সুরকার, কবি ও নাট্যকার হিসাবেই দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩ - ১৯১৩) বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। কিন্তু কবিতা, গান ও নাটক ছাড়াও তিনি প্রহসন, পত্রসাহিত্য, এবং সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। রঙ্গলাল, মধুসূদনের সময় থেকেই বাংলাসাহিত্যে সার্থক ও সচেতনভাবে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব সঞ্চারিত হয়। দ্বিজেন্দ্রলালের সামনেও তাঁর পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের আদর্শ ছিল, সে কারণেই ইংরেজি সাহিত্য ও বিলিতি গানের সুর তাঁর ভাবজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল। এ বিষয়ে মোহিতলাল বলেছেন—
“মধুসূদন যেমন বিজাতির সাহিত্যিক আদর্শ নিজের আত্মায় আত্মসাৎ করিয়া বাংলা কাব্যকে নবকলেবর দান করিয়াছিলেন, দ্বিজেন্দ্রলালও আর এক ক্ষেত্রে, সেই ধরনের প্রতিভার পরিচয় দিয়াছিলেন – বিলাতি গীতিসুর নিজ প্রাণে গ্রহণ করিয়া তাহাকে বাংলা ছন্দে ও বাংলা সংগীতে রূপ দিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। সুরের সেই অভিনবত্ব বাংলা ভাষায় তাঁর শ্রেষ্ঠ দান”।বাংলা ও হিন্দি ভাষার আদি স্রোত এবং বিকাশভূমি একই হবার কারণে উভয়ের মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। এই দুই ভাষার প্রদেশসীমাও মিলিত হয়ে আছে। হিন্দি প্রদেশের অনেক কবি ও সাহিত্যকদের বাংলা ভাষার জ্ঞান ছিল ও আছে। অনেক সময় হিন্দি সাহিত্যের কবি ও লেখকেরা তাঁদের সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন বাংলাকে আশ্রয় করেই। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির ঘটনা এই আদান-প্রদানের বিষয়টিকে আরো ত্বরান্বিত করে। দ্বিজেন্দ্রলালের মতো হিন্দি সাহিত্যের জয়শংকর প্রসাদও কবি, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। তিনি হিন্দি সাহিত্যে ছায়াবাদী কবি রূপে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। ‘লহর', ‘কামায়নী, ‘আঁসু’, ‘ঝরনা’, ‘অনামিকা’ ইত্যাদি কাব্য রচনা করে তিনি যেমন কাব্যের ক্ষেত্রে বিশেষ স্থানের অধিকারী হয়েছেন, ঠিক তেমনই ভাবে নাটকের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রসিদ্ধি অনেক।(দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সাহিত্যবিতান, মোহিতলাল মজুমদার, পৃষ্ঠা – ৯১)
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আবির্ভাব ‘পাষাণী’ ও ‘সীতা’ নাটক (বা নাট্যকাব্য) দিয়ে। ‘সীতা’ (১৩০৯) তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। এরপর মোগল ও রাজপুত ইতিহাস অবলম্বন করে নাটক রচনা করেন--‘প্রতাপসিংহ’ (১৩১২), ‘দুর্গাদাস’ (১৩১৩), ‘নুরজাহান’ (১৩১৪), ‘মেবারপতন’ (১৩১৫), ‘সাজাহান’ (১৩১৭)। আবার তিনি হিন্দু যুগ অবলম্বন করে দুটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন—‘চন্দ্রগুপ্ত’(১৯১১) ও ‘সিংহল বিজয়’(১৯১৫, মৃত্যুর দু’বছর পর প্রকাশিত)।
দ্বিজেন্দ্রলাল যে-সময়ে নাটক রচনা করেন, হিন্দুযুগের ইতিহাস সম্পর্কিত বিস্তৃত তথ্য তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ভূমিকায় এই অসুবিধার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন—
“চন্দ্রগুপ্তের জীবনবৃত্তান্ত ইতিহাসে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। পুরাণ মতে তিনি মহাপদ্মের শূদ্রাণী-পত্নীগর্ভজাত পুত্র ও নন্দের বৈমাত্রেয় ভাই। তিনি বাহুবলে নন্দকে সিংহাসন চ্যূত করিয়া মগধের রাজা হন এবং মন্ত্রী চাণক্যের সাহায্যে ভারতে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করেন। সেলুকসের সহিত তাঁহার বিবাহ-এ দুই (?? কোন দুই??) ব্যাপারের উল্লেখমাত্র পুরাণে নাই। গ্রীক ইতিহাসে পাঠে আমরা এ বৃত্তান্ত অবগত হই”।নাট্যকারের স্বীকৃতি থেকে জানা যায় যে, পুরাণোক্ত গ্রীক ইতিহাস মিলিয়ে তিনি চন্দ্রগুপ্তের জীবনীর যে অংশটুকু পেয়েছেন, তাকে ভিত্তি করেই নাটক রচনা করেছেন।
বাংলার প্রতিবেশী হিন্দী সাহিত্যের নাট্যকাররাও বাংলা নাটকের প্রতি গভীরভাবে আকর্ষিত হয়েছিলেন। হিন্দী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার জয়শংকর প্রসাদের বাল্যকালে হিন্দী-সাহিত্যে মৌলিক নাটক বিরল ছিল, বরং বাংলা নাটকের অনুবাদের একছত্র সাম্রাজ্য ছিল। সে সময়ে মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকগুলির অভিনয়ের কথা সর্বত্র প্রচারিত ছিল। হিন্দী নাটকের ক্ষেত্রে ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রের পরে মৌলিক নাটকের অভাব ও অনূদিত নাটকের দ্বারা হিন্দী নাট্য-সাহিত্যে শক্তি সঞ্চার করা হচ্ছিল, সেই সন্ধিক্ষণে জয়শংকর প্রসাদ তাঁর কাজ আরম্ভ করেন। ১৯১১ থেকে ১৯১৫-র মধ্যে তিনি ‘সজ্জন’, ‘কল্যাণী’, ‘পরিণয়’, ‘করুণালয়’, ‘প্রায়শ্চিত্তা’, আর ‘রাজশ্রী’--এই পাঁচটি নাটক রচনা করেন। এর পর তিনি আবার নাটক রচনা শুরু করেন—‘বিশাখ’, ‘অজাতশত্রু’, ‘জন্মেজয়ের নাগযজ্ঞ’, ‘কামনা’, ‘স্কন্দগুপ্ত’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, 'ধ্রুবস্বামিনী’ ইত্যাদি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক রচনা করেন ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে আর জয়শংকর প্রসাদ ‘চন্দগুপ্ত’ রচনা করেন ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে। একই শিরোনাম, একই চরিত্রগুলি (কিছু কিছু স্থানে চরিত্রের নাম পরিবর্তন হয়েছে)-কে নিয়ে দুই নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গির মোটামুটি তুলনা করলে আমরা পাই—
১। দুই নাট্যকারেরই নায়ক চন্দ্রগুপ্তের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের দ্বারা পরিচালিত। চাণক্যবিহীন সে যেন অসহায়। ক্রুদ্ধ হয়ে চাণক্য যখন চন্দ্রগুপ্তের কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তখন চন্দ্রগুপ্ত দুর্গে শত্রু সৈন্য প্রবেশের খবর শুনে বলে—
“আমি যুদ্ধ কর্ব্ব না। আমি নিজের ওপর প্রতিশোধ নেব। আমি আত্মহত্যা কর্ব্ব।”
(দ্বিজেন্দ্রলাল রচনাবলী, চন্দ্রগুপ্ত, চতুর্থ অঙ্ক, পঞ্চম দৃশ্য, পৃষ্ঠা- ২৬৩)
আর জয়শংকর প্রসাদের চন্দ্রগুপ্ত বেশি সাবলম্বী, ধীর ও পরাক্রমী। সেখানে চাণক্য ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যাবার পর সে কিন্তু ব্যাকুল হয় না। তার বন্ধু সিংহরণও চাণক্যকে খুঁজতে চলে যায়, তখন চন্দ্রগুপ্ত বলে—
“পিতা গেছেন, মাতা গেছেন, গুরুদেব গেছেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রাণ দেবার মতো চিরসহচর বন্ধু সিংহরণও গেল, তবু চন্দ্রগুপ্তকে থাকতে হোলো আর থাকতে হবে।"(‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক – জয়শংকর প্রসাদ, চতুর্থ অংক, পৃষ্ঠা – ১৭১ --?? বাংলায় নাকি? কার অনুবাদ? তথ্যসূত্র চাই...??)
২। চাণক্য চরিত্র দুই নাট্যকারেরই অপূর্ব সৃষ্টি। বিদ্বান, বিচক্ষণ ও কুশাগ্রবুদ্ধি এই ব্রাহ্মণ ভাগ্যবিড়ম্বিত ও নিপীড়িত। সেকারণে চাণক্য সৌন্দর্য, করুণা ও বিশ্বাসের স্বর্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে। তার তার চরিত্রে ক্ষমা, সমবেদনা প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি তিরোহিত হয়েছে, তার স্থান অধিকার করেছে জ্বলন্ত প্রতিহিংসাস্পৃহা ও নির্মম অবিশ্বাস। দ্বিজেন্দ্রলালের চাণক্য নন্দ দ্বারা অপমানিত হবার পর নির্মম হয়ে ওঠে, আর নন্দকে বধ করার জন্য চন্দ্রকেতুর বাধাকে অস্বীকার করে কাত্যায়নকে নন্দ-বধের জন্য প্রেরিত করে।—
“চাণক্য – বধ কর কাত্যায়ন।(দ্বিজেন্দ্রলাল রচনাবলী, চন্দ্রগুপ্ত, তৃতীয় অঙ্ক, ষষ্ঠ দৃশ্য, পৃষ্ঠা – ২৫৩)
(কাত্যায়নের খড়গ পড়িল। নন্দের দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইল)চাণক্য – হা: হা: প্রতিহিংসা পূর্ণ হল।”
(নন্দের রক্তে হস্ত রঞ্জিত করিয়া শিখা বাঁধিয়া প্রস্থান)
আর জয়শংকর প্রসাদের চাণক্যও নন্দের দ্বারা অপমানিত। সে নিজের ব্যক্তিগত দ্বেষকে রাষ্ট্রহিতের জন্য বিলীন করে দেয়। নন্দকে হত্যা করবার জন্য নগরবাসীদের বাধা দিয়ে সে নন্দকে বলে—
“আমরা ব্রাহ্মণ, তোমার জন্য ভিক্ষা করে তোমায় জীবনদান দিতে পারি। ... নাগরিকবৃন্দ, তোমরা আজ্ঞা দাও, নন্দকে যাবার আজ্ঞা দাও!”(জয়শংকর প্রসাদ, চন্দ্রগুপ্ত, পৃষ্ঠা – ১৪৯)
৩। দ্বিজেন্দ্রলালের চাণক্য রাজসুখ থেকে বঞ্চিত হবার ফলে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে—
“চাণক্য – বুদ্ধি, বুদ্ধি, বুদ্ধি। শুন্তে শুন্তে অধীর হয়ে গেছি।(দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, চন্দ্রগুপ্ত, পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য, পৃষ্ঠা – ২৬৯)কাত্যায়ন – তুমি ক্ষিপ্ত হয়েছো চাণক্য ।
চাণক্য – (ক্ষণেক নীরব থাকিয়া) এই সুন্দর প্রভাত। ... এই সুন্দর হাস্যময় জগৎ - আর আমি কেউ নয়! একা আমি এই অসীম সৌন্দর্য রাজ্য থেকে নির্বাসিত! আর পঙ্গু আমি তাপিত তৃষিত হৃদয়ে তীরে ছটপট কর্চ্ছি তপোবনের প্রান্তে শূকরের মত পল্বলপঙ্কে পড়ে আছি।”
যেখানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চাণক্য বিচলিত সেখানে জয়শংকর প্রসাদের চাণক্য তার বুদ্ধি দ্বারা রাষ্ট্রের উদ্ধার ও লোক কল্যাণের কামনা করে —
“(চোখ খুলতে খুলতে) কতো গৌরবময় আজকের এই অরুণোদয়! ভগবান সবিতা। তোমার আলোক জগতের মঙ্গল করে। আজ আমি যেন নিষ্কাম হচ্ছি। আজ যেন আমার অন্তর্নিহিত ব্রাহ্মণত্বের উপলব্ধি হচ্ছে। চৈতন্য সাগর নিস্তরঙ্গ আর জ্ঞানজ্যোতি নির্মল।”(জয়শংকর, চন্দ্রগুপ্ত নাটক, পৃষ্ঠা-২০৮)
৪। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চাণক্য যেন সর্বদাই ষড়যন্ত্রকারী, ঈর্ষা-দ্বেষে জর্জরিত ক্রুরকর্মী হয়েই রয়ে গেছে। অবশ্য শেষে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেছে, কিন্তু ব্রাহ্মণের উপলব্ধি করতে পারেনি—
“চাণক্য - আমি বুঝছি যে আমার কঠোর শাসনে যে ক্ষমতা স্বপ্নের প্রাসাদের মত অভ্রভেদ করে উঠেছে, তা স্বপ্নের প্রাসাদের ন্যায় আকাশে লীন হয়ে যাবে। ব্রাহ্মণের নির্জীব ক্ষমতাকে পুনরায় মন্ত্রবলে গড়ে তুলতে পারি, কিন্তু ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব ফিরিয়ে আনতে পারি না।”(দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, চন্দ্রগুপ্ত, পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য, পৃষ্ঠা – ২৬৮)
কিন্তু জয়শংকর প্রসাদের চাণক্য নিষ্কাম বুদ্ধি দ্বারাই রাষ্ট্রের জন্য কাজ করেছে।—
“সে ক্রূর কেবল বর্তমানের জন্য, ভবিষ্যতের সুখ ও শান্তির জন্য পরিণামের জন্য নয়।”৫। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও জয়শংকর প্রসাদ দুজনেই সেলুকসের পুত্রীর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দিয়েছেন। রায় তার নাম রেখেছেন হেলেনা, আর প্রসাদ রেখেছেন কার্নেলিয়া। কার্নেলিয়ার বৈশিষ্ট্য হলো ভারতের দার্শনিকতার সঙ্গে সঙ্গে, সে চন্দ্রগুপ্তের রূপগুণেও মুগ্ধ। এর বিপরীতে দ্বিজেন্দ্রলালের হেলেনার গ্রীক ও ভারতবর্ষকে সম্মিলিত করার ভাবনা এত প্রবল যে সে চন্দ্রগুপ্তের সাথে নিজের বিবাহকে বিশ্বমঙ্গলের জন্য বলিদান ভাবে ।
এভাবে আলোচনার দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে যদিও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’-এ কিছু নতুন বিচার পরিলক্ষিত হয়, তথাপি জয়শংকর প্রসাদ তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি সেখানে কিছু অন্য আদর্শেই রচনা করেছেন। তিনি ঐতিহাসিকতা রক্ষার জন্য চন্দ্রগুপ্তকে ক্ষত্রিয়-বংশী রূপে প্রমাণিত করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ইতিহাসের অনুসন্ধানের কথা চিন্তা না করেই তার অনুরূপ নিজের নাটক রচনা করেছেন, আর সেই নাটকের দ্বারা বিশ্বপ্রেমের কথা বলেছেন, আর প্রসাদ তাঁর নাটকে রাষ্ট্রপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের সমন্বয় স্থাপন করেছেন। এখানেই দুজনের নিজ নিজ দৃষ্টভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়।