পনের বছর বয়স থেকেই আমার কাছে স্বপ্নের দার্জিলিং। তাকে যে দু-ঘণ্টার প্ল্যানিং-এ দেখতে পাব জীবনের প্রায় শেষ মোড়ে এসে তা আমার জানার বাইরেই ছিল। কিন্তু শীতলা মা, ষষ্ঠী ঠাকুরানী, ছটি মাঈয়ের মতো না হলেও হালে আগত আর এক আধুনিকা দেবী (ক্ষমতা দেখে দেবীই বলতে হয়) ইন্টারনেট ঠাকুরাইনের দৌলতেই তা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। প্যাকিং করতে করতে মন চোখ ঠেরে বলেছিল ‘অয় অয়, সব অয়; z।ন্তি পারো না’।
ইদানীং ‘দার্জিলিং যাব’ বল্লে আশপাশের বেশিরভাগ জনকেই নাক সিঁটকিয়ে বলতে শুনতাম ‘দার্জিলিং আবার কেউ যায় নাকি আজকাল সিকিম ভূটান থাকতে? ঘিঞ্জি, নোংরা, আধা শহর ছাড়া ও আর কিছু না।’ মনের ইচ্ছে তাই মনেই থেকে গিয়েছিল। গিয়ে দেখলাম তিনি আজও রানিই রয়েছেন। বয়স হয়েছে নিশ্চয় তবু মাথার মুকুট কাঞ্চনজঙ্ঘা অমলিন। পরনের সবুজ পাইন গাছ আর চা বাগানের ছবি দিয়ে কাঁথা স্টিচ করা জোব্বাতে বেশ কিছু তাপ্পিও পড়েছে। সেই ঘেরই যখন লহর তুলল দেখলাম যাদুগরীকে। চোখ মিটি মিটি হাসিতে হাজার যাদুর চিকিমিকি--কোনটার কথা বলি, সে যে নানানে ছড়িয়ে আছে। রাতের পাহাড়ের গায়ে ঝিকিমকি আলোয়, ভোরবেলার গোলচক থেকে ভেসে আসা ঘড়িঘরের মূর্ছনায়।
আছে চোস্ত আধুনিকা গোর্খা মেয়েদের মোম পাথর মুখ, ভ্রু ধনু (হয়তো আঁকাই) মাস্কারা চোখ আর গাঢ় লিপ্সটিকে। আছে ক্ষুদে শিশুদের চারটে দাঁত সমেত ফোকলা খিলখিলানিতে, স্কোয়াশ, মূলো, গাজর আর টুকটুকে লাল পাহাড়ি কুলে লঙ্কার ঢেরা নিয়ে বসা বৃদ্ধা পসারিণীর এচিং করা মুখের সহজ হাসিতে। পিঠে পাথরের বস্তা বা বিশাল লোহার আলমারি বওয়া মাথা নীচু করে হেঁটে যাওয়া গোর্খা কুলির ভঙ্গিতে দেখেছি বিষাদ ভরা এক অভিব্যক্তি যা যাদুর মতই সম্মোহনকারী। আর আছে এ সব কিছুর সাক্ষী থাকা ধুলোহীন গভীর রাতের আকাশে সপ্তর্ষির দ্যূতিতে।
যাদুর শুরু তো সেই রোহিণী বাইপাসের পথেই। ব্রেকফাস্টের টোস্ট ওমলেট বাদ দিয়ে ভোর ভোর অফিস দৌড়ানো বাঙালির মত অল্প খানিক পোস্ত-লাউশাক আর মাছের ঝাল দিয়ে ভাত খেয়ে প্লেন ধরেছিলাম। সব মিলিয়ে মেরে কেটে দেড়-দুই ঘণ্টা বাদে বাগডোগরা পৌঁছেই পেট চুঁই চুঁই। ড্রাইভার পুষ্করজীকে বলেই ফেললাম ‘কিছু খেতেই হবে, পেটে যে ছুঁচো ডন মারে’। উনি বললেন রোহিণী বাইপাসের কাছেই খাওয়া যেতে পারে। এসে দাঁড়ালাম ছোট এক তিন দিক খোলা রেস্তোঁরায়, শ্যাক বললেও ভুল হবে না। এক দিকে হলুদ-সবুজ ধান ক্ষেতে তার থেকে আরও আরও চোখ ধাঁধানো হলুদ চন্দ্রমল্লিকা (কেউ কি পুঁতেছে না কি এমনি এমনি ফুটেছে ওরা?), অন্য দিকে খয়েরীর ওপর মোটা ব্রাশে সবুজের স্ট্রোক মারা রুক্ষ পাহাড়। এক কানে ঝিকিমিকি পাথরের টপ পরা শ্যামলবরণ ঝকঝকে চেহারার ছেলেটি সমানে হেঁকে চলেছিল ‘ এক(EK) দম গরম মোমো, চখ কে তো দেখিয়ে’। থাকতে পারলাম না, জীবনে সেই প্রথম মোমো খেয়ে চিরতরে বাঁধা পড়লাম। মোমো তৈরি করতে করতে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলে ‘আপ কঁহাসে আ রহে হ্যাঁয়?’ কোলকাতা বলাতে বললে ‘পহলে থা ক্যালকাটা য্যায়সে দার্জিলিং থা দরজিলিং অউর কার্শিয়াং থা খরসাঙ’---সপ্রতিভ অথচ অচেনা মানুষটিকে বেশ লেগেছিল।
দার্জিলিং-এর বর্ণনা করতে আমার মনে একটা ইংরেজি শব্দ বারবার ঘুরে ফিরে আসছে--‘কোয়েন্ট’, যা বলতে বোঝায় পুরনো হওয়ার দরুন অসাধারণ এবং তার জন্যই আকর্ষণীয়। ঝকঝকে তকতকে নতুন হিলস্টেশন বলতে যা বোঝায় এতো তা নয়। প্রথমত গোর্খাদের চেহারা আমাদের থেকে অন্যরকমই, চিরন্তন পাহাড়ি মানুষের ছাপ আছে তাতে। মহিলারা সব রকম পোশাকই পরছেন। কিন্তু একটু বয়স্কা যাঁরা তাঁদের সাবেক পরিচ্ছদ বেশ একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে শহরটাকে। তার ওপর উঁচু নীচু রাস্তা দিয়ে প্রায় একজনের বাড়ির মাথায় আর একজনের বাড়ি ঢোকার পথ। খুব ছোট ছোট ঘর বাড়ি, ঘুপচি রোদ না ঢোকা জানলা দরজা। সাবেক বাজারে দোকানপাটের দরজাও এত নীচু যে মাঝারি মাপের মানুষের মাথাও চালে ঠেকে যাবে।
পসরা আধুনিকতা ছুঁয়ে ফেলেও যেন পুরো ছুঁয়ে ফেলতে পারেনি। বেশিরভাগ দোকানেই ঘরোয়া ব্যবহারের এল্যুমিনিয়ামের বিশেষ ধরনের টিপ টিপ আঁকিবুকি কাটা মোমো পাত্র আর সব্জি বলতে স্কোয়াশ মুলো গাজরের ঢেরা। হয়তো সেসব বাড়ি-ঘর স্বাস্থ্যসম্মত নয়, কিন্তু মনকে অলীক স্বপ্নে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হাতছানি দেয়। জল সরবরাহ ব্যবস্থাও অদ্ভুত, সারা পাহাড়ময় রাস্তার ধার ঘেঁষে পাইপ লাইন, বেশ খানিকটা অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকরও বটে; টয় ট্রেন, দার্জিলিং হিল রেলওয়ে, সব ধূলিময়, যেন অবহেলার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। কিন্তু কি হওয়া উচিত আর কি নেই-এর চাবিকাঠিটা বন্ধ করে দিলেই কেমন যেন পরীর দেশ পরীর দেশ। ওই সব কিছু ছোট ছোট বলেই কি?
কেরল দেখলে যেমন প্রকৃতির প্রাচুর্যের সাথে চোখে পড়ে সেখানকার লোকেদের আর্থিক সচ্ছলতা, দার্জিলিং-এ ঠিক তার উল্টো। একটু নজর করলেই মানুষের কষ্ট চোখ এড়ায় না। তাহলে কোথা থেকে আসে এত হাসি মুখ, এত ফুলের ঢেরা? পাহাড়ের গা ধরে একেবারে সটান সোজা থাক থাক কাঠের বাড়ি আর তাদের প্রত্যেকের বারান্দায় রঙের আসর।
ফুলের টব নেই, (মনে হয় টব পড়ে নীচের কারো চোট লাগতে পারে তাই), কালো পি ভি সি ঠোঙায় চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গাঁদা থরে থরে। আর তারই মাঝে কোথাও ছাদে পড়ন্ত বিকেলের রোদে গালে হাত দিয়ে দূর পাহাড়ের পানে তাকিয়ে থাকা গোর্খা বৃদ্ধা মাথায় লাল রুমাল কানের পাশ পেরিয়ে বাঁধা—কি ভাবে সে জানতে পারিনি, কিন্তু আমি ভরে গেছি কানায় কানায়।
এদের আত্মসম্মানও খুব—টয় ট্রেনের টিকেট চারশো সাড়ে চারশোর মত। হয়তো ড্রাইভার জোগাড় করে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাইছেন সাড়ে ছয়শো। চ্যালেঞ্জ করাতে কথা কাটাকাটির ধার দিয়ে গেলেন না। শান্ত উত্তর ‘দেখ লিজিয়ে’। আর এদের আনন্দ! মনে করিয়ে দেয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিমালয়ের পথে দেখা এক পাহাড়ির নাচের কথা। কোনো এক হিংস্র পশু তার মুখ বিকৃত করে দিয়েছে, কিন্তু তার ক্ষোভ নেই, নেচেই চলেছে আপন মনে। লোকসংস্কৃতির তত্ত্বাবধানে ম্যালে আশপাশের পাহাড়ি গ্রামের ছেলেমেয়েদের ছ' দিন-ব্যাপী নাচ গানের ব্যবস্থা ছিল। তাদের তালে তালে স্টেজের বাইরে শীতের সন্ধ্যা নামা আলো আঁধারে শতছিন্ন পোশাক পরা এক গোর্খার নাচ দেখে আমার মনে হয়েছিল এত অমৃতের সন্ধান এরা পায় কোত্থেকে!
দার্জিলিং-এর যৌবনকালে তো আমার যাওয়া হয় নি তাই সে সময় আর আজকের তুলনার প্রশ্নই ওঠে না। আমি বয়স্কা, সেও তাই, তবু সাঁঝের বেলা প্রায় রোজই আলো ঝলমল ম্যালে গ্লেনারিজ বেকারিজের কাপ-কেক, রাম ভরা চকোলেটের দিকে গুটি গুটি এগিয়ে বা ঝকমকে রোদে কেভেন্টার্সের ছাদে আইস্ক্রিম খাওয়ার বিলাসিতা বেশ জম্পেশ হয়ে উঠেছিল। আর বেড়াতে আসা মানুষজন? বেশি বকবক করি বলেই বোধ হয় কত অচেনাকেই জানা হয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে বেরোলে আমাদের সবার স্বভাবই হয়তো অল্প সময়ের জন্য হলেও শুধরে যায়। রোজের বার বার পরা জামা কাপড়গুলো ছাড়ার সাথে সাথে রোজের খিটিমিটিদেরও বোধহয় মনে মনে বলি ‘থাক তোরা তালাচাবি বন্ধ, এই আমি চল্লাম, বরং বাড়ি ঘর দেখিস’।
ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনি থেকে গোলাপী কাঞ্চনজংঘা দেখছি--শুনলাম ‘গুড মর্নিং’। নিজের পরিচয় দিলেন মুম্বাইএর কোন ফিল্ম প্রডিউসর। সব কিছুই অবশ্য ঝকঝকে নয়, স্ত্রীকে এনেছেন, তাঁর ডায়ালিসিস চলছে--তবু তো এসেছেন। আর একদিন সেই জায়গাতেই খুবই ক্যাঁচম্যাচ লাগিয়েছি, করিডরের দরজা খুলে এক আধুনিকা যুবতী বিরক্ত হয়ে চুপ করতে বললেন; খানিক পরে সেই আবার বেরিয়ে এসে বলে ‘সরি আমার অমন রাগ করা উচিত হয় নি, আসলে ক-রাত ভাল ঘুম হয়নি জার্নি করে’। ওর নাম হেথ ল, ওর সাথে আছে বসকি, বিজল—কি সুন্দর অথচ কত মানে না জানা নাম--ওরাও মুম্বাইবাসী। ম্যালের পথে গ্লেনারিজে দেখা হয়েছিল এক দঙ্গল স্কুল পড়ুয়াদের সাথে। ওদের ক্লাস জিগেস না করে আমিই বল্লাম ‘ক্লাস সিক্স তো?’ ওদের কি হাসি! সব দল বেঁধে রাম ভরা চকোলেট কিনছে। আমাকে দেখে সমস্বরে বললে ‘উই ওন্ট ইট আন্টি, দে আর ফর ফ্যামিলি’। মনে মনে বললাম ‘বুঝেছি’। আলাপ হয়েছিল এক বয়স্কা দম্পতির সাথে—তের বছর পরয়ানুতে (সিমলার কাছে) থেকেছেন (বার বার আউড়িয়ে মনে রেখেছি), এখন হাজরায়। এত মানুষ দেখলাম, কেবল মনে হতে লাগল নিজের আস্তানার আশেপাশেও তো কত কাউকে দেখি, তাদের খামতিই চোখে পড়ে। এক ঋষি বলে ছিলেন ‘চরৈবেতি চরৈবেতি’—চলতে থাকা, চলতে থাকা, তাহলেই মনে ধুলো জমে না—কি জানি, হবেও বা। অবশ্য আটপৌরে মনটা এক ফাঁকে ফোড়ন কাটল ‘ভাল খাচ্ছ। ঘুরছ, বেড়াচ্ছ--রাঁধার পর বাড়া, তারপর খাওয়া, আবার রাঁধার চক্কর থেকে তো মুক্ত আছ, কে তোমার বাগানের বেড়া ফাঁক করলে, কে দেখেও দেখলে না, কেউ এমন দেখলে যেন তুমি কাঁচের দেওয়াল—এ থেকে তো ছুটি--পাশের মানুষগুলো আটা, চাল, চিনি, মেডিক্লেমের বাইরে কম কথাই বলে, তারাও বক বকম করছে—সব তো আলো দেখবেই।' হার মেনে ভাবছি হয়তো বা তাও হতে পারে।
মন তো জলে ভাসা পাতার মত; ভাবনার টানে আগে যায়, পিছিয়ে আসে। এমনি এক ভাবনা, (ছবি বললেই ভালো হয়) জড়িয়ে আছে এই পর্বত শহর দার্জিলিং-এর সাথে। যখন দার্জিলিং দেখাও হয়নি, সেই তখনই স্বনামধন্য শ্রীসত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটা আমার কল্পনার দার্জিলিং-এর সাথে মিলে গেছে আমার অজান্তেই। বিশেষ সেই শেষ দৃশ্য যেখানে কুয়াশা ঘেরা ম্যাল যেন মানুষের মনের বিভ্রান্তি আর সংশয়ের প্রতীক। এবার যখন ম্যালে হাঁটছিলাম আমার মনের মাঝে শুনছিলাম শ্রীছবি বিশ্বাসের সেই ভুলতে না পারা ডাক,---উনি ডাকছেন তাঁর দুই কন্যাদের যারা ওনার থেকে মানসিক ভাবে দূরে সরে গেছে। আবার কুয়াশা কেটে রোদ উঠেছে, ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটেছে। প্রকৃতির সঙ্গে ছবির এই একাত্মতা, মহান হিমালয়, স্তব্ধ ঋষিকল্প পাইন গাছ যেন সত্যি আমাদের সাহসী করে তোলে। মনে হয়, আমিও যেন এক ‘কেউকেটা’, জীবনের সব স্ট্রাগল কাঁধে নিতে পারব ছবির চরিত্র অশোকের মত।
এত কথা মনে এল গেল, তবু যেন কত কথা বাকি। নির্ভীক, হাসিখুশি, কর্মঠ এক জাতিকে দেখে এলাম। কত অবহেলায় সে আনন্দের আলো জমাট বেঁধে আগুনের ফুলকি হয় তাও চোখ এড়ায়নি। উত্তরাধিকারসূত্রে ওরা হৃতসর্বস্ব, ওদের কাহিনি যথার্থই ‘ইনহেরিটেন্স অফ লস’। এ যেন গৃহকর্মে নিপুণা গৃহিণীর অ্রবমাননা, সে শুধু দিয়েই যায়। সেই ইংরেজি প্রবচনের মত--ডেলিভারিং দ্য গুডস। হাল আমলের অ্যাডভারটাইজমেন্টে কেউ গরম চা আর বিস্কিট হাতে বলছে ‘মা তুমি কত ছোটাছুটি করো, আমাদের জন্য অন্তত একটু বসো, একটু আরাম করো’--এ আদর তাঁর জোটে নি। দার্জিলিং শুধু দিয়েই গেছে, পেয়েছে অনেক কম।