‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’ নাট্যদলের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘বোমা’র বজ্রনির্ঘোষ এবং তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থিয়েটার রসপিপাসু ব্যক্তিদের চক্ষু ও হৃদয়কে আকর্ষণ করবে — এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। এই নাটকের নাট্যকার ব্রাত্য বসু। ইতিহাস থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় ‘বোমা’র ঘটনাবলী উদ্ভাসিত। আর সে আলোর সেতুপথে বাঙালির মন ও মনন অতীত থেকে বর্তমানের পথে পা বাড়িয়েছে। অনুশীলন সমিতির সদস্যদের কর্মনিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ, আলিপুর বোমার মামলা, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানাবিধ কর্মকাণ্ড নাটকে ইতিহাসকে সোচ্চারে সমর্থন করে। ইতিহাসের তলায় তলায় দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের চোরা স্রোত বয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির বিপুল ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড যাবতীয় দুর্বলতা সহ স্থান করে নিয়েছে এখানে। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে টিঁকে থাকা, ভেসে ওঠার প্রাণান্তকর প্রয়াসও ঠাঁই পায় এই নাটকে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন—‘সমাজ জীবন গড়ে ওঠার সময় থেকেই দুইটি শক্তি কাজ করে আসছে—একটি ভেদ সৃষ্টি করছে অন্যটি ঐক্য স্থাপন করছে।’ আসলে দ্বন্দ্ব দলাদলি এবং ঐতিহাসিক স্তরে বিশেষ দেশ কালের চাহিদা--এই দুটি পরস্পর সংযুক্ত ব্যাপার। এই দুই ধারার ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে চলতে না পারলে ব্যক্তিনেতৃত্ব ও গোষ্ঠীসমাজ তার ঐতিহাসিক ভূমিকা হারিয়ে ফেলে। এই নাটকের নাট্যকার ব্রাত্য বসু বলেছিলেন যে “বোমা কোনও স্থানিক ভূখণ্ডে আবদ্ধ নয়। রাজনীতি, শিল্প বা সাহিত্যকে মধ্যবিত্ত সমষ্টিগতভাবে deal করতে চাইলে ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্ঘের যে টানাপোড়েন চলে ‘বোমা’ নাটকে তারই পরীক্ষা নিরীক্ষা। বিস্ফোরণের ভিতরে অনন্ত বিস্ফোরণের পালা চলতে থাকে আর ‘বোমা’তে তারই নাট্যায়ন।" (২৪ ঘন্টা চ্যানেলে সাক্ষাৎকার; ১৮ই মে, ২০১৫)। ‘বোমা’ একপক্ষে উপনিবেশবাদের সূত্রে মধ্যবিত্তের নানা টানাপোড়েন এবং অন্তর্ঘাতের ইতিবৃত্ত।
বোমার কান ফাটানো শব্দে, নীল আলোয়, মঞ্চব্যাপী ধোঁয়ায় দর্শক ১৯০৮-সালে পৌঁছে যান দ্রুত। মঞ্চ জোড়া পাটাতনের বিভিন্ন প্রান্তে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নানা বিপ্লবী। যে-কোনো এ্যাকশনের জন্য সদা প্রস্তুত। তাদের দেহভঙ্গিতে ক্ষিপ্রতা, দার্ঢ্য, আত্মবিশ্বাসের দুরন্ত ছায়া। নাটকের চলনের বীজ রোপিত হয় ঐ দুরন্তভঙ্গির স্থির ছবিতে। এই নাটকে পরিচালক ব্রাত্য বসুর কৃতিত্ব এই যে মঞ্চে এক সঙ্গে চার, পাঁচ বা ততোধিক অভিনেতা স্বত:স্ফূর্ত অভিনয় করেছেন স্বচ্ছন্দে। দলগত অভিনয়ের সুঠাম ছাঁদটি বরাবর বজায় থেকেছে এখানে। বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তীর মৃত্যুর সূত্রে তাঁর স্ত্রী কল্পনা নাটকে ঢুকে পড়েন অতর্কিতে। তিনি আপাতভাবে ইতিহাসের কোনো চরিত্র নন। ইতিহাসকে ‘কাটা ছেঁড়া করে নির্মোহ বিশ্লেষণের দায়ভার’ তাঁর উপর ন্যস্ত। অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্রনাথ ঘোষের উৎকেন্দ্রিকতা ইতিহাসবিরোধী নয়। নাট্যকার এ-নাটকে তা ব্যবহার করেছেন মাত্র। ‘বোমা’ নাটকে বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম, গভীর আবেগ, স্ববিরোধিতা, হিংস্রতা, মধ্যমেধার দ্বন্দ্ব সবই বিরাজমান। সংলাপের তীরগুলি ছুটে চলে অতীত থেকে বর্তমান ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিকে। চরিত্রগুলির উদাসীনতা, বৈরাগ্য, দেশপ্রেম, আত্ম উৎসর্গের তীব্র ইচ্ছায় আলোময় হয়ে উঠেছে নাটকের নানা মুহূর্ত। তথ্যচিত্রের আঙ্গিক, অ্যানিমেশনের যথাযথ ব্যবহার নাটকটিকে সমৃদ্ধ করেছে। বিপ্লবীরা ধরা পড়ার পরে আকাশ থেকে যে বৃষ্টিধারা ঝরে পড়ে মঞ্চে তার চমকপ্রদ ব্যবহার—বিষয়ের কারুণ্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
ঐতিহাসিক চরিত্রকে মঞ্চে বা ফিল্মে রূপায়িত করতে গেলে অভিনেতার উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে। সেই চাপ ঝেড়ে ফেলেছেন এই নাটকের সকল অভিনেতা, বিশেষত: বারীন ঘোষের প্যাশন, স্বপ্ন, মেধা ও মনন, দ্বিধাবিভক্ত ব্যক্তিত্ব—সবই ব্যক্ত হয়েছে কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজীর অভিনয়ে। সময়ের ব্যবধানে এই সমালোচক নাটকের তিনটি রজনীর অভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে। কল্পনারূপী পৌলোমী বসুর অভিনয় পরিণততর হয়েছে ক্রমশ:। নাট্যকারের কথায় “এই নাট্যের সমস্ত চরিত্রই ঐতিহাসিক, একজন মাত্র নয়। সে কল্পনা। আর সেখানেই কল্পনা ও ইতিহাসের যুগগ্রন্থিতে আখ্যানের উড়ান।” বারীন ঘোষের আত্মধ্বংসী প্রেমনিবেদনে কল্পনার তীব্র ঘৃণার ফেনিল উচ্ছ্বাস, তেজস্বিনী এই রমণীর উদ্দাম ডাকাতি এই সব মিলিয়ে পৌলোমী বসুর অভিনয়ে দর্শক আবিষ্ট হয়ে পড়েন। উল্লাসকর দত্তের ভূমিকায় অনির্বাণ ঘোষের সেনসিটিভ অভিনয়, দেশপ্রেমের উদাত্ত গান দর্শকের মনে অনুরণন তৈরি করে। চার্লস টেগার্টের চরিত্রে সত্রাজিৎ সরকার সামান্য উচ্চকিত অভিনয়ে ইংরেজ শাসকদের দমন পীড়নের কাজটি ভালই করেছেন। দেবশঙ্কর হালদার অরবিন্দ ঘোষ থেকে ঋষি অরবিন্দের পরিবর্তনটি অভিনয়ে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। ১৯২০-সালের ৫ই জানুয়ারি ব্যাপটিস্টাকে এক চিঠিতে অরবিন্দ লেখেন—‘রাজনীতিকে আমি হেয় মনে করি না, কিম্বা তার উপরে চলে গেছি তাও মনে করি না। আগে তা জোরের সঙ্গেই করেছি কিন্তু এখন আধ্যাত্মিক জীবনের উপরেই জোর দিচ্ছি, যদিও আমার আধ্যাত্মিকতা সংসারত্যাগী বা সংসার বিমুখ নয়। আমার কাছে মনুষ্য জীবনের সবকিছুই পূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবনের অন্তর্ভুক্ত, রাজনীতিও তার মধ্যে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে আমার ক্রিয়াদর্শের অনেক পার্থক্য।’ এই চিঠিটির পরিপ্রেক্ষিতে নাটকের শেষ ভাগে অরবিন্দরূপী দেবশঙ্কর আত্মগ্লানিতে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় ‘বোমা’ শব্দটির যে আর্ত উচ্চারণ করেন তাতে নাটকটি সমকালের পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আর প্রেমহীন ধরিত্রীর ধূসর উষরতাকে মনে করিয়ে দেয়।
‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক লোকের অভ্যুদয় হয় যাঁহাদের সুখদু:খ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সহিত বদ্ধ। রাজ্যের উত্থানপতন, মহাকালের সুদূর কার্যপরম্পরা যে সমুদ্র গর্জনের সহিত উঠিতেছে পড়িতেছে, সেই মহান কলসংগীতের সুরে তাঁহাদের ব্যক্তিগত বিরাগ অনুরাগ বাজিয়া উঠিতে থাকে। তাঁহাদের কাহিনী যখন গীত হইতে থাকে তখন রুদ্রবীণার একটা তারে মূলরাগিণী বাজে এবং বাদকের অবশিষ্ট চার আঙুল পশ্চাতের সরু মোটা সমস্ত তারগুলিতে অবিশ্রাম একটা বিচিত্র, গম্ভীর, একটা সদূর বিস্তৃত ঝঙ্কার জাগ্রত করিয়া রাখে।’ ‘বোমা’ নাটকে নাট্যকার ও অভিনেতার অরিবন্দ চরিত্র সৃজনে সেই মূল রাগিণী এবং তার সুদূর বিস্তৃত ঝঙ্কার একত্রে শোনা গিয়েছে।
দক্ষ অভিনয় এই নাটকের একটি বড় গুণ। হেমচন্দ্র কানুনগোর ভূমিকায় কৌশিক কর, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়-রূপী তরঙ্গ সরকার, পূর্ণ লাহিড়ী-বেশী প্রান্তিক চৌধুরী চরিত্রগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। সরোজিনী-রূপী পাপড়ি ঘোষের অভিনয় স্বাধীনতা যুদ্ধে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ নারীদের কথা স্মরণ করায়। নাটকের শেষে চিত্তরঞ্জন দাশের ভূমিকায় নাট্যকারের সংযত অথচ দৃঢ় আবির্ভাব হৃদয়স্পর্শী। এ নাটকে আলোর কারিগরী ভাবনায় রয়েছেন দীনেশ পোদ্দার আর পৃথ্বীশ রাণা। পৃথ্বীশ রাণার বহুস্তরী মঞ্চ, সিঁড়ি ও নানা ধাপের কুশলী ব্যবহার প্রশংসার দাবী রাখে। সমকালের বাংলা থিয়েটারে ‘বোমা’ একটি সাড়াজাগানো, কুশলী প্রযোজনা যা পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও নানা জায়গায় অভিনীত হয়ে চলেছে।