• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬২ | মার্চ ২০১৬ | কবিতা
    Share
  • গোধূলির ডাকপিওন : সুবীর বোস


    গোধূলির ডাকপিওন - ১

    রাতকাপড়ের সুখ লেগে আছে ফোঁটায় ফোঁটায়
    ভাগ্যমন্ত বহু অন্ত্যমিল পার হয়ে
    তুমি আজ সুখী ডাকঘর – আর আমি
    আজও সেই জটিল পিওন

    এখন প্রশ্রয়ী ঋতু – এখন ঈশ্বর দিয়েছেন পরিসর
    তবু মনে হয়
    নিয়ম-অনিয়ম, ব্রতভঙ্গ ও ঝড়ে
    ঢের বেশি ভালো ছিল আমাদের ভীতু চিঠিবেলা!

    গোধূলির ডাকপিওন - ২

    অনামিকা, শেষ তক্‌ রেলিঙের চোখেও আঁকা থাকে
    নিঝুম প্রেমের প্রতিশ্রুতি
    তুমি জানো, সে নিঝুমে গাঢ়তর মেঘের প্রকাশে
    জানালারা ভিজে যায়
    আর মোমের গলনে পড়ে থাকে ভাঙাচোরা আগুনের ছায়া

    অনামিকা, তবু কি প্রত্যাশা থাকে – থেকে যায় রোগ?

    তা না হলে প্রকৃত নিঝুমে আজও তুমি নীল শাড়ি –
    তুমি নীল শাড়ি আড়াআড়ি হেঁটে গেলে
    কেন মনে হয়
    আহ্লাদী রেলিঙ থেকে খুলে আনি
    প্রিয় লাল সোয়েটার!

    গোধূলির ডাকপিওন - ৩

    আমি এখন মধ্য মাঘে প্রবল শীতে ম্লান
    অল্প আলো গৃহস্থালী ভাঁটায় খুঁজি গান
    ক্লান্ত তবু রাত্রি এলে চাঁদ কুড়োনো জলে
    তুলির টানে চেষ্টা করি রঙিন হব বলে

    এমন রাতে সাঁতার চেয়ে স্নানের মাঝে যদি
    ঝিমিয়ে পড়ি তোমার আগে আমার প্রিয় নদী
    ঘাটেই রেখো চোঁয়ানো রাগ ইচ্ছে ঘেঁষা আড়ি
    ক্ষমায় বেঁধো মেঘ বিরতি থিতিয়ে আসা খাঁড়ি

    কৃষ্টি থেকে গাছ-গাছালি সৃষ্টি ছোঁয়া ভোরে
    সবাই কাঁপে দেদার সুখে বৃষ্টি এলে জোরে
    আমিও কাঁপি কাঠের পিঁড়ি শীত-বর্ষা দিনে
    আশায় থাকি দিন ফিরবে আলনা ছেঁচা ঋণে

    আজ গোধূলি সাঁতার চেয়ে মধ্য মাঘে ম্লান
    তুলির তালে হাঁফায় ছায়া নাগাল খোঁজে স্নান!

    গোধূলির ডাকপিওন - ৪

    এখনও আঙুলগুলো আকাঙ্ক্ষা পূরণ চেয়ে
    কী উন্মুখ – যেন ওরা সেই উপনদী
    যার আঁতুড়ে অস্থির লেখা থাকে সমুদ্র দর্শন

    এ নিশ্চিত – তুমি সমুদ্দুর,
    তুমি ফিতে খোলা আলগা অন্তর্বাসের ঢেউ তাই
    প্রেরণা অবশ্যম্ভাবী

    তুমি ঢেউ হও
    তুমি ঢেউয়ের গভীরে মেখে নাও সামুদ্রিক রীতি
    আমি নিষিদ্ধ আকরে আঙুল ছুঁইয়ে দেখি
    সুরে বেজে ওঠে কিনা বসন্ত পেরনো বাতিঘর

    গোধূলির ডাকপিওন - ৫

    আনত চামচ বেয়ে আহা ঝরবে কি অনুরাগ?
    এই তো প্লেটের নাভিতে তিরতির
    আদুরে বিন্যাস। তবু কাপের নিতান্ত
    অবিকলে যতবার প্রিয় ঠোঁট খুঁজি পরিচিত
    অবয়বে – যেন মনে হয় শিকড়েই
    লেগেছে গ্রহণ –
    যেন গোধূলির ছায়াগাছ একে একে নিয়ে গেছে
    আমাদের রোদ ও দুপুর!

    এসো, অবিন্যস্ত লেবু চায়ে চামচ ডুবিয়ে দেখি
    ঔষধি হয় কী না হয় সন্ধ্যার এত জটিলতা!

    গোধূলির ডাকপিওন - ৬

    বারান্দা ও অবসর প্রতিদিন ভুলি মুখরাতে

    যাপনে অতীত এলো মানে
    চোর-পুলিশের খেলা – কখনও আলোর ছাড়পত্র!
    প্রথম অন্তরা জুড়ে তুমি খোলাচুল
    ঢুলু ঢুলু চোখ
    নতুন বইয়ের মতো কুমারী মোড়কবন্দী তুমি
    অহো, টেবিলের কোলাহল ...

    সঞ্চারীতে সেই তুমি – যেন অন্য কেউ
    যে কিনা আমাকে বসিয়ে রাখে বাঁশি ও দীঘির মূল বিপরীতে
    আমি ব্যবহৃত সময়ের দাবি মেনে
    জড়সড় বসে থাকি ঘড়ির কাঁটার ঠিকুজিতে
    আবেগের খোঁজে
    বাকি আর যত কথা – জানে শুধু শেষের অন্তরা
    জানে, প্রকাশের আয়োজনে তুমি খুব বেশি খোলামেলা হলে
    কীভাবে আমিও সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ি, ভাবি –
    হয়ত মোড়কহীন এভাবেই একদিন তুমি
    হাতে হাতে চলে যাবে অন্য কোনও পাঠকের বাড়ি!

    গোধূলির ডাকপিওন - ৭

    ঠোঁটের চলন এখন রাখছি মন্থর চলাচলে
    খণ্ডিত চাঁদ যৎসামান্যে তাই বিষণ্ণ জ্বলে
    অনাড়ম্বর এই সন্ধ্যায় বিনুনির শেষ প্রান্তে
    আজ রাখব না ঠোঁটের আদর তুমি নিশ্চিত জানতে

    তাই আজ তুমি সান্ধ্য মেনুতে প্রান্তিক হলে ফোনে
    হাঁস দেখে খুব ঠোঁট ওল্টালে বিপ্লবী রিংটোনে
    সেতুর উপর নিঝুম আঙুল এমন ভাবছি – ভাববে
    উঁচু রাস্তার অনেক কথাই ভুল লেখা হয় কাব্যে

    ঠোঁটের চলন এই যে রাখছি মন্থর চলাচলে
    রাত্রিও জানে বরফ গলবে সৃষ্টির কোলাহলে
    পাঁজর বলছে কাল ভোরবেলা স্থায়ী চিহ্নের কমা
    বুকপকেটেই আপোষ লিখবে রোদ্দুর করে জমা!

    গোধূলির ডাকপিওন - ৮

    একটা খামে দুপুর লেখা নাম
    একটা চিঠি কপাল জোড়া টিপ
    পিওন দিলে দু-এক ফোঁটা ঘাম
    সন্মোহনী বঁড়শি পাবে ছিপ

    সবিস্তারে ডাকের চেনা চাষ
    নরম জিভে খামের আঠা ঢেউ
    সময় মেনে বদলে গেলে ঘাস
    নতুন মাঠে বন্য হবে কেউ

    পিওন জানে হাতের ঢালে কাজ
    পিওন জানে রীতি, সহজ পাঠ
    পিওন জানে গাছবালিকা, খাঁজ
    কাজ ফুরোলে – নেহাত চ্যালাকাঠ।

    গোধূলির ডাকপিওন - ৯

    ডাকপিওনের কথা মানেই একটা-দুটো ত্যাগ
    সঙ্গে থাকে খাকী পোশাক এবং ঝোলা ব্যাগ
    এসব মেনেই জাগিয়ে রাখি ডাকবাক্সের লাল
    তবুও চিঠির শীত কাটে না খামেই কাটে কাল

    প্রায় প্রতিদিন শিশির জমা ময়নাগুড়ির মাঠে
    কলম থাকে – যেমনটা হয় – মগ্ন নিজের পাঠে
    খামের উপর আঙুল হাঁটে চিঠির নাগাল পেতে
    কব্জি ভাবে নির্জন হব আঙুল যদি জেতে
    ঠিক তখনই শীতের হাওয়া জ্বর তাড়ানোর নামে
    বরফ হাঁকায় চিঠির গায়ে – পত্রপাঠ সে খামে
    ঠিক এভাবেই রোজ কাজিয়ায় জোঁককে ঘেরে চুণ
    পাণ্ডুলিপি ধুলোয় ওড়ে হারিয়ে কাব্যগুণ

    এই আবহে খুব স্বাভাবিক ধ্বস্ত কবির মুখ
    চিঠি বলছে – আড়াল থাকুক – ওটাই কাব্যসুখ!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ - অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments