টেক্সাসের দক্ষিণে স্যান অ্যান্টোনিও শহর। শহরের আনাচে-কানাচে মন কেমন করা আভাস। কারা যেন ছিল, আর নেই, তাদের ফিসফাস। তাদের ফেলে যাওয়া ঘরদুয়ার, পাড়া, গোলা, গমকল, ভাটি, আর গির্জা। গির্জার দেওয়ালে কারা যেন খোদাই করেছে পরী, সন্ত, পাতা, আর—ফুলবাহার। আবছা রং-ওঠা ছবি আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে লেপ্টে আছে দেওয়ালে। বিশাল গম্বুজ গমগমিয়ে তোলে “আভে মারিয়া”। নিথর, নিস্তব্ধ ভারি ঘন্টাগুলো আরও গম্ভীর হয়ে দাবি তোলে গভীরতর তাৎপর্যের। কখনও কখনও মনে হচ্ছে এই বুঝি ফিরবে তারা ঘরে যারা ক্ষেতে গেছে ভোরের প্রার্থনা সেরে ভুট্টা সেদ্ধ আর চেরকি খেয়ে। কখনও কখনও সেই অপেক্ষা চুরমার করে দিচ্ছে প্রাচীনকে দেখতে চেয়ে জমা হওয়া জনতার বিস্ময়বাক। এখানে ঠোক্কর খেয়ে চলেছে পথচলতি আধুনিকতা আর মিশনবন্দি প্রাচীনতা। অন্তত পাঁচবার। কিংবা ছ-সাতবার, দ্য মিশন ট্রেল ধরে দক্ষিণ থেকে উত্তরে।
দক্ষিণতম প্রান্তে 'মিশন এস্পাদা'। ঢোকার মুখে তিন প্রস্থ পাথুরে দেওয়াল। তার মধ্যে ভেতরের দুই দেওয়ালের মধ্যে চওড়া দালান। ছাদ নেই। মেঘলা সকাল গুমোট ছড়াচ্ছে দালানের ঘাসে-ঢাকা মেঝেতে। সেসব পেরিয়ে পায়ে চলা পাথুরে পথ পৌঁছে দিল গির্জায়। তার প্রাঙ্গণে তখন তিরোহিত আত্মাকে শান্তির বাণী শোনাচ্ছেন পাদ্রি। কফিন ঘিরে দাঁড়িয়ে তাঁর পার্থিব জীবনের আত্মীয়, বন্ধু, প্রিয় ও নিকটজনেরা। প্রাঙ্গণের পাশে ঘাসে ছাওয়া কুয়োতলা। কুয়োর মুখ কাঠজালি দিয়ে ঢাকা দেওয়া। জলতোলার জন্য রয়েছে কাঠের কপিকল। ঢাকা সরালেও বালতি গলানোর ফাঁক দেখা যায় না সেখানে। কুয়োর ওপর ছায়া দিচ্ছে শিরিষ গাছ। গাছের ডালে দোল খাচ্ছে নীলচে কালো রোলার পাখির ঝাঁক। মকিং বার্ডের দল অবশ্য ঘাসের গভীরে ঠোঁট চুবিয়ে খুঁটে চলেছে মনপসন্দ খাবার। কোনো অবিমৃষ্যকারী আগন্তুক কুড়কুড়ের ঠোঙাটা কুয়ো পাড়ে ফেলে গিয়েছে। অন্য আরেকজন সংবেদনশীল পর্যটক সেটা কুড়িয়ে নিলেন; ফেলার জায়গা না পেয়ে পকেটে রাখলেন। এসবের মধ্যে দিয়ে শবযাত্রা সমাধিস্থলের দিকে যাত্রা করেছে। আবার ফাঁকা হয়ে গেছে উপাসনালয়ের প্রবেশপথ। কারুকাজে দারুণ কাঠের দরজা ঠেললেই উন্মোচন উপাসনালয়ের। তার দেউড়ি পেরোলে, দুপাশে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা তাক; তাকে রাখা পাথরের সরা ভরা জল। উপাসনালয়ের ভেতরে সাদামাটা কাঠের বেঞ্চি পাতা দুই সারিতে আর নানা পঙ্ক্তিতে। সেসব পঙ্ক্তির শেষে দারুণ উজ্জ্বল রঙিন চালচিত্রের সামনে কাঠের যীশুমূর্তি, মূর্তির সামনে মোমবাতি আর ধূপ। তাদের মোটা দেওয়ালে ছাদের ভারি কড়িতে সোঁদা শীতল গ্রাম্য নিঃস্তব্ধতা, নিবিড় শান্তি, খাঁখাঁ শূন্যতা, আদিম সৃজনীর প্রতি কৃতজ্ঞ ভালো লাগা।
উপাসনালয়ের পাশে পুরোহিতের বিশ্রাম গৃহ। দুয়ে মিলে ইংরেজির ‘L’ অক্ষর। বিশ্রাম গৃহের বারান্দার সামনে বাগান আর সেই শিরিষ গাছে ছাওয়া কুয়োতলা। বিশ্রাম গৃহ থেকে বেরিয়ে ঘরের পথ ধরলেন পুরোহিত। কিন্তু পথরোধ করলেন একদল আগন্তুক। কথাবার্তা সেরে তিনি যে দিকে চলেছিলেন সেদিকেই এগিয়ে গেলেন। আর পর্যটকের মনোযোগ তখন উপাসনালয়ের দেউড়ির ওপরের ঘরহীন ঘন্টাত্রয়ের দিকে। কি সাধারণ কায়দায় অসাধারণ অপরূপ নির্মাণ।
উপাসনালয়ের যে পাশে কুয়োতলা তার উল্টোদিকে ভিতের থেকে ফুটখানেক উঠে আসা কয়েকটা দেওয়ালের অবশেষ। গ্রামে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নাকি খ্রিষ্টিয় অষ্টাদশ শতকেই শুরু হয়েছিল গির্জার উপাসনালয়কে বড়ো করার কাজ। কিন্তু কাজ শুরু করে কোয়াউইটেকেন মিস্ত্রি পালিয়ে যায় তার অতীত জীবনে। তারপর আজ অবধি সেই নির্মাণ শেষ হয়নি, যদিও এই গির্জা এখনও সংলগ্ন গ্রামীণ ধর্মজীবনের প্রাণকেন্দ্র। এসব কথা জানানোর জন্য মিশন এস্পাদায় রয়েছেন ইউনাটেড স্টেট্স ন্যাশানাল পার্ক সার্ভিসের একজন রেঞ্জার।
রেঞ্জারের আপিস ঘর বানানো হয়েছে কোয়াউইটেকেন বাসিন্দাদের পরিত্যক্ত বাসার অবশেষ ব্যবহার করে। সেই যে সেই তিন প্রস্থ পাথুরে দেওয়াল আর ছাদহীন দালান ছিল ঢোকার মুখে সেগুলোই মিশন এস্পাদার সপ্তদশ শতকের কোয়াউইটেকেন বাসিন্দাদের বাসা বা দোকান ঘরের অবশেষ। তার সাথে লম্বভাবে রেঞ্জারের আপিস। তার ভেতরটা কিন্তু আধুনিক সাজে ও আরামে যথাযথ। সেই আপিসের ভেতরেই মিশনের তথ্যভাণ্ডার, প্রাচীন কৃষি, শিকার, পশুপালনে ব্যবহৃত যন্ত্রের আর যুদ্ধাস্ত্রের সংগ্রহ শালা।
মিশন এস্পাদার তিনশ বছরের পুরোনো জলসেচ প্রণালীটি এখনও সজীব। স্যান অ্যান্টোনিও নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার বানিয়ে তার থেকে নানা খাল দিয়ে চাষজমিতে জল সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভূমির ঢাল ধরে জল বয়ে যেত খাল দিয়ে। আর খালের শাখা-প্রশাখার মুখের বাধাকে কপিকলের সাহায্যে খুলে দিয়ে চাষিরা নিজেদের খেতে জল দিতেন। এক এক মিশনে জলসেচের জন্য দিনের একেকটা সময় নির্দিষ্ট ছিল; যাতে ঢালের সর্বত্র কৃষিজমিগুলো যথাযথ সেচ পায়। সেচ নিয়ে নানা কথা জানা যায় মিশন সান উয়ান ক্যাপিসট্রানোর তথ্যকেন্দ্র ও সংগ্রহশালায়। দুই মিশনের মধ্যে দেখা হয়ে যায় মিশন এস্পাদার জলাধার।
মিশন সান উয়ান ক্যাপিসট্রানোর তথ্যকেন্দ্র ও সংগ্রহশালায় তিনশ বছর আগেকার কোয়াউইটেকেন বাসিন্দাদের খাবার, পোশাক, ভেষজের সংরক্ষিত সংগ্রহ আছে। এই তথ্যকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা থেকেই জানা যায় কোয়াউইটেকেনরা কী করে ক্যাথলিক চার্চ আর স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের বশে এসেছিল। সেটা একটা সভ্যতার শুরু ছিল। আর শেষ? মধ্য আর শেষের খোঁজে দেখা হলো মিশন স্যান ওসের সাথে।
মিশন স্যান ওসের তথ্যকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা অডিটোরিয়ামে দফায় দফায় বলা হয় স্যান অ্যান্টোনিওর মিশনগুলির শুরু আর শেষ হওয়ার কথা একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। তাছাড়াও এখানে আছে নানারকম বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক ব্যবস্থা যার সাহায্যে চারশ বছর আগে শুরু হওয়া ইতিহাসের এক অধ্যায়কে, শুধু জানা নয়, বোঝাও যায় মন দিয়ে।
যখন শিল্প-বাণিজ্যকে সাম্রাজ্যের বাহন করে ব্রিটিশরা পৃথিবীর যাবতীয় সূর্যোদয়ের মালিকানা জিতে ফেলেছে, তখনও স্প্যানিয়ার্ডরা সাম্রাজ্য বাগিয়ে চলেছিল ভূমিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক চালে। পুরোনো পৃথিবীর অধিকাংশ তখন ব্রিটিশ বাণিজ্যের সাম্রাজ্যভুক্ত। তাই স্প্যানিয়ার্ডরা বেছে নিয়েছিল নববিশ্ব।
সপ্তদশ খ্রিষ্টিয় শতকের শেষে স্প্যানিয়ার্ডরা নিউ স্পেন অর্থাৎ আজকের মেক্সিকো থেকে উত্তরে টেহাস মানে এখনকার টেক্সাসে ভূমির দখল কায়েম করতে শুরু করে। মূলত লুইসিয়ানায় ফরাসী আধিপত্য কায়েম হওয়ার ফলে স্পেনের সম্রাট লুইসিয়ানা সংলগ্ন এলাকায় নিজেদের অধিকার কায়েম রাখার জন্য সেখানে পাঠান ফ্রান্সিসকান মিশনারিদের। তখন এই অঞ্চলে বাস করত টেহাস নামে ইন্ডিয়ান উপজাতি যাদের থেকে পরে এই এলাকার নাম হয়েছিল টেক্সাস। রিও গ্রান্ডের পুবের জল ও জঙ্গল ভর্তি ছিল পশু, পাখি ও মোটা মোটা গুঁড়িওলা গাছে। এই এলাকায় স্পেন সম্রাটের প্রতিনিধিত্ব করতে প্রথমে আসেন ফ্রান্সিসকান মিশনারিরা। তাঁরা দারিদ্র্য, পবিত্রতা ও বশ্যতার ব্রত নিয়েছিলেন। এঁরাই এই এলাকার যাবতীয় অনুসন্ধানের কাজ করেছিলেন। অর্থাৎ এই এলাকার প্রথম মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এই সমস্ত ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীরাই। এঁরাই এই অঞ্চলের প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষক এবং প্রথম কালানুক্রমিক ঘটনাবিবরণীর লেখকও। যেহেতু তাঁরা শুধু ধর্মের নয় রাষ্ট্রেরও প্রতিনিধি ছিলেন সেহেতু এঁরা এখানে স্পেন সম্রাটের যাবতীয় কূটনৈতিক কাজও করেছিলেন।
সে সময় উত্তর-পূর্ব নিউ স্পেন ও টেহাস জুড়ে বাস ছিল যাযাবর কোয়াউইটেকেনদের। কোয়াউইটেকেন বলে বোঝানো হতো নানা সম্প্রদায় ও উপজাতির আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের। তারা প্রকৃতই আদিম জীবন যাপন করত। খাবার খেত শিকার করে বা সংগ্রহ করে। সংগ্রাহক বলেই তারা বড়ো বড়ো বেতের ঝুড়ি বুনত। বড়ো বড়ো শিলনোড়ায় শক্ত খাবার বেটে নিত। গায়ে পরত শিকার করা পশুর ছাল। আর পায়ে পরত ঘাসে বোনা চপ্পল। এদেরকে ধরে বেঁধে কাপড়ের জামা-পাজামা পরিয়ে চাষি, পশুপালক, কুমোর, কামার, তাঁতি বানিয়েছিলেন মূলতঃ ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসীরাই। স্পেনের সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক জীবনের ভিত গড়ে চলেছিলেন, ধরে রেখেছিলেন তাঁরা। কালক্রমে বিপরীতমুখী সাংস্কৃতিক ঢলে কোয়াউইটেকেনদের ফসলের দেবী গুয়াদালুপে ক্যাথলিক ধর্মে দেবত্ব পান। তার কারণ হয়তো ছিল নতুন জীবনযাত্রা ও নতুন ধর্মানুশাসনে মাঝে মাঝেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠা যাযাবর ইন্ডিয়ানদের মনকে বশে রাখার চেষ্টা। তারা থেকে থেকেই পালিয়ে যেত গহীন বনে; নিজেদের মনের মতো করে স্রষ্টা ও প্রকৃতিকে পুজো দিতে; মূলতঃ যখনই বিচলিত, রোগগ্রস্ত বা আহত হতো, তখনই। নতুন ধর্মানুশাসনে কোয়াউইটেকেনরা বিচলিতও হয়ে পড়ত বেশ ঘনঘন। তাদের যাযাবর জীবনে ধর্মের বাঁধন ছিল না, ধর্ম নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নিয়ম ছিল না, অনবগত বিচ্যুতিতে অপ্রত্যাশিত শাস্তি ছিল না। তার ওপর ছিল ইউরোপ থেকে আসা সর্দি জ্বর, বসন্তের প্রকোপে তাদের জনসংখ্যার ক্রমহ্রাস। সব কিছুকে ছাপিয়ে ছিল উত্তরের অ্যাপাচে আর কোমাঁচে উপজাতিদের আক্রমণ। উত্তরের দুই ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা উপজাতির যাযাবর জীবনে নিশ্চিত খাবারের উৎস ছিল মিশনের শস্যগোলাগুলো আর পশুখামার। তারা থেকে থেকেই আক্রমণ করত মিশনগুলোকে। এদের প্রতিহত করার জন্য স্পেনের রাজা মিশনকে পেয়াদা দিতেন দুজন করে। ফলে লড়াই করে খাবার আগলানোর কাজটাও কোয়াউইটেকেনদেরই করতে হতো। পরে যখন মিশনগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ করদ এলাকায় পরিণত করা হলো আর কোয়াউইটেকেনদের করদাতা চাষিতে পরিণত করা হলো তখন তারা অধিকাংশই পালিয়ে গিয়েছিল তাদের মিশনযুগের আগের জীবনধারণে। তবুও সেই মানুষদের বংশধরেরা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন গির্জা ও চাষ-আবাদ - মিশন জীবনের দুই ভিত্তিপ্রস্তর।
মিশন স্যান ওসের রোসা উইনডো এক চমকপ্রদ ভাস্কর্য। কেউ কেউ বলে ছুতোর পেড্রো উইসার প্রেমিকা রোস স্পেন থেকে টেহাস আসার পথে সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলেন; সেই প্রেমিকার স্মৃতিতে এই কাজ। এই ধারণার সপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিক সূত্র সমর্থিত তথ্য হলো এই জানলা নববিশ্বের প্রথম সন্ত, লিমার সন্ত রোসার স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত। মিশন স্যান ওসের উপাসনালয়ের মূল তোরণে সন্ত ওসে (জোসেফ), আসিসির সন্ত ফ্রান্সিস, সন্ত দমিনিক, দেবী গুয়াদালুপে, সন্ত আনা, সন্ত ওয়াকিন-এর মূর্তিগুলো যেন একটা সম্পূর্ণ পরিবারের ছবি। এদের মধ্যেও রয়েছে রোসা জানালার কারুকাজ। তোরণ ফটকের পাশের দেওয়াল জুড়ে প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া গোলাপি টালিতে সেকালের জ্যামিতিক নকশা। এখানেও গির্জার চারপাশে ঘিরে আছে বাসিন্দাদের খালি বাসা, ফাঁকা শস্যগোলা, মূল ফটকে পাহারাদারির ঘর ও মিনার, মিনারের দেওয়াল জুড়ে বন্দুকের নল গলাবার ফুটো। খিড়কি ফটক পেরিয়ে আছে দোতলা টারবাইন ঘর। যেখানে স্যান অ্যান্টোনিও নদীর জল খাল দিয়ে এসে স্রোতের তোড়ে একটা চাকা ঘোরাচ্ছে। সেই চাকার থেকে জল গড়িয়ে যাচ্ছে নিচের ঘরে রাখা গম ভাঙানো কলের চাকার ফলকে এবং সেই চাকাও ঘুরছে জলের তোড়ে; গম ভেঙ্গে আটা তৈরি হচ্ছে। আবার জলের তোড়ে আরেকটা ফলকওয়ালা চাকাকে ঘুরিয়ে চেলে নেওয়া হচ্ছে আটা। বাকি জল গড়িয়ে যাচ্ছে ঢাল বেয়ে চাষজমির দিকে, আজও।
এর পর মিশন কন্সেপসিয়ন। সেখানে গির্জার বাইরের দেওয়াল রঙচটা মলিন। কিন্তু ভিতরে এখনও জেগে আছে দারুণ রঙিন সব ফ্রেস্কো যেগুলো এখনও মূর্ত করে আবহমান কিছু ধর্মীয় চিহ্ন ও তার অর্থ।
বাকি মিশন আলামো, টেক্সাসের স্বাধীনতার পীঠস্থান। সেটা আলামো প্লাজায়। তার থেকে একটু পশ্চিমে এল মার্কেদো একটা রঙিন বাজার। এখানের ইঁটের আর্চ আর উজ্জ্বল রঙের দেওয়ালে অদ্ভুত প্রাণবন্ত জীবন। বাজারের একধারে অস্থায়ী মঞ্চে গান শুনিয়ে যায় লাতিনো ব্যান্ড। রেস্তোরাঁতে মনোরঞ্জন করে মারিয়াচি। নিউ মার্কেটকে আরও কয়েক পোঁছ পরিষ্কার করে আর কয়েক ভাঁজ ছোট করে নিলে যা দাঁড়াবে এল মার্কেদো খানিকটা তাই।
১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে স্যান অ্যান্টোনিও নদীর সাথে প্রথম চেনাশোনা হয় পুরোনো পৃথিবীর সভ্য মানুষদের। তার প্রায় তিন দশক পরে নদীটার তীরে বসানো হয় ভ্যালেরোর স্যান অ্যান্টোনিও মিশন। কিন্তু ছবছরের মধ্যেই এক ঘূর্ণিঝড়ে ধূলিসাৎ হয় প্রথম দিকে বানানো কুঁড়েগুলো। তারপর আজকের জায়গায় সরে আসে মিশন যাতে নদী থেকে পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায় খেত খামারের কাজ চালানোর জন্য; আবার বানভাসি হওয়ার সম্ভাবনাও না থাকে। তারপর টেক্সাসের পুব দিক থেকে মিশনগুলো একে একে সরিয়ে এনে বসানো হয় স্যান অ্যান্টোনিও নদীর উপত্যকা বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে।
উনিশ শতকের শুরুতে বার বছর স্প্যানিশ সেনা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল আলামো। সেনারা এসেছিল নিউ স্পেনের পাররাসের আলামোর স্যান ওসে সান্টিয়াগো শহর থেকে। তাদের মনে করে মিশনের নাম রাখা হয়েছিল আলামো। এখন অবশ্য আলামোতে দাঁড়িয়ে কয়েক গজ দূরের নদীটার অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না। আলামো আর নদী এই দুইকে নিয়ে স্যান অ্যান্টোনিও শহরের প্রাণকেন্দ্র।
শহরের একতলা নিচে লক গেটের দুপাশে প্রায় পাঁচ মাইল জুড়ে আছে রঙচঙে ফুর্তির এলাকা রিভারওয়াক। দিনে নদীতে নানা রঙের নৌকা চড়া যায়। রাতে ওপরের রাস্তায় নানা রঙের আলোর সাজে ঝলমলানো ঘোড়ার গাড়ির সওয়ারি করা যায়। তার সাথে দেখে ফেলা যায় মাদাম ত্যুসোর মিউজিয়াম আর রিপলে’স বিলিভ ইট অর নট যেমন এগুলো দেখা যায় স্যান ফ্রানসিস্কোর পিয়ার থার্টি নাইনে কিংবা লস এঞ্জেলসের হলিউড বুলেভার্ডে। তাছাড়া আছে নদীর পাড়ে ছাতার তলায় বসে খাওয়ার মজা। রাজহাঁসেরা নদী ছেড়ে ভিড় করে খাবার দোকানের ছাতার নিচে। কিন্তু তাদের খাবার দেওয়া মানা। যাবতীয় বড়ো হোটেল, জামার দোকান থেকে শুরু করে ওষুধের দোকান আর বিখ্যাত কাফে সবই আড্ডা জমিয়েছে রিভারওয়াকে।
শহরটাকে দিনের আলোয় ঘিরে রাখে স্মৃতিমেদুর ইতিহাস। সেই ইতিহাসই মোহময় করে তোলে রাতের সাংস্কৃতিক আবহকে। মিলেমিশে যায় ঘোড়ার গাড়ির ঝলমলে, নরম, রোম্যন্টিক এলইডি আলোর সাথে এমিলি মরগান হোটেলের চূড়ার পতাকায় চুঁইয়ে ওঠা আলো-আঁধারি। সমস্ত আধুনিক যাপনের আনাচ-কানাচ দিয়ে ইতিহাস নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে থাকে অবলীলায়।