ঘানায় ভলন্টিয়ার ডাক্তারী করতে যাওয়ার সময় মনে হোলো এই সুযোগে টিমবাকটুও দেখে আসা যায়। সবারই মনে গোপন ইচ্ছা টিমবাকটু দর্শন। পৃথিবীর সুদূরতম শহর বলে তার এত খ্যাতি।
|
কিন্তু কাজের সময় দেখলাম ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয়। ম্যাপে কাছে দেখালেও সোজাসুজি ঘানা থেকে যাওয়া যায় না। আমার ইচ্ছা ছিল দেশ দেখতে দেখতে ট্রেনে যাব। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকায় সেরকম দূরপাল্লার ট্রেন নেই। মোটরগাড়িতে যাওয়াও বিপজ্জনক; পথে লুঠতরাজের ভয়। একজন বন্ধু উপদেশ দিলেন নাইজার নদী বেয়ে নৌকায় যাও। দেখলাম অগষ্ট মাসে নদী শুকনো ও নৌকা যাচ্ছে না। আবার বৃষ্টি এলে তবে ছাড়বে। তা বৃষ্টি কবে আসবে, আদৌ আসবে কিনা তা ভগবানের ইচ্ছা। তাই রোমান্স ছেড়ে প্লেনেই যাওয়া ঠিক করলাম। তাও অনেক হ্যাপা। ঘানায় কুমাসি থেকে বাসে আক্রা; আক্রায় প্লেন নিয়ে আবিদজান সেখান থেকে অন্য প্লেনে মালির রাজধানী বামাকো; সেখানে গিয়ে আটকে গেলাম। সেখান থেকে উত্তর সাহারা মরুভূমির প্রান্তরে টিমবাকটু যাওয়ার প্লেনের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যখন বেশ কয়েকজন যাত্রী জোগাড় হয় তখনই ছাড়ে। ছন্নছাড়া শহর (দেখার কিছুই নেই) বামাকোয় দুদিন কাটাতে হল।
টিমবাকটুর এয়ারপোর্টটা ছোট্ট। একটা বাস-স্টেশনের মতো। সিকিওরিটি, ভিসা, পাসপোর্টের কোনো বালাই নেই। নেই কোনো গেট বা দেয়াল। প্লেন থেকে নেমে ব্যাগ হাতে শহরের দিকে হন্টন।
মালির উত্তর ভাগ সাহারা মরুভূমির ও তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চল সাহেলে পড়ে। দক্ষিণভাগ একটু উর্বর। সেখানে রাজধানী বামাকো। মাঝখানে বিশাল নদী নাইজার টিমবাকটু পর্যন্ত গিয়ে মরুভূমিতে শেষ হয়ে যায়। টিমবাকটু ঠিক সাহারা মরুভূমির এককোণে। বহু শতাব্দী আগে সিল্ক রোড যখন রমরমা ছিল, দূর দেশ ভারত, চীন, ও আরব সাম্রাজ্য থেকে ব্যবসায়ীরা আসত সিল্ক আর মশলাপাতি নিয়ে। এখান থেকে নিয়ে যেত নাইজারের বেলাভূমিতে পাওয়া মরুর লবণ। এখনও তাল তাল নুন বাজারে বিক্রী হয়। টিমবাকটুর তখন খুব নামডাক। ইবন বতুতা ভারত থেকে এই শহরে এসে থেকেছেন। তাঁর নাম লেখা বাসাটি এখনও সুরক্ষিত।
|
শুধু ব্যবসাই নয়, টিমবাকটুর খ্যাতি ছিল তার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। আট, নয়, দশ শতাব্দীতে পৃথিবীর দূর প্রান্ত থেকে ছাত্ররা এখানে শিক্ষা নিতে আসত। এখনও হাজার বছরের পুরনো কোরানের পাতা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। টিমবাকটু ইউনিভার্সিটির তখন হাভার্ড অক্সফোর্ডের মতোই নাম-ডাক ছিল।
|
তারপর এই শহরের ওপর দিয়ে কত সহস্র মরুধূলির ঝড় বয়ে গেছে। এখন সেই পুরনো গৌরবের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু সাহারার উপজাতিদের কেন্দ্র হিসেবেই টিঁকে ছিল। ইদানিং ট্যুরিজমের দয়ায় একটু রুজি-রোজগার হচ্ছে।
|
|
টিমবাকটুর আরেক দ্রষ্টব্য হল মাটি দিয়ে তৈরি মসজিদগুলি। ইজিপ্ট-এর কথা না ধরলে, এই শহরের মসজিদগুলিই সারা আফ্রিকা মহাদেশে সবথেকে পুরনো। এদেশের মধ্যে সবথেকে পুরনো হল জিঙ্গেরেবার (Djinguereber) মসজিদ, ১৩০০ শতাব্দীর তৈরি। মাটির পলেস্তারা, ওপর নীচে কাঠের কাঠামো বা skeleton. কাঠের ডগাগুলি দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে থাকে। ঐগুলির সাহায্যে দেয়াল বেয়ে ওঠা যায় এবং দেয়ালে বাৎসরিক নতুন মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। নইলে মরুভূমির বালির আঁচড়ে দেয়াল কবেই গুঁড়িয়ে যেত। বছরভর উত্তর আফ্রিকার মুসলমানরা এই মসজিদ দর্শনে আসেন দূরদূরান্তর থেকে। আমার দুর্ভাগ্য, দোরগোড়ায় এসেও ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। অমুসলমানদের ঢোকা সখ্ত মানা।
|
টিমবাকটু শহরের সব বাড়িঘর ঐরকম মাটির পলেস্তারা দেওয়া। সমস্ত শহরটাই মাটি রংয়ের আর রাস্তা ঘাট মরুভূমির বালি ঢাকা। গাছপালা বিশেষ নেই। শহর থেকে উত্তরে পা বাড়ালেই দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি যা হাজার মাইল পর ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে। থেকে থেকে ধূলোর ঝড় (হার-মাটান) এসে শহরটা ঢেকে দেয়। সব কিছুতেই বালি। চোখে কনট্যাক্ট লেন্স রাখাও মুশকিল।
আমি গেছিলাম অগষ্ট মাসে। দুর্দান্ত গরম। সারা শহরে আমি ও একটি ফরাসী ছেলে ছাড়া আর কোনও ট্যুরিস্ট নেই। ছায়াতেই তাপমাত্রা ১১৩ºফা: (৪৪-৪৫º সে: )। রোদ্দুরে কত কে জানে। আর শুকনো খটখটে। বোতল বোতল জল খাচ্ছিলাম আর ভীষণ খারাপ লাগছিল যে আমার গাইড নির্জলা উপবাস করে আছে। সারা দিন। তখন রমজান চলছিল। মালি পুরোপুরি মুসলমান দেশ। কী কষ্ট করে যে ওরা রমজান পালন করে ভগবান জানেন। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কখনো রমজানের সময় কোনো মুসলিম দেশে বেড়াতে যাবো না।
|
টিমবাকটু্তে একটা নতুন আবহাওয়া কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। জানি না কি কাজে লাগবে। ওদের আবহাওয়া একই গরম। বৃষ্টির নামগন্ধও নেই।
গত শতাব্দীতে মালি ফরাসীদের কলোনি ছিল। সরকারী ভাষা এখনও ফরাসী। টিমবাকটু নামটা এসেছে বাকটো (Buctou) পরিবারের মরুদ্যানের একটি কুয়ো (Tom) থেকে। অন্যান্য ফরাসী কলোনির মতোই ফরাসী রান্নার প্রভাব মালিতেও আছে। সামান্য উপকরণ দিয়ে সুস্বাদু খাবার বানাতে পারে। এমনিতে আমি আফ্রিকার খাবারের খুব একটা ভক্ত নই। কিন্তু ফরাসী উপনিবেশ দেশগুলিতে (ম্যাডাগাস্কার, মালি) আমি অল্প খরচে দারুণ মুখরোচক খাবার পেয়েছি। তার জন্য ফরাসীদের ধন্যবাদ দিতেই হবে। মালির দেশীয় খাবার ‘তো’ ঘানার ‘ফু–ফু’ র মতোই স্বাদহীন। কিন্তু আমি খেতাম নাইজার নদীতে ধরা টাটকা কাপিতান মাছ (কাতলার মতো)। তাই দিয়ে কতরকমের রান্না, আর ভাত। এই বাঙালির আর কি চাই। টিমবাকটুর আরেকটা সবাদু খাবার--নান-এর মতো নরম রুটি। রাস্তার কোণে কোণে সর্বজনীন তন্দুরের মতো উনুন বসানো। পাড়ার মহিলারা সেখানে পরিবারের রুটি তৈরি করে নেন। এর চল নিশ্চয়ই সিল্ক রোড ধরে আরবী দেশ থেকে এসেছে। বেশ খেতে, শুধু একটু বালি মাখা এই যা।
|
মরুভূমির দেশ বলেই দিনের বেলা আগুন গরম হলেও সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বেশ সুন্দর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমার হোটেলটিও কাদা লাগানো, ভেতরে গুহার মতো অন্ধকার ও ঠাণ্ডা। ওপরে প্রশস্ত ছাদ, সেখানেই বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত খাওয়া, গানবাজনা, প্রার্থনা সবই চলতে থাকে। শুকনো গরমের জন্য মশা মাছির বালাই নেই। ঠিক দিল্লীর মতো।
মালি দেশটিতে সব মিলিয়ে অনেকগুলি আলাদা আলাদা প্রজাতির বাস--জেন্ (Djenne), ফুলানি, ডোগোন, তুয়ারেগ ইত্যাদি। প্রত্যেকের ভাষা, পোশাক ও রীতিনীতি আলাদা। অনেকেই নামমাত্র মুসলিম। আফ্রিকার অন্যান্য রাজ্যের মতো এদেশে কিন্তু ঝগড়া যুদ্ধ ছিল না এদের মধ্যে। ইদানীং অবশ্য সেরকম আর নেই।
|
এসব প্রজাতিরা মরুভূমির পুত্রকন্যা। এদের কোনো নির্দিষ্ট দেশ নেই। সারা সাহারাই এদের দেশ। মালি, চ্যাড, নাইজার ইত্যাদি দেশে এদের যত্রতত্র ভ্রমণ। কোনো পাসপোর্ট-ভিসার বালাই নেই। নেই কোনো ট্যাক্স বা ভাড়ার দায়িত্ব। এর যেখানে ইচ্ছা তাঁবু খাটিয়ে যতদিন ইচ্ছা থেকে যায়। আমাদের হোটেলের পাশেই পার্কিং লটে একটি তুয়ারেগ পরিবার তাঁবু খাটিয়েছিল। আমার গাইডটিও তুয়ারেগ। সে আমাকে ওদের তাঁবুতে নিয়ে গেছিল চা খেতে। একটু গল্পসল্প হলো। তুয়ারেগরা ঘন নীল রংয়ের জোব্বা ও পাগড়ি পরে। এই নীল রংটা নাকি ভারতের নীলচাষের ফল। ভারত বলতে ওদের ঐটুকুই জ্ঞান। তুয়ারেগ পুরুষরা পাগড়ি দিয়ে মুখ, মাথা ঢেকে নেন। শুধু দুটো চোখ ছাড়া।
|
|
মরুভূমির গরম হাওয়া ও বালি থেকে রক্ষা পাবার জন্যই এই ব্যবস্থা। মেয়েরাও নীল কালো রঙের আলখাল্লার মতো পোষাক পরে কিন্তু অন্যান্য মুসলিমদের মতো মাথা বা মুখ ঢাকে না। আমার অভিজ্ঞতায় মুসলিমদের মধ্যে এই উলটো পর্দারীতির এই একমাত্র উদাহরণ।
অন্যান্য প্রজাতিদের মধ্যে তুয়ারেগরাই একটু রগচটা স্বভাবের, স্বাধীনচেতা ও গর্বিত। অল্পতেই এদের গর্বে ঘা লাগে। চা খাওয়ার সময় প্রথমবার আমি ভুল করে ‘না ধন্যবাদ’ বলেছিলাম (চায়ের কাপের ওপর বালির ছোপ দেখেই) তাই আমাকে ওরা বেশ লেকচার শুনিয়ে দিল। থেকে থেকেই এদের মধ্যে স্বাধীন ভাবটা নড়ে চড়ে ওঠে। তখন কোন ছোটখাট লুঠপাট থেকে ট্যুরিস্টদের কিডন্যাপ করা ইত্যাদিও করে ফেলে। কে আসল কর্তা সেটাই দেখানোর প্রয়াস। শুনেছিলাম একবার ট্যুরিস্টদের জীপ চুরি করে তাদের মরুভূমিতে ছেড়ে দিয়েছিল। দুদিনের মধ্যেই সবাই মারা যায়--হয়ত বা গুজব। আমার গাইডটি আধা তুয়ারেগ; ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ ও আমার দেখাশোনায় তৎপর। হয়ত ওর জন্যেই আমি একলা যাত্রী হওয়া সত্ত্বেও কোনোরকম খারাপ ব্যবহার কারুর কাছ থেকেই পাইনি। সবাই অতিথি হিসাবে আমার অশেষ যত্ন নিয়েছিল। তবে এরা গর্বিত বটে। এদের ছেলেমেয়েরা কখনো ট্যুরিস্টের কাছে হাত পাতে না বা পেছনে ছোটে না। দূর থেকেও এদের ঘন নীল পোশাক ও প্রখর চাউনি দেখেই চিনতে পারা যায়।
|
একদিন বিকেলে মরুভূমির অভ্যন্তরে যাবার প্ল্যান করা হল। দরাদরি করে একটি উটও ঠিক করলাম। আমি, গাইড ও উটওয়ালা বিকেলে গরমটা একটু পড়তেই উত্তরে রওনা দিলাম।
|
মালিতে উটে চড়া একটু অন্যরকম। পা তুলে বসতে হয়, এবং জুতো খুলে। উটের গায়ে জু্তো লাগানো উচিত নয়। এরকম বসে ব্যালান্স রাখা একটু মুশকিল। কিন্তু খালি পায়ের নীচে নরম উটের লোম সত্যিই আরামের। ধু–ধু বালির সমুদ্র। দেখলেই ভয় হয়। তাও তো আমি শুধু সাহারার এক কোণে পা দিয়েছিলাম সমুদ্রে কড়ে আঙুল ডোবানোর মতোই। আরও ভেতরে যাবার সাহস আমার নেই।
|
মাইল দুয়েক গিয়ে একটি তুয়ারেগ ক্যাম্পে পৌঁছলাম। আগে থেকেই আমার গাইড জোগাড় যন্ত্র করে রেখেছিল। আমাকে অভ্যর্থনা করে বালির ওপর বসিয়ে চা খাওয়ানো ও কিছু নাচগান হল। হাতে তালি দিয়ে ও ছোট তবলা জাতীয় ড্রামে তাল দিয়ে মেয়েদের গান ও খোলা তলোয়ার হাতে ঘুরে ঘুরে পুরুষদের নাচ। তারই মধ্যে ছোট্ট বাচ্চাদের ছুটোছুটি। তলোয়ারের আশে পাশে বাচ্চাদের দেখে আমারই ভয় করছিল।
|
তুয়ারেগ মেয়েরা ঘননীল কালো পোশাক পরে কিন্তু অন্ত:স্বত্তা অবস্থায় সাদা পোশাক। হাতে অনেকেই মেহেদী রং দিয়ে আঁকেন। কিন্তু ডিজাইন আলাদা ও রংও অনেক কালচে।
|
|
তুয়ারেগ শিশুরা সত্যি মরুভূমির শিশু। খালি পায়, খালি গায় বালিতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলে। পোকামাকড়, সাপ, বিছে কোনো কিছুরই ভয় নেই। স্কুল কলেজের বালাই নেই। বড় হলে উটের দেখাশোনা করা শেখে। ঐ করে আর ট্যুরিস্টদের নাচগান দেখিয়ে যা উপার্জন হয় তাই দিয়েই চালায়। আমি সবার জন্য বলপয়েন্ট পেন ও পেনসিল নিয়ে গেছিলাম; দাঁত খারাপ হবার ভয়ে এখন আর মিষ্টি দিই না কাউকে। বাচ্চারাও খুব সভ্য, অন্যদের মতো উপহার নিয়ে হুড়োহুড়ি করে না। বেশ বালির ওপর বসে চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখলাম তুয়ারেগ পরিবারের সঙ্গে।
টিমবাকটু থেকে আমেরিকা ফেরার পর্ব। লম্বা পাড়ি। টিমবাকটু - বামাকো - প্যারিস - মিনিয়াপলিস - ওমাহা।
মিনিয়াপলিস পৌঁছে আমায় নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। একজন প্রৌঢ়া জিগ্যেস করলেন “কোথা থেকে আসছ?” আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম “টিমবাকটু”। ভদ্র মহিলা রেগে মেগে বললেন “ঠিক আছে, কথা বলতে চেয়ো না, বোলো না।” বলে গটমট করে বেরিয়ে গেলেন। আমি প্রথমে একটু অবাক হতে তারপর হেসে ফেললাম। ওঁর আর দোষ কোথায়!
|