—তাহলে?
—তাহলে আমার সামনে আপনি দাঁড়িয়ে নেই?
—আমার পাশটাতেও দাঁড়িয়ে নেই?
—আর পিছনে? পিছনেও কেউ নেই?
তার মানে এই মাঝরাতে – বাড়ির সদর দরজায় শুধু আমিই দাঁড়িয়ে আছি একা—তাই না?
অথচ আমি—আমরা – আপনার তো কোনো ক্ষতি করিনি। আপনার কেন—ভেবে দেখলে কারো কোনো ক্ষতি করিনি কোনোদিন আসলে কারো সাত পাঁচে কক্ষনো থাকিনি আমরা। আমরা মানে বুঝতেই পারছেন আমি আর ইলা। নয়তো এ বাড়িতে আর আছেটা কে? তাই না?
কি ভাবছেন? আমরা এ বাড়িটায় থাকি এটা খুব খোলামেলা দারুণ আলো বাতাসওলা—আর এমন পুরোনো বনেদী পাড়ায় বলেই? ভুল। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আসলে কি জানেন? মায়া—বড়ো মায়ায় জড়িয়ে আছি এই বাপ—ঠাকুরদার আমলের বাড়িটার সঙ্গে। এই বাড়িটার প্রতিটি জানালা—দরজা—সিঁড়ির ধাপ—প্রতিটি ঘরের কোণায় কোণায় আমাদের দুজনের সেই ছোট্ট বেলা থেকে বড়ো হয়ে ওঠার সমস্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেসব কথা বলতে গেলে ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে। কিন্তু তার কতোটুকু বুঝবেন আপনি?
তাই ওসব কথা থাক। শুধু এটা জেনে রাখুন যখন আমি আর ইলা এখানেই থাকার ব্যাপারটা স্থির করলাম তখন অনেকে অবাক হয়েছিলো। দশ বারোজনের থাকার বিশাল বাড়িতে মাত্র দুজন লোকের বাস? ওরা বলেছিলো পাগলামি। কেউ কেউ আবার খুব খারাপ কথা বলতেও ছাড়েনি। কিন্তু আমরা ওসব পাত্তা দিই নি।
তবে আপনার—হ্যাঁ আপনার অবশ্যই জানা উচিত কিভাবে আমি আর ইলা দিন কাটাই এই প্রকাণ্ড বাড়িটাতে। মোটামুটিভাবে সকাল সাতটায় আমরা উঠে পড়ি। আর আটটার মধ্যে চা-জলখাবার শেষ করে এই বাড়ির পরিচর্যাতেই লেগে পড়ি। একটি একটি করে প্রতিটি ঘর—প্রতিটি আসবাব ঝাড়পোঁছ করি। পুরোনো ঘড়িগুলোয় দম দি। কাঁচের শার্সিগুলো মুছে মুছে ঝকঝকে করে রাখি। এইসব করতে করতেই প্রায় এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। তারপর আমি বাইরে বেরিয়ে যাই টুকটাক কিছু কাজ সারতে। আর ইলা তখন রান্নাঘরে ঢোকে। আমাদের দুপুরের খাওয়াটা সাধারণত দেড়টা দুটোর মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আর তারপর? তারপর পড়ে থাকে একটা লম্বা দুপুর আর বিকেল। আর সেটা কিভাবে কাটে জানেন? কিছুই না। আমাদের স্রেফ এই সেই কথাবার্তায়—দুচারটে গল্পগুজবে। সত্যিই চমৎকার কেটে যায় ওই সময়টা। তাই ওই বিশাল বাড়িটায় প্রায় নি:শব্দে দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল আসে টেরই পাই না। অবাক হচ্ছেন? আরে মশাই আর দশজনের মতো বিয়ে-থা করে জীবন কাটালে কেমন হতো সে ভাবনা আমরা দুটিতে বহুকাল হোলো ছেড়ে দিয়েছি। কথাগুলো ভারী অদ্ভুত লাগলো শুনতে তাই না?
তাহলে বলি? আপনি কি জানেন যে ইলার জীবনে অন্তত দুজন ব্যক্তি এসেছিলো। তন্ময় আর অর্ণব। তারা চলে গেলো কেন কে জানে! ইলা কখনো বলেনি আমাকে। আর আমিও জানতে চাইনি নিজের থেকে। নিজে যেচে এসব কথায় কি দরকার? বলুন?
আর আমার কথা? কি বলবো বলুন তো? শুধু এইটুকু জেনে রাখুন যে, মনীষাকে যেদিন আমি কথা দিয়েছিলাম একসাথে চিরটাকাল থাকবো বলে—তার সাতদিন বাদেই সে চলে গেলো সবাইকে ছেড়ে। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যস্। আর কি? উত্তর তিরিশের দিনগুলো কিভাবে পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। এখন চল্লিশের কোঠায় এসে আমদের – না – না – ভুল বুঝবেন না – কোনো খেদ নেই – বরং বেশ আছি আমরা দুটিতে।
সেই সাথে শুনে রাখুন—মন দিয়ে শুনে রাখুন—আমরা এইভাবেই থাকবো এখানে—আরো বুড়ো হবো—তারপর—একদিন এই জন্মভিটেতেই শেষ নি:শ্বাস ফেলবো। তখন হয়তো দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয়রা এ বাড়িতে এসে বাস করবে। কিংবা বেচেও দিতে পারে বাড়িটা। ইট-কাঠ-জমি-টমি মিলিয়ে বেশ মোটা দামই পাবে বুঝলেন! আরে এটাতো আমরাও করতে পারতাম মনে করলেই। কিন্তু সেটা কখনো করতে চাই নি প্রাণ থাকতে! বুঝেছেন?
আর ইলা? ইলার কথাটা ভাবুন তো! সে তো সারাক্ষণ নিজের মনেই থাকে। রান্নাবান্না ঘরদোর পরিষ্কার হয়ে গেলে নিজের ঘরে বেতের চেয়ারটায় বসে ও বোনার কাজ করে। উলবোনা, লেসবোনা, এইসব আরকি। কেন যে এতো বোনে ওই জানে। কিন্তু ওর হাতের কাজ অপূর্ব। সামান্য অপছন্দ হলেই ও সেই বোনাটা খুলে ফ্যালে। তারপর আবার শুরু করে নতুন উদ্যমে। এইসব বোনার জন্যে ওর সামনে সবসময়েই থাকে নতুন নতুন ডিজাইনের বই। যেগুলো অবশ্যই আমার কিনে আনা। আপনি ভাবতে পারবেন না ও কি খুসীই হয় এই বইগুলো হাতে পেয়ে। আর আমারও খুব ভালো লাগে নানান ধরনের এইসব সেলাইয়ের বই খুঁজে পেতে এনে ওর হাতে তুলে দিতে। আমি বুঝি যে এই রঙীন রঙীন উল আর সুতোর কারুকার্যের মধ্যেই আছে ওর খুসীর জগৎ।
আর আমার জগৎটা কোথায় জানেন? গল্পের বইয়ে। বিশেষ করে উদ্ভট রোমাঞ্চকর গল্পে। এডগার অ্যালেন পো, অ্যামব্রোস বিয়ার্স, লাভক্রফট এদের বানানো আবছায়ার জগৎটা আমার খুব পছন্দের।
আমার কথা থাক। ইলার কথা বলছিলাম। ইলার কথাই বলি। কারণ ইলা আর এই বাড়িটা নিয়েই তো যত কথা। আর যত সমস্যা। তাই না? নয়তো আমি কোন হরিদাস পাল আপনাকে এতো কথা বলার?
যা বলছিলাম—মাঝে মাঝে আমি ভাবি এই বোনাবুনির ব্যাপারটা না থাকলে ইলা সারাটা দিন কি করতো। যখন ওকে দেখি ওর ঘরে জানালার ধারে সেই বেতের চেয়ারটায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাড় গুঁজে কি অক্লান্ত পরিশ্রমে ও বুনে যাচ্ছে একটা দারুণ রঙচঙে উলের চাদর, তখন মনে হয় ও যেন ওর জীবনটাকেই এইভাবে বুনে চলেছে নি:শব্দে। আমিও কখনো কখনো মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি ওর শাঁখার মতো ধবধবে সাদা সুন্দর হাত দুটো কিভাবে উলের কাঁটা ধরে সমানে নড়াচড়া করছে প্রজাপতির পাখাদুটোর মতো।
চল্লিশের কোঠায় এসেও ও এখনো যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। বাড়ির বাইরে খুব একটা যেতে দিত না ওকে। মেলামেশাও করতে দিই না যার তার সঙ্গে। জানেন তো দিনকাল যা পড়েছে। তাই সারাক্ষণ দুহাতে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। এই নিরাপত্তা, এই যত্ন—এটাই তো এখন জীবনের সব কিছু। তাই না? আর ও সত্যিই বোঝে আমার এই ব্যাপারটা।
ইলার কথা তো বললাম। এবার ইলার দোসরের কথা বলি। অর্থাৎ এই বাড়িটা। হ্যাঁ এই বাড়িটাকেও আমি আগলে রেখেছি একইভাবে। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না বিশ্বাস করুন।
দেখেছেন? দেখেছেন বাড়িটাকে ভালো করে? লক্ষ্য করেছেন বাড়িটার গড়নটা কতো অদ্ভুত। বাড়ির সামনেটা কি রকম আর পিছনের দিকটা কি রকম? আরে বাবা, একটু খেয়াল করে দেখলেই বুঝতে পারবেন বাড়িটার দুটো অংশ দুরকমের। সামনের দিকটা একটু বেশি পুরোনো আর যাকে বলে সেই আভিজাত্যপূর্ণ। একতলায় আছে বসার ঘর, লাইব্রেরী আর খাওয়ার ঘর। প্রত্যেকটাই বিশাল জমকালো। বিরাট উঁচু সিলিং। সেগুন কাঠের ভারী ভারী দরজা। সারসার রঙীন কাঁচের জানালা। দারুণ কারুকার্য করা মোজাইকের মেঝে। ভালো করে নজর দিলেই বুঝবেন যে এখানকার আসবাবগুলোও তেমনই সেকেলে আর পেল্লায়।
অথচ দেখুন বাড়ির পিছনের অংশটা—কতটা সাদামাটা আর মাপেও কতটা ছোটো। একতলায় একটা বসার ঘর। এর লাগোয়া একটা ভাঁড়ার ঘর। তার পাশেই ছোটো একটা খাওয়ার ঘর। তারপর একটা কলঘর। দোতলায় পরপর তিনটে ঘর। শেষ দুটো আমার আর ইলার। প্রথম ঘরটা বাড়ির সামনের অংশের দোতলার বড়ো ঘরটার সাথে অদ্ভুতভাবে জুড়ে আছে। এই ঘরটাকে আমরা মাঝের ঘর বলি। এই মাঝের ঘরটায় একটা বিশাল কাঠের দরজা আছে। দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া যায় দুদিক থেকেই। আর দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলে বাড়িটা যেন দুটুকরো হয়ে যায়। ভারী গোলমেলে ব্যাপার তাই না?
আরে না না। তেমন কিছু নয়। আসলে বাড়িটার দুটো অংশ আলাদা আলাদা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকেদের হাতে তৈরী। পূর্বপুরুষদের ব্যাপার স্যাপার আর কি! সে যাই হোক। যে কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম। কতো যত্নে বাড়িটাকে আগলে রেখেছি বলুন তো? বাড়ির দুটো অংশকেই সমান যত্ন করে। তাই লক্ষ্য করলে দেখবেন সামনের অংশের বিশাল মোজাইকের মেঝে যেমন ঝকঝক করছে, তেমনই পিছনের দিকের লাল সিমেন্টের মেঝেতেও এতটুকু ধুলো নেই। কতোটা যত্নে আর পরিশ্রমে এই পুরোনো বাড়িটাকে এইভাবে ধরে রেখেছি ভাবতে পারেন?
এইবার সমস্যাটা কিভাবে এলো শুনুন। আগেই বলেছিলাম না—সমস্যাটা ইলাকে নিয়ে আর এই বাড়িটাকে নিয়ে। আমার কিন্তু কোনো ব্যাপার নয়। সেদিন দুপুরে—ধরুন দুপুর দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে—দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলাম, হঠাৎ ইলা এলো কেমন হন্তদন্ত হয়ে। বললো—‘শুনতে পাচ্ছো?’ আমি বললাম—‘কি? কি শোনার কথা বলছিস?’ ও যেন ভয়ে কাঠ হয়ে কোনোক্রমে বললো—‘একটা আওয়াজ’। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—‘আওয়াজ? কিসের আওয়াজ? কোত্থেকে?’ ও একইভাবে প্রায় আড়ষ্ট হয়ে উত্তর দিলো—‘নীচে—নীচের কোনো ঘর থেকে।’
আমি আরো আশ্চর্য হয়ে বললাম—‘সেকি? কোন্ ঘর থেকে?’ ইলা যেন কোনমতে ঠোঁট নেড়ে বলতে পারলো—‘পিছনের দিকের বড়ো ঘরটায়’। ‘হুঁ’—বলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম কি অসহায় আর করুণভাবে ও তাকিয়ে রয়েছে আমার মুখের দিকে। আমি লাফিয়ে উঠে নীচে নামতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আমরা কাঁধটা ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো ও—‘থেমে গেছে – থেমে গেছে আওয়াজটা’। আমি বললাম—‘চুপটি করে একটু দাঁড়া’। বলেই এক দৌড়ে নীচে গেলাম। নীচের সিঁড়ির বড়ো দরজাটা লাগিয়েই উপরে উঠে এলাম। নীচে সত্যিসত্যিই কেউ এলো কিনা—কিসের থেকে ওই আওয়াজটা এলো সেসব তদন্ত করে দেখতে আমি নীচের ঘরগুলোয় ঢুকিনি। কারণ ওখানে ঢুকতে আমি চাইনি। ঢুকতে আমার কোনো ইচ্ছেই হয়নি। আমার দরকার আমাদের নিরাপত্তা। বিশেষত ইলার নিরাপত্তা। তাই সেইটুকু করেই আমি চলে এলাম নীচ থেকে। ওপরে এসে ওকে বললাম—‘সিঁড়ির বড়ো দরজাটা খুব ভালোভাবে আটকে দিয়ে এলাম। নীচের ওদিকে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওদিকটা তো আমাদের কোনো কাজেই লাগে না। এবার থেকে দোতলাতেই থাকবো আমরা। তোর নিরাপত্তার কথাটা তো ভাবতে হবে। তাই না?’ ইলার চোখে চোখ রেখে বললাম কথাগুলো। ইলাও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো। ইলা বরাবরই এরকম। বড়ো বাধ্য মেয়ে। আমার কথা অমান্য করে নি কখনো।
ব্যাপারটা একদিক দিয়ে ভালোই হোলো। কাজ কমলো অনেকটা। এতো বড়ো বাড়ি সাফসুতরো করে রাখার কাজ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেলো। অবশ্য দুটো বিষয়ে আমরা একটু কষ্ট পেলাম। ইলার ছোটবেলার খুব সাধের খেলনাগুলো নীচে পড়ে রইলো। আর আমার বইয়ের একটা বড়ো অংশ রয়ে গেলো নীচের লাইব্রেরী ঘরে।
আমি জানি—বিলক্ষণ জানি—এইবার এই প্রশ্নগুলো উঠবেই—নীচে সত্যি সত্যিই কেউ এসেছিলো কিনা—কিসের থেকে আওয়াজটা এসেছিলো—কতক্ষণ ছিলো এসব আমি কি কিছুই জানতে পারিনি? না। পারিনি। কারণ ওসব জানতে আমার কোন আগ্রহই ছিলো না। আমার চিন্তা শুধু নিরাপত্তা। বিশেষ করে ইলার নিরাপত্তা।
কি ভাবছেন? কি ভাবছেন আমায়? ইডিয়ট? অ্যাবনর্মাল? ইন্সেন? যা খুসী ভাবতে পারেন। তাতে আমার কিছু আসে যায়না। কারণ আমি নিজের কাছে খুব পরিষ্কার যে আমি যা করেছি তা কতোটা উচিত কাজ।
যাইহোক। পরের দিন আবার এক অঘটন। তখন রাত দশটা সাড়ে দশটা হবে। এবার আমিও শুনতে পেলাম। কেমন একটা চাপা খসখসে আওয়াজ। কারা যেন পা চেপেচেপে হাঁটছে। ইলা আমার মুখের দিকে তাকালো। ভয়ে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে ওর ফর্সা মুখটা। আমি দৌড়ে গিয়ে দোতলায় আমাদের দিকে আসার সবকটা দরজাই বন্ধ করে দিলাম। মাঝের ঘরে গিয়ে অনেক কষ্ট করে বন্ধ করলাম ওই প্রকাণ্ড দরজাটা। ঘরে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম—“চিন্তা নেই। আর কোনো চিন্তা নেই।” ও ভয়ে কাঠ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম—“কিচ্ছু হবে না। চারদিক খুব ভালো করে বন্ধ করে এসেছি। আজ থেকে রাতে তুই আমার ঘরে শুবি।” ও আমার হাতদুটো শক্ত করে ধরে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো। তারপরেই আমার ঘরে এসে বসলাম আমরা। মাথার ধারের স্ট্যান্ড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে পড়তে শুরু করলাম পো-এর ‘ফল্ অফ হাউস অফ আশার’। কতবার পড়েছি। কিন্তু যখনই পড়ি তখনই যেন আবার নতুন করে পড়ি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ি। আর ইলা শুরু করলো তার লেস বোনা। তারপর খানিকবাদে আমার পাশটিতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লো।
অতি উদ্ভট কিংবা গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে আমাদের তাই না? বিশেষ করে আমায়? কি বলেন? আরে জানি—জানি—জীবনের বাঁধাধরা ছকের বাইরে চললে লোকে তাদের নিয়ে ঠাট্টা করে—কুকথা বলে—এমনকি আড়ালে গালিগালাজও করতে ছাড়ে না। আর কেউ কেউ ওত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে—সুযোগের অপেক্ষায় কখন ধ্বংস করে দেবে এই রকম ব্যতিক্রমী জীবনকে—লুঠপাঠ করে নেবে সব কিছু। এদের ব্যাপার স্যাপার সব জানা আছে আমার।
হঠাৎ শুনতে পেলাম—‘খটখট – খস্খস্ - খট্খট্।' আওয়াজটা আসছে যেন পাশের ঘর থেকে। আমি লাফিয়ে উঠে পাশের ঘরের দরজাটার দিকে দৌড়োলাম। তারপর দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করলাম আওয়াজটা আসছে কোত্থেকে আর কিভাবে। পরিষ্কার পায়ের আওয়াজ। মনে হোলো পা ঘসে ঘসে কেউ হাঁটছে। কিংবা কিছু টেনেটেনে নিয়ে আসছে। তার মানে ওরা অনেজকন। নীচ থেকে উপরে উঠে এসেছে। প্ল্যান করে। সব্বোনাশ করেছে! তাহলে কি করি? হঠাৎ চমকে উঠলাম ওর হাতের আঙুলের ছোঁয়ায়। কখন নি:সাড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘এবার কি হবে?’—ফিসফিস করে বলে উঠলো ও। বললাম—‘ভাবছি’। ও আমার হাতদুটো শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো আমার গা ঘেঁসে। তক্ষুনি আমার কি মনে হোলো কে জানে—আমি ওর কাঁধটা ধরে টেনে নিয়ে এলাম ঘর থেকে—তারপর বারান্দা দিয়ে একছুটে সিঁড়িতে—সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে একেবারে বাড়ির বাইরে। ও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো আমার মুখের দিকে। তারপর প্রায় নি:শব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো—‘কি হোলো?’ আমি কোনোক্রমে বলতে পারলাম—‘দখল। বাড়িটার দখল নিয়ে নিলো ওরা।’ ও আমার কাঁধে মাথাগুঁজে কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে। ওর পাখির মতো নরম শরীরটা থিরথির করে কেঁপে উঠলো আমার গায়ের উপর। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম—‘হ্যাঁরে—ওরা সব দখল করে নিলো—আমরা পারলাম শেষটায়।’ কিন্তু নাহ্। কোনো আওয়াজই বেরোলো না—সব কিছু কেমন দলা পাকিয়ে এলো আমার গলার কাছটায়।
আর তখনই বুঝলেন—ঠিক তখনই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ছুরির মতো এসে বিঁধলো আমার পিঠের উপর। সারাটা শরীর যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো আমার। দেখতে পেলাম পায়ের কাছের জানালাটা পুরো খোলা। আর সেই দিক দিয়েই হাওয়া আসছে হু হু করে। আর এসে হাড় কাঁপুনি লাগিয়ে দিচ্ছে আমার।
উফ্। দেখে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম আমি। তার মানে বুঝতে পারছেন তো? স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ। ভাবুন তো কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! তারপর জানেন কেমন একটা জড়ভরতের মতো বসে রইলাম বিছানায়। ভাবছিলাম কেন দেখলাম এই ধরনের বিদঘুটে স্বপ্ন। পাশেই ইলা অঘোর ঘুমে অচেতন। হাল্কা আলোয় দেখলাম ওর সুশ্রী মুখের আভাস। কতো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ও। সাবধানে বিছানা থেকে উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে এলাম। শুয়ে পড়লাম ওর নরম হাতটা আমার মুঠোয় নিয়ে। ঘুম আসছিলো না। শুয়ে শুয়ে কতো কি ভাবছিলাম জানেন? ভাবছিলাম আমাদের ছোটোবেলার কথা। এ বাড়ির কোথায় কোথায় খেলা করতাম আমরা। তারপর যেন হঠাৎই বড়ো হয়ে উঠলাম। সব কিছু যেন বদলে যেতে শুরু করলো। কিন্তু বছর দশেক আগের কয়েকটি ঘটনার পর এই বদলে যাওয়াটা আমি আটকাতে পেরেছি। আমাদের বাইরের জগৎটা রোজ বদলাচ্ছে। কিন্তু আমরা জেনে রাখবেন একই রকম আছি। বাইরে কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতে আমাদের কিচ্ছু এসে যায়না। বুঝলেন? পৈতৃকসূত্রে ব্যাঙ্ক থেকে যা পাই তাতে আমাদের দিব্যি চলে যায়। আর ব্যাঙ্কে যা পড়ে আছে তা আমাদের জীবন কাটানোর পক্ষে যথেষ্ট। তাই আমরা দুজনে যেভাবে আছি বাকি জীবনটা সেভাবেই থাকবো। অন্যকথা ভাবতে যাবো কেন বলুন তো? কিন্তু কেউ যদি সেটা সহ্য করতে না পারে—তাহলে সে কি চাইবে না নষ্ট করে দিতে আমার এতো কষ্টে আগলে রাখা ব্যাপারগুলোকে? ওত পেতে বসে থাকবে না অন্ধকারে বেড়ালের মতো সুযোগের অপেক্ষায়? বলুন? বলুন? সত্যি করে বলুন তো দেখি? তাহলে তখন আমার কি করা উচিত আপনিই বলুন।
আর ঠিক সেই সময়েই—‘খট্খট্ – খট্খট্’ – আবার আওয়াজ! চিন্তা করুন—সবেমাত্র শুয়েছি মাঝরাতে। এবার তো আর স্বপ্ন নয়—এবার তো পরিষ্কার জেগে আছি—আর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি—ঘরের দরজায় আওয়াজ করছে কেউ। কিন্তু আমি সিওর যে এই আওয়াজের ধরনটা অন্যরকম।
এতো কড়া নাড়ার আওয়াজ। কেউ ঢুকতে চাইছে? ভিতরে আসতে চাইছে? কিন্তু এই দোতলার ঘর অবধি সে উঠে আসবে কি করে? ভাবতে ভাবতে অত শীতেও সারা শরীর ঘামতে লাগলো আমার। ‘খট্খট্ – খট্খট্’ আওয়াজটা আবার ধাক্কা মারলো আমার কানে।
যতোটা সম্ভব মনের জোর এনে উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম ওই আওয়াজটার দিকে। কেন? আরে—দেখতে হবে না? অনেক সহ্য করেছি। কে এভাবে রাতবিরেতে দরজা ধাক্কাচ্ছে তার সঙ্গে মোকাবিলা আমায় করতেই হবে।
মাঝের ঘরের প্রকাণ্ড দরজাটা খুললাম। নাহ্। কেউ নেই। তাহলে খোলা থাক দরজাটা। আবার আওয়াজ আসে কিনা দেখি। ততক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে থাকি এই মাঝের ঘরের দোরগোড়ায়। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি।
খট্খট্ – খট্খট্ – খট্খট্ – আবার সেই আওয়াজ। দৌড়ে নামলাম সিঁড়ি দিয়ে। তাহলে নিশ্চয়ই সিঁড়ির দরজা থেকে আসছে আওয়াজটা। হাঁফাতে হাঁফাতে সিঁড়ির দরজায় পৌঁছে একটানে দরজাটাকে খুলে দেখলাম সেই একই ব্যাপার! কেউ তো কোথাও নেই!
তাহলে ভাবুন কতোটা তাজ্জব কিংবা ভূতুড়ে ব্যাপার। আমি কিন্তু ভূতটুতে বিশ্বাস করি না। তাই ওইসব ফালতু ভয়ডর আমার নেই। সিঁড়ির দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। নাহ্। আর কোনো আওয়াজ নেই। তখন মনে হোলো—তাহলে কি ইঁদুর বেড়াল কিছু এসেছিলো? এতো পরিষ্কার করে রাখা সত্ত্বেও? ভাবতে ভাবতে আবার উপরে উঠে আসছিলাম। আর তখনই শুনতে পেলাম সেই আওয়াজটা। খুব স্পষ্টভাবে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেই সিঁড়িতেই। খুব মন দিয়ে শুনতে লাগলাম আওয়াজটা। নিশ্চিতভাবেই বাইরের দরজা ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ। শুনুন—আমি কোনো নেশা করিনা। ঘুমের ওষুধ খাই না। মাথার গণ্ডগোলে ভুগি না। অতএব—আমি একশো ভাগ নির্ভুল।
আওয়াজটা একনাগাড়ে হয়েই যাচ্ছিলো। হোক্। হোক্। কোনো তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে পা ফেলে ফেলে নামতে লাগলাম সিঁড়ি দিয়ে। এতক্ষণ ধরে এত কষ্ট করে মাঝরাতে লোকের বাড়ি হানা দিয়েছে যে তাকে তো একটু ধৈর্য ধরতেই হবে। তাইনা বলুন? আরে দরজা তো খুলবেই। অনেকদিন ধরে অনেকক্ষণ ধরে তুমি চেষ্টা করছো এখানে ঢুকতে—তা তুমি যে কে সেটা তো আমাকে জানতেই হবে। কিন্তু আমাদের সাক্ষাৎ হচ্ছে না কিছুতেই। তাই এবার একটু সামনে এসে দাঁড়া। দরজা তো খুলছি এখুনি। হিম্মৎ থাকলে দাঁড়িয়ে থাক। মুখোমুখি বল্ কি চাস? ঠিক বলছি কি না আপনিই বলুন।
হঠাৎ যেন চমকে উঠলাম ঠাণ্ডা আঙুলের স্পর্শে। ইলা! ভাবুন দেখি। ইলা এসে দাঁড়িয়েছে আমার পিছনে। ওর ডান হাতের আঙুলগুলো দিয়ে চেপে ধরেছে আমার কাঁধটাকে। কি পাথরের মতো শক্ত ওর আঙুলগুলো। কি বরফের মতো ঠাণ্ডা ওর সেই দৃষ্টি।
মনে হোলো চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করি—কি বলতে চাইছিস তুই? কি বলতে চাইছিস তোর ওই হিম দৃষ্টি দিয়ে? কিন্তু পারলাম না। বিশ্বাস করুন একটা কথাও বলতে পারলাম না।
‘নারে! ভয় পাস না। কিচ্ছু ভয় পাস না। অনেক হয়েছে। অনেক সয়েছি। আর নয়। আরে আমি তো আছি তোর পাশটাতেই। তাহলে?’—নি:শব্দে কথাগুলো বললাম আমি। ইলার চোখের দিকে তাকিয়ে।
‘কিন্তু এ দরজা আমি খুলবোই। এখুনিই।’ দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো বললাম নিজেকেই। হ্যাঁ নিজেকেই বললাম জানেন। তারপর—তারপর—শক্ত হাতে সদর দরজায় লাগানো লোহার খিলটা এক ঝটকায় সরালাম—বুঝলেন? এবার আস্তে করে খিলটা সরিয়ে সদর দরজার ভারী পাল্লা দুটো খুললাম। আর সোজা তাকালাম সামনের দিকে। কি? কি? বোঝা যাচ্ছে তো? সামনের দিকে—মানে বাইরের দিকে তাকালাম আমি। ঠিক আছে?
আর সামনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি—একি! এতো আপনি?
—তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনি?
—আপনিই এইভাবে মাঝরাতে!
চমৎকার। সত্যিই চমৎকার। দখল নিতে এসেছেন তাই না? দখল? তাহলে আসুন—ভিতরে আসুন —অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন আমার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার—তাই তো? বেশ তো চলে আসুন—
—কোনো উত্তর দিচ্ছেন না কেন?
—আমার কথার কোনো উত্তর দিচ্ছেন না কেন?
—ওইরকম নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম আমি—আর তখনই একটা কনকনে ঠাণ্ডা দমকা হাওয়ায় হঠাৎ কুঁকড়ে গেলাম আমি—হাড় পর্যন্ত ঠক্ঠক্ করে কেঁপে উঠলো—ঠোঁট চিপে চোখ বুজিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম—আর তারপরেই চোখখুলে যেন দেখতে পেলাম—সামনের আবছায়াতে—চলে যাচ্ছেন আপনি—আর ইলা—কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে—হাতে হাত দিয়ে—
—এই তোরা কোথায় যাচ্ছিস?
—আমায় না বলে কয়ে কোথায় যাচ্ছিস তোরা?
—এইভাবে—মাঝরাতে—এক সাথে!
—শোন শোন—
কোনো উত্তর এলো না। মনে হোলো ওরা চলে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে থেকে—দূরে—আরো দূরে—
—তাহলে?
—তাহলে এখন আমার সামনে আপনি দাঁড়িয়ে নেই?
—আমার পাশটাতে ইলা দাঁড়িয়ে নেই?
—আর পিছনে? পিছনেও কেউ নেই?
—তাহলে এখন আমি একা?
—হ্যাঁ – হ্যাঁ – এই মাঝরাতে
—এই ঘোলাটে চাঁদের আলোয়
—এই কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায়—
—আমিই দাঁড়িয়ে আছি—
—কারণ আমিই দাঁড়িয়ে থাকি রে—
—প্রতি রাতে—
—এইভাবে—
—অধমের মতো
—একা
উনিশশো আটাত্তর সালের সতেরোই মার্চ বেলতলা রোডের একটি পুরোনো বাড়ীর দরজা ভেঙে এক প্রৌঢ়ের গলাপচা মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ইনিই অশেষ মিত্র। মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত।
মৃতের বিছানার পাশেই একটি খাতা পাওয়া যায়। খাতার মধ্যে একটি হলুদ হয়ে যাওয়া পুরোনো ছবি ছিলো। ছবিটি একটি অতীব সুন্দরী মহিলার। এনার সাপেক্ষে আর কোনো নথি বা পরিচয় পাওয়া যায় নি।
তদন্তকারী পুলিশ অফিসারটি খাতাটি থেকে ছবিটি বার করে গোপনে নিজের কাছেই রেখে দেন। কেন জানা নেই।
বেলতলা রোডের বাড়িটি এখনো টিঁকে আছে বসতিহীন পোড়ো ‘বিপদ্জনক’ বাড়ি হয়ে। কোনো দাবিদারের সন্ধান পাওয়া যায় নি।
ইন্সপেক্টর অরুণ দে আজ রিটায়ার করলেন। চাকরী জীবনের গোড়ার দিকে অশেষ মিত্রের কেসটিতে ইনিই ছিলেন তদন্তকারী অফিসার। শেষবারের মতো ধবধবে সাদা ইউনিফর্মটি হ্যাঙারে টাঙাতে গিয়ে একটু আনমনা হয়ে যাওয়ায় পোষাকটা পড়ে গেলো তাঁর হাত থেকে।
“ছবিটা কোথায় রেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। ভাবছি আজ মাঝরাতে যাবো নাকি একবার ওই বাড়িটায়?”—হঠাৎই মনে হলো আমার।
ও হ্যাঁ। বলা হয় নি আমিই সেই অধম পুলিশ অফিসার অরুণ দে।
(গল্পটির প্রথম অংশটি Julio Cortazar এর House Taken Over গল্পের দ্বারা প্রাণিত)