• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • রূপকুণ্ড ও জলপ্রলয় : পলাশ রায়

    ০ জুন সন্ধেবেলা। হলদুয়ানীর হোটেল ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে তখন। সারাদিনের দীর্ঘ শকট যাত্রা ও পদযাত্রার ক্লান্তি শরীরে। সদ্য স্নান সেরে সুসজ্জিত বিছানায় এলিয়ে দিয়েছি গা। চোখ টিভির পর্দায়। পর্দা জুড়ে তখন কেবল একটাই খবর - “দেবভূমিমে জলপ্রলয়” - “হিমালয় মে সুনামি” - ‘উত্তরাখণ্ডমে মেঘবিস্ফোট” ইত্যাদি। হেলিকপ্টার থেকে তোলা কেদারনাথের প্রলয় পরবর্তী টাটকা ছবি। আর এর মাঝে অলকানন্দা মন্দাকিনীর গর্জনকে অতিক্রম করে তীব্র হয়ে উঠেছে স্বজন-হারানো মানুষের কান্না। উত্তরাখণ্ডের এই ঐতিহাসিক মেঘবিস্ফোরণের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা পাহাড়প্রেমি চার বন্ধু।প>

    কলকাতা সহ সমগ্র উত্তর ভারত তখন তীব্র দাবদাহে জ্বলছে। ৯ই জুন ২০১৩, এমনি এক তাপদগ্ধ সকালে অকাল তখ্‌ত এক্সপ্রেসে চার বন্ধু মিলে শিয়ালদা থেকে রওনা দিলাম বেরিলীর উদ্দেশ্যে। ১০ তারিখ সকালে সেখান থেকে একটা ছোট গাড়ি নিয়ে হলদুয়ানী। হলদুয়ানী থেকে শেয়ার জিপের পিছনে বসে পড়লাম। কাঠগোদাম পেরোতেই শুরু হল চিরন্তন হিমালয়ের গা ধরে পাহাড়ি যাত্রা। মন ভরে উঠল পুলকে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। ভীমতাল পেরোতেই গা গুলিয়ে উঠল। শুরু হল বমি। ওষুধকে মিথ্যে প্রমাণিত করে সারা পথ জুড়ে থেমে থেমে বমন চলতে লাগল। বাকি পথটা প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থায় কেটেছে। গরুড়ে এসে যখন নামলাম তখন দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। হিমেল ছোঁয়া বাতাসে। শরীর একেবারে অবসন্ন। সেদিনের মতো মন এখানেই যাত্রার ইতি টানতে চাইছে। কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। যতটা এগিয়ে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। তাই আরেকটা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। অন্ধকার বৃষ্টিভেজা পথ ধরে যখন গোয়ালদাম বাজারে পৌঁছালাম তখন রাত বেশ ঘন। শীতটাও জমাট।

    ১১ তারিখের সকাল হল বৃষ্টির মধ্যে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি কমতে শুরু করল। হোটেলের বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট মেঘের টুকরোর পাহাড়ের গা ধরে গুটি গুটি পায়ে বিচরণ। হাল্কা বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ধরালিতে পৌঁছানোর পর বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ল। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে পৌঁছালাম দেবল-এ। ততক্ষণে এসে হাজির লোহাজং-এ যাওয়ার গাড়ি। আমাদের গাইড দেব সিং দানু পাঠিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যেই এসে পৌঁছালাম লোহাজং-এ। ইতিমধ্যে আমাদের গাইড থাকার সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছে। সেদিনের মতো পঞ্চায়েত সমিতির পর্যটক আবাসে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি একটা ভাবনার কারণ হয়ে রইল।


    রৌদ্রোজ্জ্বল লোহাজং
    পরদিন ১২ তারিখ--রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। লোহাজং পাসের একদিকে সুবিস্তৃত সবুজ উপত্যকা। আর তার গায়ে স্থানে স্থানে আটকে রয়েছে মেঘের ছানারা। অন্যদিকে তখন উঁকি দিচ্ছে তুষারধবল নন্দাঘুন্টি পর্বত। মনটা ভালো হয়ে উঠল। শুরু হল রূপকুণ্ডের উদ্দেশ্যে পদযাত্রা। আজ যাব দিদিনা গ্রামে। দূরত্ব প্রায় ১১কি. মি.। কুক্ শের সিং ও খচ্চরবালা বল্লু রেশনপত্র নিয়ে সহজ পথে কুলিং গ্রাম হয়ে দিদিনার পথে রওনা দিল। জমিজমার বিশেষ কাজে দেবসিংকে চলে যেতে হল বাগেশ্বর। আমরা সৌন্দর্যের অভিসারী হয়ে ধরলাম অপেক্ষাকৃত কঠিন পথ - লর্ডকার্জন ট্রেইল। রডোড্রেনড্রনের অরণ্যের মধ্যে দিয়ে যাত্রা। গাছে গাছে রকমারি পাখির কলকাকলি। তাদের বেশির ভাগকেই দেখতে পাচ্ছি না। তবে একটা রেডবিলড ব্লু ম্যাগপাইকে দেখলাম একেবারে কাছ থেকে। নদীর একটানা ক্ষীণ গর্জন শোনা যাচ্ছে। পথ নিম্নমুখী। কেবল মনের আনন্দে হাঁটা। একটা করে ঝর্ণা – নদীর সেতু অতিক্রম করছি মাঝে মাঝে। হঠাৎ অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে হাজির হলাম এক অপূর্ব-সুন্দর ছোট্ট চারণভূমিতে। ছোট পাহাড়ি শিশুরা ছাগল ভেড়া চরাচ্ছে সেখানে। ক্ষণিকের জন্যে ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আবার হাঁটা শুরু। দু’চার ঘরের ছোট্ট গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। নীলগঙ্গার গর্জন এতক্ষণে আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। বুঝলাম কাছেই নদী। অবশেষে নদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। স্থানীয় লোকেরা জায়গাটাকে বলে রণবাগাদ। একটা লোহার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নীলগঙ্গার স্বচ্ছ জলধারার উন্মাদিনী গতিকে দেখলাম মন ভরে। সামনের পাহাড়ের গায়ে দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা ঝর্ণা নেমে এসেছে অরণ্যের বুক চিরে। ব্রিজ পেরিয়ে শুরু হল চড়াই। প্রথম দিনের চড়াই-এ সামান্য হাঁফ ধরছিল। পাহাড়ি ব্ল্যাকবেরি মুখে দিতে দিতে একসময় পথের চড়াই শেষ হল। মিলল বাড়িঘর আর মানুষের দেখা। পৌঁছলাম দিদিনা গ্রামে। পিছন ফিরলে দেখা যাচ্ছে লোহাজং-এর অস্পষ্ট বাড়িঘর ও ফোনের টাওয়ার। সে দিনের মত জয়বীর সিং-এর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সম্পূর্ণ স্লেট জাতীয় পাথর দ্বারা নির্মিত দোতলা বাড়িটা দেখবার মতো। তার মুক্ত চত্বরে রোদ মাখতে বেশ ভালো লাগছিল। এদিকে নিজের বানানো প্লেনকে আকাশে ওড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আমাদের উড়ানদা (পলাশ পাল)। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে উড়ল প্লেন। গ্রামের ছোট ছোট কচিকাঁচা ছেলে মেয়েদের কাছে তখন সে এক আকর্ষণীয় ব্যাপার। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের পাহাড়গুলোর মাথা ধরে নেমে আসতে লাগল মেঘ। শুরু হল বৃষ্টি। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি চলল সারা রাত ধরে।


    মেঘ সবুজের দিদিনা গ্রাম

    ১৩ তারিখ সকালে উঠে দেখলাম চারপাশ কেঁচোতে ভরে গেছে। হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে তখনো। আজ তাড়াতাড়ি বেরোতে হল। কারণ আজ এই ট্রেক পথের দীর্ঘতম চড়াই আমাদের সামনে অপেক্ষা করে আছে। আর পাহাড়ের মাথায় অপেক্ষা করে আছে অনিন্দ্যসুন্দর এক উপত্যকা। রূপকুণ্ডের পথের যা শ্রেষ্ঠ পাওনা। দিদিনাকে বিদায় জানিয়ে শুরু হল যাত্রা। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা মাটি। আর প্রাণান্তকর চড়াই। তনুদা (তনুশ্যাম ভট্টাচার্য) হাঁপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে হাঁটছে। উড়ানদাও হাঁটুর ব্যথায় কিছুটা হয়ে পড়েছে কাবু। দলের দুই কনিষ্ঠ সদস্য আমি আর যীশু (দেবদূত ভট্টাচার্য) চড়াই-এর ক্লান্তির সঙ্গে খেলতে খেলতে তখনো দিব্যি হেঁটে চলেছি। পথের শেষ কোথায়! চড়াই-এর শেষ হয়না। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট লোহাজং। দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গা চিরে চলে যাওয়া কুলিং – ওয়ান যাওয়ার পথের রেখা। অবশেষে পথের শেষ হল। শেষ হল জঙ্গল। শুরু হল সুবিস্তৃত তৃণভূমি। এই সেই অলি বুগিয়াল।


    মেঘের পথযাত্রী... অলি বুগিয়াল
    ইন্টারনেটে যার ছবি দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়েছি। যার গল্প এ-পথের ট্রেকার্সদের মুখে মুখে। সত্যিই লাবণ্যময়ী রূপসী অলি। পথের ক্লান্তি তখন কোথায় হাওয়া। কেবলই ইচ্ছে করছে ছোট শিশুর মতো সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ কার্পেটে ছুটে বেড়াই। সারা উপত্যকা জুড়ে দলে দলে চরে বেড়াচ্ছে ভেড়া-বখ্‌রির দল। ইচ্ছে করছে ক্ষণিকের জন্য এই পাহাড়ের রাখাল হতে। উপত্যকা জুড়ে ততক্ষণে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বেলা ১-টার পর আবহাওয়ার এই পরিবর্তন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সমস্ত ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুরু হল পাহাড়ের শিরা ধরে ওঠা। এখন পুরো পথটাই ঢেউ খেলানো বুগিয়ালের মধ্য দিয়ে। তার মাঝে মেঘেরা তখন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি। যীশু ও উড়ানদা এগিয়ে গেছে। আমি তনুদা ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেদেনী বুগিয়ালের মাথায় পৌঁছে দেখতে পেলাম আমাদের তাঁবুগুলোকে। ঘন সবুজ উপত্যকায় গায়ে রঙিন টেন্টগুলোকে লাগছিল অপূর্ব সুন্দর। চারপাশ তখন ঘন মেঘে আচ্ছন্ন। ফলে চারপাশের পার্বত্য দৃশ্য কিছুই চোখে পড়ছে না। সামনে বেদিনী কুণ্ড।

    বেদিনি বুগিয়ালে আমাদের টেন্ট
    সামান্যই জল তাতে। আর একপাশে নন্দা-মায়ের মন্দির। উপত্যকা জুড়ে চরে বেড়াচ্ছে ঘোড়া খচ্চরের দল। কিন্তু এসবের মধ্যেই আমার শরীরটা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। আশ্রয় নিলাম স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে। তনুদার ডাকে টেন্টের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি পর্বতশিখর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী আলো। আর সেই আলোয় বেদিনীর সুবিস্তৃত সবুজ গালিচা এক অসামান্য রূপে সেজে উঠেছে। দেখা যাচ্ছে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূলকে। ত্রিশূলের ছায়া তখন বেদিনী-কুণ্ডের জলে। কিন্তু শারীরিক কারণে এই দৃশ্য সম্পূর্ণ উপভোগ করতে পারলাম না। শুধুমাত্র ছাতু খেয়ে শুয়ে রইলাম। আমাকে নিয়ে দলের সকলের চিন্তা। যদিও পাহাড়ে নতুন নই আমি, কিন্তু মাউন্টেন সিকনেসের দুশ্চিন্তাও একেবারে ঝেড়ে ফেলা গেল না। কাল আমার অবস্থা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানাল তনুদা। তার দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা সে কেবলমাত্র আমাদের মধ্যে বড়ই নয়, সে আমাদের সকলের অভিভাবক-প্রতিম ।

    মহিনের ঘোড়াগুলি সব ঘাস খায়... বেদিনী বুগিয়াল

    আজকের রাতটা আমাদের জীবনে ঘটনাবহুল হয়ে রইল। শীত ও উচ্চতাজনিত কারণে এমনিতেই গভীর নিদ্রায় কেউ নেই। শুরু হল এক আজব খেলা। বাইরে থেকে কেউ যেন আমাদের টেন্ট নিয়ে টানাটানি করছে। তনুদাকে ডেকে উড়ানদা বাইরে বেরিয়ে গেল। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বেরোবার আগে কেবল একটা কিছু ছুটে যাওয়ার শব্দ যেন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেরোলে কোথায় কি! উড়ানদার শক্তিশালী টর্চের বলয়ে তো সন্দেহজনক কিছুই পড়ছে না! বাইরে তখন কেবলই নিস্তব্ধ গম্ভীর তারাভরা রাতের হিমালয়। এ খেলার শেষ হয়না। সন্দেহ হল কুণ্ডের পাশের একটি সাময়িক আস্তানাতে থাকা একটি ছেলের প্রতি। সেখানে দিয়ে তাকে বকাবকিও করা হল। কিন্তু কোথায় কি! আবার যে কে সেই। হঠাৎ মনে পড়ল খচ্চরওয়ালা বল্লু খচ্চর খুঁজতে গিয়েছিল সন্ধ্যার সময়, সে এতক্ষণ খচ্চর না পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে না তো? উড়ানদা একজনের আওয়াজ পেয়ে টেন্টের ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করল--“কওন? বল্লু? খচ্চর মিলা?” চারজনই শুনলাম ভারি পুরুষকন্ঠে উত্তর--“নেহি মিলা। খচ্চর গুম হো গয়া”। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে কিছু চোখে পড়ল না। কিচেন টেন্টে গিয়ে দেখা গেল বল্লু তখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তাকে ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করাতে জানাল, সে তো খচ্চর নিয়ে সন্ধেবেলায় চলে এসেছে। বুকের মধ্যে বাসা বাঁধল ভয়। অবশেষে দু’জনের টেন্টে চারজনের রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত হল। অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রায় বিনিদ্রায় সমাপ্ত হল একটা রাত। আর নাস্তিক যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী আমাদের চারজনের কাছে অদ্ভুত প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে জেগে রইল মৃত্যু উপত্যকার পথের সেই রাত।

    ১৪ তারিখ সকালে দেখলাম শরীর একেবারে চাঙ্গা। মন যদিও বলছিল এখানে অতিরিক্ত একদিন থাকি। কিন্তু আবহাওয়ার আনুকুল্যকে কোনভাবেই অস্বীকার করা গেল না। নিজের শরীরের ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে গেলাম সবার আগে। বেদিনীকুণ্ড অতিক্রম করে শুরু হল চড়াই। ভেজামাটি। স্থানে স্থানে মেঘ জমে রয়েছে। পথের দুপাশে হলুদ, নীল, লাল পাহাড়ি ফুলের শোভা। আমরা উঠে এলাম সামনের পাহাড়ি শিরার একেবারে মাথায়। জায়গাটার নাম ঘোড়া লোটানি। সামনে তখন ঘনকালো পাথরের কালিডাক পর্বত। মাথায় ছড়িয়ে রয়েছে শ্বেত বরফ। কিন্তু মেঘের কারণে দৃশ্য তখনো অবাধ নয়। ইতিমধ্যে দেবসিং এসে পড়ায় আমরা চিন্তামুক্ত হলাম। সম্পূর্ণ ওর ওপর ভরসা করেই আমাদের এ পথে আগমন। এরপর উৎরাই পথে প্রায় ছুটে ছুটে এসে হাজির হলাম পাথর নাচুনীতে। সেখানে বনবিভাগের গ্রিনহাটে সামান্য বিশ্রাম ও চা পানের পর আবার পথচলা। এরপর শুরু হল চড়াই পথ ধরে ঘুরে ফিরে হাঁটা। উচ্চতাজনিত শ্বাসকষ্ট বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। যত ওপরে উঠছি ততই সবুজ ঘাসের গালিচা কমে আসছে। বাদামী কালোঘাস ও পাথর চোখে পড়ছে বেশি। এই চড়াই-এর একেবারে শীর্ষে সবার আগে হাজির হলাম যীশুর সঙ্গে। জায়গাটার নাম কৈলুবিনায়ক। উচ্চতা ১৩,৯০০ ফুট। পাথর নির্মিত ছোট্ট মন্দিরে রয়েছে বিনায়ক--গণেশের শিলামূর্তি। আর আছে অনেক পিতলের ঘন্টা। জায়গাটায় হাওয়ার তেজ বেশ প্রবল। ঠাণ্ডা বাতাস যেন কামড় বসাচ্ছে গায়ে। দুপাশ থেকে মেঘ এসে ধাক্কা মারছে পাহাড়ের দেহে। কৈলুবিনায়কের পর উৎরাই পথ ধরে ছুটে ছুটে নামতে থাকলাম। প্রবেশ করলাম হিমবাহের জগতে। মেঘ-কুয়াশার পথে বরফ ও কালো পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে এলাম। পাথরের ওপর পাথর দিয়ে সাজানো রানি কি সুরেলার ভগ্ন আস্তানাকে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলাম পৌঁছে গেছি বাগুয়াবাসা। তাকে পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে আমাদের টেন্ট চোখে পড়ল। জায়গাটার নাম হুনিয়াথার। শুনেছি আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে জায়গাটা নাকি ব্রহ্মকমলে ভরে থাকে। ঘনমেঘে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ডিনার করে টেন্টের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। ভোর ৪টে-তে বহু আকাঙ্ক্ষিত রূপকুণ্ড ও জিউনার গলির উদ্দেশ্যে যাত্রার কথা রইল। কিন্তু সারা রাতভর প্রচণ্ড বৃষ্টি চলতে লাগল। মন হয়ে উঠল আশঙ্কিত।


    রূপকুণ্ডের পথে
    ১৫ই জুন ভোরে যখন উঠলাম, চারপাশে তখন ঘন অন্ধকার। গত রাতের পরিকল্পনা মতো ভোর ৪টে-তে আমাদের বেরোনোর কথা অথচ সারারাতের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির বোধহয় থামার কোন পরিকল্পনা নেই। অবশেষে মনে হল আগের দিনের জমাট বাঁধা মেঘটা কিছুটা দূরে সরেছে। ভোর তখন চারটে পঁয়তাল্লিশ। হাল্কা আলো-আঁধারি পথে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। সকালের আলো ফুটতে আর বেশি দেরি নেই। ঘন মেঘেরা টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যেতে লাগল। একটার পর একটা গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে অতি সাবধানি পদক্ষেপে এগোতে থাকলাম। ওপরে উঠে বুঝতে পারছি আমরা আসলে এক পর্বতের গা ধরে এগিয়ে চলেছি। মাথার ওপর দেখা যাচ্ছে আমাদের গন্তব্য। চড়াই পথ ধরে কেবলই এগিয়ে চলা। উঠে এলাম পাথরের সিঁড়ি পেরিয়ে অনেকটা উঁচু একটা জায়গায়। জায়গাটার নাম চিড়িয়ানাগ। নিচে তখন সকালের আলোয় সবুজ উপত্যকা ফর্সা হয়ে উঠছে। যত উপরে উঠছি, গ্লেসিয়ারের দৈর্ঘ্য ততই বাড়ছে। শেষ অব্দি একটা ছড়ানো বোল্ডার জোনে উঠে এলাম। বেশি বরফ থাকলে হাঁটা সুবিধাজনক। কিন্তু বোল্ডারের ওপর বরফের হাল্কা আবরণ পড়ায় কখনো কখনো পা পিছলে যাচ্ছিল। উঠতে হচ্ছিল অতি সাবধানি পদে। হঠাৎ এক পশলা হাল্কা তুষারপাতও হয়ে গেল। দেখি চড়াই পথ শেষ। সমস্ত প্রতীক্ষার অবসান।


    রূপময়ী রূপকুণ্ড
    বহু আকাঙ্ক্ষিত রূপকুণ্ডের তীরে আমরা উঠে এসেছি। ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তুষার আচ্ছাদিত রূপময়ী রূপকুণ্ড। অন্তর তখন আনন্দে আত্মহারা। অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হল। কুণ্ডের উঁচু পাড়ে হর-পার্বতীর পাথর নির্মিত ছোট্ট মন্দির। উড়ানদা সেখানে সমস্ত আধ্যাত্মিক আবেগ নিয়ে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুরাণ বলে দেবী দুর্গার রূপ শৃঙ্গার করার ইচ্ছে হলে মহাদেব নাকি ত্রিশূলের আঘাতে তৈরি করেন এই কুণ্ড। তাই এই কুণ্ডের নাম রূপকুণ্ড। ভূবিজ্ঞানীরা বলেন উল্কাপাতের ফলে এই কুণ্ডের সৃষ্টি। সে যাই হোক সেদিন সকালে আমাদের কাছে সত্য হয়ে রইল শুধু উচ্চ হিমালয়ের অবর্ণনীয় এক রূপ। যে রূপের নাম রূপকুণ্ড। তার পাশে ছড়ানো বেশ কিছু মানুষের কঙ্কাল। বরফের নিচে নাকি আরো বহু কঙ্কাল লুকিয়ে রয়েছে। অন্তত পাঁচশোটা। এ নিয়ে গল্পেরও শেষ নেই।

    মৃত্যু উপত্যকা... রূপকুণ্ড
    কেউ বলে এ নাকি দক্ষের সৈন্যদের অংশাবশেষ। আবার অর্ধ ঐতিহাসিক কাহিনি বলে কনৌজের রাজার সাঙ্গ পাঙ্গদের দেহাবশেষ এগুলো। তিনি এই পবিত্র স্থানে সুরাপান ও বাঈজি নাচিয়ে ক্ষিপ্ত করেছিলেন দেবী নন্দাকে। দেবীর কোপে তুষার ঝড়ে এদের মৃত্যু হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল জিউনার গলির মাথায় ওঠার। কিন্তু আবহাওয়া প্রতিকূল হতে শুরু করল। ত্যাগ করতে হল সে আশা। এখন ফিরে যাওয়ার পালা। রূপকুণ্ডকে শেষ বারের মতো দেখে বিদায় নিলাম। যখন হুনিয়াথারে পৌঁছালাম, ততক্ষণে চারপাশে কেবলই ঘন মেঘের রাজত্ব। বৃষ্টিও পড়ছে ছিটে ফোঁটা।

    ফেরার পথে একটি গ্রাম
    এরই মধ্যে লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়লাম। পরবর্তী গন্তব্য পাথর-নাচুনী। কৈলুবিনায়কের পর অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হল। বেলা তখন প্রায় ২টো। মোটা জ্যাকেট ভিজে ভারি। প্রবল বাতাসের গতি। তাই হাতে বানানো প্লাস্টিকের পঞ্চো (বর্ষাতি) গায়ে থাকতে চাইছে না। ছুটতে ছুটতে এসে আশ্রয় নিলাম পাথর-নাচুনীর গ্রিন-হাটে। অন্য দিন শের সিং ও বল্লু খচ্চরে করে মাল নিয়ে এসে আগেভাগেই টেন্ট রেডি করে রাখে। কিন্তু সেদিন তখনো ওরা এসে পৌঁছতে পারেনি। যখন এসে পৌঁছাল ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আরো জাঁকিয়ে। খচ্চরগুলো বৃষ্টির জন্যে বারবার পিঠ থেকে মাল ফেলে দিয়েছে, সেইজন্যেই দেরি। ওখান থেকে প্রায় ১-কিমি এগিয়ে একটা পাহাড়ি ঢালের ধাপে বৃষ্টির মধ্যেই টেন্ট রেডি করা হল। ভেজা অবস্থায় আশ্রয় নিলাম তাঁবুর মধ্যে। স্যাক খুলে দেখলাম সব ভিজে গেছে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত আর তুষারপাতের এটাই তফাৎ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বাড়তে লাগল। বৃষ্টিতো নয়—সে এক মহাপ্রলয়। ভয়ঙ্কর বহুমুখী বাতাস। বৃষ্টি-বাতাসের সে কি প্রচণ্ড গর্জন! টেন্টের inner এবং outer মিলে এক হয়ে গেছে। ভেতরের বাতাস পরিণত হয়েছে জলে। সব ভিজে একাকার। কোনো কিছুই শুকনো নেই। উষ্ণ থাকার শেষ সম্বল স্লিপিং ব্যাগেও ঢুকে পড়েছে জল। মাঝ রাতে টেন্টের একটা দিক আমার গায়ে ভেঙে পড়ল। দেখলাম জলের ওপর ভাসছে টেন্ট। আমার টেন্ট-পার্টনার উড়ানদা বারবার আমাকে সাবধান করছে। দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধছে মনে। কিছুটা আলোর আভাস পাওয়া গেল বাইরে। বুঝলাম সকাল হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির তো কোন বিরাম নেই। কি করব ভেবে পাচ্ছি না। খিদেও পেয়েছে। অবশেষে নিজের শেষ শুকনো সম্বল বার্মুডাটিকে নিয়েই ছুটলাম কিচেন টেন্টে। সেদিনের মতো লাঞ্চ সারা হল গরম খিচুড়ি দিয়ে। মনে হল বৃষ্টি সামান্য যেন ধরেছে। আমার আগে যীশু প্রায় গড়াতে গড়াতে টেন্ট পর্যন্ত পৌঁছাল। দমকা বাতাস আমাকেও ভূপতিত করে দিল ভিজিয়ে আমার শর্টস। অবশেষে চারজন আশ্রয় নিলাম ভালো একটা টেন্টের মধ্যেই। হাসি ঠাট্টা মজা সব করার চেষ্টা করছি--কিন্তু দুশ্চিন্তাটা কেমন যেন অবসন্ন করে তুলেছে। রাতের খাবার একমাত্র চকলেট। কোনোক্রমে ভিজে অবস্থায় তীব্র শীতের মধ্যে গাদাগাদি করে চারজনে রাতটা কাটালাম।

    ১৭ তারিখেও অবস্থার কোন পরিবর্তন দেখলাম না। অবসাদ আর ভয় আমাদেরকে গ্রাস করতে শুরু করল। দিবাস্বপ্নে মন কখনো খুঁজে পাচ্ছে প্রিয়জনের কোল। কিন্তু কোথায় কি! সেই একটানা ভয়ঙ্কর গর্জন। কি করব যখন ভেবে উঠতে পারছি না, তখন গাইড দেব সিং এসে হাজির হল। সে বলল, এখানে কোনভাবেই আজকের রাতটা কাটানো ঠিক হবে না। আমাদেরকে মূল পাথর-নাচুনীর গ্রিন-হাটে পালিয়ে যেতে হবে। এই মহাপ্রলয়ের মধ্যে দিয়ে এতটা পথ কিভাবে যাব ভেবে পাচ্ছি না। বেরিয়ে পড়লাম। কাদাভরা পাহাড়ি ঢাল দিয়ে ছুটতে ছুটতে বুঝতে পারছি না মরে গেছি, কি বেঁচে আছি। তীব্র ঠাণ্ডায় শরীর পাষাণ হয়ে গেছে। গ্রিন-হাটে পৌঁছে তখন এক মর্মান্তিক অবস্থা আমাদের। হাটের মধ্যে কাঠ ছিল। দেব সিং তা দিয়ে আগুন জ্বালানোর পর দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম। রাতের দিকে বৃষ্টি থামল।


    মেঘ বিস্ফোরণের পর ... টেন্ট গোছানোর পালা
    সকালে দেখলাম চারপাশের পাহাড়গুলো থেকে মেঘ সরতে শুরু করেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে গাই গরু খচ্চরের মৃতদেহ। টেন্ট থেকে সমস্ত জিনিস উদ্ধার করে শুরু হল আবার হাঁটা। অনেকগুলো শ্বেতশুভ্র পর্বতকে আজ দেখা যাচ্ছে। বেদিনীকুণ্ড জলে থৈ থৈ করছে। বেদিনীর পর ধরলাম ওয়ান গ্রামের রাস্তা। গড়ৌলি পাতালে সাময়িক বিশ্রাম। তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলা। অনেকটা নেমে এসে দেখলাম নীল গঙ্গার জল তখন ফুঁসছে। পাহাড় ধসে নেমে আসছে জলের ধারা। মাঝে মধ্যেই রাস্তা বলে কিছু নেই। বড় বড় গাছ শুদ্ধু সব ধসে গেছে।

    ওয়ান গ্রামের কাছে স্নেক লিলি
    এসে পৌঁছালাম পাহাড়ি উপত্যকা জুড়ে ছড়ানো ওয়ান গ্রামে। ওয়ান গ্রাম থেকে গাড়িতে লোহাজং যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাস্তা বলে আর কিছু বেঁচে নেই। অধিকাংশ পথটাই ধসের কবলে। ধসপ্রবণ পথ ধরে সে দিন প্রায় ৩৫ কিলোমিটার হেঁটে এসে পৌঁছালাম লোহাজং-এ। লোহাজং বাজারে তখন মানুষের মুখে মুখে ধ্বংসের গল্প। শেষ হল আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত রূপকুণ্ড ট্রেক। এখন ভাবনা শুধু বাড়ি ফেরার। শুনছি ফিরে যাবার সব রাস্তা ধসে গেছে। স্যাক রেখে সবাই ছুটলাম পরিজনদের কাছে নিজেদের কুশল সংবাদ দিতে। একটু নিচে গেলেই নাকি পাওয়া যাবে ফোনের সিগন্যাল!



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments