সামন্ত বাড়িতে কাজের লোক বলতে দু’জন। একজন অবিনাশ, যে সামন্ত বাড়ির টুকিটাকি অনেক কাজের সঙ্গে সঙ্গে গোয়ালঘরে থাকা গোটা তিনেক গরুর দেখাশোনা করে আর আছে সরলা, যে, এ বাড়ির কাচাকুচি, উঠোন পরিষ্কার করা আর হেঁশেলের কাজ সামলায়।
এ বাড়ির বাকি লোকজন বলতে বিপত্নীক বারীণ সামন্ত, তার পুত্র অজয় এবং পুত্রবধু কাকলি। অজয় ও কাকলির বিয়ে পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও, ওদের কোনও সন্তান নেই। কাপড়ের ব্যবসায়ী মানুষ বারীণ সামন্ত সকাল ন’টার মধ্যেই ছেলে অজয়কে নিয়ে তার রাণাঘাটের দোকানমুখো হন। তারপর বাড়িতে লোক বলতে থাকে কাকলি, অবিনাশ আর সরলা।
অবিনাশের অনেক কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মাঝে মাঝে নিজেকে আড়ালে রেখে কাকলি, মানে তার বৌদিকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখে নেওয়া। এই বৌদিকে দেখলেই অবিনাশের আর মাথার ঠিক থাকে না। সদ্য আঠারো পেরনো অবিনাশ এ বাড়িতে আছে প্রায় আট বছর। কোনও রকমে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়া অবিনাশ বহু রাতেই মনে মনে বা স্বপ্নে নিজেকে দেখে যেন হাতে লাল গোলাপ, আদলে শাহজাহান। কল্পনায় নিজেকে জরির পোশাকে মুড়ে কত রাত যে অবিনাশের যুদ্ধ জয়ের আনন্দে কেটেছে – তার সাক্ষী আছে কেবল কিছু রাত পেঁচা আর তার অগোছালো তক্তপোষ।
অন্যদিকে সরলাকে অবিনাশের ঘোর অপছন্দ। আসলে কাকলিকে নিয়ে অবিনাশের এই তাপ-উত্তাপের খবর যে সরলা ভালোই বুঝতে পারে, সেটা আর কেউ না জানুক, অবিনাশ জানে, প্রবল ভাবে জানে। অবিনাশের বিশ্বাস, এ বাড়িতে সরলা না থাকলে আড়াল থেকে “উঁকি-ঝুঁকি”র ব্যাপারটা সে শিল্পের পর্যায় নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা তো আর হবার নয়। সরলা নিজের কাজ-কর্মটা ভালোই বোঝে এবং সে জন্য এ বাড়ির লোকজন সরলার উপর বেশ খুশি। এ অবস্থায় অবিনাশ যেটা করতে পারত, সেটাই করে – মানে সে সরলাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
এই তো কিছু দিন আগেই কাকলি নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অবিনাশকে ডেকে পাঠিয়েছিল। অবিনাশ বারান্দা পেরিয়ে দরজার কাছাকাছি আসার আগেই থমকেছিল। কাকলি তখন নীল রঙের ম্যাক্সি। কাকলি তখন মাঝের একটা বোতাম খোলা ম্যাক্সি। অবিনাশ বুঝতে পেরেছিল কাকলি খেয়ালই করেনি যে, একটা মোক্ষম বোতাম ঠিকঠাক ঘরে ফেরেনি। সে দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে অবিনাশ তখন আক্ষরিক অর্থেই ঝিনুকে থমকানো সেই পথিক, যে সম্ভাব্য মুক্তোর খোঁজে দিশেহারা। অবিনাশ নিজের শরীরে বারুদের উত্তাপ টের পাচ্ছিল, তার শরীর বিদ্রোহ করতে চাইছিল।
“অবিনাশ, দেশলাই ফুরিয়ে গেছে, এক ডজন দেশলাই কিনে নিয়ে আয়”, অবিনাশের সংবিৎ ফিরেছিল কাকলির কথায়।
সে সময় অবিনাশের ওই ঘোলাটে চোখ, নিশ্বাসে আগুনের সাক্ষী ছিল সরলা, যে কিনা একটু দূরে বসে সব লক্ষ্য রাখছিল। ব্যাপার বেশি দূর গড়ানোর আগেই সরলাই তখন অবিনাশকে থামিয়েছিল “তাড়াতাড়ি দোকান থেকে ফিরিস বাপু” বলে। যদিও সরলা যে দিকে হাঁটে অবিনাশ তার উল্টো দিকে হাঁটাই বেশি পছন্দ করে, তবু সরলার কথা শুনে অবিনাশের মনে হয়েছিল কোনও সর্বনাশ হবার আগে ওখান থেকে কেটে পড়াই ভালো। এবং অবিনাশ ঘোলাটে চোখে সরলাকে খুব গভীর ভাবে মেপে নিয়ে হাঁটা দিয়েছিল দোকানের পথে।
এ ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই অবিনাশ বিভিন্ন ছুতো-নাতায় কাকলিমুখো হয়। কিছুক্ষণ পর-পরই কাকলিকে একবার দেখে না নিলে, অবিনাশের মনে হয়, কী যেন একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। সব চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অবিনাশের কেন জানি মনে হয় যে, তার মনের দোলাচলের খবর কাকলি জানে। আবার তার এ কথাও মনে হয় সবটাই তার মনের ভুল। অবিনাশ খেয়াল করেছে, যতক্ষণ অজয় বাড়িতে – কাকলি তখন নিজের পোশাক এবং চালচলন নিয়ে অনেক সাবধানী। অজয় বেরিয়ে গেলেই কাকলি যেন অন্য কেউ। এমন হয়েছে – ছাদে মেলে রাখা কাকলির শাড়িতে অবিনাশ লুকিয়ে আবেগী গন্ধ খুঁজছে ঠিক সে সময়ই কাকলির আবির্ভাব। ভয়ে কাঁটা অবিনাশ দেখেছে, কাকলি কিছুই দেখেনি এমন ভান করে অবিনাশকে বলেছে, শাড়িটা শুকিয়ে গেছে, তুলে রাখ। অবিনাশ তাই যেন প্রতিদিনই আরেকটু সাহসী, আরেকটু প্রত্যয়ী। ফলাফল, রোজই সে তার বরাদ্দটুকু নিজের মতো করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এভাবে ভালোই চলছিল। কিন্তু গোল বেঁধেছ দিন কয়েক আগে। সেদিন রাতের খাওয়ার শেষে অবিনাশের মনে হল একটু যেন গুরুভোজ হয়ে গেছে। সামন্ত বাড়িতে হাঁটাচলা করার জায়গা অনেক। অবিনাশের মনে হল একটু পায়চারী করলে হয়ত অস্বস্তিটা কাটবে। সেই “পায়চারী” করার জন্যে দু’ পা হাঁটার পরেই হঠাৎ অবিনাশ শুনতে পেল মেয়েলী গলায় কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। ডাক শুনে অবিনাশ একটু থমকাল। তারপর সে পিছন ফিরে দেখল ডাকটা এসেছে তার বৌদির গলা থেকে।
তখন সময় রাত প্রায় দশটা। পাড়াগাঁয়ে রাত দশটা মানে বেশ রাত। অত রাতে অগোছালো, অবিন্যস্ত পোশাকের কাকলিকে দেখেই অবিনাশের গা টা কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। কিন্তু সে তেমন করে কিছু ভাবার আগেই উল্টো দিক থেকে কাকলি প্রায় ভূমিকাহীন বলে,
— অবিনাশ, নিখিল ডাক্তারকে একবার ডাকতে হবে। তোমার দাদার ধুম জ্বর। ডাক্তারবাবুকে ফোনে অনেকবার চেষ্টা করলাম। কেউ ফোন ধরছে না।
কাকলির কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই অবিনাশ বাস্তবে ফিরে আসে। সে দ্রুত চিন্তা করে নেয় – অজয়ের জ্বর, এত রাতে বৌদি তার কাছে – মানে ব্যাপার গুরুতর। তারপর “কোনো চিন্তা নেই বৌদি, আমি এখনই যাচ্ছি ডাক্তারবাবুর বাড়িতে”, বলে অবিনাশ দ্রুত ঢুকে যায় তার ঘরে পোশাক বদলাতে।
এ পাড়ায় ডাক্তার বলতে ডাঃ নিখিল ব্যানার্জী, এলাকায় তিনি নিখিল ডাক্তার নামেই পরিচিত। নিখিল ডাক্তারের বাড়ি মানে অন্তত মিনিট দশেকের পথ। শীত ক্যালেন্ডারের পাতা পেরিয়ে গেলেও নদীয়া জেলার কালীনারায়নপুর, মানে এই গ্রামদেশে এখনও একটা শীত-শীত ভাব আছে। অবিনাশ তাই গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়ে দ্রুত সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল।
মিনিট পনের পরেই দেখা গেল রোগীর ঘরে ঢুকছেন নিখিল ডাক্তার, পিছন পিছন অবিনাশ, হাতে ডাক্তারবাবুর ব্যাগ। ঘরে তখন অজয়ের জ্বর নিয়ে উদ্বিগ্ন কাকলি বারবার অজয়ের কপালে জলপট্টি লাগিয়ে যাচ্ছে। ঘরে তখন আরও একজন, বারীণ সামন্ত, কাকলির শ্বশুর মশাই খুব বিষণ্ণ মুখে পায়চারি করছেন।
অজয়কে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে নিখিল ডাক্তার খুব সরাসরি বললেন, মনে হচ্ছে ম্যালেরিয়া। তারপর বারীণ সামন্তর দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু ফের বললেন, খুব ভালো হয় আজ রাতেই অজয়কে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কোনও বড় ডাক্তার দেখাতে পারলে।
— আজ রাতেই? অসহায়, কাতর শোনালো বারীণ সামন্তর গলা।
— হ্যাঁ, আজ রাতেই। তাড়াতাড়ি ম্যালিগনেন্সি টেস্টটা করিয়ে নিতে হবে। নিখিল ডাক্তার ফের স্পষ্ট নিদান দিলেন।
নিখিল ডাক্তারের নিদানে প্রায় দিশেহারা বারীণ সামন্ত বুঝে পারছিলেন না তার সে মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত। তাঁকে সে সময় বল-ভরসা দিল কাকলি। কাকলি আদতে কলকাতার মেয়ে। তার বাপের বাড়ি বেলেঘাটায়। কাকলি বলল, আপনার কোনো চিন্তা নেই বাবা, আমি ওকে কলকাতা নিয়ে যাব। কাকলির কথায় কিছুটা আশ্বস্ত বারীন সামন্ত তবু জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু এত রাতে তোমরা কলকাতা অবধি পৌছবে কী করে?
— চিন্তা করবেন না বাবা। প্রগতি সংঘের অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন করে দিচ্ছি। ফোন পেলেই ওরা চলে আসবে। কাকলি নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করে তার শ্বশুরকে।
— কিন্তু কলকাতার কোন হাসপাতালে নিয়ে যাবে, সেটা কী কিছু ভেবেছ?
— হাসপাতালে নয় বাবা। আমার বাপের-বাড়ির কাছে একটা ভালো নার্সিং হোম আছে, আমি ওকে ওখানেই নিয়ে যাব।
— ঠিক আছে, তাই যাও। সঙ্গে টাকা-পয়সা নিতে ভুলো না। আর হ্যাঁ, তুমি তাহলে অবিনাশকেও সঙ্গে নিয়ে যাও।
— হ্যাঁ, একা-একা এতটা পথ, সঙ্গে রোগী। হ্যাঁ, বাবা, অবিনাশকে তো সঙ্গে নিতেই হবে।
কাকলির শেষ বাক্যটা যেন নরম তুলি হয়ে অবিনাশের শরীরে রঙিন ছবি এঁকে গেল। তার বুকের ভিতরে স্পষ্ট হল দামামার শব্দ। আহা, এতটা পথ বৌদির সঙ্গে, পাশাপাশি – নাহ্, অবিনাশ আর ভাবতে পারল না।
একটু পরেই প্রগতি সংঘের অ্যাম্বুলেন্স অজয়, কাকলি আর অবিনাশকে নিয়ে রওয়ানা দিল কলকাতার পথে।
অ্যাম্বুলেন্সে কাকলির পাশে বসে অবিনাশের মনে হল সে একটা দামী গাড়িতে বসে আছে বৌদিকে নিয়ে। ওদিকে অজয়, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ, অজ্ঞানপ্রায় পড়ে আছে। কাকলি, অগোছালো পোশাক, মাঝে মাঝে নীচু হয়ে অজয়কে সামলাচ্ছে, মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অবিনাশের সে সব দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে মনে সে তখন নিজেকে রাজা ঠাউরে শরীরে জরির পোশাক চড়িয়ে দিয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্সের ঝাঁকুনি কখনও কখনও অবিনাশকে প্রায় কাকলির গায়ে ফেলে দিচ্ছিল। কাকলির সাবধান বাণী, “অবিনাশ, সামলে” শুনেও অবিনাশের শরীর, মন যেন কথা শুনছিল না। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরকার কষ্টের বাতাবরণ কিছুতেই তেমন করে অবিনাশকে ছুঁতে পারছিল না। এ কথা সত্যি যে, অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে কাকলির আদেশে অবিনাশ কখনও অজয়ের পা ডলে দিয়েছে, কখনও তার কপালে জলপট্টি লেপটে দিয়েছে, কিন্তু সে কাজগুলো সে করেছে প্রায় যন্ত্রচালিত রোবটের মতো।
অবিনাশের মনের এই দোলাচলের মধ্যেই রাত যখন প্রায় আড়াইটা, অ্যাম্বুলেন্স পৌছাল কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলের ‘কেয়া নার্সিং হোম’-এ। কাগজপত্রের ঝামেলা, টাকা-পয়সার হাতবদলের পর দ্রুত অজয়ের ঠাঁই হল একটা কেবিনে। এরপর টানা কিছু পরীক্ষা। ডাক্তারবাবু, যিনি অজয়কে দেখছিলেন, বললেন, রিপোর্টগুলো হাতে পেলে বোঝা যাবে আসলে কী হয়েছে। আপনারা এখন বাড়ি চলে যান, আমরা এখনকার মতো ওষুধ দিয়ে দিয়েছি রোগীকে। রোগী ঘুমোক।
এ দিকে অজয়ের অসুখের খবর পেয়ে ততক্ষণে নার্সিং হোমে পৌছে গেছে কাকলির ভাই তাপস আর তার এক বন্ধু। ডাক্তারের কথা শুনে তাপস কাকলিকে বলল, দিদি তুই বাড়ি চলে যা, আমরা তো আছি। কাকলি গেল তার বাপের বাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স বিষণ্ণ অবিনাশকে নিয়ে ফিরে গেল কালীনারায়নপুর।
বাড়ি ফেরা ইস্তক অবিনাশের মন ভালো নেই। সে শুনেছে অজয় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এখনও অন্তত দশ দিন। তার মানে দশ দিন সে বৌদিহারা। কাকলিহীন সামন্তবাড়ির শূন্যতা যেন অবিনাশকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে চাইছিল।
সেই শূন্যতা থেকে সাময়িক মুক্তি পেতেই মাঝে একদিন অবিনাশ ছাদে গিয়েছিল বিড়িতে দু-টান দিতে। বিড়িতে অনভ্যস্ত টান দিতে দিতেই অবিনাশের হঠাৎ চোখ পড়ে উঠোনের দিকে। উঠোনে সরলা তখন বেশ খানিকটা নিচু হয়ে এখানে-ওখানে পড়ে থাকা শুকনো পাতা জড় করছিল। চাঁদ আকাশের, কিন্তু পূর্ণিমা আসলে পৃথিবীর, এই সত্য প্রমান করার জন্যেই বোধহয় এই প্রথম অবিনাশ তার ঘোর অপছন্দের সরলাকে দেখে শরীরে একটা অন্য উত্তেজনা টের পেল। সরলা, বছর ত্রিশের সরলা তখন শরীরে সাপের বাঁক নিয়ে উঠোন জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবিনাশ মোহগ্রস্থের মতো গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল।
অবিনাশ নিচের বারান্দায় বসে বেশ কিছুক্ষণ খুব কাছ থেকে সরলার উঠোন পরিষ্কার করা দেখল তারপর খুব নিচু গলায় আন্তরিক ডাক দিল, ও সরলাদি, এত কাজ করলে হবে? এস না একটু গল্প করি। অবিনাশের এমনতর আন্তরিক ডাক শুনে সরলা বেশ অবাক হল। সে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অবিনাশকে কিছু কড়া কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়িয়েই দেখল অবিনাশ, খালি গা, হাসিমুখ, বসে আছে বারান্দায়। এই প্রথম সরলা খেয়াল করল, বদ ছেলেটা হঠাৎ করেই কেমন যেন এক শক্তিশালি পুরুষ হয়ে উঠেছে।
সরলা তার কড়া কথাগুলো গিলে ফেলে অবিনাশের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল, — ডাকছিলি কেন বল্?
— ধুর, অত দূর থেকে কথা হয় নাকি। এস সিঁড়িতে এসে বস। একটু গল্প করি।
অবিনাশের এমন ভিন্ন মলাটের কথাবার্তায় সরলা অন্য গন্ধ পায়। সে অবিনাশকে এড়িয়ে যাবার জন্য ফের বলে, এখন বসলে হবে। এখন আমার অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।
— আরে ছাড়ো তো। তোমার খালি সারাদিন কাজ আর কাজ। বললাম তো, এসো একটু গল্প করি। অবিনাশ ফের গলায় মধু ঢেলে ডাকে সরলাকে।
অবিনাশের অমন কথায় সরলা ভিতরে ভিতরে কিছুটা যেন অগোছালো হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না এগোবে না পিছোবে। এরপর কথা ঘোরানোর জন্য সে অবিনাশকে বলে,
— তুই এখানে বসে কী করছিস? তোর কাজ নেই?
— না, যা কাজ ছিল হয়ে গেছে। এখন গল্প করব। ব্যস। কথা বলতে বলতে অবিনাশ সরলার দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে আসে।
সরলা অবিনাশের এই এগিয়ে আসাটা লক্ষ্য করে। তবু কী এক অজ্ঞাত কারণে সে দূরে সরে যেতে পারে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে সরলা ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অবিনাশকে বলে,
— তুই দেখলাম সাদা গরুটাকে কলাগাছে বেঁধে রেখেছিস। বুঝি না কী আক্কেল তোর!
— কেন এতে ভুল কী হলো? অবিনাশ অবাক চোখ রাখে সরলার চোখে।
— আরে কলাগাছটাকে না হোক, কলাপাতাগুলো তো সাবাড় করে দেবে গরুটা। তখন তো আবার গাল শুনবি। সরলার গলায় উদ্বেগ।
— বাব্বা, তুমি আমার কথা এত ভাবো সরলাদি। অবিনাশ মজা করার চেষ্টা করে।
— বাজে কথা না বলে যা গরুটাকে এখনই অন্য কোনও গাছে বেঁধে দে।
— সরলাদি, গরু ওই কলাগাছ ছোঁবে না।
— ছোঁবে না? কেন?
— আমি ওই গাছে গরুর জন্যে ওষুধ লাগিয়ে রেখেছি।
— ওষুধ? হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথা বল্ তো বাপু। আমিও একটু শিখি তোর থেকে।
— আমি ওই গাছের পাতায় আর গায়ে গোবর জল ছিটিয়ে দিয়েছি। বুঝেছ?
— তাতে কী হলো? সরলার প্রায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
— আরে গোবর বা গোবর জল গাছে বা গাছের পাতায় লাগিয়ে রাখলে গরু সে গাছে মুখ দেয় না। তুমি গ্রামের মেয়ে হয়েও এই কথাটা জানো না দেখে বেশ অবাক হচ্ছি।
অবিনাশের যুক্তি শুনে সরলা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ কী সব চিন্তা করে। তারপর হাসতে থাকে, একা একাই। অবিনাশ অবাক। সে বলে, কী গো সরলাদি, একা একা হাসছ কেন? সরলা হাসতে হাসতেই উত্তর দেয়, এমনি।
সে হাসি দেখে আবেগের গভীর থেকে অবিনাশের গলায় খুব সরাসরি উঠে আসে, সরলাদি, তোমার হাসিটা কিন্তু খুব সুন্দর।
অবিনাশের কথা শেষ হওয়া মাত্র সরলার মাথাটা বেশ কিছুটা ঝুঁকে পড়ে। অবিনাশ বুঝতে পারে না, সে ভুল কিছু বলে ফেলল কিনা। অবস্থা সামাল দেবার জন্যে সে ফের বলে, কী হল গো সরলাদি, আমি কি খারাপ কিছু বলে ফেললাম নাকি?
— নাহ্, সে রকম কিছু নয়। সরলা মাথা নিচু করেই বলে কথাটা।
— তবে হঠাৎ এমন মিইয়ে গেল কেন তুমি?
— আসলে এই কথাটাই আরও এক মিনসে বলত এককালে। সে যাক...
— সে যাক বললে হবে? তা সে মিনসে এখন কোথায়? অবিনাশের কৌতুহলি প্রশ্ন
— জানি না। দু’ বছর আদর করে, সোহাগ করে তারপর একদিন কোনো কারণ ছাড়াই রাগ দেখিয়ে মানুষটা যে কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে।
কথাগুলো বলতে গিয়ে সরলার গলা কান্নাতে জড়িয়ে যায়। তা দেখে স্পষ্টতই বিব্রত অবিনাশ বলে, থাক সরলাদি, আর কিছু বলতে হবে না তোমায়।
এরপর সরলা অবিনাশের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে হেঁশেলের দিকে হাঁটা দিল। সরলার হঠাৎ প্রস্থানে সামান্য হতচকিত অবিনাশও অন্য কিছু আঁচ করে গরুকে গোয়ালে ফিরিয়ে আনতে কলাবনের দিকে চলে গেল।
দিন দশেক পরে সুস্থ কিন্তু তখনও দুর্বল অজয় কাকলির কাঁধে ভর দিয়ে ফিরে এল গ্রামের বাড়িতে। অজয়ের ম্যালেরিয়াই হয়েছিল, তবে তা সাধারণ ম্যালেরিয়া। ডাক্তাররা অজয়কে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন। অজয় ক’দিন বিশ্রামে থাকবে। অজয় বিশ্রামের জন্য ক’দিন বাড়িতেই থাকবে। অজয় আজকাল দুপুরে তার ঘরে কাকলিকে নিয়ে বিশ্রাম নেয়। ওদের ঘরের দরজা বন্ধ থাকে। খোলা ছাদে তখন অবিনাশ বিড়ি ফোঁকে আর উঠোনে চরে বেড়ায় সরলা।
কাকলির এমন “প্রায় ঘরবন্দী” অবস্থার মধ্যেও প্রথম দিন কয়েক অবিনাশ কাকলিকে নিয়ে পুরোনো অভ্যেসগুলো ঝালিয়ে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু এই দিন কয়েকের ভ্রমণেই অবিনাশ টের পায় – কোথাও যেন একটা তাল কেটেছে, কাকলিকে নিয়ে তার আর আগের মতো নেশা হচ্ছে না। অবিনাশ অনেক ভেবে নিশ্চিন্ত হয় যে, এমনটা ঘটার জন্য সরলাই দায়ী। সে চেষ্টা করে সরলার ঘনিষ্ঠ হবার। হতে পারে অজয় বাড়িতে আছে তাই অবিনাশ খানিকটা ভয়ে ভয়েই কাকলির থেকে দূরে থাকার চেষ্টা শুরু করেছিল। হতে পারে সরলা অনেক সহজলভ্য এই ধারণাটাই যুবক অবিনাশকে বার বার টেনে নিয়ে গেছে সরলার কাছাকাছি। কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই অবিনাশ টের পেল সাবধানী সরলা সম্ভবত সব বুঝতে পেরে বারবার অবিনাশের পাতা জাল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এই জাল গড়া আর জাল কেটে বেড়িয়ে যাওয়ার জটিল গদ্যের মধ্যেই এক সকালে সরলা মন দিয়ে পেঁয়াজ কাটছিল হেঁশেলে, ঠিক সেই সময়ই হন্তদন্ত ঢুকল অবিনাশ এবং বলল, সরলাদি, তাড়াতাড়ি দেখে যাও আমাদের পেয়ারা গাছটায় একটা অদ্ভুত পাখি এসে বসেছে। “তুই দ্যাখ গিয়ে, আমার সময় নেই” বলে আবার পেঁয়াজ কাটায় মন দেয় সরলা। অবিনাশ এবার হঠাৎই, “চলো না” বলে সরলার হাত ধরে তাকে তুলতে গেলে সরলা অবিনাশের গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সারা শরীরে অপ্রত্যাশিত নরম স্পর্শ অবিনাশকে থামিয়ে দেয়। সরলা নিজেকে কোনও রকমে ছাড়িয়ে, “কিছুই হয়নি” ভাব করে ফের পেঁয়াজ কাটতে বসে যায়। অবিনাশ ধীর পায়ে হেঁশেল ছেড়ে যাবার সময় একবার পিছন ফিরে দেখে তার সরলাদি মাথা নিচু, খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এরপর অবিনাশের জাল ক্রমশ পোক্ত হয়েছে এবং সে আরও বেশ কয়েকবার কখনও উঠোনে, কখনও সিঁড়িতে, কখনও ফাঁকা ছাদে একদম গায়ে-গায়ে তার সরলাদির এই জোরে জোরে নিশ্বাসের সাক্ষী থেকেছে।
এবং এ সবের সাক্ষী যে আরও একজন ছিল, সেটা বোঝা গেল কয়েক দিন পরেই। অজয় তার “বিশ্রাম” কাটিয়ে ব্যবসায়ে ফিরে যাবার পর থেকেই কাকলির বেশিরভাগ দুপুর এখন ফের টিভিতে সিরিয়াল দেখে কেটে যায়। সেই “বেশিরভাগ দুপুর”এর একদিন কাকলি হঠাৎ হাঁক পাড়ল, অবিনাশ একবার এদিকে আয়, আমার ঘরে।
কাকলির সেদিনের ডাকে কিছু একটা ছিল যা অবিনাশকে ভয় পাইয়ে দিল। সে খুব ভয়ে ভয়ে কাকলির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আজ কাকলির ম্যাক্সিতে সবকটা বোতাম ঠিকঠাক লাগানো আছে কিনা সেটা দেখার মতো সাহসও ছিল না অবিনাশের। সে মাথা নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বলল, বৌদি আমাকে ডেকেছিলেন? — হ্যাঁ, তোর সাথে বিশেষ কিছু কথা আছে।
কাকলির এই “বিশেষ কিছু কথা” শুনে অবিনাশ আরও ভয় পেয়ে যায়। সে পিছন ফিরে দেখতে পায় এই সামন্ত বাড়িতে কাজটা পাবার আগের প্রায় না খেতে পাবার দিনগুলো। সে জড়ানো গলায় বলে, বলুন বৌদি, কী কথা।
— তোর আজকাল কী হয়েছে বল তো? তোর অজয়দা কলকাতার নার্সিং হোম থেকে ফিরে আসার পর থেকেই দেখছি তোর ব্যবহার অনেক বদলে গেছে। কী ব্যাপার?
— আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বৌদি। অবিনাশ আমতা আমতা করে।
— লক্ষ্য করে দেখেছি তোর আজকাল কাজে আর তেমন মন নেই। তোর হাঁটা চলা দেখলে তো মনে হয় যে নবাব পুত্তুর পায়চারিতে বেরিয়েছেন।
— কী বলছেন বৌদি। আমি তো আগের মতোই সব কাজ করি। এই তো গরুগুলোকে রোদ থেকে ছায়ায় বেঁধে দিয়ে এলাম।
— তুই থাম। আগে বিকেল না হতেই ছাদে মেলা সমস্ত জামা-কাপড় তুই ঘরে তুলে দিয়ে গুছিয়ে রাখতিস। আজকাল দেখছি সন্ধ্যা হয়ে গেলেও তোর কোনও হুঁশ থাকে না। কাকলির গলায় তখন প্রকৃত মালকিনের মেজাজ।
— বৌদি, আসলে অন্যদিকের কাজ কম্ম মানে অনেকটা বেড়ে গেছে তো তাই...
— অন্য দিকের কাজকম্ম? হুম্ম্, সেটা আমিও লক্ষ্য করেছি।
কাকলি এবারের কথাগুলো বলে বেশ বক্রভাবে। এতে অবিনাশ পুরো গুটিয়ে যায়। সে চুপ করে যায়। অবিনাশকে চুপ করে থাকতে দেখে কাকলি ফের বলে,
— আজকাল মাঝে মাঝেই তুই আর সরলা কী এত গুজুর-গুজুর করিস বল তো?
অবিনাশ ঠিক এই ভয়টাই করছিল। সে ভেবে দেখল যে ব্যাপারটা হালকা না করতে পারলে তার ঘোর বিপদ। তাই খুব বিনয়ের সঙ্গে সে বলল,
— ওহ্, সরলাদি? সে তো গল্প করতে আসে আমার সঙ্গে। আমিও যাই। আসলে সারাদিন কাজ-কম্ম করে একটু গল্প করলে যদি...
কাকলি অবিনাশকে কথা শেষ করতে দেয় না। গলা আরও চড়িয়ে সে বলে,
— না, ব্যাপারটা এত সোজা নয়। তোকে আমি বেশ কয়েকদিন দেখেছি যে তুই দুম-দাম হেঁশেলে ঢুকে আড্ডা জমিয়েছিস।
— সে তো কাজ থাকলে যাই। অবিনাশ এবারের উত্তরটা একটু দ্রুত দিয়ে ফেলে।
— কাজ? হেঁশেলে তোর কী কাজ? আগে তো কখনও ও -চত্বরে তোকে দেখা যেত না। কাকলি চেপে ধরে অবিনাশকে।
— ওই সরলাদি হয়ত বলল, একটু জল তুলে দিয়ে যা...
এবারেও অবিনাশের কথা শেষ হবার আগেই কাকলির হুঙ্কার, তুই থাম। আমাকে কি বাচ্চা পেয়েছিস নাকি? তোর দাদা অসুস্থ হয়ে কলকাতা যাবার আগে দেখেছি, সরলা তোকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না। তুইও ওকে এড়িয়ে চলতি। আমার কাছে ও তোর নামে অনেক নালিশ করেছে। আর এখন তোর সঙ্গে দু-বেলা গুজুর-গুজুর না করলে তার চলছে না। তাই তো?
অবিনাশ কাকলির এই বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে পুরোপুরি ভেঙে পড়ার আগে বলে,
— সরলাদি আমার নামে আপনার কাছে কী নালিশ করেছে বৌদি?
— সে অনেক কথা। সে সব নিয়ে আমি তোর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই না। তুই নিজেই তো জানিস...
কাকলির কথা শেষ হবার আগেই এবারে অবিনাশ, দু-চোখে ভয়, বলে, বৌদি, আমি না জেনে কোনও অন্যায় করে থাকলে দয়া করে ক্ষমা করে দিন আমাকে। দাদাকে আবার এ সব কথা বলবেন না যেন। এবার থেকে আপনি যেমনটা বলবেন, তেমনভাবেই চলব আমি।
এতগুলো কথা বলার পরেও উল্টো দিক থেকে কোনও উত্তর আসছে না দেখে অবিনাশ মাথা তুলে দেখল, কাকলির ঠোঁটে একটা অর্থবহ হাসি হেঁটে বেড়াচ্ছে। ঠোঁটে ওই হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই কাকলি অবিনাশকে বলল, যা, এবারের মতো তোকে ক্ষমা করে দিলাম। এর মধ্যে যদি নিজেকে না শুধরে নিস, আমি ব্যাপারটা তোর দাদার কানে তুলব। হ্যাঁ, এবার তুই আসতে পারিস।
কাকলির ঘর থেকে বেরিয়ে অবিনাশ গোয়ালঘরের দিকে হাঁটা দিল। গোয়ালঘরের কাছাকাছি পৌছে অবিনাশ দেখল সরলা অপেক্ষা করছে তার জন্যে। “তোকে বৌদি ডেকেছিল কেন রে?” সরলা চোখেমুখে উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অবিনাশের দিকে। “ও কিছু না, এমনিই”, এড়িয়ে যাবার ভঙ্গিতে ঘর্মাক্ত অবিনাশ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল।
অবিনাশের এমন দায়সারা উত্তরে সরলা কিছু একটা আঁচ করে। সে এবার গলা চড়িয়ে বলে,
— কিছু না, এমনিই মানে? তুই কিন্তু একটা কিছু চেপে যাচ্ছিস। সত্যি করে বল কেন ডেকেছিল।
একটু আগে কাকলির কড়া ধমক খেয়ে তখন অবিনাশের সরলা-নেশা প্রায় ঘুঁচে যাবার মুখে। নতুন করে আর কোনও বিপদে সে নিজেকে জড়াতে না চেয়ে অবিনাশ মূল আলোচনাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য বলে,
— আরে ধুর বাবা, বললাম তো এমনিই। আর হ্যাঁ, বৌদি বলল অজয়দার জন্যে ওষুধ কিনে আনতে হবে।
— অবিনাশ, তুই মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না। সরলার গলা আরও চড়ছে।
— ফাঁকি দেবার কী আছে? বৌদি কি আগে আমাকে এভাবে ডাকেনি কখনও আগে? অবিনাশ কৈফিয়ত দেবার ঢঙে বলে কথাগুলো। — হ্যাঁ, আগে এভাবে অনেকবার ডেকেছে। কিন্তু আজ বৌদির চোখ অন্য কথা বলছিল। নির্ঘাত আমার নামে কিছু বলছিল। কী বলছিল বল? নইলে তোর মরণ কিন্তু আমার হাতে —
— সত্যি বলছি তোমার নামে কিছু বলেনি। অবিনাশ ফের এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে সরলাকে।
অবিনাশের কথা শুনে সরলা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর অবিনাশকে সরাসরি বলল, বৌদি তোকে ওষুধ আনার কথা বলেছে, তাই তো? তার মানে তোকে ওষুধ আনার টাকাও নিশ্চয়ই দিয়েছে। কই টাকা বের কর দেখি। ওষুধের টাকা।
অবিনাশ এমন একটা আক্রমণের জন্যে তৈরি ছিল না। সে আমতা আমতা করছে দেখে সরলা অবিনাশকে একটু আড়ালে নিয়ে তার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে। সে অবিনাশকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করার ভঙ্গিমায় বলে, তুই বলবি কিনা বল?
সরলার বুদ্ধি এবারে কাজে এল। গায়ে নরম মাংসের স্পর্শে যুবক অবিনাশ ভুলে গেল তার প্রতিজ্ঞার কথা, ভুলে গেল তার বৌদির হুঁশিয়ারি। এবং এরপর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ পর্বে অবিনাশ আস্তে আস্তে বৌদির সব কথাই উগরে দিল সরলার কাছে।
অবিনাশ ভেবেছিল, সব কথা শুনে সরলা সেদিনই হয়ত বৌদির সঙ্গে ঝগড়া করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল, সব শুনে সরলা ঠোঁট চেপে হাসছে। অবাক অবিনাশ প্রশ্ন না করে পারল না,
— সরলাদি, তুমি হাসছ?
— হ্যা, হাসছি। আমি জানতাম যে বৌদি এসবই বলবে। সরলার গলায় হেঁয়ালির ছোঁয়া।
— তুমি জানতে? অবিনাশ আরও অবাক।
— হ্যাঁ, জানতাম। এমনটা যে ঘটবে আমি সেটা জানতাম। সরলায় গলায় প্রত্যয়।
— আচ্ছা সরলাদি, একটা কথা বলো। তুমি কি সত্যিই বৌদিকে আমার নামে কখনও কিছু বলেছ?
— সে সব তোর জেনে কাজ নেই। যা তুই তোর কাজে যা।
— বল না, সরলাদি, কিছু অন্তত বল। অবিনাশ ছেলেমানুষের মতো জেদ দেখায়।
— আগে তুই বল, তোকে কলাগাছে গোবর জল ছেটানোটা কে শিখিয়েছিল? সরলা অবিনাশকে প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
— সে তো আমি অনেক ছোটবেলায় শিখেছি। আমার কাকা শিখিয়েছিল আমাকে। অবিনাশের সরল উত্তর।
— আজকেও তো দেখলাম সাদা গরুটাকে একটা কলাগাছে বেঁধে রেখেছিস। গাছে গোবর জল ছেটাতে ভুলে যাসনি তো?
— আজকে আর গোবরজল ছেটাইনি। অবিনাশ জবাব দেয়।
— সেকি গোবরজল ছেটাতে ভুলে গেছিস। তাড়াতাড়ি যা...এতক্ষণে হয়ত ওই গরু গাছটাকে সাবাড় করে দিয়েছে।
— সরলাদি, আজ ওই গরুটার নাগালে থাকা কলাপাতাগুলোয় আমি কিছুটা গোবর মাখিয়ে দিয়েছি। মানে আজকে আরও কড়া ওষুধ দিয়েছি।
কথা শেষ করে অবিনাশ হাসে। তারপরই সে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে সেইভাবে সরলাকে বলে, আচ্ছা সরলাদি, তুমি বললে না তো – তুমি আমার নামে বৌদিকে কিছু বলেছিলে কিনা।
অবিনাশের কথা শুনে সরলা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে, গরুর ওষুধ গোবরজল, গরুর ওষুধ গোবরজল। তারপর সে মাথা তুলে অবিনাশকে বলে, তোর এত জেনে কাজ নেই। তুই নিজের কাজে যা। কথা শেষ করে সরলা আবার হাসে, প্রাণখুলে হাসে।
সরলার অভিব্যক্তি এবং কথা শুনে অবাক, হতচকিত অবিনাশ “নিজের কাজে” যেতে যেতে লক্ষ্য করে, তার সরলাদির ঠোঁটে তখন আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে দেখে আসা বৌদির অর্থবহ, আত্মবিশ্বাসী হাসি।