাশটিতে দাঁড়ায়, কাছাকাছি বসে। ভোগ অর্পণের পর মায়ের বেদীতে বসেই শ্রীরাধারা অঞ্জলি দেবে।

    এই তো সে চেয়েছিল। মায়ের পাশাপাশি বসতে, কাছাকাছি পৌঁছতে। কিন্তু এ তার কি হল? শ্রীরাধা মাকে দেখছেই না। তার চোখ মহিলাদের প্রতি। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে মন্তব্য, টিপ্পনী। শ্রীরাধা শারীরিকভাবে মায়ের কাছে বসেও যেন সে অনেক দূরে কোথাও। তার মনকে সে মায়ের পায়ে এনে ফেলতে পারছে না। সেই সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটিকেও আর ঐশ্বর্যময়ী লাগছে না তো! মেয়েটি তার লোক দেখানো প্রবৃত্তি দিয়ে শ্রীরাধার কাছে কেমন ঠুনকো এলেবেলে হয়ে গেল।

    শ্রীরাধার রাগ হয়। কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় তার যেন অনেকখানি হারিয়ে গেল। শ্রীরাধা নতুন করে বোঝে, তোমার কথা এরা কেহ তো বলে না, শুধু করে মিছে কোলাহল।

    আজ অষ্টমী। শ্রীরাধা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে মণ্ডপে এসেছে, কুমারীপুজো দেখতে। এইবার ন-জন কুমারী। ছোট ছোট মেয়েদের পরনে লাল শাড়ি, মাথায় ওড়না, কপালে চন্দন, গায়ে ঝুটো গয়না। পরপর নটা টুলে কুমারীদের বসানো হয়েছে। পুরোহিত শুদ্ধাচারে পুজো করছেন। কচি মুখগুলিতে প্রথমে কৌতূহল, তারপর ক্লান্তি, এখন ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফটানি। কুমারীদের অদূরে তাদের মা-বাবারা দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের হাতে ক্যামেরা। এমন একটি দুর্লভমুহূর্তকে ছবির ফ্রেমে ধরে রাখবার জন্য। কুমারীদের দুধ আলতা সহযোগে পা ধোয়ানো হল। পূজা শেষে মহিলারা দেবী জ্ঞানে ওই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দক্ষিণা দেবে।

    শ্রীরাধার চোখের সামনে কয়েকটা ছবি সারবন্দী হয়ে ভেসে ওঠে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যানসার হসপিটালে শ্রীরাধার তখন চিকিৎসা চলছে। সেডেটিভ হয়ে গেছে জলভাত। শরীরে ডিপ দেওয়ার পার্মানেন্ট চ্যানেল অপারেশন করে বসানো হয়েছে। প্রায়ই কোন কারণে ডিপ চলে। হয় ওষুধ, না হয় ব্লাড বা প্ল্যাটেলেট। কিছু খেতে গেলেই বমি হয়। পেচ্ছাপ পায়খানায় কন্ট্রোল নেই। একই ঘরে তারা চারজন পেশেন্ট ছিল। শ্রীরাধার উল্টোদিকের ভদ্রলোক কিছুতেই বাথরুম যেতে চাইতেন না। তিনি নিয়মিত ইউরিনাল ব্যবহার করতেন। রাত্তিরে তার বেডের পাশে একটার পর একটা ইউরিনাল জমা হতো। একদিন সকালে ভদ্রলোকের পা লেগে ইউরিনালগুলো উল্টে পড়ে। সে এক দৃশ্য বটে। সারা ঘরের মেঝেতে প্রস্রাব। দুষ্কৃতকারী লজ্জায় কুঁচকে একপাশে। শ্রীরাধা ও বাকি দুজন পেশেন্ট ঘেন্নায় সিটিয়ে। তারা ঘর থেকে বেরোতেও পারছে না কারণ প্রত্যেকেই একটা দুটো টিউব দিয়ে ডিপ বা কোন যন্ত্রের সাথে যুক্ত।

    ওখানে মেলিনা বলে একজন নার্স ছিল। সে ঘরে ঢুকেছিল রুগীদের ওষুধ দিতে। অবস্থা দেখে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পরিস্থিতি সামলায়। আলমারি থেকে টিস্যুর রোল বার করে অকুস্থলে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। তারপর ধৈর্যের সাথে মমতাময় মুখে সে ওই প্রস্রাব পরিষ্কার করে। শ্রীরাধা ও বাকি পেশেন্টরা নাক থেকে হাত সরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

    শ্রীরাধাকে অবাক করেছিল মেলিনা। সে দেখেছিল সুস্থ মেলিনার মুখের রেখায় কোথাও কোন ঘেন্নার চিহ্ন নেই, নেই কোনরকম বিরক্তি। রুগীর প্রতি সে কোন কটূক্তি করে না, অযথা জ্ঞান দেয় না। এ যেন তারই কাজ। যদিও শ্রীরাধারা ভালো করেই জানতো, এ কাজ সুইপারের, মেলিনার নয়।

    মেলিনার সেই মুখ শ্রীরাধা আজও ভুলতে পারে না। রাগ নেই, বিরক্তি নেই, ঘেন্না নেই। মূর্তিময়ী সেবা যেন। এমনই হয় কি এঞ্জেলদের মুখ ?

    এই যে শ্রীরাধা কুমারীদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, সেদিন যদি এমনই ভাবে মেলিনাকেও প্রণাম করতো!

    অষ্টমীর সন্ধি পুজো শেষ। নবমী নিশির রাত পোহাইলো। আজ দশমী। দধিকর্মের দিন। দধিকর্ম অর্পণের পড় ঘট নাড়ানো। এরপর পঞ্চগ্রাসের মন্ত্র, দুর্গাস্তুতি, প্রণাম, বিসর্জন, দেবীর মূর্তির ভিত নাড়ানো। তারপর জলস্থাপন। একটা থালায় জল ভরে মায়ের পায়ের কাছে রাখা, দর্পণে মায়ের প্রতিবিম্ব দর্শন। প্রার্থনা, মা তুমি কৈলাসে চলে গেলেও আমাদের পাশে থেকো, আমাদের মাঝে থেকো।

    শ্রীরাধার কি মনে হল, মায়ের স্পর্শের আশায় সে আচমকা দর্পণের প্রতিবিম্ব ছুঁতে যায়। থালার জল নড়ে ওঠে, প্রতিবিম্ব ভেঙে ভেঙে পড়ে, শ্রীরাধা মাকে হারিয়ে ফেলে।

    শ্রীরাধা এখন একা। পুজো মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে হনহন করে বাড়ি ফিরছে। তার মনের মধ্যে আলোআঁধারি, ওঠাপড়া, ভাঙচুর, চার দিনের পুজোর স্মৃতি। সে কেন চেয়েছিল মাকে ছুঁয়ে দেখতে? কেন গিয়েছিল মায়ের পাশটিতে? বেশ তো ছিল দূরে, একা। ওই মসৃণ রেশম শাড়ি, ভারী গয়নার ঝলমলে আলো তাকে আকৃষ্ট করেছিল? সে এসেছিল ভ্রমর হয়ে নীলপদ্মের থালার পাশে? পতঙ্গের মত ডানা ঝাপটিয়ে সন্ধিপুজোর প্রদীপের কাছে? তবে ওই ভ্রমর আর পতঙ্গ মাত্র, শ্রীরাধা হয়ে মায়ের কাছে যেতে পারেনি।

    শ্রীরাধা বোঝে, ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ হয় কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে। মা যে নিজে আসেন। মা তো মিশে আছেন। মায়ের স্নেহে, দিদির বকুনিতে, সব্যসাচীর ভালোবাসায়, জনের চিকিৎসায়, মেলিনার সেবায়। যাহাতে শুভ, যাহাতে মঙ্গল, যাহাতে আনন্দ, তাহাই আনন্দময়ী। আনন্দকে ধরতে যাওয়া, আলোকে ছুঁতে চাওয়া—ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর।

    শ্রীরাধার মনের আলোআঁধারি দ্বন্দ্বের বুঝি অবসান হয়। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)